দৃশ্যাবলী
"বরং রেখা, সমূহে একা.....'
সাদা পাতারা আক্রান্ত নয় বহুদিন। শব্দে শব্দে বিয়া হয় নাই। এই ব্যস্ততা, এই ক্লান্তি, এই দিনযাপন। মনিটরে ধুলোর সর। কী-বোর্ডেও। অক্ষরের পাশে অক্ষর বসে না, শব্দের পরে শব্দ আসে না। কী-বোর্ড হাৎড়ে বেড়াই। লেখার বসত খুঁজি এদিক সেদিক.....
খাঁড়ির জল আর সামান্য জঙ্গল ঘিরে বিকেলের হাঁটা। স্বাস্থ্যচর্চায় ব্যস্ত মানুষের জগিং। শুভেচ্ছা বিনিময়, হাত নাড়া। জ্যাকারান্ডাগুচ্ছে আকাশের বেগুনি হয়ে থাকা। একা একা জলের মুখোমুখি দাঁড়ানো। সেই সব বোটগুলি। পরিত্যক্ত জেটি। ইউক্যালিপটাসের এলোমেলো হাওয়ায় সূর্য ডোবা, স্কাই লাইনে হারবার ব্রিজ। আলো জ্বলে ওঠে শহরের সৌধে, আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একলা ক্রেনটি। জল-মাটি-মানুষের এই আয়োজন। আমার লেখা বসত করে কোনখানে?
দৃশ্য এক
আমার প্রতিদিনের পথটি। সেই ইন্টারসিটি। সেই সব সবজেটে সিট। সেই পুরোনো কালচে কার্পেট। জানলার বাইরে সেই যে নদীটি, সেই জল, জঙ্গল, উপত্যকা এবং ঘোড়াগুলি। কামরার আলো ঘিরে বসন্তের পতঙ্গসমূহ। সহযাত্রীরা কেউ ঘুমে, কেউ বই মুখে, কেউ গান কানে, জানলার বাইরে তাকিয়ে কেউ। সহযাত্রী মহিলাটি আচমকাই বের করেন কুরুশে বোনা একখানি ছোটো ব্যাগ। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে পোকাদের পশ্চাৎধাবন করতে থাকেন কামারার ভেতরে। একটি একটি ধরেন আর ব্যাগে পোরেন। বেশবাস অসম্বৃত হয়ে পড়ে। তবু পোকা ধরেই চলেন, ধরেই চলেন তিনি। হতভম্ব দৃষ্টি আর অবাক প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে দৌড়ে পাশের কামরায় চলে যান। আমি বের করি কাগজ-কলম। একটি শব্দ, দুটি শব্দ....। তারপর ছিঁড়ে ফেলি। আমার লেখা বসত করে কোনখানে?
দৃশ্য দুই
তখনও ভোর হয়নি পুরোপুরি। গাড়িগুলি পার্ক করা। শেষ রাতের শিশিরে ভিজে। জলের ফোঁটা গড়িয়ে নামে ধাতব শরীর বেয়ে। সামান্য আবছা জানলার কাচের ভেতর চোখ চলে যায়। চালকের সিটে পরিণতবয়স্ক ভারিক্কি মানুষটি। স্যুটেড বুটেড। ঘুমোচ্ছেন। মুখে তাঁর বুড়ো আঙুল! চুষছেন! সেকি ঘুমে? সে কি জাগরণে? কি জানি কি জানি! দাঁড়িয়ে দেখি। ষষ্ঠেন্দ্রিয়টি সক্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর। ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে অপ্রস্তুত। হুষ করে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে পলকে হাওয়া। ঝোলাতে হাত ঢোকাই। কলমে হাত ঠেকে। বের করি। আবার ঢুকিয়ে রাখি। আমার লেখা বসত করে কোন খানে?
দৃশ্য তিন
সিডনি নোলানের এক্সিবিশনে গিয়ে এই গল্পটা আবিষ্কার করি। গল্পটা বেহড়-বাগী বন্দুকের আর রং তুলি ক্যানভাসের। গল্পটা অস্ট্রেলিয়ার রবিন হুড সদৃশ নেড কেলি আর বিখ্যাত শিল্পী সিডনি নোলানের। ঊনিশ শতকের আইরিশ কনভিক্ট বাবার ছেলে, দুটি শূয়োর চুরি করে যাঁর অপরাধ জীবনের শুরু, পরবর্তীকালে স্বহস্তনির্মিত বর্ম পরিধান করে পুলিশের সঙ্গে নিয়ত সংঘর্ষে, পুলিশ নিধনে আর ফাঁসির দড়িতে হয়ে উঠবেন অস্ট্রেলিয়ান আইকন, গানে গল্পে মিথে লোকের মুখে ফিরবেন, সেই নেড কেলি একশো বছরেরও বেশি সময়পরে সিডনি নোলানের তুলিতে ফিরে আসবেন সেই স্বহস্ত নির্মির্ত বর্মে, হাতে বন্দুক নিয়ে, ঘোড়ার পিঠে। ডিম্বুলার নিসর্গ, রাঙা ভাঙা চাঁদ কিম্বা গোলাপ বাগিচার তলায় শুয়ে থাকা মেয়েটিকে সরিয়ে রেখে নোলানের তুলিতে ঘুরে ঘুরে আসবে নেড কেলি-পতোন্মুখ ঘোড়ায়। নদীটির বাঁকে বাঁকে, জঙ্গলে পুলিশের মুখোমুখি হয়ে বর্মে, বন্দুকে কিম্বা অশ্বারূঢ়। চল্লিশের দশকে, নোলানের ক্যানভাসকে সম্পুর্ণ অধিকার করবে নেড কেলি। বাগী বন্দুক হয়ে উঠবে রং তুলির অনুপ্রেরণা।
আমার লেখা বসত করে কোন মানুষে? তারেই খুঁজে বেড়াই।
দৃশ্য চার
নিউ সাউথ ওয়েলস আর্ট গ্যালারিতে একটি ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পিতলের, ভিক্ষাপাত্রসদৃশ। থাইল্যান্ডের শিল্পী, বুনমার কাজ। তিনি কর্কটে আক্রান্ত সেইসময়। স্ত্রীও চলে গিয়েছিলেন এই অসুখেই। পাত্রটির সমস্ত অভ্যন্তর জুড়ে শিল্পীর দাঁতের ইম্প্রেশন। সারি সারি দাঁতের পাটি কেবল। কৃষ্ণবর্ণ। পাত্রের কিনারায় হাতের মুঠি। অস্থিসর্বস্ব। তলদেশে একটি ছোটো পানপাত্র। হাঁ করা করোটির আদলে। আমূল কেঁপে যাই। শুনতে পাই স্পষ্ট-এই আমার সমস্ত যন্ত্রনা, এসো। পান করো, পান করো, শুষে নাও। এই যন্ত্রনা। এই মন্থন। এই শিল্প।
এইখানেই কি বসত আমার লেখার? এই যন্ত্রনায়? এই মন্থনে?
শেষ দৃশ্য
প্রবাসী বসে থাকে কী-বোর্ড হাতে। একা একা। লেখার টেবিলে। মধ্যরাতে। সেই সব শব্দাবলীর প্রতীক্ষায়। আর দূরে কোন নির্জনে বকুলশাখায় দোলায় কেউ দোলে। দোদুল দোলে, দোদুল দোলে, দোদুল দোলে। ঝরকে ঝরকে বকুল ঝরে। আকাশে তার আঁচল ওড়ে। কবরী খসে যায়। কেশদামে আবৃত মুখমন্ডলটি তার। প্রবাসী লেখার টেবিল ছেড়ে ওঠে। কী-বোর্ড সরিয়ে রাখে। কম্পিউটার অফ করে দেয়। তারপর বেরিয়ে পড়ে। অদেখা সে মুখটির খোঁজে। টেবিল বাতিটি জ্বলতে থাকে।
সাদা পাতারা আক্রান্ত নয় বহুদিন। শব্দে শব্দে বিয়া হয় নাই। এই ব্যস্ততা, এই ক্লান্তি, এই দিনযাপন। মনিটরে ধুলোর সর। কী-বোর্ডেও। অক্ষরের পাশে অক্ষর বসে না, শব্দের পরে শব্দ আসে না। কী-বোর্ড হাৎড়ে বেড়াই। লেখার বসত খুঁজি এদিক সেদিক.....
খাঁড়ির জল আর সামান্য জঙ্গল ঘিরে বিকেলের হাঁটা। স্বাস্থ্যচর্চায় ব্যস্ত মানুষের জগিং। শুভেচ্ছা বিনিময়, হাত নাড়া। জ্যাকারান্ডাগুচ্ছে আকাশের বেগুনি হয়ে থাকা। একা একা জলের মুখোমুখি দাঁড়ানো। সেই সব বোটগুলি। পরিত্যক্ত জেটি। ইউক্যালিপটাসের এলোমেলো হাওয়ায় সূর্য ডোবা, স্কাই লাইনে হারবার ব্রিজ। আলো জ্বলে ওঠে শহরের সৌধে, আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একলা ক্রেনটি। জল-মাটি-মানুষের এই আয়োজন। আমার লেখা বসত করে কোনখানে?
দৃশ্য এক
আমার প্রতিদিনের পথটি। সেই ইন্টারসিটি। সেই সব সবজেটে সিট। সেই পুরোনো কালচে কার্পেট। জানলার বাইরে সেই যে নদীটি, সেই জল, জঙ্গল, উপত্যকা এবং ঘোড়াগুলি। কামরার আলো ঘিরে বসন্তের পতঙ্গসমূহ। সহযাত্রীরা কেউ ঘুমে, কেউ বই মুখে, কেউ গান কানে, জানলার বাইরে তাকিয়ে কেউ। সহযাত্রী মহিলাটি আচমকাই বের করেন কুরুশে বোনা একখানি ছোটো ব্যাগ। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে পোকাদের পশ্চাৎধাবন করতে থাকেন কামারার ভেতরে। একটি একটি ধরেন আর ব্যাগে পোরেন। বেশবাস অসম্বৃত হয়ে পড়ে। তবু পোকা ধরেই চলেন, ধরেই চলেন তিনি। হতভম্ব দৃষ্টি আর অবাক প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে দৌড়ে পাশের কামরায় চলে যান। আমি বের করি কাগজ-কলম। একটি শব্দ, দুটি শব্দ....। তারপর ছিঁড়ে ফেলি। আমার লেখা বসত করে কোনখানে?
দৃশ্য দুই
তখনও ভোর হয়নি পুরোপুরি। গাড়িগুলি পার্ক করা। শেষ রাতের শিশিরে ভিজে। জলের ফোঁটা গড়িয়ে নামে ধাতব শরীর বেয়ে। সামান্য আবছা জানলার কাচের ভেতর চোখ চলে যায়। চালকের সিটে পরিণতবয়স্ক ভারিক্কি মানুষটি। স্যুটেড বুটেড। ঘুমোচ্ছেন। মুখে তাঁর বুড়ো আঙুল! চুষছেন! সেকি ঘুমে? সে কি জাগরণে? কি জানি কি জানি! দাঁড়িয়ে দেখি। ষষ্ঠেন্দ্রিয়টি সক্রিয় হয়ে ওঠে তাঁর। ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে অপ্রস্তুত। হুষ করে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে পলকে হাওয়া। ঝোলাতে হাত ঢোকাই। কলমে হাত ঠেকে। বের করি। আবার ঢুকিয়ে রাখি। আমার লেখা বসত করে কোন খানে?
দৃশ্য তিন
সিডনি নোলানের এক্সিবিশনে গিয়ে এই গল্পটা আবিষ্কার করি। গল্পটা বেহড়-বাগী বন্দুকের আর রং তুলি ক্যানভাসের। গল্পটা অস্ট্রেলিয়ার রবিন হুড সদৃশ নেড কেলি আর বিখ্যাত শিল্পী সিডনি নোলানের। ঊনিশ শতকের আইরিশ কনভিক্ট বাবার ছেলে, দুটি শূয়োর চুরি করে যাঁর অপরাধ জীবনের শুরু, পরবর্তীকালে স্বহস্তনির্মিত বর্ম পরিধান করে পুলিশের সঙ্গে নিয়ত সংঘর্ষে, পুলিশ নিধনে আর ফাঁসির দড়িতে হয়ে উঠবেন অস্ট্রেলিয়ান আইকন, গানে গল্পে মিথে লোকের মুখে ফিরবেন, সেই নেড কেলি একশো বছরেরও বেশি সময়পরে সিডনি নোলানের তুলিতে ফিরে আসবেন সেই স্বহস্ত নির্মির্ত বর্মে, হাতে বন্দুক নিয়ে, ঘোড়ার পিঠে। ডিম্বুলার নিসর্গ, রাঙা ভাঙা চাঁদ কিম্বা গোলাপ বাগিচার তলায় শুয়ে থাকা মেয়েটিকে সরিয়ে রেখে নোলানের তুলিতে ঘুরে ঘুরে আসবে নেড কেলি-পতোন্মুখ ঘোড়ায়। নদীটির বাঁকে বাঁকে, জঙ্গলে পুলিশের মুখোমুখি হয়ে বর্মে, বন্দুকে কিম্বা অশ্বারূঢ়। চল্লিশের দশকে, নোলানের ক্যানভাসকে সম্পুর্ণ অধিকার করবে নেড কেলি। বাগী বন্দুক হয়ে উঠবে রং তুলির অনুপ্রেরণা।
আমার লেখা বসত করে কোন মানুষে? তারেই খুঁজে বেড়াই।
দৃশ্য চার
নিউ সাউথ ওয়েলস আর্ট গ্যালারিতে একটি ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পিতলের, ভিক্ষাপাত্রসদৃশ। থাইল্যান্ডের শিল্পী, বুনমার কাজ। তিনি কর্কটে আক্রান্ত সেইসময়। স্ত্রীও চলে গিয়েছিলেন এই অসুখেই। পাত্রটির সমস্ত অভ্যন্তর জুড়ে শিল্পীর দাঁতের ইম্প্রেশন। সারি সারি দাঁতের পাটি কেবল। কৃষ্ণবর্ণ। পাত্রের কিনারায় হাতের মুঠি। অস্থিসর্বস্ব। তলদেশে একটি ছোটো পানপাত্র। হাঁ করা করোটির আদলে। আমূল কেঁপে যাই। শুনতে পাই স্পষ্ট-এই আমার সমস্ত যন্ত্রনা, এসো। পান করো, পান করো, শুষে নাও। এই যন্ত্রনা। এই মন্থন। এই শিল্প।
এইখানেই কি বসত আমার লেখার? এই যন্ত্রনায়? এই মন্থনে?
শেষ দৃশ্য
প্রবাসী বসে থাকে কী-বোর্ড হাতে। একা একা। লেখার টেবিলে। মধ্যরাতে। সেই সব শব্দাবলীর প্রতীক্ষায়। আর দূরে কোন নির্জনে বকুলশাখায় দোলায় কেউ দোলে। দোদুল দোলে, দোদুল দোলে, দোদুল দোলে। ঝরকে ঝরকে বকুল ঝরে। আকাশে তার আঁচল ওড়ে। কবরী খসে যায়। কেশদামে আবৃত মুখমন্ডলটি তার। প্রবাসী লেখার টেবিল ছেড়ে ওঠে। কী-বোর্ড সরিয়ে রাখে। কম্পিউটার অফ করে দেয়। তারপর বেরিয়ে পড়ে। অদেখা সে মুখটির খোঁজে। টেবিল বাতিটি জ্বলতে থাকে।
Comments
Post a Comment