বিরাশি ডিগ্রি পূর্ব
জীবনের সর্বাপেক্ষা ভীতির স্থল, বেদনার কারণ সম্ভবত এই যে, সময়কে একটি মুহূর্তে স্থির রাখা কিম্বা ইচ্ছেমতো আগুপিছু করা যায় না। আবার সব থেকে ভরসার জায়গাও এইখানেই। সময়ের সামনে আমরা সবাই সমান। অথবা কানেক্টেড। আজ এই মুহূর্তে আমি যেখানে যেতে চাইছি, লীলা হয়তো অন্য কোনো সময়ে পৌঁছোনোর কথা ভাবছে, আবার তিন্নি, বিল্টুদের চয়েস একেবারেই আলাদা হবে, হওয়াই উচিত। সময়কে থামিয়ে দেওয়ার, এগোনো পিছোনোর ক্ষমতা যদি আমাদের হাতে থাকতো , তাহলে, এই যে হাসপাতালের বারান্দা, টবের গাছ, আলো ছায়া, এই সব সারিবদ্ধ কেদারায় রোগীদের আত্মীয়স্বজন, ডাক্তারবাবু, নার্সদিদি, পিজিটিরা, যেভাবে এক ছাদের নিচে রয়েছি, হয়তো তা ঘটতই না, যে যার মতো সময় বেছে নিয়ে, সেখানেই থেকে যেতাম আমরা। গোটা পৃথিবী যেন এক হাইপারল্যাপ্স ভিডিও হয়ে যেত তখন। মাথা টলটল করে উঠল আমার। এত আপেক্ষিকতার চিন্তা এই মুহূর্তে হ্যান্ডল করতে পারছিলাম না, যদিও সময় এগিয়ে দেওয়ার একটা খেলা খেলতে চাইছিলাম। একা একাই। আসলে, লীলার অসুস্থতা আমাকে তীব্র শোকের জন্য প্রস্তুত করে দিচ্ছিল। লীলা মালা পরে শুয়ে, চার কোণে রজনীগন্ধার ডাঁটি, শববাহী শকটের গতি অনুযায়ী ওর ঘাড়, মাথা নড়ছে, দুলছে - কল্পনা করতে এমনই তীব্র যন্ত্রণা হয় যেন বিশাল এক ক্ষতস্থানের মুখ খুলে গিয়েছে, রক্ত আর পুঁজ বেরোচ্ছে গলগল করে। এবড়োখেবড়ো পিচে বীমারের সামনে হেলমেটহীন নেট প্র্যাকটিশের মতো। যতদিন যায় বুঝতে পারি আরো অনুশীলন আমাকে ম্যাচের জন্য পুরোপুরি তৈরি করে দেবে। দেবেই। যত্রতত্র নেট পাতা যায় না অথচ, লীলার সামনে বিশেষ করে। হয়তো বিছানায় লীলা আধঘুমন্ত বা চোখ বুজে ঝিমিয়ে, ওর সামনে বসে বোজা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন নেট লাগিয়ে শ্যাডো করতে শুরু করেছি আর লীলা ঠিক জেগে উঠেছে সেই সব মুহূর্তে, আমার চোখে চোখ রেখেছে- ওর চোখের শাদা অংশ ঘোলাটে আর হলুদ ; সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নিচু করে নেট থেকে বেরিয়ে পড়েছি আমি, হেলমেট, প্যাড, গার্ড সব পরে নিয়ে আবার লীলার সামনে এসে বসেছি- " জল খাবে লীলা? বেদানার রস করে দিই? "
আজ অনেকদিন পরে গার্ড নিচ্ছিলাম উইকেটের সামনে। ক্লীন বোল্ড হয়ে গেলে হাউজ্যাট বলে চেঁচিয়ে ওঠার যদিও কেউ নেই, আমি জানব উইকেট পড়ে গিয়েছে; মাথা নিচু করে সাজঘরে বসে থাকব কিছুক্ষণ, তারপর আবার গার্ড নেব। ছোটোবেলার মতো দেওয়ালে কাঠকয়লায় আঁকা উইকেট যেন, ক্যাম্বিসের বল হতে হবে ভেজা, আউট হলে কারচুপির যো নেই, ভিজে ছাপ পড়ে গিয়েছে এক কি দুই নম্বর কালো দাগে। এই প্রাচীন হাসপাতালের দেওয়ালে আজ তেমনই ভিজে যাওয়ার দাগ, গাছের পাতারা বৃষ্টির জলে যথার্থ সবুজ আর সিক্ত; লীলার ক্যাবিনের সামনে টানা বারান্দা; সেখানে দাঁড়ালে প্রাচীন ক'টি বৃক্ষ, তার নিচ দিয়ে যে পথ গিয়েছে, সেখানে অগাস্ট দ্রোহের কিছু নাছোড় চিহ্ন; খেয়াল করলে বিশাল এক নয়ন থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে বোঝা যায়; তারই ওপর দিয়ে মানুষের আনাগোণা -আরোগ্যপ্রার্থী, তাঁদের আত্মীয়স্বজন, ডাব আর চা বিক্রেতা, রাস্তার শুকনো অংশে চপ্পলের ভিজে ছোপ লেগেই মিলিয়ে যাচ্ছিল। আসলে কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল নাকি। পাড়ার একটি ছেলে , উবার ড্রাইভার - হাসপাতালে নিয়ে আসে আমাকে; গলির মুখ থেকে গাড়ি বের করতে করতে বলছিল, "হয়তো শেষ রাতে গাড়ি ধুয়েছে কেউ, তাই জল জমে রয়েছে"। পথে আরও জল ছিল, ছেলেটি বলল, "পাইপ ফেটেছে, দাদা।" গাড়ি ধোয়া আর পাইপ ফাটার ব্যাখ্যার একটা প্যাটার্ন তৈরি হচ্ছিল ক্রমে যাতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে কাল রাতে আমরা সবাই গভীর ঘুমিয়েছি, কখন বৃষ্টি হয়েছে জানতে পারি নি কেউই- কেউ মানে, উবারের ছেলেটি, আমি, হয়তো লীলাও। অথবা বৃষ্টিকে অস্বীকার করার চেষ্টা করছিলাম আমরা। যেন বৃষ্টির কথা উঠলেই প্রাচীন অথবা আসন্ন শোকের কথা মনে হবে আমাদের, এই সকালে যা সরিয়ে রাখাই শ্রেয়।
যদিও সে সব সম্ভব হচ্ছিল না। লীলা এখন ঘুমোচ্ছে। "কাল রাতে ছটফট করেছেন খুব। একটু আগে ঘুমোলেন, আপনি না হয় একটু বাইরে অপেক্ষা করুন"- ওর অ্যাটেন্ডেন্টের কথায় মাথা নেড়ে বারান্দার চেয়ারে বসলাম। রোজকার মতো বারান্দার এক কোণে বেসিন, লাল নীল প্লাস্টিক গামলায় রাসায়নিক তরল, নার্স স্টেশনে ফাইল দেখছেন ডাক্তারবাবুরা, সাদা গাউনে নার্স দিদি, দূরের চেয়ারে একটি মেয়ে মাস্ক পরে ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে টাইপ করছে, মাঝে মাঝে বিড়বিড় - রোজই দেখি - এই সময় অন লাইন মীটিং অ্যাটেন্ড করে সম্ভবত। লীলার পাশের ঘরের তরুণীটি আজ নিজে নিজেই হাঁটছে; এক হাত কোমরে রেখে দু' পা সামান্য ছড়িয়ে হাঁটছিল মেয়েটি - এ মাথা ওমাথা, ওমাথা এ মাথা; আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় একটা দুর্গন্ধ নাকে আসছিল- তাকিয়ে দেখি ওর হাতে বর্জ্যের থলি, রং গাঢ় খয়েরী। অথচ তখনও বারান্দা জুড়ে রোদ, টবে রাখা গাছের ছায়া পড়ছে পরপর, একদল পিজিটি স্টেথো ঝুলিয়ে হেঁটে গেল- সে হাঁটায় স্বাস্থ্য আর যৌবন ফুটে বেরোয়, বাইরের গাছে পাখিরা এসে বসছে, আরোগ্যের আশা নিয়ে মানুষজন ঢুকছে বেরোচ্ছে, আজানের আবছা ধ্বনি ভেসে আসছিল - আমি নেট খাটিয়ে শ্যাডো প্রাকটিশ শুরু করেছিলাম; আমার চোখ বন্ধ ছিল, কাচের গাড়ির ভিতরে লীলার ফুলে ঢাকা শরীর দুলে দুলে উঠছিল, আমার কপালে রোদ পড়ছিল, ভারি ট্রলির আওয়াজ, খয়েরি ব্যাগের দুর্গন্ধ আনাগোনা করছিল। এ'সবের মধ্যে নারকেল তেলের বাসের প্রবেশ নিষিদ্ধ, অথচ এক অন্তর্ঘাতের মতো তা ঢুকে পড়েছিল; নারকেল তেল, বোরোলিন, তুহিনা সব মিলিয়ে একটা প্রাচীন বাস- খুব নরম স্বরে আমাকে বলছিল- "নমস্কার, আমি অর্পিতা। আপনার অলক মেঘ পড়েছি।"
আমার চোখের ওপর রোদ তাকে স্পষ্ট দেখতে দিচ্ছিল না প্রথমটায়; উঠে দাঁড়িয়ে অলকমেঘের পাঠিকার মুখোমুখি হ'লাম। মাস্কপরিহিতা যিনি অন লাইন মীটিং করছিলেন , তিনিই। দূর থেকে অল্পবয়সী মনে হয়েছিল, অথচ এই মুহূর্তের দুপুরের রোদ তাঁর দু একটি পাকা চুল, ঠোঁটের ভাঁজ চিহ্নিত করছিল।
- লিখি বটে, সামান্যই লিখেছি। তবে অলক মেঘ আমার লেখা নয়।
" ইশ, কী কাণ্ড! এক্সট্রীমলি সরি। আসলে মা বলেছিল, আপনি লেখক। আমিই ভেবে নিয়েছিলাম অলক মেঘ আপনার। কিছু মনে করবেন না প্লীজ"- মাস্কের ওপর তার দু চোখে ঘন ক্লান্তি।
-বসুন না। রোদ থেকে সরে এইখানে বসুন। আপনার কে ভর্তি ?
- মা। আপনার?
-আমার স্ত্রী। মা কেমন আছেন?
-দুই একদিনের মধ্যেই ছাড়া পাবেন, ডাক্তারবাবু বললেন আজ। অ্যান্টিবায়োটিকের একটা কোর্স চলছে, সেটা শেষ হলেই। বৌদি কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন , বলেছে কিছু?
"ওর তো ক্যান্সার আসলে, একদমই ভালো নেই মানে হয়তো বাড়ি ফেরাই হবে না আর.."- এতবার এই বাক্যটি বলেছি ফোনে, সরাসরি, তবু আমার গলা কেঁপে যায়। রুমাল বের করে মুখ মুছি।
মেয়েটি মাথা নিচু করে -" খুব খারাপ লাগছে শুনে। ভীষণ খারাপ লাগছে। দেখুন, মিরাকল তো ঘটে। হয়তো….. আশা হারাবেন না।"
"আপনি কি সারাদিন থাকেন?"- কথা ঘোরাই।
- না। ভিজিটিং আওয়ারেই আসি। সকালে হাসপাতাল ঘুরে অফিস চলে যাই, আবার বিকেলে আসি।
-খুবই ধকল তো তবে। আমি অবশ্য রিটায়ার্ড।এখানেই বসে থাকি সারাদিন। রাতে ফিরি।
-আর দুপুরের খাওয়া?
-ক্যান্টীনে খেয়ে নিই।
-খুব বাজে খাবার না?
-না তো। দিব্যি খাচ্ছি।
-মা খেতে পারে না এখানকার রান্না। আমিই নিয়ে আসি। কাল আপনার জন্য নিয়ে আসব।
-না না সে কী কথা! একদম এসব করবেন না। ক্যান্টীনেই আমি দিব্যি..
- একদিনই তো। মাকে হয়তো পরশুই ছেড়ে দেবে। তারপর তো আর আসব না এখানে।
আমার অস্বস্তি হয়। মুখ মুছি। রুমাল পকেটে ঢোকাই-" একটু ভেতর থেকে ঘুরে আসি? আপনি কি অফিস যাচ্ছেন এখনই?"
- আর একটু পরে বেরোবো। মা-কে আল্ট্রাসাউন্ড করাতে নিয়ে গেছে, ক্যাবিনে ফিরলে অফিস যাবো।
লীলা এখনও ঘুমোচ্ছে। ওর কপালে হাত রাখলাম। ঈষৎ তপ্ত। পাকা চুলের ফাঁকে ফাঁকে খুলির গড়ণ স্পষ্ট -কেমোতে প্রায় সব চুলই ঝরে গিয়েছে। অ্যাটেন্ডেন্ট মেয়েটি হাই তুলতে গিয়ে থেমে যায়-" দাদা আপনি খেয়ে আসুন । আমি তো আছি।"
- তুমি খাবে কখন?
- আমি অনেক বেলায় খাই, এক ফাঁকে খেয়ে নেব ঠিক।
অর্পিতা মোবাইল নাড়াচাড়া করছিল বারান্দায়- "মা র ফিরতে দেরি হবে, মেশিন নাকি ডাউন ছিল দু ঘন্টা, এমনিতেই আল্ট্রাসাউন্ডে আজ ভীষণ ভীড়। ঢোকার সময় খেয়াল করেন নি?"
-আপনার তো অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে তাহলে-
- পরে যাব। এখানে বসে বসেই তো কাজ করছি সকাল থেকে। আপনি ক্যান্টীনে যাচ্ছেন? চলুন, আজ ওখানেই খাই।
অন্য কোনো সময় হলে এড়িয়ে যেতাম। কিন্তু হাসপাতালের ব্যাপারটাই অন্যরকম। এ' চত্বরে, রোগীর পরিজনদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়- হয়তো ক্ষণিকের, হয়তো একদিনের কিম্বা সাত দিনের। নিত্যদিনের সংসারে কথা শোনার লোক থাকে না, অথচ এইখানে বারান্দায়, গাছের নিচে চেয়ার পেতে, শতরঞ্জি বিছিয়ে সারি সারি শ্রোতারা; সকলের অবস্থান সময়ের একই তলে, যা কেবলই ঘটমান বর্তমান। যদিও একলা থাকার প্রয়োজন ছিল, একা একা অনুশীলনের দরকার, অথচ আমার নিজেরই একটা অংশ অর্পিতার সঙ্গে সময়ের একই তলে অবস্থান করতে চাইছিল। ক্যান্টীনে ভাত মাখতে মাখতে অনর্গল কথা বলছিল সে- "এত ভালো মাছের ঝোল তো খাই নি কোনোদিন। রেসিপিটা যোগাড় করতে হবে। মা কেন যে বলল এখানকার রান্না খারাপ। আপনি শিওর, একই রান্না ওখানে যায়? আচ্ছা প্যাক করে নিতে চাইলে, দেবে? আপনি নিয়েছেন কোনোদিন?"
-বলুন, বাক্সে দিয়ে দেবে। রাতে খাওয়ার জন্য নেবেন?
-হ্যাঁ, ছেলের জন্য। খুব মাছ ভালোবাসে। আমার মতো। ভাগ্যিস , ছেলের কথা উঠলো। ভুলেই গিয়েছিলাম, ওর প্রজেক্টের কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে। কাছাকাছি কোথায় পাই বলুন তো। চার্ট পেপার, ফেল্ট পেন এই সব আর কি-
- এখান থেকে বেরিয়ে দুটো গলি পরেই বড় দোকান। আমিও যাবো চলুন। একটা ক্লিপবোর্ড আর কাগজ কিনব। লীলা বাড়ি এলে, টেম্পারেচর, ব্লাড প্রেশারের রেকর্ড রাখতে হবে...
প্রাচীন হাসপাতালের সামনে দুপুরের কলকাতা তখন আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। ট্রাফিক পুলিশ, লাল, হলুদ সবুজ বাতি পেরিয়ে একপাল গাড়ি বাঁদিকে বেঁকছে, দুটো খালি বাস ঢিমে তালে চিড়িয়াখানার দিকে গেল, ডাইনের আকাশে ভিক্টোরিয়ার পরীর শিল্যুয়েট, তারই সামনে সার সার ঘোড়ার গাড়ি; কিংখাবের সাজ পরা শান্ত ঘোড়ারা, রুগ্ন কোচোয়ান ময়দানের বাতাসে ঘাম শুকোয়, সেলফি তোলে তরুণ তরুণী -তাদের হাসিমুখ আটকে থাকে এই মুহূর্তের ফ্রেমে তারপর ডিজলভ করে, এই শহরের অংশ হয়ে যেতে থাকে ক্রমশ।
বড় রাস্তা পেরিয়ে আমরা দোকানে ঢুকেছিলাম। কেনাকাটার মধ্যেই অর্পিতা মোবাইলে কথা বলছিল নাগাড়ে। ফোন বন্ধ করে ঘাড় ঘোরালো-" মা কে ক্যাবিনে ফেরত এনেছে। কিন্তু এখন আর আমাকে ঢুকতে দেবেনা, সারাদিনের পাস তো নয় আমার। এখন অফিসে গিয়ে আবার ভিজিটিং আওয়ারে আসব কী করে? আপনি হাসপাতালে ফিরবেন?
- দেখি। এক এক দিন বাইরে কোথাও বসে থাকি, চা খাই, আবার বিকেলে ঢুকি। নয়তো সামনের বারান্দায় বসে ঝিমাই। আপনি তাহলে কী করবেন এতটা সময়?
অর্পিতা মোবাইল নাড়াচাড়া করে, একটু সময় নিয়ে উত্তর দেয়, "ছেলের বন্ধুর জন্মদিন সামনে। দেখি যদি গিফ্ট কিনতে পারি। আচ্ছা, আপনিও উপহার কিনুন না বৌদির জন্য। দারুণ একটা সারপ্রাইজ হবে। বৌদি ভীষণ খুশি হবেন। কিনবেন?"
কতদিন পরে গিফ্ট, সারপ্রাইজ, খুশি শব্দরা পাশাপাশি। সব শব্দের গা থেকে এতদিনের স্যাঁতলা কেউ যেন ঘষে ঘষে তুলে দিয়েছে- ঝকঝক করছে প্রতিটি অক্ষর -কোথাও মালিন্য নেই, দীনতা নেই কোনো, মুখ লুকিয়ে থাকা নেই। যেন হঠাৎ একটা হাওয়া উঠেছে কোথাও। যেন ভূমধ্যসাগর থেকে ঝোড়ো বাতাস ছুটে এলো, ঝিমন্ত কোচোয়ান সব জেগে উঠে জিন চাপালো ঘোড়ায়, শত শত অশ্বখুর খটাখট শব্দ তুলল রাস্তায় রাস্তায়, যেন এ শহরের সব ওষুধের দোকানের সাইনবোর্ড মুছে গিয়ে লেখা হয়ে গেল- এখানে গোলাপ বিক্রয় হয়।
- ফুল কিনলে হয়। হাসপাতালে আর কী বা নেওয়া যায়?
- ফুল দেবেন? অন্য কিছু দিন না। একদম স্পেশাল কিছু। হয়তো বৌদি চেয়েছেন, আপনার দেওয়া হয় নি। ছোটো কিছু জিনিসই। হয়তো ব্যস্ততার জন্য কেনা হয় নি। তারপর ভুলে গেছেন। হয় না এরকম?
আমি মোবাইল বের করে সময় হিসাব করি- "শ্যামবাজারের দিকে যেতে কত সময় লাগবে? ভিজিটিং আওয়ার শুরু হওয়ার মধ্যে ফিরতে পারব?"
- মেট্রোতে আর কতক্ষণ লাগবে! ফাঁকাও থাকবে এই সময়। যাবেন?
- আসলে একটা ঠিকানায় যদি যেতে পারতাম এর মধ্যে..
- বৌদির গিফ্ট কিনবেন না?
- ঐটাই গিফ্ট। একটা ঠিকানা। লীলা ইদানিং যেতে চাইছিল খুব। ওর বাল্যবন্ধু। এখনও ওখানেই আছে কী না তাও জানি না। আপনার কষ্ট হবে , আবার অদ্দুর যাবেন, হয়তো কাজের কাজ কিছুই হবে না-
- কিছু অসুবিধে হবে না। ভালই লাগবে বরং। আচ্ছা বৌদির বন্ধুর ফোন নম্বর? ফেসবুক? কিছু নেই?
"না। " আমি চুপ করে গেলাম। ঝোঁকের মাথায় শ্যামবাজারের দিকে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে কী না বুঝতে পারছিনা এখনও।
মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে পাঁচমাথার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, "বাড়ির নম্বর তো মনে নেই তবে গলিটা দেখলে চিনতে পারব ঠিক।"
- সে বাড়িতে কি আমরা ঢুকব? বন্ধুকে পাকড়াও করে বৌদির কাছে নিয়ে যাব তারপর? বাড়িটা ঠিক চিনতে পারবেন তো?
- গলিটা যেখানে শেষ হয়, সেখানে ঠিক দুটো বাড়ি, তার মধ্যে একটা বাড়ি। ঠিক কোন্টা জানি না।
-কোনোদিন ভিতরে যান নি আপনি?
আমি চুপ করে থাকি। লীলার আসন্ন পরিণতির ব্যাকড্রপে এই নীরবতা নিজেরই অসহনীয় ঠেকে। এতদূর যখন এসেই পড়েছি অপরিচিত এই মেয়েটির সঙ্গে, সব কথা বলতে তো হবেই। সময়কে পিছিয়ে নিতে হবে শুধু। আজকের এই দুপুর আর পুরোনো সেই সব বিকেলগুলোর মধ্যে সময়ের যে ব্যবধান তাকে এই মুহূর্তে আমার অলঙ্ঘনীয় প্রাচীরের মতো লাগছিল। নদীতে ডুব দেওয়ার আগে দুহাত দিয়ে জল সরানোর মত সময়কে সরাচ্ছিলাম, কী প্রচণ্ড ভারি যে সেই জল, অথচ স্থাবর তো নয় - " আমি আসলে লীলার বন্ধুকে ফলো করতাম। কোনোদিন একা থাকত, কোনোদিন লীলার সঙ্গে। গলির মুখ অবধি এসে লুকিয়ে পড়তাম, গলির শেষে ঠিক কোন বাড়িতে যে সে ঢুকত , দেখা হয় নি কোনোদিন।"
- ফলো করতেন?
- লীলার সঙ্গে তখনও আমার বিয়ে হয়নি। লীলা বলেছিল ওর বন্ধুর কথা। সমর। ছাত্র রাজনীতি করত। সেটা সাতের দশক। খুব সাঙ্ঘাতিক সময়। লীলা সমরকে নানাভাবে সাহায্য করত। কিন্তু আমি ... আমার মনে সন্দেহ ছিল। ফলো করতাম।
-তারপর?
- আমাদের বিয়ের আগেই একদিন নিখোঁজ হয়ে গেল সমর। লীলার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রইল না। সংসার, সন্তান এই সব করে যা হয় আর কি, সমরের খোঁজখবর করি নি আমরা। লীলার অসুখটা ধরা পড়ার পর থেকেই ও সমরের কথা আবার বলতে শুরু করে। অনেকদিন বলেছে, সমরের খোঁজ নিতে। যদি এ'বাড়িতে নাও থাকে বাড়ির কেউ না কেউ কিম্বা পাড়ার লোক খোঁজ দিতে পারবে। আসা হয় নি। ইচ্ছে করেই আসি নি। পুরোনো সব ক্ষত আবার খুঁচিয়ে তোলা...
-ক্ষত কেন বলছেন?
"আসলে, মানুষের মন তো... আমাদের মন বড় জটিল, জানেন-" রুমাল বের করি পকেট থেকে।
অর্পিতা চুপ করে গেল প্রথমে তারপর ভরদুপুরে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঠা ঠা করে হাসতে লাগল। এই সব হাসি গুপী গায়েনের গানের মত, সব থমকে যায়, গোটা পৃথিবী যেন আহ্নিক গতি পলকের জন্য থামিয়ে ঘুরে তাকায়। আজ এই মুহূর্তে অর্পিতার হাসি দেখছিল পথচারী, দোকানদার, কাক, চিল, চড়াই, নেতাজীর ঘোড়া, নেতাজী, ল্যাম্পপোস্ট, কিছু উড়ো মেঘ আর দমদমের দিকে নাক নিচু করা এরোপ্লেন। হাসি থামিয়ে সে আচমকা বলে-" আমার জন্মদাত্রী আমার আড়াই বছর বয়সে মারা গিয়েছেন; কাকা কাকিমার কাছে বড় হয়েছি"; তারপর দম নেয়। অর্পিতার কথা আমার ভয়ংকর রকম প্রেক্ষিতবিহীন মনে হতে থাকে, ভয় করে ওঠে - "হাসপাতালে তার মানে আপনার কাকিমা ভর্তি?"
অর্পিতা মাথা নাড়ে দুদিকে-"হাসপাতালে যিনি ভর্তি, রক্তের সম্পর্কে কেউ নন, সামাজিক সম্পর্কও নেই কিছু। চাকরি করতে এসে আলাপ। অফিস কোলীগ, সিনিয়র। একজন মা র থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান যা পায়, ইনি আমাকে তার থেকে অনেক বেশি দিয়েছেন, কখনো শৈশবের অনেক অভাবও ভরে দিয়েছেন। আমি ওঁকেই মা বলি। দেখুন, আমার জন্মদাত্রীর যে সময়টা আমার মা হয়ে থাকার কথা ছিল, তিনি তো সেই সময়কালে প্রবেশই করতে পারেন নি, তাহলে সেই সময়কে এখন ঢুকতে দেব কেন বলুন তো?
প্রাসঙ্গিকতা আবছা বুঝতে পারি এবারে। হাল্কা তর্কের ইচ্ছা হয়- "অতীতকে আটকাবেন কী ভাবে? সে কি সম্ভব? সেও তো জীবনেরই অঙ্গ, সেও তো সত্যি।"
- আমি তা মানি না। দেখুন, একটা সময় ছিল, যখন বৌদি আর সমরবাবুর সম্পর্ক হলেও হতে পারত, তা তো ঘটে নি। আমার জন্মদাত্রীর মতই সমরবাবু ফ্রেম থেকে উধাও, রইলেন শুধু আপনি আর বৌদি- এক ফ্রেমে পাশাপাশি, তাহলে একটা শূন্য সময় এখানে কেমন করে ঢোকে আমি তো বুঝি না।
- শূন্য সময় মানে ঠিক কী? আসলে এভাবে ভাবাটা কঠিন তো-
-আমার তো ধারণা ছিল আপনি জানেন, অলক মেঘে তো এ সবই লেখা ছিল-
- অলক মেঘ আমি লিখি নি, বললাম যে-
-ও হ্যাঁ, বললেন তো তখন। আসলে একটা কাল্পনিক রেখা ভেবে নিতে হবে। ভৌগোলিক নয়, একটা সময়ের রেখা, যার ও'দিকে অতীত, এই দিকে বর্তমান। অতীতের মধ্য দিয়ে আবার কাল্পনিক রেখা টানুন। একটা শূন্য সময় পাবেন, তাকে আলাদা করে রাখুন। এই তো ব্যাস।
আমার মনে হচ্ছিল, অর্পিতা স্কুলে ভূগোলের ক্লাস নিচ্ছে, অক্ষাংশ , দ্রাঘিমাংশ বোঝাচ্ছে তারপর এইটিটু ডিগ্রি ঈস্ট এর কথা বলছে; জীবন কি এত সহজ!
-শূন্য সময় বলে কিছু হয়?
- সবই নির্ভর করছে একটা সময়কে আপনি কী ভাবে মনে রাখছেন, পরবর্তীকালে ব্যবহার করছেন- অলক মেঘে ছিল তো-
-কিন্তু আমি তো অলক মেঘ পড়ি নি। আপনি বলুন না।
অর্পিতা আকাশের দিকে আঙুল তুলল- "দেখুন। টিপিকাল শেষ দুপুরের আকাশ। একটা অন্য আকাশ দেখেছিলাম এই পাঁচ মাথার মোড়েই। পুজোর ঠিক পরে। কার্নিভাল সে দিন। ছবিটা ভাইরাল হয়েছিল। নেতাজীর মূর্তির পিছনে লাল আকাশ। অদ্ভুত লাল জানেন? যেন আগুন লেগেছে। যেন লাল রঙে মোটা ব্রাশ ডুবিয়ে আকাশের সমস্তটুকু ঢেকে দিচ্ছে কেউ। যেন এতটুকু নীল না থাকে কোথাও-"
- দেখেছি ছবিটা। মনেও আছে। লীলার কেমো চলছিল সেই সময়-
-আমি এসেছিলাম এখানে সেদিন। ঐ সময় প্রায় রোজই যেতাম কোনো মিছিলে। গান গেয়েছি, হেঁটেছি। রাস্তায় আঁকতাম। কেঁদেওছিলাম খুব। এখন আকাশ দেখুন। রাস্তা দেখুন। সেদিনের কোনো চিহ্ন আছে ? কোথাও?
-হাসপাতালের সামনের রাস্তায় কিন্তু এখনও কিছু আঁকা রয়ে গেছে.. দেখছিলাম-
-ঐটাই বলছি। ভাবতে গেলে ঐ সময়টা হয়তো এখন শূন্য সময় অনেকের কাছে। আবার আমার কাছে নয়। অর্পিতা হাতের পাতার উল্টো দিক দিয়ে চোখ মোছে, নাক টানে-" চলুন তবে। সমরবাবুর খোঁজে যাই। কতক্ষণ এখান থেকে? আবার তো ফিরতে হবে। ভিজিটিং আওয়ারের সময় হয়ে আসছে।"
- মিনিট সাতেক বড়জোর। চলুন।
- এই সময়টুকু একটা খেলা খেলবেন? অলক মেঘে আছে না…..
- কী খেলা?
-বাজি ধরার মতো। আপনি বলবেন, সমরবাবুকে আমরা পাবো কী না। আমিও বলব। তারপর কারটা মেলে দেখি.. সিরিয়াস কিছু নয়, টাইমপাস আর কি- খেলবেন?
-মন্দ কি। খেলা যাক। আমি বলি। সমরকে পাবো না। সে সম্ভবত আর নেই।
-কেন এ কথা মনে হচ্ছে আপনার?
-খেলার নিয়মে ব্যাখ্যা করার কথা তো বলেন নি আপনি-
-আচ্ছা থাক। সে সব কথা বরং খেলার শেষে হবে। হারজিতের পরে।
-আপনার কী মনে হয়? সমরকে পাবো?
- আমার তো মনে হয় পাবেন। কিন্তু..
-কিন্তু কী?
-খেলার শেষে বলব। আসলে, অলক মেঘে এরকম একটা সিচুয়েশন ছিল-
-অর্পিতা, এসে গেছি। এই গলিটা। গলির শেষে ঐ যে দুটো হলুদ বাড়ি। তার কোনো একটায়..
"কোন বাড়িতে আগে যাবেন? দাঁড়ান টস করি। হেড পড়লে বাঁদিকেরটা প্রথম।" পার্স খুলে কয়েন বের করে হাতের পাতায় টস করে সে -"হেড। যান এবারে।"
- আপনি যাবেন না?
-একটা কল নেওয়ার আছে। এই রোয়াকে বসে মীটিংটা সেরে নি। আপনি ঘুরে আসুন।
নির্জন গলিতে একটি রিক্শা, দুটি স্কুটার - আরোহীবিহীন, ফলত স্থবির। বাদামী সাদা ছোপ ছোপ কুকুর দৌড়ে এসে পেরিয়ে গেল আমাদের। দুপুরের রোদ পড়ে আসছিল। পরিচ্ছন্ন পথ। গায়ে গায়ে বাড়ি, রোয়াকের লালচে মেঝে। অর্পিতাকে ল্যাপটপ বের করে বসতে দেখলাম।
হলুদ বাড়ির দরজা জানলা সবুজ রঙের। বেল বাজিয়ে পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে হল। একটি কিশোর দরজার পাল্লা ফাঁক করেছিল।
-সমরবাবুর বাড়ি? উনি আছেন?
সে মাথা নাড়ে - "আসুন"।
একতলার একটি ঘরের পর্দা সরিয়ে বসতে বলে সোফায়। পাখা খুলে দেয়- "দাদা আসবেন এক্ষুণি। আপনাকে বসতে বলেছেন।"
-আমাকে ? আমি আসব সমর জানবে কী ভাবে?
-আপনি প্রোমোটারের লোক তো?
-না না । ওসব নয়। অন্য কারণে।
ছেলেটি সামান্য ঘাবড়ে যায়, তারপরেই স্বস্তির শ্বাস ফেলে -"ঐ তো দাদা এসে গেছেন। "
আমার হৃদপিণ্ড ধক ধক করতে থাকে যেন বুকের খাঁচা থেকে ছিটকে বেরোবে এক্ষুণি। এত বছর পরে সমরের মুখোমুখি হব। আমি কি প্রস্তুত? কী বলব সমরকে?
পর্দা সরায় হেলমেট পরিহিত এক দীর্ঘদেহী - জীন্স, লাল টী শার্ট, দুহাতের আঙুলে আঙুলে লাল, হলুদ, নীল, সবুজ পাথর বসানো আংটি সব। তর্জনীতে চাবির রিং দ্রুতগতিতে ঘুরছিল। হেলমেট খুললে সমরকে শেষ যেমন দেখেছিলাম, সেই রকমই বয়স, চাপ দাড়ি, ঝাঁকড়া চুল- " আপনি আমাকে খুঁজছেন? কী ব্যাপার বলুন তো?"
"ভুল হয়ে গেছে আসলে। মানে ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়েছি। সরি। ভেরি সরি। "- হতভম্ব লাল টী শার্টের পাশ কাটিয়ে দ্রুত বেরই। এক দমে গলির সামনের রোয়াকে থামি।
অর্পিতা হেডফোন নামায়, ল্যাপটপের প্যাডে আঙুল চালায়। সম্ভবত মিউট করে নিজেকে। গলা খাঁকরে বলে, "পেলেন না?"
- না। একই নাম কিন্তু অন্য লোক।
-দুটো বাড়িতেই?
-ডানদিকের বাড়িতে তো আর ঢুকিই নি।
-কেন?
- একই নামের লোক পাশের বাড়িতে থাকলে বলত না?
- তা ঠিক। কিন্তু আপনি কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন আগে এ বাড়িতে কারা থাকতেন বা গলিতে এই নামের কেউ আছেন কী না।
- কেমন ভয় পেয়ে গেলাম, জানেন? মনে হল, সমরকে পেলেও, ফেস করতে পারব না।
- কেন?
কপাল, নাক, ঠোঁট রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছতে থাকি এমন যেন অর্পিতার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে আমার সমস্ত মুখমণ্ডল। গলা খাঁকরে ঢোঁক গিলি তারপর- "লীলা জানে না একথা। কাউকে বলি নি কখনও। আসলে, সমরকে আমিই পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। লোকাল থানায় যোগাযোগ করে ... সমর পরে জানতে পেরেছিল কী না বলতে পারব না। বোঝার মতো সময় পেয়েছিল কী না তাও জানি না।
- মানে সমরবাবু নেই? আপনি জানেন?
-জানি না। তবে আশঙ্কা করি। এনকাউন্টার করে অনেককেই তো তখন…..
অর্পিতা কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ-" আমি বলি কি, অন্য বাড়িটা ঘুরে আসুন। আরো দু একটা বাড়িতেও জিজ্ঞাসা করুন। "
-কী লাভ?
-আগে যাই ঘটে থাক, আজ তো বৌদিকে গিফ্ট দেবেন বলেই এত দূর এসেছেন। আপনার মনে কোথাও তো আশা ছিলই, সমরবাবুকে পেয়ে যাবেন, নইলে আর আসবেন কেন এতদূর? দেখুন, খোঁজ করে। যা জানতে পারবেন, তাই বলবেন বৌদিকে। আপনি যে এসেছিলেন এখানে, খোঁজ করেছেন, সেটুকু বৌদি জানুন অন্তত।
রোয়াকে বসে পড়েছিলাম। ঘাম হচ্ছিল। বিকেল হতে বেশি দেরি নেই আর। হাওয়ার তাপমাত্রা কমছে, পায়ের কাছে জমিয়ে রাখা ছায়া লম্বা হয়ে সামনের ফুটপাথ ছুঁয়ে ফেলছে। অর্পিতা হেডফোন, মোবাইল , ল্যাপটপ ব্যাগে ঢোকায়- " আসি তবে? ছেলের বন্ধুর গিফ্ট কিনে হাসপাতালে ঢুকব। আপনি মেট্রোয় না গিয়ে বরং উবার ডেকে নেবেন।"
- আপনি চলুন না আমার সঙ্গে। সাহস পেতাম কিছুটা।
- দেখুন সমরবাবুর আর খোঁজ করবেন কী না সম্পূর্ণ আপনার সিদ্ধান্ত। তবে এই পথটুকু আপনাকে একলাই যেতে হবে। অলক মেঘে যেমন ..
-একটা কথা শুধু বলুন- অলক মেঘ কার লেখা আপনি সত্যি জানেন না?
সে উত্তর দেয় না। ঈষৎ হাসে। তারপর হাঁটতে শুরু করে।
অর্পিতা বড় রাস্তার দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। ওর পূর্বগামিনী ছায়া দীর্ঘ বিনুনীর মতো গলিটুকু ঢেকে দিচ্ছিল। আমি পিছন ফিরলাম। গলির শেষ বাড়িতে পৌঁছতে হবে আমাকে। সময় বেশি নেই। আজকের দুপুর অতীত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বিগত দু'ঘন্টাকে শূন্য সময় ধরে কোনো কাল্পনিক রেখা আঁকা সম্ভব কী না আমার জানা ছিল না।
[প্রথম প্রকাশ: পরম্পরা, ২০২৫]
Comments
Post a Comment