জন এলিয়টের ইচ্ছামৃত্যু
ইউথ্যানেজিয়া অস্ট্রেলিয়ায় বৈনী। সুইসাইড তা' নয়। আবার, অ্যাসিস্টেড সুইসাইড নিষিদ্ধ এখানে। যদি আপনি অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা হ'ন আর রোগযন্ত্রণা আপনার বেঁচে থাকার সমস্ত ইচ্ছে শেষ করে দেয়, ইউথ্যানেজিয়ার জন্য আপনাকে যেতে হবে সুইজারল্যান্ড।নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, আর ইউ এস-এর ওরেগনে ইউথ্যানেজিয়া আইনী তবে শুধু সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য।সুইজারল্যান্ডের গল্পটা অন্য।ইউথ্যানেজিয়া নিষিদ্ধ সুইজারল্যান্ডেও। কিন্তু আত্মহননে নি:স্বার্থ সহায়তা নিষিদ্ধ নয়। এখানে আছে পঁচিশ বছরের পুরোনো সংস্থা একজিট-শুধুমাত্র সুইসদের জন্য। বছর আট আগে একজিট থেকে বেরিয়ে লুডউইগ মিনেলি শুরু করেন ডিগনিটাস-ইচ্ছামৃত্যুতে আগ্রহী বিদেশীও সেখানে স্বাগত।
২
জানুয়ারির শেষ,দু'হাজার সাত। সিডনি থেকে জুরিখে এসে পৌঁছলেন ডক্টর জন এলিয়ট আর স্ত্রী এঞ্জেলিকা। তাঁদের সঙ্গে এলেন ডক্টর ফিলিপ নিত্শে আর ফিওনা স্টুয়ার্ট। ডক্টর এলিয়ট বৃদ্ধ, দৃশ্যত: অসুস্থ, হুইল চেয়ারে বসে আছেন; এঞ্জেলিকার হাতটি তাঁর হাতে সবসময়।
আসুন, আলাপ করি সবার সঙ্গে।পরে হয়ত আর সময় হবে না-
ডক্টর জন এলিয়ট-
বয়স আশির কাছে। পেশায় ডাক্তার। বছর বাইশ আগে সস্ত্রীক আমেরিকা থেকে সিডনি এসেছিলেন নিছকই বেড়াতে। সিডনি এত ভাল লাগে যে পাকাপাকিভাবে এখানেই থেকে যান। বছর ছয় আগে ধরা পরে তাঁর মাল্টিপল মায়েলোমা বা বোন ম্যারো ক্যান্সার।আনুষঙ্গিক লার্জ প্রস্টেট আর শেগ্রেন'স সিন্ডোম।অসহণীয় যন্ত্রণা-শিরদাঁড়ায় যেন ছুরি চালাছে কেউ।ঘন ঘন বাথরুম, চোখের গ্ল্যান্ড শুকিয়ে গেছে, মুখের ভেতরও খটখটে শুকনো, খেতে কষ্ট হয়।সিডনির সেন্ট ভিনসেন্ট হসপিটালে , এলিয়টের হেমাটোলজিস্ট ডক্টর মিলিকেন বললেন এলিয়টের অসুখের টার্মিনাল ফেজ শুরু হয়েছে।যন্ত্রণা কিছুটা লাঘবের জন্য রেডিওথেরাপি শুরু করা যেতে পারে।
ডক্টর এলিয়ট সিদ্ধান্ত নিলেন ইচ্ছামৃত্যুর। সে'জন্যই এসেছেন জুরিখ। ওয়ান ওয়ে টিকেট।
এঞ্জেলিকা এলিয়ট-
ডক্টর এলিয়টের সঙ্গে চৌত্রিশ বছরের দাম্পত্য। নি:সন্তান। জনের সঙ্গে বয়সের পার্থক্য অনেকখানি-কুড়ি বছর।চাকরি করতেন সিডনির একটি অ্যান্টিক শপে। জনের অসুখ ধরা পড়ার পরে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। জুরিখে আসার কিছুদিন আগে দৃশ্যত: বিধ্বস্ত এঞ্জেলিকা জানিয়েছিলেন,' অল দ্য এভরিডে নাইস থিংস হ্যাভ গন।।।ইট ইজ ডেথ, ইলনেস, ড্রাগস অ্যান্ড সুইসাইড।।। ইট'স আ নাইটমেয়ার। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু হ্যাভ আ নরমাল লাইফ এগেন।'
সঙ্গতকারণেই তাঁর ফেরার টিকেট জুরিখ থেকে প্যারিস হয়ে সিডনি।
ডক্টর ফিলিপ নিত্শে এবং ফিওনা স্টুয়ার্ট-
অস্ট্রেলিয়ার দীর্ঘদিনের ইউথ্যানেজিয়া ক্যাম্পেইনার ডক্টর নিত্শে। একজিট ইন্টারন্যাশনাল-একটি ভলান্টারি ইউথ্যানেজিয়া / অ্যাসিস্টেড সুইসাইড অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা। । অস্ট্রেলিয়ায়, ঊনিশশো পঁচানব্বই নাগাদ নর্দার্ন টেরিটরিতে কিছুদিনের জন্য পাশ হয় 'রাইট টু ডাই'।সঙ্গে সঙ্গেই নিত্শে চার জন মরণাপন্নর মৃত্যু ত্বরাণ্বিত করতে সাহায্য করেন।কে টারমিনালি ইল আর কে তা নয় -এই নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। ফেডেরাল পার্লামেন্টে লেজিসলেশনটি নাকচ হয়। নিষিদ্ধ হয় ডক্টর নিত্শের ইউথ্যানেজিয়া সেল্ফ হেল্প ম্যানুয়াল, 'দ্য পীসফুল পিল হ্যান্ডবুক।' তবু, ডারউইনে বসে নিত্শে আর ফিওনা গত দশ বছরে অন্তত: জনা বারো অসুস্থ মানুষের আত্মহত্যায় সাহায্য করেছেন। এ'যাত্রায় ওঁদের টিকেটের সমস্ত খরচ দিয়েছেন ডক্টর এলিয়ট স্বয়ং। ওঁরা থাকবেন এঞ্জেলিকার সঙ্গে শেষ অবধি। তাই ওঁদের ফেরার টিকেটও ভায়া প্যারিস।
৩
পঁচিশে জানুয়ারি, দু'হাজার সাত।
শরীরের ভার লাঠির ওপর রাখছেন ডক্টর এলিয়ট, অন্য হাতখানি স্ত্রীর হাতে। জুরিখের একটি গ্রাউন্ড ফ্লোর অ্যাপার্টমেন্ট-ডিগনিটাসের পক্ষ থেকে এই দিনটির জন্য নির্দিষ্ট। ডিগনিটাসের পক্ষে উপস্থিত আছেন একজন নার্স আর একজন সোশ্যাল ওয়ার্কার।
সই সাবুদের পালা শেষ। নার্স জলে মেশালেন বার্বিচ্যুরেট সোডিয়াম পেন্টোবার্বিটাল। তার আগে ডক্টর এলিয়টকে খেতে হল বমি নিরোধক ওষুধ। আধঘন্টা টুকটাক গল্প, কনিয়াক পান। নার্স বারবার বললেন ,'য়ু ক্যান অপ্ট আউট অ্যাট এনি টাইম।'
জনের গলা শান্ত -'নো, আই জাস্ট ওয়ান্ট টু গেট গোয়িং। হারি আপ।'
চেয়ারে বসে পান করলেন পেন্টোবার্বিটাল -হাতে ধরা এঞ্জেলিকার হাত-'ইট'স নট বিটার অ্যাট অল'।
এঞ্জেলিকা জড়িয়ে ধরলেন জনকে। জনের মাথা ঝুঁকে এল যেন ঘুমে ঢুলে পড়ছেন। তারপর আর মাত্রই পনের মিনিট।
৪
জন লিখে গেছেন, 'মাই ডিজিজ হ্যাজ ডিকটেটেড দ্যাট আই উইল ডাই সুন। আই উইল ডাই ইন পেইন। ওয়ার্স্ট দ্যান দিস দো, আই উইল হ্যাভ নো ডিগনিটি ইন ডেথ। আই ডু নট ওয়ান্ট মাই ওয়াইফ এঞ্জেলিকা টু সি মি দিস ওয়ে। আই হ্যাভ বীন অ বারডেন অন হার ফর টু লং অলরেডি।।। আই ওয়ান্ট টু একজিট দিস ওয়ার্ল্ড ফ্রী উইথ মাই হেড হেল্ড হাই। ।।।। আই অ্যাম হিয়ার ইন জুরিখ বিকজ ইট ইজ দ্য ওনলি লীগাল অপশন অ্যাভেলেবেল টু মি অ্যাজ অ্যান অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেন।।।। আই অ্যাম শেয়ারিং মাই স্টোরি টু হেল্প আওয়ার পলিটিশিয়ানস আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াই পিপল মাস্ট বি অ্যালাউড কনট্রোল অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটি ইন ডাইং, জাস্ট লাইক দে হ্যাড ইন লিভিং।
মাই লাইফ, মাই চয়েস।'
৫
জনের হেমাটোলজিস্ট মিলিকেন বেশ অসন্তুষ্ট। কেউ তাঁকে যোগাযোগ করে নি। ডিগনিটাসের ডাক্তারদের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বলেও মনে করেন না তিনি।তাঁর চিকিত্সকজীবনে জনের মত রোগী আরো দেখেছেন।টারমিনাল স্টেজে পৌঁছেও রেডিওথেরাপি আরো ছ'মাস কি একবছর আয়ু দিয়েছে তাঁদের। আঙুল উঠছে ডক্টর নিত্শের দিকে। যদিও নিত্শে বারেবারে বলেছেন জনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু জন ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফিয়োনা স্টুয়ার্ট নিজেই বলছেন,' ডিড আই ইন্সাইট দিস ম্যান টু টেক হিজ লাইফ? ডিড আই প্রোভাইড মরাল সাপোর্ট বিইং প্রেজেন্ট?।।।আই হোপ মাই প্রেজেন্স ওয়াজ সাপোরটিভ ইন অ্যাশিওরিং হিম অফ দ্য ডিগনিটি অফ হিজ চয়েস।' সুইজারল্যান্ডেও কথা উঠেছে এই ডেথ টুরিজম নিয়ে। সুইজারল্যান্ডের অপর সংস্থা একজিট বিস্মিত ডিগনিটাসের কাজকর্মের অস্বাভাবিক দ্রুততায়।অস্ট্রেলিয়াতে ইউথ্যানেজিয়া আইনী করার পক্ষে বিপক্ষে লেখালেখি শুরু হয়েছে । এইসব নানা কথা,নানা মত, বিতর্ক তুমুল।
সুইস পাহাড়ের নীচে কোনোখানে পাশাপাশি দুটি সমাধিক্ষেত্র-বহুদিন আগে কেনা-জন আর এঞ্জেলিকার নামে। এই মুহূর্তে, জনের দেহভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সেইখানে।আর আমাদের চোখ আটকে যাচ্ছে ডক্টর এলিয়টের একটি সাক্ষাত্কারে। তাঁকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, 'হাউ মাচ হ্যাজ কনসার্ন ফর এঞ্জেলিকা'জ কোয়ালিটি অফ লাইফ ইনফ্লুয়েন্সড হিজ উইশ টু ডাই।' জন বলেছিলেন,'ও:, আ হেল অফ আ লট। ইফ শি হ্যাজ টু টেক কেয়ার অফ মি ফর অ্যানাদার সিক্স মান্থ্স অর আ ইয়ার শি উইল কিল হারসেল্ফ।শি হ্যাজ ডান সো মাচ ফর মি। আই ডোন'ট নো হাউ শি ডাজ ইট। আয়াম সরি।'
ঠিক এইখানেই যাবতীয় তর্ক বিতর্ক ঢেকে দেয় তুমুল আবেগ; ইউথ্যানেজিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাটি নিখাদ ভালবাসার গল্প হয়ে যায়।
Comments
Post a Comment