সাগর থেকে ফেরা


"কি যেন কি যেন ঠিক
মন দিয়ে জানতে না জানতে,
স্টীমার পৌঁছে যায়
আজ-কাল-পরশুর প্রান্তে।'



সমুদ্র কি আর টানে না তেমন? আজকাল? নীলচে সবুজ, সবজেটে নীল ঢেউগুলি। গাঙচিল, জল ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক। সিন্ধুসারস। বালি আর কাঁকড়া। শুকনো গুল্ম, ভাঙা ঝিনুক। সানসেট, সানরাইজ, রৌদ্রস্নানে আদুল গাত্র নরনারী। ব্যালকনিতে গোল ছোট টেবিল, অ্যাশট্রে আর ভেজা তোয়ালে। বালিমাখা হাওয়াই চটি। আকাশ মেঘহীন। পাবে আর ফিস অ্যান্ড চিপসে উপচানো ভিড়। হলদে চাঁদ।
সিডনির ঘরে বাইরে মেঘলা আকাশ। বৃষ্টি। রোদ্দুর চাই। রোদ্দুর। সমুদ্রকেই মনে পড়ে তখন।



"খুঁজে দেখো, আছে, আছে,
নির্জনে কি কোনও জনতায় ...'

কুইন্সল্যান্ডের গোল্ডকোস্ট। হোটেল, মোটেল আর হলিডে অ্যাপার্টমেন্ট -- নো ভেকেন্সি। স্কুল হলিডেতে ভিড় আর ভিড়। প্রায় ষাট কিলোমিটার তটরেখা বরাবর সারফার্স প্যারাডাইস, ব্রডবিচ, পামবিচ, মারমেইডস বিচ ইত্যাদি নির্জন সৈকতসকল। অথচ ভিড় উপচে পড়ে মুভি ওয়ার্ল্ডে, ওয়েট অ্যান্ড ওয়াইল্ড, সি ওয়ার্ল্ডে কিংবা ওয়ন্ডার ওয়ার্ল্ডে। মুভি ওয়ার্ল্ডে ঘুরে বেড়ায় ব্যাটম্যান, বাগসবানি, টুইটি, স্কুবি ডি। অস্টিন পাওয়ার। ক্যাট উওম্যান। লাস্যে ও হলদে স্পোর্টসকারে মেরলিন মনরো। পোলিস অ্যাকাডেমির লাইভ স্টান্ট শো। ভয়াবহ কিছু রোলার কোস্টার। তবে সব ভিড় টেনে নেয়ে সবুজ দত্যিটি, মিষ্টি বিড়াল আর বকবকম গর্দ্ধভ। শ্রেক, পুস ইন দ্য বুটস, ডংকি লাইভ শো, ফোর ডি -- সবেতেই উপচে পড়া ভিড়। প্যারেডে সবাই হাত মেলাতে চায় শুধু এদেরই সঙ্গে। গথাম সিটি হলটি জনহীন। সুপার হিরোর দিন গিয়াছে বুঝি। দেখেশুনে বিশাল বপু এক বন্ধু তার বিরলকেশ ললাটে হাত বুলিয়ে হেসে বলেন, "আমাদেরও আশা আছে তাহলে?' সবুজ লম্বকর্ণ দত্যি অসম্ভব সরল চোখে চেয়ে থাকে।

হাতের নাগালে জ্যান্ত সমুদ্দুর, অথচ লোকজন হু হু নেমে যাচ্ছে ওয়েট অ্যান্ড ওয়াইল্ডের ওয়েভ পুলে। বিশাল শঙ্কুতে ঘুরপাক খেতে খেতে আছড়ে পড়ছে জলে। ভীষণ প্যাঁচালো টিউব দিয়ে ফ্লাশড অ্যাওয়ে হচ্ছে মহানন্দে। আরও আছে ব্ল্যাক হোল, অ্যাকোয়া রেসার, ম্যামথ ফলস, ক্যালিপসো বিচ, স্পিডকোস্টার -- এইসব।

সমুদ্র কি বড় একঘেয়ে আজকাল? ঢেউ ভাঙে, ফেনা সরে যায়, ভিজে বালি অপেক্ষায় থাকে। ওদিকে জনতা ভিড় করে সি ওয়ার্ল্ডে সিলের কেরামতি আর ডলফিনের খেলায়। স্কাই সাফারি, ওয়াটার স্কি, কর্কস্ক্রু, রোলার কোস্টার, ভাইকিং রিভেঞ্জ রাইড অথবা স্নরকেলিংয়ে। বিষণ্ন মেরুভল্লুকটি মুখ তোলে না।

সমুদ্র আর টানে না তেমন? বোট নিয়ে তাই ভেসে পড়া খাঁড়ির জলে? আনাড়ি হতে স্টিয়ারিং। ভরা জোয়ারে নয়, তরি টলমল বিশাল বোটের পাশ কাটাতেই। তবু এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপ। ক্যাম্পিং। পাহাড়ের কাছে যাওয়া। মাউন্ট টাম্বুরিন -- সিনিক ড্রাইভ -- ওয়াইনারি -- মস্ত সবুজ উপত্যকা। রাতের গোল্ডকোস্টে ফূর্তির অঢেল আয়োজন -- ক্যাসিনো, নারী, পানীয়। গভীর রাতে এগিয়ে আসে ফসফরাসের দাগ -- সাদা। একটানা।



"যত গুমোট মেঘ-সরানো
হৃদয় জুড়ে রোদ-ছড়ানো
সেই তো তোমার অগাধ অপার নীল।'

সমুদ্র আর টানে না তেমন? তবু আটটা পাঁচটা নেই। নেই রাশ আওয়ার ট্রাফিক। ভিজে ঠান্ডা উধাও। নীলকান্তমণি আকাশ। ঝলসানো ত্বক। জুতোয় বালি। পকেটে ঝিনুক। বালিকাটির তুমুল উচ্ছ্বাস। অনেক খুঁজে কেয়াগাছ চিনে নেওয়া। বহুদিন পরে চোখে চোখ রাখার অবসরটুকু। আর বন্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ফুটে থাকা একাকী গন্ধরাজটি। এইটুকুই। হাওয়াবদল।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস