চারশো সাতান্ন


 


যদিও এখন শহরে এসে গেছেন জর্জ বুশ, কন্ডোলিজা রাইস কিম্বা হু জিনতাও, শিগ্গিরি এসে পড়বেন শিনজো আবে, স্টিফেন হারপার প্রমুখরা, যদিও এই মুহূর্তে সমস্ত অস্ট্রেলিয়া সিডনির দিকে তাকিয়ে, যদিও এই মুহূর্তে শুরু হ'তে চলেছে এশিয়া প্যাসিফিক ইকনমিক কো-অপরেশন ফোরামের সামিট, যদিও এখন মিডিয়া জুড়ে শুধুই নিরাপত্তার বিবরণ আর নেতাদের মুখ, ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে হলদে কেকের রাস্তা এব ১২৩;ং আমরা যাব শহর থেকে দূরে, সঙ্গে থাকবে সম্পূর্ণ অন্য সংখ্যাত্রয় -৪৫৭।

ব্রিসবেন থেকে প্রায় ঘন্টা সাতেক পশ্চিমদিকে গাড়ী চালালে সাইপ্রেস পাইনের জঙ্গল। সেখানে আরো কয়েকজনের সঙ্গে অন্য দিনের মত পাইনে করাত চালাচ্ছিলেন গুয়াও জিয়ান দ,ং বছর তেত্রিশের মঙ্গোলিয়ান। দুপুরে খাওয়ার পরে অনেকক্ষণ গুয়াও-র করাত চলার আওয়াজ না পেয়ে তাঁকে খুঁজতে যান বাকিরা। গুয়াও তখন শুয়ে আছেন মাটিতে মুখ গুঁজে , তাঁর ওপর একটি মৃত পাইনবৃক্ষ। সঙ্গীরা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে প্রায় একশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তাঁকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে-ততক্ষনে গুয়াও আর নেই। তাঁর স্ত্রী আর সদ্যজাত মেয়েটি সেই মুহূর্তে রাশিয়া চীনের বর্ডারে , মঙ্গোলিয়ার প্রত্যন্ত কোনো অঞ্চলে। স্থানীয় পত্রিকায় ক'দিন পর এই দুর্ঘটনার খবর বেরোয় ছোট্টো করে, খুব কিছু হই চই হয় না। কেই বা চিনতো গুয়াওকে? গতবছরে অস্ট্রেলিয়ায় আসা প্রায় সত্তরহাজার বিদেশী কর্মীর তিনি একজন ছিলেন। প্রায় অদৃশ্যই বলা চলে। ইংরিজি না জানা, পরিবারহীন একাকী, বলতে গেলে সমাজসীমান্তেই দিনযাপন গত দেড় বছর। আশেপাশের মানুষজনের কাছে তিনি 'ও! দ্যাট চাইনিজ গাই', বড়জোর 'গো'।

এন কে কলিন্স অস্ট্রেলিয়ার টিম্বার ইন্ডাস্ট্রির একটি বেশ ভারি নাম। এদের মিলগুলি মূলত: পশ্চিম কুইনসল্যান্ডে। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সংস্থার কাজ, বা ক্যাঙারু শিকার আকর্ষণ করে নিচ্ছে এই অঞ্চলের কর্মীদের এই সময়ে। ফলে এন কে কলিন্সের কাজে দক্ষ কর্মীর অমিল এদেশে। এই সময় যাকে বলে 'কাট প্রাইস গডসেন্ড ' হয়ে আসে ফেডেরাল গভরণমেন্টের ভিসা চারশো সাতান্ন। এই ভিসা অনুযায়ী কলিন্স চিনে কর্মী নিয়োগ করে তাদের অস্ট্রেলিয়ায় আনতে পারবেন চার বছরের জন্য।এই ভিসার অন্যতম একটি শর্ত হ'ল, কর্মীটির যদি এই কাজ পছন্দ না হয় তবে তাঁকে অন্য স্পন্সর তথা অন্য কাজ খুঁজে নিতে হবে আঠাশ দিনের মধ্যে অথবা দেশে ফিরে যেতে হবে। অতএব ধরেই নেওয়া যায় এজেন্টকে গুচ্ছের পয়সা দিয়ে, প্লেনের ভাড়া মিটিয়ে, সর্বোপরি হেল্থ ইনশিওরেন্সের খাঁই মিটিয়ে এই ভিসায় যাঁরা আসবেন কাজ করতে, কাজ পছন্দ না হলেও চট করে কাজ ছাড়বেন না কেউই। এই ভাবেই কোনো এজেন্টের হাত ধরে সুদূর মঙ্গোলিয়া থেকে এতদূর আসেন গুয়াও, জু এবং আরো অনেকে। অস্ট্রেলিয়ায় এসে পৌঁছানোর পরে ওঁদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল অতি অপরিসর জায়গায়, ভাড়া লাগতো না যদিও। গুয়াওরা অবশ্য এই 'ঘর'এ থাকতেন না বললেই চলে-প্রায় সারাদিন তাঁরা শুধু কাঠ কেটেই চলতেন, কেটেই চলতেন। ইংরিজি না জানা, সমাজের মূল স্রোতে মিশতে না পারা, পরিবারহীন মানুষ আর কি করবেন? তাই কাজ শুধুই কাজ।

এখন কুইন্সল্যান্ডে কাঠ কাটতে হ'লে ফরেস্ট প্রডাক্ট ইন্ডাস্ট্রির ইস্যু করা লেভেল থি স্রার্টিফিকেট প্রয়োজন।কলিন্স কম্পানি একজন ট্রেইনার ঠিক করেন গুয়াওদের প্রশিক্ষণের জন্য। ইনি প্রবীণ ট্রেইনার, ট্রেইনিং শেষে সার্টিফিকেটের বন্দোবস্ত ইনি-ই করেন। এই ভদ্রলোক জ্যাক ওয়াটসন। গুআওদের ট্রেইনিং দিতে এসে তিনি তাজ্জব! ভিসা চারশো সাতান্ন অনুযায়ী গুয়াওরা দক্ষ কাঠুরে অথচ ওয়াটসনের মতে 'এঁরা জন্মে পাঁউরুটিও কেটেছেন বলে মনে হয় না।'ওয়াটসনের বিচারে এই কাজে শুধু থেকে যান গুয়াও আর জু, বাকিদের অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ইংরিজি না জানায় ইশারা ইঙ্গিতে আর কিছুটা দোভাষীর সাহায্যে ওয়াটসন কোনোক্রমে তাঁদের ট্রেইনিং দেন। ইশারা ইঙ্গিতে এই ট্রেইনিং কতটা আইনসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।আর গুয়াওরা কতটা শিখেছিলেন এভাবে , এই মৃত্যু সেই প্রশ্নও তুলে আনছে।

মাইনেপত্তরের ব্যাপারে আসা যাক। কলিন্স সংস্থার অন্যান্য কর্মীদের বেতনের হারের সঙ্গে গুয়াওদের বেতনের হারের বিস্তর অমিল লক্ষ্য করা গেছে। এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে মুখ খোলেন নি সংস্থার মালিক। চারশো সাতান্ন অনুযায়ী এঁদের যা প্রাপ্য তা আদৌ দেওয়া হ'ত কিনা এই নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এইটুকুই নয়। আরো আছে। কলিন্সের যে বিজনেস অ্যাসোসিয়েট এই কর্মীদের যোগাড় করেন, তাঁরাই গুয়াওদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ঠিক করে দেন, মাইনে সেই অ্যাকাউন্টে সরাসরি চলে যেতো। মজার কথা হ'ল এই অ্যাকাউন্টগুলিতে এই অ্যাসোসিয়েটদের অ্যাকসেস ছিল। গুয়াওরা হঠাত্ই খেয়াল করেন অ্যাকাউন্টে তাঁদের টাকা কমে যাচ্ছে। মালিককে নালিশও করেন এই নিয়ে। কিছুই করা হয় নি-বলাই বাহুল্য। আর এই দুর্ঘটনার পরে সবাই স্পিকটি নট এ' ব্যাপারে। কলিন্স কম্পানি যদিও জানিয়েছে গুয়াওর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে , তাঁর স্ত্রী যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ এবং সুপার অ্যানুয়েশনের ডেথ বেনেফিট পাবেন। কিন্তু সত্যি সত্যি কত পরিমাণ অর্থ সুদূর মঙ্গোলিয়ায় গুয়াওর স্ত্রীর হাতে পৌঁছবে বা আদৌ পৌঁছবে কিনা -কেউ জানে না।

গাল্ফ অফ কার্পেন্টারিয়ায় এই রকমই একটি মৃত্যু-ফিলিপাইনস থেকে চারশো সাতান্নয় আসা পেড্রোর, সেই কম মাইনে , হাড় ভাঙা খাটুনি, তার সঙ্গে এক্ষেত্রে যোগ হয়েছিল 'বুলি' করা। একইরকম মৃত্যু ম্যানিলা থেকে আসা উইলফ্রেডোর।সেই ভিসা চারশো সাতান্ন, সেই খাটুনি, সেই কম মাইনে।।। সম্প্রতি সিডনি মর্নিং হেরাল্ড প্রকাশ করেছেন ভিসা চারশো সাতান্নর অপব্যবহারের এই ঘটনাগুলি। ফিলিপাইন সরকার সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়াকে এব্যাপারে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ জানিয়েছে। অভিবাসন মন্ত্রী কেভিন অ্যান্ডুজ ভিসার পাশেই দাঁড়িয়েছেন, জানিয়েছেন , কর্মীরা ভিসার যে কোনো অপব্যবহারের অভিযোগ নির্ভয়ে আনতে পারেন। হয়তো সত্যি কথাই। কিন্তু , এই দূরদেশ থেকে আসা , কম ইংরিজি জানা গুয়াও বা পেদ্রোরা এই অধিকার সম্বন্ধে কতটা সচেতন? সরকারি তরফে এঁদের সচেতন করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? সরকারি তরফে অঘোষিত কর্মস্থল তদারকির কোন ব্যবস্থা আছে কি? 'বুমিং ইকনমি'র প্রয়োজন মেটাতে এই ভিসার সাহায্যে যাঁদের আনা হচ্ছে, এই রকম অনিশ্চিত জীবনই কি প্রাপ্য তাঁদের? এশিয়া প্যাসিফিকের এই সামিটের প্রাক্কালে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা জরুরী ।


সেপ্টেম্বর ৯, ২০০৭

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস