এলিজি

প্রকাণ্ড হাঁসের পিঠে উড়ে বেড়াচ্ছি; পায়ের তলায় ময়দার দলার মতো মেঘ, তারও নিচে চৌকোনা জমি - সবুজ, হলুদ, বাদামী, লালচে রঙের খোপ পাশাপাশি; যেন বুড়ো আংলার মলাট আচমকা থ্রি ডি হয়ে গিয়ে আমাকে টেনে নিয়েছে তার ভিতরে। সামান্য মাথা ঘুরছিল তারপর হঠাৎ খুব শীত করে উঠল - মনে হল ঠাণ্ডা জলে পড়ে গিয়েছি। ধড়মড়িয়ে উঠে দেখি , গায়ের ওপর থেকে কখন যেন লেপ সরে গিয়েছে, মুখের ওপর মশারি ঈষৎ ঝুঁকে - ঘোলাটে অন্ধকার আর ন্যাপথালিনের গন্ধে সমস্ত ঘর থম মারা। লেপের তলায় শীত করছিল। পুরোনো স্যাঁতানো লেপ। তবে ওয়াড় খড়খড়ে নতুন। আমি আসব বলে মীরাদি সদ্যই কিনে এনেছে হয়তো। শোয়ার সময় খেয়াল করেছিলাম,  বালিশের ঢাকনা , বিছানার চাদর সব নতুন;  বালিশের ওপর ছোটো তোয়ালেতে দামের স্টিকার আটকে রয়েছে। মীরাদি বিসলেরির বোতল খাটের পাশে রেখে দিয়ে বলেছিল, " একটা লেপে হবে তোমার? পায়ের কাছে কম্বল রাখব? শীত করলে টেনে নিও।" " তেমন ঠাণ্ডা নয় তো"- পায়ের কাছে আবার একটা কম্বলের উপস্থিতি অস্বস্তিকর মনে হয়েছিল। রাতে সত্যি তেমন শীতও করে নি । অথচ এখন করছে। লেপটা মাথা অবধি টেনে স্বপ্নের কথা ভাবছিলাম; লেপের খোলে প্রাচীন শিমূল তুলোরা সব ড্যালা পাকিয়ে গিয়েছে- হাত বোলালে টের পাওয়া যাচ্ছিল। তখনই মনে হল, শীতকালে তুলোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই বহুদিন, ইদানিং ঠান্ডা মাপি মরা রাজহাঁস গুণে;  কাল বিকেলে  যে জ্যাকেট পরে প্লেন থেকে নেমেছি,  তার লাইনিংএর ভিতরে যতগুলো পালক , তা অন্তত কুড়ি বাইশটা হাঁসের শরীরের। আমার সুটকেসে আরো জ্যাকেট - কোনোটায় তিরিশ, কোনোটায় পঞ্চাশটা পাখির পালক  - শীতলতর দিন ও রাতগুলির জন্য। স্বপ্ন ছাড়াও, এই শীতের ভোরে হাঁসদের কথা ভাববার আরো কারণ ছিল।

এই ছোটো শহরে শীত আর তেমন জাঁকিয়ে পড়ে না- কাল এয়ারপোর্ট থেকে এ বাড়ি আসার পথে  মনে হয়েছিল। জ্যাকেট খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিয়েছিলাম;  দেখছিলাম, সূর্যাস্তের পরে বাতাসে পিএম টেনরা একে একে গেঁথে গিয়ে ধোঁয়ার চাদর তৈরি করে ফেলেছে; শহরের ওপরের এই আস্তরে উত্তরের হাওয়া ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে ;  নাছোড়বান্দা যেটুকু যা চুঁইয়ে ঢুকছিল, তারই প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়েছে পথচলতি লোকজন ।  মনে হচ্ছিল, এখন স্রেফ  ক্যালেন্ডারের তারিখ দেখে মানুষ তোরঙ্গের ডালা খোলে কিম্বা আলমারির পাল্লা- ন্যাপথালিন দেওয়া টুপি সোয়েটার বের করে আনে অথবা সটান শপিং মল থেকে ব্যাগ বোঝাই শীতবস্ত্র -  সেই সমস্ত জামা কাপড় যেন এই ডিসেম্বরের শুরুতেই পরে ফেলতে হবে।  গরম লাগছিল মানুষের রকম দেখে। সেই তাপ সম্ভবত এ বাড়িতে বয়ে এনেছিলাম। আর ভয়। কিম্বা প্রবল অস্বস্তি। মায়ের মুখোমুখি হওয়ার। ভয়ের শৈত্যকে বিরক্তির গরম কাউন্টার করছিল প্রথমটায়, এখন দেখছি, শীতই জিতে গিয়েছে। মফস্সলের ভোরবেলার ঠাণ্ডা আর বিচিত্র সব চিন্তা ছেঁকে ধরেছে। মনে হচ্ছিল, একজন মানুষ তার সমস্ত জীবনে কতগুলি মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকে?   গাছ হোক, হাঁস হোক, অথবা মানুষ - নিকটজন বা অপরিচিত? সে কি সমস্ত মৃত্যুগুলিকে চিহ্নিত করতে পারে? দোষ স্বীকার করে?  ক্ষমা চায়? কার কাছে? বন্ধ ঘরে এই সব কথা ধুলোর রেণুর মত ভেসে ছিল; ঘুলঘুলি দিয়ে সকালের রোদ ঢুকলো ত্যারছা হয়ে আর সমস্ত ভাসমান জিজ্ঞাসা যেন দৃশ্যমান হল; লেপের তলায় সাময়িক আড়াল খুঁজতে লাগলাম কারণ আমার নিজস্ব বর্ম গতমাসেই চুরমার হয়ে গিয়েছে। 

আসলে, গত দু বছর এ বাড়িতে  আসি নি,  বুকু চলে যাওয়ার পরেও নয়। ছোটো মাসি, মেসো, খুশিদি, পিন্টুদা সবাই নাগাড়ে ফোন করে সান্ত্বনা দিয়েছে, মায়ের কাছে আসতে বলেছে তারপর আমার শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত হয়েছে- যেন এসব আমার ওপর বুকুর ঘটনার স্বাভাবিক অভিঘাত; আমার লুকিয়ে বেড়ানোর আসল কারণ ওদের অজানা। জানে শুধু মা। মীরাদি কতটা কী জানে বোঝা মুশকিল। এই দু’বছর  ফোনে মীরাদিকে জরুরী কুশল প্রশ্ন সেরেই ব্যস্ততার ভান করেছি  অথবা  কানেক্টিভিটির সমস্যার অজুহাতে মায়ের সঙ্গে সরাসরি কথা এড়িয়ে গিয়েছি ; অমানুষিক পরিশ্রম করেছি অফিসে; জামা জুতো জ্যাকেট, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, এন্তার ঘুরে বেড়ানোতে খরচও করেছি দুহাতে। নিজের গড়ে তোলা এই জাড্যে অভ্যস্ত হয়ে যেতে চাইছিলাম যেন এক কৃত্রিম মাতৃজঠরে নতুন করে জন্মাতে চাইছি;  অ্যামনিওটিক স্যাক নয়, আসলে ওটা শস্তা বেলুন বুঝতে পারলাম যখন গতমাসে অনুরাধা অনায়াসে এই আবরণ ভেঙে দিল।  অনুরাধা এ শহরে এসেছিল ওর এনজিওর কাজে।  আমাদের ডিভোর্সের পরেও, মায়ের সঙ্গে অনুর যোগাযোগ ছিল আগাগোড়াই;  এবারে, মায়ের সঙ্গে দেখা করেই মেসেজ পাঠিয়েছিল আমাকে- "পারলে মা কে দেখে যেও, ব্রেন ঠিকমতো কাজ করছে বলে মনে হয় না।" 

- মানে, ভুলে যাচ্ছে? কই, মীরাদি তো কিছু বলে নি-

- কথাবার্তা অসংলগ্ন একটু। কখন কী বলছেন, মানে কনটেক্সট বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হল, উনি একটিবারের জন্য নাম ধরে ডাকেন নি। কেমন আছি জিজ্ঞাসা করেন নি। অস্বস্তি হচ্ছিল ...

অনুর কথার মাঝখানেই আমার মাথার মধ্যে যেন একটা ছোটো পোকা ঢুকে পড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল, তার পাখার আওয়াজ না থামাতে পারলে আমার এই জাড্য ভেঙে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী - বুঝতে পেরেও  নিশ্চেষ্ট ছিলাম - উড়ুক, উড়ুক ।  এক সময় হঠাৎ মনে হল, মা হয়তো ভুলেই গেছে সব, মুখোমুখি হতে অসুবিধে হবে না;  ফ্লাইট বুক করে মীরাদিকে পৌঁছোনোর দিনক্ষণ জানিয়ে  দিয়েছিলাম। " মাসিমাকে বলে দিচ্ছি"- মীরাদি বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে নি।

গতকাল সন্ধ্যে নাগাদ টোটো থেকে নেমে দাঁড়াতেই বুক কেঁপে উঠেছিল - এ'বাড়িতে বুকু আর নেই- সম্ভবত একটু পরেই ওর হাসিমুখের ল্যামিনেটেড ছবি দেখতে হবে; যে গলির মুখে দাঁড়িয়ে এই মুহূর্তে  সুটকেস নামাচ্ছি, সেই পথ দিয়েই বুকু চলে গিয়েছে শুয়ে শুয়ে- এই ভাবনা এমন মারাত্মক ভারি,  আমাকে সম্পূর্ণ নুইয়ে ফেলছিল যেন ;  মাথা, ঘাড়, দু হাত অবহ আর পায়ের সমস্ত রক্ত মাংস পেশী শক্ত ও অনড়। একবার মনে হল, ফিরে যাই অথবা এই গলির মোড়েই বসে থাকি যতক্ষণ না শরীরের বাকি অংশটুকু পাথর হয়ে যায়। মীরাদিই সেইসময় আমাকে  ছাদ থেকে দেখতে পায়, হাত নাড়ে, তারপর দরজা খুলে দিয়ে হাসিমুখে দাঁড়ায়।  সিঁড়ির নিচে জুতো খুলতে খুলতে ওপরে চোখ চলে গিয়েছিল নিজে থেকেই - ল্যান্ডিংএ টিউবলাইট জ্বলছে আর সেই সাদা আলোকে পিছনে রেখে মা দাঁড়িয়ে - মায়ের ছায়া আমার ওপর পড়ছিল, আমার মুখের ওপর মায়ের চোখ ন্যস্ত; এই দুবছরে অনেক রোগা হয়েছে , সমস্ত চুল ধবধবে সাদা, বাদামী আলোয়ানের তলায় শীর্ণ মুখণ্ডল, চশমার কাচ অপরিষ্কার - চোখের মণি দেখা যায় না।  আমার মনে হয়েছিল, যেন কেউ দু বছর আগে  বাড়ি থেকে বেরোনোর মুহূর্তর ওপর আজকের এই সময়টিকে সযত্নে রেখেছে -  দুটি ভিন্ন কাল ও পরিস্থিতির উঁচু, নিচু, বক্র ও সরল রেখা সব যেন মিলে মিশে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে দু বছর পরে মায়ের গলা শুনলাম, " এত দেরি হল ফিরতে? পাখি দেখতে গিয়েছিলি?" সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে প্রণাম করলে, মা আমার বুকের ওপর দু হাত রেখে কপালে ছুইঁয়েছিল তারপর ম্যাজিশিয়ানের মত হাতের তেলো মেলে ধরেছিল - " দ্যাখ, পালক লেগে আছে তোর গায়ে।"


এখানে আসার আগে অনিমেষকে কনসাল্ট করেছিলাম। ও ভরসা দিচ্ছিল, পেশেন্টদের কথা বলছিল- সবাই ভালো হয়ে উঠছে নাকি। আধুনিক চিকিৎসার কথা আগ্রহ নিয়ে শুনছিলাম; মস্তিষ্কের সমস্যায় স্টেম সেলের ব্যবহার এবং আরো বিবিধ গবেষণা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে সব শেষে  বলেছিল, "মাসিমাকে তোর কাছে নিয়ে আয়, একবার দেখি তারপর রেফার করে দেব।"

মা কি আসবে? এত কিছুর পরেও?  মাকে কথাটা কীভাবে বলব, কখন বলব বুঝতে পারছিলাম না। 

কাল সন্ধ্যেয় বাড়ি ঢুকে এ’ঘর ও’ঘর ঘুরেছি এলোমেলো, যেন নতুন হাঁটতে শিখেছি, কমজোরী পা । বুকুর খাটে পরিপাটি বিছানা, গোছানো টেবিল, যেন সকালে উঠে বিছানা তুলে কাজে বেরিয়েছে, একটু পরেই ফিরবে, খেয়ে নিয়ে ঘুমোবে এখানে। মা গোটা সন্ধ্যা চাদর মুড়ি দিয়ে খবর দেখল আর একটাও কথা না বলে, যেন আমি এ বাড়িতেই থাকি, রোজই দেখা হয়, আলাদা করে বলার মতো আর কিছু নেই। মীরাদি মা কে  দুধ রুটি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "মটরশুঁটির পুর বানিয়েছি। কচুরি ভেজে দিচ্ছি। আলুর দম দিয়ে দি?"  মা আর মীরাদির আচরণে ভয় আর স্বস্তি যুগপৎ ঢেউয়ের মতো যাচ্ছিল, আসছিল। একবার  মনে হয়েছিল, দু বছর আগে আমার  চলে যাওয়ার পর থেকে এ বাড়িতে কালপ্রবাহ থমকে দাঁড়িয়ে আছে- বস্তুত প্রবাহ বলেই কিছু নেই- কিছুই বদলায় নি, কেউ কাউকে পাল্টে দেয় নি, বাঁচা কিম্বা মরার দিকে ঠেলেও দেয় নি। মীরাদি যেন ধরেই নিয়েছে আমার  বয়স বাড়ে নি একটুও, খাওয়া দাওয়ার অভ্যাস, ভালো লাগা মন্দ লাগা সব একই রয়ে গিয়েছে, যেন প্রতিদিনই এই সময়েই বাড়ি ফিরি, হাত পা ধুয়ে খেতে বসে যাই। আবার কচুরি ছিঁড়তে গিয়ে বুকুর কথা মনে পড়ে বুক কেঁপে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, মীরাদি এক্ষুণি চোখে আঁচল দিয়ে বুকুর কচুরি খাওয়ার কথা বলে উঠবে, তারপর ও ঘর থেকে মা বেরিয়ে আসবে তারপর দুজন মিলে আমার দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠবে, বেরিয়ে যেতে বলবে বাড়ি থেকে। শঙ্কা থেকে দ্রুত  স্বস্তিতে ঢুকে যেতে চাইছিলাম,  মীরাদিকে জিজ্ঞেস করলাম- "মা যে পাখিদের কথা বলছিল,  বড় ঝিলে পাখিরা আসে এখনও?" মীরাদি বড় বাটিতে কচুরি রেখে আঁচলে হাত মুছল-" ওদিকে বহুদিন যাই নি তো আর । তবে মাসিমা তো বলেন- আসে।"

- মা ঝিলের দিকে যায়? একা?

- মাঝে মাঝে বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে- 

- সে কী?

- সন্ধ্যার আগে নিজেই ফিরে আসেন। প্রথমদিন আমি ভয় পেয়ে পাশের বাড়ির বৌদিকে ডাকলাম, পিন্টুদাকে ফোন করলাম। সবাই খুঁজতে বেরোলাম। নিজেই ফিরে এলেন।

-কোথায় যায়? কিছু বলে?

-বলেন, কাছেই যাচ্ছেন, ফিরে আসবেন - যেন না খুঁজি। কতবার বলেছি, বেরোবার সময় ডাকতে- সঙ্গে যাবো। শোনেন না। যখনই স্নানে ঢুকি বা দোকানে যাই, বেরিয়ে যান। দুপুরের দিকে হয়তো একটু চোখ লেগে আসে আমার, তখন …  ভোর রাতেও এক এক দিন…. - আমি বা একা একা কতদিক সামলাবো? আমারও তো বয়স হচ্ছে-

-কোনোদিন তো বলো নি মীরাদি একথা…. ফোন করি যখন- পিন্টুদাও কই ...

মীরাদি চুপ করে থাকে; দেখি মীরাদির চোয়াল শক্ত, টেপা ঠোঁট, ঠান্ডা চোখে কচুরি তুলে দিচ্ছে পাতে;  আমি ঘাড় হেঁট করে কচুরি ছিঁড়ি,  আলুর টুকরোয় সামান্য ঘষি। চকিতে মনে হয়, বুকু আর মা একসময়  বাজারের দিকে কুকুরদের খাওয়াতে যেত, মা হয়তো এখনও... 

- আচ্ছা, কুকুরদের খাওয়াতে যায় না তো?

- ভোর রাতে কাকে খাওয়াবেন ? আর তাছাড়া  কুকুর কোথায়? আসার সময় দেখলে একটাও?

- কোথায় গেল?

- ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে, সর্বক্ষণ ভাঙাভাঙি, রাস্তা জুড়ে দেখো নি বালি ইঁট স্টোনচিপ?  এখানে থাকবে কোথায়? কে খেতে দেবে?

- কেউ খেতে দেয় না?

- তবেই হয়েছে। বরং মেরে ফেলে। গতবছরই তো ...যাগ্গে, খাও তুমি। এসব শুনে কী করবে আর?

-তাহলে যায় কোথায় ?

- পিন্টুদা বলছিল, মাসিমা কে নদীর দিক থেকে ফিরতে দেখেছে-

- সে তো অনেক দূর….

- পিন্টুদা বলল সেদিন, নদীর পাশে শ্মশানে যান বোধ হয়-

"কেন" বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। 

- অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের একটা দল হয়েছে- নদীর দিকটায় গাছ লাগাচ্ছে, ওখানেও যেতে পারেন। মাসিমার হাতে পায়ে কাদা মাটি দেখেছি, যখন ফিরে আসেন। কপালেও….

- কপালে?  কী?

- ছাই বা ধুলোর টিপের মতো কিছু। হয়তো মন্দিরে প্রণাম করতে যান-

- কিন্তু মা তো কোনোদিন মন্দিরে যায় নি। তোমাকে মা কিছু বলে নি কোনোদিন? মানে কোথায় যায় কেন যায়..

" আমাকে কেন বলতে যাবেন? কচুরি ঠান্ডা হয়ে যাবে, খেয়ে নাও। যে জ্যাকেটটা পরে এলে, সেটা দিও তো, রিফু করে দেব"- তীক্ষ্ণ হয়েই দ্রুত কোমল হল মীরাদি, যেন  আমাকে স্বস্তির কোটরে ঢুকে দেওয়ার সুযোগ করে  দিতে চাইছে আন্তরিকভাবেই।

- জ্যাকেটে কী হল?

- পিঠের দিকটায় ফেঁসে গেছে। খুব বেশি নয়, কিন্তু সেলাই না করলে আরো ফাঁসবে।

-নিয়ে নিও। চেয়ারে ঝোলানো আছে। বুঝতে পারি নি লাইনিং ছিঁড়েছে-

- ঐ যে মাসিমা পালক দেখালেন- তোমার জ্যাকেট থেকেই তো বেরিয়েছে। দ্যাখো এখনও দুটো উড়ছে ঘরে। পালক বলে বুঝিই নি প্রথমে তারপর দেখলাম ছোট্টো সরু রোঁয়ার মতো পালক। রাজহাঁসের?  না? কী কষ্ট দেয়! জ্যান্ত হাঁসের গা থেকে পালক তুলে নিচ্ছিল লোকগুলো - মাসিমা আর আমি টিভিতে দেখলাম একদিন।

"সব সময় তা নয়, অন্যভাবে মানে এথিকাল.." - গলায় আলুর টুকরো আটকে গিয়ে বিষম লেগে যায় ।

- জল খাও। ওমা ষাট ষাট। এত কথা না বললেই হত খাওয়ার সময়।

আমারও মনে হল, আমার জ্যাকেট এথিকাল না নন-এথিকাল- তাতে কী এসে যায়? মীরাদি যে সব হাঁসকে কষ্ট পেয়ে মরে যেতে দেখেছে, তারা তো আর বেঁচে উঠবে না। আজ যে লোক এথিকাল জ্যাকেট পরে ঘুরছে, সে যে কত অনায়াসে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে- এ কথা আমার থেকে ভালো আর কে জানে? ফলে, আমি আরো কাশি, প্রবল কাশি, যেন কাশিতে আমার সব কান্না ঢাকা পড়ে যাবে অথবা এক জটিল ব্যূহ তৈরি হবে আমাকে ঘিরে, যেখানে আমার মতো আততায়ীও সুরক্ষিত। এই সময় পাশের ঘর থেকে মা বেরিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়িয়ে থমকে গেল-  " একটা কিছু ভেসে যাচ্ছে কোথাও। টের পাস? খড়কুটোর মতো। সারাক্ষণ ভেসে বেড়াচ্ছে। কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাচ্ছে বুঝতে পারি না । একবার ধরতে পেরেছিলাম- কী ঠাণ্ডা আর ভারি , হাত থেকে পিছলে পড়ে গেল, জলে ভরে গেল ঘর দোর-"


দুপুরে স্নান করতে ঢুকে দেখলাম, ফিকে রঙের এক চিলতে গ্লিসারিন সোপ ঝাঁঝরির ওপর।

- মীরাদি, সাবানের টুকরো দেখলেই তুলে ফেলে দেবে। মা পা হড়কাবে কোনদিন। ছেঁড়া কাপড় বা কাগজ কিছু দাও তো, তুলে নি-

"জল ঢেলে দে, গলে যাবে নিজে থেকেই" - মা কখন যেন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

- সে যাবে  জানি, কিন্তু সময় লাগবে, তুমি আবার এলে কেন? আমি আর মীরাদি পরিষ্কার করে নিচ্ছি"- তোয়ালে পরা খালি গা আমি, বুকভরা পাকা চুল , পেটে মেদ - অস্বস্তি হচ্ছিল।

- এতদিন সারভিস দিল, ডাস্টবিনে ফেলে দিবি? জল ঢাল, নিজে থেকে গলে যেতে দে। স্বাভাবিক মৃত্যু হোক। জল ঢেলে প্রার্থনা করিস।

"কী? প্রার্থনা করব? " বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। স্পষ্ট দেখছিলাম, বিকেলে ঘনিয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আমরা দু ভাই সেই প্রথম একটি মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ - ছেঁড়া ডানা মৃত ফড়িংকে বাক্স ভরে মাটি চাপা দিচ্ছি আমাদের ছোটো বাগানে আর মা বলছে- “ফড়িং, আমরা তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। আমাদের ক্ষমা করো।“ মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বুকু আর আমি বলছি –“ক্ষমা করো, ক্ষমা করো।“

মা যেন সেদিনের সুরই টেনে বলে চলছিল - " দেখিস নি, সাবানের মতো সেদিন একটা হিমবাহ গলে গেল?  কত বছরের পুরোনো। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা এসেছিলেন। প্রে করলেন। 

"মাসিমা আপনি আসুন। পুলু স্নান করে নিক। একসঙ্গে খাবেন। মোচার ঘন্ট করেছি  নারকেল দিয়ে" -মীরাদি মায়ের হাত ধরেছিল। 

সাবানের গায়ে জল ঢালছিলাম, গলে যাচ্ছিল। মা কি আমাকে ক্ষমা চাইতে বলছিল? ছোটোবেলার বিকেলের মতো?

সকালেই এ বাড়ির লেপ , কম্বল ছাদের রোদে দিয়েছি, এখন, দুপুরে খেয়ে উঠে সে সব উল্টে পাল্টে দিচ্ছি, একটু পরে তুলে নেব। চারপাশ কত বদলে গিয়েছে। ছাদে উঠলে ট্রেন দেখা যেত  আগে। এখন শুধুই উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি। পাশের বাড়িটাও ভাঙা হচ্ছে, আর একটা বহুতল উঠবে। ইলেকট্রিক ড্রিলের আওয়াজ হচ্ছিল গোঁ গোঁ করে। ছাদের ছোটো টবে বেগুন , টমাটো, ঢেঁড়স; জলের ট্যাংকের দিকটায় মরশুমি ফুল ফুটে রয়েছে, তার পাশে পুরোনো খবরের কাগজ বিছিয়ে মাটি, সার আর খুরপি, প্লাস্টিকের বালতি, মগ। 

" শিকড় পচে যাবে। অত জল লাগে না ওদের।  মাটি ভেজা আছে কী না  আঙুল দিয়ে দেখে নে। তারপর জল দে।"- মা উঠে এসেছে ছাদে, হাতে  ছোটো মোড়া; হাঁফাচ্ছিল। দুপুরের রোদে শীর্ণ মা আর তার ছোট্টো ছায়া- মাকে এখন রুক্ষ চুলের একটা বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে- বাল্মীকিপ্রতিভার পথহারা বালিকার মতো যেন এখনই গেয়ে উঠবে - আঁধার ছাইল, রজনী আইল, ঘরে ফিরে যাব কেমনে? 

হঠাৎ মনে হল, ক্ষমা চাওয়ার সময় হয়েছে, এখনই মাকে জড়িয়ে ধরি- ক্ষমা করে দাও মা। আমার সঙ্গে চলো। একই সঙ্গে বুঝতে পারছিলাম, অনেক দূরত্ব মাঝখানে- আমার গায়ে মরা হাঁসের পালক, আমি এখনও নিপুণ আততায়ী। মনে হচ্ছিল, আবার সব নতুন করে শুরু হোক। আবার ছাদ থেকে ট্রেন দেখা যাক, কুকুররা ফিরে আসুক। আমি যেন আবার নতুন করে জন্মাই। আমি জন্মাব, বুকু জন্মাবে।  আর সেই জন্মজল থেকে ওষুধ তৈরি হয়ে মায়ের নিরাময় হবে। মনে হচ্ছিল, মার কোলে মুখ গুঁজে কাঁদি-  বুকুর জন্য, বাবার জন্য, নিজের জন্য, অনুরাধার জন্য, মা র জন্য , এ জগতের সমস্ত প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর জন্য- " বোসো না মা, মোড়াতে বোসো। দাঁড়িয়ে থেকো না। হাঁফাচ্ছো তো-"

-আরও মোড়া নিয়ে আসি-

- তুমি বোসো। আমি আনছি।


আরো দুটো মোড়া এনে দেখেছিলাম, মা ছাদের কোণের দিকে দাঁড়িয়ে; মাথা হেলিয়ে পাঁচিলে কান পাতছে, যেন কিছু শুনতে চাইছে।

- কী করছ ওখানে ?

- শুনতে পাচ্ছিস না?

- ড্রিলের আওয়াজ তো?

- না, কান্না…

- কে কাঁদবে এখানে?

- রিফিউজিরা…

- এখানে কে রিফিউজি?  দত্তকাকুরা তো প্রোমোটারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে বাড়িটা, মীরাদি বলল। কাঁদবে কেন? 

- একটা ময়ূর কাঁদছিল একদিন-

- এখানে ময়ূর? কোথায়?

 - টিভিতে কাঁদছিল। লোকেরা জঙ্গল কাটছিল বড়ো বড়ো যন্ত্র দিয়ে। কী বিশাল ইলেকট্রিক করাত। একটা বড়ো পাখি কাঁদতে কাঁদতে উড়ে গেল। মনে হল ময়ূর। দেখিস নি? 

- এখানে কে কাঁদছে? আমি তো শুধু ড্রিলিংয়ের আওয়াজ শুনছি।

- পাখিরা। ওদের বাসা ভেঙে যাচ্ছে না? কত গাছ ছিল-

- সে তো ছিল। নিম , বকুল - পুরো সবুজ ছিল এ দিকটা-

- কত পাখি। ওরা কাঁদছে। শোন। মন দিয়ে শোন।

- কী করছ কী? আঙুলে ভর দিয়ে ওরকম ঝুঁকো না- ব্যালেন্স চলে যাবে মা, পড়ে যাবে- 


ছাদের ওপর উপুড় হয়ে ছিল মা, নত হয়ে প্রণাম করতে করতে স্থির হয়ে গিয়েছে যেন; সোজা করে শুইয়ে দিয়েছিলাম- কপালে ধুলোর টিপ, গভীর ক্ষত থেকে রক্ত চুইঁয়ে বেরোচ্ছিল। মীরাদি অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করেছে; পিন্টুদা, ডাক্তার দাদুরাও এখনই এসে পড়বে। মায়ের হাত ধরে বসে আছি; কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে ছাদের ধুলোয় মিশছিল,  মনে হচ্ছিল, মা র খুলি ফুটো হয়ে স্মৃতির স্রোত বয়ে যাচ্ছে - বিকেলের রোদ , রক্ত আর ধুলোয় এক্ষুণি একটা সিঁড়ি তৈরি হবে, যার ওপরের ধাপে বুকু, নিচে আমি; ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে, বেরিয়ে পড়তে হবে আর বুকু টাকা চাইছে, বারে বারে টাকা চাইছে, বলছে, " বাজারে অনেক দেনা হয়ে গেছে দাদা, এবারের মতো বাঁচিয়ে দে" আর আমি গলা চড়াচ্ছি, বাড়িতে মা আছে জেনেও উঁচু গলায় কথা বলছি- " টাকা উড়িয়ে দেওয়ার সময় খেয়াল থাকে না? মন দিয়ে কোন কাজটা করেছিস তুই? আর একটা টাকাও দেব না।" বুকু বলছে-" ছোটো ব্যবসা করি দাদা, নোটবন্দীর পরে কোভিড আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের কোমর ভেঙে দিয়েছে, বিশ্বাস কর, টাকা ওড়াই নি আমি। গলা অবধি ঋণ- শোধ দিতে না পারলে আত্মহত্যা করা ছাড়া গতি থাকবে না।"  আর আমি চেঁচাচ্ছি- "যা পারিস কর , ফ্লাইটের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।" তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখছি,  মা দাঁড়িয়ে রয়েছে- আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে।

এই মুহূর্তে মায়ের, আধখোলা চোখে কোনো বুকু, কোনো পুলু, কোনো অভিযোগ নেই ;  বিস্ফারিত মণি স্থির হয়ে যাচ্ছিল কেঁপে কেঁপে। বয়ে যাওয়া রক্ত দেখছিলাম খুঁটিয়ে। হয়তো বুকু নয়, পুলু নয়, সিঁড়ি নয়, এই রক্তের মধ্যে গলে যাওয়া হিমবাহ আর মরা পাখিদের দেখতে পাব অথবা শত শত মহীরূহ গজিয়ে উঠবে করুণ রঙীন পথের দু পাশে। সে সব কিছুই ঘটছিল না। শুধু একটা পালক উড়ে এসে রক্তে বসে রইল যেন তার আর কোথাও যাওয়ার নেই।


[প্রথম প্রকাশঃ শারদীয় পরিচয় ১৪৩২]

Comments

  1. "একজন মানুষ তার সমস্ত জীবনে ঠিক কতগুলো মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকে?? "...... নাড়িয়ে দেওয়া লাইন।

    ReplyDelete
  2. অপরাধবোধ, বিপন্নতা। জেনে - না জেনে অনেকেই এরকম অপরাধ করে থাকেন, অনেক সময় হয়েও যায়.......
    ....... কিন্তু উপলব্ধি করতে পারেন ক'জন, স্বীকার করেন বা করতে পারেন কতোজন? স্বীকার করে নিয়ে নিজের একান্ত আপন ডায়েরিতেই বা লিখে রাখতে পারেন কতোজন?
    এই প্রশ্নগুলোই উঠে এলো নাকি......

    ReplyDelete
  3. অনামা পাঠকদ্বয়কে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

সিম্পল প্যাশন

বিরাশি ডিগ্রি পূর্ব

তিমি দেখার দিন