পড়শিনগর

মেয়েটি ছবি আঁকে। ছবি তোলেও। এটুকু জানা ছিল। ক্লেয়র কনরয়। আমার পড়শি। দেখা হয় লন্ড্রিতে। সিঁড়িতে। দেখা হয়। কথা হয় কম। মেয়েটি স্বল্পবাক। আমি মুখচোরা প্রবল। একটু হাসি-কুশল বিনিময় -- আজ গরম বেজায় ... বিকেলে বৃষ্টি নামবে ... এই ফিরলেন বুঝি?

গত শীতের সকালে মস্ত এক ট্রাক এল বাড়ির দোরগোড়ায়। চারদিক বন্ধ বিশাল রেন্টাল ট্রাক। বাড়ি বদলালে লোকজন যেরকম ট্রাক ভাড়া করে সেরকম। ক্লেয়র সেই ট্রাক নিয়ে বেরোয় প্রায়ই। ছবি তুলতে যায়। কোনওদিন সঙ্গীসহ। কখনও একা। গ্রীষ্মে ওর একজিবিশন। এত বড় ট্রাকে কি এত সরঞ্জাম নেয় -- জিগ্যেস করতে ভুলে যাই।

শীত চলে যায়। বসন্তও। ক্লেয়র আমাকে কার্ড দেয় ওর একজিবিশনের -- "লাইট স্পিড -- আ জার্নি অ্যাক্রস সিডনি ইন আ পিনহোল ক্যামেরা।' অবাক লাগে। অ্যাত্ত বড় ট্রাক নিয়ে টই টই, তার সঙ্গে পিনহোল ক্যামেরা -- মেলে না যেন ...

আসে শনিবারের দুপুর। ডে স্ট্রিটে গ্যালারিটি। মোরি গ্যালারি। সাদামাটা ব্যবস্থাপনা। দেওয়ালে ফ্রেমহীন ছবিগুলি। আট ফুট বাই তিন ফুট মোটামুটি। সাদা-কালো। প্রতিটি ছবির সঙ্গে সাউন্ডট্র্যাক। এম পি থ্রিতে। ছবি তোলার এক্সপোজারের সমান সময় সাউন্ড ট্র্যাকেরও।

ছবিগুলি সিডনি শহরের। বা শহর থেকে সামান্য দূরের। যেমন, কুড়ি মিনিট এক্সপোজারের এম টু ট্রান্স -- আরবান টোলগেটের ছবি -- সাউন্ডট্র্যাকে ট্যাক্সি স্টার্ট নিচ্ছে, খুচরো পয়সার আওয়াজ উঠছে টোলগেটে বা পনেরো মিনিট এক্সপোজারের কন্সট্যান্স ক্লোজ ছবিটি -- একটি পরিত্যক্ত কারখানা -- সাউন্ড ট্র্যাকে গেট খোলা-বন্ধ, মেশিনের আওয়াজ গা ছমছমে -- এইরকম, গোরে পয়েন্ট অয়েল টারমিনাল, বেরি আইল্যান্ড রিজার্ভ, লাইটহর্স এক্সচেঞ্জ, সিনক্লেয়ার মোটোরস ... আদ্যন্ত নাগরিক ছবি। চূড়ান্ত ব্যস্ত, ক্লান্ত, নির্জন। বন্ধ গেট, পরিত্যক্ত কারখানা, কাঁটা তারের বেড়া, বজ্রগর্ভ মেঘরাজি ফিরে ফিরে আসে ছবিগুলিতে। নেপিয়ান নদীর ছবিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে উদাসীন ক্লেয়র-বেরি আইল্যান্ড রিজারভেও একটি শূন্য বোট বাঁধা থাকে পাড়ের কাছে -- তিনটি বোট উল্টে রাখা ঘাসজমিতে -- আবছা জঙ্গল -- বিজনতরুমূলে জল ছলছলিয়ে উঠছে ...

গ্যালারির এককোণে ক্লেয়রের পরিকল্পনার ভিডিও বিবরণ ক্লেয়র অঙ্ক কষছে -- পিনহোলের মাপজোক, এক্সপোজার টাইমের হিসেবনিকেশ। ট্রাক ভাড়া করছে। তারপর ট্রাকটিতে ঢুকে শাটার বন্ধ করছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেতরে। সে টর্চ জ্বালায়। ড্রিল করে তৈরি করে সুগোল ছিদ্র। বাকি ফুটোফাটা ব্ল্যাকটেপ দিয়ে ঢাকে ... অর্থাৎ? অর্থাৎ ট্রাকখানি-ই আদতে পিনহোল ক্যামেরা! সকালে-সন্ধ্যায় কতবার ট্রাকটি বাড়ির দোরগোড়ায় -- কল্পনাও করিনি তার পিনহোলনয়নের।

গ্যালারি থেকে বেরিয়ে ঝাঁ ঝাঁ দুপুর। ব্যস্ত শহর একলা ঝলসাচ্ছে। ক্রসিংয়ে সিগনাল সবুজ। কালো, সাদা, লাল, রুপোলি গাড়ি, মোটরবাইক, বিরাট ট্রাক ... বাসা বদলায় কেউ। আর, তার লটবহরের সঙ্গে, বন্ধ শাটারের সুগোল রন্ধ্র বেয়ে কখন ঢুকে পড়ে ফেলে আসা শহর। ট্রাকের ভিতর। কাঁটাতারের বেড়া ... বন্ধ কারখানা ... একলা তরীখান ... এক্সপোজার বদলে বদলে যায়। শাটার পড়ে। নির্মাণ চলে। পড়শির পিনহোল ক্যামেরায়।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস