আবহমান

দখলদার

ভবানী ঘটক

পরম্পরা প্রকাশন

দাম ৩৫০ টাকা

 

কুন্দেরার দ্য আর্ট অফ নভেলে  প্রাগের এক এঞ্জিনিয়ারের গল্প ছিল- প্রাগ থেকে তিনি লন্ডনে এক কনফারেন্সে গিয়ে আবার ফিরে এসেছেন দেশে। পরদিন নিজের অফিসে বসে কম্যুনিস্ট পার্টি অফ চেকোস্লোভাকিয়ার দৈনিক মুখপত্রটিতে চোখ বোলাতে গিয়ে দেখছেন, যে এক চেক এঞ্জিনিয়ার লন্ডনে কনফারেন্সে গিয়ে তাঁর সোশালিস্ট জন্মভূমি নিয়ে  প্রেসের কাছে নিন্দাসূচক কথাবার্তা বলে তারপর ওখানেই রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন; এই রকম অবৈধ উপায়ে দেশত্যাগ তদুপরি প্রেসের কাছে উল্টোপাল্টা কথা -এতে কমসে কম কুড়ি বছরের জেল হওয়া উচিত ইত্যাদি। এঞ্জিনিয়ার যখন খবরটি পড়ছেন, তাঁর সেক্রেটারি ঘরে ঢুকে প্রায় মূর্ছা যান -আপনি  এখানে! ওদিকে খবরের কাগজে দেখেছেন তো! এ কী কাণ্ড!!!

এঞ্জিনিয়ার গেলেন কাগজের অফিসে। সম্পাদক ক্ষমা চেয়ে বললেন, মিনিস্ট্রি অফ ইন্টিরিয়র থেকে সরাসরি খবর এসেছে, আমার কিছু করার নেই এক্ষেত্রে। এঞ্জিনিয়ার দৌড়োলেন মিনিস্ট্রিতে। তাঁরা বললেন, মিসটেক, মিসটেক। আমরা লন্ডন এম্ব্যাসি থেকে খবর পেয়েছিলাম; খবর প্রত্যাহার করা যাবে না কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার কোনো ভয় নেই। কিন্তু এঞ্জিনিয়ারের রাতের ঘুম গেল ঘুচে, তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাঁকে ফলো করা হচ্ছে, ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে, এক কথায় রাষ্ট্রের কড়া নজরদারিতে তাঁর দিন কাটছে। এই চাপ ক্রমে অসহনীয় হল। তিনি প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ উপায়ে দেশত্যাগী হলেন।

কুন্দেরা বলেছিলেন, এই ধরণের গল্প এক কথায় কাফকান (যেহেতু আর্ট অফ নভেলে কাফকান শব্দটিই ব্যবহৃত আগাগোড়া, কাফকায়েস্ক নয়, এই লেখাটিতে কাফকান শব্দটিই ব্যবহার করছি); এই কাফকান আখ্যানের বৈশিষ্ট্যগুলি কী?

১] ক্ষমতার অনন্ত গোলকধাঁধাঁ - যার মূলে যাওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। এই হতভাগ্য এঞ্জিনিয়ারটির সম্পর্কেই কেন এমন লেখা হল,  এ কি কোনো চক্রান্ত না নিছক ভুল ছিল, কেনই বা তাঁকে রাষ্ট্রের নজরদারির আওতায় আনা হল না কিছুই তিনি জানতে পারলেন না, জানা সম্ভবই নয়;

২] ব্যক্তিগত জীবনের অসারতা- জীবন যেন এক ছায়ার মতো- উচ্চ কর্তৃপক্ষের যে ফাইলটির গন্ডগোলে (যদি তাই ধরে নেওয়া হয়), এঞ্জিনিয়ারটির জীবন যেন সে ফাইলের ভুলত্রুটিগুলির ছায়ামাত্র, নিজস্ব কোনো মূল্যই তার নেই যেন ; এবং 

৩] ডস্টয়েভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্টের দর্শনের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ অবস্থান; ডস্টয়েভস্কিতে যেমন অপরাধ খুঁজে নিচ্ছে শাস্তিকে, কাফকান পরিস্থিতিতে যে শাস্তি পাচ্ছে, সে জানেই না তার অপরাধ, শাস্তির অবাস্তবতা এক্ষেত্রে এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠছে যে সাজাপ্রাপ্ত মানুষটি সেই অন্যায়টিই করছে- এ যেন তার শাস্তিকে প্রতিপন্ন করা। অর্থাৎ শাস্তি ই যেন অপরাধকে যাচ্ঞা করছে। 

তবে কি এ কথা বলা যায় যে কাফকান চিহ্নগুলি বস্তুত  সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রকেই ইঙ্গিত করে যেখানে রাষ্ট্রশক্তি নিজে এক নিকষ ছায়াপিণ্ড হয়েও তার নাগরিকের কাছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা দাবি করে যেখানে ব্যক্তিগত বলে কিছুই থাকতে পারে না? 'আর্ট অফ নভেলে ' এই জিজ্ঞাসার উত্তর রয়েছে; সে কথায় পরে আসছি।

 আসলে, এই সবই মনে হয়েছে শ্রী ভবানী ঘটকের ' দখলদার' উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে।  আখ্যানটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল 'কথাসাহিত্য' পত্রিকায় - বছর পাঁচেক আগে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত সম্প্রতিই।

উত্তমপুরুষে বর্ণিত কাহিনীর সূত্রপাত এক দোলপূর্ণিমার রাতে; উপন্যাসের কথক নীলুর স্ত্রী নীপা ঘনিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তে জানাচ্ছে " সৌমেনদা আমাকে  রং মাখিয়েছে -বিশ্রীভাবে, জানো!" উপন্যাসটি ঠিক এই ভাবে শুরু হচ্ছে। নীলুর স্ত্রী নীপার উক্তির চলনটি এমনই- প্রথম অংশ যেন স্টেটমেন্ট "সৌমেনদা রং মাখিয়েছে" - যা শ্রোতা নীলু এবং পাঠক স্বাভাবিক মনে করে; বাক্যের দ্বিতীয় অংশ ধাক্কা দেয় এই পারসেপশানে- এবার বলা হয় “বিশ্রীভাবে, এবং শেষ শব্দটি -"জানো!" যা একই সঙ্গে বিস্ময়ের, বেদনার এবং নীলুর প্রতি নির্ভরতার সূচক।

উপন্যাসের প্রথম লাইনের এই আপাত সরল অথচ মারাত্মক চলন পাঠকের ঘাড় ধরে নীলুর শোয়ার ঘরে ঢুকিয়ে নেয়; তন্মুহূর্তেই আখ্যানের গতিপথ মোড় নেয় অতীতের দিকে;  পাঠককে নীলুর ঘর থেকে বের করে এনে চিনিয়ে দেয় নীলুর বন্ধুবান্ধবদের, এবং উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সৌমেনকে। সৌমেনের অতীতের বিশদ জানা যায়- তার বাবা, ঠাকুর্দা, বসিরহাট রিফিউজি ক্যাম্প, মৈনুদ্দিন মণ্ডলের জমিতে টালির চালের কুঁড়ে- সৌমেনের শৈশব; যৌবনে  ইটিণ্ডা ঘাটের পিকনিক এবংবর্তমান কাজকারবার- তথাকথিত নাগরিক উন্নয়নের ডামাডোলে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ খুঁজে নিচ্ছে সৌমেন। উপন্যাসের শুরু যেখানে আবেগ ও সংশয়ের এক তুঙ্গমুহূর্তে, প্রায় তৎক্ষণাৎ ঐ মুহূর্ত থেকে সরে এসে অতীতের কথা বলায় পাঠকের মনোযোগ হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি থাকেই। এখানেই শ্রী ভবানী ঘটকের কলমের মুন্সীয়ানা।  সময়ের আগুপিছু বেণীবন্ধনের মতো আখ্যানটিকে ধরে রাখে। একদম টানটান। পাঠক যেন ভিলেনকে চিহ্নিত করে কাহিনীর চরিত্রদের সাদা কালো দুইভাগে ভাগ করে ফেলে এবং লেখকের সঙ্গে খেলায় অপেক্ষাকৃত সুবিধেজনক অবস্থানে আছে বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে থাকে।

কিন্তু খেলা ঘুরে যায়।  ঘটমান বর্তমানে দুর্বলচিত্ত নীলু, নীপার সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্রমাবনতি- হতচকিত পাঠকের কাছে ভিলেনের সংজ্ঞা বৃহত্তর ও জটিল রূপ ধারণ করতে থাকে। উপন্যাসটি নীলুর শোয়ার ঘরের মশারির ঘেরাটোপ থেকে এ সমাজের অন্তঃস্থলে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয়।

 উপন্যাসের আগাগোড়াই চাপা উদ্বেগ ও সংশয়, অথচ প্রকাশভঙ্গী আপাত নির্লিপ্ত, নীলুর বয়ানে আখ্যান গড়ে উঠতে থাকে সংলাপে, মূলত অনাটকীয় অবশ্যম্ভাবী ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনে। মাঝে মাঝে বিদ্দ্যুচ্চমকের মতো ঝিলিক দিয়ে যায় তীব্র কিছু মুহূর্ত। কথন শান্ত, নির্লিপ্ত সেখানেও। যেমন, নীলুর বিবাহবার্ষিকীতে সৌমেন আমন্ত্রিত। ট্রেতে চায়ের কাপ সাজিয়ে নীপা ঢুকছে ঘরে, নীলুর সব বন্ধুদের চা দিচ্ছে একে একে, নীলুকেও। এরপর শেষ কাপটি  নিয়ে সৌমেনের দিকে এগিয়ে গেল নীপা; চোখের পলকে গরম চা সৌমেনের গায়ে ছুঁড়ে দিল , দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। শান্ত কথনে এই মুহূর্তের অভিঘাত মারাত্মক।

 কাহিনীতে ক্রমে আসে মহানগর নির্মাণের বিতত বিতংস যা সম্পর্কগুলিকে তথা আখ্যানকে জটিলতর করে।  আসে নীলকমল চরিত্রটি যাঁকে  কখনও নীলুর অল্টারইগো হিসেবে ভাবতে পারেন পাঠক; নীলুর কাছে যা প্রত্যাশা ছিল পাঠকের, নীলকমল সেই বিপদসঙ্কুল পথে হাঁটে। এসবই আখ্যানসূত্রে অনায়াস, বিন্দুমাত্র কষ্ট কল্পনা এখানে নেই অথবা থিয়োরির মারপ্যাঁচ।  উন্নতির মইতে চড়ে ক্রমশ উঁচুতে উঠতে থাকে সৌমেন , স্প্রিং চাকু নীলুর পকেটে পড়েই থাকে। নীলকমল হারিয়ে যান। সৌমেনের অন্যায়ের কাছে নতজানু হয় নীলু। অ্যান্টাগোনিস্ট ও প্রটাগনিস্ট যেন স্থান বদল করে। ট্র্যাজেডির  অপার বিষাদ ঘনিয়ে আসে। গল্পের প্রথম লাইনে মুগ্ধ হয়েছিল পাঠক, শেষ লাইনেও সে মুগ্ধতা অব্যাহত।  কাহিনীর সমাপ্তিতে ক্ষমতার আঁধার দখল করে নিল মানবিক সম্পর্ক সংসার, সমাজ। 'দখলদার' নামকরণের ব্যঞ্জনা উপলব্ধ হল। নিবিড় বিষণ্ণতায় যেন কলমটি জলে ছোঁয়ালেন লেখক। এক ফোঁটা কালি ছড়িয়ে পড়ল,  তারপর দুফোঁটা; ব্যাপন ঘটতে লাগল, সমস্ত কালো হয়ে গেল।

বাংলা সাহিত্যের পাঠক সাম্প্রতিক নগরায়ন ও নগরকেন্দ্রিক দুর্নীতিকে নানাভাবে পড়েছেন রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অপারেশন রাজারহাট' বা অমর মিত্রর 'নিস্তব্ধ নগর' উপন্যাসে।  এই সমস্ত উপাদানের উপস্থিতি 'দখলদার' এ থাকা সত্ত্বেও, এই উপন্যাসটিকে কোনো খোপে বন্দী করা যায় না, কোনো নির্দিষ্ট তকমা লাগানো যায় না। এখানেই উপন্যাসটির মহিমা ও সৌন্দর্য। লেখকের অনুভবে এ কাহিনীতে ধরা দিয়েছে দলীয় রাজনীতির চেয়ে অনেক জটিল অথচ চিরন্তন রাজনীতি - পাওয়ার পলিটিকস। পাওয়ার শব্দটাই রিলেটিভ- ক্ষমতার ঢাল অবশ্যম্ভাবী-ই। এ আখ্যান এই ক্ষমতার ঢাল বেয়ে নামা অথবা ওঠার গল্প।

এই আখ্যান নিঃসন্দেহে কাফকান।  এবং কাফকার লেখাগুলির মতোই এ আখ্যান কেবলমাত্র রাষ্ট্রের দিকেই আঙুল তোলে না। বরং আরো গভীরে গিয়ে মানুষের আবহমান নিয়তির কথাই বলে যেখানে ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করাটাই ভবিতব্য। ব্যক্তিগত যা কিছু তাকেও দখল করেছে ক্ষমতা, অথচ এ আখ্যান শুধুই ব্যক্তিগত অথবা সর্বগ্রাসী ক্ষমতার কাহিনী নয়- এ উপন্যাসে দুইই বিদ্যমান- কুন্দেরা যেমন কাফকান চিহ্নগুলি নিয়ে বলেন, ‘The public is the mirror of the private , the private reflects the public.'

[প্রথম প্রকাশ : শারদীয় শিস, ১৪৩২]

Comments

Popular posts from this blog

সিম্পল প্যাশন

বিরাশি ডিগ্রি পূর্ব

তিমি দেখার দিন