স্মারক অথবা --
ইদানীং পোস্টারে ছয়লাপ পাড়া। ল্যাম্পপোস্টে সাঁটা, উঁচু দেওয়ালে টাঙানো অথবা ফুটপাথে ইষৎ হেলিয়ে দাঁড় করানো চড়া হলুদের ওপর কালো মোটা হরফে লেখা পোস্টার -- সেভ আওয়ার অ্যানজ্যাক হেরিটেজ বা সেভ গ্রেথওয়েট অথবা রাইট লেমা ইমিডিয়েটলি কিংবা স্টপ লেমা সেলিং আওয়ার অ্যানজ্যাক হেরিটেজ ... এইসব।
লেমা নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার।
লেখার সঙ্গে কোথাও একটি ম্যাপ বা পুরোনো বিশাল বাড়ির ছবি, কোথাও বা একটি অতি প্রাচীন সিপিয়া রঙের গ্রুপ ছবি-সৈনিকের বেশে, নার্সের পোশাকে নারী, পুরুষ-পরিচ্ছদ, কেশবিন্যাস সবই বেশ প্রাচীনকালের অন্তত একশো বছরের পুরোনো তো বটেই।
'শ পুরতে আর সামান্যই বাকি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু। অস্ট্রেলিয়া একটি ফেডের্যাল কমনওয়েলথ সেই সময় -- বয়স বছর পনেরো। নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার সেনা মিলে তৈরি হল অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড আর্মি কর্পোরেশন বা অ্যানজ্যাক -- মিত্রশক্তির নৌবাহিনীর অবাধ প্রবেশের জন্য অ্যানজ্যাক আক্রমণ করল গ্যালিপলি পেনিনসুলা। উনিশশো পনেরোয়। প্রায় আট হাজার অস্ট্রেলিয়ান সেনা নিহত আর আহতের সংখ্যা অগণন।
সেই সময় নর্থ সিডনি অঞ্চলের জনৈক স্যার থমাস ডিবস নিউ সাউথ ওয়েলসকে দান করলেন তাঁর বিশাল ভিক্টোরিয়ান ম্যানসন "গ্রেথোয়েট', আহত অ্যানজ্যাক সেনাদের শুশ্রুষার জন্য। উনিশশো ষোলো থেকে উনিশশো আশি রেডক্রস ব্যবহার করে গ্রেথওয়েটকে। আশি থেকে স্বাস্থ্য দফতর দায়িত্ব নেয় এই বাড়ির একটি নার্সিং হোম চালু করে।
এখন এই বিশাল বাড়ি, সংলগ্ন বাগান ব্যবহারের অযোগ্য সর্বতোভাবে স্বাস্থ্যদফতর চাইছে গ্রেথওয়েট বিক্রি করে দিতে, চাইছে ম্যানসনটি ভেঙে গড়ে উঠুক একটি কারপার্ক, কিছু টাউনহাউস। এর আগেও, চুরানব্বই নাগাদ, সরকার একই প্রস্তাব এনেছিল কিন্তু জনমত ছিল এবারের মতোই অর্থাৎ প্রস্তাবের বিপক্ষে। সেই সময় এলেকশনের মুখে তাই বিক্রির প্রস্তাবে ধামাচাপা পড়ে। এখন আবার উদ্যোগী হয়েছে গভর্নমেন্ট। তবে, এই সময়, শুধু প্রতিবাদ নয়, নর্থ সিডনি কাউন্সিল এবারে সরকারের থেকে বাড়িটি কিনতে চেয়েছে -- রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাউন্সিলের। একটি হেরিটেজ পার্ক গড়ে তুলবে কাউন্সিল, ম্যানসনটি অটুট রেখে। হলদে কালো পোস্টারগুলির পশ্চাৎপট এইটুকুই।
এই বিকেলে স্যান্ডস্টোনের এই ভিক্টোরিয়ান ম্যানসনটির সামনে এসে দাঁড়াই। পোস্টারের ম্যাপ দেখে পৌঁছে গেছি। প্যাসিফিক হাইওয়ের মতো অতি ব্যস্ত রাস্তা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ অথচ নাগরিক কোলাহল ফেলে আসছি রাস্তার মুখের পাবটিতে। প্রাচীন বাড়ি, প্রাচীন দুয়ার, অজস্র পাখি ডাকছে -- কুলায় ফেরা পাখি সব, সূর্য অস্তগামী। হাল্কা হিমভাব।
প্রবল অযত্নের চিহ্ন সর্বত্র। আগাছা, বিষাক্ত ঝোপ-ঝাড়, কুকুরের বর্জ্য, বিয়ারের ক্যান, প্লাস্টিক ইতস্তত -- ভারী ট্রাকের টায়ারের দাগ ঘাসে। দুটি অতি প্রাচীন ডুমুর গাছ। তিনতলা প্রাসাদোপম বাড়িটির জীর্ণ অতি জীর্ণ দশা। প্রাচীন উদ্যানটিতে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল একটি ঘটনা।
এই যুদ্ধস্মারক সংরক্ষণ নিয়ে ভারী গন্ডগোলে পড়ি একবার। সেদিন বাড়িতেই ছিলাম। একাই। দুপুরের দিকে জানলা দিয়ে হঠাৎ দেখি অ্যাম্বুলেন্স, দমকল, পুলিশের গাড়ি - কার কি হল ভাবতে ভাবতেই দরজায় করাঘাত। সিনেমায় যেমন দেখি তেমনই সপ্রতিভ ভঙ্গিতে আইডেন্টিটি কার্ড দেখান তরুণ পুলিশ অফিসারটি -- "যে অবস্থায় আছেন, সেই অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে আসুন, নীচের স্টোরেজে গুটিকয়েক গ্রেনেড পাওয়া গেছে।' অগত্যা পাসপোর্ট আর ল্যাপটপটি হাতে, চটি পরেই সটান বাইরে। জানা গেল, আমারই ওপরতলার বাসিন্দার কিছু জিনিসপত্র রাখা ছিল স্টোরেজে -- বৃদ্ধ মারা গেছেন বহু বছর, বৃদ্ধাও অসুস্থ নার্সিংহোমে। তাঁদের পুত্রটি এসে স্টোরেজ পরিষ্কার করতে গিয়ে গ্রেনেডগুলি দেখে ও তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেয়। অফিসার নাম-ধাম খাতায় লিখে কাছের থানায় কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, থানায় কফি খেলে কত -- এরকম কোনও কাল্পনিক মানসাঙ্ক কষে অকুস্থলেই দাঁড়িয়ে থাকি আমি। অত:পর বম্ব স্কোয়াড আসে। জানা যায়, এই গ্রেনেড বিশ্বযুদ্ধের সময়ের - বৃদ্ধ ছিলেন সৈনিক, তিনি নাকি গ্রেনেডগুলি স্মারক হিসাবে তুলে রেখেছিলেন সযত্নে। পুলিশের মত সেরকমই। সত্যি কথা সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ স্বর্গে গেছেন বহুদিন, বৃদ্ধাও অসুস্থ। অতএব ...
এই জীর্ণ ম্যানসন, প্রাচীন বৃক্ষদ্বয়, সিপিয়া রং-এর গ্রুপ ছবিটি, গ্রেনেডসমূহ যুদ্ধস্মারক সংরক্ষণের একটি কোলাজ হতে পারত। আদ্যন্ত। অথচ, সেদিন, শেষ বিকেলে, সেই ডুমুর গাছের তলায় কোলাজের এই ফ্রেমটিতে ঢুকে পড়ে আরও একজন। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। ফর্সা। চোখা, সাহেবি গড়ন ... হারবার্ট। হারবার্ট সরকার।
মুহূর্তে, প্রাচীন গাছটি শমীবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আয়ুধসকল অপেক্ষায় থাকে।
Comments
Post a Comment