সিম্পল প্যাশন

 আমি কখনও নীল ছবি দেখি নি । ল্যাপটপ কিম্বা টেলিভিশনের স্ক্রীনে যোনি আর পুরুষাঙ্গর ঘর্ষণ দেখার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না যা থেকে তীব্র কোনো অভিঘাত তৈরি হতে পারে। এই সব দৃশ্যের ক্লোজ আপে, ক্যামেরার বিভিন্ন অ্যাঙ্গলে নৈতিকতার বোধ চুরমার হয়ে নেশা তৈরি হয়,  নারীর নাভির ওপর  বীর্য পড়ে থাকার মত কিছু উদ্বেগের ছিটে তাতে। লেখাদের এরকম হওয়ার কথা। আমি এমন লিখি নি কোনদিন। এযাবৎ আমার ভূমিকা বরং সেই স্প্যানিশ সিনেমার লেখক চরিত্রের মতো - নিরিবিলিতে লিখবে বলে  শহর থেকে দূরে এক গঞ্জে এসেছিল  যেখানে  একদল নেকড়ে আর সে  ছিল সম্পূর্ণ বহিরাগত। সিনেমাটা আমি দশ মিনিট দেখে বন্ধ করে দিই, যখন লেখকের গায়ে আউটসাইডারের তকমা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম; দেখছিলাম সেই শহরের যাবতীয় রহস্য লেখকের সামনে একই সঙ্গে উন্মোচিত  এবং গোপন। ঠিক এইখানে আমি সিনেমা দেখা থামিয়ে একটা শহর বানাই মনে মনে,  বাকি গল্পটা ভেবে নিতে থাকি আর ঐ লেখকের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করি নিজেকে- ফ্রেমের বাইরে একজন কমপ্লিট আউটসাইডার। অথবা অনেক দূরের এক আখাম্বা হাওয়াকল, বাতাস ঘুরিয়ে আখ্যান তৈরি করে জনপদে ফিরিয়ে দেওয়া যার কাজ। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে সিম্পল প্যাশন পড়তে শুরু করে এই সব মনে হওয়া আমার কাছে খুব স্বাভাবিক ছিল।

আসলে, বজ্রগর্ভ মেঘের কারণে আজ সমস্ত ফ্লাইট ডিলেড। কিন্ডলে অ্যানি আর্নো  আর কফি নিয়ে বোর্ডিং গেটের সামনে বসে রয়েছি অনেকক্ষণ।  ভেবেছিলাম, ফ্লাইটে পড়ব । তারপর আকাশের এই অবস্থায়, ডিপার্চার স্ট্যাটাস দেখে  লাউঞ্জেই পড়তে বসেছি। মেঘ ডাকল, বাজ পড়ল, ঝড় উঠল, থামল, বৃষ্টি শুরু হল। দু কাপ কফি জুড়িয়ে জল হল। চারজন  চিনতে পেরে অটোগ্রাফ চাইলেন, তারপর সেলফির আবদার।  সে সব মিটিয়ে ভেজা রানওয়ের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলাম।  বৃষ্টি থেমে গিয়ে উড়োজাহাজের ওঠানামা শুরু হয়ে গিয়েছিল সেখানে। রানওয়ে থেকে উত্থিত জলীয় বাষ্প হলদে আলোদের সামনে ভীড় করে ছিল । সেই সব আলোয় নেমে আসা উড়োজাহাজদের সেলোফেন মোড়া উপহার মনে হয়, মোড়কের ওপর দিয়ে যাদের অবয়বের আভাস স্পষ্ট, খাঁজখোঁজ সমেত - এ উপহারে কোনো সারপ্রাইজ নেই। অনেকটা আমার লেখার মতো। দূরে টাচডাউন জোন বরং অধিক রহস্যময়- গাঢ় অন্ধকারে আলোর সারি মিটমিট করছিল; এক টানা তাকিয়ে থাকলে জোনাকিদের মতো লাগে। আমি আবার পড়তে শুরু করি।

গোটা সেপ্টেম্বর মাস আমার প্রতীক্ষায় কেটেছে। ওর ফোনের অপেক্ষা, ওকে একবার দেখার। বাজার করেছি, সিনেমায় গিয়েছি, বই পড়েছি, খাতা দেখেছি, ড্রাই ক্লীনারের থেকে কাপড় নিয়ে বাড়ি ঢুকেছি। সবই করেছি, কিন্তু এসব কাজ, এমনকি আমার হাসি, আমার কথা - সব কেমন সহজাত প্রবৃত্তির মতো, কেমন অসাড়ে করে গিয়েছি, একটা প্রাণীর পক্ষে যা যা স্বাভাবিক; ফলে যা হয় আর কি, ঐ সময় কোন সিনেমা দেখেছি, কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কী কথা বলেছি - সব স্মৃতি ঝাপসা।  মনুষ্যোচিত বুদ্ধি বৃত্তি, প্রবৃত্তি, আকাঙ্খা , ভালো-মন্দ বিচারবোধ - সবই ছিল ওকে ঘিরে, শুধুই ওকে ঘিরে। 

দু কাপ কফি তলপেটে চাপ দিল।  বোর্ডিং অ্যানাউন্সমেন্টও হল ঠিক এই সময়। বাথরুমের দিকে এগোলাম-মুখে চোখে জল দিয়ে ফ্লাইটে উঠব। টয়লেটে অ্যাটেন্ডেন্ট মহিলা সুগন্ধি স্প্রে করছিলেন এদিক ওদিক। গজগজ  করতে করতে ন্যাতা বোলাচ্ছিলেন মেঝেয়। একের পর এক খুপরিতে ঢুকে দুবার তিনবার ফ্লাশ করছিলেন কমোড। সংকর্ষণ বলত, ওর বাবা বাথরুম করে জল দিতেন না। মা জল ঢেলে আসতেন প্রতিবার। ওদের বাথরুমের ঠিক সামনে এক চিলতে ঘরে ওর মা কবিতা লিখতেন।  তিনি লিখতে বসলেই বাবা বাথরুম যেতেন ঘন ঘন- সব নোংরা করে জল না দিয়ে বেরিয়ে আসতেন, দরজা হাট করে খুলে দিতেন যাতে দুর্গন্ধ সটান ওর মার লেখার ঘরে ঢোকে। এসবই সংকর্ষণ আমাকে বলেছিল প্রথম আলাপে। বলেছিল, কোনো লেখকের সঙ্গে ওর সম্পর্কে জড়াতে ভয় করে কারণ সংকর্ষণের মধ্যে নাকি ওর বাবা রয়ে গিয়েছেন অনেকখানি। এই সব কথা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার বয়স ছিল তখন।  বস্তুত, শৈশবের ট্রমা থেকে সংকর্ষণ বেরোতে তো পারেই নি বরং মেয়েদের লেখালেখির প্রতি তীব্র ঘৃণা ওর স্বভাবের অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। এসবই বিয়ের পরে বুঝতে পেরেছিলাম। 

টয়লেট  থেকে ফিরে বোর্ডিংয়ের লাইনে দাঁড়িয়েই পুতুলকে টেক্স্ট করলাম – ‘বোর্ডিং ইন ফাইভ মিনিটস।‘ পুতুলের বাসার কাছাকাছি কোনো এয়ার বিএনবি আস্তানায় আমার থাকার ব্যবস্থা। পুতুলই বুক করেছিল - ব্রীসাইড ব্রীজ। পুতুলের কাছে গেস্ট এলে তারা ওখানেই ওঠে। কথা আছে এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে যাব সটান।  ব্রীসাইড ব্রীজের তরফে মায়াজী কথা বলেছিলেন আমার সঙ্গে; বলেছিলেন, চাবি দরজার সামনে লাল চেয়ারের নিচের বাক্সে রাখা থাকবে। এত রাতে সেই ব্যবস্থাই বজায় থাকবে কী না জেনে নেওয়া জরুরী ছিল;  রিসেপশনের ফোন বেজে যাচ্ছিল অথচ। পুতুলও মেসেজ করে নি;  নতুন লেখা কিম্বা আগামীকালের সাক্ষাৎকারের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত  হয়তো- ফোন অফ করে রেখেছে। পুতুল এরকমই। ভিড় থেকে দূরে, নির্জন, আলাদা। ওর লেখাও অন্যরকম। একদম অন্যরকম। সঙ্গত কারণেই  পুরস্কার পেল। এত অল্পবয়সে এই সাহিত্য পুরস্কার আর কেউ পান নি বলেই জানি। আগামীকালের সাক্ষাৎকার পুতুলের পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষ্যেই। একটি সর্বভারতীয় প্রকাশনা সংস্থার উদ্যোগে পুতুলের বাড়িতেই। সাক্ষাৎকার কিম্বা কথোপকথন। সাহিত্যের জনপ্রিয়তা আর নির্জনতা কেন্দ্রে রেখে কথা হবে পুতুলের আর আমার, কোনো স্ক্রিপ্ট  ছাড়াই। তবু একটা আউটলাইন পাওয়া গেলে সুবিধে হয় ভেবে গত সপ্তাহে পুতুলকে মেসেজ করেছিলাম। পুতুল লিখল- "সাধারণ কথাই- যেমন সাহিত্য আলোচনায় হয়ে থাকে। আগের থেকে অত ভাবার কিছু নেই। আপনার বাড়িতে আমি চা খেতে এলে যেমন কথা হবে, সেই রকমই। সামনে জোরালো আলো আর ক্যামেরাম্যান থাকবে এই যা। তবে একদম শেষে, বুঝলেন, একদম শেষে আমি ভেবেছি, ইফ ইউ এগ্রি অফকোর্স, আমরা পরস্পরের কাছে একটা সত্যি কথা জানতে চাইবো- একটা খুব সত্যি কথা , যা আগে কখনও কাউকে বলি নি ;  দেখুন, পাঠককে আমরা কী দিয়েছি তা তো পাঠক বলবে, সময় বলবে। কিন্তু আমরা আমাদের লেখাকে কী দিয়েছি? বলবেন ক্যামেরার সামনে?”

আমি রাজি হয়েছিলাম।

একটু পরে নিজেই টেক্স্ট করেছিল পুতুল – “আর একটা কথা বলি? সিম্পল প্যাশন পড়েছেন?”

-অ্যানি আর্নোর? না ...

-ছোটো বই, পঞ্চাশ পাতার। পড়ে ফেলুন। কথা হবে।

পুতুল যখন কথা বলে, কন্ট্রোল সম্পূর্ণ ওর হাতে-কী বলবে, কতটুকু বলবে, কতটুকু শুনবে। অথচ অশ্রদ্ধা থাকে না এক ফোঁটাও। জেনেশুনেই আত্মসমর্পণ করি প্রতিবার। 

খনও মনে হয়েছে, ওর জন্য আমার এই যে প্রবল আবেগ, আসক্তি, মুহূর্তগুলির রোমন্থন, এই ভাবে লিখতাম যদি; ঠিক এই রকম অভিনিবেশ,  বিশদ বর্ণনায় ঠিক এই রকম মনোযোগ। একটা সময়কে সংজ্ঞায়িত করতে আরম্ভ আর সমাপ্তির প্রয়োজন। আমি জানি। আমার এই প্রতীক্ষার সময়টুকু নির্দিষ্ট করতে মারা যাওয়ার কথাও ভেবেছি। এই লেখা শেষ করার পরে তেমন মরে যাওয়াই যায়। 

প্যান্ট্রির পর্দা সরিয়ে এয়ারহস্টেসরা ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে  ঢুকছিলেন, কফির গন্ধ, ভাজা মশলার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল কেবিনে। বই মুড়ে সামনের ফোল্ডিংট্রে খুললাম। পাশের মেয়েটি হাই তুলল। তার পাশে  ছেলেটি  ইশারায় আকাশ দেখালো- অ্যাসফল্ট ব্ল্যাকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মেয়েটি ছেলেটির আঙুলে আঙুল জড়াচ্ছিল- "কত রাত হয়ে যাচ্ছে, ক্যাব পাবো ?"  আমাকেও  ট্যাক্সি নিতে হবে এয়ারপোর্ট থেকে; আয়োজকদের বারণ করেছি আসতে,  নিজেই চলে যাবো বলেছি।  আগামীকালের  কথোপকথন  নিয়ে ভাবা, তাদের সাজিয়ে ফেলার জন্য এই পথটুকু একলা থাকা জরুরী মনে করেছিলাম। গত কয়েক দিন সাংবাদিকদের কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে;  একটা প্রশ্ন কমন- "আপনার লেখা সাঙ্ঘাতিক জনপ্রিয়- সন্দেহ নেই, কিন্তু এই পুরস্কার পান নি; পুতুলের সাফল্যে  সহলেখক হিসেবে গর্বের পাশে নিজের ব্যর্থতা টের পান?"  ক্রমাগত এই একই কথায় যেন  লুকোনো ব্লেডের মতো এক প্রশ্ন রাখা থাকে - "আপনার হিংসে হয়?" চামড়া চিরে রক্ত বেরিয়েছিল আমার। পুতুলকে আমার আদর্শ মনে হয়- আমি যা হতে চেয়েছিলাম,  যেমন লিখতে চেয়েছিলাম আদতে। শুরু থেকেই ওকে ফলো করি। ওর লেখা। ওর বই পড়া। ওর লেখা নিয়ে আমার বিশ্লেষণ , মতামত বহু পত্রিকায় প্রকাশিত। পুতুল অনুবাদ দিয়ে শুরু করেছিল তারপর ফিকশন। প্রথম গল্পেই একটা সময়ের অভ্যন্তরে অন্য একটা সময়ের সম্পূর্ণ ঢুকে যাওয়া ছিল- অতীত গিলে নিয়েছিল বর্তমানকে। তারপর প্রথম উপন্যাস। ডিস্টোপিয়ান। দ্বিতীয় উপন্যাস স্পেকুলেটিভ জনরার-  এই লেখাই পুরস্কার পেয়েছে। আমার হিংসে নেই - এই কথাটা  বলব আগামীকাল। অন ক্যামেরা। তবে বেদনা ছিল। যদিও আমার অ্যানেমোমিটার বাতাসের গতিবিধি ঠিকঠাক মাপছিল, প্রোপেলর, ব্লেড কাজ করছিল মসৃণভাবে, গল্পরা জনপদের দখল নিয়ে নিচ্ছিল সহজে,  আমার বইয়ের বিরাট কাটতি, আমার ফ্যানডম -তবু চাপা কষ্ট ছিল, পুতুলের মতো লিখতে না পারার কষ্ট । আর কৌতূহল। পুতুল কোনোদিন আমার লেখা  নিয়ে একটি  শব্দও উচ্চারণ করে নি।  পুতুল কিছু বলবে এবারে? অন ক্যামেরা অথবা স্টুডিওর বাইরে কোথাও? 

ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ আমার ছেলেদের কিম্বা ছাত্রদের কাছে গোপনই ছিল। আমাদের নিজস্ব কিছু ব্যবস্থাপনা ছিল, ফলে সমস্যা হয় নি। জ্ঞানতঃ সন্তানদের আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের বাইরেই রাখতে চেয়েছিলাম। আসলে, মা-বাবা আর সন্তানের সঙ্গে নিজস্ব যৌনতাপ্রসঙ্গে এক প্রকার অনধিগম্যতা থাকেই। কোনো কোনো মুহূর্তে মা তার সন্তানদের  প্রতি উদাসীন হতেই পারে, শিকার ধরার মুহূর্তে মা বিড়ালের কাছে সন্তানরা যেমন। তবে, মানবসন্তান মায়ের চোখের উদাসভাব কিম্বা নীরবতায় লুকোনো সত্যকে খুঁজে দেখতে চায় না, মুখ ঘুরিয়ে নেয়, অস্বীকার করে। একবার মেরি ক্লেয়ার ম্যাগাজিনের তরফে একটি ইন্টারভিউতে  একদল তরুণ তরুণী তাদের ডিভোর্সী মায়েদের প্রণয় সম্পর্ককে তুমুল নিন্দে করেছিল। কেবল একটি মেয়ে বলেছিল, মা যেন এখন সর্বক্ষণ স্বপ্নের ঘোরে থাকে, এর বেশি আর কী চাইবার?

ল্যান্ড করতে আর বোধ হয় আধঘন্টা। এয়ারহস্টেসরা ট্রলি ঠেলে ঠেলে প্যান্ট্রিতে ঢুকে যাচ্ছিল। টয়লেটের সামনে লাইন তৈরি হচ্ছিল ক্রমশ। ছোটো বাচ্চার হাত ধরে বাথরুমের দিকে ধাবিত এক তরুণী আমার সীটের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল- " আরে আপনি! আপনার লেখার বিরাট ভক্ত আমি, আমার স্বামী। আপনার লেটেস্ট বই এই সেদিন কিনলাম। দেখো দেখো সোনা, ইনি একজন লেখক"-

-লেখক কী, মা?

সংকর্ষণ আমার এই খ্যাতি দেখে যায় নি। বিয়ের পরপরই একবার খুব জ্বর আমার, খাটে বসে লিখছি- একটা লেখা জমা দেওয়ার শেষ দিন আসন্ন ; সংকর্ষণ অফিস থেকে ফিরেছে, ঘরদোরে জ্বোরো গন্ধ,  আলো জ্বালা হয় নি, রান্না হয় নি, আমার প্রতিটি শ্বাসের সঙ্গে জমা কফের সাঁই সাঁই আওয়াজ, আর আমি লিখে চলেছি; সংকর্ষণ ডেস্কটপের মনিটর তুলে নিয়ে আছাড় দিতে গিয়েছিল- কী মনে হয়েছিল শেষ মুহূর্তে, নিজেই নিজেকে আটকালো যেন, মনিটর নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গিয়েছিল - "তাও যদি তোমার নাম কেউ জানত! লেখো তো পাতি লিটল ম্যাগে, বিনে পয়সায়... " দড়াম করে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গিয়েছিল, মধ্যরাতে ফিরে মিলনে বাধ্য করেছিল, ক্ষমা চেয়েছিল তারপর- জিন ঘটিত দোষের দোহাই দিয়ে। সংকর্ষণের বাবার অদৃশ্য উপস্থিতি সত্ত্বেও কুড়ি বছরের বিবাহিত জীবন ছিল আমাদের। সংকর্ষণের মৃত্যু অবধি। কোনো সন্তান আসে নি। ডাক্তার বলেছিলেন, আমাদের কোনো শারীরিক ত্রুটি নেই। সংকর্ষণ যদিও এজন্য আমার লেখাকেই দায়ী করেছিল। সংকর্ষণ অথবা আমার মৃত শ্বশুরের জিন।

মনস্তাত্ত্বিকের সাহায্য নিয়ে আমার তীব্র আবেগের উৎস অনুসন্ধানের কোনো কারণ তো দেখি না।  নিজের আবেগকে ব্যাখ্যা করা মানে এই গোটা ব্যাপারটাই দোষ বলে মেনে নেওয়া নয় কি? বর্ণনা করতেই চেয়েছি কেবল, ন্যায্যতা প্রমাণের কোনো দায় নেই আমার। 

 তুমুল বৃষ্টিতে নিচের শহরকে জলছবির মত দেখাচ্ছিল ল্যান্ডিংএর আগে। প্লেনের জানলার শার্শিতে মুখ ঠেকিয়ে দেখছিলাম  সরণিতে, গৃহকোণে আলোরা ফুটে উঠছিল, মিলিয়ে যাচ্ছিল তৎক্ষণাৎ, আবার ফুটে উঠছিল;  সে সব অন্য আলো, অন্য রাস্তার, অন্য বাড়ির , তবু তাদের ক্ষণিক আগের আলো বলে বোধ হচ্ছিল। এর ফলে যে মায়া  সৃষ্টি হচ্ছিল, তাতে একপ্রকার স্থিতির বোধ ছিল।  পুতুলের মুখোমুখি হওয়ার তাগিদ প্রবলতর হচ্ছিল ক্রমশ। বেল্ট বেঁধে সীট সোজা করলাম। " মন দিয়ে পড়ছেন আর আপনাকে বারবার বিরক্ত করছি, প্লীজ আমার মেয়েকে কিছু লিখে দিন " - তরুণী দ্রুত এসে অটোগ্রাফ নিল, সেল্ফি তুলল। 

পুতুলের শহরে পৌঁছোলাম প্রায় মধ্যরাতে। বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টের মায়াজীকে এখনও যোগাযোগ করতে পারি নি।  আশা করি,  চাবি যথাস্থানেই থাকবে। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। ট্যাক্সির লম্বা লাইন। জমা জলে শহরের নিয়নসাইন চলকে ওঠে। ট্রলি ব্যাগ টেনে টেনে রাস্তা পার হয়ে যান ক্লান্ত যাত্রীরা -পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বা উবরের সন্ধানে।  প্রায় আধঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। উবর বুক করেও  সুরাহা হয় নি। বারেবারে ক্যানসেলেশনের মেসেজ আসছিল।

- এত রাতে অতদূর যাবেন? ঠিকানায় কোনো ভুল নেইতো?

- এই ঠিকানাই। ব্রীসাইড ব্লিস। বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট। কোনো সমস্যা আছে যেতে?

- দিনের বেলায় অসুবিধে নেই। টুরিস্ট স্পট। এত বৃষ্টি হচ্ছে আসলে, জায়গাটা প্রায় জঙ্গলের মধ্যে, ন্যাশনাল ফরেস্ট শুরু হচ্ছে ওখান থেকেই। রাস্তায় আলো টালো নেই। চলুন দেখা যাক।

শহরের মাঝখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছিল, জলকাদায় সেখানে এক বিশাল ট্রাক গাড্ডায় পড়েছে; ফলে ট্যাক্সি,  বাস, অটো  জট পাকিয়ে যেন এক চাইনিজ অয়্যার পাজল কিম্বা বিশাল চেসবোর্ডে স্টেলমেট হয়ে আছে। শহর পেরোতেই প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ। ফ্রী ওয়ে ধরতেই ট্যাক্সির সঙ্গে হাওয়ার গতিবেগ পাল্লা দিয়ে বাড়ল। গাড়ির ভিতরে হাওয়ার শব্দকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন মনে হচ্ছিল আমার। উইন্ড শিল্ড, জানলার কাচ বেয়ে নিরবচ্ছিন্ন জলের ধারা, ট্যাক্সির অভ্যন্তরে জলীয় বাষ্প তৈরি হয়ে কাচকে অস্বচ্ছ করে দেয়। সেই কাচে আমি আঙুল দিয়ে নৌকা আঁকি, ঢেউ আঁকি। কিন্ডলে অ্যানি আর্নো খুলি আবার। 

যেখানে তার গর্ভপাত ঘটেছিল, সেই ক্লিনিকে মেয়েটি কি কখনও আবার যায়, আমার মতো? মাঝে মাঝে মনে হয়, অন্য সবাই ঠিক আমার মতই ভাবে কীনা , একই কাজ করে কী না - এসব জেনে নেওয়াই বোধ হয় আমার লেখালেখির একমাত্র কারণ অথবা এই অ্যাবরশন ক্লিনিকে আবার ঘুরে আসাও যে খুব স্বাভাবিক এই টুকু পাঠককে বলা। এও ভাবি, এই সব অনুভূতি যেন তাদের একান্ত নিজস্ব হয়, সে সময় যেন  আমার লেখার কথা তাদের মনে না পড়ে।

এসির টেম্পারেচর বাড়াতে বললাম। গাড়ির সীট যেন শীতল রক্তের কোনো প্রাণীর শরীর। চোখ বুজে পিঠ ঠেকাতে গিয়ে আমার অ্যাবর্শনের দিনের কথা মনে পড়ল। অ্যানি মেট্রোয় ফিরেছিলেন অ্যাবর্শনের পরে। আমি ট্যাক্সিতে। বিয়ের পরে আমার লেখা চালিয়ে যেতে অসুবিধে হচ্ছিল, অথচ সংকর্ষণকে ছেড়ে চলে আসার মতো মনের জোর ছিল না। এর মধ্যে সন্তান এলে লেখা অসম্ভব হয়ে যেত। নিয়মিত ওষুধ খেতাম তাই। তবুও নাছোড় কেউ কী ভাবে এসে গেল জরায়ুতে।  সম্ভাবনা বুঝতে পেরে ক্লিনিকে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে এসেছিলাম।

-টেম্পারেচর ঠিক আছে ম্যাডাম?

চোখ বন্ধ রেখেই হ্যাঁ বললাম। হাত মুঠো করলাম, খুললাম,  বন্ধ করলাম। লেখাকে কী দিয়েছি ক্যামেরার সামনে বলতে আমার গলা কাঁপবে না।

-আর কতক্ষণ?

-বেশিক্ষণ নয়, তবে রাস্তা চিনতে সময় লাগবে-

-কেন? জিপিএস?

-এখানে কাজ করে না। রাস্তার নামই নেই।, তবে আমি আগে এসেছি দিনের বেলায়। আন্দাজ একটা আছে কিন্তু এত বৃষ্টি, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না- দেখুন তো, এই বাড়িটা মনে হচ্ছে।

 নীল রঙে বড় হরফে ব্রীসাইড ব্রীজ লেখা- আলো জ্বলছিল বাড়ির সামনে। ভাড়া মিটিয়ে নেমে এলাম। শুনশান রাস্তা । ট্যাক্সির টেললাইট মুহূর্তে রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে গেল। সামনে বৃষ্টির পরদা। মোবাইলের আলোয় গাছের শিকড়দের ওঁত পাতা গিরগিটির মতো লাগে। রাস্তা পেরোতেই পুরো ভিজে গেলাম। মায়াজী বলেছিলেন লাল চেয়ারের পাশে ছোটো কৌটোয় চাবি থাকবে। এদিকে দরজার সামনে কোনো চেয়ারই নেই। মায়াজীকে ফোন করি, একবার দুবার, তিনবার-্ফোন বেজে বেজে কেটে যায়, আবার ডায়াল করি আবার কাটে। 

"পৌঁছে গেছেন নিরাপদে আশাকরি"-পুতুলের মেসেজ অপ্রত্যাশিত। টেক্স্ট না করে পুতুলের নম্বরে ডায়াল করি সটান-" সরি, এত রাতে ফোন করলাম।"

- আরে আমিই তো মেসেজ করে ডিস্টার্ব করলাম; আসলে কালকের প্ল্যানটা একটু বদলাচ্ছি-

-পুতুল, শোনো,  আমি এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে, চাবি খুঁজে পাচ্ছি না

-চাবি ছাড়া তালা খুলতে পারেন না? সে কী? আপনার হীরোরা তো পারে- সরি, রাগ করবেন না। মজা করছি। শুনুন, আপনি ঠিক কোথায় বলুন তো? সদর দরজায়? আলোর সামনে?

-হ্যাঁ-

- ওখানে চাবি পাবেন না। ডানদিকে একটা রাস্তা দেখছেন?

-সাংঘাতিক অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। 

-মোবাইলের টর্চ জ্বালুন , তারপর  ডান দিক দিয়ে বাড়ির পিছনে পৌঁছে যান, ওটা খিড়কি, ওখানেই চাবি রাখা-

- আমার তো ডেড এন্ড মনে হচ্ছে-

-নতুন এলে, এই অন্ধকারে সেটাই স্বাভাবিক। আমার অনেক গেস্ট ব্রীসাইডে থেকে গেছেন, রাতে পৌঁছে তাঁদের অনেকেরই এই সমস্যা হয়েছিল। আচ্ছা আপনি দাঁড়ান। আমি আসছি । দশ মিনিট লাগবে। এর মধ্যে আপনি হয়তো নিজেই চাবি পেয়ে যাবেন। আচ্ছা শুনুন, একটা  কথা ভাবছিলাম, লেখাকে কী দিয়েছি প্রশ্নটা ক্যানসেল করব। পাঠককে হাঁড়ির খবর জানানোর কী দরকার?  তার চেয়ে সেই গোপন কথা নিয়ে আপনি বরং একটা গল্প লিখুন, যদি এতদিনে না লিখে থাকেন। লিখেছেন কি?

-না

-আমিও লিখব।  আমাদের দুজনের আগামী পাঁচটা লেখার একটা এই থীমে হতে হবে। তারপর আমরা গেস করব পরস্পরের গোপন কথা-

- রাজি, কিন্তু কালকের কথোপকথন খুব সাদামাটা হয়ে যাবে না তাহলে?

-তা কেন? আপনি আমার লেখাকে  নস্যাৎ করে জনপ্রিয় হওয়ার টেকনিক শেখাবেন। 

- তুমি আমাকে শিখিও অ-জনপ্রিয়তার টেকনিক

- আপনি সে সবই জানেন, তবু ক্যামেরার সামনে শেখাবো না হয় …বাই দ্য ওয়ে, সিম্পল প্যাশন পড়লেন নিশ্চয়ই।

ব্রীসাইড ব্রীজের সদর দরজার সামনে  আমি আবার কিন্ডল খুলেছিলাম। 

আমি আমার সমস্ত শরীর দিয়ে সময়ের পরিমাপ করেছি। মহৎ অথবা মারাত্মক সব আকাঙ্খা, আত্মমর্যাদার নিদারুণ অভাব, আশ্চর্য সব মনোবৃত্তি অথবা বিশ্বাস যা এতদিন নিতান্ত অযৌক্তিক মনে হত , তা নিজের মধ্যেই আবিষ্কার করেছি। অজান্তেই ও আমাকে মাটির কাছাকাছি নামিয়ে এনেছিল।

বৃষ্টি ধরে এসেছে। পুঞ্জিভূত মেঘ আকাশে। হাওয়ায় জলের রেণু উড়ে আসছিল। টর্চ জ্বালিয়ে চাবি খোঁজার কোনো চেষ্টা করছিলাম না- ডানদিকের অন্ধকারকে এখনও ডেড এন্ড মনে হচ্ছিল।  জোলো হাওয়ায় হরেক গল্প ভেসে বেড়াচ্ছিল, এলোমেলো । হাওয়াকলের ঘূর্ণ্যমান ব্লেড বন্ধ রেখেছিলাম, উড়ন্ত গল্পদের তৎক্ষণাৎ  জনপদে ফেরৎ পাঠানোর কোনো তাগিদ আমার ছিল না। বৃষ্টিবারিবিন্দুগুলি লম্বা লম্বা গাছেদের কান্ড বেয়ে নেমে আসছিল, রাস্তার জমা জলে মিশে যাচ্ছিল। স্রোত তৈরি হচ্ছিল একটা। জল বয়ে যাওয়ার সেই সব আওয়াজ শুনতে শুনতে, সমস্ত সত্ত্বাকে প্রদীপশিখার মতো দুহাতে আড়াল করে আমি পুতুলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।


 [ইটালিক্সে সিম্পল প্যাশনের কিয়দংশের ভাবানুবাদ লেখক-কৃত]

[প্রথম প্রকাশ : লেখাজোকা বইমেলা সংখ্যা, ২০২৫]

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

পদ্মসম্ভব