তিমি দেখার দিন

- তিমি তো মাউন্ট এভারেস্ট নয়,  কোনো মহাসাগর টাগরও নয় , সুনামি নয়, অরোরা বোরিয়ালিস নয়-

- কী বলতে চাইছ এক্জ্যাক্টলি?

- নীলুদাকে হোয়েল ওয়াচিং এ নিয়ে যাচ্ছি কেন বুঝতে পারছি না।

বাচ্চু যে আমার উত্তর শুনতে চাইছে না, এ সবই স্রেফ স্বগতোক্তি - স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। ওকে ভয়ানক অস্থির দেখাচ্ছে এখন;  ল্যাপটপের সামনে চশমা খুলে চোখ রগড়াচ্ছে, মাথায় হাত রাখছে ঘন ঘন; দেখছিলাম, ঢেউখেলানো পাকা চুলের গোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে ওর আঙুল, গোছা ধরে টান মারছে যেন কোনো ফলিকলের অভ্যন্তরে  ওর জিজ্ঞাসার উত্তর লুকোনো  রয়েছে, এবং সেই অবস্থান চিহ্নিত করতে পারলেই এই সব অবিরত প্রশ্ন থেমে যাবে। সে সব কিছুই ঘটছিল না এই মুহূর্তে , বরং বাচ্চুর অস্থিরতা আমাদের ঘরদোরে ছড়িয়ে পড়ছিল যেন এমন এক ব্যাপন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে যেখানে উচ্চ ঘনমাত্রার স্থানে স্বয়ং মৃত্যু ; ফলে  এবার আমি মুখ না খুললে মুহূর্তের মধ্যে  ব্যাপন সম্পন্ন হবে, এ ঘরের হাওয়াবাতাসে মৃত্যু আর নশ্বরতার রং গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে হতে স্থায়ী হয়ে যাবে একসময়।

" নীলুদা খুব বড় কিছু দেখতে চাইছে চলে যাওয়ার আগে", আমি বলে উঠলাম। 

- সে তো জানি, রুবি  বলেছে।  কিন্তু কেন?

- মৃত্যুকেই যাতে সব থেকে বড় মনে না হয়, অবভিয়াস্লি। একটা মানুষ ঘরে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে । মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, প্রগ্নসিস তাই।  নীলুদা চাইছে একটা বড় কিছুর মুখোমুখি হতে-জীবন্ত বড় কিছুর-

- আর সেই দৃশ্যটা বাকি কটা দিন বাঁচিয়ে রাখবে ভাবছে। মৃত্যুকে যাতে এত বড় মনে না হয়। এটা না বোঝার কিছু নেই।  কিন্তু তিমি কি সত্যি এত বড়? হোয়েল ওয়াচিংএর ভিসুয়াল মৃত্যুভয়কে হারিয়ে দেবে?  আমি আর থাকব না, সবাই থাকবে, সব থাকবে, আমি থাকব না - এই বোধটাই তো মারাত্মক।

এর উত্তর আমার জানা  নেই। ভাবতেও চাইছিলাম না।  কথা ঘোরালাম, " শরীরের এই অবস্থায় কোথায় আর নিয়ে যাবে,  বৃহৎ আর কী বা দেখাবে? কাছাকাছির মধ্যে সী বীচে যাওয়ার কথা রুবি বলেছিল। নীলুদা উত্তর দেয় নি। হোয়েল ওয়াচিং স্পট বীচের  খুব দূরে নয় -  দুটো ক্লিফ রয়েছে, ওখান থেকে এই সীজনে তিমি দেখা যায় । নীলুদাও রাজি- রুবি অন্তত তাই বলল। আরো একটা সুবিধে হল,  পার্কিং  থেকে হুইল চেয়ার  টানা ক্লিফ অবধি নিয়ে যাওয়া সম্ভব। রুবি একা পারবে না।  সায়ন যাবে সঙ্গে। তবু আমরা গেলে সুবিধা হয়। এই তো..."

বাচ্চু গজগজ করতে থাকে।  চুল টানে । চোখ মোছে,  জল খায়। সহপাঠীর ভবিতব্য তৎসহ নিজেদের আসন্ন ভবিষ্যৎ বাচ্চুর ডোন্ট কেয়ার ভাবকে সম্পূর্ণ  পেড়ে ফেলেছে বুঝতে পারি। যেন সে চোখের সামনে আমাদের সবার প্রগ্নসিস দেখতে পাচ্ছে - প্রত্যেকটি চরম  নেগেটিভ।

" এই মুহূর্তে হোয়েল ওয়াচিংএর চেষ্টা করা ছাড়া  উপায় নেই। তাও ক্লিফ থেকে। বোটে সম্ভবই নয়। তোমার অন্য কোনো সাজেশন থাকলে রুবিকে বলো না"-  আমি আবার  বললাম।

- আমি জানি না। কী করে জানব? আমার পয়েন্ট হল,  তিমি দেখার অভিজ্ঞতা মৃত্যুভয়, শারীরিক যন্ত্রণা সব ভুলিয়ে দেবে? তাই কি সম্ভব? অ্যাবসার্ড।

 - সম্ভব নয়। তবু ঐ যে অ্যাব্সার্ডিটি- ঐটাই আঁকড়ে ধরতে চাইছে হয়তো-

বাচ্চু উত্তর দেয় না। নাক ঝাড়ে। ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে- "কটায় বেরোতে চায় রুবি?"

- বিকেলে। তিনটে সাড়ে তিনটে  নাগাদ। ঘন্টাখানেক লাগবে পৌঁছতে। রোদ পড়ে যাবে ততক্ষণে। নীলুদার কষ্ট হবে না।


সমুদ্রের বাঁদিক ঘেঁষে স্যান্ডস্টোনের খাড়াই- পাশাপাশি দুটি চূড়া রেলিং দিয়ে ঘেরা - পার্কিং লট থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। হেমন্তের শুরুতে তিমিরা উষ্ণ অঞ্চলের দিকে যাত্রা শুরু করে; যদিও  অতীতে এই অঞ্চল তাদের যাত্রাপথের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, আমরাও এত বছরের মধ্যে এ অঞ্চলে হোয়েল ওয়াচিংএ আসিনি,  ইদানিং দূষণ কিম্বা এল নিনোর কারণে মাইগ্রেশন রুট খানিক বদলেছে- এই দুটি ক্লিফ তিমি দেখবার আদর্শ স্থল হয়ে উঠেছে ফলত। আজ শেষ বিকেলে পার্কিং লট থেকে টুরিস্টরা ঝাঁক বেঁধে পাহাড়ের দিকে হাঁটছিল। তাদের চলনে , হাসিতে, গানে,  উচ্চ কণ্ঠে যৌবনের তাপ।  সে'সবের সবের মাঝে ছায়া ফেলে ফেলে নীলুদার হুইলচেয়ার আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল।  রুবির ভাই সায়ন চেয়ার ঠেলছে, পাশে রুবি, রোদচশমা, ভারি ব্যাগ, পা টেনে হাঁটছিল এবং পিছিয়ে পড়ছিল। হুইলচেয়ারের ছায়া থেকে রুবির নিজস্ব  ছায়াটি আলাদা হয়ে যাচ্ছিল ফলত।  রুবি আবার তখন গতি বাড়াচ্ছিল,  ছায়ায় ছায়া জুড়ে দিচ্ছিল। সায়ন হাত নাড়ল আমাদের দেখে।  রুবি হাসবার চেষ্টা করলে ওর চোয়াল বেঁকে চুরে যাচ্ছিল আগাগোড়া। আমাদের কোমরের কাছাকাছির উচ্চতার হুইলচেয়ারে নীলুদা সামান্য ঝুঁকে বসেছিল- মুখ নামানো।  একমাস আগে  যা দেখে এসেছিলাম, নীলুদার ওজন তার থেকে আরো কমে গিয়েছে। চোখ কোটরে, দুই গালের হাড় ঠেলে বেরোচ্ছে, সমস্ত শরীরে কেউ নীল কালি বুলিয়ে দিয়েছে যেন। কেশহীন করোটিতে  বেসবল ক্যাপ ঢলঢল করছে, নাকে নল, পায়ের ওপর রাখা চাদরের নিচে ড্রেনেজ ব্যাগের রং দেখা যায়। 

"কোন ক্লিফে উঠছি আমরা?" প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েই  ঘড়ি দেখল সায়ন।

"দুটো জায়গা থেকেই একইরকম ভিউ পাওয়া উচিত। তবে সামনেরটাতেই চলুন, দূরত্ব কম" -হুইলচেয়ারে হাত রেখে শ্বাস নিল বাচ্চু। 

 এক নম্বর ভিউপয়েন্টের  রেলিং দেওয়া র‌্যাম্প ধরে ওপরে উঠছিলাম আমরা । খুব আস্তে হাঁটছিলাম সবাই। টুরিস্টের দল টপকে যাচ্ছিল আমাদের।  সায়ন আর বাচ্চু পালা করে হুইলচেয়ার ঠেলছে, পিছনে রুবি আর আমি। কেউ কথা বলছিলাম না, নীলুদার মতই মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটছিলামযেন নির্দ্ধারিত সময়ের আগেই শবানুগমন শুরু হয়ে গিয়েছে আমাদের। সমুদ্র আর আকাশ যথাবিহিত নীল ও উদাসীন।  বাতাসে নুন আর মাছের গন্ধ স্পষ্ট।   শ্যাওলা ধরা পাথরের গায়ে জল আছড়ে পড়ার শব্দ উঠছিল নিরন্তর। 

চূড়ায় পৌঁছে নীলুদাকে জল খাওয়ালো রুবি, মুখ মোছালো। রেলিং ঘেরা ভিউ পয়েন্টে তখন বিস্তর মানুষ; মোবাইল কিম্বা পেল্লায় ক্যামেরা বাগিয়ে জনতা ছবি নেওয়ার জন্য রেডি; ভিড় ঠেলে সায়ন আর বাচ্চু হুইলচেয়ারের জন্য জায়গা করে নিচ্ছিল ।

" ঐ তো ঐ তো" - ভরা গ্যালারির সামনে যেন নেটে বল জড়িয়েছে ডার্বি ম্যাচে- দ্বিতীয় ভিউ পয়েন্ট থেকে এই সময় তুমুল হৈ হৈ ; দেখছিলাম, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছে মুহুর্মুহু, আঙুল তুলে সমুদ্রের দিকে দেখাচ্ছে মানুষজন, শিশুদের কাঁধে তুলে  নিচ্ছে তিমি দেখাবে বলে। উচ্ছ্বাস মিলিয়ে যেতে না যেতে ওখান থেকেই আবার সম্মিলিত হর্ষধ্বনি, তারপর আবার, আবার, আবার।  আমাদের আশপাশের মানুষজনকে প্রথমে বিহ্বল লাগছিল, তারপর দেখলাম, এক নম্বর ভিউ পয়েন্ট খালি হয়ে যাচ্ছে দ্রুত, র‌্যাম্প বেয়ে নেমে গিয়ে দ্বিতীয় ক্লিফে উঠে যাচ্ছে জনতা।  দু একজন সামান্য থমকে যাচ্ছিল হুইলচেয়ারের কাছে- "আপনারা যাবেন না? এই পয়েন্ট থেকে আজ দেখা যাবে না, বুঝলেন? এই রকম হয় এক এক দিন। এর পর আর দেরি করলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে, পেশেন্ট নিয়ে নামতে উঠতে অসুবিধে হবে তো-"

আমরা মুখ চাওয়াচায়ি করছিলাম। কী করা উচিত এই মুহূর্তে বুঝতে পারছিলাম না।

"একটু ধৈর্য নেই লোকজনের, কী যে হয়েছে! ঐ পয়েন্ট থেকে দেখা গিয়েছে তো আমাকেও এখনই দেখতে হবে। একটু অপেক্ষা করতে কী হয়"- বাচ্চু বলল

-একদিকে ভালৈ হয়েছে, ভীড়ে ঠেলাঠেলি করতে হবে না।

রেলিং ঘিরে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছিলাম আমরা। হুইল চেয়ার ঠেলে রেলিংএর খুব কাছে নিয়ে গিয়েছিল সায়ন আর বাচ্চু। রুবি আবার জল খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিল নীলুদার।

দুই নম্বর পয়েন্ট থেকে উল্লাসধবনি ভেসে আসার কমতি ছিল না। তিমিদের এই বৈষম্যমূলক অবস্থানের খবর ছড়িয়ে গিয়েছিল দ্রুত। এখান থেকে নিচে তাকালে দেখা যাচ্ছিল, টুরিস্টের দল দু নম্বর র‌্যাম্প বেয়ে উঠে যাচ্ছে, এক নম্বর র‌্যাম্প ছায়াময় , নির্জন। এখানেও যেন আবার এক ব্যাপন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই থমকে গিয়েছে - যেন জীবন আর মৃত্যু দুটি বিন্দুতে উচ্চ ঘন মাত্রায় অবস্থান করছে, মাঝখানে কোনো ভেদ্য পর্দা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এদিকে  হাওয়ার জোর বাড়ছিল, তাপমাত্রা কমে আসছিল ক্রমশ। রুবিকে  শঙ্কিত দেখাচ্ছিল। নীলুদার গালে কপালে আঙুল ছোঁয়াল প্রথমে তারপর  ব্যাগ থেকে পাতলা চাদর বের করে বেসবল ক্যাপের ওপর বিছিয়ে দিল রুবি। তারপর সায়নের কানে কানে কিছু বলল। সায়ন তার দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর গলা খাঁকরে চেঁচিয়ে উঠল "ঐ যে ঐ যে",  তারপর সিটি বাজালো আর দ্বিতীয় ক্লিফ থেকে ভেসে আসা উল্লাসধবনি হুবহু তুলে আনল নিজের গলায়। বাচ্চু খেলাটা ধরে নিল তৎক্ষণাৎ; "ঐ যে আরেকটা- লেজ দেখা যাচ্ছে- ঝাপটটা দেখলে ?" বলেই সিটি বাজাল বাচ্চু। তারপর হাততালি দিল, সেই হাততালিকে থামতে দিল না রুবি- তারপর সায়ন , বাচ্চু  আর রুবি মিলে এক নাগাড়ে হাততালি আর উল্লাসধ্বনি -  যেন একটা বল ছুঁড়ে দিচ্ছে কেউ, অন্যজন তাকে লুফে নিয়েই আবার ছুঁড়ে দিচ্ছে, সবার চোখ বলের দিকে , দুহাতের তালু জড়ো করে তুমুল মনঃসংযোগ করছে সবাই যেন ফস্কালেই  ড্রপ খেয়ে বল গড়িয়ে যাবে ঢালু বেয়ে, তৎক্ষণাৎ শেষ হয়ে যাবে খেলা। রুবি আর বাচ্চু এবার আমাকে ইশারা করল চোখে চোখে। ততক্ষণে দু নম্বর ক্লিফের লোকজন তুমুল কনফিউজড। রেলিংএর ডানধারে সরে এসে আমাদের দিককার ভিউ বুঝে নিতে চাইছে তারা, বাইনোকিউলার বাগিয়ে ধরেছে কেউ কেউ, টেলি ফোটো লেন্স ফোকাস করছে। নিচে র‌্যাম্পে ওঠার জায়গায় পাবলিক থতমত। বাঁ না ডানদিকের র‌্যাম্প ধরবে বুঝে উঠতে পারছে না।  আমি দু হাতের পাতা মুখের সামনে নিয়ে " ও ই যে " বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাবো, জড়ানো গলায় কথা ভেসে এলো। মৃদু খোনা স্বর;  শব্দ, বাক্য ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল- " ঐ যে ঐ যে ঐ যে..."। নীলুদার গলা। দেখি, মাথা আরো হেলে পড়েছে নীলুদার, চোখ বোজা , হাপরের মতো বুকের খাঁচা উঠছে আর নামছে। শির বের করা আঙুল তুলে  বলছে, " ঐ যে ঐ যে ঐ যে"।  এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে  গলা ছাড়লাম - " আর একটা- ঐ তো- কী বিশাল কী বিশাল।" বাচ্চু এসে আমার কাঁধে হাত রাখল, চোখ বুজে সিটি মারল জোরে। সায়ন আর রুবি চোখ বুজে চেঁচাতে লাগল নাগাড়ে। আমিও চোখ বুজলাম। এ যাবৎ সিনেমায়, টিভিতে, বোট থেকে যে সব তিমিদের দেখেছি- তাদের স্মৃতি ফিরিয়ে এনে বর্ণনা করছিলাম নিখুঁত, -" ঐ যে ঐ হাম্প ব্যাক, ওয়াও কী লাফটাই না দিল, দেখেছ দেখেছ কেমন ডিগবাজি খেল - আকাশ ছুঁয়ে ফেলছিল প্রায়"। 

পরস্পরের হাত ধরেছিলাম আমরা যেন এক ব্যূহ রচনায় প্রয়াসী; আমাদের এই ছোটো দলের সবাই উল্লাসধ্বনিতে গলা মেলাচ্ছিলাম একসঙ্গে। আমাদের সবার চোখ বন্ধ ছিল।


[প্রথম প্রকাশ ঃ বাতায়ন, ২০২৫]

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

পদ্মসম্ভব

সিম্পল প্যাশন