আইকম্ বাইকম্ গপ্পগাড়ি
রোববারের সকালটি ঈষৎ অন্যরকম যেন। যদু মাস্টাররা আজ শ্বশুরবাড়ি যাবেন না। ছেলেপিলের হাত ধরে সোজা এসেছেন সিডনি সে¾ট্রাল স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে স্টিমে টানা পুরোনো ইঞ্জিন, সঙ্গে ছোট ছোট আটখানি বগি। সে¾ট্রাল থেকে স্ট্র্যাথফিল্ড, লিডকোম্ব, ব্যাঙ্কসটাউন, সিডেনহ্যামের বৃত্তপথে আবার সে¾ট্রালে ফিরে আসা। বসন্তের বই সপ্তায় চিল্ড্রেন্স বুক কাউন্সিল অফ অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগ এই স্টোরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস। গপ্পগাড়ি।
প্ল্যাটফর্মে কাউন্সিলের স্টল। যদু মাস্টারের পকেট কিছু খালি হল শুরুতেই। বাচ্চাদের হাতে এল এক ব্যাগ বই, ব্যাজ, পেন্সিল কেস, বেলুন, এটা সেটা। প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়ায় বই-এর পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র সব। ব্যাগি গ্রিন ইউনিফর্মে গল্পগাড়ির কর্মীদের হাসিমুখ। উষ্ণ অভ্যর্থনা। অল অ্যাবোর্ড। সিগনাল সবুজ। গপ্পের চাকা নড়ে উঠল।
ছোট ছোট পুরোনো বগি। আনাচে কানাচে ভিড় করে আছে গপ্পরা। অবয়বহীন আপাতত। অন্দরসজ্জায় মনে হয় এই বুঝি গোঁফ চুমরে বেরিয়ে এলেন এরকুল পোয়ারো। না, এরকুল নন, কামরায় ঘুরে বেড়ায় উইচ, ডরোথি, অ্যালিস, কাকতাড়ুয়া। অথবা স্টোরিটেলারের ব্যাজ এঁটে স্বেচ্ছা-গল্পবলিয়ে। বাচ্চার ঘিরে ধরেছে তাদের। একধারে টেবিলে রাখা বই। বিস্তর। বিক্রির জন্য। এক এক করে কামরায় আসছেন এখানকার শিশু ও কিশোর সাহিত্যের বিখ্যাত সব লেখক আর ইলাসট্রেটর। পামেলা ফ্রিডম্যান, অ্যালান বেইলি, সুজান জার্ভে, দেভ অ্যাবেলা, জুলি ভাইভাস, ক্রিস চেং। অকাতরে অটোগ্রাফ বিলোন। গল্প বলেন। নিজের লেখা পড়ে শোনান। প্রশ্নের উত্তর দেন। কু ঝিক ঝিক গল্পগাড়ি স্ট্র্যাথফিল্ড পেরোয়।
একটি কামরায় দেখা হয়ে যায় সুজান জার্ভের সঙ্গে। হাসিমুখ, একমাথা এলোমেলো সোনালি চুল। জমিয়ে গল্প করেন। কিশোর সাহিত্যে সুজানের বেস্ট সেলার "আই অ্যাম জ্যাক' এবং সিকোয়েল "সুপারজ্যাক' আর "বাটারফ্লাই'। "আই অ্যাম জ্যাক' পড়তে পড়তে মনে হতেই পারে মনোজদের অদ্ভুত বাড়ির কথা। সুজান নিজেই বললেন, "আই অ্যাম জ্যাক অ্যান্ড সুপারজ্যাক আর ইনস্পায়ার্ড বাই মাই ওয়ান্ডারফুল ক্রেজি ফ্যামিলি।'
"বাটারফ্লাই' আবার সম্পূর্ণ বিপরীত -- নিতান্ত শৈশবে দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়া একটি মেয়ের বয়:সন্ধিকালীন একাকিত্ব এবং তা অতিক্রম করে যাওয়া। অনেক গল্প করলেন সুজান। সৎ লেখার কথা বললেন বারেবারে। বাচ্চাদের বললেন লিখে যেতে, শুধু লিখে যেতে -- "জাস্ট লেট ইয়োরসেল্ফ গো'।
এরপর, এ-কামরা থেকে সে-কামরা। বই কেনা। লেখকের মুখোমুখি হওয়া। কুইজের উত্তর দেওয়া। গপ্পের চাকা সিডেনহ্যাম তক। পথ ফুরোচ্ছে দ্রুত। এ যাবত কোকের ক্যান আর কমিক্সে ডুবে থাকা সহযাত্রী কিশোরের হাতে উঠে আসছে "বাটারফ্লাই'। কিশোরীর আকুল জিজ্ঞাসা "লিখতে চাই, লিখতে চাই, কেমন করে লিখব?' এই সব।
লেখক-পাঠক কথোপকথনে ছেলেপুলের তুলনায় বাবা-মাদের উৎসাহই বেশি যদিও। তবু, হয়তো এইভাবেই, একদিন দেখা হয়ে যাবে জামাল ওয়ালেস আর উইলিয়াম ফরেস্টারে গল্পগাড়ির কামরায়। দাগা বুলোতে বুলোতে নিজস্ব লেখাটি লিখে ফেলবে নবীন কিশোর। স্বেচ্ছানির্বাসন ভেঙে বেরিয়ে আসবেন অভিমানী লেখক। উত্তরাধিকার বাহিত হবে। হয়তো।
হয়তো, সেই বিশ্বাসেই, যাত্রা শেষের সামান্য আগে, কামরার আনাচ-কানাচে লুকিয়ে থাকা গপ্পের একটি সামনে আসে। হঠাৎ। একটি লিফলেট। জানা গেল, এই স্টিম ইঞ্জিন, এই কামরা সব এ যাবত থ্রি ওয়ান জিরো এইট লিমিটেড কোম্পানি দেখাশোনা করে এসেছে। হেরিটেজ ট্রেন ট্রিপ চালু রেখেছে আজ কুড়ি বছর -- সিডনি থেকে সে¾ট্রাল কোস্ট বা সাদার্ন হাইল্যান্ড-জর্জেস রিভারের পাশ দিয়ে, আঁধারময় ওটফোর্ড টানেলের ভেতর দিয়ে উলংগং-এর পাহাড় আর সমুদ্রে। আর মাত্রই তিন মাস। তারপর বন্ধ হয়ে যাবে থ্রি এইট জিরো ওয়ান লিমিটেড। স্টিম ইঞ্জিনটি চলে যাবে নিউ সাউথ ওয়েল্স ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়ামে। কামরাগুলি নিয়ে নেবে নিউ সাউথ ওয়েলস রেলকর্প-ব্যাকপ্যাকাররা থাকবে এসে। বিশিষ্ট লেখককুল, পাঠকবৃন্দ যদি নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ারকে অনুরোধ করেন, তবে এ যাত্রা গপ্পটির পরিণতি বিয়োগান্ত হয় না। লিফলেটের বক্তব্য এইটুকুই।
লক্ষণ তেমন নয় যদিও। সে¾ট্রালে কোঁচা সামলে নেমে যাচ্ছেন যদু মাস্টার। জামাল আর ফরেস্টার ঠিকানা বিনিময় করছেন। ঝোলাব্যাগের দুরূহ কোণে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে লিফলেট, প্রিমিয়ারের ঠিকানা সহ; দুয়েকটি হাত ফস্কে হাওয়ায় লাট খাচ্ছে অথবা ঝকঝকে নতুন বইয়ের পেজমার্ক হিসেবে উঁকি দিচ্ছে। ফ্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হচ্ছে ক্রমশ।
তাহলে? থ্রি এইট জিরো ওয়ানের কর্মীদের ভবিষ্যৎ? প্রিমিয়ারমশাইকে লিখে কাজ হবে? আদৌ লিখবেন কেউ? যদু মাস্টার সামান্য অন্যমনস্ক এই মুহূর্তে। পকেটের কলমটি সুড়সুড়ি দেয়।
গল্পগাড়ি তার বাঁশি বাজাল -- টুউউট, টুউউট। স্টিম মিশল বাতাসে। মুচকি হেসে পষ্ট বলে গেল -- "অমাবস্যা। ঘোড়ার ডিম।'
Comments
Post a Comment