উতঙ্কের নয়নবারি ও আর্তি
দিতি ও মহারানি
মৃণাল শতপথীগুরুচ্ন্ডা৯
দাম ৬৬ টাকা
সাতটি গল্প এই বইতে। ব্লার্বে যথার্থই বলা হয়েছে- এই গল্পগুলিতে পাঠকের পরিণতমন প্রাসঙ্গিক বিষয় খুঁজে নেবে। বস্তুত যে বয়সে 'বুদ্ধির এলাকায় বৈজ্ঞানিক সার্ভে ' আরম্ভ হয় না,'সম্ভব-সম্ভবের সীমাসরহদ্দের চিহ্ন থাকে পস্পর জড়ানো', মৃণালের বইটি সেই নবীন সংবেদনশীল মনটির অন্বেষণে বেরিয়েছে।
চিরঞ্জিত সামন্তের প্রচ্ছদ এবং রমিত চট্টোপাধ্যায়ের অলঙ্করণে বইটি রূপময়।
গল্পগুলির ভাষা, বিষয়, গোত্র বদলে বদলে গেছে - অথচ প্রতিটি গল্পেই প্রকৃতির, মানবসম্পর্কের বিপন্নতা, দুঃসময় ও পারস্পরিক সহযোগিতায় উত্তরণ। কখনো আখ্যান যেন রূপকথা, কখনও সায়েন্ন্স ফিকশন, অথবা ম্যাজিক রিয়ালিজম। গল্পের নামকরণও শৈশবের চৌকাঠ পার হয়ে কৈশোরে পা রাখছে ক্রমশ। রয়েছে জলের তলায় মাছেদের দুনিয়া, কোথাও ডিস্টোপিয়ান জগতে একটি শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ, কখনও সর্বার্থে কোণঠাসা বালিকার এক অলীক জগতে উড়ে বেড়ানো, আবার বনের মা আর গৃহের মা মুখোমুখি কোনো গল্পে-হৃদয়ে অভিন্ন অনুভূতি, আবার পরিণত বয়স্ক কখনও সময়কে পিছু হাঁটিয়ে নিয়ে যান তাঁর রঙীন শৈশবে, যেখানে উঁকি দিয়ে যায় বড়দের জগৎ- বিচ্ছেদময় এবং অবশ্যম্ভাবী মনোক্রোম, কোনো গল্পে এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার জন্য আত্মাহুতি ।
বইটি শেষ করে, একটি গল্প মনে পড়ে।
মহাভারতে আছে, মহর্ষি গৌতমের হাজার শিষ্যর মধ্যে প্রিয়তম শিষ্য ছিলেন উতঙ্ক। সব শিষ্যই শিক্ষান্তে গৃহে ফিরে গেলেন, উতঙ্ক রয়ে গেলেন। গৌতম স্নেহভরে তাঁকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেন না। উতঙ্ক এভাবে বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হলেন কিন্তু গৌতমের আশ্রমের কাজকর্ম , গুরুসেবায় এতই মগ্ন নিজে তা বুঝতেই পারলেন না। অবশেষে একদিন, মাথায় করে কাঠ আনছিলেন, আশ্রমে পৌঁছেই তাড়াতাড়ি কাঠের বোঝা মাথা থেকে মাটিতে ফেললেন ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত উতঙ্ক- অবিলম্বে স্নান খাওয়া আবশ্যক। ঐ সময় তাঁর জটা থেকে রূপালী কগাছা চুল ছিঁড়ে গিয়ে কাঠের সঙ্গে মাটিতে পড়ল। সেই জটার শুক্লতা তাঁর অবিশ্বাস্য বোধ হল প্রথমে তারপর নিজের অনবধানে এতকাল পার হয়ে বৃদ্ধাবস্থায় উপস্থিত হওয়ার বেদনায় আর্ত্তস্বরে রোদন করতে লাগলেন উতঙ্ক। গৌতম তাঁর কন্যাকে বললেন, অঞ্জলি পেতে উতঙ্কের নয়নজল ধারণ করতে। কিন্তু সেই অশ্রুতে বিষাদের এতই তীব্রতা ছিল, চোখের জলে কন্যার হাত পুড়ে গেল। তখন সর্বংসহা ধরণী অতিকষ্টে উতঙ্কের সেই নয়নবারি ধারণ করতে লাগলেন।
ঝড়ের রাতে প্রদীপশিখাটি বাঁচিয়ে রাখার যে আকিঞ্চনে প্রবীণ এসে হাত ধরে নবীনের, গোটা বইতে সেই যেন অন্তর্লীন সুর; সে এক জলস্রোতের মতো বহমান, সেই স্রোতে পাঠক উতঙ্কের নয়নবারি ও আর্তিকে প্রত্যক্ষ করে।
Comments
Post a Comment