পরীকথা

পরীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট গল্পে। নিত্যদিনের অনলৌকিকতার মাঝে হঠাৎই এসেছিল একটি রাত-পরী দেখা রাত; চিরচেনাজন পরী হয়ে যায় যে ফিনিক ফোটা রাতে।
তারপর আর কোনও পরীর কাছাকাছি আসা হয়নি।

মাস দুয়েক আগে, হঠাৎই পরীস্থানের খোঁজ পাই। সিডনি শহরের কাছেপিঠেই পরীরা আছেন। চাইলেই হাজির হবেন তাঁরা। জন্মদিনের আসরে। সকালে, দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায়। ফুরফুরে টিংকার বেল, পিনোক্কিওর ব্লু ফেয়ারি, সিন্ডারেলার ফেয়ারি গডমাদার, অথবা সাতরঙা রেনবো ফেয়ারি, ছটফটে বাটারফ্লাই ফেয়ারি, দুষ্টু-মিষ্টি টুথ ফেয়ারি।

বেশ কয়েকটি অর্গানাইজেশনের সঙ্গে পরীদের দিব্যি জানাশোনা, প্রতিযোগিতাও বেজায় তাদের। এখানকার পরীটি আপনার শিশুটিকে দেবেন ফেয়ারি কৃস্টাল তো ওখানকার পরীটি আনবেন ম্যাজিক নেকলেস। এই পরীটি যদি শিশু অতিথিদের জন্য আনেন পরী আঁকা থালা বাটি, ওই পরীটি আনবেন পরীস্থান স্পেশাল খেলনা পুতুল। আপনি চাইলে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও পরীরাই করবেন। আপনি শুধু মেনু পছন্দ করুন। বেছে নিন পছন্দের প্যাকেজটি। তারপর ফোন কিংবা ই-মেইল। আপনার আসর কখন শুরু, কজন নিমন্ত্রিত, তাদের বয়স, কোন পরীটি চাই আপনার, কতক্ষণের জন্য -- সব জানিয়ে দিন। আসরে বাচ্চাদের সংখ্যা পনেরোর বেশি হলে অবশ্য দুজন পরীকে আসতেই হবে -- সেরকমই নিয়ম -- আসলে, গলা তুলে ধমক দেওয়া পরীকে মানায় না। পছন্দের প্যাকেজ অনুযায়ী অ্যাডভান্স টাকা পাঠিয়ে দিন চেকে বা ক্রেডিট কার্ডে আর অপেক্ষায় থাকুন পরীর আবির্ভাবের। শুধু শিশুরা যেন না জানে প্যাকেজের কথা। ওরা জানুক, পরী আসবে।

এমনভাবেই গতমাসে এক জন্মদিনের আসরে আমার সঙ্গে পরীটির দেখা।

বসন্তের মনোরম সকাল। রঙিন কাগজের শিকলি আর অজস্র বেলুনে সাজানো ঘরখানা। জনা পরেরোর শিশু পরীর অপেক্ষায়।

পরীটি আসে। একহাতে তার বেতের টুকরি, অন্য হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড। হাতে গলায় ফুলের গয়না, রঙিন ডানা দুটি, গোলাপি সুদৃশ্য পোশাক, একমুখ হাসি। টুকরি থেকে একে একে বের হয় জাদু শতরঞ্চি, হৃদয় আকৃতির বেলুনসমূহ রং তুলি, গল্পের বই, রঙচঙে সব মোড়ক, একটি ছোট মিউজিক সিস্টেম। বাচ্চারা পরীকে ঘিরে বসে। পরী গল্প বলেন, গান শোনান, খেলাচ্ছলে সবাইকে উপহার দেন। পরীকে ঘিরে শিশুরা নাচে। ছবি আঁকে। পরী রং তুলিতে তাদের রাজকন্যে সাজান কিংবা প্রজাপতি, খরগোশ, জলদস্যু কিংবা স্পাইডারম্যান -- যে যেমনটি চায়। মুঠো মুঠো ফেয়ারি ডাস্ট উড়িয়ে দেন ঘরময়। টুকরি থেকে আরও বেরোয় ললিপপ আর জলছবি। শিশুরা পরীতে মজে যায়।

সকাল গড়িয়ে দুপুর। প্যাকেজ অনুযায়ী পরীর যাওয়ার সময়। ম্লানমুখ শিশুদের কেউ কেউ পরীর উড়ান দেখতে ব্যালকনিতে এসে আকাশ খোঁজে। পরী বলেন, সামান্য দূরের পার্কটি থেকে উড়ান শুরু তাঁর। সেখানে আকাশ ঢাকেনি উঁচু বাড়ি-ডানা মেলতে সুবিধে।

সিঁড়ি বেয়ে সদর দরজা অবধি পরীর সঙ্গে আসি। শিশুদের কৌতূহলী চোখ এড়িয়ে তার হাতে প্রাপ্য টাকা তুলে দিতে হবে। সে ক্লান্ত হাসে। পরীর মুখে খিদের গন্ধ পাই। খেয়ে যেতে বলি। ফুলের মধু ছাড়া অন্য কিছু খায় না সে-মিষ্টি হেসে একটু গলা তুলে বলে। শিশুরা যেন শুনতে পায়।
তারপর হেঁটে যায়। ওর এক হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, অন্য হাতে ভারি টুকরি। ফিরে তাকায়। ব্যালকনিতে হাত নাড়ে শিশুরা। পরী রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যায়।

তখন একটি শিশু বলে ওঠে, আচমকাই -- "আমি জানি, ও সত্যি পরী নয়। আমি জানি ও উড়তে পারে না। ও হেঁটে গেছে।'

কার্পেট থেকে ফেয়ারি ডাস্টের শেষ কুচিটুকু তুলে নিল ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। দুপুরের রোদে পরীর ডানাদুটি গলে গেল।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস