সন্ন্যাসী দাদু

জীবনের পথ বলতে যা বোঝায় সেই অর্থে এযাবত্ বাবাজীদের সংস্পর্শে আসা হয় নি; জীবনের গোড়াতে আমার সন্ন্যাসী দাদুকে দেখেছিলাম আমাদের বাড়ীতে এক সকালে।
তিনি আমার ঠাকুমার দাদা, বাবার বড়মামা।বাবার ছোটোমামা অঙ্ক পাগল ছিলেন শুনেছি, আঁক কষতে কষতে নদীতে স্নান করছিলেন, আর ওঠেন নি।ঠাকুমার তাই গভীর দু:খ ছিল দাদা/ভাইদের ব্যাপার স্যাপারে।

আমাদের কোনো আত্মীয় হরিদ্বারে গেলেই , ঠাকুমার কঠোর নির্দেশ মেনে সন্ন্যাসী দাদুর সঙ্গে দেখা করে আসতেন,ঠাকুমার দেওয়া টাকা পৌঁছে দিতেন তাঁরা কলকাতায় ফিরলেই ঠাকুমার অনিবার্য্য প্রশ্ন-'হ্যায় কিছু জিগায়?'অর্থাত্, পূর্বাশ্রমের কথা কিছু তিনি শুধোন কি না।

আমি নিজেও একটু বড় হয়ে পোস্টাপিস থেকে এম ও করেছি হরিদ্বারে; প্রতিবারই শুদ্ধ ভাষায় লিখতে হ'ত-আশ্রমের সেবার জন্য এই টাকা পাঠাইলাম, গ্রহণ করিলে বাধিত হইব-বিনীতা ইত্যাদি।

আমার বয়স যখন ৪ কি ৫, আমি সন্ন্যাসী দাদুকে দেখি।বেশ মনে আছে, সকাল থেকেই বাড়ীতে সাজ সাজ রব, প্রচুর আত্মীয় স্বজন এলেন, আমাদের স্নান টান করিয়ে দেওয়া হয়েছিল ভোর হতে না হতেই। তারপর তিনি এলেন-আমি সন্ন্যাসী বলতে ততদিন বিবেকানন্দ কেই বুঝতাম-সেইরকমই তেজস্বী চেহারা কল্পনায় ছিল-সন্ন্যাসী দাদু-কে দেখে তাই হতাশ হলাম-আমার কুটুরি বুটুরি ঠাকুমাকে গেরুয়া পরিয়ে দিলে ওরকমই দেখাবে।
তা, তিনি বসার ঘরে গালচেয় বসলেন -একটা বড় বাটিতে কাজু আর কিশমিশ রাখা ছিল, সবাইকে এক মুঠো করে দিচ্ছিলেন; আমিও পেলাম।
এক মুঠো পেয়ে যথারীতি বাঁ হাত বাড়িয়েছি কি বাড়াই নি, আমাকে কোলে করে কোনো গুরুজন ঘর থেকে বের করে আনলেন-সেই কাজু কিশমিশের দু:খ আমার আজও যায় নি।
এরকম অবশ্য আমার খুব হয়-পঁচিশ বছর আগে কোন্ বিয়েবাড়ীতে পেট ভরে গেছিল তাই লেডিকেনি টা খাওয়া হয় নি-সে কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায়
...

সন্ন্যাসী দাদু সেদিন কেন এসেছিলেন জানি না, আর আসেন নি কখনও। ঠাকুমা প্রায়ই দাদার কথা বলতেন-আমাদের কোনো আত্মীয়, সন্ন্যাসী দাদুর একটি সাদা কালো ছবি তুলে এনেছিলেন তাঁর বক্স ক্যামেরায়-সেইটি বাঁধিয়ে ঠাকুমা তাঁর পুজোর ঘরে রেখেছিলেন, দেব দেবীদের সঙ্গে তাঁকেও ধূপ দেখাতেন খুব সম্ভব।

শেষের দিকে অনেকে বলেছেন, সন্ন্যাসী দাদু নাকি আত্মীয় স্বজনদের কথা জিগ্যেস করতেন, 'হ্যায় আজকাল কিছু জিগায়' জেনে ঠাকুমা খুশী হয়েছিলেন না ধূপ দেওয়া বন্ধ করেছিলেন -জানি না। সন্ন্যাসী দাদুর মৃত্যুর খবর ঠাকুমাকে জানানো হয় নি, মানি অর্ডার-ও অব্যাহত ছিল আশ্রমের সেবায়।তবু বোধ হয়, আঁচ করেছিলেন কিছু
... ঠিক বলতে পারবো না। খুব কান্নাকাটি করতেন-'হ্যায় বুঝি আর নাই'। তা তিনিও তার এক বছরের মধ্যেই গত হন।

আমার সেই ৪/৫ বছরের স্মৃতির কতটা সত্যি কতটা কল্পনা আমি জানি না-আমার স্পষ্ট মনে পড়ে সন্ন্যাসী দাদুকে পা ধুইয়ে পা মুছিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সবাই বলেন এরকম হয় নি নাকি
... কে জানে?কাজু কিশমিশ-ও সত্যি কি না তাই বা জানে কে?
কিন্তু ঐ সাদা কালো ছবিটা ভীষণ সত্যি-যেটাতে আমার ঠাকুমা দাঁড়িয়ে আছেন সন্ন্যাসীর বেশে, ব্যাকগ্রাউন্ডে হরিদ্বারের গঙ্গা-সেটা আছে এখনও।
আছে? না কি নেই?

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস