অকালবোধন

দেখা হওয়ার সময় হয় নি এখন। কথা ছিল না কোনই। তবু দেখা হ'ল। হঠাৎ। এই সময়।
যখন নীলকন্ঠ পাখিটি ওড়ে নি-শিউলি ফোটে নি-কাশের গোছা দুলছে না কোত্থাও-পদ্মটি নাই- পদ্মটি নাই ...
অস্ট্রেলিয়ান সামার তুঙ্গে,পারা ছুঁয়ে যাচ্ছে চল্লিশ প্রায়-বুশফায়ারে ঝলসাচ্ছে ভিক্টোরিয়া-ঘাম জবজবে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ...
অথচ তিনি এলেন।সিডনিতে।শুধুই সিডনিতে।

প্রস্তুতি ছিল। পরিকল্পনামাফিক।
দু'হাজার ছয়ের অক্টোবরের মাঝামাঝি শুরু হয়েছিল প্রদর্শনী-'গডেস-ডিভাইন এনার্জি'। নিউ সাউথ ওয়েলস আর্ট গ্যালারিতে।ভারত, তিব্বত আর নেপালের শ' দেড়েক ছবি আর ভাস্কর্য্য। কোনটি বৃটিশ মিউজিয়ম, কোনটি সানফ্রানসিস্কো,কোনটি বা ভারতের সংগ্রহশালা থেকে এসেছে এই প্রদর্শনীতে। দশটি কক্ষে সাজানো ছবি আর ভাস্কর্য্য-ভিন্ন শিরোনামে-'আর্লি গডেস', 'রাধা', 'দেবী', কালী', 'পার্বতী', 'তারা','কালী', 'তন্ত্র', 'বুদ্ধিস্ট গডেস' এবং 'বজ্রযান'।
প্রদর্শনীর পাশাপাশি, নাচের আসর-ওড়িশি, ভরতনাট্যম। সেমিনার, ওয়ার্কশপ।আর সিনেমা।থীম-'গডেস'।

এই থীমসরণি বেয়েই তাঁর আবির্ভাবের সূচনা দু'হাজার সাতের ৯-ই জানুয়ারি-'দুর্গা-ক্রিয়েটিং আ গডেস'।
মূর্তি গড়তে কৃষ্ণনগর থেকে এসেছেন নিমাইচন্দ্র পাল মশাই তাঁর আরো দুই সঙ্গীকে নিয়ে।মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছেন ঢাকী ছয়জনা। আর ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রাফট্‌স কাউন্সিলের পক্ষ থেকে উপস্থিত শ্রীমতী রুবি পালচৌধুরী।
একচালা ট্র্যাডিশনাল প্রতিমার মিনিয়েচার ভারশানটি রাখা থাকে একপাশে আর মূল প্রতিমার খড়ের কাঠামো বাঁধা হয়, মাটি পড়ে তাতে,একমেটে, দো'মেটে... ক্রমে আদল গড়ে ওঠে...লাল রঙের গণেশটি... সবুজ অসুর...আর বাদামী সিংহমশাইএর পিঠে চড়ে কি অপরূপ রূপে বাহির হ'লে জননী-
নির্মাণের জাদুতে বিদেশী দর্শককুল হতবাক।
সবিস্ময়ে আর্ট গ্যালারি অপেক্ষায় থাকে ২৬ তারিখের। গ্র্যান্ড ফিনালে। পুজো আর বিসর্জন।

২৬শে অস্ট্রেলিয়া ডের ছুটি।আর্ট গ্যালারি উপচে পড়ে মানুষে-ধুতি, শাড়ী,জীন্স, ট্রাকস্যুট, শর্টস-কে আসে নি একচালাটির সামনে? ষোড়শোপচারে পুজো। ধূপ, ধুনো, ফুলমালা, মঙ্গলারতি, অঞ্জলি-
ঢাকের বাদ্যির তালে শরীর দোলায় বাঙালী আর বিদেশী , মাথা নামিয়ে শান্তিজল নেয়, হাত ভ'রে প্রসাদ।বিসর্জনের সময় হয়ে আসে।

আর্ট গ্যালারির সামনে নিয়ে আসা হয় প্রতিমা -ট্রাকে করে। ঢাকের তালে শুরু হয়ে যায় বিসর্জনের নাচ-রাস্তার উল্টোদিকের ঈষৎ উঁচু ঘাসজমিতে আমরা ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াই।
এই যে অসময়ের পুজো অথচ না-পুজো, এই যে খেলা খেলা বিসর্জন-ঢাকের বোলে মনে আসে না সে'কথা। প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া হাত জোড় করছেন, রুমালে চোখ মুছছেন।আর এই যে আমরা-চোখে চালশে, চুলে পাক-অবশ্যম্ভাবী মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের ছোটবেলা, আমাদের প্রথম যৌবন, মৃত প্রিয়জনসকল-ক্যামেরার লেন্স ঝাপসা দেখাচ্ছে। হয়তো রোদ, হয়তো ধুনুচির ধোঁয়া, হয়তো প্রবাসীর ন্যাকামি কেবল-

আর্ট গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি-ভুবনমনোমোহিনী-ডাকের সাজে,ঢাকের বোলে, ধুনোর গন্ধে।রাস্তার এ'পারে দাঁড়িয়ে আমরা। মুঠিতে পরের প্রজন্মের হাতখানা।
পাশে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ। বিদেশী।শুধোন-'আর ইউ হিন্ডু?'
'ইয়েস আই অ্যাম।' অ্যাম আই? অ্যাম আই?
হিন্দুধর্ম-ছাতার তলায় ছাতা-বড় ছাতা, মেজ ছাতা, ছোটো ছাতা-কেমন করে কোন ছাতার তলায় ঢুকে যাচ্ছি আমাহেন ব্যক্তি-এই সব দার্শনিক কচকচি শুরু হয়ে যায়। অর্থহীন ঠেকে নিজের কানেই।
মাঝের রাস্তাটুকু জুড়ে বিসর্জনের উদ্দাম নাচ চলছে তখন-সেখানে অস্ট্রেলিয়া ডের প্যারেড ফেরত ভীড় করছে মানুষ, হাতে অস্ট্রেলিয়ান ফ্ল্যাগ-বাঙালী, চীনা, বৃটিশ, অস্ট্রেলিয়ান, আফ্রিকান-সাদা, কালো, বাদামী, পীতবর্ণ-মিলেমিশে যাচ্ছে সব-মানুষ, মানুষ, মানুষ শুধু-
আমরা রাস্তায় নেমে আসছি।আলগা হচ্ছে মুঠো। হারিয়ে ফেলছি-খুঁজে পাচ্ছি-হারাচ্ছি আবার-
ঢাকের বোল ঘা দিচ্ছে বুকে....ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন-ভুবনগ্রাম ভুবনগ্রাম ভুবনগ্রাম...



Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস