দিবসারম্ভে
সন্দীপদের পুরোনো কোয়ার্টারে গল্প হচ্ছিল শেষ দুপুরে - মায়া, সন্দীপ, রেণু আর আমি। ব্রিটিশ আমলের বাড়ি, বার কয়েক মেরামতির পরেও বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ । সমুদ্র কাছে হওয়ায়, বাতাসের নুনে ঘরদোর অকালেই বুড়িয়ে গেছে- মায়া আর সন্দীপ তাই বলে। আর সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যে ওদের নতুন বাসায় চলে যাওয়ার কথা। এ' বাড়ির দেওয়ালের আস্তর খসেছে যত্র তত্র, সেখানেই ঠেসান দিয়ে ডাঁই করা কার্ডবোর্ডের বাক্স - বেশিরভাগই প্যাকিং টেপ দিয়ে আটকানো; কিছু এখনও হাঁ করে তাকিয়ে - গেরস্তালির আরো জিনিসপত্র ঢুকবে। বাক্সের ঘষায় ঘষায় দেওয়াল থেকে আরো চুন বালি ঝরছিল। এই সব দৃশ্য জীবনের অনিত্যতার কথা বলে। সে দিকে পিঠ ফিরিয়ে আমরা মোড়ায় বসেছিলাম। খাওয়া দাওয়ার পর যেমন হয়- হাতে হাতে জলের বোতল, ঈষৎ হলদে তেলোয় জোয়ান মৌরি দু এক কুচি সুপুরি, দুপুরের ঝিম, কথার পিঠে কথা- অগোছালো আর দিশাহীন, জানলার পর্দা ঠেলে বহিরাগত হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে যায়, কোথাও পৌঁছোনোর কথাই থাকে না যাদের । ব্যাকড্রপে দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা সরে সরে যেতে থাকে, পেঁপে গাছের ছায়া অতিরিক্ত লম্বা হয়ে ঘরে ঢুকে যায় ।
- চার্লি চ্যাপলিন নাকি একবার চ্যাপলিন লুক অ্যালাইক কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট করেছিলেন?
- দূর!
- সত্যি নয় ? পড়লাম যেন কোথায়। থার্ড হয়েছিলেন না কি...
- আরে এসবই গুলগল্প। আরবান মিথ আর কি।
- তাই বল। আমি ভাবছিলাম- সে কী করে হয়...
- হতে পারে, ধরো অভিনেতার কিছু সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো পর্দায় প্রকট নয়, একজন খুব ভালো দর্শক বা বলা ভালো, একজন ফ্যান সে সব মাইনিউটলি অবসার্ভ করল, তার নিজের অভিনয়ের সময় সেগুলো হাইলাইট করল-
- মানে বলতে চাইছ, নিজস্ব স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য -যেগুলো তিনি অভিনয় করছেন না , হয়তো সেভাবে কনশাসও নন, অথচ একজন ক্লোজ অবসারভারের কাছে ধরা পড়ছে? ইন্টারেস্টিং-
" ইন্টারেস্টিং ইন্টারেস্টিং ইন্টারেস্টিং" - আওয়াজ করে হেসে উঠল রেণু। ওর মুখে হাসি ছিল না, গলায় ছিল। হাসতেই লাগল , হাসতেই লাগল। জোরালো, কর্কশ হাসির দমকে রেণুর শরীর কাঁপছিল, হাতে ধরা জলের বোতল সমেত; আশ্চর্যজনকভাবে ওর হাসি উপচে উঠে ছড়িয়ে পড়ছিল না ঘরময়, বরং নিচের দিকে নামছিল, কোল বেয়ে হাঁটু বেয়ে পায়ের পাতায়, চপ্পলে , মেঝেতে- চুন বালির গুঁড়ো কেঁপে উঠে থিতিয়ে গেল। রেণু বোতলের ছিপি খুলে জল খেতে গিয়েছিল, মায়া ওর হাত ধরল- " বিষম লাগবে, একটু বাদে খেও।" মায়ার মুখেও এখন হাসি নেই , ওর চোখ রেণুর মাথা থেকে পা খুঁটিয়ে দেখছিল; ও দেখছিল, রেণুর অযত্নের হাত, ফাটা গোড়ালি, গলায়, কব্জির কাছে রহস্যময় গাঢ় কালো খয়েরী দাগ সব। আমি জানি মায়া এবার চোখ তুলবে আমার দিকে, তারপর সন্দীপের দিকে ফিরে "একটু আসছি" বলে রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল বসাবে। গত দুদিন এরকমই ঘটেছে বারবার।
এখন অবশ্য সন্দীপই উদ্যোগ নিল; গলা খাঁকরে বলল- "ইন্টারেস্টিং তো বটেই, চা খাওয়া যাক এবার, জল বসাই দাঁড়াও।" মায়া বলল, "পাঁপড় ভাজি?" উত্তর শোনার আগেই উঠে পড়ল দুজনেই, পর্দা সরিয়ে ভিতরে গেল। আমি আর রেণু বসে রইলাম মুখোমুখি।
- দুপুরের ওষুধটা খাও নি?
রেণু চুপ করে রইল। আমি কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম - "এই তো কাল বাদে পরশু বাড়ি ঢুকে যাবে এই সময়ে। ছুটি শেষ।" রেণু এখন আর হাসছিল না; হাতের নখ দেখছিল, তারপর মেঝের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
সন্দীপ ডালমুট আর চা নিয়ে ঢুকে রেণুর হাতে কাপ ধরিয়ে দিল এই সময়-" নাও শুরু করো; আমি একটা ফোন করে নিই, জলের পাম্প টা গন্ডগোল করছে, বিশু এসে দেখে যাক"।
"মানে? জল নেই? জল আসছে না বাথরুমের কলে?" রেণু এমন চেঁচিয়ে উঠল যেন ও এক বিজন দ্বীপে নির্বাসিত হয়েছে, ওর চারদিকে স্রেফ নোনাজল আর নোনাজল। সন্দীপ হকচকিয়ে গিয়েছিল-" না না জল আছে, নিচের চৌবাচ্চা তো ভর্তি, ঐ জলটাই দিনে দুবার ওভারহেড ট্যাঙ্কে তুলি, এখন পাম্প চালাতে গিয়ে দেখি চলছে না। বিশু ঠিক করে দেবে।"
- আর ঠিক করতে না পারলে? জল থাকবে না?
- বিশু ঠিক করে দেবে, প্রাইমিং করতে হবে মনে হয়। আর নিচের চৌবাচ্চা তো ভর্তি, একটা টিউবয়েলও আছে; আর কিছু না হোক, বিশুর অ্যাসিস্ট্যান্ট কয়েক বালতি জল ওপরের ট্যাঙ্কে ঢেলে দেবে- ওতেই রাতটা অনায়াসে চলে যাবে- তারপর সকালে...
" যদি ঐটুকু জলে না হয়? কে বলতে পারে! যদি ডায়রিয়া হয়.. যদি বাথরুমে যেতে হয় ঘন ঘন " রেণুর চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছিল- হাতের পেয়ালা পিরিচ ঠকঠক করে কাঁপছিল।
" আরে ওপরের ট্যাঙ্কে এখনও জল আছে, সকালে তো পাম্প চলেছিল, তেমন হলে আমি বালতি করে জল টেনে এনে দেব তোমাকে, নাও পাঁপড় খাও। মুড়ি মাখি একটু? জল নিয়ে ভাবতে হবে না। জি বাংলায় আজ কৌশিক গাঙ্গুলির লেটেস্ট সিনেমাটা দেখাবে একটু পরেই। এই, টিভিটা খোলো না" - মায়া পাঁপড় নিয়ে ঢুকেছিল।
" এক মিনিট " মোবাইল কানে চেপে বারান্দার দিকে গেল সন্দীপ; ফিরে এসে বলল, "শুনছ, ব্যাড নিউজ, বিশু আসতে পারবে না -"
- আরে বাবা দেখছ, বেচারি টেনশন করছে, ব্যাড নিউজ ব্যাড নিউজ বলে চেঁচাচ্ছ কেন! আরো অনেক প্লামবার আছে, তরুণকে ফোন করো, নম্বর আছে?
- কেসটা জটিল। বিশু বলল- নতুন পাড়ার দিকে কুমীর দেখা গেছে। টিভিতে দেখাচ্ছে। ওদের এলাকায় মাইকিং শুরু হয়েছে। তরুণও আসতে পারবে বলে মনে হয় না।
"কুমীর!" আমরা সবাই একসঙ্গে চেঁচালাম, রেণু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সবার চোখ অটোমেটিকালি রেণুর দিকে এখন- সে মুখ সম্পূর্ণ রক্তশূন্য, চোখ বিস্ফারিত-আমার দিকে আঙুল তুলে সে বলে- " আমাকে আনলে কেন এখানে?"
" আরে দূর ভয়ের কিছু নেই, বনবিভাগের লোক এসে ধরে নিয়ে যাবে একটু পরেই। কোনো ভয় নেই,রিল্যাক্স"- সন্দীপ বলল। আমি ঢোঁক গিললাম। ওদের সামনে অপ্রস্তুত লাগছিল। তারপর সামলে নিয়ে , রেণুর পিঠে হাত রেখেছি- " কতদিন কোথাও যাও নি..."
-তাতে অসুবিধে কিছু হয়েছে? তুমি তো গিয়েছ -এখানে ওখানে-কাজে, বেড়াতে, সভায়- তোমার বেরোনো দরকার, আমার তো দরকার ছিল না।
সন্দীপ আর মায়া চায়ের কাপ হাতে আড়ষ্ট হয়ে যায় এমন যেন রেণু গোগোগোগো বলতে বলতে আচমকা স্ট্যাচু বলে দিয়েছে; এরপর পরিস্থিতি যথাসম্ভব স্বাভাবিক করতে একজন তরুণের নম্বর ডায়াল করতে থাকে, অন্যজন টিভি খুলে দেয়।
সিনেমাই হোক বা চিড়িয়াখানা- বরাবরই কুমীরদের আধখোলা চোখ মেলে রোদে শুয়ে থাকতে দেখেছি, কখনও বা গাছের গুঁড়ির মতো জলে ভেসে থাকতে। এই মুহূর্তে টিভির পর্দা জুড়ে বিশাল কুমীরকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছিল, এমনি অবিশ্বাস্য সে দৃশ্য যে মনে হল, দম দেওয়া এক বিশাল খেলনা স্লো মোশনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লম্বা মোটা ল্যাজ, ছোটো ছোটো হাত পা ,দাঁত বেরিয়ে আছে- তার চকচকে পিঠে বিকেলের রোদ। এ দরজা থেকে ও বাড়ি সিঁড়ি, উঠানে রাখা লাল নীল সাইকেল, ঝাঁটা বালতি পেরিয়ে সে হাঁটছিল, গৃহস্থের দোরগোড়ায় ঘুরছিল, থামছিল, আবার ঘুরছিল। ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে, বারান্দায় মানুষের ভীড়, সবার হাতে মোবাইল, ভিডিও নেওয়া চলছে; ভিতরকণিকার দিক থেকে কোনোভাবে চলে এসেছে- টিভিতে বলছিল।
- দ্যাখ , কেমন লেখার মেটেরিয়াল পেয়ে গেলি, এখানে এলি বলেই না! করাল কুম্ভীর লিখে ফেল জমিয়ে।
- মা গো, কী কান্ড, চ্যানেল বদলাও, সিনেমা শুরু হয়ে গেল।
রেণু যান্ত্রিকস্বরে বলে উঠল-" জলের কী হবে?"
"জল আছে তো রেণু , ফুরিয়ে গেলে টিউবয়েল থেকে এনে দেব, বললাম তো "- সন্দীপ আর মায়া একসঙ্গে বলল- ওরা স্পষ্টতই বিরক্ত হচ্ছিল এবার- কুমীর দেখার মজা বা কৌশিক গাঙ্গুলির সিনেমা মাটি হওয়া- যে কারণেই হোক-
রেণু বলল- " আমার পেট ব্যথা করছে, বাথরুমে যাব।" ও বেরিয়ে গেলে, আমি বললাম- "সরি রে"। মায়া বলল- "দূর, সরি র কী?" সন্দীপ বলল, " রেণু এখন পুরো কিয়োর্ড , ভেবেছিলাম.. ওষুধ খাচ্ছে না?”
- খায় তো। আজ খায় নি বোধ হয়- দেখছি।
- দাঁড়া , ক বালতি জল টিউবওয়েল থেকে তুলে আনি।
-আমি যাই তোর সঙ্গে। টিউবওয়েল কেন? নিচের ট্যাঙ্ক ভরা বলছিলি-
- ঐ ট্যাঙ্কের ঢাকনা খোলা খুব ঝামেলার- শুধু বিশুই পারে, একটা ট্যাপ আছে অবশ্য কিন্তু সে এতই নিচে-একটা মগ বসানো যাবে বড়জোর-
- আর একবার বিশুকে ফোন করো না হয়
-দেখছ তো কী অবস্থা, এর মধ্যে কেউ বেরোবে না- ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক কখন আসবে , কতক্ষণ লাগবে সব সিকিওর করতে কে জানে!
- এরকম কাণ্ড আগে হয়েছে?
সন্দীপ মাথা হেলায়, ফোন টিপতে গিয়ে চশমা পরে, খোলে- " দ্যাখো, কাউন্সিলরের মেসেজ- পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া অবধি কেউ যেন বাড়ির থেকে না বেরোয়। চল, চট করে দু বালতি জল নিয়ে আসি।"
" কেউ এক পা বেরোবে না বাড়ির থেকে-" মায়ার মুখ গম্ভীর; খোলা জানলা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বন্ধ করতে থাকে। সন্দীপ সিগ্রেট ধরায়- " আরে জানলা দিয়ে কুমীর ঢুকবে না কি? তোমারও কি মাথা.." বাকি শব্দ ধোঁয়ার সঙ্গে গিলে নেয় সে।
বাথরুমের দরজার আওয়াজ হ'ল, রেণু বেরিয়ে এসেছে - কাফতান বদলেছে, চুল ভেজা, হাতে পায়ে জলবিন্দু, ভেজা চটি, হাতে ভেজা তোয়ালে, কাফতান, শায়া। " আবার স্নান করলে? কেন?" আমি গলা তুললাম; মায়ার মুখ অভিব্যক্তিহীন, সন্দীপ ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে বলছে। রেণু নিঃশব্দে বারান্দার তারে ভেজা তোয়ালে মেলতে লাগল।
- চা করি, সব ঠান্ডা হয়ে গেল; রেণু তো কিছুই খেল না । মিষ্টি খাবে , এই রেণু?
- টিভি টা বন্ধ করো না, বেচারির টেনশন বাড়ছে এসব দেখে।
" আমার গা গুলোচ্ছে।" বাথরুমে ঢুকে গেল রেণু। মায়া আর সন্দীপকে আবার স্ট্যাচু মোডে চলে যেতে দেখলাম।কিছু একটা করা দরকার এখনই -" সন্দীপ, ভ্যালিয়াম আছে তোর কাছে?"
- তা আছে, কিন্তু রেণু অন্য কী ওষুধ খায় না খায়-
- এখন ঘুমের ওষুধ না দিলে এরকমই চলবে -যতক্ষণ না কুমীর ধরা পড়ে, বিশু এসে পাম্প সারায়-
- এত সিরিয়াস ব্যাপার তো বুঝি নি রে; জানা থাকলে, আসার জন্য জোর করতাম না-
- এক বছর বেশ ভালই ছিল, বুঝলি..
সন্দীপ মাথা নাড়তে নাড়তে ওদের শোবার ঘরে ঢুকে যায়-" মায়া , একটু শোনো, ওষুধের বাক্সটা.. একবার এসো... "
আবার স্নান করে বেরিয়ে এলে, রেণুকে ওষুধ দিলাম। রোবটের মতো ওষুধ নিলো আমার হাত থেকে, জল ঢালল গলায়, ওষুধ গিলল- " জল থাকবে তো ট্যাঙ্কে? এতবার যেতে হচ্ছে-"
- একটু শুয়ে নাও, বুঝলে? ও'ঘরে গিয়ে শোবে, চলো।
পরপর দুবার স্নান করে রেণুর স্নায়ু শান্ত হয়ে আসছিল ক্রমশ, বারান্দা পেরিয়ে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুলো পাখা চালিয়ে। পাতলা চাদর টানলো গায়ে। চোখ বুজলো। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে, বসার ঘরে আবার টিভি চালালাম। সন্দীপ ভলিউম কমিয়ে দিয়ে বলল- "তুই রেণুর কাছেই বোস না।"
- ও ঘুমিয়ে পড়বে এখনই। আমি থাকলেই বরং-
"বিয়ের পরে তোর একটু বদলানো উচিত ছিল, বিশেষ করে বিল্টু হওয়ার পরে; আমরা সবাই বদলাই, আমাকেই দেখ না- এই সাদা কাঠিটুকু বাদ দিয়ে বাকি সব ত্যাগ করেছি" সিগারেট ধরালো সন্দীপ।
-তুই কি আমাকে দায়ী করছিস?
"দেখ, কলকাতা থেকে দূরে থাকলেও কিছু কথা আমাদের কানে আসে, এসে যায়- তার কতটুকু সত্যি আমরা বিচার করি নি কোনদিন, কিন্তু এসব কথা না ওঠাই ভালো" -গেঞ্জি পাজামা পরা সন্দীপ নিমেষে গম্ভীর অধ্যাপক হয়ে যায়। হয়তো কেয়া আর স্বাতীদের ইঙ্গিত করল; আমি চুপ করে থাকি, অনিমেষের ঘটনাটা ওরা জানে না- " জ্ঞানত রেণুর অযত্ন করি নি আমি। একটা সিগারেট দে।"
রেণুকে বাদ দিয়েই আমরা রাতের খাওয়া সারি; ও অঘোরে ঘুমোতে থাকে, ঘুমোতেই থাকে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার দেখি। কেয়ার মেসেজ দেখি- টিভিতে কুমীর দেখেছে-আমরা ঠিক আছি কী না জানতে চায়। মেসেজ করি একটা। কেয়া পাল্টা কবিতা পাঠায় চার লাইন। মফস্সলের রাস্তা, আজ রাত দশটায় সম্পূর্ণ জনশূন্য। সন্দীপ আমার কাঁধে হাত রাখে- " সরি। আমার এভাবে বলা উচিত হয় নি। তোর কষ্টটা আমি বুঝি। আর জাগিস না। এবার শুয়ে পড়, কুমীর রাতেই ধরা পড়ে যাবে মনে হয়।"
-টিভিতে কী বলছে?
- আর খুলি নি। খবর দেখলে টেনশন বেড়ে যায় আরো।
দাঁত মেজে বাথরুমের কাজ সারতে সারতেই জলের পাইপে হাওয়ার বুজকুড়ি কাটা শুনতে পাচ্ছিলাম। জল ফুরিয়ে এসেছে।
রেণুর হাল্কা নাক ডাকে। গায়ে হাত রাখলে পাশ ফিরে শোয়, নাক ডাকা বন্ধ যায়। আজ যেমন ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। কুমীরের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো যখন, বাইরে অন্ধকার, মোবাইলে সময় দেখলাম চারটে, বিছানায় রেণু নেই। বাথরুমে গেছে ভেবে পাশ ফিরেই মনে হল- যদি জল ফুরিয়ে গিয়ে থাকে! একলাফে খাট থেকে বাথরুমের সামনে গিয়ে দেখি দরজা খোলা, বাথরুম অন্ধকার। কোথায় গেল রেণু? করিডোর অন্ধকার, ও’ মাথার ঘর সন্দীপদের - সে দরজা বন্ধ। বাইরের ঘর শুনশান। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছি- ক্যাঁচ কোঁচ আওয়াজ শুনলাম বাইরে । কিচেনের লাগোয়া সরু বারান্দার শেষে কোল্যাপসিবল গেট, এবাড়ির খিড়কি। গেট পেরিয়ে টিউবওয়েল- তারপরেই ঝোপঝাড়, ভাঙা পাঁচিল, মজা পুকুর। দেখলাম , গেটের তালা খোলা, আর সামনের চাতালে আধো অন্ধকারে মাথা নিচু করে টিউবওয়েল পাম্প করছে রেণু -ক্যাঁচ, কোঁচ, ক্যাঁচ...বালতি ভরছে একটার পর একটা। বাইরের আলো জ্বালিয়ে দিলাম । রেণু একমনে বালতি ভরছিল-নানা মাপের , বিভিন্ন রংএর প্লাস্টিকের বালতি সব -কলতলার আলোয় তাদের জাইলোফোনের মতো লাগে। দীর্ঘ ছায়া পড়ছিল রেণুর আর টিউবওয়েলের- যেন একের সঙ্গে এক অঙ্গাঙ্গী; গাছের মরা ডালের মতো লাগছিল। এদিকটা একেবারেই আসি নি এই দু দিনে। ভাঙা পাঁচিলের দিকে ঝোপঝাড়ের ঘন ছায়া । জঙ্গল, আগাছা বহুদিন পরিষ্কার করা হয় নি, মনে হয়। কলতলায় নামতে গিয়ে চমকে উঠলাম। ঝোপের ছায়া যেন নড়ে উঠল।
দিবসারম্ভের ঘোলা আলোয় লম্বাটে এবড়ো খেবড়ো একটা মাথা দেখলাম -মাটির সঙ্গে সমান্তরাল। দেখলাম দাঁত , নিঃস্পন্দ চোখ। গুঁড়ি মেরে রেণুকে দেখছে। চাতাল থেকে পা তুলে নিয়েই, বারান্দার দিকে ফিরলাম - ছাতা হোক, লাঠি হোক, আধলা ইঁট না হোক ক্যাম্বিস বল- পুরোনো বারান্দায় গৃহস্থের যা যা থাকে - একটা কিছু খুঁজছিলাম - যা ছুঁড়ে মারা যায়। কুমীরকে বিভ্রান্ত করে রেণুকে টেনে আনব ঘরের মধ্যে। অথচ সেরকম কিছুই নেই হাতের কাছে; কোল্যাপসিবল গেটের গায়ে ঘর মোছার ন্যাতা শুধু- ব্যাস এই। মোবাইলটাও ঘরে ফেলে এসেছি- এখন ঘরে ফিরে গেলে, সন্দীপদের ডাকতে গেলে যে টুকু সময় লাগবে, তার মধ্যেই রেণুকে কুমীর নেবে, আমি নিশ্চিত। কিছু করতে হবে- এক্ষুণি। হাল্কা শিস দিলাম -যদি রেণু ফিরে তাকায়, ওকে হাত নেড়ে ঈশারা করব; ক্যাঁচ কোঁচ আওয়াজে শুনতে পেল না কিচ্ছু, একমনে পাম্প করে যাচ্ছে, যেন জগতের সমস্ত বালতি ভরে ফেলবে এই ঊষাকালে যাতে সারাজীবনে আর ওর জলের অভাব না হয়। কুমীর এখনও ওর দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে। এবারে ভরা বালতি সরিয়ে খালি বালতি পাতছে রেণু - পাম্প করার আওয়াজ এই মুহূর্তে অনুপস্থিত, সময়ের ঐ ফাঁকটুকুর মধ্যে আবার শিস দিলাম মরিয়া হয়ে; মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো রেণু- আমি ঝোপের দিকে দেখালাম, হাত নেড়ে দৌড়ে চলে আসার ইঙ্গিত করলাম। রেণু বালতি রেখে কুমীরের দিকে তাকালো, আবার আমার দিকে। আমি ফিসফিস করে বললাম- " চলে এসো রেণু, আমার কাছে এসো। "
আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছিল। এইটুকু আলোয় নিকটজনের চোখ নির্ভুল পড়ে মানুষ। রেণু আমার দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালো- সে দৃষ্টিতে প্রেম অপ্রেম ঘৃণা রাগ বেদনা কিচ্ছু ছিল না। হাত তুলে কিছু বলল। থেমে থেমে। আমি শুনলাম- ওখানে জল। আছে। রেণু আর একবার তাকালো এদিকে, তারপর কলতলার চাতালে ভেজা পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে কুমীরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
[সাহিত্যিক শ্রী জগদীশ গুপ্তকে শ্রদ্ধার্ঘ্য]
[প্রথম প্রকাশঃ গল্পবিশ্ব, ৭ম সংখ্যা, ২০২৪]
Comments
Post a Comment