ভারতীয় বিজ্ঞান - নির্মাণ ও বিনির্মাণ

 ভারতীয় বিজ্ঞান - নির্মাণ ও বিনির্মাণ

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
গুরুচন্ডা৯
দাম ১৫০ টাকা

অর্থনীতিবিদ ডঃ কৌশিক বসুর একটি লেখা পড়ছিলাম কিছুক্ষণ আগে। গত পঁচাত্তর বছরে আমাদের দেশের যাত্রাপথ নিয়ে কথা শুরু করেছেন, বলছেন, " ভারত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বেছে নিয়েছিল, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেছিল, তৈরি করেছিল  উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার একাধিক প্রতিষ্ঠান। ভুলত্রুটি বিলক্ষণ ছিল কিন্তু সব মিলিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে ভারত যা অর্জন করতে পেরেছিল, তা বিশ্বের উন্নততম দেশগুলির সঙ্গে তুলনীয় ছিল।"  জরুরী অবস্থার কলঙ্কের কথা বলেছেন, ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিপক্কতার পক্ষে কিছু গল্প বলেছেন।  উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে লিখছেন, " দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই একাধিক আইআইটি  এবং বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পিছনে যে বিনিয়োগ করেছিল ভারত, উচ্চ শিক্ষার পরিসরে মুক্ত চিন্তা, আলোচনা, তর্কের, এবং নতুন কথা বলার যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, তার জোরেই আমরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বচ্ছন্দ  হতে পেরেছিলাম। " তারপর বর্তমানের ভয়াবহ অর্থনৈতিক অসাম্যের কথা বলে স্বল্প পরিসরে কারণ অনুসন্ধানে  গিয়েছেন। বলছেন, কারণ মূলত দুটিঃ ঘৃণা ও মেরুকরণের রাজনীতি ভারতের অর্থনৈতিউক ভিত্তির ক্ষতি করছে। আর দ্বিতীয় কারণটি " এখন ভারতে রাজনীতি করতে আর স্লোগান দিতে যত সময় ব্যয় করা হয়, বিশ্লেষণ, পরিসংখ্যান আর বিজ্ঞানের পিছনে তার অংশমাত্রও দেওয়া হয় না। ... এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যত রাজনীতির কবলে পড়ছে, বাকস্বাধীনতা যত খর্বিত হচ্ছে, ততই বিজ্ঞানকে পিছনে  ঠেলে দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ তার জায়গা দখল করছে।" পরিস্থিতির ভয়ংকর পরিণাম বলতে গিয়ে একটি গল্প শোনাচ্চ্ছেন কৌশিক বসু। ঘটনা পঞ্চাশের দশকের আমেরিকা, সে দেশে তখন পৃথিবীর আকার নিয়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিবাদ চরমে; সেই প্রেক্ষাপটে এক শিক্ষকপদপ্রাথী যুবককে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে- পৃথিবী গোল না সমতল? এবং যুবক জবাব দিচ্ছেন, " আমি দু রকমই পড়াতে পারব।"

ঠিক এই জায়গাতেই রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের বইটি আমাদের হাতে এক আয়ুধ হয়ে এলো। বইটি শুরুই হচ্ছে প্রশ্ন করতে শেখা ও  শেখানোর গুরুত্ব নিয়ে। তারপর পাঁচটি পর্বে একে একে আসছে বিজ্ঞানদিবসের থিমের তালিকা যেখানে থিমে ২০১৫ পরবর্তী বদল লক্ষ্যণীয়, বিজ্ঞান শহীদদের কথা( ডঃ দাভলকরের কথা মনে করুন), গবেষণায় অনুদানের অসাম্য, বিজ্ঞানচেতনার অভাব, অপবিজ্ঞানের প্রচার, জাতীয় বিজ্ঞাননীতি, পরিবেশপাঠ, দূষণ, জলবায়ু  বিপর্যয়। 
তথ্য সমৃদ্ধ, বিশদ, যুক্তিবহুল বলিষ্ঠ লেখা প্রতিটি। রূপালী পরিসংখ্যান সহযোগে  দেখাচ্ছেন, একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের জন্য সরকারি বরাদ্দ কমে চলেছে, অন্যদিকে সরকারি তরফে বিজ্ঞানীদের কাছে বার্তা যাচ্ছে, যে দেশের উন্নতির জন্য 'দরকারি বিষয়ে গবেষণা করতে হবে। যুক্তি সহ লিখেছেন কী ভাবে জি এস টি ও জি ই এমের সাঁড়াশি আক্রমণে দেশের বিজ্ঞানচর্চা কীভাবে বেহাল হয়ে পড়ছে। চন্দ্রযানের সাফল্যে 'অভিভাবকদের' ভাগ বসানোর কথা বলে একই সঙ্গে সংশয় প্রকাশ করেছেন," ভয় হচ্ছে মহাকাশ গবেষণা যে ছবি বানানোর চেয়েও সস্তায় করা যায়-েই তত্ত্বটা না প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়!"। মনে করিয়ে দিয়েছে, যে সব প্রতিষ্ঠানে এই যন্ত্রাংশ তৈরি, তাদের পাওনা মেটানো হয় নি। বইয়ের চতুর্থ পর্বে বিশদে ধরা নীতির সেকাল ও একাল। বইটি শেষ হচ্ছে বিজ্ঞানীর নীতিবোধের কথা বলে, স্পষ্ট বলা হচ্ছে "বিজ্ঞানী তাঁর নীতিবোধ ও দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসছেন বলেই অপবিজ্ঞানের চর্চা এত রমরমিয়ে উঠবার সুযোগ পাচ্ছে।" 
 
কিছু প্রসঙ্গ, কিছু কথা হয়তো ঘুরে ঘুরে এসেছে, কিন্তু লেখকের মতো পাঠকও বিশ্বাস করে অনেক সত্যি কথাই বার বার বলতে হয়, বলে যেতেই হয়।

আমরা বলে চলব।  রূপালী আমাদের অস্ত্র দিয়েছেন - আসুন, হাতে হাতে তুলে নিই। শান দেওয়া চলুক।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস