রিটার্ন টিকিট
১
স্টেশনে যাওয়ার এই একটি-ই রাস্তা।পুজোর মুখে সামান্য নুড়ি আর পিচের প্রলেপ, বছর না ঘুরতেই খানা খন্দগুলি আবার পরিস্ফুট। দুপাশে ছোটো ছোটো দোকান-সারদা মেডিকেল হল, কাকলি স্টেশনারিজ, মা তারা সুইট্স। রাস্তা আর দোকানের মধ্যবর্তী অপ্রশস্ত চাতালে সকালে ফুল, মালা, বিকেলে পেয়ারা আর কেরোসিন। জেরক্সের দোকানে কোচিং ফেরত ভীড় সন্ধ্যা নাগাদ।
দুপুরবেলা পথটি নিরিবিলি।রূপায়ণ টেলার্সের সেলাই মেশিন আর লালার আটাচাক্কির সামান্য আওয়াজ।
সুলেখা এই সময় বেরোন। শিয়ালদার ট্রেন ধরেন সপ্তাহে দুদিন।
এই সব দোকানপাট পরিচিত এখন, গলিঘুঁজিও সড়গড়। এক বছরের বেশি-ই হয়ে গেল এই অঞ্চলে।খাস কলকাতায় বছর তিরিশেক চাকরির পরে মফস্বলে তিন কামরার ফ্ল্যাট। একাই থাকেন।স্বামী গত হয়েছেন বহুবছর।আর মেয়ের সংসার মালদায়।
কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল।সাদা শাড়ীটি গোড়ালির ওপর আলগোছে তুলে হাঁটেন সুলেখা।ওভারব্রিজ পেরিয়ে টিকিটঘর। প্ল্যাটফর্মে নামতেই বোঝেন ট্রেনের গোলমাল।শনিবারের দুপুরে প্ল্যাটফর্মে বেশ ভীড়। ঘোষক জানাচ্ছেন, পরবর্তী ডাউন ট্রেন আসতে এখনও ঘন্টা দেড়েক।
এতগুলো সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে সুলেখা ঘামছিলেন। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে আলতো মুখ মোছেন। দেড়-দুঘন্টা পরের ট্রেনে ওঠা তাঁর পক্ষে অসম্ভব-এখনই স্টেশনে যা ভীড়। ফিরতেও অনেক রাত হয়ে যাবে। ফিরে যাওয়াই ভালো।
-'মিনিবাসে যাবেন?'
পাশেই দাঁড়িয়ে আর একজন সাদাখোলের শাড়ী, সবজেটে পাড়। তাঁরই মত । চোখে চশমা, শ্যামবর্ণা , দীর্ঘাঙ্গী।
-'পরের ট্রেন আসার আগেই শিয়ালদা পৌঁছে যাবো। আপনিও তো শিয়ালদায় যাচ্ছেন?'
মহিলাকে এবার চেনা ঠেকে সুলেখার। তাঁদেরই পাড়ার। দেখেছেন আগে। মুখচেনা। এই টুকুই।
সুলেখা এই বয়সেও মুখচোরা। কিছু বলার আগে তিনবার ভাবেন। সবুজ পাড় নিজেই বলেন-'একটা মিনি বোধ হয় এক্ষুণি ছাড়বে, চলুন যাই।'
সুলেখা চলতে থাকেন সবুজ পাড়ের সঙ্গে।স্টেশন থেকে বেরিয়েই মিনিবাসের স্ট্যান্ড। একটা বাস ভর্তি।দুজনে পরের বাসে ওঠেন।পাশাপাশি সিট পেয়ে যান। বাসটিও ছেড়ে দেয় মিনিট দশেকের মধ্যেই।
জানলার ধারে সুলেখা। বাস ছাড়তেই এক ঝলক হাওয়া কপালের ঘামে।সবুজ পাড়ের দিকে ফিরে বলেন, 'মৌরী খাবেন?'
এইবার দুজনের গল্প জমে উঠতে থাকে। স্টেশন রোডের পিন্টু লটারি, খোকন রোল সেন্টার, অন্নপূর্ণা বস্ত্রালয়, রূপলেখা সিনেমা পেরোয় বাসটি । সুলেখার জানা হয়ে যায় সবুজ পাড়ের নাম। গায়ত্রী একটি মেয়েদের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। স্কুলের স্থপতি-ই বলা চলে। নদীয়ায় স্কুলটি।ওখানে বাসাভাড়া করে থাকা আর ছুটিছাটায় ভাইএর কাছে আসা। বিয়ে করেন নি।
-'আপনাকে দেখি মাঝে মাঝেই। ট্রেনে। কথা হয় নি এতদিন'।
-'শনি রবি ফাঁকায় ফাঁকায় শিয়ালদার দিকে যাই। '
-'কোনো মন্দিরে?'
-'না, একজন অসুস্থ।দেখতে যাই। আপনিও কি রোজ এই সময় বেরোন?'
-'ঐ ছুটিতে যখন আসি তখন।একটা অনাথ আশ্রমে যাই মাঝে মাঝে'।
-'খুব ভালো কাজ করছে তো আপনি, বাঃ-' সুলেখা মুগ্ধ হন।
-'আপনিও তো এই বয়সে এত দূরে অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে যান। কে করে বলুন আজকাল এসব?'
দুজনে হাল্কা হাসেন।
শিয়ালদা আসার একটু আগে নেমে যান গায়ত্রী। মিনিটি সুলেখাকে নিয়ে শিয়ালদায় পৌঁছয়। দেড় ঘন্টা সময়টুকু দিব্যি কাটলো মনে হতে থাকে সুলেখার।মৌরী মুখে দিয়ে হাঁটতে থাকেন।
পুজোর ছুটিতে গায়ত্রী আর সুলেখার দেখা হতে থাকে প্রতিটি শনি-রবিবারেই। জানা হয়ে যায় , সুলেখার মেয়ে- জামাই-নাতি দার্জিলিং বেড়াতে গেছে আর গায়ত্রীর ভাই- ভাইবৌ-ভাইপো পুরীতে।জানা হয়ে যায় সুলেখা রিটায়ার করার ছমাসের মধ্যেই পেনশানের কাগজপত্র হাতে পেয়ে গেছেন আর গায়ত্রীর রিটায়ারমেন্টের আরো বছর দুই বাকি।জানা হয় গায়ত্রী মাঝে মাঝে গলস্টোনের ব্যথায় ভোগেন , পরের ছুটিতেই হয়তো অপারেশন করবেন। সুলেখা ভোগেন স্পন্ডিলাইটিসে-বেল্ট পরতে হয় কোমরে যখন বাড়াবাড়ি হয়। গায়ত্রীর ভাই,ভাই বৌ খুব ভালো আর ভাইপোটি পিসিকে খুব ভালোবাসে । সুলেখা এই শীতেই মালদা যাবেন-নাতির জন্য তাঁর মন পোড়ে।
টুকরো টাকরা ঘরোয়া কথা সব-
তারপর সুলেখা চলে যান হাসপাতালে অসুস্থ আত্মীয়র কাছে আর গায়ত্রী আশ্রমে।সন্ধ্যেয় বাড়ী।রিটার্ন টিকিট কাটাই থাকে।
২
শীতের সন্ধ্যেয় তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে যায়।সুলেখা তাই একটু আগে বেরোচ্ছেন। অন্ধকারে অসুবিধে হয় পথ চলতে।
ট্যাক্সি আর অটোর ভীড় হাসপাতালের মুখটায়। একপাশে কমলালেবুর পিরামিড।উস্কো চুল লালচে চোখ কিছু মানুষ। দেহাতী বৌটি আঁচলের আড়ালে বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছে । অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াচ্ছে।
সুলেখা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন।
চোখ বুজে শুয়ে আছেন শিবনাথ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ।
সুলেখা এসে দাঁড়ান। শিবনাথের কপালে হাত ছোঁয়ান। চোখ খুলে ম্লান হাসেন শিবনাথ। সুলেখা টুলে বসেন। নীলপাড় শাদা শাড়ী মেয়েটি সুলেখার কাছে এসে বলে,'দিদা এসেছ?দাদু আজ ভালো।দুপুরে খেয়েছে ঠিকমত।'
সুলেখা ওর হাতে তুলে দেন ফল আর হর্লিক্স আর পঞ্চাশটি টাকা-'দাদুকে দেখিস'।
মায়া মেয়েটি ঘাড় নাড়ে-'ভেবো নাতো তুমি; আমি থাকতে দাদুর কোনো অসুবিধে হবে না।'
সুলেখা শিবনাথের কপালে হাত বুলিয়ে দেন প্রতিদিন। শিবনাথের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে রোজ।ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়।
৩
পালবাবুর সঙ্গে গায়ত্রীর আজ বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে।বছর পাঁচেকের নতুন আসা মেয়েটির জ্বর আজ দুদিন। কোনো ওষুধ পড়ে নি এখনও।
পালবাবু বলেন 'ও কিছু নয়। আপনি উতলা হন বড় বেশি। সীজন চেঞ্জের সময় অমন হয় একটু আধটু। আজকের রাত টা দেখে কাল ডাক্তার দেখাবো।'
গায়ত্রী উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করবেন বলে শাসিয়েছেন।
এখন মনে হচ্ছে হয়ত বাড়াবাড়ি হয়েছে।সেই মুহূর্তে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।
অসহায় শিশুসব। মা নেই । বাবা নেই। অথবা আছে। ঘরে নেয় না। নিতে পারে না। এরকম তো হয়। আগেও হ'ত।
দেশভাগের প্রবল ডামাডোলের সময় পূর্ববঙ্গের এক গ্রামে কোনো এক কিশোরী গর্ভবতী হয়েছিল।বড়দাদা আর কাকা কলকাতায় নিয়ে আসেন তাকে।একটি কন্যাসন্তান জন্মায়। জারজ সন্তানটিকে রেখে আসা হয় কলকাতার একটি অনাথ আশ্রমে। কেউ টের পায় না।কিশোরীটি যুবতী হয়, ক্রমে প্রৌঢ়াও। ঘর বসায় না।
বাড়ী ফিরছেন গায়ত্রী। কান মাথা ঢেকেছেন শালে। ছায়াটি সঙ্গে হাঁটে। শীত করে বড়।
৪
প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢোকার অপেক্ষায় সুলেখা।দেখতে পেলেন গায়ত্রী ঢুকছেন শাল জড়িয়ে।
-'আজ বেশ শীত'।
-'এই সময় ফেরেন আজকাল?দেখা হয় না তো-'
-তাড়াতাড়ি ফিরি, আজ দেরী হ'ল।অন্ধকার হয়ে যায়... হাঁটতে অসুবিধে...'
পাশে এসে দাঁড়ান গায়ত্রী।
-'আপনার আত্মীয় এখনও হাসপাতালে? কেমন আছেন?'
--'একই রকম।আর কেউ নেই ওঁর। সংসার করেন নি। অনেক করেছেন আমাদের জন্য.... আমার স্বামী চলে গেলেন, তারপর উনি-ই... অনেক করেছেন।' সুলেখার গলা ভারী হয়।
গায়ত্রী হাত ধরেন সুলেখার-'আসুন। ট্রেন ঢুকছে'।
অজস্র মুখ। বাড়ী ফেরে। বৈধ সম্পর্ক অথবা শূণ্যতার কাছে।
স্টেশনে যাওয়ার এই একটি-ই রাস্তা।পুজোর মুখে সামান্য নুড়ি আর পিচের প্রলেপ, বছর না ঘুরতেই খানা খন্দগুলি আবার পরিস্ফুট। দুপাশে ছোটো ছোটো দোকান-সারদা মেডিকেল হল, কাকলি স্টেশনারিজ, মা তারা সুইট্স। রাস্তা আর দোকানের মধ্যবর্তী অপ্রশস্ত চাতালে সকালে ফুল, মালা, বিকেলে পেয়ারা আর কেরোসিন। জেরক্সের দোকানে কোচিং ফেরত ভীড় সন্ধ্যা নাগাদ।
দুপুরবেলা পথটি নিরিবিলি।রূপায়ণ টেলার্সের সেলাই মেশিন আর লালার আটাচাক্কির সামান্য আওয়াজ।
সুলেখা এই সময় বেরোন। শিয়ালদার ট্রেন ধরেন সপ্তাহে দুদিন।
এই সব দোকানপাট পরিচিত এখন, গলিঘুঁজিও সড়গড়। এক বছরের বেশি-ই হয়ে গেল এই অঞ্চলে।খাস কলকাতায় বছর তিরিশেক চাকরির পরে মফস্বলে তিন কামরার ফ্ল্যাট। একাই থাকেন।স্বামী গত হয়েছেন বহুবছর।আর মেয়ের সংসার মালদায়।
কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল।সাদা শাড়ীটি গোড়ালির ওপর আলগোছে তুলে হাঁটেন সুলেখা।ওভারব্রিজ পেরিয়ে টিকিটঘর। প্ল্যাটফর্মে নামতেই বোঝেন ট্রেনের গোলমাল।শনিবারের দুপুরে প্ল্যাটফর্মে বেশ ভীড়। ঘোষক জানাচ্ছেন, পরবর্তী ডাউন ট্রেন আসতে এখনও ঘন্টা দেড়েক।
এতগুলো সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে সুলেখা ঘামছিলেন। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে আলতো মুখ মোছেন। দেড়-দুঘন্টা পরের ট্রেনে ওঠা তাঁর পক্ষে অসম্ভব-এখনই স্টেশনে যা ভীড়। ফিরতেও অনেক রাত হয়ে যাবে। ফিরে যাওয়াই ভালো।
-'মিনিবাসে যাবেন?'
পাশেই দাঁড়িয়ে আর একজন সাদাখোলের শাড়ী, সবজেটে পাড়। তাঁরই মত । চোখে চশমা, শ্যামবর্ণা , দীর্ঘাঙ্গী।
-'পরের ট্রেন আসার আগেই শিয়ালদা পৌঁছে যাবো। আপনিও তো শিয়ালদায় যাচ্ছেন?'
মহিলাকে এবার চেনা ঠেকে সুলেখার। তাঁদেরই পাড়ার। দেখেছেন আগে। মুখচেনা। এই টুকুই।
সুলেখা এই বয়সেও মুখচোরা। কিছু বলার আগে তিনবার ভাবেন। সবুজ পাড় নিজেই বলেন-'একটা মিনি বোধ হয় এক্ষুণি ছাড়বে, চলুন যাই।'
সুলেখা চলতে থাকেন সবুজ পাড়ের সঙ্গে।স্টেশন থেকে বেরিয়েই মিনিবাসের স্ট্যান্ড। একটা বাস ভর্তি।দুজনে পরের বাসে ওঠেন।পাশাপাশি সিট পেয়ে যান। বাসটিও ছেড়ে দেয় মিনিট দশেকের মধ্যেই।
জানলার ধারে সুলেখা। বাস ছাড়তেই এক ঝলক হাওয়া কপালের ঘামে।সবুজ পাড়ের দিকে ফিরে বলেন, 'মৌরী খাবেন?'
এইবার দুজনের গল্প জমে উঠতে থাকে। স্টেশন রোডের পিন্টু লটারি, খোকন রোল সেন্টার, অন্নপূর্ণা বস্ত্রালয়, রূপলেখা সিনেমা পেরোয় বাসটি । সুলেখার জানা হয়ে যায় সবুজ পাড়ের নাম। গায়ত্রী একটি মেয়েদের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। স্কুলের স্থপতি-ই বলা চলে। নদীয়ায় স্কুলটি।ওখানে বাসাভাড়া করে থাকা আর ছুটিছাটায় ভাইএর কাছে আসা। বিয়ে করেন নি।
-'আপনাকে দেখি মাঝে মাঝেই। ট্রেনে। কথা হয় নি এতদিন'।
-'শনি রবি ফাঁকায় ফাঁকায় শিয়ালদার দিকে যাই। '
-'কোনো মন্দিরে?'
-'না, একজন অসুস্থ।দেখতে যাই। আপনিও কি রোজ এই সময় বেরোন?'
-'ঐ ছুটিতে যখন আসি তখন।একটা অনাথ আশ্রমে যাই মাঝে মাঝে'।
-'খুব ভালো কাজ করছে তো আপনি, বাঃ-' সুলেখা মুগ্ধ হন।
-'আপনিও তো এই বয়সে এত দূরে অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে যান। কে করে বলুন আজকাল এসব?'
দুজনে হাল্কা হাসেন।
শিয়ালদা আসার একটু আগে নেমে যান গায়ত্রী। মিনিটি সুলেখাকে নিয়ে শিয়ালদায় পৌঁছয়। দেড় ঘন্টা সময়টুকু দিব্যি কাটলো মনে হতে থাকে সুলেখার।মৌরী মুখে দিয়ে হাঁটতে থাকেন।
পুজোর ছুটিতে গায়ত্রী আর সুলেখার দেখা হতে থাকে প্রতিটি শনি-রবিবারেই। জানা হয়ে যায় , সুলেখার মেয়ে- জামাই-নাতি দার্জিলিং বেড়াতে গেছে আর গায়ত্রীর ভাই- ভাইবৌ-ভাইপো পুরীতে।জানা হয়ে যায় সুলেখা রিটায়ার করার ছমাসের মধ্যেই পেনশানের কাগজপত্র হাতে পেয়ে গেছেন আর গায়ত্রীর রিটায়ারমেন্টের আরো বছর দুই বাকি।জানা হয় গায়ত্রী মাঝে মাঝে গলস্টোনের ব্যথায় ভোগেন , পরের ছুটিতেই হয়তো অপারেশন করবেন। সুলেখা ভোগেন স্পন্ডিলাইটিসে-বেল্ট পরতে হয় কোমরে যখন বাড়াবাড়ি হয়। গায়ত্রীর ভাই,ভাই বৌ খুব ভালো আর ভাইপোটি পিসিকে খুব ভালোবাসে । সুলেখা এই শীতেই মালদা যাবেন-নাতির জন্য তাঁর মন পোড়ে।
টুকরো টাকরা ঘরোয়া কথা সব-
তারপর সুলেখা চলে যান হাসপাতালে অসুস্থ আত্মীয়র কাছে আর গায়ত্রী আশ্রমে।সন্ধ্যেয় বাড়ী।রিটার্ন টিকিট কাটাই থাকে।
২
শীতের সন্ধ্যেয় তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে যায়।সুলেখা তাই একটু আগে বেরোচ্ছেন। অন্ধকারে অসুবিধে হয় পথ চলতে।
ট্যাক্সি আর অটোর ভীড় হাসপাতালের মুখটায়। একপাশে কমলালেবুর পিরামিড।উস্কো চুল লালচে চোখ কিছু মানুষ। দেহাতী বৌটি আঁচলের আড়ালে বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছে । অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াচ্ছে।
সুলেখা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন।
চোখ বুজে শুয়ে আছেন শিবনাথ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ।
সুলেখা এসে দাঁড়ান। শিবনাথের কপালে হাত ছোঁয়ান। চোখ খুলে ম্লান হাসেন শিবনাথ। সুলেখা টুলে বসেন। নীলপাড় শাদা শাড়ী মেয়েটি সুলেখার কাছে এসে বলে,'দিদা এসেছ?দাদু আজ ভালো।দুপুরে খেয়েছে ঠিকমত।'
সুলেখা ওর হাতে তুলে দেন ফল আর হর্লিক্স আর পঞ্চাশটি টাকা-'দাদুকে দেখিস'।
মায়া মেয়েটি ঘাড় নাড়ে-'ভেবো নাতো তুমি; আমি থাকতে দাদুর কোনো অসুবিধে হবে না।'
সুলেখা শিবনাথের কপালে হাত বুলিয়ে দেন প্রতিদিন। শিবনাথের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে রোজ।ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়।
৩
পালবাবুর সঙ্গে গায়ত্রীর আজ বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছে।বছর পাঁচেকের নতুন আসা মেয়েটির জ্বর আজ দুদিন। কোনো ওষুধ পড়ে নি এখনও।
পালবাবু বলেন 'ও কিছু নয়। আপনি উতলা হন বড় বেশি। সীজন চেঞ্জের সময় অমন হয় একটু আধটু। আজকের রাত টা দেখে কাল ডাক্তার দেখাবো।'
গায়ত্রী উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়েছেন। কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করবেন বলে শাসিয়েছেন।
এখন মনে হচ্ছে হয়ত বাড়াবাড়ি হয়েছে।সেই মুহূর্তে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।
অসহায় শিশুসব। মা নেই । বাবা নেই। অথবা আছে। ঘরে নেয় না। নিতে পারে না। এরকম তো হয়। আগেও হ'ত।
দেশভাগের প্রবল ডামাডোলের সময় পূর্ববঙ্গের এক গ্রামে কোনো এক কিশোরী গর্ভবতী হয়েছিল।বড়দাদা আর কাকা কলকাতায় নিয়ে আসেন তাকে।একটি কন্যাসন্তান জন্মায়। জারজ সন্তানটিকে রেখে আসা হয় কলকাতার একটি অনাথ আশ্রমে। কেউ টের পায় না।কিশোরীটি যুবতী হয়, ক্রমে প্রৌঢ়াও। ঘর বসায় না।
বাড়ী ফিরছেন গায়ত্রী। কান মাথা ঢেকেছেন শালে। ছায়াটি সঙ্গে হাঁটে। শীত করে বড়।
৪
প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢোকার অপেক্ষায় সুলেখা।দেখতে পেলেন গায়ত্রী ঢুকছেন শাল জড়িয়ে।
-'আজ বেশ শীত'।
-'এই সময় ফেরেন আজকাল?দেখা হয় না তো-'
-তাড়াতাড়ি ফিরি, আজ দেরী হ'ল।অন্ধকার হয়ে যায়... হাঁটতে অসুবিধে...'
পাশে এসে দাঁড়ান গায়ত্রী।
-'আপনার আত্মীয় এখনও হাসপাতালে? কেমন আছেন?'
--'একই রকম।আর কেউ নেই ওঁর। সংসার করেন নি। অনেক করেছেন আমাদের জন্য.... আমার স্বামী চলে গেলেন, তারপর উনি-ই... অনেক করেছেন।' সুলেখার গলা ভারী হয়।
গায়ত্রী হাত ধরেন সুলেখার-'আসুন। ট্রেন ঢুকছে'।
অজস্র মুখ। বাড়ী ফেরে। বৈধ সম্পর্ক অথবা শূণ্যতার কাছে।
Comments
Post a Comment