অ্যানাগ্রাম
- তোরা কি শেষ অবধি যাবি?
- মানে শ্মশানে যাবো কি না বলছিস?
"শেষ অবধি মানে তো তাই, না?"- সাইড মিরর দেখে নিয়ে একবার ঘাড় ঘোরালো অশোক, তারপর আবার সামনে। নীরবতার স্ট্রেচ তৈরি হল একটা; সুপ্রিয়া বাইরের কুয়াশায় তাকিয়ে রইল, পিছনের সীটে পৃথ্বীশ আর আমি পরস্পরকে একবার দেখে নিলাম যেন গো গো গো গো স্ট্যাচু খেলার ডাক দিয়েছে কেউ, আর আমরা সে খেলায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য পারস্পরিক অনুমোদন চাইছি যা অনাবশ্যক অথচ অবশ্যম্ভাবী। সুপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে নিয়ে অশোকই কথা বলে উঠল আবার - "স্নেহর ওখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না বুঝলি? আসলে, সুপ্রিয়ার পিসির বাৎসরিক আজ - বেহালায় যেতে হবে। তোরা তবে ফিরবি কী ভাবে? শ্মশানে যাস যদি. উবার নিবি?" "ভাবি নি কিছু, ওখানে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে.. মানে স্নেহময়ের লোকবল কেমন সেটা বুঝে…" - পৃথ্বীশ জানলার কাচ নামাল সামান্য। একটা শ্বাস ফেলল আওয়াজ করে। গুমোট কাটানোর জন্য ঐ শ্বাসটুকু লুফে নিয়েই তাতে কথা জুড়ে দিলাম আমি- " ট্রেনে ফিরে আসব, স্নেহদের বাড়ির কাছেই স্টেশন। মনে নেই?" শেষ দুটি শব্দ ভর করে পুরোনো কথাদের আসা উচিত; অথচ অশোক বর্তমানেই - "কাচটা তুলে দে রে, সুপ্রিয়ার অ্যাজমা অ্যাটাক শুরু হয়ে যাবে- বাইরে দ্যাখ - কী স্মগ, ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছিস না?"
যদিও কুয়াশা কেটে যাচ্ছিল, উড়ালপুলের মাথার ওপর থেকে শহরের উত্তরাংশ দৃশ্যমান হচ্ছিল ক্রমশ। রাতের দিকে এখান থেকে শহরকে আলোর নদীর মতো দেখায়, ফ্লাইওভার দিয়ে নামার সময় শরীরে একটা শিরশিরানি জন্ম নেয় - হয়তো নিরবচ্ছিন্নতাকে ফীল করা- নৌকো বেয়ে চলার মতো লাগে তখন। আজ এই ভোরে, সেরকম কিছু ঘটছিল না; কিছু নিয়নসাইন জ্বলছে , রাস্তার বাতিও- কুয়াশায় সে সব আলো মিটমিটে এবং ভুতুড়ে আর গাড়ির অভ্যন্তরে আমরা চারজন খণ্ড খণ্ড সময় নিয়ে নাড়াচাড়া করছি।
"আমার প্রচন্ড ডাস্ট অ্যালার্জি, সেজন্যই ভয় পাচ্ছে; আজ ও একটু শেকি আসলে "- সুপ্রিয়া ঘাড় ঘোরালো। অশোক বলল, "দেবারতির ঘটনাটা বলো। অ্যালার্জি কী ভয়ংকর হতে পারে। অ্যাকচুয়ালি দেবারতির খবরটা পেয়ে এই রকমই সকালবেলা বেরিয়েছিলাম, তাই না?" "হ্যাঁ, এরকমই ভোরে; দেবারতি আমার ব্যাচমেট , চিংড়িতে যে ওর অ্যালার্জি - আমরা সবাই জানতাম" - চশমা খুলে আবার পরল সুপ্রিয়া যেন অতীতের কোনো দৃশ্যকে দেখে নিয়ে বর্তমানে ফিরছে - "একদিন ভোরে দেবারতির ভাই ফোন করে বলল, ও আর নেই। আমরা সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ি, মাথা কাজ করছিল না- এত আকস্মিক ঘটনা। গিয়ে শুনলাম, আগের সন্ধ্যায় ওর বর চিংড়ি মাছ এনেছিল, দেবারতি তরিবৎ করে রাঁধে। তারপর দশটা এগারোটা থেকে ভয়ংকর শ্বাসকষ্ট .... কাছের নার্সিংহোমে নিয়ে চিকিৎসা শুরুও হয়, ভোররাতে হার্ট ফেল -" সুপ্রিয়া চুপ করে গেল, নাক টানল সামান্য। "অ্যানাফল্যাক্সিস। রান্না করে হাত টাত ধুয়ে নেন নি তার মানে, কখন যে কী হয় মানুষের!" পৃথ্বীশকে দৃশ্যতই আতঙ্কিত দেখায়। অশোক ঘাড় ঘোরায়- "গল্প এখানেই শেষ নয় রে। আমরা তখন দেবারতিদের বাড়িতে, ফুল টুল আনা, হার্সের ব্যবস্থা চলছে; ওদের গ্রুপেরই একজন- মীরা - জল খেতে না চা বানাতে দেবারতিদের রান্নাঘরে ঢোকে। তো, সেখানে দেখে, সিঙ্কে দুটি থালা, দুটিতেই চিংড়ির খোলা টোলা মানে ভুক্তাবশেষ আর কি আর থালায় আঙুলের দাগ শুকিয়ে রয়েছে।"
-মানে? ভদ্রমহিলা জেনেশুনে চিংড়ি খেয়েছিলেন?
- স্পষ্ট করে কিছু বলা যায় না। তবে মীরা তো বটেই, আমরা সকলেই খুব শকড হই। আসলে ওদের স্বামী স্ত্রীর খুব গন্ডগোল চলছিল কয়েকবছর, দেবারতি নিজেই ফোন করে বলত বন্ধুদের। ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে এরকমও বলত। তাই ব্যাপারটা আরো শকিং মানে যেমন হয়- নানা সন্দেহ, আশংকা...আচ্ছা একটা কথা বল -এই কথার পিঠে মনে হল, স্নেহ আর গোপার সম্পর্কটা ঠিক হয়েছিল মানে আগের মতো?
- থাক না এসব কথা, গোপাদি তো আর নেই। কী মারাত্মক কষ্ট পেলেন শেষদিকটায়, উফ ভগবান -
"অশোক, সামনে দাঁড়াবি কোথাও?" সুপ্রিয়াকে প্রায় থামিয়ে দিয়েই বললাম। উড়ালপুল থেকে নেমে সামান্য ঘিঞ্জি এলাকা এখন - ফ্ল্যাটবাড়ি, ছোটো দোকান, ফুটপাথে বাজার বসছে।
- সত্যি সমীর, তুই আর বদলালি না। ছোটো না বড়ো? কিন্তু এখানে কোথায় করবি? চেনা বাড়ি টাড়ি,...
- ফুল নিতে হবে না? দাঁড়া। আমি নিয়ে আসছি।
ফুটপাথ ঘেঁষে অশোক নিখুঁত পার্ক করেছিল। "তুই চিনিস এ দিকটা? কোথায় ফুল পাবি? চল আমিও যাচ্ছি" - পৃথ্বীশ নেমে এল। অশোকও সীট বেল্ট খুলল, তারপর গাড়ির দরজা- রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত পা টান করতে লাগল।
ভোর হচ্ছিল; রাতের গাড়িদের ডিজেল আর ধোঁয়ার বাসি গন্ধের সর ছিঁড়ে দিচ্ছে গরম তেলের বাস-ছোটো দোকানে কচুরি ভাজা শুরু হয়েছে, কাগজ নিয়ে গলিতে ঢুকে যাচ্ছে সাইকেল, মিষ্টির দোকানের শাটার তোলার আওয়াজ হল। গোপা এসব আর দেখবে না। রাস্তার ওপারে ছোটো ফুলের দোকান - কুচো ফুল, মালা; শ্বেতপদ্মের রীথ পছন্দ করল পৃথ্বীশ; দু'ডজন রজনীগন্ধা প্যাক করাচ্ছিলাম আমি- " আর কিছু নিবি, পৃথ্বীশ?
- এইই থাক । পৌষালীও ফুল নিয়ে আসবে। তাই তো বলল।
- ওকে ক’টায় তুলে নেব, বলেছিস?
- মোটামুটি একটা উইন্ডো দিয়েছিলাম। এখন টেক্স্ট করব। ওর বাড়ির কাছাকাছি এসেই গেছি, না?
- রাস্তা ফাঁকা তো, আর হয়তো মিনিট পনেরো বড়জোর-জানিয়ে দে। কল্যাণকে ফোনে পেয়েছিলি? আসবে কি না বলল কিছু?
- পৌঁছে যাবে বলল। বেরোনোর আগে তাড়াহুড়োয় কথা তো। বাড়িতে না ডাইরেক্ট শ্মশানে যাবে জিজ্ঞেস করা হয় নি।
-শ্মশান কথাটা আজকাল আর সহজে বলতে পারি না জানিস? কেমন অস্বস্তি হয়।
দোকানের সামনেটায় সামান্য জল, পাতা, ছেঁড়া ফুল- পিছল মতো; সে সব পেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে হাঁটছি; মাথা নামিয়ে গাল চুলকোচ্ছিল পৃথ্বীশ- না কাটা দাড়ি, সব পাকা; চুলে আঙুল চালাল -" ষাট তো হল প্রায়। থাকতেও পারি আরো তিরিশ চল্লিশ বছর আবার কালই ফুটে যেতে পারি….ভেবে কী হবে?" ওর কথার ধরণে ডাকাবুকো ভাবটা এখনও স্পষ্ট। তবু বললাম, বলা দরকার মনে হল- "ভয় করে মাঝে মাঝে, জানিস। লেট ম্যারেজ তো। ছেলেটা এখনও দাঁড়ালো না সেভাবে, মেয়েটাও পড়ছে; কিছু হলে..." "ধুস, কিস্যু হবে না। চেক আপ করাবি রেগুলার। নিজের। পূর্ণিমার। দ্যাখ, গোপার তো যাওয়ারই ছিল, কতদিন ভুগল...আরে আরে দেখে পার হবি তো? এক্ষুণি ধাক্কা লাগত"- আমার কনুই ধরে টান মারল পৃথ্বীশ। সাঁ করে বেরিয়ে গেল মোটরবাইক।
" তোদের এতক্ষণ লাগল? আমি তো ভাবলাম পাঁচ মিনিটে হয়ে যাবে। থামলামই যখন চা খেয়ে নিবি নাকি?" সিগারেট টানছিল অশোক। সুপ্রিয়া গাড়ির ভেতরেই, মোবাইল দেখছে।
- পৌষালী চা আনবে। এইতো টেক্স্ট করল।
- চল তবে। এই, পৌষালী একা আসছে তো?
" হ্যাঁ,বলে দিয়েছি গাড়ি প্রায় ভর্তি- একজনেরই জায়গা হবে, তাছাড়া জয় খুবই ব্যস্ত..." আচমকা চুপ করে গেল পৃথ্বীশ। "তোর সঙ্গে ভালই যোগাযোগ আছে তাহলে, আমাদের সঙ্গে বহুদিন সেভাবে কথা হয় নি... নে চল.." গাড়ির চাবি আঙুলে দুলিয়ে নিল অশোক, তারপর চটিতে সিগারেট পিষে স্টীয়ারিংএ বসল। "একটু দাঁড়াবে? গা গোলাচ্ছে কেমন" - সুপ্রিয়া কাচ নামালো। ঘামছে। বাইরের হাওয়া বাতাস চোখে মুখে নিতে চাইছিল।
- মনে হয়, অ্যাসিড হয়ে গেছে। জল খাবে? ওষুধ আছে সঙ্গে? এই তোদের কাছে জেলুসিল টিল হবে কিছু?
সুপ্রিয়া হাত তুলল, মুখ ঘোরালো আমাদের দিকে, অস্ফুটে বলল- "লাগবে না"; দরজা খুলে, পা নামালো রাস্তায়, যেন দম নিচ্ছে; ফুটপাথের দিকে মাথা নোয়ালো তারপর, ওয়াক তুলে বমি করতে লাগল।
২
পৌষালীকে অনেকদিন পরে দেখলাম। সেই একই রকম আহ্লাদী চেহারা; বড়ো ব্যাগ, ঢাউস ফ্লাস্ক, স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগে মালা, ফুল টুল- খলবল করে গাড়িতে ঢুকলো। ওকে জায়গা দিতে আমার দিকে অনেকখানি চেপে এলো পৃথ্বীশ।"তোর কাছে জেলুসিল হবে পৌষালী? আসলে সুপ্রিয়ার অ্যাসিডিটি হয়ে গেছে. ওষুধের দোকান খুলতে দেরি আছে.." গাড়ি স্টার্ট করতে করতে পিছনে ঘুরল অশোক। "ওমা কী হল তোমার সুপ্রিয়া- জেলুসিল থাকার কথা তো, না কি অনডেম দেব?..." পৌষালী ব্যাগ ঘাঁটতে থাকে। " লাগবে না, ভালো লাগছে অনেক। পরে মনে হলে চেয়ে নেব। কেমন আছ তুমি? কতদিন পরে দেখা হল! " অবসন্ন শোনাচ্ছিল সুপ্রিয়ার গলা। "একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিলে পারতে, যাক যা ভালো বোঝো-" স্পীড তুলল অশোক আর "উঃ" বলে চেঁচিয়ে উঠল পৃথ্বীশ- "ফ্লাস্কের ঢাকনা লাগাস নি ঠিক করে?" "সরি সরি, ভেরি সরি। টাইট করেই তো লাগালাম" - ব্যাগ রেখে দ্রুত ফ্লাস্কের অবস্থান বদলালো পৌষালী। "পুড়ে গেল নাকি?" - সুপ্রিয়া দ্রুত পিছন ফিরল।
- কী রে দাঁড়াবো সামনে ? সিরিয়াস কিছু?
-না না জাস্ট ছ্যাঁকা মতো। তুই চল।
"বোরোপ্লাস লাগিয়ে নিবি?" পৌষালী আবার ব্যাগ ঘাঁটতে থাকে। “ফ্লাস্কটা সামনে দাও না, আমি ধরছি"- সুপ্রিয়া হাত বাড়িয়েছিল। " তুমি আরাম করে বোসো তো। সব সামলে নিয়েছি। আরে জয়ের নার্সিং হোম এই পথেই , বলছিল নিয়ে যাবে। হাত পা ছড়িয়ে যেতে পারতাম হয়তো কিন্তু মনে হল, তোদের সঙ্গেই যাই। স্নেহকে কেমন দেখব কে জানে রে... গত সপ্তাহে ফোন করেছিলাম, জানিস তো? কথা বলতে চাইছিল না, বোঝাই যাচ্ছিল, স্নেহ আর পেরে উঠছে না, অসম্ভব টায়ার্ড- ক'মাস যেন ঝড় বয়ে গেল - আর কতক্ষণ লাগবে রে অশোক?" নাগাড়ে কথা বলতে থাকে পৌষালী। সামান্য হাঁপায়।
- আর বড় জোর আধ ঘন্টা। কুড়ি মিনিটেই পৌঁছে যাব মনে হয়। তুই কী ভাবে ফিরবি? তোকে নামিয়ে দিয়ে যেতে পারি কিন্তু।
- স্নেহদের বাড়ির কাছেই তো মেজমামার ফ্ল্যাট। ওখানে চলে যাব। জয় ওটি করে ফেরার পথে নিয়ে যাবে। এই পৃথ্বীশ, স্নেহর গলা কেমন শুনলি রে? খুব ভেঙে পড়েছে না?
- ফোনে অত বোঝা যায় ? আর ক'সেকণ্ড মাত্র কথা। বললাম - আসছি। বলল- আয়।
অশোক উসখুস করছিল, একবার পিছনে তাকালো, আবার সামনে, রিয়ার ভিউ চেক করল; চিবুক উঁচু করে গলা তুলল সামান্য- " শোন, তোদের একটা কথা বলি। বলি নি কখনও। স্নেহ একবার আমার কাছে এসেছিল। একটা অনুরোধ নিয়ে।" " থাক না, অশোক" - সুপ্রিয়ার গলায় ক্লান্তি স্পষ্ট।
- না, আজ বলি। আজই বলা ভালো। নিন্দে তো করছি না। একটা ফ্যাক্ট জাস্ট। আর তোদের কাছেই... বাইরের কাউকে বলতেও যাচ্ছি না। মানে সে প্রশ্নই নেই। আসলে গোপার এই অসুখ, চিকিৎসার বিরাট খরচ - স্নেহর ধার দেনা হয়ে যাচ্ছিল বিস্তর।
" আমরা তো টাকাও তুলেছিলাম"- আমার কথায় পৃথ্বীশ মাথা নাড়ল।
- সে সব যথেষ্ট ছিল না। ও একটা অ্যামাউন্ট সরিয়েছিল অফিস থেকে। ফেরত দেবে ভেবেছিল, পারছিল না। আমার কাছে এসেছিল টাকার জন্য। দিতে পারি নি সেদিন। পরে একদিন ফোন করে বলেছিল, অফিসের ঝামেলা মিটিয়ে নিয়েছে। কোনো বন্ধু নাকি সাহায্য করেছে। স্নেহ নাম বলে নি। আমিও জানতে চাই নি। সমস্যা মিটে গেছে এই অনেক। আসলে লস্ট ব্যাটল জেনেও, স্নেহ গোপাকে বেস্ট ট্রীটমেন্ট দিতে চেয়েছিল- তার খরচ ... একটাই কথা মনে হত তারপর থেকে- সেজন্যই তোদের জিজ্ঞেস করছিলাম- ওদের সম্পর্ক আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছিল? জানিস তোরা?
" কী করে বলব? তবে সমীর তো গোপা, স্নেহময়ের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অবধি ছিল, রাকেশকেও চিনত; পরে একটা সময় আমি মাদ্রাজে, তুই আমেরিকায়, গোপা ইটালি চলে গেছে, সমীরই একমাত্র রেগুলার যেত স্নেহময়ের কাছে - কী রে? "- পৃথ্বীশ যেন একটা বেমক্কা ব্যাকপাস করল আমাকে। রিসিভ করব না গোলে ঢুকে যেতে দেব- কথা বলতে বলতে ভেবে নিচ্ছিলাম- "গত দু তিন বছর গোপার এই অসুখ - স্নেহ যথাসাধ্য করল ; এর বেশি কী আর জানার দরকার বল-"
- আসলে ব্যাপারটা আনইউজুয়াল তো, স্নেহর সঙ্গে প্রেম ছিল কবে থেকে; বিয়েও করল, তারপর ছেড়ে চলে গেল ইটালি না জার্মানি -রাকেশের সঙ্গে-
- অশোক, প্লীজ। এসব কথা না বললেই নয়?
“ রিল্যাক্স সু। আজ এসব কথা হবেই। আসলে, স্নেহর কোনো অ্যাম্বিশন ছিল না, তার ওপর একগুঁয়েমি -এই শহর ছেড়ে যাবে না; গোপা অত ব্রাইট মেয়ে, স্কলারশিপও পেয়ে গেল...আমি তো গোপার দোষ দেখি না কোনো। দিব্যি কাজ করছিল ওখানে, ইউনিভার্সিটিতে, রাকেশের সঙ্গে কয়েকবছর সংসারও তো করল, আবার ফিরে এল স্নেহর কাছেই। অদ্ভুত না? ওদেশে থাকলে হয়তো বেটার চিকিৎসা হত, হয়তো রোগটাই হত না- কে বলতে পারে ! কার যে কোথায় মৃত্যু লেখা থাকে ..." অশোক গতি কমিয়ে, হর্ন বাজালো -সামনে দুটো রিক্শা, অটো; একটা কুকুর হেলেদুলে রাস্তা পার হল।
"সত্যি, ঠিক বলেছিস অশোক- " পৌষালী অনেকক্ষণ পরে কথা বলে উঠল-" কাগজে পড়েছিলাম জানিস - আসাম থেকে একটা গণ্ডার ফ্রান্সে গিয়েছিল- "
- গন্ডার!
“হ্যাঁ রে, চন্দননগরের গভর্নর পাঠিয়েছিলেন, যতদূর মনে পড়ছে। ভার্সাইয়ের প্রাসাদে পৌঁছতে কয়েকমাস লেগে গিয়েছিল। তারপর ফরাসী বিপ্লবের সময় গন্ডারটাকে মেরে ফেলে লোকজন। ভাব একবার, আমাদের আসামের গণ্ডার কোথায় গিয়ে মরল-" আমাদের শব্দটার ওপর এমন জোর দিল পৌষালী যেন ওর পোষা।
"আমিও কাগজে পড়েছি । ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে একজিবিট। আসলে কী জানিস, সমীর ঠিকই বলেছে - স্নেহময় সব রকম চেষ্টাই করেছে; ওর রোজগারও যে বিশাল কিছু তাও নয়, তবু করল তো। কাজেই ধরেই নেওয়া যায়, চিড়টা জুড়ে গিয়েছিল সামহাউ"- পৃথ্বীশ কোমরে আঙুল ছুঁইয়ে চোখ মুখ কুঁচকালো।
"বাট হাউ?" - অশোক নাছোড়বান্দা-" ওদের কোনো সন্তানও নেই মানে বাচ্চাকাচ্চারা অনেক সময় সিমেন্টিং করে তো"- সুপ্রিয়াকে একঝলক দেখে নিয়ে আবার রাস্তায় তাকালো। " - - ইউনিভার্সিটিতে ওদের প্রেমের সময়টায় খুব কাছ থেকে দেখেছি, রেজিস্ট্রেশনেও ছিলাম। নেমন্তন্ন করতে এসে স্নেহ একটা কথা বলেছিল। বলেছিল, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য জল লাগে। গোপা আমার নদী। এই নদীর কূলে জীবন কাটাব। আর কোথাও যাব না " - আমার গলা ধরে গেল। একটা দুটো সিঁড়ির ধাপ টপকে টপকে বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে আমাদের ছাদের ঘরে উঠে আসছে স্নেহ, চকরা বকরা একটা শার্ট পরেছে - এই তো সেদিন যেন-
"এটাই বুঝতে চাইছিলাম, কত ভালোবাসলে মানুষ…" অশোক ইউ টার্ন নিল আচমকা, ঝাঁকুনিতে আমার মাথা ঠুকে গেল জানলার কাচে।
- সরি, ভেরি সরি, বাঁদিকের রাস্তায় ঢোকার ছিল, কথায় কথায় মিস করে গেছি।
সুপ্রিয়া অশোকের কাঁধে হাত রাখল প্রথমে, মৃদুস্বরে বলল " কী হচ্ছে অশোক? আস্তে। সাবধানে"; তারপর মুখ ফেরালো এদিকে-" একটা অদ্ভুত ব্যাপার - আজই বলি। গোপাদি শেষের দিকে কথা বলতে পারতেন না, হাতের কাছে একটা বেল ছিল, চব্বিশ ঘন্টার আয়া, নার্স। দেখেছিলাম, মাঝে মাঝে একটা ছোটো লাঠি দিয়ে টেবিলে, খাটে আওয়াজ করছেন, করেই চলছেন, কিন্তু কিছুতেই বেল বাজাচ্ছেন না। ঐ ঘরে বসে থাকলে সে আওয়াজ সহ্য করা যায় না এমন। নার্স দৌড়ে যাচ্ছেন, সঙ্গে আয়ামাসি-কী কষ্ট হচ্ছে, জল ডায়াপার এইসব ; আর গোপাদি মাথা নেড়ে যাচ্ছেন দুদিকে আর লাঠি দিয়ে ঠক ঠক ঠক ঠক। স্নেহময়দা এসে দাঁড়াতেন তখন। গোপাদি তখনও আওয়াজ করতেন- দুবার কখনও তিনবার চারবার তবে আওয়াজ স্তিমিত অনেক।"
" আমরাও দেখেছি"-পৃথ্বীশ কপাল মুছল। "হ্যাঁ হ্যাঁ , মনে পড়ল। জয় বলেছিল- নার্ভের কী একটা প্রবলেমের জন্য নাকি এমন হয়, নিজেকে থামাতেই পারে না- " কথা বলতে বলতেই আবার ব্যাগ আর ফ্লাস্কের অবস্থান বদলালো পৌষালী।
- কিন্তু জানেন, আমার মনে হত, উনি এইভাবে কথা বলছেন স্নেহময়দার সঙ্গে। জোরে আওয়াজ করছেন - দূরে থাকলে যেমন চেঁচিয়ে ডাকে মানুষ। তারপর আস্তে আস্তে আওয়াজ করতেন -একটা কোড ছিল মনে হয়- দুবার আওয়াজ মানে এই, চারবার মানে এই- শুধু ওঁরা বুঝতেন। বাইরের লোকের সামনে এইভাবে কথা বলতেন। অশোককে বলেছিলাম, এইভাবে কমিউনিকেট করছেন গোপাদি। ও তো ...
সুপ্রিয়ার কথার শেষটুকু স্টীয়ারিংয়ের সঙ্গেই পাকড়ে নিল অশোক- "তোমরা মাইরি অতি মাত্রায় রোমান্টিক। আমার তো বরং উল্টোটাই মনে হত। স্নেহকে যেন সহ্যই করতে পারছে না গোপা। লাঠি দিয়ে তাড়াতে চাইছে। এমনও মনে হয়েছে-গোপা আসলে এখান থেকে চলে যেতে চাইছে। স্নেহর কাছ থেকে মুক্তিই চাইছে।"
নীরবতার সেই পরিসর আবার ফিরে এল গাড়ির অভ্যন্তরে। পৌষালী জানলার বাইরে তাকিয়ে। পৃথ্বীশের কালো চশমা- চোখ বুজে আছে না কিছু দেখছে বোঝা যায় না; মাঝে মাঝে আঙুল ছোঁয়াচ্ছে কোমরে, মুখ বিকৃত করছে সামান্য। মোবাইল খুলে গোপার খবরটা কলেজের গ্রুপে পোস্ট করছিলাম আমি- সকালের তাড়াহুড়োয় জানানো হয় নি। আর একটা ট্রাফিক সিগনাল পেরোলাম, তারপর ডানহাতি গলিতে ঢুকে পার্ক করল অশোক; মিউনিসিপালিটির শববাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে, ছোটো লোহার গেট পেরিয়ে ঘাসজমি। তারপর কাঠের দরজা। পুরোনো। সবুজ রং কালচে মেরে গিয়েছে। চটিজুতোর জটলা সামনেটায়।
৩
বিকেলের ট্রেনে ভিড় ছিল না।
"ছটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব" গম্ভীর গলায় পৃথ্বীশ বলল- ঠিক স্টেশনের ঘোষণার মতো; যেন বলছে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে ডাউন ট্রেন ঢুকবে। বাড়ি শব্দটাও অনেকক্ষণ পরে শুনলাম; এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে- আজ স্নান হয় নি, দু কাপ চা আর বিস্কুট ছাড়া আর কিছুই খাই নি আমরা কেউই। শ্মশানের কাজ সেরে স্নেহরা কখন ফিরবে কখন খাবে!
-ওদের ফিরতে রাত হবে, বল?
-কত লম্বা লাইন , ওদের আগে ক'জন - তার ওপর সব।
- স্নেহর ভাইঝি কদিন এখানে থেকে যাবে বলছিল না? ভালো হয় তাহলে। নইলে খাওয়া দাওয়াও করবে না ঠিকমতো।
লম্বা শ্বাস ফেলে জানলার বাইরে তাকালো পৃথ্বীশ-" কষ্ট তো হবেই। তারপর আস্তে আস্তে সয়ে যাবে।"
- স্নেহ যে কষ্ট পেয়েছে সে তুলনায় হয়তো এ শোক...
- গোপার ইটালি চলে যাওয়ার কথা বলছিস?
- তার চেয়ে আরো বেশি কিছু, অশোকদের সামনে বলি নি। ইটালিতে গোপা আর রাকেশের যমজ বাচ্চা হয়েছিল জানিস?
-তুই কী করে জানলি?
-স্নেহই বলেছিল। জন্মেই মারা যায় তারা। তারপরেই রাকেশের সঙ্গে গন্ডগোল হয়ে ছাড়াছাড়ি। গোপা ফিরে আসে।
- ফিরে আসার কথাই জানি। আর বেশি কিছু…. জিজ্ঞেস তো করা যায় না বল?
- গোপা ফিরেছিল স্নেহর কাছে ঠিকই কিন্তু ঐ বাচ্চাদের নিয়ে মানে স্মৃতি নিয়ে। ওদের হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ, মৃত বাচ্চাদের কোলে নিয়ে ছবি- বিদেশে ওরকম নাকি ব্যবস্থা আছে- হাসপাতাল থেকেই অ্যালবাম তৈরি করে দেয়। গোপার অসুখের সময় একদিন - গোপা তখন হাসপাতালে , কেমো চলছে- স্নেহ দেখিয়েছিল অ্যালবাম। ওদের শোয়ার ঘরে, খাটের পাশে টেবিলে থাকত। রাতে শোয়ার আগে রোজ গোপা ঐ অ্যালবাম খুলে দেখত। ইচ্ছে করেই আজ সকালে বলি নি-
- ঠিকই করেছিস। অশোক তো স্নেহময়ের অত ক্লোজ নয়-
- আসলে শোক করার জন্যও তো একটা জায়গা লাগে- নিজের জায়গা, একটু নির্জন। স্নেহ ছিল গোপার সেই আশ্রয়। গোপা শোক করার জন্য ফিরেছিল। স্নেহর কথা ভাবে নি। আমার তাই মনে হয়।
চুপ করে বসে রইলাম আমি আর পৃথ্বীশ। পর পর স্টেশন আসছিল, ট্রেনের গতি বাড়ে, কমে; অল্পই যাত্রী ক'জন-কানে মোবাইল, হাতে মোবাইল, আলো কমে আসছিল বাইরে । পৃথ্বীশ গলা খাঁকরায়, মুখ মোছে, স্বগতোক্তির মতো বলে , "শ্মশানে যাওয়ার আগে অবধি স্নেহময় গোপার পাশে বসেছিল। হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল কপালে, গালে, ঠোঁটেও। "
- দেখেছি-
- হেলেন কেলার আর রবীন্দ্রনাথের ছবিটার কথা মনে আছে তোর?
- আঙুল দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মুখ স্পর্শ করছেন?
- হ্যাঁ, পরে বলেছিলেন, ওঁর মনে হয়েছিল, কোনো এক পবিত্র নদীর তীরে বসে রয়েছেন। আজ সকালে তুই নদীর কথা বলছিলি না? স্নেহময় তো মহাপুরুষ কিছু ছিল না। কিন্তু এভাবে ভালোবেসে যেতে তো পারল। এক বছর দু বছর নয়, এতগুলো বছর শালা। পারল কী করে ?
জানলার বাইরে চোখ সরালাম। ট্রেন স্পীড নিয়েছে, গ্যালপিং লোকাল- পরের স্টেশনে থামবে না। ঘর বাড়ি পুকুর রাস্তা নারকেল গাছ পিছনে চলে যাচ্ছিল মুহূর্তে। পৃথ্বীশও তাকিয়েছিল বাইরে। আমার দিকে ঘুরল , তারপর আচমকা বলল, "অশোককে আজ খুব কেয়ারিং মনে হল। ভালো আছে সুপ্রিয়া। না রে?" চুপ করে গেল আবার। কালো চশমা পরে জানলার দিকে মুখ ফেরালো।
শেষ বিকেলের চলন্ত ট্রেনে আমরা দুই বন্ধু পাশাপাশি- বয়ে চলা কোনো নদীর কথা ভাবছি।
[প্রথম প্রকাশ ঃ শারদীয় লেখাজোকা, ১৪৩২]
ষাটের কোঠায় পৌঁছে নিজেদের ই দেখতে পাওয়া গল্প যেন!
ReplyDeleteসম্পর্কের কথকতা। তবে, সম্পর্কগুলো ঠিক......
ReplyDelete...... গোপা - স্নেহময়ের চরিত্র চিত্রণে কিছুটা মেরুকরণ যেন। অনেকটা ফর্মুলা মাফিক কালো - সাদা। হতেই পারে, লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্জাত।
তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় উল্টোটাই চোখে পড়েছে। উজ্জ্বল কেরিয়ারের স্বপ্নিল হাতছানি, উড়ান উপেক্ষা করে পরিবার, সন্তান, সন্তানসম ছাত্রছাত্রী। মানুষ গড়ার কারিগর। দিনের শেষে, ব্যক্তিগত জীবনেও পরিপূর্ণ, সুখী। ওপরওয়ালার পোয়েটিক জাস্টিস.....
অনামা দুজনকেই ধন্যবাদ। টেখক কয়েকটি চরিত্র ফেটিয়ে এ্যানাগ্রাম তৈরি করতে চেয়েছেন। পাঠক তাঁর মতো করে সল্ভ করবেন - সেটিই প্রার্থিত।
ReplyDelete