দালির বিষয় আশয়

 

এই দেশে ঘরবাড়ির ছাদ হয় না। চার দেওয়ালের ওপর যে ঢাকনা  বসানো-  তাকে ছাদই বলে সবাই। বিভাস বলে না। যে ছাদে ওঠা যায় না, তাকে বড়জোর চাল বলা যায়- বিভাসের মনে হয়। এখানে কোনোদিন ওর নিজের বাড়ি হলে ঢালা ছাদ থাকবে- ছোটো টবে ফুলগাছ, জলের ট্যাঙ্ক, কল থেকে জল নিয়ে গাছে দেওয়া যাবে;  দুপুরে তেতে পুড়েও ছাদটা আবার একটা প্ল্যানেটারিয়াম হয়ে যাবে রাতের দিকে।

বিভাস থাকে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের দোতলায়- তিনটে ঘর, বাথরুম, রান্নাঘর আর ব্যালকনি।  দরজার উল্টোদিকে অন্য ফ্ল্যাট, মাথার ওপর আরও দুটো, তার ওপরে তিনকোণা ঢালু চাল -সেরামিকের টালি বসানো,  আর একটা চিমনি। সেইখানে  উঠবার কোনো পথ নেই- তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে সিঁড়িটা শেষ হয়ে গেছে দুম করে। টালি রং করতে, চিমনি পরিষ্কার করতে মই লাগাতে হয়। হারনেস লাগিয়ে রং মিস্ত্রি  তরতরিয়ে ওঠে নামে। দেশে আসার পরে প্রথম প্রথম বিভাস একবার  মই তে চড়ে ঢালু চালের রকম সকম দেখে আসবে ভেবেছিল- কতটা ঢালু, সমতল কতখানি, আর কী আছে এই সব জানতে ইচ্ছে করেছিল ওর। তারপর অফিসের দেরি হয়ে যাবে ভেবে পিছিয়ে গেল।

সময়নিষ্ঠার ব্যাপারে বিভাস ওর বাবার ধারা পেয়েছে। প্রভাসের  ভয় ছিল ট্রেন, বাস মিস করার, অফিসের হাজিরার সময় পেরিয়ে যাওয়ার - সারাজীবন এক ঘন্টা হাতে নিয়ে বেরোতো প্রভাস। ' তর বাপে অফিস ঝাঁট দিতে যায় - " ঠাকুমার এই কথা শুনে শুনে বড় হল বিভাস , তারপর বাপের স্বভাবেই ফিট করে গেল কখন।  ' দেশে  পৌঁছনোর পরে মনে হয়েছে , সঠিক সময়টা মিস করে গেছে সে,  বড় দেরি হয়ে গেল আসতে। আরও আগে এলে এতদিনে ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টের বদলে নিজের বাড়ি হয়ে যেত ওর, মাথার ওপর সত্যিকারের ছাদ। এই সব যত ভাবে, ততই স্পীড বাড়ে বিভাসের। ঘন ঘন মোবাইলে সময় দেখে, ঘর সাজানোর ছোটো বালিঘড়ি ক্রমাগত উল্টে পাল্টে ক্যালিব্রেট করতে থাকে বালি ঝরার সময় তারপর আরো ভোরে ওঠে,সাতটার বাস ধরে, সকাল হতে না হতেই অফিস পৌঁছে যায়।

আজকের দিনটা অন্যরকম। বিভাস দৌড়চ্ছে না। আজ পরী আসবে। এই মুহূর্তে  পিট স্ট্রীটের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে  জেব্রা ক্রসিংএর ওপর আলোর রং বদলে যেতে দেখছে বিভাস।  অফিস থেকে বেরোনোর পর এইখানে দাঁড়িয়ে কলকাতার কথা মনে পড়ে -  ওর চোখের সামনে ঠিক সাতটা পাঁচে  উঁচু উঁচু বাড়ির পিছনে সূর্য ডুবে যায়, রাশ আওয়ারে  অফিস ফেরতা মানুষের দীর্ঘ ছায়া ফুটপাথে পড়ে , আলো কমে যায় অথচ স্ট্রীট লাইট জ্বলতে দেরি  হওয়ায়, গোধূলিতে  সব মানুষের রং সবজেটে দেখায়;  তারপর সাড়ে সাতটা বাজতেই কিওস্ক থেকে ভাজা মাংসের বাস;  ক্রসিংএ  লাল, হলুদ, সবুজ আলোয় ট্যাক্সি, বাস, পথচারীর জট পাকায়, খুলে যায় আবার। বিভাস  মোবাইল খুলে সময় মিলিয়ে মিলিয়ে  দেখে।  আজ অবশ্য ভর দুপুর-  বিভাস  হাফ ডে নিয়ে বাড়ি ফিরছে। তিন্নির  পাঁচ 'ল। অ্যাপার্টমেন্টেই ছোটো পার্টি। পরী আসবে।

একটু আগেই ঘন কালো পিচরাস্তার ওপর দুপুরের রোদ ঠিকরে পড়ছিল অথচ এখন এই বেলা তিনটেয় রোদ মরে আসছে দ্রুত।  বিভাস দেখল,  আকাশের উত্তর দিক থেকে ঘন কালো মেঘ দৌড়ে আসছে। একই দিক থেকে ধেয়ে আসছিল ডাউনের বাস। বিভাসের ঢিলেঢালা মেজাজ এক নিমেষে  কেটে গেল;  চৌমাথার মোড়ে কে আগে দাঁড়াবে  মেঘ না বাস-    মনে মনে বাজি রাখল বিভাস তারপর সিগ্নাল লাল হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল- দশ নয় আট সাত ছয় পাঁচ চার তিন দুই এক.. সেই সময় উল্টো দিক থেকে জোর হাওয়া উঠল- ধুলো, ভাজা সসেজের গন্ধ, টিউব রেল স্টেশনের চত্ত্বরের চিনে বৃদ্ধর ছড় টানা যন্ত্রের সুর শংকুর মত পাক খেতে খেতে  বিভাসকে ঘিরে নিল; মেঘের পাল টার্ন নিল সম্পূর্ণ বিপরীতে। বাসগুলো আচমকা ওয়াক ওভার পেয়ে সিগন্যালে পা ছেতরে দাঁড়িয়ে পড়ল।  'জিত গিয়া' বলল বিভাস। পোস্ট অফিসের মাথার ওপর  টুং টাং টুং টাং করে ঘন্টা বাজল তিনটের। বিভাস ঘড়ি মিলিয়ে  বাস স্টপে দাঁড়াল। তিনটে পাঁচের বাস।পরী আসবে আজ - আবার ভাবল বিভাস।

কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে ফিরে তিন্নি বলেছিল, ওর এবারের জন্মদিনে ফেয়ারিদের আসতে হবে। গত মাসে জিনি, আর জ্যাকের জন্মদিনে টিংকার বেল এসেছিল-  এই অবধি শুনে, বিভাস অবাক হয়ে তাকাতেই, লিপি গুগল করেছিল মোবাইলে- তিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল-' হ্যাঁ, আসবে তো। কোন ফেয়ারি চাও তুমি? টিংকার বেল? ফেয়ারি গড মাদার?'  কলকল করতে করতে মা মেয়ে ভেতরের ঘরে চলে গিয়েছিল। বিভাস ফেয়ারি আর পরী শব্দ দুটো নিয়ে খেলা করেছিল অনেকক্ষণ নিজের মনে-  তারপর তিন্নির জন্য ফেয়ারি রেখে দিয়ে পরী শব্দটা নিজের মাথায় গেঁথে নিয়েছিল।

গুগল করেই পরীস্থানের খোঁজ পেয়েছিল  বিভাস আর লিপি। শহরের কাছেপিঠেই  আছে পরীরা -চাইলেই হাজির হবে।জন্মদিনের আসরে। সকালে, দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায়।  টিংকার বেল, ব্লু ফেয়ারি,  ফেয়ারি গডমাদার, অথবা রেনবো, বাটারফ্লাই ফেয়ারি,  টুথ ফেয়ারি- যে যেমন চায়। বিভাস  পছন্দের প্যাকেজ অনুযায়ী অ্যাডভান্স টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল অনলাইনে। তিন্নি জানে না প্যাকেজের কথা। জানে আজ টিংকার বেল আসবে।

বিভাসের অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তার দুধারে জ্যাকারাণ্ডা  গাছ- সন্ধ্যের আকাশ ঘন নীল হয়েছে জ্যাকারান্ডার বেগুণী ফুলে- দুপুরের মেঘ কেটে গিয়ে মিটমিটে তারা ফুটছিল। এদিক ওদিক অ্যাপার্টমেন্টের জানলায় আলো - একটা লম্বা ক্রেন উত্তর দিকের আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে;  বিভাসের মনে হল হুবহু এই রকম আকাশ, এই রকম একটা ক্রেন আগে কোথাও দেখেছে। মাথা চুলকালো তারপর পকেটে হাত ঢুকালো যেন স্মৃতিরা সব ছোটোবেলার মার্বেলের মত ওর পকেটেই আছে- পকেট হাতড়ালেই মার্বেলে মার্বেলে ঠোকাঠুকির আওয়াজ হবে আর হাতের তেলোয় তুলে আনবে সেই মার্বেল যার ভেতরে হাওয়ার বুদ্বুদের মধ্যে বেগুনী আকাশে হেলানো ক্রেন দাঁড়িয়ে আছে। একটা হাত পকেটে রেখেই দরজার ঘন্টা বাজালো বিভাস। ফ্ল্যাটের দরজার তলা দিয়ে দুধ উথলানোর গন্ধ আসছিল- সম্ভবত পায়েস রেঁধেছে লিপি।

বসবার ঘরের  সিলিং, দেওয়াল বেলুনে স্ট্রীমারে  ঢাকা।  জনা পনেরো বাচ্চা পরীকে ঘিরে  বসে। কার্পেটেও প্রচুর বেলুন, রঙীন  কাগজের টুকরো।  পরীর হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, হাতে গলায় ফুলের গয়না। তিন্নি হাঁ করে পরীর  রঙীন ডানা, বাহারি গোলাপী জামা দেখছে। গল্প বলছিল পরী। বিভাসের মনে হল ছোটোবেলায় রাশিয়ান সার্কাসের টিকেটে মাথায় ব্যান্ড বাঁধা এরকম মুখ সে দেখেছে - মুখ বলতে পিক্সেল- আবছা চোখ, আবছা নাক, ঠোঁট- মনে মনে একটা মুখ ভেবে নিত বিভাস সেই সময়।

রান্নাঘর থেকে লিপি ইশারা করতেই পরীকে পাশ কাটিয়ে সে বসবার ঘরে ঢুকল  যখন, রাঘব, পরাশর, তপন, শান্তা, সুপ্রিয়া আর দোলন গল্প শুরু করেছে;  বিভাস  রান্নাঘরে ঢুকে গেল- বিরিয়ানিতে ফাইনাল টাচ দিতে হবে। লিপি ' ঘর ' ঘর করছিল- বাচ্চাদের সামনে মাফিনের ট্রে ধরছিল, পরক্ষণেই রান্নাঘরে, তারপরেই বন্ধুদের কাছে হাসিমুখে পকৌড়া নিয়ে।

 

পরীকে ঘিরে বাচ্চাদের নাচ শুরু হয়ে গিয়েছিল।  মুঠো মুঠো ফেয়ারি ডাস্ট ওড়াচ্ছিল পরী। হাততালি দিয়ে গাইছিল-"ইফ ইউ হ্যাপি অ্যান্ড ইউ নো-" লিপি ভিডিও করছিল; শান্তা, রাঘব মোবাইলে ছবি নিল।হাততালি দিল তালে তালে। টিংকার বেল জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল। 

তিন্নি বলল- "উইল ইউ ফ্লাই ফ্রম দিস ব্যালকনি?"

টিংকার বেল হেসে হেসে ললিপপ দিল-" উইল ফ্লাই ফ্রম দ্য পার্ক। ইউ নো হোয়াই?"

-কেন?

-তোমার ব্যালকনি থেকে উড়তে গেলে যে দেওয়ালে ধাক্কা খাব। পার্কের দিকটা ফাঁকা।

বিভাস বলল, "আমি আপনাকে পার্ক অবধি পৌঁছে দিচ্ছি। "

- না না একলাই চলে যাব।

পরীর মুখ থেকে খিদের গন্ধ পেল বিভাস

-খেয়ে যান কিছু পরীরা কী খায়? এই লিপি,  একটা প্লেট এদিকে-

- এখানে কিছু খাব না।  পার্ক থেকে ফুলের মধু খেয়ে নেব। এই যাঃ ভুলে গেছিলাম-

-কী?

ঝোলার ভেতর থেকে ছোটো একটা কাগজের বাক্স বের করে এনেছিল পরী। বিভাসের হাতে দিয়েছিল।

-তোমাদের গিফ্ট। জল দিও রোজ।

- তোমার বাড়ি কোথায় টিংকার বেল? কত দূরে?

-ক্যা-টা-লো-নি-য়া বলেছিল পরী- যেন পিয়ানোর চাবি টিপে টিপে টিউন করে নিচ্ছে কনসার্টের আগে।  চেনা লাগছিল শব্দটা। পকেট হাতড়ে মার্বল খুঁজল বিভাস।

হাসতে হাসতে রাস্তায় নেমেছিল পরী।  জ্যাকারান্ডার তলা দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল তারপর - এক হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, অন্য হাতে ব্যাগ। ব্যালকনিতে ভীড় করে দাঁড়িয়ে তিন্নি আর ওর বন্ধুরা-পরী একবার হাত  নেড়েছিল তারপর রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে গিয়েছিল।

রাতের দিকে পরীর দেওয়া বাক্স খুলল বিভাস-  লালচে টেরাকোটা টব তাতে মাটি আর  পাতলা কাগজে মোড়া ঘন কালো বীজ- জল দিয়ে রাতভোর ভিজিয়ে রাখার নির্দেশ দুটি তিনটি ভাষায় লেখা- ব্রোশিওরে যেমন থাকে। ওদের ব্যালকনির ঠিক নিচে ঘাসজমিতে ছোটো টব নামিয়ে রাখল বিভাস। জল দিল।

-কী গাছ হবে বাবা? ফুল না ফল?

- কী জানি! পরীর দেশের গাছ তো!

- বীন স্টক হবে বাবা- এই লম্বা

-তাহলে তো ভারি মুশকিল, মাথার ওপর দৈত্যের বাড়ি হবে। তারপর সে যদি বলে, ফী ফী ফো ফ্যাম-

- আমরা তো ইংলিশম্যান নই

-নোস?

- নই তো

-শুতে যা মা, কত রাত হল বলতো-

- আজকের মত কালও তিনটের সময় বাড়ি আসবে তো বাবা?

- রোজ হয় না কি? কত কাজ আছে না?

অস্থিরতা ফিরে আসছিল বিভাসের।  মনে হচ্ছিল, কতটা সময় নষ্ট হল আজ, কী অপচয়!  কাল আরো ভোরে উঠে অফিস যাবে। মোবাইলে অ্যালার্ম দিল শেষ রাত নাগাদ। তারপর মনে ', যদি শুনতে না পায়, যদি ঘুম না ভাঙে। ভলিউম বাড়ালো মোবাইলে। তারপর আবার অ্যালার্ম ক্লক নিয়ে খুটখাট করতে শুরু করল এই সময় লিপি ঘরে ঢুকেছিল।

- তিন্নি আজ তাড়াতাড়ি ঘুমোলো?

- যা নাচানাচি  করেছে সমস্তদিন-

-তিন্নি খুশি?

- বন্ধুদের সঙ্গে এতক্ষণ, খুশি তো হবেই। শোনো, বলছি, ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলে কিছু?

-ফিরে মানে? কোথায়?

-দেশে।  এখানে এত একা তিন্নি-

-একা কোথায় ? কত বন্ধু - আজ তো প্রায় পনেরোজন এল-

-বাড়িতে যখন থাকে, একদম তো একা। তোমাকে তো পায়ই না। বেচারির ঘুম থেকে ওঠার আগেই বেরিয়ে যাও। সেদিন ঝড় বৃষ্টি হল না ভোরের দিকে? গত বুধবার? বাজ পড়ছিল?  সকালে উঠে কী কান্না মেয়েরঃ  এই থান্ডারস্টর্মে আমার বাবা কোথায় গেল- কী করে অফিস যাবে, কী করে ফিরবে-

- পাগল হলে? এর সঙ্গে দেশে ফেরার কী? তিন্নির জন্য অন্য কিছু কর।

-কী?

- বন্ধু জোগাড় কর। ওর বয়সী। ওর সঙ্গে  খেলবে। বাংলায় কথা বলবে।

- সে তো আছে। শান্তার মেয়ে, সুপ্রিয়াদির ছেলে। পিকু অবশ্য বাংলা বলতে পারে না। বোঝেও না-

- আমি বলছি, রোজ কথা বলবে, রোজ খেলবে, এই রকম বন্ধু-

-সে আমি কোথায় পাব?

-নিয়ে আসবে

-মানে?

-মানে? একসঙ্গে নিয়ে আসব। এসো।

-দ্যুৎ। তিন্নির ঘরের দরজা খোলা-

- সে ঘুমিয়ে কাদা- এসো না

অস্থির হচ্ছিল বিভাস। লিপি দেরি করছে, বড্ড দেরি করছে। মাথার মধ্যে  অ্যালার্ম বাজছিল ওর। লিপির হাত ধরে টানল বিভাস।

-কী হল?

-ভোরে উঠতে হবে লিপি। এসো।

- এই তিন্নি উঠে পড়েছে

-ভ্যাট

- একটু বড় জায়গা লাগবে এবারে, মেয়ে বড় হচ্ছে।

-হবে। একটা বাড়ি,  তিন্নির ঘর হবে লম্বা বারান্দা পেরিয়ে-

-কোথায় বাড়ি?

-এইখানে। পাহাড়ের মাঝে। এইখানে। নদীর ধারে।এইখানে। ভালো না?

-আকাশটা লাল হয়ে আছে দেখো, আগুন লাগল নাকি!

-আবার আকাশে তাকায়!  এইবার সত্যি তিন্নি উঠে পড়বে-

- বাড়ি কেনার টাকা তো আমাদের নেই গো

-হয়ে যাবে। স্পীড বাড়াতে হবে শুধু।  অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আর নয়।  টাইম ইজ মানি লিপি। টাইম ইজ মানি।

-উফ এত তাড়াহুড়ো! আস্তে..

শেষ রাতে জানলার বাইরে তাকালো বিভাস। আকাশের গায়ে কমলা আলো তখনও। প্রথমে  কমলা,  তারপর হলদেটে তারপর আশ্চর্য একটা নীল - আকাশের পূব কোণে  রিফ্লেক্ট করছিল একের পর এক তারপর মিশে যাচ্ছিল। বিভাস ভাবল, অরোরা বোরিয়ালিস। ভাবল, লিপিকে ডেকে দেখায়। তারপর একলাই ব্যালকনিতে দাঁড়াল।  নিচে তাকিয়ে দেখল, পরীর দেওয়া  টব থেকে ঘন সবুজ লতা দেওয়াল বেয়ে বারান্দায় উঠেছে তারপর কার্নিশ পেরিয়ে  আকাশের দিকে। ব্যালকনি থেকে মাথা ঝুঁকিয়ে ওপরে তাকালো বিভাস - মাথার ঠিক ওপরে কমলা আলো-  অ্যাপোক্যালিপটিক সিনেমায় আকাশের রঙ যেমন হয়। বিভাস ব্যালকনির রেলিং টপকে কার্নিশে নামল। পরীর লতা কার্নিশের পাশের পাইপ জড়িয়ে ছাদের দিকে গেছে। বিভাসও আঁকড়ে ধরল পাইপ ; একহাত পাইপে জড়িয়ে রেখে অন্য হাত তুলে দিল ঢালু টালিতে - চাপ দিয়ে পরখ করল পোক্ত কতখানি; সমস্ত শরীরের ভার দিয়ে ঝুলে পড়ল টালি  ধরে, তারপর সামান্য দোল খেয়ে  'বাড়ির চালে উঠে এল

বিভাসের খালি পায়ের পাতার তলায় ঠান্ডা টালি;  সামনে অসমতল এবড়োখেবড়ো অন্ধকার সামান্য ঢালু হয়ে উঠে গেছে রাতের আকাশের দিকে।  চোখ সয়ে গেলে এবারে রঙ দেখতে পাচ্ছিল সে- নিকষ কালো প্রথমে তারপর গাঢ়ত্ব কমে গিয়ে হাল্কা খয়েরী হয়ে ধূসর হতে শুরু করেছে, সেখান থেকে হাল্কা হলুদ- বালুচরের মত দেখাচ্ছিল। সেই সব রং রিফ্লেক্ট করছিল আকাশে। বাঁ দিকে খানিকটা উঁচু জায়গা-  জলের ট্যাঙ্কের মত মনে হল ওর , সেখানে কমলা রঙের এক  জমাট  পিন্ডে পিঁপড়ে ধরেছে- পচে যাওয়া ঘড়ি, মনে ' বিভাসের।  তার ঠিক পাশে যেখানে পরীর লতার উপরিভাগে  লম্বা আকর্ষ সমান্তরাল এগিয়েছে , সেখান থেকে দুপাট করে কাপড় মেলার মত নীল ডায়ালের ওভাল শেপের ঘড়ি নেতিয়ে ঝুলে আছে; বিভাসের মনে হল ঘড়ি তুলে নিয়ে সোজা করে মেলে দেয়, নইলে পচে গিয়ে পিঁপড়ে ধরবে। ওর মনে হল, এই থেমে থাকা জীবন, অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাড়িতে  না যেতে পারা - স্রেফ যেন ঘড়িটার জন্য;  আর দেরি না করে এক্ষুণি দম দিয়ে চালু করে দিতে হবে।

বিভাস যেখানে দাঁড়িয়ে, তার অনেকটাই দূরে , পরীলতার আকর্ষ থেকে ঝুলে ছিল ঘড়ি। একবার মনে হ’ল নাগাল পাবে না , পরক্ষণেই মনে হল,  একটু ঝুঁকলেই হবে।‘ পেয়ে যাবো ‘-বাজি ধরল সে, তারপর  হাত বাড়ালো ঘড়ির দিকে। ওর হাত লেগে ঘড়ি সামান্য সরে গেল - বিভাস মরিয়া হয়ে পরীর লতায় টান দিল। একটা স্প্রিংএর মত লাফিয়ে উঠল লতা- ঘড়ি আকাশের দিকে উঠে গেল সটান তারপর নিচের দিকে নামল। বিভাস ডাইভ দিল সামনের দিকে।

একবারজিত গিয়া’ -বলেছিল মনে মনে তারপর পেনাল্টি শট আটকে যেমন আনন্দ আর গর্বে মাখামাখি হয়ে ঘাসে মুখ ডোবায় গোলকীপার , দু হাতের মধ্যে ঘড়ি নিয়ে সেইভাবে ঘাসের দিকে পড়তে লাগল সে।  স্লো মোশনে। এই প্রথম স্পীড বাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হল না বিভাস। বরং মনে হল, বাস মিস করে গেলে ছুটি হয়ে যায় সেদিনের মত, তখন বাড়ি ফিরতে হয়।  বাড়ি। মাথার ওপর ছাদ।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে  তিন্নি দেখল,  অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ভীড়, পুলিশের গাড়ি-  ছেঁড়া পাতা, ঘাস , লতা, ফুল, গাছের ডাল  ছড়িয়ে  ছিটিয়ে- যেন ঝড় বয়ে গেছে রাতে; সেই সবুজ ধ্বংসস্তূপে তার বাবা উপুড় হয়ে শুয়ে; দু হাতের মাঝে পুরোনো অ্যালার্ম ঘড়ির টুইন বেল দৈত্যের শিংএর মতো দেখাচ্ছিল।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

পদ্মসম্ভব

কোলক্লিফ, ২০২৩