ভোরের ডায়েরি


"যাচ্ছ কোথায়? কদ্দুর?'

ভোর ভোর বেরবে সে। খুব ভোরে। শেষ রাতেই হবে হয়তো। অন্ধকার। বাতাসে হিমভাব থাকবে তখন। পথ থাকবে জনহীন, তার জুতোর শব্দে ডানা ঝাপটাবে পাখি, একটা পসাম ঝাঁপ দেবে বটলব্রাশের ডাল থেকে, আকাশে থাকবে চাঁদ, তারাগুলি, কখনও মেঘ। গৃহস্থের একটি দুটি জানলায় আলো থাকবে হয়তো; গ্রসারি স্টোরটির বন্ধ দরজার সামনে রাখা থাকবে দ্য অস্ট্রেলিয়ান, সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের বান্ডিল; ছোট স্টেশনটিতে আলো জ্বলবে -- টিকিট ঘরটি বন্ধ থাকবে যদিও। সে এসে দাঁড়াবে নির্জন প্ল্যাটফর্মে আর ভেন্ডিং মেশিনের গোঁ গোঁ শব্দ হবে শুধু। একা হওয়া যাবে না তবু। ক্যামেরার চোখ নজর রাখবে তার ওপর, প্ল্যাটফর্মে নির্দিষ্ট বাটন টিপে ফায়ার ব্রিগেড বা পুলিশের সাহায্য চাইতে পারবে। একলাটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু'হাতের পাতা ঘষবে সে, মোবাইলের ঠান্ডা ধাতব শরীরে হাত দেবে দু'একবার। চেনা কোনও ফুলের গন্ধ আসবে নাকে, নামটা মনে পড়বে না। তারপর একসময় হেলতে দুলতে ফার্স্ট ট্রেনটি এসে দাঁড়াবে -- প্রথম কামরায় বেগুনি জ্যাকেট আর কোঁকড়া চুল ঘুমোবে বসে, বাদামি লেদার জ্যাকেট, বেসবল ক্যাপ ঝিমোবে। রোজ। দ্বিতীয় কামরায় উঠে চারটি স্টেপ টপকে দোতলায় বসবে সে -- সামনের সিটে মোবাইলের বাটন টিপেই চলবেন এক প্রৌঢ়; চিনে ছেলেটি হুড তুলে মাথা ঢেকে ঈষৎ হাঁ করে অঘোরে ঘুমোবে প্রতিদিন। সমস্ত পথে আর কেউ উঠবে না কামরায়। ট্রেনটি হর্ন্সবিতে থামবে এসে। শেষ স্টপে। গার্ড সাহেবের কাজ হবে প্রতিটি কামরায় ঢুকে ঘুমন্ত যাত্রীদের তুলে দেওয়া, হেঁকে বলা উঠে পড়ুন মশাইরা, ট্রেন আর যাবে না।

এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ওভারব্রিজ পেরিয়ে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসবে সে। ইন্টারসিটি আসতে আরও মিনিট পনেরো। প্ল্যাটফর্মের শেডে জলকণা জমবে তখন, ফোঁটা ফোঁটা ঝরবে; রিফ্রেশমেন্টের দোকানটি সবে খুলবে, ভাবলেশহীন মুখে কোকের ক্রেট ট্রলিতে তুলবেন দোকানের মালকিন। একই ট্রেনের অপেক্ষায় থাকবে রূপবান যুবকটি -- বই মুখে। এই সময় গটগটিয়ে হেঁটে আসবেন এক বৃদ্ধ -- হাতে গরম কফির কাপ। হেঁটে আসবেন একদম সরলরেখায়, একচুলও এদিক-ওদিক হবে না। সেই সরলরেখায় অবস্থানরত যে কোনও কিছুকে অবলীলায় ধাক্কা দেবেন বৃদ্ধ। খবরের কাগজ হাতে ওই সরলরেখায় দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে সে।
ইন্টারসিটির সবুজ সিট, পুরোনো কার্পেট। প্রতি মঙ্গলবার সে দেখবে খালি পা মহিলাকে জানলার ধারে। মাথা নিচু করে বসে থাকবেন তিনি। মাথা নিচু, হাত জড়ো। ফাটা গোড়ালি, খালি পা, হলদে নেলপালিশ। হলদে নেলপালিশ!

"মেঘ, বৃষ্টি, রোদ্দুর ...'

ইন্টারসিটি নড়ে উঠবে। আকাশে তখন ভোর ভঁয়ি ভোর ভঁয়ি। শহর ছাড়াতেই নদীটি আসবে। সেই যে নদী, নদী পেরিয়ে বন। আবার জল, আবার জঙ্গল। কখনও বাঁয়ে জল, তো ডাইনে জঙ্গল, কখনও ডাইনে নদী, তো বাঁয়ে টিলা। ঢালু ঘাসজমিতে ঘোড়াগুলি চরবে। নীল জামা, সাদা জামা পরা। বকটি নিবিষ্টমনে ঘোড়াদের দেখবে। নদী পেরিয়ে, জঙ্গল ছাড়িয়ে কাশ ফুলে ভরা মাঠ আসবে -- মাঠভরা অজস্র গাড়ির কঙ্কাল ঘিরে শুধু কাশফুল আর কাশফুল। পুরোনো কারখানা, ছোট-বড় জলাভূমি, দু-তিনটি ক্রিক আসবে তারপরে। বাড়িগুলির খুব কাছ দিয়ে ট্রেন যাবে সেই সময় -- কোথাও ডিশ অ্যান্টেনা, সুইমিং পুল দেখবে সে, কোথাও ছোট ভাঙা সাইকেল ওল্টানো। এইসময় তার ঘুম পাবে। আধোঘুমে, পথটি তার সম্পূর্ণ দেখাবে হবে না কোনওদিন। ছোটবেলার মহালয়া শোনার মতো -- শেষ রাতে, বালিশে মাথা -- বাজলো তোমার আলোক বেণু শুনতে শুনতে অবধারিত পরের গান মিস করা, আবার হয়তো জেগে ওঠা রূপং দেহি-র সময়। পায়ের ওপর পাতলা চাদর টেনে নেওয়া, আলসেমি সামান্য। সেইরকম। সিটে হেলান দিয়ে জানলার দিকে তাকাবে সে, নিজেকে দেখবে -- কপালে ভাঁজ পড়ছে, চোখে ক্লান্তি। চুলের প্রথম রূপোলি রেখাটিতে অবাক হয়ে আঙুল রাখবে সে। ট্রেনটি বাঁক নেবে।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস