সেতুপ্রসঙ্গ

দক্ষিণ গোলার্ধের শরৎ-সূচনায় সেতুটি পঞ্চসপ্ততি বৎসরে পদার্পণ করিল। অস্ট্রেলিয়ার নামোল্লেখেই যেমন ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা এবং ক্রিকেট ভাবনায় ভাসিয়া উঠে, তেমনই সিডনি শ্রবণে মনশ্চক্ষে উদিত হয় অপেরা হাউজ এবং হারবার ব্রিজ। এই সেতুটিরই পঁচাত্তর পূর্ণ হইল সম্প্রতি। বিশাল সে সেতু। সম্ভবত পৃথিবীর প্রশস্ততম; অথচ ফেব্রুয়ারি-অন্তে এক সন্ধ্যায়, সেতুটিতে যান চলাচল বস্তুত রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। নীলবর্ণ বাসগুলি বিবিধ বর্ণের ও আকৃতির মোটর গাড়ি সকল, মোবাইক, সাইকেল প্রভৃতি সকল প্রকার যানবাহনের গতি স্তব্ধ হয় সেইদিন। হেতু বিবৃত করি এইক্ষণে।

দুখানি বিশালাকৃতি প্রমোদতরণী সেইদিন সিডনি বন্ধরে নোঙর করিয়াছিল -- কুইন মেরি এবং কুইন এলিজাবেথ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এই প্রথম দুই সুবিপুল বিলাসবহিত্র একত্রে সিডনি আসিল। অতএব জনতা হুজুগে মাতিলেন। প্রভাতে কুইন মেরি যখন বন্দরে আসিতেছিল, নবোদিত সূর্যদেব বহিত্রের বিশাল ছায়াটিকে বন্দরের নিকটস্থ সুউচ্চ হর্ম্যরাজিতে স্থাপন করিলেন। অত:পর পাজামা পরিহিত সদ্য নিদ্রোত্থিত জনতা হর্ম্যের উচ্চতমতলে আরোহণপূর্বক রাজকীয় দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করিয়া যৎপরনাস্তি আনন্দিত হইয়া প্রাত:রাশ ভুলিলেন। কর্মস্থলে পৌঁছিয়া কহিতে লাগিলেন -- "ও: ইট'স হিউজ। ও: ইট'স গর্জাস।' অতপর, মধ্যাহ্নভোজনকালে বিলাসতরণীযুগলের উচ্চতা, আয়তন এবং অবশ্যই উক্ত তরণীদ্বয়ের আরোহীগণের সুবিপুল ধনের পরিমাণের আনুমানিক নিরুপণ চলিল। ফলত, ভোজনান্তে তৃপ্তির উদ্‌গারের সহিত সামান্য দীর্ঘশ্বাস মিশিয়া গেল।

অতপর সন্ধ্যা নামিল। সেই রাত্রিকালেই একটি তরণীর বন্দরের কাল সমাপ্ত হইবে। এতদুপলক্ষ্যে রাত্রি নয় ঘটিকায় আতসবাজির আয়োজন করা হইয়াছে। অতএব, জনতা কর্মক্ষেত্র হইতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া, বেশ পরিবর্তনান্তে পথে নামিলেন। আপন আপন গৃহের দূরত্ব অনুযায়ী, কেহ পদব্রজে অগ্রসর হইলেন, কেহ মোটরযানে রওনা হইলেন, কেহ বা রেলশকটে আরোহণ করিলেন। কাহারও সহিত পরিবার, জল, দুগ্ধ, শিশুখাদ্য। কেহ বিয়ারের বোতল আঁকড়িয়া বন্ধুসমভিব্যহারে যাত্রা করিলেন। আপন আপন বিবেচনামতো সকলেই সংক্ষিপ্ত ও নিরাপদ পথ নির্বাচন করিয়াছিলেন। কিন্তু সকল পথ আসিয়া হারবার ব্রিজে মিলিয়া গেল, ফলত: জনতা গতিরুদ্ধ হইলেন। নয়টা বাজিতে বিলম্ব নাই।। অথচ যানসকল একই স্থলে দণ্ডায়মান। শিশুদিগের কেহ কেহ সজোরে ক্রন্দন শুরু করিল, কেহ সেই অতীব সঙ্কটকালে প্রাকৃতিক বেগ অনুভব করিয়া আপন আপন জনক জননীর অপার বিরক্তিভাজন হইল। যানারোহী সকলেই তারস্বরে হর্ন বাজাইতে শুরু করিলেন এবং পার্শ্ববর্তী যানচালকের প্রতি কভু হতাশ কভু ক্রুদ্ধ লোচন স্থাপন করিতে লাগিলেন। কেবল, মদ্যপসকল শকটের গবাক্ষপথে মুণ্ড নিষ্ক্রমণপূর্বক উল্লাসের ধ্বনিতে যাত্রাপথ মুখর করিতে লাগিলেন। এই বিচিত্র সিম্ফনিতে তরণীদ্বয় যোগ দিল -- তাহারা গুরুগম্ভীর নিনাদে শিঙা ফুঁকিতে লাগিল। পুন: পুন: ভেঁপু নির্ঘোষ শুনিয়া সকলে ললাটে করাঘাতপূর্বক কহিলেন, "জিসাস! অই বোধকরি শুরু হইয়া গেল।' বাস্তবিকই বাজি শুরু হইয়া গিয়াছিল। নয়টা বাজিতেই আকাশে একখানি আলোকবিন্দু উঠিল, এক বিন্দু হইতে বাহির হইয়া আসিল সহস্র বিন্দু আলো -- কখনও তাহা সিংহের কেশরের ন্যয়, কখনও একটি বৃহৎপুষ্পের উড্ডীয়মান স্বর্ণালী পরাগরেণু সদৃশ, কখনও অগ্নিবৃক্ষরূপ। সেতুতে সেইসময় কাহারো কাহারো অবস্থান অনুকূল ছিল -- তাঁহারা বাজি দেখিয়া হৃষ্টচিত্ত হইলেন। বাকি হতভাগ্যসকল সেই স্থলে রুদ্ধগতি যানে আসীন হইয়াই পরিবহনমন্ত্রীর ঊর্দ্ধতন চৌদ্দ গোষ্ঠীর শ্রাদ্ধশান্তি সমাপ্ত করিলেন। রাজ্যের নির্বাচন আসন্ন সেইসময়।

পরদিন সকল সংবাদপত্রের প্রথম পাতাটি দখল করিয়াছিল দুই বহিত্র এবং রুদ্ধগতি সেতুটি। দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত না হইতেই সেতু পুনরায় সংবাদশিরোনামে আসিল। সেদিন, ষোলই মার্চ, তাহার এই পঞ্চসপ্ততি বয়োপ্রাপ্তি উপলক্ষ্যে জনতা পদব্রজে সেতু অতিক্রম করিয়াছিলেন। পুলিশে স্বেচ্ছাসেবকে শহর পূর্ণ ছিল; প্রশাসনের তরফে, সেতুর উপর সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ রাখা হইয়াছিল। বিশেষ ব্যাজে, টুপিতে, টি শার্টে জনতা সাজিয়াছিলেন। ভারতীয়, ফিলিপিনো, পূর্ব ইউরোপিয়ান, ব্রিটিশ, চৈনিক, জাপানি, কোরিয়ান, আফ্রিকান -- কৃষ্ণ, বাদামি, শ্বেত, পীত -- কেহই বাদ পড়েন নাই -- সকলেই হাঁটিয়াছিলেন। এই সম্মিলিত পদচারণার প্রত্যক্ষ বিবরণ লিপিবদ্ধ করিতে প্রবাসী অপারগ। উক্ত দিবসের প্রাক্কালে প্রবাসীর নিকট বঙ্গভূমের একটি অঞ্চলের দুই রাত্রি পূর্বের নরমেধের বিশদ বিবরণ আসিয়াছিল। সে হাঁটে নাই।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস