বসন্তের উত্তর

শীতের শুরুটা এরকমই। শিরশিরে হাওয়া। পাতা ঝরতে থাকে। শুকনো মরা পাতা। বাদামি, হলদে। হাওয়ায় পাকসাট খায়, তারপর মাটি ছোঁয়। কম্যুনিটি নোটিসবোর্ডে গাঁথা কাগজগুলি হাওয়ায় ওড়ে। লম্বাটে, চৌকোনা, আয়তাকার, লাল, গোলাপি, সবুজ কাগজ। আয়তাকার কাগজখানিতে চোখ যায়। তিব্বতী শ্রমণদের অনুষ্ঠান ঞ্ছমন্ডলাঞ্চ -- নর্থ সিডনি কাউন্সিলের একটি সভাগৃহে। পাঁচদিনের অনুষ্ঠানের প্রথম দিনই উপস্থিত হই। যেতে বেলা হয়ে যায়। ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে "মন্ডলা' নির্মাণ। সুবিশাল সভাগৃহের মাঝখানে বর্গাকার বিশাল একটি নকশার হালকা আভাস, তিনজন ভিক্ষু আসনপিঁড়ি, পাশে পিতলের বেশ কয়েকটি শঙ্কু রাখা, ভিন্ন রঙের সূক্ষ্ম মসৃণ প্রস্তরচূর্ণ ভরা শঙ্কুগুলি ...
তিব্বতী বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী "মন্ডলা' স্বপ্নসম্ভব, অলীক আদর্শ জগৎ সকল জীবের ঠাঁই সেথায় এবং ধ্যানে কেবল ধ্যানেই উপলব্ধি করা যায় "মন্ডলা'। প্রাচিন পুঁথিপত্র মেনে অতি যত্নে তৈরি হয় "মন্ডলা'। দেখলাম, শ্রমণত্রয় আসনপিঁড়ি অবস্থায় সামনে ঝুঁকে ছোট ধাতবদন্ড দিয়ে শঙ্কুর সম্মুখভাগ ঈষৎ ঘর্ষণ করছে, সেই মৃদু ঘর্ষণে সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ ভরে দিচ্ছে নকশার ছোট ছোট অংশগুলি -- লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ... এইভাবেই ধীরে ধীরে "মন্ডলা' নির্মাণ। তারপর এই অসাধারণ আলপনাটি এক নিমেষে পরিষ্কার করে ফেলা হবে -- অনিত্য জীবন বোঝাতে। ভাসিয়ে দেওয়া হবে নদীতে। নদী বহন করবে ওই প্রস্তরচূর্ণ, বালি -- সকল প্রাণীর কাছে বয়ে নিয়ে যাবে শুশ্রুষা, শান্তি, সম্প্রীতি -- ওঁদের বিশ্বাস তাই।

শীতের শুরুতে "মন্ডলা' নির্মাণশেষে ভিক্ষুরা যখন নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন আলপনার অবশেষ, সেই সময়ে শোনা গিয়েছিল "সেক্রেড ফুটস্টেপস ফ্রম দ্য রুফ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' -- অস্ট্রেলিয়ায় এসে পৌঁছেছিলেন দলাই লামা, জন হাওয়ার্ড টালবাহানা করছিলেন শীতের এই বিশিষ্ট অতিথির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে, হাওয়ার্ডকে চাপে রাখতে রোজ হুমকি দিচ্ছিল চিন, চিনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মুক্ত বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হচ্ছিলেন সবাই, আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছিল, ঠিক এই কারণে দলাই লামার বেলজিয়াম সফর বাতিল হওয়ার কথা। অবশেষে চিনের হুমকি উড়িয়ে দিয়ে হাওয়ার্ড দেখা করেছিলেন শীতের অতিথির সঙ্গে। দশদিনের সফর নির্বিঘ্নে শেষ হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ড্যামেজ ক®¾ট্রালের চেষ্টায় নেমেছিলেন হাওয়ার্ড। ততদিনে অলীক ভুবনের অবশেষটুকু ভাসিয়ে নিয়েছিল নদীটি।

এই সময় পেঙ্গুইনটি এসেছিল। শীতের আর এক অতিথি। এসেছিল আড়াই হাজার কিলোমিটার সাঁতার কেটে। কোস্টাল নিউজিল্যান্ড থেকে। খাবারের খোঁজে বেরিয়ে, সিল আর হাঙরের হাত থেকে বাঁচতে দলছুট হয়ে। অর্ধমৃত অবস্থায় পৌঁছেছিল অস্ট্রেলিয়ার সে¾ট্রাল কোস্টে। অত্যন্ত দুÖপ্রাপ্য প্রজাতির পেঙ্গুইনটি -- ফিওর্ডল্যান্ড ক্রেস্টেড। তার এই দু:সাহসিক সমুদ্রযাত্রার পরই জানা গিয়েছিল আর মাত্র ২০০০টি পেঙ্গুইন আছে এই প্রজাতির। টরঙ্গা জুতে আশ্রয় হয় তার -- নাম হয় মিস্টার মুনরো, নিউজিল্যান্ডের তার বাসস্থান মুনরো বিচের নামে। জু'র বিশেষজ্ঞরা চাইছিলেন এখানে একটি মিলন ঘটুক, নতুন প্রাণ আসুক। টরঙ্গা জুতে আমি যখন তাকে দেখতে যাই, সে তখন অনেকটাই সুস্থ; ছোট ছোট ফেয়ারি পেঙ্গুইনদের কর্যকলাপ ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছিল কিঞ্চিৎ অবজ্ঞাভরে। কমলা ঠোঁটটি তার, চোখের ওপর দিয়ে হলদে পালকের বাহার। শেষ বিকেলের সূর্যের আলোর পড়েছিল তার ওপর। সেই ছবি তুলতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছিলাম ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ।

ফুরনো ব্যাটারি, ভিজে ঠান্ডা হাওয়া, সে¾ট্রালকোস্টের সাইক্লোন, খবরের কাগজের হেডলাইন হয়ে প্রিজনভ্যানে মুখ গুঁজে বসে থাকা মানুষটি -- আমাদের শীতকাল এইভাবেই কেটে যেতে থাকে। ফুরিয়েও আসে এক সময়। মরা ডালে পাতার অঙ্কুর দেখি। খবর আসে -- মিস্টার মুনরোর মিলন ঘটেছে সেই ছোট ছোট পেঙ্গুইনদের দুই মহিলা চকি আর মিলফোর্ডের সঙ্গে। ডিম ফুটবে শিগগিরি। এই বসন্তেই। ... শ্রমণত্রয় আসনপিঁড়ি অবস্থায় সামনে ঝুঁকে, ধাতবদন্ড দিয়ে শঙ্কুর সম্মুখভাগ ঈষৎ ঘর্ষণ করবেন, সেই মৃদু ঘর্ষণে সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ ভরে দেবে নকশার ছোট ছোট অংশগুলি -- লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ... এবং নদীটি বয়ে চলবে।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস