চরাচরের পাখিরা
এই সব বিকেলে ক্রিকেটম্যাচের শেষটুকু না দেখে চলে যাওয়া অসমীচীন; যখন রোদ পড়ে আসে, ছায়া দীর্ঘ এবং পূর্বগামী, সঙ্গী বলতে খুচরো কিছু বিষণ্ণতা আর দুশ্চিন্তা, সেই সময়ে পাড়ার মাঠে খেলা চলতে দেখলে, দাঁড়িয়ে পড়েছি। বরাবর। পাড়ার না বেপাড়ার দল, রাউন্ড রবিন না নক আউট , সেমিফাইনাল না কি ফাইনাল জানার প্রয়োজন বোধ করি নি। স্রেফ দাঁড়িয়ে গিয়েছি। ম্যাচের শেষ ওভার যেন এক এসকেপ রুট খুলে দেয়। হয়তো পরপর বাউন্ডারি অথবা সিক্সার, হয়তো একটা রান আউট, কিংবা লং অনের ওপর লোপ্পা ক্যাচ আর তারপরেই খেলোয়াড় আর সমর্থকদের লাফিয়ে ওঠা, স্টাম্প খুলে নিয়ে মাঠময় দৌড়োতে থাকা - এই সব দৃশ্য এবং মুহূর্তরা অকারণ উত্তেজনা আর আনন্দের সঞ্চার করে, স্যাঁতস্যাঁতে অনুজ্জ্বল সন্ধ্যার প্রাক্কালে যাকে অভাবিত লাগে তখন। আজ এখন সেই রকমই কিছু ঘটছিল।
বড় রাস্তায় বাস
থেকে নেমে তরুণ সঙ্ঘের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছি। আসলে, মিতুলদি
উবের বা হলুদ ট্যাক্সি নিতে বারণ করেছিল- " অত টাকা ট্যাক্সি কম্পানিকে দেওয়ার
কোনো মানে হয়? এখন বুঝবি না, বয়স হলে, অসুখে বিসুখে টাকার মূল্য বোঝা যায়। আর তুই জোয়ান
ছেলে- এত বাবুগিরিই বা কীসের? রবিবারের বিকেলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট
ফাঁকাই থাকে, ট্রেন থেকে নেমে বাস ধরে শিবতলা স্টপে নেমে সোজা হাঁটবি, যেখানে
এসে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে সেইখানে তরুণ সঙ্ঘ, পাড়ার ক্লাব। ওখানে পৌঁছে ফোন করবি আমাকে।
বাকি ডিরেকশন তখন দেব। এখন বললে গুলিয়ে ফেলবি।"
অনেকদিন পরে
মিতুলদির কাছে যাচ্ছি। স্বপনদা, মিতুলদি দুজনেই রিটায়ার্ড, ছোটো ছেলে বিদেশে, বড় জন্ম
থেকেই অসুস্থ ছিল; তারপর দিনে দিনে অবস্থা খারাপ
হয়েছে, কথাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শেষের ক' মাস, রাইল্স টিউবে খাওয়াতে হত, এত রোগা
হয়ে গিয়েছিল যেন বিছানার সঙ্গে মিশেই গিয়েছে; কোভিডের থার্ড ওয়েভ চলার সময় মারা যায়
সে। আমার মা, বাবা অসুস্থ তপুকে দেখে এসেছে নিয়মিত, আমিও গিয়েছি, তবে শেষের দিকে আর
যাওয়া হয় নি। তপুর মৃত্যুর পর থেকে স্বপনদা প্রায় শয্যাশায়ী, পায়ের সমস্যার জন্য মিতুলদিও কোথাও বেরোয় না। মা খুব বলছিল, ওদের দেখে
আসতে, তাই এবার দিল্লি থেকে বাড়ি এসে ফোন করেছিলাম - " পর্শু ফেরা, কাল বিকেলে
যাই তোমাদের কাছে?" এতে, মিতুলদি খুব
অবাক হয় প্রথমে তারপর আত্মহারা হয়ে পড়ে- "ছোটোবেলার কথা তোর মনে পড়ে রে? কোন ক্লাসে
যেন পড়তি তুই আমার বিয়ের সময়? মামীমা তোকে খেতে বসিয়েছিলেন আর তুই টেবিলের তলা দিয়ে
বেরিয়ে আসতে গিয়ে টেবিল উল্টে দিয়েছিলি- সে কী কাণ্ড! পুরোনো অ্যালবাম দেখি প্রায় রোজ। জানিস? আচ্ছা তোর
বৌ, মেয়ে এলো না? এর পর একসঙ্গে আসিস। তোর মেয়েকে তো দেখলামই না। মামা, মামীমা আসতে পারবেন তোর সঙ্গে? না না সে তো
জানি , কতদিন দেখি নি, তাই বলছি। এই পুড়িয়ে দেওয়াটা খুব খারাপ জানিস, কিছু তো আর থাকে
না। কফিনে করে কবর দিলে, মাঝে মাঝে... দ্যাখ
কী সব বলছি, মাথাটাই গেছে আমার- " একটানা কথা বলে গিয়ে এইখানে গলা বুজে যায় মিতুলদির।
এই সব কান্না,
হা হুতাশের মধ্যে আগামী দু ঘন্টা কাটবে আমার। যেতে ইচ্ছে করছিল না। আসলে এই শহরটাকেই ইদানিং আর ভালো লাগে না; অল্পদিনের জন্য আসি, তারপর কাজের খুব ক্ষতি হচ্ছে বলে ছুটি ফুরোনোর আগেই
দিল্লি ফিরে যাই; বেশিদিন থাকলেই মা ঠেলে ঠেলে
বড় মাসি, সনৎ পিসেমশায়, অথবা জেঠিমার কাছে
পাঠাবে। সে সব বাড়িতে প্লেটে সন্দেশ, গেলাসে জল,
আমাকে ঘিরে শিরা ওঠা হাত, ঘোলাটে সব চোখ, আর কথোপকথন বলতে, হয় কাজের মাসির বেয়াদপি,
কিম্বা নিজেদের অসুখবিসুখ, অবহেলিত জীবনের কাহিনী আর আমাদের জেনেরেশনকে দোষারোপ। আমার
তরফে মিষ্টি মুখে দিয়ে এই সব শুনে যাওয়া, ঘন ঘন ঘড়ি দেখা আর 'আসি, ভালো থেকো' বলে পালিয়ে
আসা। এ শহরের প্রতিটি বাড়ি, রাস্তাঘাট যেন ময়লা হলুদ
সেলোফেন কাগজে আগাপাশতলা মোড়া - যার
ভাঁজে ভাঁজে কান্না, হতাশা আর আক্ষেপ। কলকাতায় আমার দমবন্ধ লাগে আজকাল।
শিবতলার বাসস্টপে
নেমে মিষ্টি কিনতে গিয়েও দোকান থেকে খালি হাতে বেরিয়ে এলাম- কে আর রসগোল্লা খাবে? শুধু বিস্কুট আর কমলালেবু নিয়ে হাঁটতে শুরু
করেছি। তারপর অপ্রত্যাশিত এই মাঠ, ক্রিকেট ম্যাচের শেষ কটি ওভার। এখানেই আটকে গিয়েছি। আসলে এ'সবই মৃত্যু, অসুস্থতা, শোকতাপভরা একটা বাক্সে
ঘন্টাদুয়েক কাটানোর প্রস্তুতি। পিঠের ওপর পশ্চিমের রোদের তাত ক্রমশ কমছে, হলদেটে মাঠে
শীতের হাওয়া এপার ওপার করছে ঘন ঘন, মাফলার জড়িয়ে নিয়ে হাতে হাত ঘষছে প্রায় সমস্ত দর্শক
আর শেষ ওভার চলছে; এখন চারদিকের এই অবিমিশ্র উল্লাস, ঝাঁকড়া চুলো লম্বা ছেলেটার বল
হাতে ছুটে আসা, এই রোদটুকু- এই সবের মধ্যে দাঁড়ালে প্রত্যাশিত মৃত্যুকেও চরম অ্যাবসার্ড
মনে হয়। শেষ বলে একটা ছক্কার দরকার ছিল, ব্যাটার টাইমিং ভুল করে লোপ্পা তুলে দিল। বাউন্ডারির ওদিক থেকে মাঠে লোকজন ঢুকে এলো হৈহৈ
করে। এই সময় রোদও পড়ে গেল ঝুপ করে। এবারে গোটা মাঠময় ছায়ারা লম্বা আর গাঢ় হবে আরো,
এর ছায়া ওর ছায়াতে মিলে পিশে পিন্ড হয়ে যাবে ক্রমে, তারপর মিশকালো অন্ধকার গড়িয়ে গড়িয়ে এত বড় মাঠের ইজারা নিয়ে নেবে; এই সব
উল্লাস, উদযাপন অতীত হয়ে যাবে স্রেফ। যাবতীয় হৈ চৈ এর দিকে পিঠ ফিরিয়ে পা চালালাম।
বেশ অনেকখানি
হাঁটতে হল তরুণ সঙ্ঘ অবধি পৌঁছতে। ছোটো ক্লাবঘর- সদ্য রঙ করা; সামনে শিরীষ গাছ থেকে
পাতা ঝরছে, ক্লাবের বারান্দায় দুটো ক্যারমবোর্ড,
গ্রিলের দরজার ফাঁক ফোকর দিয়ে ঝুলন্ত পাঞ্চিং ব্যাগ, গোটা কয়েক প্লাস্টিকের চেয়ার আর
পুরোনো টেলিভিসনের কোণা দেখা যায়। সেই দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডানদিকে খোয়া ফেলা পথ আর
বাঁদিকে অপ্রশস্ত এবং কর্কশ পিচরাস্তা যাকে শেষ বিকেলে এক পরিত্যক্ত রানওয়ের মতো মলিন
দেখাচ্ছে। দুদিকের গোলাপী, নীল, হলুদ রঙা ফ্ল্যাটবাড়িরা সে রাস্তাকে ঈষৎ কোমল ও ঘরোয়া
করে তুলেছিল যেন এরোপ্লেন নয়, পাখিরা উড়ে যাবে চরাচরের দিকে। এখানেই কোথাও মিতুলদিরা
থাকে।
" কী রে?"
- মিতুলদি ফোন করেছে।
- এই তো আসছি,
একটু দেরি হয়ে গেল-
- ক্লাবের বারান্দায়
উঁকি ঝুঁকি না মেরে বাঁদিকের রাস্তাটা ধর-
- আরে তুমি দেখতে
পাচ্ছ আমাকে?
- আমাদের বারান্দা
থেকে ক্লাবের সামনেটা অবধি দেখা যায়। তুই বাঁদিকের রাস্তা ধরে, গোলাপি রঙের চারতলা
বাড়িটায় ঢোক, রাস্তার ডানদিকে- দেখ মহামায়া
লেখা-
-কোথায়?
- বাড়ির সামনে,
এই বিল্ডিংএর নাম আর কি। ঢুকে চলে আয় চারতলায়,
ফোন কাটিস না-কী রে বুঝলি কী বললাম?
সূর্যডোবার আধঘন্টা
পরে গোলাপি ফ্ল্যাটবাড়ির রঙ বোঝা যাচ্ছিল না।
নিচের দুই তলে জাস্ট তিনটি ঘরে বাতি জ্বালা, অ্যাপার্টমেন্টের ওপরের অংশ যেন সন্ধ্যার
আকাশ কপ করে গিলে নিয়েছে - তিন আর চারতলা আছে কী নেই সে নিয়েই সংশয় তৈরি হচ্ছিল। সংশয়
আর প্রত্যাশা। কোবাল্ট ব্লু , গয়াশ ফিনিশ আকাশের
নিচে মহামায়া ফ্ল্যাটবাড়ি বিশাল এক কু কু ক্লকের মতো, যেন এক্ষুণি ছটা বাজবে , সঙ্গে
সঙ্গে বাকি সব ঘরদোরে আলো জ্বলবে, মানুষজন বারান্দায় বেরিয়ে হাঁক্ডাক শুরু করে দেবে।
গমগম করবে গোটা চত্ত্বর। স্ট্রীটলাইট জ্বলছিল
অবশ্য। সেই আলোয় খেয়াল করলাম, রাস্তা থেকেই সিমেন্টের চাতাল শুরু হয়ে বাড়ির দরজায় শেষ
হয়েছে, আর সেখানে তালা দেওয়া।
- এই মিতুলদি,
কোল্যাপ্সিবল গেটে তো তালা ঝুলছে। ঢুকব কী করে ?
- সুখরাম সামনে
নেই?
- কেউ নেই। একটা
খালি টুল দেখছি শুধু-
- একটু দাঁড়া,
চলে আসবে এক্ষুণি, বাথরুমে গেছে হয়তো। ইশ কী
খারাপ লাগছে, তুই এতদিন পরে এলি, অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছিস। এই আসছে আসছে। সুখরাম
আসছে, দেখতে পাচ্ছি।
- ঠিক আছে, রাখি
তাহলে।
- না না ফোন
কাটিস না, কথা বল, কথা বল। হ্যালো হ্যালো এ্যাঁ,
কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না। উঠলি লিফটে?
এ বাড়ির চৌহদ্দিতে
ঢোকার পরে এমনিতেই ফোনে নানাবিধ আওয়াজ হচ্ছিল, উপরন্তু যার সঙ্গে দুমিনিট পরেই চাক্ষুষ
দেখা হবে, তার সঙ্গেই এতক্ষণ কানে মোবাইল চেপে হুঁ হাঁ করে যেতে ক্লান্ত লাগছিল আমার; মিতুলদির
বিভ্রান্তির সুযোগে লাইন কেটে দিলাম।
প্রাচীন এলিভেটর,
দু দুটো কোল্যাপ্সিবল গেট সমেত থম মেরে দাঁড়িয়েছিল; ল্যান্ডিং শব্দহীন, এবং আশ্চর্যরকম
নির্গন্ধ। টিভির আওয়াজ নেই,বাচ্চাদের হই হট্টগোল নেই, ফোড়ণ অথবা দুধ উথলানোর
গন্ধ এমনকি মশার তেলের গন্ধও অনুপস্থিত। আলো কম, হাওয়া ঠাণ্ডা ও স্যাৎসেঁতে, আমন্ত্রণ
জনিত কোনো ঊষ্ণতা তৈরি হয় না যার ফলে, এবং গৃহস্থর সম্বন্ধে যে কোনো রকম কল্পনা দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে
মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। রোগা পাতলা সদ্য যুবক সুখরাম আমার নাম ঠিকানা খাতায় লিখে, লিফটের
তালা খুলে আমাকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করে, নিজেও
ওঠে। সুখরাম চারতলার বোতাম টেপে, মুখভরা পান নিয়ে ঘোষণা করে, লিফটম্যান ছাড়া একলা ওঠানামার
নিয়ম নেই। তখনই এবাড়িতে প্রথম কোনো গন্ধ পেলাম
আমি - মেলানো মেশানো সুবাস - সম্ভবত চমনবাহার আর নারকেল তেল । এ সবই সুখরামের মুখ ও
কেশদাম নিঃসৃত ছিল।
"বাঁদিকের
ফ্ল্যাট"- চারতলায় আমাকে পৌঁছে দিয়ে সুখরাম নেমে গেল। এই কথাটুকু এ'মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় কারণ মিতুলদি
সামনে দাঁড়িয়ে, কানে এখনও ফোন - " এই তুই ফোন কাটলি না লিফটে কেটে গেল?"
আমি হাসলাম, মিতুলদি বুঝে নিক। কয়েকবছর আগে মিতুলদিকে যা দেখেছি, চুল তার থেকে অনেক
পাতলা ও রুপোলি , ত্বকে কুঞ্চন সুস্পষ্ট। শরীর একেবারে ভেঙে গিয়েছে - বাদামী আলোয়ান না থাকলে শীর্ণত্ব আরো প্রকট হত। মিতুলদিকে লুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
"তোর জন্য
আমরা সবাই অপেক্ষা করে বসে আছি সেই কখন থেকে, দুপুরে এখানে খেলে কত ভালো লাগত বল তো-"
মিতুলদি নাগাড়ে কথা বলতে বলতে ওদের ফ্ল্যাটের দিকে এগোচ্ছে, বাঁ পা টেনে টেনে হাঁটছে,
পিছন পিছন আমি, শ্যাফটের অভ্যন্তরে ধড়ফড় করে লিফট নেমে যাচ্ছে, সুখরামের চুলের গন্ধকে মাস্ক করছে মিতুলদির ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে আসা বাসি
গন্ধ- দুঃখী মানুষের অন্দরের নাছোড় গন্ধ যেমন হয়। বাইরে জুতো খুলে ঘরে ঢুকতেই দেখি
সোফায় তপু বসে আছে- জীনস, লাল টি শার্ট, মাথায়
ক্যাপ- ভাবলেশহীন, চোখের পাতা পড়ে না। আমার
হতভম্ব ভাব খেয়াল করল মিতুলদি , মুখ নামিয়ে নিল তারপর বলল, "সিলিকোনের। অবিকল
তপু। না রে? খরচ পড়ল অনেক। তা হোক। তবু তো বুড়োবুড়ি দুবেলা দেখতে পাচ্ছি। মালা দিয়ে
তপুর ছবি দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখব? তাই হয়? জানিস, শেষের দিকে খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল চেহারা।
পুরোনো কটা ছবি দিয়েছিলাম অ্যালবাম থেকে। ঐ ছবি বেস করেই বানিয়েছে আর কি।"
- কে তৈরি করলেন?
- তোর স্বপনদার
এক বন্ধু বলেছিল। সূর্য, বরানগরের। তুই চিনবি না। বলেছিল, কাগজে পড়েছে এরকম। সূর্যই
খোঁজ খবর নিয়ে সেই আর্টিস্টের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দিল। তুই বোস না। আবার ফল
টল আনতে গেলি কেন?
- স্বপনদা কোথায়?
- কোথায় আর যাবে?
ঘুমোচ্ছে ভেতরে। জেগে ছিল অনেকক্ষণ। ডাকছি। তুই একটু চা খা আগে।
-তুমি কেন করবে
মিতুলদি? আমাকে চা, চিনি দেখিয়ে দাও। আমি করছি।
- দু মিনিটে
হয়ে যাবে। আরে রোজই তো করি। রান্নাও।
- কেউ এসে করে
দিলে ভালো হয় না? এই পা নিয়ে সব কর?
"কেউ আসতে
চায় না রে। ভয় করে না কি।" মিতুলদি আঙুল
তুলে সিলিকোন-তপুকে দেখায় , চোখ মোছে, আবার কথা বলতে থাকে, "আমার অসুবিধে হয় না।
সুখরাম বাজার করে দেয়। আর দুটো মানুষের তো রান্না। ডান্ডা মপ মেঝেতে বুলিয়ে নিই যখন
পারি। একজন আয়া ছিল। সেন্টার থেকে নিয়েছিলাম, এখন তোর স্বপনদা ওয়াকার নিয়ে বাথরুম যেতে
পারে। তাই সে আর আসে না। তুই বোস না। তপুর পাশেই বোস।"
মূর্তিদের পাদদেশে
অনশনে বসাই রেওয়াজ। মিতুলদির বসার ঘরের মেঝেতে চুলের নুটি, সুতো টুতো, মৃত আরশোলা আর সামান্য কাদামাটি। মিতুলদি টিভি খুলে দিয়ে ভিতরের
ঘরে স্বপনদাকে ডাকতে গিয়েছে। সিলিকোনের তপুর
পাশে বসে চা খাচ্ছি, তপুর চোখ টিভিতে নিবদ্ধ, হাসিমুখ, বাঁহাতের ওপর আলগোছে ডানহাত
রাখা, পিঠ সোজা, টী শার্টের ওপর হাল্কা ধুলোর
আস্তর দেখা যাচ্ছিল। আমি আড়চোখে ঘড়ি দেখলাম। এসেই তো আর যাই বলা চলে না।
- তুই ভেতরে
আয়। স্বপনদা উঠেছে।
পর্দা সরিয়ে
ঘরে ঢুকতেই বায়ু নিঃসরণের প্রবল আওয়াজ। মিতুলদি শান্ত স্বরে বলল- "বাথরুমে যাবে?"
তারপর একগোছা ধূপ জ্বালিয়ে খাটের পাশে রাখল। ধূপের ধোয়াঁর ব্যাকড্রপে , ছোটো তোয়ালে
ঢাকা বালিশে কেশহীন মাথা , অক্ষৌরিত মুখমন্ডলের স্বপনদা সদ্যমৃতবৎ , যেন এখনও রাইগর
মরটিস সেট করে নি, যেন বাড়ির লোক ফুল টুল আনতে গিয়েছে, কেউ যেন চন্দন পরিয়ে দেবে এক্ষুণি।
আমি আবার ঘড়ি দেখলাম।
" আরে বোসো
বোসো , কতদিন পরে দেখছি তোমাকে, দিল্লির খবর কী বল?" মৃতদেহ কথা বলে উঠল। শরীরের
আভ্যন্তরীণ হাওয়া বাতাস বাইরে এলো পুনরায়।
"শুয়ে শুয়ে
গ্যাস হয়ে যায়, কী করব ভাই। বড় অসহায় আমরা দুজন। ঐ পা নিয়ে গার্গী সমস্ত করে। সুখরাম
আছে তাও বাজারটা..." একটু আগে মিতুলদি যা যা বলেছে, স্বপনদা তা রিপীট করে যায়, মিতুলদি চুপ করে শোনে, মাথা নাড়ায়, যেন এই সব কথা এই বাড়িতে
প্রথম উচ্চারিত হল। স্বপনদা সবিস্তারে নানা অসুখের পুঙ্খানুপুখ বিবরণ দিয়ে যেতে থাকে,
তারপর তপুর শেষ দিনের কথা বলতে বলতে আকুল হয়ে কাঁদে। মিতুলদি চোখের জল মোছায়, পর্দা সরিয়ে বলে- "ঐ তো দেখো টিভি দেখছে তপু,
দেখো, দেখো।" স্বপনদা হু হু করে কেঁদে চলে। বায়ুত্যাগ করে দুবার।
আমি মরিয়া হয়ে
উঠি, "মিতুলদি , আমার তো কালই ফ্লাইট, গোছগাছ রয়েছে। আসি এখন? পরেরবার একটু সময়
নিয়ে আসব।"
- পরের বার?
আমরা কি থাকব তখন? আর একটু বোস। কাল থেকে ভেবেছি
, তুই আসবি। কত কথা বলব। কাল কটায় ফ্লাইট?
-রাতে।
- তাহলে তো কাল
সমস্তদিনই পাবি। থাক না আর একটু। লুচি ভাজি। কতদিন কোনো মানুষের সামনাসামনি বসে কথা
বলি নি। যা কথা হয় সবই তো ফোনে ফোনে। আর এখানে লোক বলতে আর কে? সুখরাম আর ঐ পাশের ফ্ল্যাটের
মোহিনীবাবু। তিনিও তো... চল তোকে মোহিনীবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়ে আনি। তুই আসবি শুনেই
বলেছেন তোকে যেন নিয়ে যাই। মামা, মামীমাকে চেনেন উনি। তপুর অসুখের সময় এখানেই দেখা
হয়েছে। তুই তখন বিদেশে। চল।
মিতুলদি পা টেনে
টেনে বেরোয়, আমিও। মিতুলদিদের বসার ঘরে সিলিকোন চোখ একজোড়া, তার সামনে নিউজ চ্যানেল- রাশিয়ার নব্বই ড্রোন আঘাত হানে
ইউক্রেনে, ইরানে বম্ব ব্লাস্ট হয়, ইন্দোনেশিয়ায় ট্রেন উল্টে যায়, গাজা স্ট্রিপের শেলটারে
শিশুরা তাকিয়ে থাকে, অযোধ্যায় ভজন কীর্তন চলতে থাকে, চলতেই থাকে।
দরজা টেনে দিতে
দিতে মিতুলদি বলল, " হ্যাঁরে তুই না কি আজকাল লিখিস টিখিস। মামীমা ফোনে বলছিল
সেদিন। পড়াবি না আমাদের? " মা র ওপর রাগ হল আমার- সবাইকে বলে বেড়ানোর মানে হয়?
মিতুলদিরা কোনোদিন পড়বে আমার লেখা? বিরক্তি লুকিয়ে বললাম- "দূর মায়ের যেমন কথা-"
"লিখিস
না? ও। আমি তো ভাবছিলাম, তোকে বলব আমাদের কথা লিখতে" -মিতুলদি মুখ নামিয়ে নিল।
অকারণ চাদর টানল গায়ে।
মোহিনীবাবুর
মাথার চুল ধবধবে সাদা। হাত কাঁপে সর্বক্ষণ। লাঠি নিয়ে হাঁটেন। মিতুলদি বেল বাজাতে নিজেই
দরজা খুলে দিলেন- "তোমার জন্যই বসে আছি। গার্গী বলল, তুমি আসবে। মা, বাবা ভালো? ওঁদের বয়স কত হল ? আমার থেকে বড়?
আচ্ছা তুমি কি জিমে টিমে যাও? চমৎকার স্বাস্থ্য তোমার। এক কালে আমি মুগুর টুগুর ভাঁজতাম
বুঝেছ। তোমাদের দেখে ভালো লাগে. বোসো , বোসো" - আমার দিক থেকে চোখ না ফিরিয়ে একটানা কথা বলে যান মোহিনীবাবু। আমার অস্বস্তি হয়, ঘরের কোণের মোড়ায় বসি।
- ওখানে গিয়ে
বসলে? মশা কামড়াবে। এখানে বোসো। আচ্ছা, সমুদ্রের
তলায় দুমাস কাটিয়ে এলে নাকি দশ বছর বয়স কমে যায়?
- জানি না ।
মানে ঠিক জানি না
-জানো না? পেপারে
দেখছিলাম কদিন আগে। আমি তো ভাবলাম তুমিই জানবে। ইয়াং ম্যান তুমি-
- না মানে ঠিক...
- হাই প্রেশার
এনভাইরনমেন্টে থাকলে শরীরের বয়স কমে যায় নাকি , ক্রোমোজোমের কিছু চেঞ্জ টেঞ্জ হয়। জানো
না বলছ। অ। আমি তো ভাবলাম, তোমার থেকে জেনে টেনে অ্যাপ্লাই করব।
-খোঁজ নেব আমি।
হাইপারবারিক থেরাপি কিছু হয় বোধ হয়।
-খোঁজ নেবে?
খুব ভালো হয় তাহলে। জানিও আমাকে কেমন? দশটা বছরও যদি কমানো যায়, বুঝলে? সবারই উপকার হবে । তোমার বাবা মার বয়স কমাতে পারবে।
এই তোমার দিদি, স্বপন- সবার বয়স একদম দশ বছর কমে যাবে, ভাবো তো। দিল্লি ফিরেই খবর নিও।
কেমন?
"কার জন্য
বয়স কমাবো মোহিনীদা?" মিতুলদি ডুকরে উঠেছিল এই সময়। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলল-"
আসি মোহিনীদা। একটু লুচি ভাজি। ও তো বেশিক্ষণ বসবে না, কাল ফ্লাইট।"
- কিন্তু ও এখন
বেরোবে কেমন করে?
- মানে?
-সুখরাম তো তালা
দিয়ে বেরোলো-
- চলে আসবে নিশ্চয়ই-
- তা জানি না।
বলল কী এমার্জেন্সি কাজ পড়েছে, যেতে হবে-
- আপনাকে বলল?
- কেন তোমাদের
বলে নি?
- কই না তো-
আমার ভীষণ গরম
লাগছে। কানের পিছনে, চোখে মুখে ঠান্ডা জল দিতে পারলে ভালো হত। ঘাড়, পিঠ শক্ত হয়ে উঠছে
ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম। মোহিনীবাবুর ঘরের দেওয়াল, ছাদ, মেঝে সব যেন গুটিয়ে এইটুকু হয়ে
যাচ্ছে, যেন মহাসমুদ্রের তলায় হাই প্রেশার চেম্বারে আট্কা পড়ে গেছি, এসকেপ রুট খুঁজে
না পেলে দম বন্ধ হয়ে যাবে এক্ষুণি; মাফলার খুলে কপাল মুছলাম," তার মানে কী? এবাড়ি
থেকে কেউ বেরোতে পারবে না?"
"আরে এ'বাড়ি
থেকে কেউ বেরোয় না, বেরোলে শুয়ে শুয়ে- হাসপাতালের স্ট্রেচারে কিম্বা ..." মোহিনীবাবু
হাসতে লাগলেন।
-কী বলছেন কী? কেউ অসুস্থ হলে, অ্যাম্বুলেন্সের লোকও তো আসতে পারবে
না।
"সে কোনো
একটা ব্যবস্থা তখন হয়ে যাবে। তালা ফালা ভাঙবে
-" মোহিনীবাবু নিরুত্তাপ।
- এরকম আগে হয়েছে?
মিতুলদি?
-মাঝে মাঝে।
তবে বলে যায়।
-কেউ আসে না
বাইরে থেকে তোমাদের কাছে?
- রাতের বেলায়
কে আসবে? সেই আবার সকালে আয়ারা, বা কাজের দিদিরা আসবে। এখানে সবাই তো বয়স্ক মানুষ,
রিটায়ার্ড, অফিস কাছারি থেকে ফেরা নেই। সকালে হাঁটতে যায় দু এক জন। সকাল দশটার মধ্যেই
ফিরে আসে।
-সোসাইটি বলে
কিছু নেই?
-থাকবে না কেন?
তবে এরকম আগে হয়েছে, মাথা ঘামাই না। আমাদের কোথাও বেরোনোর নেই তো-
-কী বলছ কী?
আমি নেমে গিয়ে দেখছি।
"আরে কোথায়
আর যাবে? সুখরাম আসুক"- মোহিনীবাবু চোখ না সরিয়ে তড়বড় করে বলে ওঠেন।
- সুখরামের ফোন
নাম্বার নেই?
"সে আছে,
চল ফ্ল্যাটে ফিরে ফোন করব-তুই এত অস্থির হচ্ছিস কেন? জলে তো পড়ে নেই" -মিতুলদিকে
বিধ্বস্ত দেখায়।
" আসি মোহিনীবাবু"-
এক দৌড়ে লিফটের সামনে এসে বোতাম টিপি। অন্ধকার শ্যাফটে সাসপেন্শন রোপের বিন্দুমাত্র
নড়াচড়া লক্ষিত হয় না।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে
থাকি দ্রুত। একতলায় লিফটের দুটো গেটই খোলা। বাড়ির মূল দরজা বন্ধ। টানাটানি করার চেষ্টা
করলাম। কী করব? কাকে ফোন করব? পুলিশে? এ বাড়ির
বাসিন্দাদের সম্মতি না নিয়ে তা কি সম্ভব? এবাড়ির
বাকি মানুষজন যা মনে হয় এই রকম হাই প্রেশার চেম্বারের বাসিন্দা, কোনো লাভ হবে না তাদের
কাছে গিয়ে। আমি আবার কপালের ঘাম মুছি। জোরে
জোরে শ্বাস নিই। মাথার চুলে হাত চালাই। মনে হতে থাকে, সেই কবে এসেছি মিতুলদির কাছে,
কত যুগ যে কেটে গেল এই মহামায়া অ্যাপার্টমেন্টে, যেন আমার সামনে আয়না ধরলে দেখতে পাবো
আমার মাথার চুল সম্পূর্ণ সাদা হয়ে গিয়েছে।
" উঠে আয়
ওপরে, কিছু মুখে দে, সুখরামকে ফোন করছি আমি। অত ব্যস্ত হস না বাবু। কী যে খারাপ লাগছে
আমার"- মিতুলদির ফোন।
লিফটে উঠতে গিয়েও
পিছিয়ে আসি। যা কপাল আজ, বলা যায় না লিফটই হয়তো আটকে গেল মাঝপথে। সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসে
হাঁপাচ্ছিলাম। মিতুলদিদের দরজা খোলা, মোহিনীবাবু নিজের ফ্ল্যাট থেকে মুখ বের করে বলছেন,"
সুখরামের ফোন বেজে যাচ্ছে। তিনবার চেষ্টা করলাম।
-আমি দেখছি মোহিনীদা।
আপনি ব্যস্ত হবেন না। আয় বাবু। ময়দা মাখা আছে। তুই খেয়ে উঠতে উঠতে সুখরাম এসে যাবে।
- তুমি ফোন করে
দেখো না মিতুলদি।
-তোর আর এক মুহূর্তও
থাকতে ইচ্ছে করছে না, তাই না? জানি রে। কেউ আসতে চায় না। এই শোকতাপের ঘরদোর। কে আসবে?
কেনই বা আসবে?
- না না মিতুলদি।
তা নয়। আসলে কাল যাওয়া তো।
মিতুলদি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। তারপর সুখরামের নম্বর
ডায়াল করে স্পীকারে রেখে, ময়দার লেচি গড়তে থাকে। সুখরামের ফোন বেজে বেজে থেমে যায়।
মিতুলদি ডায়াল করে আবার। বসার ঘরে সিলিকোন-তপু টিভি দেখছে। স্বপনদার ঘরের ধূপের ধোঁয়া এ ঘরে এসে ঢুকছে। তারপর লুচির
গন্ধের সঙ্গে মিশে পুরো শ্রাদ্ধবাড়ি যেন। স্বপনদার
গলা পাওয়া যায়- "লুচি ভাজছ? আমাকে দিও না। রাতে খাবো না কিছু। বড্ড গ্যাস হয়েছে
আজ।" গা গুলিয়ে ওঠে। বমি বমি লাগে। কিছুই খাব না বললে মিতুলদি কেঁদে ফেলবে শিয়োর। মিতুলদির পাশে গিয়ে
দাঁড়াই-" লুচি বেলে দিই?"
- না না তুই
বরং ওর কাছে একটু বোস। বেশিক্ষণ না। আমার এক্ষুণি হয়ে যাবে। আর সুখরাম ফোন না ধরলে,
সোসাইটিতে ফোন করব। একটা কিছু ব্যবস্থা হয়েই যাবে। তুই ভাবিস না।
ও ঘরে স্বপনদাকে
আরো অবসন্ন দেখাচ্ছিল। আমি ঘরে ঢুকতে ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল, " জলের গেলাসটা দেবে?
না থাক। গার্গী এসে দেবে খন। বিষম টিষম লেগে গেলে কেলেংকারি। বোসো না। বোসো। পাঁচ মিনিটে
লুচি হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে গার্গী এখনও এক নম্বর। বলো তোমার কথা বলো। কী লিখছ?"
উসখুস করে কথা ঘোরাই -" স্বপনদা, ফিজিওথেরাপি করে দেখলে হয় না?"
- অনেক করা হয়েছে-
কোনো রকমে বাথরুমে যেতে পারি এখন - এইটুকুই যা ইম্প্রুভমেন্ট, আর কিছু হবে না। করেই বা কী হবে? সব ফিনিশ।
- অপু এসেছিল
এর মাঝে?
- তপুর শেষ সময়ে
এসেছিল, শ্রাদ্ধশান্তি অবধি রইল। আর আসে নি। ফোনে কথা হয়। আবার হয়তো এক বছর পরে আসবে।
কী করতে আসবে এখানে?
- তা কেন ? আসবে
ঠিকই। পিঠোপিঠি দাদা। শোক তো ওরও কিছু কম নয়।
-তোমার সঙ্গে
অপুর কথা হয়?
-ঐ হোয়াটস্যাপ
মেসেজ আর কী-
-তুমিও তো অনেকদিন
পরে কলকাতায় এলে। আর কটাদিন থেকে যেতে। ওয়র্ক ফ্রম হোম করতে পারতে-
- না কাল ফিরতেই
হবে। টিকিট পাওয়াও একটা সমস্যা হয়ে যাচ্ছে এই সময়- ঐ রামমন্দিরের জন্য আর কী-
"রাম মন্দির?"
ঘরে যেন বাজ পড়ল। খাটের পাশে রাখা জাগ , গেলাস ঝনঝনিয়ে উঠল। জল উপচে পড়ল খানিকটা। স্তম্ভিত হয়ে দেখি- বালিশ
থেকে নিজেই মাথা তুলে ফেলেছে স্বপনদা, বুক ওঠানামা করছে দ্রুত, লম্বা নখওলা শীর্ণ আঙুল
তুলেছে সামনের দিকে- "হু ইজ রাম? টেল মী হু ইজ রাম? সার্কাস হচ্ছে দেশে?"
স্বপনদার নাকের পাটা স্ফীত, কপালের শিরা জেগে উঠেছে, হাঁ মুখের ভেতর কয়েকটি ক্ষয়া দাঁত-
গ্যের্নিকার ঘোড়া যেন কেশর ঝাঁকিয়ে হ্রেষ্বাধবনি
করে উঠল।
লুচির থালা হাতে
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল মিতুলদি।
- ইলেকশন কবে, গার্গী?
- ডেট দেয় নি।
মে মাসে হবে হয়তো।
- এখন তো বাড়ি
এসে ভোট নিয়ে যায়। আর চার পাঁচ মাস বাঁচব না গার্গী? বাঁচব না?
মিতুলদি নিঃশব্দে
কাঁদতে থাকে, চোখ মুছে নাক টানে- “তুমি শুয়ে পড়। বাবু তুই খেতে বোস। সুখরাম এসে পড়বে
, ওর বোনের মেয়েটার মাথা ফেটেছে, আর কেউ নেই, তাই দৌড়েছিল। রওনা হয়েছে। এসে যাবে। তুই
চট করে খেয়ে নে-
- আমি ভাবছি
আজ এখানেই থেকে যাব মিতুলদি। থাকতে দেবে?
সকালে বেরিয়ে আসছিলাম মিতুলদিদের বাড়ি থেকে। চায়ের কাপ হাতে মিতুলদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। মাথা ঘুরিয়ে হাত নাড়লাম। চোখ মুছছে মিতুলদি। সূর্যের আলোয় অপ্রশস্ত পিচরাস্তাকে ম্যাচ শেষের বাইশ গজ মনে হচ্ছে এখন। যেন সদ্য ম্যাচ শেষ হয়েছে, একটা ঝাঁকড়াচুলো লম্বা ছেলে এক ইয়র্কারে ভেঙে দিয়ে গেছে শোক, জরা, মৃত্যুর স্টাম্প। মেক্সিকান ওয়েভ উঠেছে গ্যালারিতে। বাস স্টপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমি সেই সব উল্লাস স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারছিলাম।
Comments
Post a Comment