নিছক ব্যক্তিগত, অথবা --



তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। কথা তো ছিল না এমন।
পুজো আসে, পুজো যায়। আমাদের বয়স বাড়ে।বিজয়ার প্রণাম সারি ফোন অথবা ইমেলে। আমাদের জানা থাকে, পরের বিজয়ায় প্রণাম করার লোক আরো কমে যাবে। আমরা প্রস্তুত থাকি।
এবারে তৈরী ছিলাম না। আমাদের আর দেখা হবে না।এরকম তো কথা ছিল না।

অসম-আগরতলা ন্যাশনাল হাইওয়েতে তোমার বাস মিলিটারি এসকর্ট ভেঙে ওভারটেক করবে -- কথা ছিল না। পথের দু'ধারের পাহাড়ে সিকিউরিটি ফোর্স সেদিন অনুপস্থিত -- কথা ছিল না।একাদশীর সকালে, একটিমাত্র বুলেট এসে বিঁধবে শুধু তোমাকেই, পুজোর শাড়ী পরা, জানলার ধারে বসা শুধু তোমাকেই -- কথা ছিল না।

তুমি আমার আপনজন -- তীব্র এবং তীব্রতর ট্রমা আমাকে গ্রাস করে নিমেষে। শোকবার্তায় আমার মেল বক্স ভরে যায়, আই এস ডি আসে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। মৃতের মুখ এক্ষেত্রে আমাদের চেনা। আমরা সবাই বিপর্যস্ত। ট্রমাটাইজড।

কাশ্মীরের রাস্তায়, এই বর্ষায় তুমিও ছিলে টুরিস্টবাসের জানলার পাশটিতে। মর্টার এসে পড়বে-কথা ছিল না।
আর তুমি ফিরছিলে অফিস থেকে-ভায়ান্দার, বোরিভিলি, যোগেশ্বরী, খার অথবা মাহিম স্টেশন হয়ে। তোমার আর বাড়ী ফেরা হয় নি। কথা ছিল না।
অথবা ছিল।যে কারণে, জাফনার তামিল মেয়েটি লাঞ্চরুমে ডুকরে ওঠে। ট্রেনের কামরায়,মধ্যপ্রাচ্যের যুবক সকালের ট্যাবলয়েড ছুঁড়ে ফেলে দুহাতে মুখ ঢাকে। আফ্রিকান বালক নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে কেবলই ছবি এঁকে চলে -- "আমার বাড়ী এরকম ছিল। আমার বাপ কাকারা এরকম দেখতে ছিল।' পূর্ব ইউরোপের মানুষটি পেন্সিলকাটা ছুরি দিয়ে ট্রেনের জানলার কাঁচে কেবল লিখেই চলেন -- টীয়ার্স,টীয়ার্স,টীয়ার্স।

তোমাকে আমি চিনি,তোমাকে আমি চিনি না। আজ তুমি নিকটজন, কাল শুধুই বেওয়ারিশ লাশ। তোমাকে চিনে কষ্ট পাই,না চিনে উদাসীন থাকি।
আমি আছি খবরের কাগজ, কম্পিউটার স্ক্রীন অথবা টেলিভিশনে চোখ রেখে। তুমি শরীরে বুলেট নিয়ে শুয়ে থাকছ অসম-ত্রিপুরা জাতীয় সড়কে, বোরিভিলি স্টেশন চত্বরে, জাফনায়, ইরাকে, লেবাননে। তোমার হাতের কবিতার বই অথবা বেবিফুডের টিন কিম্বা নাইলনের জালিব্যাগের কমলালেবু তোমার রক্তে ভিজে খবর হয়ে যাচ্ছে। সকালের কাগজের হেডলাইন। টিভি স্ক্রীনে তোমাকে দেখা যাচ্ছে। যে তুমি মৃত্যু মুহূর্তের সামান্য আগেই হয়ত ভাবছিলে ইশকুলে আসন্ন ট্র্যান্সফার, বুড়ো বাপ মা, ভাইপো ভাইঝির কথা কিম্বা না লেখা কবিতার দুটি লাইন, সেই তুমি নয়নবাসী জামাতিয়া , বিশ্বমোহন দেববর্মা আর এন এল এফ টির সঙ্গে ফ্রন্টপেজে চলে আসছ। বেবিফুডের টিন হাতে হেডলাইন হয়ে যাচ্ছ মাওবাদ আর ল্যান্ড মাইনের সঙ্গে। এইভাবে তোমার নাইলনের জালিব্যাগ থেকে গড়িয়ে পড়া কমলালেবু, শিবসেনা, আল কায়দা একাকার হয়ে যাচ্ছে -- কী অসম্ভব নিরর্থক। কী অসম্ভব নিরর্থক।

আমিও বাসে জানলার ধারেই বসি, অফিস ফেরত ট্রেন ধরে বাড়ী ফিরি -- তোমার মতই।
যে কোনোদিন যে কোনো মুহূর্তে আমি তোমার জায়গাটা নিয়ে নেব।সে'রকমই কথা আছে।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস