চার রঙের উপপাদ্য

 

হেমন্ত-

 

ভোর রাতে মোড়ের মাথায় দুটো বোমা ফেটেছে; বিস্ফোরণের শব্দ 'পাড়ার প্যাঁচালো গলি ঘুঁজি বেয়ে, এই দেওয়ালে ওর পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে তাগদ হারিয়েছিল অনেকখানি। কিন্তু অবশিষ্টটুকুর এমনই জোর যে এ গলির ঢ্যাঙা ফ্ল্যাটবাড়ির কাচের জানলা থরথর করে কেঁপেছিল;  ফলতঃ লোকজন ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে বাইরে  তাকিয়ে  বিহ্বল হয়। তারপর  ঘরের বাতি জ্বালায়, জল খায়, বাথরুমে ঘুরে এসে মোবাইল চেক করে নেয় ঘুমচোখে। পাঁচতলা অবধি এক এক করে আলো জ্বলে উঠছিল -যেন বোমার  আওয়াজ  রিমোট  কন্ট্রোলে  দীপাবলীর মোম জ্বালাচ্ছে আওয়াজের কার্যকারণ  বুঝতে না পেরে আবার বিছানায় ঢুকে যাচ্ছিল কেউ। আলোরা জ্বলছিল, নিভছিল। কুকুর ডাকছিল। দৌড়োচ্ছিল গলি ধরে।

ফ্ল্যাটবাড়ির  নাম  শশীবাবুর  সংসার। তার  ডাইনে বাঁয়ে একতলা দোতলা পুরোনো বাড়ি, শ্যাওলা ধরা দেওয়াল। তিন নম্বর বাড়ি মিঠুদের। বাথরুমে যাচ্ছিল- ভোর হতে না হতেই পেট মুচড়ে ওঠে,  বমি বমি লাগে আজকাল - সম্ভবত রাতের খাবার হজম হয় না;  বিছানা ছেড়ে বাথরুমের আলো জ্বালাচ্ছে মিঠু, পাতলা সুজনির তলায় গুলগুলে আর কুন্তী, চাদর সরে যেতেই  আড়মোড়া ভাঙছে - এমন সময় গুমগুম আওয়াজ  যেন গলির মুখ থেকে এসে ওদের বাড়িতে ধাক্কা খেলো। জলের ফিল্টারের তলার তিন পা টেবিল অনেকদিন নড়বড়ে; ঝাঁকুনিতে ফিলটারের ওপরে উপুড় করে রাখা কাচের গেলাস খানখান হতেই মিঠু চেঁচালো - "মা, ভূমিকম্প";  এমন জোরে চিৎকার করল যে বুকে ধরে রাখা বাতাসটুকু যেন খরচ হয়ে গেল তার। আবার শ্বাস নিল সে, তারপর একদমে- "কতদিন বলেছি এই ভাবে গ্লাস রাখবে না"- বলে, পেট চেপে বাথরুমে ঢোকার আগে চোখের কোণ দিয়ে ডানদিকের  ঘর থেকে ছন্দাকে আলুথালু হয়ে বেরোতে দেখল। এক মুহূর্তের কৌতূহল হয়েছিল , বিপ্লবও একই ঘর থেকে বেরোলো কী না জানতে। পরমুহূর্তেই নিজেকেই অচেনা ঠেকেছিল তার- মিঠু ছিটকিনি দিয়েছিল বাথরুমে।

ছন্দা প্রথমে বারান্দার , তারপর বাইরের ঘরের আলো জ্বালিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালো- সামনের গলিতে আধো অন্ধকার, নর্দমার গন্ধ আর মশার ঝাঁক জমাট হয়ে আছে, হাওয়া বাতাস নেই- কালু, লালু, আর বিউটি পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে;  পাশের বাড়ির মীনা আর সুধীনকে গেট খুলে রাস্তায় বেরোতে দেখে ছন্দা চেঁচিয়ে বলল- "কী হয়েছে  বৌদি?"  মিঠু বাথরুম থেকে অ্যাম্বুল্যান্সের হুটারের আওয়াজ পাচ্ছিল।  তারপর দমকলের ঘন্টা। কুকুরের ডাক অবস্থান বদলাচ্ছিল। ছন্দার গলা পাওয়া যাচ্ছিল- মা সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তার দিকে যাচ্ছে টের পাচ্ছিল সে। বিপ্লবের কাশির আওয়াজ পেল তারপর। বাথরুমের দরজায় টোকা দিল বিপ্লব, " দেরি আছে রে? একটু যেতাম-"

- আসছি, দাঁড়াও। গ্লাস ভেঙেছে একটা। পা কেটো না।

গলির প্রায় শেষ বাড়ি মিঠুদের। পরের দুটো বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না- প্রোমোটারকে দেওয়া আছে,  ফ্ল্যাটবাড়ি উঠবে। ছন্দা, মীনা আর সুধীন এক কোণে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল;  বড় রাস্তার দিক থেকে চেঁচামেঁচি, অ্যাম্বুলেন্স আর দমকলের আনাগোণা টের পাওয়া যাচ্ছে। বাতাসে হিম রয়েছে।

-কী হয়েছে মা? ভূমিকম্প হয় নি?  বাইরে কী করছ? ভেতরে ঢোকো ঠান্ডা লাগবে। কুন্তী কই?

- ঘরে আটকে রেখেছি।  কোথায় আবার  ভূমিকম্প!! মীনা  তো বলছে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটেছে। দাঁড়া দেখে আসি। কাচগুলো তুলে ফেলিস। তোর মামু পা কাটলে কেলেংকারি।

মিঠু জানে , মা এখন মীনা আর সুধীনকে বিপ্লবের সুগার ইত্যাদি চোদ্দো রকম অসুখের ফিরিস্তি দিতে দিতে বড় রাস্তা অবধি যাবে; মীনাকাকিমারা মুখ টিপে শুনবে এখন , অথচ বাড়ি ফিরে-

ভাবতেই মিঠুর কান , মাথা গরম হল। মনে মনে নিজেই হাসল তারপর-  এত বয়সেও অভ্যাস হল না। ভারি শরীর নিয়ে নিচু হল মিঠু; কাচের টুকরো কতদূর ছড়িয়ে গেছে- অগম সব কোণ থেকে কাচের টুকরো টুকিয়ে আনতে মজা পাচ্ছিল সে। শেষ টুকরোটা কুড়োতে গিয়ে খেয়াল করল দেড় সেন্টিমিটার সূর্যের আলো  চৌকাঠ পেরিয়েছে অলরেডি।  খিদে পেতে লাগল। চায়ের সঙ্গে কড়া টোস্ট-ফ্রিজ থেকে মাখন বের করে লাগাতেই গলে গলে যাবে - মুখ ভরে জল এল মিঠুর। ছন্দা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই চেঁচাচ্ছিল, " কত দেরি হয়ে গেল রে! চা বসিয়েছিস?  সাঙ্ঘাতিক কান্ড বোমা পড়েছে মোড়ের মাথায়- যেতে দিচ্ছে না ওদিকে।"

-তাহলে এতক্ষণ কোথায় ছিলে?

উত্তর না দিয়ে ছন্দা বাথরুমে ঢুকে গেল।

~*~

এই এখন মিঠু, ছন্দা আর বিপ্লব চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অন্যদিন এই সময় সামনের ফুটে বাপি আর মাণিক  তরকারি নিয়ে বসে, সামনের মুদীখানার ঝাঁপ খুলে বেচাকেনা শুরু হয়- পাঁউরুটি, মাদার ডেয়ারির পাউচ, মারি বিস্কুট;  স্কুলবাস বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়,  গলির বাচ্চারা দলবেঁধে বাস ধরতে হাঁটে। মিঠুর রিক্সা আসে; বলাই এলে  ছন্দা আর বিপ্লব ব্যালকনিতে দাঁড়ায়; মিঠু হাত নেড়ে কালো চশমা পরে নেয় তখন, তারপর রিক্সার হুড তুলে , হুডের দু'দিকের কলকব্জা টিপে সমান করে, বাদলা দিনে প্লাস্টিকের পর্দা  টেনে দেয়।  তারপর,বলাই মিঠুকে বড়রাস্তায় নামিয়ে দিলে সে বাস ধরে কলেজ পৌঁছয়।

আজ রবিবার। মিঠুর কলেজ নেই। বলাইকে আসতে বলেছিল তবু - টুকটাক কেনাকাটা- ক্রীম  ট্রীম; নেলপলিশ ফুরিয়ে গেছে, একটা পারফিউম-  সকাল সকাল সেরে আসবে ভেবেছিল। তারপর দুপুরে খেয়ে দেয়ে লম্বা ঘুমোবে।

ছন্দাই বলল, "বলাই কি আসতে পারবে আজ? বড় রাস্তার দিক  দিয়ে তো কিছুই আসতে দিচ্ছে না।"

বলাই মিঠুকে মোবাইলের নম্বর দিয়ে রেখেছে বহুদিন। রিক্সা চালালে ফোন ধরতে পারে না আজ একবার বাজতেই ধরে নিল।

- দিদি, আমি তো বড় রাস্তার মোড়ে সেই কখন থেকে। ভিতরে ঢুকতে  দিচ্ছে না পুলিশ।

-জানি তো। মেলার মাঠের পিছন দিয়ে একটা ঘোরা পথ আছে না সাহেবগলি হয়ে? আসবে?

-না দিদি। এখানে খুব ঝামেলা হচ্ছে।   মাণিক মারা গেছে জানেন তো?

-মানে?

- মাণিককে চেনেন না? আপনাদের বাড়ির সামনেই তো বসে সব্জি নিয়ে। বোমায় উড়ে গেছে।

মিঠুর হাত পা থরথরিয়ে কাঁপতে  থাকে।

-তুমি জানলে কী করে?

- দুজন মারা গেছে দিদি। টিভিতে দেখাচ্ছে - কী রক্ত, কী রক্ত!!  বডি দুটো এখন নিয়ে যাবে।  রাস্তা খুলবে। তারপর আসব দিদি?

- না , আজ থাক। মা, মা,  টি ভি খোলো শিগ্গির।

~*~

টিভির সামনে থম মেরে বসে আছে বিপ্লব- -চ্যানেল - চ্যানেল ঘুরিয়ে একই খবর শুনে যাচ্ছে বারবার- যেন মাণিকের মৃত্যুর খবর ভুল বলে প্রমাণ করে দেবে কোনো এক চ্যানেল। ছন্দা খানিক কাঁদল, এখন বাজার কী করে হবে,  মাসকাবারি জিনিস কে নিয়ে আসবে - এই সব বলছে।  গুলগুলে ল্যাজ  তুলে একবার বিপ্লবের পাজামা  আর একবার ছন্দার শাড়িতে মাথা ঘষছিল।  কুন্তী চাদরের তলায় অ্যাজ ইউজুয়াল। মিঠু হাত বোলাচ্ছিল কুন্তীর মাথায়।  তারপর আলনা থেকে ওড়না টানল- " আমি বাজার নিয়ে আসছি"। বিপ্লব বলল, "তুই বোস, আমি যাই।" " মিঠু যাক। তোমার আজ বেরিয়ে কাজ নেই " -ছন্দা চোখ মুছল। "আমি ঠিক আছি" বিড়বিড় করতে করতে বিপ্লব আবার বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিল। পা  টেনে টেনে হাঁটছিল বিপ্লব, কাঁধ ঝুঁকে গেছে, পায়জামার দড়ি ঝুলছিল; বারান্দার বেসিনে নাক ঝেড়ে বাথরুমে ঢোকার আগে বলল- “বেশি দূরে যাস না মিঠু, মোড়ের মাথায় সব পেয়ে যাবি।

আয়নায় তাকালে মিঠুর আজকাল নিজেকে গ্যাসবেলুনের মত লাগে- যেন সুতো ছেড়ে দিলেই আকাশে উড়ে যাবে। এই গলির ওপর দিয়ে, শশীবাবুর সংসারের ছাদের ওপর দিয়ে  ভেসে যাচ্ছে সে- তার হাওয়া ভরা হাত, পা, শরীর- বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে মা আর মামু- ভাবতে হাসি পায় তারপর চোখে জল আসে যেন গ্যাসবেলুনের সুতো আটকে আছে ছাদের জং ধরা অ্যান্টেনায়, সে চাইছে আরো উঠতে, তারপর স্রেফ ভেসে যেতে, অথচ  টান পড়ছে সুতোয়। ডক্টর দাসের বহুদিনের বক্তব্যঃ " মিঠু, ওজন কমা। এখনই হাঁটুতে ব্যথা, কোমরে ব্যথা তোর। এরপর অসুখের ডিপো হয়ে বসে থাকবি।“   ডায়েট, নিয়মিত এক্সারসাইজ- না পারলে সকাল বিকাল হাঁটাহাঁটির প্রেসক্রিপশন  তার ব্যাগেই আছে, অথচ এই গলি পেরিয়ে বড় রাস্তা অবধি সে হাঁটতে চায় না- বলাইএর রিক্সা লাগে; মিঠুর ভয়  করে- এই বুঝি  সনৎএর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল-  ছন্দা অনেকবার দেখেছে সনৎ কে 'অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করতে। একদিন নাকী বিপ্লবকে বাজারে ধরে প্রণাম করেছিল-" মামু কেমন আছেন?" ছন্দা সে কথা শুনে চেঁচামেচি করেছে- "তুমি ওকে প্রণাম করতে দিলে?" বিপ্লবকে কাঁচুমাঁচু দেখিয়েছে আর মিঠুর ভয় বেড়ে গেছে তিনগুণ। রিক্সার ঘেরাটোপ, কালো চশমা ছাড়াও আজকাল একটা চাদর নিতে শুরু করেছে মিঠু। তবে বড় রাস্তার মুখ অবধি। একবার বাসে, লোকের ভীড়ের মধ্যে নিজেকে গুঁজে দিতে পারলে আর ভয় নেই।

এই সব গন্ডগোলে সনৎ এদিকে আসতে পারবে না - মিঠুর মনে হয়েছিল; কালো চশমা, ছাতা আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। প্যাঁচানো গলির শেষ গিঁটটা পার হতে বাঁয়ে ঘাসজমি আর সামান্য এগোলে বড় রাস্তা।  আকাশ ঝকঝকে  - সাদা মেঘ ছোটো নৌকার মত ভাসছে;  যদিও অক্টোবরের শেষাশেষি,  পারফেক্ট শরতের আকাশ আজ বাংলা রচনা বই থেকে সটান উঠে এসেছে ঘাসজমিতে এখনও প্যান্ডেলের খাঁচা  -  কালীপুজো সবে শেষ হয়েছে। মিঠু একবার ছাতা সরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল তারপর সামনে। পুলিশে, গাড়িতে, ভীড়ে বড় রাস্তার মোড় থই থই করছে। ওর অসহায় লাগল - ঝোঁকের মাথায় না বেরোলেই হত;  এই ভীড় পেরিয়ে বাজার অবধি কেমন করে যাবে ? বলাইকে ফোন করতে এবারও বলাই একবারে ধরে নিল।

-দিদি, বেরিয়েছেন?

- তুমি কোথায়?

- আমি তো এই মোড়ের মাথায়, মিষ্টির দোকানের সামনে - একটু এগিয়ে আসুন। বডি নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষুণি সব ক্লীয়ার হয়ে যাবে।

মিঠু ফোনে কথা বলতে বলতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। টেন কম্যান্ডমেন্টস সিনেমায়  যেমন সমুদ্রর জল সরে গিয়েছিল, ভীড়টা সেই রকমভাবে পথ করে দিচ্ছিল দুটি সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহকে।  এর মধ্যে একজন মাণিক। গতকাল সন্ধ্যায়ও ওর থেকে টমেটো আর বেগুন কিনেছিল মিঠু। কুপির আলোয় মুড়ি খাচ্ছিল - " নিয়ে যান দিদি, পোকা নেই" বলেছিল। মিঠুর মাথার ওপরে নীল আকাশ- তার নিচে দুটি প্রাণহীন দেহ।  মেঘে মেঘে ঘর বাড়ি তৈরি হচ্ছিল এতক্ষণ, তারপর ভেঙে গিয়ে মানুষের মুখ;  একটা  ডানাওলা পাখি দুটো সাদা  ঘোড়া হয়ে  এবারে ঘন মেঘের সুড়ঙ্গ হয়ে গেল চোখের সামনে- ভেতরে কালচে গহ্বর। অমনি ইলেকট্রিক চুল্লির কথা মনে হল মিঠুর। আজকের  রোদ আর আকাশের সঙ্গে মৃত্যুকে মেলাতে পারছিল না সে। ওর মনে হচ্ছিল,  মৃত্যুতে জীর্ণ দেহ, ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীর মেলে শুতে হয় - এই রোদে সে যেন এক মহা পতন। আচমকাই  নিজের মৃত্যুর কথা ভাবল মিঠু  - এই রকম সাদা চাদরের তলায় যেন তার ভারি শরীর- চুল্লিতে ঢুকে যাবে এইবারে।  তারপর এই পতনকে সে অস্বীকার করতে চাইল বারে বারে;  আকাশের দিকে তাকিয়ে,  কার কাছে  চাইল সে নিজেও জানে না-  মনে মনে বলল,  সে যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরতে পারে-

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হেমন্ত-

 

পিট স্ট্রীটের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে জেব্রা ক্রসিংএর ওপর আলোর রং বদলে যেতে দেখছিল পঙ্কজ   অফিস থেকে বেরোনোর পর এইখানে দাঁড়িয়ে কলকাতার কথা মনে  হয় -  ওর চোখের সামনে উঁচু উঁচু বাড়ির পিছনে সূর্য ডুবে যায়, রাশ আওয়ারে অফিস ফেরতা মানুষের দীর্ঘ ছায়া ফুটপাথে পড়ে , আলো কমে আসে এই সময়;  গোধূলিতে সব মানুষের রং সবজেটে, মাথার দিকটা কমলা হলুদ- সবাইকে একলা আর সন্ত্রস্ত লাগে পঙ্কজের।  কিওস্ক থেকে ভাজা মাংসের  সুবাস  বাতাসে ভাসতে থাকে, ক্রসিংএ লাল, হলুদ  সবুজ আলো জ্বলে নেভে - সে আলোয় ট্যাক্সি,  ট্রাক, বাস আর পথচারীর জট পাকায়, খুলে যায় আবার। স্ট্রীট লাইট জ্বলে উঠলে মানুষ আবার স্টীল গ্রে  হয়ে যায় , তখন একটা মানুষের চারটে করে ছায়া। নিজের ছায়া দেখতে দেখতে বাড়ি যায় পঙ্কজ।

আজ অবশ্য ভর দুপুর- পঙ্কজ হাফ ডে নিয়ে সুবিমলের বাড়ির দিকে চলেছে ; লিপি, সুবিমলের মেয়ে তিন্নির আজ পাঁচ ';  ওদের অ্যাপার্টমেন্টেই ছোটো পার্টি। পঙ্কজ অফিস ফেরত  খেলনার দোকানে ঢুকেছিল।  সফ্ট টয়, বারবি ডল, রকিং হর্স, ট্রাইসাইকেল, লেগো- কী নেওয়া যায়? স্মিতাকে একবার ফোন করে দেখবে? ঘড়ি দেখল পঙ্কজ তারপর স্মিতার সময় হিসেব করে মোবাইল ঢুকিয়ে ফেলল পকেটে। বনময়ূরের জন্য একটা সফ্ট টয় বাছল, ট্রলিতে রেখে চকিতে মনে হল, পার্টি চুলোয় যাক, বাড়ি ফিরে গেলে হয়- কত খুশি হবে বনময়ূর! লাল নীল সাদা হলুদ গোলাপি টেডিদের আইলে দাঁড়িয়ে  বনময়ূরের গায়ের গন্ধ পাচ্ছিল সে। অথচ, সুবিমলকে কথা দেওয়া আছে, আজ সকালেও ফোন করেছিল- " তাড়াতাড়ি চলে আসবে। বুঝলে? গুলি মারো অফিসে।"   পঙ্কজ ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এগোলো আবার। সামনের আইলে ম্যাজিক  সেট ফর কিডস- নানা ব্র্যান্ডের চৌকো বাক্স- ওয়ান ফিফটি ক্লাসিক ট্রিকস, হোকাস পোকাস কালেকশন, ম্যাজিক ইন স্ন্যাপ-  খরগোশ, টুপি, তাস, জাদুকাঠি এই সব ছবি বাক্সের ওপর- মুখ ফিরিয়ে নিল পঙ্কজ। পরের আইলে পুতুলের গায়ে হাত বোলালো, লেগোর বাক্স তুলে নিল-

একটু আগেই ঘন কালো পিচ রাস্তার ওপর দুপুরের রোদ ঠিকরে পড়ছিল অথচ এখন এই  বেলা তিনটেয় রোদ মরে আসছে দ্রুত। দোকান থেকে বেরিয়ে পঙ্কজ  দেখল,  আকাশের উত্তর দিক থেকে ঘন কালো মেঘ দৌড়ে আসছে। একই দিক থেকে ধেয়ে আসছিল ডাউনের বাস। চৌমাথার মোড়ে কে আগে দাঁড়াবে  মেঘ না বাস-   মনে মনে বাজি রাখতে রাখতে সিগ্নাল লাল হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল পঙ্কজ সেই সময় উল্টো দিক থেকে জোর হাওয়া উঠল- ধুলো, ভাজা সসেজের গন্ধ, টিউব রেল স্টেশনের চত্ত্বরের চিনে বৃদ্ধর ছড় টানা যন্ত্রের সুর শঙ্কুর মত পাক খেতে খেতে পঙ্কজকে ঘিরে নিল; মেঘের পাল টার্ন নিল সম্পূর্ণ বিপরীতে। বাসগুলো আচমকা ওয়াক ওভার পেয়ে সিগন্যালে পা ছেতরে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর ম্যাজিক শব্দটা মুহূর্তে পঙ্কজের  মনে ঢুকে তার শাখাপ্রশাখা ছড়াল; এই ক্রসিং থেকে যেমন একটা রাস্তা ডাউনে গিয়েছে, অন্যটা আপে; পঙ্কজের মগজের মধ্যে  মুহূর্তে একটা রাস্তা বহু  বছর আগের সাহেবগলিতে বাঁক নিয়ে ঢুকল।

~*~

সুবিমলের অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করছিল পঙ্কজ। রাস্তার দুধারে জ্যাকারাণ্ডা  গাছ- সন্ধ্যের আকাশ ঘন নীল হয়েছে বেগুণী ফুলে;  মেঘ কেটে গিয়ে মিটমিটে তারা ফুটছিল। এদিক ওদিক অ্যাপার্টমেন্টের জানলায় আলো - একটা লম্বা ক্রেন উত্তর দিকের আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে;  ওর মনে হল হুবহু এই রকম আকাশ, এই রকম একটা ক্রেন আগে কোথাও দেখেছে। কোথায়? মাথা চুলকালো তারপর পকেটে হাত ঢুকালো যেন স্মৃতিরা সব ছোটোবেলার মার্বেলের মত ওর পকেটেই আছে- পকেট হাতড়ালেই মার্বেলে মার্বেলে ঠোকাঠুকির আওয়াজ হবে আর হাতের তেলোয় তুলে আনবে সেই মার্বেলটা যার ভেতরে একটা বুদ্বুদের মধ্যে বেগুনী আকাশে হেলানো ক্রেন দাঁড়িয়ে আছে। এক হাত পকেটে রেখেই দরজার ঘন্টা বাজালো পঙ্কজ। সুবিমলের ফ্ল্যাটের দরজার তলা দিয়ে দুধ উথলানোর গন্ধ আসছিল- সম্ভবত পায়েস রেঁধেছে।

সুবিমল পঙ্কজের থেকে অনেকটাই ছোটো। এক পাড়ায় বাড়ি ছিল। এ দেশে আবার দেখা হয়ে যায়। সুবিমলের  বৌকে এক এক দিন এক এক রকম দেখতে লাগে পঙ্কজের-  কোনোদিন চশমা পরা, কোনোদিন চশমাহীন, চশমার ফ্রেমের রং বদলে বদলে যায়, কোনোদিন কোঁকড়ানো খোলা চুল,  আবার একদিন হর্স্টেল;  ওর মনে হয়, রাস্তায় দেখলে চিনতে পারবে না যদি না লিপি নিজেই পঙ্কজের কাছে এসে হেসে  কথা বলে ওঠে।  লিপিকে নিয়ে পঙ্কজের একটা কৌতূহল আছে- মনে মনে যেন এক পরীক্ষা চালাচ্ছে লিপি অজ্ঞাতে। দেখা হলে ডাটা কালেক্ট করে আর জমিয়ে রাখে- একদিন হিসেব করে দেখবে- এই দেশ মানুষকে কত দ্রুত বদলে দেয়। নিজেকে দিয়ে, স্মিতাকে দিয়ে পরীক্ষা চালানোর কথা যখন ভেবেছিল তখন অলরেডি দেরি হয়ে গিয়েছে। লিপিরা এই দেশে নতুন - একদম জিরো আওয়ার থেকে  হিসেব রেখে যাচ্ছে পঙ্কজ। ওর নিজস্ব একটা ফোরকাস্ট করা আছে মানুষের বদলে যাওয়া নিয়ে- লিপি আমূল বদলে গেলেই সময়টা মিলিয়ে নেবে।

আজ লিপির  খোলা চুল, কপালে টিপ, একটাও ইংরিজি শব্দ নেই কথায়  -"আসুন আসুন পঙ্কজদা, এত দেরি হল? "

-সুবিমল বলেছিল, হুরী পরী কারা আসবে,  পরী তো অন্ধকার হলেই আসে- তাই না? কে আসবে? সিন্ডারেলার ফেয়ারি গড মাদার?

- এসে গেছে অনেকক্ষণ। টিংকার বেল। অল্পবয়সের পরী চাই এখনকার বাচ্চাদের। পাঁচ বছরের মেয়ে, তারও কত প্যাখনা-

অনেকদিন পরে প্যাখনা কথাটা শুনল পঙ্কজ। এই দেশে শব্দটা সে শোনে নি- বস্তুত টানা বাংলা  সুবিমলদের কাছে এলেই শুনতে পায়। আর ' বছর যাক- লিপি, সুবিমল শব্দটাই ভুলে যাবে। জুতো খুলতে খুলতে পঙ্কজ দেখছিল, লিপিদের বসবার ঘরের  সিলিং, দেওয়াল বেলুনে স্ট্রীমারে  ঢাকা।  জনা পনেরো বাচ্চা পরীকে ঘিরে  বসে। কার্পেটেও প্রচুর বেলুন ,  রঙীন কাগজের টুকরো।  পরীর হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, হাতে গলায় ফুলের গয়না- তিন্নি হাঁ করে পরীর  রঙীন ডানা, বাহারি গোলাপী জামা দেখছে । গল্প বলছিল পরী। পঙ্কজ পাশ কাটিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকল -রাঘব, পরাশর, তপন, শান্তা, সুপ্রিয়া আর দোলন অনর্গল কথা বলে চলেছে; সুবিমল রান্নাঘরে- বিরিয়ানিতে ফাইনাল টাচ দিচ্ছে। লিপি ঘর ঘর করছিল- বাচ্চাদের সামনে মাফিনের ট্রে ধরছিল; পরক্ষণেই রান্নাঘরে, তারপরেই বন্ধুদের কাছে হাসিমুখে পকৌড়া নিয়ে। শান্তা বলল- " কী পঙ্কজদা, স্মিতাদি কবে ফিরবে? অনেকদিন তো হয়ে গেল"; পঙ্কজ এই প্রশ্নের সামনে অসহায় বোধ করত একদা, এখন একটা বর্ম ওর সঙ্গে থাকে, মুহূর্তের মধ্যে সেটা পরে নিতে হয়।

- স্মিতার জেঠিমার অবস্থা এখন তখন- কী করে আসে? আর তো কেউ নেই..

-স্মিতার কাজিন কেউ নেই? জেঠিমার ছেলে মেয়ে ? আচ্ছা, লোক টোক রেখে দেওয়া যায় না? আয়া সেন্টার থেকে?  প্যালিয়েটিভ কেয়ার টেয়ারের কনসেপ্টটাই নেই, নাকী?

বর্মের ওপর শিরস্ত্রাণ পরে নেয় পঙ্কজ। তারপর ধনুকে তীর জোড়ে।

- স্মিতা এসে গেলে তোমার সঙ্গে ফ্লার্ট করাই মাটি হা হা হা…

শান্তার পরের প্রশ্ন হাসির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলে  লিপি পঙ্কজের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিল।

বসার ঘরে পরীকে ঘিরে বাচ্চাদের নাচ শুরু হয়ে গিয়েছে। মুঠো মুঠো ফেয়ারি ডাস্ট ওড়াচ্ছিল পরী, হাততালি দিয়ে গাইছিল-"ইফ ইউ হ্যাপি অ্যান্ড ইউ নো"; লিপি ভিডিও করছিল; সুবিমল কিচেন থেকে বেরিয়ে দাঁড়ালো -  মুখে তৃপ্তির হাসি। শান্তা, রাঘব মোবাইলে ছবি নিল। হাততালি দিল তালে তালে। টিংকার বেল জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল।  তিন্নি বলল- "উইল ইউ ফ্লাই ফ্রম দিস ব্যালকনি?" টিংকার বেল হেসে হেসে ললিপপ দিল-" উইল  ফ্লাই ফ্রম দ্য পার্ক। "

-হোয়াই?

-তোমার ব্যালকনি থেকে উড়তে গেলে যে দেওয়ালে ধাক্কা খাব। পার্কের দিকটা ফাঁকা।

পঙ্কজের গরম লাগছিল, সামান্য ক্লান্তও।  কিছুক্ষণের জন্য বর্ম খোলার প্রয়োজন বোধ করছিল সে। বলল, "আমি আপনাকে পার্ক অবধি পৌঁছে দিচ্ছি। "

"সো কাইন্ড অফ ইয়ু পঙ্কজদা। আমি বিরিয়ানিটা নামিয়ে ফেলি এই তালে।" সুবিমল আবার রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিল। “ না না আমি একলাই চলে যাব”, টিংকার বেল বলল। ওর মুখ থেকে খিদের গন্ধ পেল পঙ্কজ।

-খেয়ে যান কিছু পরীরা কী খায়? লিপি?

- পার্ক থেকে ফুলের মধু খেয়ে নেব।

হাসতে হাসতে পরী রাস্তায় নেমে,  জ্যাকারান্ডার তলা দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল- এক হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, অন্য হাতে ভারি ব্যাগ। স্ট্রীটলাইটের নিচে লম্বা একটেরে  ছায়া পড়ছিল পরীর। ব্যালকনিতে ভীড় করে বাচ্চারা-পরী একবার হাত নাড়ল ওয়ান্ডসমেত  তারপর রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে গেল।

"আমি জানি, সত্যি পরী নয়। আমি জানি উড়তে পারে না। হেঁটে গেছে।" তিন্নি চেঁচিয়ে বলেছিল। লিপি একবার তিন্নির দিকে তাকাল তারপর সুবিমলের দিকে। ম্লান দেখাচ্ছিল লিপিকে অকারণ গলা তুলে বলল-" খেতে দিয়ে দিই তোমাদের"

ডিনারের পরে কথা হচ্ছিল টুকটাক। সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিল তিন্নি। ওর বন্ধুরা ফিরে গেছে অনেকক্ষণ। " আজকালকার বাচ্চারা আর পরী , ম্যাজিক এইসবে বিশ্বাস করে না", সিঙ্কে বাসন নামাতে নামাতে লিপি বলেছিল। সুবিমল সিগারেট ধরাল, " আচ্ছা পঙ্কজদা, সাহেবগলির সেই লোকটার কথা তোমার মনে আছে? খুব ফরসা, মোটা জুলফি? ম্যাজিক দেখাত নীলকমল না লালকমল নামে?" পঙ্কজ থমকাল। তারপর গলা খাঁকরে বলল, "নীলকমল।"

- অনেক গুণ ছিল লোকটার। দারুণ বাঁশি বাজাত। চেহারায় একটা নায়ক নায়ক ভাব ছিল-যাত্রা টাত্রাও করত বোধ হয়। তাই না পঙ্কজদা? খুব ভালো ম্যাজিক দেখাত, বুঝলে লিপি...  আমরা তখন স্কুলে, নীলকমলের বয়স কমই ছিল মনে হয় - যাই হোক, বস্তার মধ্যে পুরে, পাথর টাথর বেঁধে ওকে পুকুরে ফেলে দিত ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট- দু'মিনিটের মধ্যে উঠে আসত- সে কী হাততালি -

" হুডিনির খেলা? পি সি সরকারও দেখিয়েছেন তো" শান্তা ঘড়ি দেখল।

- আরে তিনি তো সেলেব। ঘ্যামা ব্যাপার। এ’ আমাদের পাড়ার জাদুকর- বস্তা, ইঁট, আর পাড়ার একটা ছেলে- স্রেফ এই নিয়ে রিস্কি খেলা দেখাত-

"এখন কী করে? সিরিয়াল?" শান্তা হাসির ভঙ্গি করেছিল।

- জানি না কী করে। আদৌ বেঁচে আছে কী না কে জানে। খুব অদ্ভুত ছিল লোকটা- মানে রহস্যময় টাইপ-  পিন্টুকে নিয়ে কী একটা কান্ড হয়েছিল। মনে আছে?

পঙ্কজ চুপ করে ছিল। উসখুস করল জল খেলো। এবারে উঠতে হবে- কতক্ষণ একলা আছে বনময়ূর। সুবিমল বকে যাচ্ছিল- কথায় পেয়েছে ওকে, "আরে তখন অনেক কথা শুনতাম। অত বুঝতাম না।  একদিন হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল- পুলিশ ধরেছিল নাকী-"

পঙ্কজ উঠে দাঁড়াল-" কদিন আগে সাহেবগলির কাছেই কোথাও একটা ব্লাস্ট হয়েছে। জানিস?

- সে কী গো!

- বোমা রাখা ছিল একটা গ্যারাজে-পার্টির ব্যাপার ট্যাপার হবে আর কী- কাল পরিতোষকে ফোন করেছিলাম-  বলল। দুজন স্পট ডেড। কাগজেও বেরিয়েছে দেখলাম।

- চেনা কেউ ?

-পরিতোষ বলল, চেনেনা। কাগজে খুব বেশি ডিটেলস নেই। লোক্যাল বাজারে সব্জী নিয়ে বসত একজন, আর একজন সম্ভবত ভবঘুরে-

একটা জন্মদিনের সন্ধ্যা যেভাবে শেষ হওয়ার কথা, মৃত্যু তাকে বদলে দিল।  দু'জন অচেনা মানুষ মারা গিয়েছে- কেউ কেউ তবু বিষণ্ণ হয়, আলতো আঙুল বোলায় নিজের গালে , ঘুমন্ত সন্তানের গায়ে চাদর টানে, কেউ চুপ করে যায়, জল খায়, গলা খাঁকরায়। সব অতিথি  ফিরে গেলে ক্লোজেট থেকে ভ্যাকুয়াম ক্লীনার বের করল লিপি- তারপর  সুইচ অন করে ফেয়ারি ডাস্টের শেষ কুচিটুকুও তুলে নিল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হেমন্ত-

 

কালীবাড়ির  ডানকোণের বাঁ হাতি রাস্তার অন্তত একশ ফুট নিচে তখন মাটি কাটছে চণ্ডী। অ্যাসেম্ব্লি শেষ - চণ্ডীর সামনে ফ্রন্ট শিল্ড, মিডল শিল্ড, কাটার হেড; পিছনের অংশে লম্বা ব্যাকাপ ইউনিটে ইরেকটর, স্ক্রু কনভেয়র ।  বিশাল ক্রেন  চণ্ডীকে স্টীল ক্রেডলের ওপর আস্তে আস্তে নামিয়ে দিয়েছিল। তারপর হাইড্রলিক সিলিন্ডার  তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 

সারদা সুইটসের সামনে রসগোল্লার রস দিয়ে কচুরি খাচ্ছিল প্রফুল্ল;  একটু আগে সুলভে গিয়ে হালকা হয়েছে, তারপর হাত মুখ ধুয়ে দোকানের সামনে এসে বসেছে; সকালের এই সময় গলির বাতাসে টক গন্ধের একটা সর পড়ে থাকে। বাজার যাওয়ার সময় লোকজন নাকে রুমাল দেয়, থুতু ফেলে। তারপর সুনীল এসে দোকানের শাটার তোলে, গোপাল দু'বালতি জল ঢালে রাস্তায়, হরি কচুরি ভাজার তেল গরম করে- তখন বাসি গন্ধের সর ছিঁড়ে যায়। সেই ফাঁক দিয়ে উনুনের ধোঁয়া ঢোকে, তার পিছনে সাইকেলে খবরের কাগজ, আর কাঁসি, বিলু, মোটকু সহ প্রফুল্ল। সুনীল একটা ভাঁড়ে বাসি রস আর কচুরি প্রফুল্লকে দিয়ে হাতজোড় করে রোজ , তারপর দোকানে ধূপ ঘুরিয়ে কাউন্টারে বসে।প্রফুল্ল প্রথম কচুরিটা চার টুকরো করে কাঁসি বিলু আর মোটকুকে দিয়ে  রসে চুমুক দেয়। আস্তে আস্তে দেড়শো দুশো বছরের পুরোনো ঘরদোরের ফাঁক ফোকর  দিয়ে তীক্ষ্ণ বর্শাফলকের মত রোদ ঢুকতে থাকে গলিতে। প্রফুল্ল পিঠ ফিরিয়ে বসে। তারপর বড়রাস্তার দিকে তাকায়- চায়ের দোকান ট্রাম লাইন পেরিয়ে কালীবাড়ি - চামর দুলিয়ে আরতি হচ্ছে; কাঁসি, ঘন্টার আওয়াজ ট্রামলাইন পেরিয়ে এই গলিতে ঢুকে পড়ে। সকাল হয়ে যায়। প্রফুল্ল কর্পোরেশনের কলে হাত ধুয়ে মন্দিরের দিকে হাঁটে- মা কালীকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে গেলে ইদানিং পেটের তলায় আলতো কাঁপন টের পায় প্রফুল্ল, শরীরের মধ্যে খুব একটা আরাম হয় তখন-ফুটপাথ ছেড়ে আর উঠতে ইচ্ছে করে না।

~*~

কালীমূর্তির পায়ের তলায় শিবের বদলে চণ্ডীর উপস্থিতি একটু আজব। আসলে এই অতিকায় টিবিএমকে চণ্ডী নাম দেওয়া হয়েছিল অন্য কারণে  - লিখতে লিখতে এইখানে  দম নিল সাহিল- এই সাইটের জুনিয়র এঞ্জিনিয়র; চা খেতে খেতে মোবাইলে টাইপ করছিল;  একটা উপন্যাস লেখার কথা ভাবে আজকাল -নোটস রাখে।

চণ্ডীর নাম টিবিএম এস৬১৫।  কাজ শুরুর আগে বোরিং মেশিনগুলোর একটা নাম দেওয়া হয় সাইটে-  ট্র্যাডিশনল রিচুয়াল। গল্পে আছে,  ঈশ্বর স্বয়ং বারবারা নামে একটি মেয়েকে লুকিয়ে রাখতে ভূগর্ভের মুখ খুলে  দিয়েছিলেন। ষোড়শ শতক থেকে তাই যে কোনো টানেলিং অপারেশনের আগে সেন্ট বারবারাকে স্মরণ করে কাজ শুরুর চল। বোরিং মেশিনের নাম রাখা হয় কোনো মহিলার নামে যিনি রক্ষা করবেন  মাটির তলার কর্মকাণ্ড, মানুষজন। আমাদের এই চণ্ডীকে দুর্গার অবতার ভাবাই যায়- কিন্তু গল্পটা অন্য। এই প্রজেক্টেই ছিলেন এক থাই এঞ্জিনিয়র- চাণ্ডী মুখন - মেশিনের নাম ওঁর নামে। মুখন এখন সন্ন্যাসী।

চায়ের কাপ রেখে মোবাইল পকেটে ঢোকালো সাহিল। পরের লাইন ভাবতে ভাবতেই হার্ড হ্যাট চাপালো মাথায়। সাহিলের  কাজ আপাতত  মাটির ওপরে। আর এ- বিল এর কাজটা দেখে ; স্কেডিউলিং ,  প্রগ্রেস ট্র্যাকিং করে তপনের সঙ্গে, আর অটোক্যাডে কিছু লে আউট ড্রয়িং পারমিন্দার বলছিল, সম্ভবত একটা শাফলিং হবে - সাহিলকে এরপর  সয়েল কোল্যাপসিংএর কিছু কাজ করতে হবে। সাহিল সাবস্ট্রাকচারে  কাজ করতে চাইছে দীর্ঘদিন- অন্যত্র সে এই কাজ করেছে ; এই যে অর্ধসমাপ্ত সুড়ঙ্গর পেটের মধ্যে ঢুকে পড়া, চারদিকে যান্ত্রিক সব শব্দ, বিবিধ ব্যাসার্ধের অজস্র পাইপ, কেবল,  ধাতব বস্তুর জটলা- তার মনে হত সে এক ভেঙে পড়া উড়োজাহাজের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, যেন  আশেপাশে অনেক কিছু হয়ে চলেছে এবং হবে অথচ  তার নিজের বেঁচে থাকা ব্যতীত আর কোনোদিকে খেয়াল নেই - সব আওয়াজ, সব আলো অন্ধকার পিণ্ড পাকিয়ে যেন তার আপন হৃদয়ের ধুকপুকে এসে দাঁড়িয়েছে।  মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে এই অনুভূতি অসম্ভব অথচ সে চাইছিল, এই সব কথা  তার লেখায় আসুক। পারমিন্দরের সঙ্গে সয়েল কোল্যাপসিংএর কাজটা নিয়ে কথা বলবে , ভাবছিল সাহিল।

এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বেরোনোর পরে ক্যাম্পাস থেকেই তার চাকরি হয়ে  গিয়েছিল কলকাতা থেকে দূরে। লেখালেখির উৎসাহ  তাকে ফিরিয়ে এনেছিল কলকাতায়। সারাদিনের কাজের শেষে, নিজের ছোটো ঘরে লেখা ' না;  সাহিল ক্রমশ বুঝেছিল , নির্জনতায় সে লিখতে পারবে না,  তার একটা শহর দরকার।  চাকরি ছেড়ে আচমকা কলকাতায় ফিরে আসা সাহিলের মা বাবা আত্মীয়কুল পছন্দ করে নি। কিন্তু সে লেখাকে পেয়ে যায়  এবং কঙ্কণাকে। এক বছরের মধ্যে এই চাকরি। কলকাতায় ফেরার পরে ছোটো গল্প, কবিতা লিখছিল সে অনায়াস। কঙ্কণার সঙ্গে তার প্রথম  শরীর হয়েছিল এক দুপুরে এবং সে আবিষ্কার করেছিল  তার প্রতিদিনের দেখা কঙ্কণার অভ্যন্তর থেকে যেন অন্য একটি মেয়ে বেরিয়ে আসছে। সে উত্তেজিত হচ্ছিল , কামার্ত হচ্ছিল; একই সঙ্গে কখনও মনে হচ্ছিল এই কঙ্কণা তার নিজের সৃষ্টি, পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল কঙ্কণা তাকে তৈরি করছে নতুন করে- কামের পরেই যে বোধ তাকে ক্রমশ অধিকার করে নিচ্ছিল  তাতে যুগপৎ মায়া আর বিস্ময় ছিল। বিস্ময় এই জন্য যে এই মেয়েটি যাকে সে চুমু খাচ্ছে , কোমর জড়িয়ে বিছানায় নিচ্ছে, যার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি আবিষ্কার করতে চাইছে সে , যাকে ঘিরে তার প্রবলতম কাম জাগছে  সেই মেয়েটির প্রতি সেই মুহূর্তে তার অন্য একটি অনুভূতি হচ্ছে যার নাম সে জানে না। কখনও মনে হয়েছে, কঙ্কণা ফ্রক পরা খুকী হয়ে যাক ওর চোখের সামনে, সাহিল তাকে কোলে করে চাঁদ দেখাক, আবার মনে হয়েছিল এই মেয়েটির সঙ্গে সে হেঁটে চলুক  বনপথ ধরে- কঙ্কণার হাতে তার হাত অথচ কোনো শারীরিক অনুভূতি নেই- শুধু কঙ্কণার কব্জির কাছে আলতো করে ছুঁয়ে থাকলে , নির্জন পথে মেয়েটির হৃদস্পন্দনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে আর ভয় হচ্ছে যেন এই শব্দ এক্ষুণি চাপা পড়ে যাবে অন্য শব্দে অথচ সে মেয়েটির হাত ধরে কোনো লোকালয়ে যেতে চাইছিল। বস্তুত যেন সে একই সঙ্গে নির্জনতা আর কোলাহলকে যাচ্ঞা করেছে। তার হতভম্ব লাগছিল।কঙ্কণাকে জাপটে ধরে সাহিল  শব্দ খুঁজেছিল তার নিজের এযাবৎ লেখা থেকে;  আতিপাঁতি করে খুঁজছিল সাহিল আর তার কবিতা, তার গল্প  তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিল বারবার।  কঙ্কণার শরীর থেকে নেমে যেতে যেতে সে বুঝেছিল তাকে শব্দ খুঁজে যেতে হবে।

~*~

মন্দিরের সামনের ফুটপাথে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত সেরে প্রফুল্ল দোকানে দোকানে খবরের কাগজ চাইছিল- রোদে বসে পড়বে।  কচুরি , রসগোল্লার রসে পেট ভরে থাকে অনেকক্ষণ। দুপুরে আর কিছু জোটে না।  তিনটে নাগাদ কাঁসি, বিলু খেতে যায় বড় রাস্তার দিকে। ওদের সঙ্গে গিয়ে বসে থাকলে এক গাল ভাত পেয়ে যায় প্রফুল্ল। কখনও বাসি রুটি। সন্ধ্যে হলে মন্দিরের সামনের ফুটপাথে পড়ে  থাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতের ভঙ্গিতে - ভক্তরা আসে, ঘন্টা বাজায়, মূর্তি প্রণাম করে দক্ষিণার বাক্সে আর প্রফুল্লকে দু' পাঁচ টাকা দেয়।  পেট পেতে পড়ে থাকতে থাকতে মনে হয়  মাটির তলার কাঁপুনি ওর পেটে একটা বিরাট খোঁদল তৈরি করছে -যেন বিরাট এক হাঁ যেখানে সব ঢুকে যেতে পারে সব কিছু- এই দোকান বাজার, বাড়ি ঘর, কাঁসি, পটল, সুনীল, মা কালী - সব,  সব।  প্রফুল্ল ধড়মড় করে উঠে আলো জ্বলা বাড়ি খুঁজে বেড়ায় তখন।  আগে, 'অঞ্চলে ব্যান্ডপার্টির চল ছিল-  সে' দলের পিছন পিছন চলে যেতে পারলেই টুনি বাল্বের জ্বলা নেবা আর লুচির গন্ধ। গেটের পাশে ঘাপটি মেরে থাকলেই মাংসের ঝোল ভাত একদম গ্যারান্টিড। সুনীলের দোকানের উল্টোদিকেই একটা ব্যান্ড ছিল- জয় মা ব্যান্ড। দোকানের ফুটপাথের ওপর লাল কোট রোদে দিলেই প্রফুল্ল বুঝে যেত আজ মাংস ভাতের দিন তারপর পিছু নিত।মেরে ইয়ার কে  শাদি হ্যায়’ গুনগুন করতে করতে পাড়ায় ফিরত ভর পেটে।

আজ কাগজে একটা বিয়ের খবর খুঁটিয়ে পড়ছিল প্রফুল্ল। কী সুন্দর বর বৌ। ফিল্মস্টার। ইতালিতে নদীর ধারে বিয়ে করছে।  সুন্দর একটা নৌকোয় চড়েছে বর বৌ। তারপর বর নামছে, বরের হাত ধরে লাল শাড়ি পরা বৌ। বরটা হাসছে হা হা করে। চাপ দাড়ি, শাদা শাদা দাঁত।  টুপি মাথায় যে ছেলেটা চা খেতে আসে রোজ -তার  কথা মনে হল প্রফুল্লর। চা খায়, ফোন নিয়ে খুটখাট করে; সন্ধ্যার দিকে একটা মেয়ের সঙ্গে ওকে  রোজ হাঁটতে দেখে প্রফুল্ল।  এই ফিল্মস্টার বৌটা কী সুন্দর ঘোমটা দেওয়া। হাতে মেহন্দি। ওদের বিয়েতে কী খাইয়েছে - খুঁজছিল প্রফুল্ল।

~*~

লোকে বলে, চান্ডী মুখন জাদু জানত-এসপ্ল্যানেড শিয়ালদা টানেল খোঁড়া চলছে- টিবিএম আটকে গিয়েছিল মাটির তলায়- কিছুতেই চালানো যায় না। এঞ্জিনিয়াররা প্রচুর চেষ্টা করল তারপর চান্ডী মুখন এল। মাটির নিচে ঠিক যেইখানে বোরিং মেশিন আটকে রয়েছে, চান্ডী এসে দাঁড়াল সেইখানে-টানেলের ওপর; চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল প্রস্তরবৎ, হাত জোড় করে। কিছুক্ষণ পরে  যেই বলল- নাউ স্টার্ট দ্য মেশিন, আবার চলতে শুরু করল ইবিএম।  দিল্লিতে লাজপতনগরের মেট্রো টানেল খোঁড়ার সময়ও তাই- আটকে গিয়েছিল মেশিন। একটা মুরগি ধরে গলা কাটল চান্ডী, রক্ত ছড়াল মাটিতে, বিড়বিড় করেছিল কী সব  মন্ত্র- অমনি আবার ঘুরতে শুরু করল কাটার হেড- এগোতে শুরু করল বোরিং মেশিন।চান্ডী টীমে থাকবে না বেশিদিন- সবাই জানত। কোন ফকিরকে ওর কথা দেওয়া ছিল চান্ডী মা অসুস্থ যখন , কোনো এক দরবেশের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল ; বলেছিল- মা কে ভালো করে দাও, আর কুড়ি বছর পরে সব ছেড়ে দেব। কথা রেখেছিল। প্রজেক্ট ম্যানেজারের চাকরি, স্ত্রী, কন্যা , সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে গেল।

চায়ের দোকানে কঙ্কণার পাশে বসে একটানা পড়ে যাচ্ছিল সাহিল থেমে গিয়ে লাজুক হাসল তারপর- " এডিট করে ব্লগে দেব।"

-চাকরি ছেড়ে দাও। লেখায় কনসেন্ট্রেট করো।  সারাজীবন ব্লগ লিখবে নাকি?

- পুরোনো দিনের নায়িকার মত কথা বলছ। চাকরি ছেড়ে দিলে চলবে?

- লেখা নিয়ে সিরিয়াস হলে চাকরি ছাড়তে হবে। এই যেমন ধরো-

- থাক থাক- কী কী নাম নেবে জানি। ওঁদের সঙ্গে আমার তুলনা?

- চান্ডী মুখনের নাম তো নিতে পারি।

-তা পারো। শোনো, একটা হেল্প লাগবে। তুমি কোনো জাদুকরকে চেনো?

-এটা কী তোমার উপন্যাসের লাইন না কি সিরিয়াসলি বলছ? কখন যে উপন্যাসে থাকছ  আর কখন যে তার বাইরে  বেরোচ্ছো-

- দূর, শুরুই ' না উপন্যাস! আরে বাবা, সিরিয়াস কথা। একজন জাদুকরের ইন্টারভিউ নেব।

- জাদুকর না জাদুকরী?

-ম্যাজিক জানলেই হবে- লেখার জন্য লাগবে।

- তো সোজা ব্যাপার।  পি সি সরকারকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নাও

- সে ইন্টারভিউ তো পুরোনো ম্যাগাজিন, ইভন নেটেই পাবো; ওরকম নয়; বিখ্যাত  কাউকে চাই না - মানে ধরো, এই সব নিয়ে চর্চা করে, বিখ্যাত নয়, হতে চায় না, মানে যশের লোভ নেই আর কী,  কেন ম্যাজিক দেখায় সে নিয়ে নিজস্ব একটা দর্শন আছে-

- সে তো কঠিন ব্যাপার। সেই রকম জাদুকর বা জাদুকরীর কথা কেই বা জানবে?

-কেউ না কেউ জানবে শিওর, আমার কাজ তাকে খোঁজা-

-সেও কঠিন। দাঁড়াও দাঁড়াও-

-কী?

- আছেন একজন। ম্যাজিকের ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন, কাগজে আর্টিকল দেখেছি। কাল ইউনি গিয়ে প্রণতিদিকে জিগ্যেস করব।

~*~

সেই সময় বড় রাস্তার শেষে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। চোখে রোদ পড়ছিল প্রফুল্লর। রুটের বাস, অটো, ট্যাক্সি তে আলো রিফ্লেক্ট করছিল এত যে রোদে রোদে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল যাবতীয় যানবাহন, রাস্তাঘাট, ঘরদোর। যেন সূর্য গিলে খাচ্ছিল  সব- এত খিদে রোদের। প্রফুল্ল মন্দিরের ফুটপাথে ইঁটের টুকরো দিয়ে কালীঠাকুর আঁকলো বড় করে -ইয়া লম্বা জিভ আঁকলো, টুপ টুপ করে জিভের জল পড়ছে - তাও আঁকল- তারপর কালীর জিভের কাছে প্রণিপাত করতে করতে মাটির তলার কাঁপুনি আবার টের পেল এই পথ বেয়ে একদিন একটা জাহাজ আসবে গলিতে- প্রফুল্লর মনে হচ্ছিল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

হেমন্ত-৪

 

ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে রাস্তায় বেরোল স্মিতা- চা খাবে। জেম্মা একই রকম- ঘোরের মধ্যে যেন।  স্মিতা রোজই কানের কাছে মুখ নিয়ে জেম্মাকে ডাকে, একাধিকবার। আজ একবার উঁ বলে সাড়া দিল; তারপর আবার যেন ঘুমোচ্ছে। নড়া চড়া নেই- ধীরে নিঃশ্বাস বইছে শুধু। ডাক্তারবাবুর রাউন্ডে আসার কথা ঘন্টা দুয়েক বাদে- কথা বলতে হবে। চা খেয়ে অপেক্ষা করবে স্মিতা। শনি রবিবারে, বাবলুদা, বৌদি, ঝিমলি, মেজোপিসি কেউ না কেউ আসেই ভিজিটিং আওয়ারে। পল্টনরা  কালীপুজোর সময় দিল্লী গিয়েছিল- ফেরেনি এখনও। ঝিমলিরাও কোথায় যেন বেড়াতে যাবে বলছিল। আজ বুধবার, স্মিতা একাই জেম্মার পাশে বসেছিল সারাক্ষণ। কাচ দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নামতে স্মিতার আরাম লাগছিল - এতক্ষণের এসির হিমঠান্ডার পরে ঈষৎ আর্দ্র উষ্ণতা পাতলা কাঁথার মত- ছাড়তে ইচ্ছে করে না। এই সময় কে যেন ডাকল ওর নাম ধরে।

কোন কোন দিন এমন হয়। হয়তো স্মিতা শাওয়ারের তলায় তখন। জল পড়ছে। কেউ যেন ডাকল স্মিতার  নাম ধরে। চেনা গলা- অথচ মনে পড়ে না নাম। সে নিজে ঠিক যে কোথায়- গুলিয়ে যেত তার।  বাষ্পে ভরা ঘর, জানলা, আয়না। শাওয়ার কার্টেন, দরজার নব হাতড়ে  হাতড়ে কোনো ক্রমে বেরিয়ে আসত সে। ভেজা আঙুলে ফোনের স্ক্রীনে মিসড কল খুঁজত। তারপর নিজেই ফোন করত একে তাকে। কিম্বা হয়ত এমন হয়েছে,  রাতের দিকে  ট্র্যাশ ফেলছে সে; কাচের ওপর কাচে শব্দ উঠে জাস্ট মিলিয়ে গিয়েছে আর স্মিতার মনে হয়েছে, কে যেন ডাকল -তারপর লম্বা একটা গাছ দেখেছে- রাতের আকাশের রঙের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে। মরা চাঁদের ওপর মেঘ ভেসে যেতে দেখেছে তারপর। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে ফোন করেছে  -" পায়েল, জেম্মা ভালো আছে? কথা বলতে পারবে? একটু দে।" আসলে তখন ওর ছোটোবেলার কথা মনে পড়ত। মা, বাবা, জেঠু, জেম্মা, বাড়ি, পেয়ারাগাছ আর বাড়ির পিছনের পুকুর, যেখানে জলের তলায় সে আর এক শহর দেখেছিল।

স্মিতাদের বাড়ির পিছনে অনেকটা ঘাসজমি -তাতে নিমগাছ, পেয়ারাগাছ , টগর, বকুল, জবা, কলাবতীর ঝাড়, বুগেনভিলিয়ার অগোছালো বাগান, সে বাগান পেরিয়ে  পুরোনো পুকুর, বাঁধানো ঘাট। বুল্টুকাকুর বিয়ের সকালে ঘুম ভেঙে সে পুকুরের দিকে গিয়েছিল সুষমা পিসির সঙ্গে। জলভরা শেষ করে ঘাটের  সিঁড়ি ভেঙে বাগানের পথ ধরেছিল বাকিরা, সেই সময় কেউ ডেকেছিল  তাকে। স্মিতা পিছন ফিরেছিল, অন্যমনস্ক পিসির হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়েছিল পুকুরের দিকে।  হলফ করে স্মিতা বলতে পারে, সে দেখেছিল  জলতল যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই আর একটা শহর  মাথা নিচু করে ঝুলে আছে-একটা গোটা শহর যেন পুকুরের তলায় ঢুকে পড়েছে। সে' শহরে পাহাড় আর পাহাড়, তার  গায়ে ছোটো ছোটো বাড়ি,  চার্চ, ঘোড়সওয়ারের মূর্তি; জলের তলার শহরে তখন রাত, চাঁদ দেখা যাচ্ছিল। আরও ভালো করে  দেখবে বলে স্মিতা  মাথা ঠেকিয়ে  দিয়েছিল জলের ওপর। কানে, চোখে নাকে টের পাচ্ছিল কনকনে ঠান্ডা জল- তখনই সুষমাপিসি ঝপ করে স্মিতাকে  কোলে তুলে নিয়ে চিল চীৎকার-"কী করছিলি এখানে?"  স্মিতা এক ঝলক তাকিয়ে দেখে নিয়েছিল, পুকুরের ওপর আবার কুয়াশা - যেন একটা দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

বিয়ের পর, বাপের বাড়ির পুকুরের নিচে অচেনা শহরের স্মৃতি তীব্র হয়ে ফিরে এসেছিল। তার নতুন বরকে পুকুরের মত মনে হয়েছিল স্মিতার - যেন সে যাকে বিয়ে করেছে তার  অভ্যন্তরে আর এক মানুষ উল্টো হয়ে ঝুলে আছে, আর পঙ্কজ সেই উল্টো মানুষকে সযত্নে আড়াল করছে স্মিতার থেকে। এই আড়াল করার বেদনা যেন একটা বিবর্ণ মশারির মত গুটিয়ে ঝুলে থাকছে ওদের দুজনের ওপর , তারপর ভার বইতে না পেরে একদিন সটান নেমে আসছে  - ক্রমে এই বসবাসেই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে দুজন। 

এই হেমন্তের সন্ধ্যায় হাসপাতালের সামনের ফুটপাথে  সেই কুয়াশা তাকে আবার ঘিরে ধরেছিল- যা তাকে এই 'বছরে বারে বারে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে তার শৈশবে আর সে কখনও মা, কখনও বাবা , কখনও জেম্মার সঙ্গে কথা বলেছে ফোনে।  আজ সে' উপায় ছিল না- তার শৈশবের শেষ যোগসূত্র এই হাসপাতালের চারতলার ঘরে নাকে মুখে নল নিয়ে শুয়ে ;  হাসপাতালের কাচ দরজা খুলছিল, বন্ধ হচ্ছিল;  নীল আলো জ্বালিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামছিল পরপর। হিম নামছিল ফুটপাথে। সেই হিমের সঙ্গে হাসপাতালের চারতলা থেকে কুয়াশার মত মৃত্যুর ছায়া এসে মিশছিল যেন।

রাস্তা পেরিয়ে চায়ের দোকান। স্ট্রীটলাইটের আলো পিচরাস্তায় রিফ্লেক্ট করছিল। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে স্মিতা সময় দেখল;  তারপর পঙ্কজের সময় হিসেব করে,  যখন মোবাইল ঢুকিয়ে  নিতে চাইছিল ব্যাগে-  হাতের রুমাল, মোবাইল দুইই পিছলে গেল ফুটপাথে; নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিতে গিয়ে স্মিতা পিঁপড়ে দেখতে পেল - ছোটো কালো এক বিন্দু হেঁটে  আসছে ফুটপাথের ওপরে সিগারেটের খালি প্যাকেট, তোবড়ানো কোকের ক্যান, চকোলেটের র‍্যাপার - সে সব পেরিয়ে পিঁপড়ে আসছিল।  এক মোচড়ানো স্ট্রয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়েছিল। তারপর সামান্য থেমে শুঁড় বুলিয়ে  নিয়েছিল ফুটপাথের শানে, শুঁড় উঁচু করেছিল। স্মিতার মনে হল, যেন গ্রীট করল তাকে তারপর পাশ কাটাল

ফুটপাথ ঘেঁষে হাইড্র্যান্ট- ধাতবজালের ঝাঁঝরি। পিঁপড়ে হেঁটে গেল-যেন সার্কাসের রোপ ওয়াকিং সামান্য হাওয়া উঠেছিল হঠাৎ।  অথচ সে এঁটে রইল লোহার জালে। শুঁড় বুলিয়ে পরখ করে নিল সামনের পথ। এগোলো আবার। এই সময় ট্র্যাফিক সিগনাল গ্রীন হয়েছিল। আপ ডাউনের সমস্ত  গাড়ি স্পীড তুলেছিল  একসঙ্গে হাওয়ার দমকে উড়ে পিঁপড়ে উড়ে এসে পড়েছিল ফুটপাথে পড়েই ছিল খানিকক্ষণ। স্মিতা অবাক হয়ে দেখল, আবার সে শুঁড় বোলাচ্ছে  বাঁধানো  ফুটপাথে , আবার পেরোচ্ছে  লোহার জাল - সন্তর্পণে। রাস্তায় নামল পিঁপড়ে, আবার। রেড সিগনালে সেই মুহূর্তে  পথ ট্র্যাফিকহীন। স্মিতা লক্ষ্য করে পিঁপড়ে এগোচ্ছে। এইসময়  সিগনালের আলো বদলায়- অবশ্যম্ভাবী। স্মিতা দেখে,  গাড়ীর চাকা, একের পর এক , বিরামহীন। ধূসর অ্যাসফল্ট। একটি কালো বিন্দু ওকে নাম ধরে ডাকে। ট্রাফিকের স্রোত ওকে টানে   সিগনাল তখনও সবুজ- স্মিতা  পা রাখল রাস্তায় তারপর সরিয়ে নিল।  ওর মনে হয়েছিল, ওকে আপের পথে হাঁটতে হবে আরো অনেকদিন। ফুটব্রিজ দিয়ে রাস্তা পেরোল স্মিতা। দোকানের বেঞ্চে বসে আদা চা চাইল।

~*~

কয়েক পশলা বৃষ্টির ফোরকাস্ট ছিল। অথচ  আকাশ পরিষ্কার - তারায় তারায় ভরে আছে এখন সন্ধ্যার পরে এই রকম সময় একলা মানুষজন আকাশের দিকে তাকায়, তারা দেখে, সামান্য অন্যমনস্ক হয়। তারপর হোঁচট খেলে,  রাস্তায়  চোখ নামিয়ে ঘরবাড়ির দিকে হাঁটে।  রাস্তার ওপর পড়ে থাকা নুড়ি, ইটের টুকরো সরিয়ে দেয় যত্ন করে। অফিসের পরে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সনৎ তারাদের কথা ভাবছিল। ছোটোবেলায় সব বাচ্চাকেই মা বলে থাকে, মানুষ মরে গেলে তারা হয়। সনতের মাও বলেছিল তারপর স্টোভ ফেটে নিজেই স্টার  হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত লিটল স্টার ; সনতের মনে হত- ওর রোগা ছোট্টো মা- সে কী করে জায়ান্ট স্টার হবে? রাতের আকাশে মা কে খুঁজতে খুঁজতে নিতান্ত শৈশবেই সনৎএর মগজের ভিতর গ্রহ তারা সেঁধিয়ে গিয়েছিল, মস্তিষ্কের  শিরা ধমনী ফুঁড়ে দিয়ে রক্তে মিশে গিয়েছিল একদম- 

সনৎএর মাথার ওপর দুশো বিলিয়ন তারা থাকা উচিত এখন- যদিও, এই মুহূর্তে মা'কে খুঁজছিল না সনৎ;  আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বিশাল বিশাল হাইড্রোজেনের মেঘ কল্পনা করছিল - লাল বেনারসী, কনে চন্দন পরা হাইড্রোজেনের মেঘ একের পর এক অরিয়ন কমপ্লেক্স ফর্ম করছে। কী বিশাল কী বিশাল - সনৎকে  যেন টেনে নিচ্ছিল তাদের দিকে- জুতোর নিচে পাড়ার রাস্তাকে ফীল করছিল না সনৎ, মাথা টলটল করছিল  তার। সে ঘাড় নামাল।  কাঁধ থেকে কাঁধ করল অফিসের ব্যাগ।  

পুকুরের পাশের বাড়িটার দোতলার জানলা আজও বন্ধ। গোটা বাড়ি ঝিম মেরে পড়ে আছে। অনেকখানি অন্ধকার মাড়িয়ে  বাড়ি ঢুকল সনৎ।  কদিন আগেও 'বাড়ির জানলা খোলা ছিল। আলো জ্বালা ছিল ঘরে। সনৎএর ঘরদোরে আজ গরম রুটির গন্ধ। তার মানে মন্টুর মা এই সবে রান্না সেরে বেরিয়েছে। ঢকঢক করে জল খেল সনৎ তারপর শোয়ার ঘরে ডেস্কটপ অন করল   ইসরোর সাইটে  লঞ্চিংএর নতুন ডেট কী দিয়েছে দেখতে হবে- মোবাইল থেকে খোলা যাচ্ছিল না।  আজই অফিসে তন্ময়ের সঙ্গে এই সব নিয়ে তর্ক তন্ময় বলছিল, “যত ভাঁওতাবাজি, প্রজ্ঞান না অজ্ঞান। সনৎ কমার্সের ছাত্র। কিন্তু ইসরোর সাইট মুখস্ত করে উগরে দিচ্ছিল অফিসে। তন্ময় হাসছিল-" শালা, তুই যেন কী। যেন তোর মেয়ের বিয়ে" বলেই চুপ করে গিয়েছিল।

সনৎ প্লাগের ওপর দুবার হাত দিয়ে চাপ দিল- স্লাইট লুজ ছিল কানেকশন;  এবার সুইচ টিপলে, গোঁ গোঁ করে সিপিউ তে সবুজ আলো জ্বলল   সনৎ ডেস্কটপের ঢাকনা খুলল যত্ন করে। ল্যাপটপ  কিনতে হবে। ডেস্কটপটা কোনোরকম জোড়াতাপ্পি দিয়ে চলছে, এবার খারাপ  হলে আর সারানো যাবে না। তিনবারের চেষ্টায় ডেস্কটপ চালু হলে ইউটিউবের সাবস্ক্রাইবড চ্যানেলের নোটিফিকেশন আসছিল টুং টাং করে- সনৎ সটান ইউ টিউবে গেল। নাসার চ্যানেলে হাবল টেলিস্কোপের ওপর ডকুমেন্টারি চালু করে ফ্যানের সুইচ অন করল - ঘাম শুকিয়ে নিয়ে বন্ধ করে দেবে;  শীত আসছে শহরে- ভোর রাতে হিম পড়ছে আজ 'দিন। সে শার্ট প্যান্ট বেল্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ল। পাজামা গেঞ্জি গলাতে গলাতে ডকুমেন্টারি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওর  অন্ধকার ঘরে টেবিলের ওপর রাখা মনিটর এখন বেগুনী আলো ছড়াচ্ছে-  স্ক্রীনের ওপর নীল সাদা হলুদ লাল সবুজ রঙের অজস্র শিরা উপশিরা শঙ্কুর  মত প্যাঁচ খেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে, সেখানে চোখের মণির মত সুগোল বৃত্ত-  কখনও সমুদ্রের ঢেউএর মত লাগছিল, কখনও মনে হচ্ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার রেঞ্জের টপ ভিউ-  সনৎ জিভ চাটল। খরখরে দাড়িতে হাত বোলালো। বিড়বিড় করে বলল , থার্টিটু মিলিয়ন লাইটইয়ারস। থার্টিটু মিলিয়ন। ওর শরীর কাঁপছিল।  নিজের নাভিতে তর্জনী ঠেকালো সনৎ, হাতের চেটো বুলিয়ে নিল আলতো করে, যেন এম সেভেন্টি ফোরের গ্র্যান্ড স্পাইরালকে ছুঁচ্ছে এইভাবে নখ বসাল গভীরে তারপর পাজামা নামাল। রক্তে ঘুরে বেড়ানো গ্রহ তারাদের ছুঁয়ে ফেলছিল সনৎএর আঙুল।  কুইপার বেল্ট পেরিয়ে ওর্ট ক্লাউড। যেন মহাজাগতিক ধুলোকণা হিমের মত ওর আঙুল বেয়ে নামছে।

খালি গা,  ভেজা পাজামায় ডকুমেন্টারির বাকিটুকু দেখছিল সনৎ- দেখছিল এনজিসি  ইলেভেন থার্টি টু - থ্রীটুয়েন্টি মিলিয়ন লাইট ইয়ার্স দূরে, দেখছিল কেমন করে গ্যালাক্সি মিশে যাচ্ছে আর এক গ্যালাক্সিতে, দেখছিল বিশাল আলোকময় সেতু, দেখছিল সহস্র তারার নদী, দেখছিল আবছা কচি কচি আকর্ষর আঙুল- মহাজাগতিক ধুলোর তৈরি- এই আছে, এই নেই।

~*~

পুকুরের পাশের হলুদ বাড়ির দোতলার জানলায়  তখন আলো জ্বলছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরে জানলা খুলছিল স্মিতা। পাশের বাড়ির অন্ধকার ঘরে নীল বেগুণী গোলাপী হলুদ আলো - প্রথমে টুনি বাল্বের মত  লাগছিল স্মিতার, তারপর দেখল, সেই আলোর তরঙ্গ যেন রঙীন সুতোর মত জানলা পেরিয়ে বাইরে আসছে আর রাতের ঘন আলকাতরার মত অন্ধকার ক্রমশ তরল হয়ে আকাশ বেয়ে গড়িয়ে নামছে। জানলা  বন্ধ করল স্মিতা।বৃষ্টি নেমেছে। যেমন কথা ছিল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শীত-

 

মিঠুর পরের ক্লাস ঘন্টা দুয়েক পরে -সেকন্ড ইয়ারের প্র্যাকটিকাল; শেষ হতে সন্ধ্যা হবে। দুপুরে খাওয়ার  জন্য বাড়ি থেকে স্যান্ডউইচ এনেছিল- আলুসেদ্ধ, শশা টশা দিয়ে ছন্দাই বানিয়ে দিয়েছিল সকালে-  কলেজে ঢুকেই টিফিন বাক্স খুলে  বার কয়েক গন্ধ শুঁকেছে মিঠু- লংকা মেশানো আলুসেদ্ধর গন্ধ, পুরোনো টোস্টারে স্যাঁকা পাঁউরুটির হাল্কা বাসে মুখ ভরে জল এসেছে, তারপর ফার্স্ট পিরিয়ডের পরেই এক ফাঁকে খেয়ে নিয়েছে। এখন খিদে নাছোড়বান্দা- জল খেয়ে খেয়ে পেট ভরাতে পারছিল না মিঠু। স্টাফরুমে  কৌটো খুলে বসেছে বাকিরা- ভাত, রুটি, আলুর তরকারি, বাটার চিকেনের গন্ধে  ভরে আছে ঘর।  "কী, আজ খাবেন না? উপোস টুপোস নাকি?" ফচকে দিব্যেন্দু  ওর পাশে ভাত নিয়ে বসল।  মিঠু আড়চোখে দেখল, ভাত, আলুভাজা,  ঢ্যাঁড়স- টমেটোর  শুকনো তরকারি, নধর কাঁচালংকা।   বোতল থেকে জল গলায় ঢেলে মাথা নেড়ে হাসল- যার মানে হ্যাঁও নয়, নাও হয়- তারপর খাতা দেখায় নিবিষ্ট হল। দিব্যেন্দু কথা না বাড়িয়ে এক গাল ভাত মুখে কাঁচা লংকায় কামড় দিল।

মুখভরা জল গিলতে গিলতে মিঠুর আতঙ্ক হচ্ছিল- প্র্যাকটিকাল শেষ 'তে  কম করে ছ’টা, তারপর আরো একঘন্টা পর বাড়ি- মানে আরো ঘন্টা। ডক্টর দাসের কথা মত টিফিনে ভাত না এনে  স্যান্ডউইচ আনছে - এতে পেট ভরে না অবভিয়াসলি। ঘন ঘন খিদে পায় বলে ব্যাগে, কলেজের লকারে বিস্কুটের প্যাকেট রেখে দেয়। আজ ব্যাগ হাতড়ালো, ড্রয়ার ঘাঁটলো- গত সপ্তাহে সব ফুরিয়ে গেছে।  তাড়াহুড়ো করে স্যান্ডউইচ না খেলেই হত। ওর ফার্স্ট পিরিয়ডে  ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল- যেন পিছিয়ে সেই সময়টায় যেতে পারলে, মিঠু এবারে বাক্স খুলবে, গন্ধ শুঁকবে, তারপর বাক্স বন্ধ করে রেখে দেবে। কী করে এতক্ষণ না খেয়ে থাকবে- ওর শরীরের মধ্যে একটা শূন্যতার জন্ম হচ্ছিল ক্রমশ। দপদপ করছিল কপালের রগ।  জাস্ট একটুখানি আলুভাজা, কাঁচা লংকা , এক মুঠো ভাত - চাইবে দিব্যেন্দুর কাছে? মিথ্যে বললেই হবে। বললেই হবে- টিফিন আনি নি।

দিব্যেন্দুর খাওয়ার ভঙ্গি মিঠুকে মরিয়া করে তুলছিল ক্রমশ। মিথ্যে বলার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠতেই বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে মাথায় জল দিল মিঠু তারপর স্টাফ রুমে এসে পার্স নিল। দিব্যেন্দুকে বলল, "একটু বেরোচ্ছি, বুঝলেন। মা ওষুধ কিনতে হবে, ভুলেই গিয়েছিলাম"

- এখন আবার বেরোবেন? ফেরার সময় কিনে নেবেন না হয়

-এত ভীড় হয় সন্ধ্যার দিকে- এখনই ঘুরে আসি।

কলেজের উল্টোদিকের ফুটপাথে ফুচকা, আইসক্রীম, রোল, চাউমিন- ছেলেমেয়েরা ভীড় করে আছে। মিঠু সানগ্লাস পরে ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়ল। ভীড়ের পাশ কাটিয়ে পাশের গলিতে ঢুকে আবার বড় রাস্তায় এল- এখানে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ, রাতের দিকে বেশ ভীড় হয়; ছাত্রছাত্রীরা এখানে আসবে না- মিঠু কাচদরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই সয়া সস, পেঁয়াজ, চিলি সসের গন্ধ ওকে ঘিরে ধরল। দেখল,  আধো অন্ধকারে লাল দেওয়াল ঘেঁষে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলায় , সামনের কাউন্টারে বেঁটে বাঁশের টব,  লাফিং বুদ্ধ, গদিমোড়া চেয়ার টেবিলে ইতস্তত দুচারজন, একজস্ট ফ্যান চলার আওয়াজ আসছিল একটানা;  মিঠু হাঁসফাঁস করে দোতলার ছোটো টেবিলে বসে মেনুকার্ডের পাতা ওল্টাল।

খাবার আসতে দেরি হচ্ছিল।  প্র্যাকটিকাল ক্লাসের সময় হয়ে আসছে। মিঠুর তীব্র খিদে ক্রমশ মরে আসছিল। কিছু আগের মিথ্যে বলা, ভাত চাইবার বাসনা নিজেরই অলীক লাগছিল- সে যেন খিদের তাড়নায় অন্য কোনো মিঠু হয়ে গিয়েছিল । এই মিঠুকে প্রথমে নিদারুণ অপছন্দ হল তার; ফলত সে দ্বিতীয় মিঠুকে অস্বীকার করল সটান। তারপর নজর দিল টেবিলে-  ছোটো শিশিতে আচার, ভিনিগারে ভেজানো লংকা, গোল পেঁয়াজ। মিঠু একটা পেঁয়াজ মুখে দিয়ে মোবাইল অন করল- বলাইকে রিক্শা নিয়ে সাতটা নাগাদ বাসস্টপে থাকতে বলবে।

ফোন করা ছাড়া আর কোনো কাজে  মিঠুর মোবাইল ব্যবহারের দরকার হয় না- ওর কোনো স্মার্ট ফোন নেই। প্রয়োজনে কথা বলে নিয়ে আবার অফ করে রাখে ফোন। আজ বলাইয়ের ফোন বেজে যাচ্ছিল।  মিঠু অধৈর্য হয়ে উঠছিল, কপালের রগে আঙুল রাখছিল ঘন ঘন;  এই সময় কিচেনের সুইং ডোর খুলে গেল- মেরুন বন্ধ-গলা কোটের ওয়েটারের হাতে ট্রে-  সাদা চীনামাটির বাসন থেকে উত্থিত বাষ্প চোখে পড়ল,  ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেনের বাস এলো নাকে- শান্ত হয়ে গেল মিঠু।  ক্ষুদে ক্ষুদে মসৃণ ভাতের দানা, তেল জবজব করছে- তাতে কুচি কুচি সবুজ কমলা লাল হলুদ রঙেরা,  বাটিতে চিলি চিকেন-  গরগরে রাঁধা। একটু আগে যে দ্বিতীয় মিঠুকে সে অস্বীকার করেছিল, তাকে সে ফিরিয়ে আনল প্লেটের সামনে; ফোন অফ করে খাওয়া শুরু করল।  দ্রুত খাচ্ছিল মিঠু, বাটি থেকে চিকেনের শেষ পিস প্লেটে তুলে মনে হল -বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল খাওয়ার সময়টুকু।  এই আলো আঁধারি, চিনে খাবারের গন্ধ, লাল রেক্সিনের পুরু গদি- ছাত্রদের কোলাহল নেই, মা' চিৎকার নেই, সনৎএর এখানে আসার সম্ভাবনাও নেই - তার আরো খানিকটা সময় থেকে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল;  হাত তুলে একটা ভ্যানিলা আইস্ক্রীম আর থামস আপ চাইল।

প্র্যাকটিকাল ক্লাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোমর ধরে  গিয়েছিল মিঠুর - তার ওপর ঝুঁকে স্লাইড চেক করা। ঢেকুর উঠল বার কয়েক। ফেরার সময় বাসের জন্য দাঁড়াতেও হল অনেকক্ষণ- সি নিয়ে মিছিল বেরিয়েছে আজ শহরে। রাত আটটায় রিকসা স্ট্যান্ড শুনশান। গলিতে ঢোকার মুখে এখনও একটা ব্যারিকেড- দু তিনজন পুলিশ টহল দিচ্ছিল।  রাস্তার ওপরে  বিয়েবাড়ির সামনে  বাঁশের গেটে কমলা হলুদ কাপড় লাগাচ্ছে ডেকরেটারের লোক। প্যান্ডেলের কাপড় থেকে গন্ধ আসছিল- সানাই, রজনীগন্ধা, নিমন্ত্রিতের পারফিউম মিলিয়ে মগজে গেঁথে থাকা টিপিকাল বিয়েবাড়ির গন্ধ- আচমকা কান্না এল মিঠুর। উল্টো রুটের  দু তিনটে ফাঁকা অটো হুস হুস করে  বেরিয়ে গেল এই সময়। চতুর্থকে থামিয়ে একসট্রা টাকা দেব বলে চড়ে বসল সে -গা গোলাচ্ছে।  পাড়ার পার্কে  লাউডস্পীকার লাগিয়ে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার পুরস্কার ঘোষণা চলছিল। দুমদাম পটকা ফাটল - ইন্ডিয়ার খেলা আছে বোধ হয় ।  শশীবাবুর সংসারে আলো জ্বলছে প্রতি ঘরে, লালু আর বিউটি অটোর পিছনে দৌড়োচ্ছে। গেট খুলে সিঁড়ি টপকে টপকে  বারান্দায় উঠছে মিঠু। তারপর বেল বাজাচ্ছে। দরজা খুলেই গলা চড়াল ছন্দা।

-ফোন অফ করে রাখিস কেন? কতবার চেষ্টা করলাম। তারপর মালবীর নম্বর খুঁজে বের করে ফোন করলাম। বলল, তোর প্র্যাকটিকাল ক্লাস চলছে। বলে নি কিছু তোকে ?

- কী বলবে? কী হয়েছে কী? সনৎ এসেছিল ?

- সারাক্ষণ বসে বসে সনৎএর কথা ভাবিস? আশ্চর্য!! না সে আসে নি। পুলিশ এসেছিল। তোর মামুকে জেরা করল।

-মামুকে!  কেন?

- মাণিকের মোবাইলে নাকি মামুর অনেকগুলো কল গেছে 'দিনে!

-মামু কোথায়?

-বেরিয়েছে। হাঁটতে গেছে। তোকে কতবার ফোন করলাম- সুইচড অফ সুইচড অফ বলল সমানে।

-বললে তো একবার। সরো বাথরুমে যাব-

-চা বসাই। মুড়ি খাবি ?

দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে হড়হড় করে বমি করল মিঠু। সয়া সস আর ভিনিগারের গন্ধের মধ্যে হতভম্ব দাঁড়িয়ে রইল ছন্দা তারপর গ্যাস জ্বেলে তিন কাপ চায়ের জল বসাল। ভাত বসাতে আরো ঘন্টাখানেক।

~*~

- এত চিন্তার কী হল তোদের? মাণিককে তো রোজই ফোন করতাম। কী সবজি টবজি লাগবে - ফোন করে বলে দিতাম -

-পুলিশ কী বলল শুনে?

- কিছু না! হুঁ হুঁ করে লিখে নিল। তোর মা ফালতু টেনশন করল। কলেজে ফোন টোন করে একশা-

-তাতে কিছু হয় নি। আমার ফোন অফ ছিল-

-চকলেট খাবি মিঠু?

-আবার তুমি..

-চুপ, মা কে বলিস না

-কেন কথা শোনো না মামু?

-শুনি তো সব কথা শুনি। দু একটা কথা শুধু- তুইও তো.. কী রে ? আজ কী খেয়েছিলি? চাইনিজ? বাথরুমে গন্ধ পেলাম- ফিনাইল ঢেলে দিয়েছি; তোর মা আবার রাগারাগি করবে - ফিনাইলের কত দাম এই সব-

-মা' কথায় কিছু মনে কোরো না- সবেতেই-

- দূর। ঠিকই তো বলে। আমার কতদিন কোনই রোজগার নেই, বসে খাই। কথা তো ঠিকই-

-এই সব বলেছে তোমাকে!

- বললে কী! তোদের ছেড়ে আমি কোথায় যাব মিঠু? তুই, তোর মা- কোথায় যাব? তুই একবার ডাক্তার দেখিয়ে নে তো। কিছু হজম হয় না।

- সে হবে। 

দুজনেই চুপ করে রইল এরপর। বিপ্লব পা নাচালো কিছুক্ষণ, মাথা চুলকে নিল। তারপর বলল, “আচ্ছা মিঠু, একটা কথা বলব ভাবি। তোর কলেজে লোক নেয় না?”

-মানে?

-আমার কোনো কাজ হয় না? এই ধর ক্ল্যারিকাল কাজ- টুকটাক হিসেব রাখা-এর বেশি আর কী পারব?

- কেন এরকম বলছ মামু?

- না রে - এই একরকম করে চলছে এখন, তারপর যদি অসুখ বিসুখ করে-

-খামোকা অসুখ বিসুখ কেন করবে?

- বয়স হচ্ছে না? এরপর অসুখ হবেই-তখন চিকিৎসার খরচ-

-ভেবো না। একদম ভেবো না। আমি তো আছি। আসলে, আমার বিয়েতে এত খরচ করল মা, অথচ.. আজকাল মেজাজ গরম করে, উল্টোপাল্টা বলে জন্য-

চোখের জল আড়াল করতে মুখ ঘুরিয়ে কুন্তী আর গুলগুলেকে খুঁজল মিঠু তারপর মাথা নামাল। দেখল,  টেবিলের পায়ার কাছে এখনও সেদিনের ভাঙা কাচের টুকরো -টিউব লাইটের আলোয় চিকচিক করছে। খণ্ডিত হওয়ার পরেও ভাঙা টুকরো কতদূর চালিত হতে পারে- মিঠু বিস্মিত হচ্ছিল।

~*~

ক্লাবঘরের লাগোয়া মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে বিপ্লব হাঁফাচ্ছিল   যদিও শীতের সময়, বাজার হাতে হাঁটতে গেলে হাল্কা ঘাম হয় তবু, ব্যাগ দুটো ভারি লাগতে থাকে।  মাঠের পাশে বেঞ্চে বসে একটু  জিরিয়ে নিলে বাড়ি অবধি আবার হাঁটা যায়।  বাড়িতে এখন ছন্দা আর টুম্পা- মিঠু কলেজে। আসলে,  শীত পড়তেই ছন্দার ঘর মুছতে, বাসন মাজতে সমস্যা - কোমর ঝুঁকিয়ে, নিচু হয়ে বসে কাজ করতে পারে না, আঙুলের গাঁটে গাঁটে ব্যথা হয়ে ফুলে যাচ্ছিল, রাতে শোয়ার সময় হট ওয়াটার ব্যাগ নিতে হচ্ছিল রোজ। 'বাড়িতে ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে মিঠু আর ছন্দার হুবহু এক সু - সেরে যাবে থেকে শুরু হয়ে আর কদিন দেখি তারপর আমার শরীর আমি বুঝব তে পৌঁছে যায় দুজনেই। মিঠুর বাবারও এই স্বভাব ছিল।  কিছু নয়, গ্যাসের জন্য চিনচিন, অম্বলের ওষুধ খেলেই সেরে যায় করতে করতে  মধ্যরাতে বাথরুমে পড়ে রইল-পাড়ার লোকজন দরজা ভেঙে হাসপাতালে নেয়। ব্রট ডেড- এমার্জেন্সির ডাক্তার বলেছিলেন। টুম্পাকে আনলো বিপ্লবই- টুকটাক কাজকর্মে ছন্দাকে সাহায্য করবে।

ছন্দা যথারীতি গলা তুলেছিল-

- টাকা খুব বেশি হয়েছে না?

- এটুকু তো প্রয়োজনেই খরচ। আর টুম্পারও কাজ দরকার।  বেশি কাজ তো নয়। সকালে বিকেলে হেল্প করে চলে যাবে। নিজেই কাজ চাইছিল। পাড়ার সবাইকেই বলে রেখেছে। কমপেনসেশনের টাকাটা পেয়ে গেলে একটা ব্যবসা শুরু করবে। ততদিন... মাণিকের মেয়ে- এইটুকু তো...

চুপ করে গিয়েছিল ছন্দা

ইদানিং বাড়ির সামনে বাজার  বসছে আবার। বিপ্লব তবু বড় রাস্তার মোড় থেকেই বাজার করে রোজ। রাতের দিকে টুকটাক দরকার হলে মিঠু কলেজ ফেরত নিয়ে আসে। মাণিকের জায়গায় এখন শম্ভূ বসে সবজি নিয়ে।  মাণিকের মতই কুপির আলোয় মুড়ি খায়। চল্লিশ টাকা  কিলো দরে বেগুন বেচে। এক গাল মুড়ি মুখে রেখে বলে -'নিয়ে যান দিদি, পোকা নেই।'

মাঠের দিক থেকে লাল ডিউস বল গড়িয়ে এল বিপ্লবের পায়ের কাছে। বিপ্লব ক্রিকেট খেলেছে ক্যাম্বিস বলে। এখন নেট পড়ে, সেখানে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে প্লেয়ারদের হেলমেট, গ্লাভস, গার্ড আর ডিউস বল। এত কাছ থেকে  সত্যিকারের ক্রিকেটের বল কখনো দেখেই নি বিপ্লব-  শুকনো হলুদ ঘাসের ওপর লাল বল- মাঝবরাবর  দু লাইন সাদা ফোঁড় সেলাই করা। মাণিকের পিঠ থেকে পেটের দিকে  'রকম দাগ ছিল একটা। অপারেশনের দাগ। বিপ্লব বল কুড়িয়ে ছুঁড়ে দিল মাঠের ভেতর। চাদর জড়িয়ে নিল। বাজারের থলি তুলে হাঁটা শুরু করল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শীত-

 

পঙ্কজের গন্ধ পেলেই বনময়ূর ডেকে ওঠে।  পিছনের দু’পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে বারান্দার দরজার জালে থাবা রাখে তারপর ঝাঁকায়। সদরের বাইরে থেকে পঙ্কজ যখন সে আওয়াজ পায়, ওর মনে হয়, গোটা বাড়িটাই যেন জ্যান্ত হয়ে উঠে পঙ্কজের দিকে দু'হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে; সমস্তদিনের কেবল এই সময়টুকু নিজেকে দামি মনে হয়। যতদিন স্মিতা আর বুল্টি  'বাড়িতে ছিল, বাড়ির ঢোকার ঠিক আগে সামান্য টেনশন হত পঙ্কজের- এত বছরেও সে যেন তার স্ত্রীর, সন্তানের মুখোমুখি হতে ক্ষণিকের অস্বস্তি বোধ করে- 

বস্তুত পঙ্কজ জীবজন্তু ভয় পেত - ওদের মফস্সলের বাড়িতে সাপখোপের উপদ্রব ছিল, বাজারে ষাঁড় তাড়া করেছে, কুকুর কামড়ে দিয়েছিল একবারসেসব পুরোনো কথা। তারপর ' দেশে এল, সংসার টংসার। বুল্টির ছোটো থেকেই কুকুরছানার বায়না, স্মিতারও ইচ্ছে ছিল খুব- শুধু পঙ্কজ নানা অজুহাতে পাশ কাটাতো- কখনও বলত, ওর অ্যালার্জি আছে- বাড়িতে কুকুর ঢুকলেই এমন হাঁচি হবে যে মরেই যাবে, কখনও কুকুর সংক্রান্ত ভয়াবহ সব ঘটনার রোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছে আর বুল্টি চোখ গোলগোল করে- "সত্যি!!"  আর স্মিতা "যত্ত গুল" বলে উঠেছে;  কখনও স্রেফ "বাড়িতে জায়গা কোথায়" বলে হাত উল্টেছে।  শেষমেষ বুল্টি যখন ক্লাস সেভেন থেকে এইট - সদ্য টীনএজারের যুক্তিজাল আর বাক্যবাণের কাছে আত্মসমর্পণ করল পঙ্কজ;  বনময়ূর এল 'বাড়িতে - নাম রেখেছিল স্মিতাই।  ইয়ামোটা ল্যাজ নিয়ে ছোটো কুকুরছানার নাচন কোঁদন দেখে  স্মিতার 'বনময়ূরের নাচ দেখতে যাব' গানটা মনে পড়েছিল। পঙ্কজ কস্মিনকালে শোনে নি ' গান। এই স্মিতার স্পেশালিটি-  এক এক সময় এমন সব গানের লাইন বলে, আদৌ সেরকম গান আছে কী না পঙ্কজের সন্দেহ হত;  স্মিতা অবশ্য এক্ষেত্রে সিনেমার দৃশ্যের বিশদ জানিয়েছিল- অনুভা গুপ্তার লিপে সন্ধ্যা মুখার্জী- স্মিতা ওর ছোটোবেলায় দিদার থেকে শিখেছিল গানটা- দু'কলি গেয়ে শুনিয়েছিল বুল্টি আর পঙ্কজকে। গানের সুর বেশ কিছুক্ষণ ভেসে ছিল ঘরে, থিতিয়ে গেলে, টুপটাপ খসে পড়ছিল শব্দ আর বনময়ূর নামটা লুফে নিয়েছিল বুল্টি।

স্মিতা আর বুল্টিই বনময়ূরের দেখাশোনা করেছে এতকাল। বুল্টি ডর্মে চলে যাওয়ার পর স্মিতা একা পেরে উঠতো না, পঙ্কজ সাহায্য করত টুকটাক। তারপর স্মিতা কলকাতা চলে গেল -  সব দায়িত্ব এখন পঙ্কজের। প্রথম প্রথম ভুল হয়েছে হয়তো অফিস থেকে ফিরতে দেরি - বনময়ূরের খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে, কিম্বা উইকএন্ডে বন্ধুবান্ধবের ফোন আসায় ভুলেই গেল বিকেলে হাঁটতে নিয়ে যাওয়ার কথা; একদিন সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে ফোনে কথা বলছে পঙ্কজ -  এই জানলার কাছে দাঁড়াচ্ছে, তারপরেই হ্যাঁ হ্যাঁ বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে উঠল, আবার হাসতে হাসতে নেমে এসে ব্লাইন্ড নামাচ্ছে;  পিছনে ছায়ার মত বনময়ূর; দরজার ঘন্টি বেজেছিল এই সময়- কানে ফোন নিয়ে দরজা খুলল পঙ্কজ- পিজ্জা আসার কথা। দরজা খুলতেই এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গিয়েছিল বনময়ূর। পঙ্কজের বাড়ির সামনে চওড়া রাস্তা , রাস্তার উল্টোদিকে বাড়ি, লাল ডাকবাক্স, স্ট্রীট লাইট , তার পিছনে জঙ্গল। হতচকিত হয়ে গিয়েছিল পঙ্কজ। তারপর  সেও দৌড়ে পৌঁছে গেল উল্টোদিকের ফুটপাথে- কোথাও নেই বনময়ূর। ফুটপাথ ধরে একবার বাঁয়ে দৌড়োয়, আর একবার ডাইনে দৌড়োয় পঙ্কজ; ততক্ষণে ঘামতে শুরু করেছে, বুকের মধ্যে একটা হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে - একটা প্রাণীকে হারিয়ে ফেলল !  তখন পাড়ার কুকুরের দল বেড়াতে বেরিয়েছে-  নীল সাদা ডোরা টিশার্ট পরা মহিলার সঙ্গে মলি, ডেভিডের সঙ্গে  মার্লি, ঘুরিয়ে পরা বেসবল টুপি , গোলগলা টি শার্ট পরা রোগা ছোটোখাটো  মানুষ আর তাঁর সানগ্লাস পরা সঙ্গিনী তিনটিকে নিয়ে মোড় ঘুরে এই ফুটে উঠেছেন-  ইজি, ব্যাঞ্জো, ডেজি-  তারা ছুটে যেতে চাইছে দিগ্বিদিক, তাদের লীশের ওপর মহিলার শিরাওঠা  লম্বা আঙুল  চেপে বসে আছে , ট্যারাব্যাঁকা মরা নখে কমলা পালিশ; পঙ্কজ শিউরে ওঠে- যদি জবাবদিহি চায়,  যদি পুলিশ ডাকে-

পাঁচটি কুকুরের নিঃশ্বাস এখন পঙ্কজকে ঘিরে, চারটি মানুষ প্রশ্ন করে-

- হোয়াট হ্যাপেনড? আর ইউ অলরাইট?

-ইয়েস ইয়েস , অল গুড।

কুকুরের দল চোখের আড়াল হতেই আবার দৌড়ে বেড়ায় পঙ্কজ- কোথায় বনময়ূর? 

সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল, হাওয়া দিচ্ছিল উথাল পাথাল, রাস্তার ওপারে বাড়ির দরজা হাট করে খোলা, দরজার সামনে পিজ্জার বাক্স, বসবার ঘরের আলো দেখা যাচ্ছে; পঙ্কজ বাড়িতে ঢুকে, ডগফুডের প্যাকেট থেকে একমুঠো পেলেট নিয়ে রাস্তা পেরোলো আবার- ডাকবাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে ডাকল-" বনময়ূর, আয়, আয়।" হাওয়ায় হাওয়ায় ডগফুডের গন্ধ, পঙ্কজের গলার কাঁপুনি ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ইজি, ব্যাঞ্জো, মার্লি ডেকে উঠেছিল খুব জোরে আর জঙ্গলের ভেতর থেকে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এসেছিল বনময়ূর;  সাইডওয়াকের ওপর তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল পঙ্কজ। তার অভ্যন্তরে যে এতখানি কান্না ছিল, জানতই না সে স্ট্রীটলাইট জ্বলে উঠেছিল, রাস্তার ধুলোর মধ্যে থেবড়ে বসে পঙ্কজ দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিল বনময়ূরকে, পঙ্কজের গাল চেটে ল্যাজ নাড়ছিল ঘন রোমে ভরা প্রাণী;  বনময়ূরের গায়ের গন্ধ, ঊষ্ণ শরীর, পঙ্কজের হাতের তলায় ধুকধুক করতে থাকা বনময়ূরের হৃদয়ের শব্দ সম্ভবত কানেকশন গড়ে তুলছিল একলা, নির্জন মানুষ আর পশুটির মধ্যে-

~*~

যেন ট্রেনে উঠেছিল লিপি- হুইশল দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে ট্রেন আর লিপি বার্থে উঠে বসছে, তারপর রেলের কামরা বদলে যাচ্ছে ওর বাপের বাড়ির পুরোনো ঘরদোরে - মলিন দেওয়ালে ঝুলে থাকা ছবি, ক্যালেন্ডার-  খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে আর দেওয়ালে ছবি তৈরি হচ্ছে- বকুল গাছ, জবা, টগর,  এই উঁচু নারকেল গাছ তারপর মেপল।  লাল হলুদ ঝরা পাতার রাশ পেরোচ্ছিল ট্রেন খুব আস্তে, সে ট্রামে করে চলেছে এরকম মনে হচ্ছিল - তারপর একটা লম্বা ব্রিজে উঠল , স্পীড বাড়াল- ঝমঝম ঝমঝম ঝমঝম;  ট্রেনের তীব্র গতিতে ভেঙে  গেল বাপের বাড়ির দেওয়াল, ঘরদোর, দেওয়ালের ছবি-ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল লিপি। জল খেল।

বিকেলে যখন স্কুল থেকে ফিরছিল , কমিউনিটি নোটিশ বোর্ডে কুকুরছানার ছবি দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল তিন্নি- কুকুর হারিয়েছে, খুঁজে পেলে পুরস্কার। তিন্নির পাশে দাঁড়িয়ে ছোটো ছোটো কাগজের টুকরো সাঁটা  চৌকো বোর্ডে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল লিপি -পিয়ানো শিক্ষক চাই, অভিজ্ঞ বেবি সিটারের জন্য এই নম্বরে যোগাযোগ করুন, যোগ শিখতে আসুন কিংবা ক্যারাটে,  মেদ কমাতে চান?  আগামী পরশু গ্যারাজ সেল, একখানি কুইনসাইজ খাট জলের দরে বিক্রি হবে ...  তারই মাঝে সবুজ চৌকো কাগজে লেখা ছিল-  ফ্রম মাদার্স টু ডটার্স : অ্যান একজিবিশন অফ প্যাচওয়ার্ক কুইল্টস- লাইব্রেরির দোতলায়। রুটিন ভাঙতে ইচ্ছে হচ্ছিল লিপির- একবার ঘুরে আসতে কতক্ষণ আর লাগবে?

টানা বারান্দায় কাচের চৌকো বাক্সে সারি সারি কুইল্ট টান টান করে পিন দিয়ে আটকানো -  কাঁথা না কি বালাপোষ বলবে ভাবল লিপি। সেই কবে জাহাজে করে এই দেশে আসতে আসতে হয়তো মা সেলাই করেছেন কাঁথা, দিয়ে গেছেন মেয়েকে, আল্টিমেটলি নাতনির ঘরে সে কাঁথা এখন। কাঁথার এত রকমফের- অবাক লাগছিল লিপির। দেখছিল, মহার্ঘ্য সিল্কের বালাপোষের পাশে ময়দার মিলের বস্তা দিয়ে তৈরি কাঁথার গায়ে দরজির দোকানের পুরাতন স্যাম্পল বুক থেকে নেওয়া কাপড়ের টুকরোর প্যাচওয়র্ক,  ছেঁড়া মোজা, ছেঁড়া সোয়েটারের ইন্সুলেশন। বারান্দার মোড় ঘুরে অভিবাসী আর শরণার্থীদের বানানো কাঁথার সামনে দাঁড়াল লিপি। প্যাচওয়ার্কের কাজে  একটা অদ্ভুত প্যাটার্ন  দেখছিল সে-  ফেলে আসা দেশ, বাড়ি, ঘর, প্রকৃতির মোটিফ ক্রমে বদলে গিয়েছে 'দেশের  পশু পাখি ফুল আর পতাকায়।  মা মেয়ে কাচের বাক্সে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। দুজনের নিঃশ্বাসের অভ্যন্তরের জলীয় বাষ্প শো কেসের  গায়ে একটা প্যাটার্ন তৈরি করছিল, তারপর মিলিয়ে যাচ্ছিল। রোঁয়া ওঠা পুরোনো বালাপোষের নকশার ফোঁড় ওদের চোখের মণি ছুঁয়ে ঢুকে যাচ্ছিল মগজে-

যদি আজ এই মুহূর্তে তিন্নির জন্য বালাপোষ সেলাই করতে বসে লিপি, নারকেল গাছ না কী মেপল ট্রীর নকশা বসাবে ভাবতে ভাবতে ব্লাইন্ড সরিয়ে রাতের রাস্তায় তাকালো। বরফ পড়ছিল সে রাতে। আকাশ থেকে নেমে আসা গুঁড়ো তুষার, সাদা হয়ে যাওয়া সাইডওয়াক, নীলাভ স্ট্রীটলাইটকে ওর অলীক লাগছিল। মনে হচ্ছিল, যেন এক স্বপ্নের মধ্যে আটকে পড়েছে- ছটফট করে জেগে উঠতে চাইছিল লিপি- ফলত জল খেতে গিয়ে বিষম লাগল। সুবিমল জেগে গিয়েছিল।

 - কী ' লিপি? বসে আছ? কথা হয়েছে আজ বাড়িতে? ঠিক তো সব?

- মা বলছিল, কিছুদিন রাণাঘাট গিয়ে থাকবে, রান্না করতে করতে আজ নাকি মনে হয়েছে দেয়াল টেয়াল দুলছে-

- আমি তো আগেই বলেছিলাম, তো বাড়ির অবস্থা , তার মধ্যে এই মেজর খোঁড়াখুঁড়ি- তোমার বাবা তো শুনতেই চান না

- বাবা বলছিল, বাড়ি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই,  মা প্রেশারের ওষুধ খায় নি সকালে ,আসলে মাথা ঘুরছিল-

-তবু... রাণাঘাটে গিয়ে থাকা ভালো- মেট্রোর কাজটা মিটে যাক-

-জানো?

-কী ?

-ঘুমোলে?

- হুঁ

- ভালো লিখতে শিখেছে তোমার মেয়ে

-কী লিখল? স্কুলের এসে?

-না না। আজ বলছিলাম,  তুই লেখ না একটা গল্প - ফুল নিয়ে। ভেবে টেবে বলল- ফার্স্ট লাইন ভেবেছি; এভরি সামার কামস উইথ  ইটস ওন স্মেল।

- তো ডেনজারাস-

- আরো আছে। বললাম, বাংলায় লেখ গল্পটা।  বলল- তাহলে ফার্স্ট সেন্টেন্স হবে- গরমকালের নিজের একটা গন্ধ আছে

- বলো কী? এই বয়সে এরকম  লাইন!  সেলিব্রেট করতে হয়-

-বলছি,  ফিরে গেলে হয় না?

-কোথায়?

-বাড়ি-

-আমার বাড়ি তো এইখানে- এই তো আমার বাড়ি, তাই না?  আমার বাড়ির একটা নিজের গন্ধ আছে- আমার লিপিমণির নিজের একটা গন্ধ আছে-কী তাই না? উঁ?

মিলিত হওয়ার মুহূর্তে  জানলার বাইরে  চোখ গিয়েছিল লিপির- এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছিল রাতের আকাশ ফুঁড়ে  -

সকালে হাল্কা রোদ, সুবিমল অফিসে বেরিয়ে গেছে, তিন্নিকে স্কুলে দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল লিপি। ফেরার পথে পাঁউরুটি, দুধ আর চকোলেট কিনছিল পাড়ার দোকানে।  বাড়ি ফিরে কমপিউটার খুলে বসবে- চাকরি খুঁজবে, অ্যাপ্লাই করবে, তারপর ফোন করবে 'দিন 'দিক; বিকেল হলে তিন্নিকে আনতে যাবে।

~*~

স্মিতা চলে যাওয়ার পরে, এখন সমস্তদিন বনময়ূর একলা -সকালে বেরোনোর সময় জল, খেলনা, খাবার দিয়ে ওকে বারান্দায় রেখে যায় পঙ্কজ- শেড দেওয়া ঘেরা বারান্দা- দু' থাবার ওপর মুখ রেখে এমন করুণভাবে তাকায়, পঙ্কজের মনে হয় -আজ অফিস না গেলে ক্ষতি কী? এক দিন মাঝপথ থেকে ফিরেও এসেছিল- দেখেছিল, বারান্দায় একলা বনময়ূর ' মাথা 'মাথা করছে- যেন মেলার ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া বালক।

গত মাসে সাইক্লোন হয়েছিল।  অফিসে গিয়ে টিঁকতে পারে নি পঙ্কজ-  হয়ত বাজ, বিদ্যুতে ভয় পাচ্ছে বনময়ূর। ওয়র্ক ফ্রম হোম করব বলে বাড়ি চলে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এই শীতে ওকে  কোট পরিয়ে রেখে যায় আর অফিস গিয়ে গুগল করে দেখে, কতখানি  ঠাণ্ডা সইতে পারবে বনময়ূর।  কিছুদিন আগে একটা সারভেইল্যান্স ক্যামেরা কিনেছে  -বারান্দার  দেওয়ালে এক কোণায় লাগিয়ে নিশ্চিন্ত -  এখন মোবাইল ফোনে যে কোনো সময়েই বনময়ূরকে দেখা যায়

বাড়িতে ঢুকতে একটু সময়  লাগে কোনদিন -  হয়ত চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতে দেরি হল, হয়ত  ঢোকার মুখে কথা শুরু করল পাশের বাড়ির অ্যালেন- বনময়ূর, পঙ্কজ দুজনেই অধৈর্য হতে থাকে তখন- তাড়াহুড়োয় উল্টোদিকে চাবি ঘোরায় পঙ্কজ  আর বনময়ূর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাড়ি ঘর  মাত করে দিতে থাকে;  তারপর ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজা খুলে দিলে বনময়ূর ছুটে এসে পঙ্কজের গায়ে গা ঘষে, হাত মুখ চাটতে থাকে। তখন বনময়ূরের গায়ে এই বাড়িটার সমস্তদিনের  গন্ধ , রোদের গন্ধ, বৃষ্টির গন্ধ- অফিসে বসে যা কিছু থেকে বঞ্চিত পঙ্কজ, বাড়ি ফিরে বনময়ূরের থেকে সে যেন সব পেয়ে যাচ্ছে- এই রকম মনে হয়।

ক্রিসমাসের ছুটি শুরু - বুল্টি  ডর্ম থেকে বাড়ি আসবে। পঙ্কজ  অগোছালো ঘর দোর গোচ্ছাচ্ছিল,  ক্রিসমাস ট্রী সাজাল, ফুলদানিতে ফুল,  বাহারি পাতা  - কমলা লাল হলুদ  সবুজ রঙ মিলিয়ে, বুল্টির  ঘর বার কয়েক ভ্যাকুয়াম করে চাদর , বালিশের ঢাকা বদলালো, বাথরুমে নতুন তোয়ালে, সাবান - স্মিতা এখানে থাকলে যা যা করত সব হল কী না ভাবতে ভাবতে সিগারেট ধরালো একটা। গ্যারাজ ঢুঁড়ে  নিয়ে এল বাক্সভরা  ফেয়ারি লাইটের গোছা -বাগান সাজাতে গেল পঙ্কজ ফোন করেছিল বুল্টি।

- কী করছ?

- এই তো আলো লাগাচ্ছি বাগানে- তোর গোছগাছ হল?

-প্লীজ কিছু মনে কোরো না বাবা। পরশু বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাব -

- আসবি না বাড়িতে? সে কী রে! কতদিন বাড়ি আসিস নি-

-আসব তো- পরশু আসছি না-

- বনময়ূরকে দেখিস নি কতদিন -ওকে দেখে যা -যদি পারিস।

- দেখি তো -স্কাইপে তো দেখছি -তোমাকে , বনময়ূরকে-

-কবে আসবি জানাস-

-চলে আসব, আগে থেকে জানানোর কী আছে?

-সবাইকে আসতে বলতাম সেই মত আর কী - একটা গেট টুগেদার ধর- পরাশর আঙ্কল, লিপিমাসিরা, সুপ্রিয়া আন্টি-

- না -

-কেন? ওরাও তো কতদিন দেখে নি তোকে, তুইও-

-তুমি  আসলে দেখাতে চাও উই আর স্টিল হ্যাপি ফ্যামিলি- তাই না?

-দেখানোর কী আছে ? নই?

-মা কেন চলে গেল?

- সে তো তুই জানিস- জেঠিদিদার অসুখ-

- সে'টা সব নয়, তুমিও জানো বাবা-

পঙ্কজ চুপ করে যায়। মাথা নামিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল বেঁকায়, মেঝের অদৃশ্য ময়লা  ঘষে ঘষে তুলতে থাকে, ব্যথা করে উঠলে সরিয়ে নেয় আঙুল।

-বেশ বলব না ওদের। ওরা যদি যেতে বলে যাবি তো?

- এই সব পার্টি ফার্টি বাদ দাও। গেলেই তো  এক কথা- মা কবে আসবে, আমার কোর্স  কবে শেষ হবে, আমি এরপর কী করব-

ফোন রেখে দিল বুল্টি।

পঙ্কজ লাথি কষাল ফেয়ারি লাইটের বাক্সে। ঘরে ঢুকে ক্রিসমাস ট্রীর ডগা মুচড়ে দিল- ঝকমকে তারা, ঝুলন্ত বল খসে পড়ে খানখান হল আওয়াজ তুলে - সেই শব্দে ছুটে এল বনময়ূর। পঙ্কজ  গাড়ির চাবি নিল--আয় বনময়ূর, আয়। গাড়ির দরজা খুলে দিতেই একলাফে বনময়ূর গাড়ির মধ্যে।উত্তাল গাড়ি ছোটাল পঙ্কজ। রোদ উঠে বরফ গলে গিয়েছিল। সমুদ্রের দিকে গাড়ি ঘোরালো প্রথমে তারপর পার্কে গেল। বনময়ূরের সঙ্গে ঠায় বসে রইল বেঞ্চে - ঠাণ্ডা  হাওয়ায় কেটে কেটে যাচ্ছিল পঙ্কজের নাক, মুখ, চোখ; ছোটো বুল্টিকে নিয়ে উইকএন্ডে কোথায় কোথায় যেত-মনে মনে লিস্ট করল পঙ্কজ। পরের রবিবার বনময়ূরকে নিয়ে লংড্রাইভে যাবে ভাবছিল।

রাতে নিজের খাবার গরম করতে দিয়ে, বনময়ূরকে খেতে  দিল পঙ্কজ- ছোটো বাটিতে জল আর মাপমতো পেলেট। নিজের প্লেট থেকে মাংস তুলে জলে ধুয়ে খেতে দিল তারপর- স্মিতা থাকলে এই নিয়ে রাগারাগি করত। তারপর হাঁটতে বেরোল দুজনে- বিশাল আকাশের নিচে দীর্ঘ ছায়ার পাশে চৌকো ছোটো ছায়া- হাঁটতে হাঁটতে পঙ্কজের মুখের দিকে তাকায় বনময়ূর আর  মায়ায় মায়ায় ভরে যেতে থাকে পঙ্কজ- রাতে একলা সোফায় টিভি দেখে, ল্যাপটপ খুলে কাজে বসে। বনময়ূর ওর পায়ের পাতার ওপর পড়ে থাকে কম্বলের মত-  ভারি আরাম হয় তখন; নিরালা এই গৃহকোণ, সে আর এই প্রাণীটি- পঙ্কজের অতীত নিয়ে যার কৌতূহল নেই, কোনো সন্দেহ নেই, কোনো রাগ নেই, কোনো ক্ষোভ নেই, অভিমান নেই- 

- চাকরি ছেড়ে দেব, তারপর সারাদিন তুই আর আমি একসঙ্গে-  দেখিস তুই-

বনময়ূর তার কান পটপট করে, ল্যাজ নেড়ে যায় অবিরাম। বনময়ূরের  ছোট্টো মাথায় হাত বোলায় পঙ্কজ - "খোকা রে"-

পঙ্কজের  অতীত খুঁজতে গেছে স্মিতা; গর্ত খুঁড়ে প্রাচীন হাড়গোড় হাতে ঠেকলে  হয়ত  আর কোনদিন ফিরবে না এখানে- পঙ্কজ কথা জানে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শীত-

 

এখান থেকে ডাইনে ঘুরে যাচ্ছিল  টিবিএম চন্ডী। মাটির ওপর দেড়শো বছরের  ঘর দোর রোয়াক উঠোন, টাইম কলের জল উপচে পড়ছে  চৌবাচ্চায়, পাখির খাঁচার পাশে  হেলান দেওয়া মোটর সাইকেল;  টানা বারান্দা,  রান্নাঘর, ডালে সম্বার দেওয়ার গন্ধ, জিরে, মৌরি বাটা, দুধ উথলে গ্যাস নিভিয়ে দিল, গৃহস্থের বসার ঘরে টিভিতে লোকসভায় সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট নিয়ে ডিবেট চলছে।

বড় রাস্তা থেকে অনেকখানি ভিতরে ইতিহাসবিদের বাড়ি;   ফুটবল মাঠ পেরিয়ে  কদম গাছের নিচে ইয়াং স্টার ক্লাবের কথা বলেছিল প্রণতিদি- ল্যান্ডমার্ক হিসেবে; অন্ধকারে সাহিলরা গাছটা মিস করেছে। শীতের সন্ধ্যায় ফুটপাথের কোনো কদমগাছকে কেমন দেখতে হতে পারে - সাহিলের  ধারণা ছিল না -কঙ্কণার ওপর নির্ভর করছিল আগাগোড়াই।  সাহিলরা  চারটের মধ্যে বেরোবে ভেবেছিল- লাস্ট মোমেন্টে তপনদা  সাইটে  মীটিং ডাকে। এই ব্যাপারটা কঙ্কণাকে জানাতে গিয়ে সাহিল  তারে আমি শুধাই তুমি’তে আটকে যায়। আসলে,  কঙ্কণা রিংটোন বদলায় ঘন ঘন। এবারেঅনেক দিনের আমার যে গানদিয়েছিল; ফলে , কঙ্কণাকে ফোন করে - দেরি হবে বলতে গিয়ে সাহিল বার কয়েক ওর নতুন রিংটোন শুনেছিল- এতে  কিছু সময় যায়। উবের পেয়েছিল সহজে কিন্তু আরো মিনিট কুড়ি মিছিলে আটকে।  ফলে অন্ধকার নেমে গিয়েছিল, মশা তাড়ানোর ধোঁয়া গলি উপচে চোখে ঢুকছিল; মূলত একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছিল ওরা। সাহিল যে উপন্যাস লিখবে মনে করেছিল, তার জন্য সে এক  জাদুকরকে খুঁজছিল -যাঁর সন্ধান দেবেন একজন ইতিহাসবিদ।  আর এই শীতের সন্ধ্যায়, সেই ইতিহাসবিদের সন্ধানে  স্রেফ একটা অচেনা কদমগাছ মিস করে গিয়ে চক্কর খাচ্ছে কঙ্কণাসমেত- গোটা ব্যাপারটার  আকস্মিক জটিলতায় মজা পাচ্ছিল সাহিল। কঙ্কণা ভুরু কুঁচকে কদমগাছ খুঁজছিল - ফাইনালি  ইয়াং স্টারের নিয়ন সাইন দেখতে পেয়ে গায়ে চাদর টানল; বড় রাস্তা থেকে গলিতে ঢুকলে তাপমাত্রার অন্তত দু ডিগ্রি ফারাক - বাড়ি খোঁজার টেনশনে এতক্ষণ বোঝেনি। হাল্কা কেশে দু হাতের তেলো ঘষে নিল সাহিল।

দোতলার ঘরে অজস্র বই, জাবদা খাতা  টেবিলে এবং সোফায়; কাগজের ফাইল টাল করে রাখা সবখানেই ; পড়ার টেবিলে ল্যাপটপ, রীডিং লাইট - এসবই সাহিল কল্পনা করে নিয়েছিল  ঘরে ঢুকবার আগেই। ওকে বিস্মিত করছিল, দেওয়াল দেওয়াল জুড়ে  ম্যাজিক শো' পুরোনো সব পোস্টার-  পলকা ফ্রেমের বাঁধাই,  কাচের আবরণ- কার্টার, থারস্টন, কেলার, সরকার, হুডিনি যেন আড়াল থেকে দর্শকদের নিরীক্ষণ করছেন;  একটু  পরে বেল বাজলেই পর্দা উঠে খেলা শুরু হয়ে যাবে - যাদুকর তখন সটান ফ্রেমের বাইরে এসে অভিবাদন করবেন সাহিল আর কঙ্কনাকে,  আস্তিন থেকে বের করে আনবেন লুকোনো সব তাস, রুমাল, খরগোশ টোশ- ঝটপট করে পায়রারা উড়ে বেড়াবে ঘরময়। সাহিল সামান্য ঠেলা দিয়ে জানলার এক পাট খুলে দিল।  কার্টারের বিষণ্ণ মুখ, লাইনে ঊষ্ণীষের পালক ছায়া ফেলেছে, হাতের কৃস্ট্যাল বল ঘিরে অদ্ভূতুড়ে লাল সবুজ ফিগার সব- নিরাবলম্ব;  ঘন নীল পোস্টারে থারস্টনের চারদিকে কঙ্কাল, করোটি- সাহিল ঘুরে ঘুরে দেখছিল।  পোস্টারের ফ্রেমে আঙুল ছোঁয়ালে ধুলো লাগছিল হাতে। কাচের শো কেসে নানা মাপের ম্যাজিক ওয়ান্ড , লাল নীল বল, একগোছা দড়ি, তাস -  বিবর্ণ হয়ে গেছে। এই প্রাচীন ঘরদোর, স্যাঁতা পড়া দেওয়াল, পুরোনো বই এর গন্ধ,  অদৃশ্য মিহি ধুলোয় এই যে আচমকা নাক সুড়সুড়  করে ওঠা, শো কেসের কাচে আঙুলের ছাপ- এই সব সাহিলকে লেখায় প্ররোচিত করছিল;  উত্তেজনা হচ্ছিল সাহিলের। ঈষৎ আশঙ্কা সেই সঙ্গে।

কঙ্কণা ইউনিভারসিটির কিছু রেফারেন্স এনেছিল। তারপর চা, আজকের মিছিল, সি নিয়ে টুকটাক কথা- কঙ্কণার ইউনিভারসিটি থেকে মিছিল সামনের সপ্তাহে-

ইতিহাসবিদ মাথায় আঙুল চালিয়ে অন্যমনস্ক হলেনঃ

- দেখুন, জাহাঙ্গীরনামায় সাতজন জাদুকরের কথা ছিল-  এত পুরোনো কিছু আপনারা চাইছেন না সম্ভবত।

এইখানে সাহিল গলা খাঁকরে নিজের উপন্যাসের কথা সংক্ষেপে বলেছিল।  সে চাণ্ডী মুখনের গল্প বলেছিল, তার নোটস রাখার কথা বলেছিল, খসড়া শুরু করেছে বলতে গিয়ে সে থেমে যাচ্ছিল বারবার - কখনও আবেগে গলা ধরে যাচ্ছিল, কখনও ভাবতে হচ্ছিল অনেক - কী বলবে, কীভাবে বলবে- তারপর উপন্যাসের চেহারা এখনও তার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয় - বুঝতে পেরে লজ্জিত হচ্ছিল।

-আপনারা তরুণ। লিখবেন নিশ্চয়ই। লিখতে তো হবেই।  কিন্তু একটা কথা বলুন, চারদিকে যা সব হচ্ছে, আপনাদের মনে হয় না, আমরা যেন একটা উপন্যাসের মধ্যে অলরেডি ঢুকেই পড়েছি? আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়,  একটা পপ আপ বই এর পাতায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, পাতা ওল্টাবো কেমন করে জানি না-

"আমাদের তুমি করে বলুন, স্যার", কঙ্কণা বলেছিল।

~*~

শীতের বিকেলে বৃষ্টি হলে ঠাণ্ডা যেন চামড়া ফুটো করে হাড়ে ঢুকে যায় সটান, তার ওপর ভেজা ফুটপাথ শুকোতে অনেক সময় নেয়- রাতে শোয়ার জন্য একটা শুকনো জায়গা খুঁজছিল প্রফুল্ল। এমনিতে, মন্দিরের সামনের ফুটপাথে প্লাস্টিক পেতে শুয়ে থাকে। গতবছর একটা কম্বল পেয়েছিল - সেদিন কালীমন্দিরে  শ্রাদ্ধ- প্রফুল্ল, কপিল, নাথু আর রঘুবীর  ফুটপাথে বসে পিণ্ডমাখা দেখছে-  ন্যাড়া মাথা দুটো ফরসা ছেলে পুজো করতে করতে চোখ মুছছিল। কাজ মিটে গেলে ছেলেদুটো ওদের হাতে লাড্ডু দিল। তারপর  টাকা, ধুতি আর কম্বল। গতবারের শীত এই কম্বলের নিচে দিব্যি কেটেছে;  তারপর প্লাস্টিক মুড়ে রেখে দিয়েছিল। প্রফুল্লর কম্বলটা নীল, ঘন নীল রঙের । এবি ইলেকট্রনিকসের সামনের ফুটে দাঁড়িয়ে পেল্লায় টিভি স্ক্রীনে   শ্রীদেবীকে কতদিন এই রকম নীল সমুদ্রের সামনে নাচতে দেখেছে। নাথু বলেছিল, "শ্রীদেবী মরে গেছে। অন্য কেউ। ক্যাট্রিনা।" রঘুবীর তর্ক করেছিল, "শ্রীদেবী কখনও মরতে পারে? জোয়ান মেয়েমানুষ। ক্যা লচক।"  প্রফুল্লকে বলেছিল, "তুই তো পেপার পড়িস। লিখেছিল পেপারে?"

"বিলকুল লিখেছিল। জলে ডুবে মরে গেছে নাহাতে গিয়ে।" নাথু উত্তেজিত হয়ে চেঁচাল।

মাথা নেড়েছিল প্রফুল্ল, "না, পেপারের লোক ভুল লিখেছিল। শ্রীদেবী একদিন জলের তলা থেকে উঠে আসবে, জাহাজে করে আসবে। পেপারের লোক জানে না"

-মরা মানুষ আবার ফিরবে কী করে?

- শ্রীদেবী ডুবে গেছে। কিন্তু মরে নি।  মরে নি তো।  জাহাজ খুঁজছে। পেয়ে গেলেই আসবে।

~*~

-জাদুকর না স্টান্টম্যান জানি না।  হুডিনির আন্ডার-ওয়াটার এসকেপ স্টান্ট দেখাতো নীলকমল। গণপতি চক্রবর্তীর ভক্ত ছিল।  নীলকমলই যে ওর সত্যিকারের নাম- তাও হলফ করে বলতে পারব না।  একটা সময় মাদ্রাজে গেল-  মানে বলেছিল, মাদ্রাজ যাচ্ছে, কোন সার্কাসে চাকরি করছে, স্টান্ট দেখায়, এসব শুনতাম।  ফিল্ম লাইনেও চেষ্টা করেছিল কিছু। বছর দুই পরে ফিরে এসে বলল, ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াবে। পয়সা কড়ি ছিল না। চটের বস্তা, দড়ি,  ইঁট, পাথর -এইসব দিয়ে মফস্সলে, গ্রামে গঞ্জে  খেলা দেখাত নীলকমল।  ম্যাজিকাল রোপ টাইজ অ্যান্ড সিক্রেট পড়ে টড়ে  স্পেশাল কিছু নট ব্যবহার করত, তার ওপর ফিটনেস, শরীরের ফ্লেক্সিবিলিটি  দুর্দান্ত ছিল- ফলে প্রতিটি শো হিট। তখন অনেক মেলা টেলাও হত তো। হুডিনির খেলাটা সবাই দেখতে চাইত। 

-আপনার সঙ্গে এখন যোগাযোগ আছে? ঠিকানা বা ফোন নম্বর?

-ওর ফোন ছিল না। ঠিকানা জানি না- এটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল আমার। আমি তখন ঘুরে ঘুরে গণপতি চক্রবর্তীর শিষ্যদের খোঁজ করতাম।  নীলকমলের সঙ্গে আলাপ হল। নিজেই আসত,  নানা দেশের ম্যাজিকের গল্প টল্প করত। নীলকমলের  একটা ইন্টারভিউ নেব ভেবেছিলাম। তারপর একদিন উধাও হয়ে গেল। আমিও তখন অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত। নীলকমলকে নিয়ে ভাবিই নি আর;  তবে নানা কথা কানে এসেছে- সত্যি মিথ্যে তো জানি না। শুনেছিলাম,  মহিলাঘটিত ব্যাপারে পুলিশের হাতে পড়েছে, আবার এও শুনতাম নীলকমলের সঙ্গে পুরুষমানুষদেরই সম্পর্ক- জটিল কোনো গোলমালে ফেঁসেছে -  জানি না কিছুই। আবার হয়ত সার্কাসেই ফিরে গেছে। অসুখ বিসুখ করে থাকতে পারে। এমনও হতে পারে- বেঁচে নেই। আসলে,  ভ্যানিশ হয়ে গেল একদম। তুমি চাণ্ডী মুখনের নাম করলে, আর আমার নীলকমলের কথাই মনে এল - যেভাবে এন্ট্রি নিয়েছিল একদিন আর যেভাবে ... -ওর মত আর কাউকে দেখি নি, সত্যি-

- নীলকমলের কোনো ছবি টবি আছে আপনার কাছে?

-না। তখন কথায় কথায় অত ছবি তোলা তো ছিল না- সুপুরুষ ছিল নীলকমল, ওয়েল বিল্ট,  রাজাদের মত পাকানো গোঁফ - কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সেটা নকল

-নকল গোঁফ?

- আমার মনে হয়েছিল আর কী। গোঁফে হাত দিত থেকে থেকে একটু নাটকীয় ঢঙে। শো থাকলে,  পাগড়ি টাগড়ি পরে খুব সেজে গুজে আসত , বুঝলে? সঙ্গে একটি অ্যাসিস্ট্যান্ট, চটের বস্তা, দড়ি, ইট, পাথর,  এই তো- কিন্তু যে কী বলে অ্যাপিয়ারেন্স - ওকে মফস্সলের পুকুরঘাটে মানাতো না, মনে হত রূপকথার জগত থেকে উঠে এসেছে; ওর অনেক শোতে আমি গিয়েছি, প্রচুর মেয়ে সেই সময় ওর প্রেমে পড়েছিল- মুগ্ধ দৃষ্টিতে সব তাকিয়ে থাকত - দেখেছি তো বিজয় নামে একটি ছেলে আমার কাছে আসত-ম্যাজিকের বইপত্রের খোঁজে-   নীলকমলের ভক্ত ছিল খুব; বিজয়ের একটা নম্বর লেখা আছে- দিচ্ছি দাঁড়াও। যদি কোনো ইনফরমেশন দিতে পারে-

-থ্যাঙ্কু স্যার।  থ্যাংকস টন।

দরজা অবধি এগিয়ে দিতে এসেছিলেন ইতিহাসবিদ।

"হঠাৎ মনে পড়ল, প্রচুর পড়াশোনা করত নীলকমল। "ডিস্টিঙ্কশন বিটুইন পাস্ট, প্রেসেন্ট অ্যান্ড ফিউচার ইজ অনলি স্টাবর্নলি পারসিস্টেন্ট  ইলিউশন'.... -  খুব আওড়াত। তোমার উপন্যাস শেষ হলে পড়িও কিন্তু। গুড লাক -"

গলির মুখে এসে একবার পিছন ফিরেছিল সাহিল। দেখেছিল, বড় চৌকো অন্ধকার বাক্সের একপাশে ছোটো উল্লম্ব আয়তাকার ক্ষেত্র , ম্লান হলদে আলোয় ইতিহাসবিদের লম্বা শিল্যুট, পিছনে পুরোনো সিঁড়ির আভাস আউট অফ ফোকাস হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ -গোটা ছবিটায় সাহিল শুধু অ্যাড করেছিল লাল সবুজ উড়ন্ত কিছু ফিগারিন, তারপর এই সন্ধ্যার যাবৎ আলো ছায়া, এবং জ্যামিতি মগজে পুরে নিয়ে মাফলারে কান, মাথা ঢেকেছিল

~*~

কালীমন্দিরের সামনের ফুটে প্রফুল্লর যখন মাথা চুলকে ওঠে, জানে এটা ফিলিম শুরুর সময়।  ওর চাঁদির ওপর যে সব ছোটো বড়ো মাঝারি ঘা- তার কোনো একটিতে হাত পড়লেই  রীলের পর রীল সাদা কালো ছবি যেন ওর কপাল ফুটো করে কির কির আওয়াজে বেরোতে থাকে - ফুটের উল্টোদিকের দেওয়াল জুড়ে  সিনেমা শুরু হয়ে যায় তখন।  কাঁসির গায়ে আলতো চাপড় দিতে দিতে প্রফুল্ল হাঁ করে দেখে,  লম্বা সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে হাফ প্যান্ট পরা একটা ছেলে ছাদে ওঠে, সাদা ঘুড়ি ওড়ায় কালো আকাশে - সিঁড়িটা এতই প্যাঁচালো যে ছেলেটা ছাদে পৌঁছোনোর আগেই ওর ঢুলুনি আসে-

এত সব ছবি তুললই বা কে আর ওর  মগজে  তা সেঁধোলো কেমন করে- প্রফুল্ল জানে না। মাথা টলটল করে ওঠে আর  নীল কম্বলকে তখন অনেক বড় লাগে  -মনে হয় কাউকে ডেকে বলে, অনেক জায়গা আছে এখানে- যা মেরে পাস-

ওর পাশে  তখন কাঁসি কিম্বা পটল কুণ্ডলি পাকিয়ে;  রাত বাড়লে, পাশের প্লাস্টিকের ওপর নাথু আর রঘুবীর এক কম্বলের তলায় ঢুকে যায়। সুনীল অনেকদিন আগে বিয়ের কথা তুলেছিল একবার- " কী রে প্রফুল্ল  কত বয়স হয়ে গেল তোর -পাকা চুল, দাড়ি- বিয়ে করবি তো বল।  মেয়ে আছে একটা”; মিষ্টির দোকানে কাজ করত  অষ্টমী।  সকালে, বিকেলে দোকান মুছতে আসত তারপর সুনীলের বাড়ি যেত- রুটি করতে।

- অষ্টমীকে বিয়ে করলে একটা ঘর ছেড়ে দেব তোকে প্রফুল্ল। ভেবে দেখিস। ভালো রুটি করে মেয়েটা।  খুব নরম রুটি রে প্রফুল্ল। খুব নরম। কী রে রাজি?

-বিলকুল নহী

-কেন?

-ম্যয় কোন হুঁ বতা

"তুই তো প্রফুল্ল", থতমত খেল সুনীল।

-মিস্টার ইন্ডিয়া হুঁ ম্যায়-

-যত্ত ইয়ে, অষ্টমীকে পছন্দ কী না বল-

"করতে হ্যায় হাম প্যার মিস্টার ইন্ডিয়া সে" শিস দিয়ে উঠেছিল  প্রফুল্ল, সটান হাঁটা মেরেছিল মন্দিরের দিকে। বছরখানেকের মধ্যে একদিন আচমকাই বেপাত্তা হয়েছিল অষ্টমী। সুনীলের মেজাজ তিরিক্ষি ছিল অনেকদিন।

~*~

আজ মন্দিরের সামনে কাউকে শুতে দিচ্ছে না-কাল কে যেন আসবে; নাথু বলছিল, " ভি আই পি " কপিল বলল- "না মন্ত্রীজী।" রঘুবীর চেঁচিয়ে বলেছিল, " মন্ত্রীর নামই ভি আই পি, চুপ হো যা।"সন্ধ্যার পরে ফুটপাথে সাদা পাউডার  ছড়ালো জন দুই লোক তারপর দড়ি দিয়ে ঘিরে দিল জায়গাটা, লাল কাপড় পেতে কয়েকটা ফুলের টব সাজালো। তারপর পুলিস এল- চেয়ার পেতে বসে রইল। রঘু, কপিলরা কোথায় ভেগে পড়েছিল। প্রফুল্ল  প্লাস্টিক আর কম্বল নিয়ে একটা শোয়ার জায়গা খুঁজছে অনেকক্ষণ, কাঁসি ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিল- লাইটপোস্টের নিচে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়েছে এখন।  প্রফুল্ল কাঁসির পাশে প্লাস্টিক পাতল।  কম্বল টেনে মাথা ঢাকতে যাবে, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ছুটে গেল একটা শাদা ঘোড়ায় টানা সোনালি রথ- খটাখট খটাখট আওয়াজ হচ্ছিল ঘোড়ার খুরে লাল নীল সবুজ ঝিকিমিকি আলো, গান বাজছিল , কাগজ ছড়িয়ে পড়ছিল রাস্তায়। আই ব্বাস- সারে রঙীন - অসলি আদমি, অসলি ঘোড়া- ইয়ে তো  ফিলম নহী-

অনেক রাতে  রথটা আবার এসেছিল। ঘোড়ার খুরে খুরে মাটির কাঁপুনি টের পাচ্ছিল প্রফুল্ল। কাঁসি কান্নার মত আওয়াজ করে সরে এসেছিল প্রফুল্লর দিকে- কম্বল সরিয়ে প্রফুল্ল  রথের ওপর ধর্মেন্দ্র আর হেমামালিনীকে দেখেছিল একদম স্পষ্ট। ধর্মেন্দ্র খুব হাসছিল।  হেমামালিনীর কোমর জড়িয়ে  চুমুক দিচ্ছিল বোতলে।

-বেলাপুর রামগড় ফতেপুর কাঁহা যাওগে বোলো

শূন্যে বোতল  ছুঁড়ল ধর্মেন্দ্র - হাউইয়ের মত হুউস করে উঠে লাইটপোস্ট ছুঁয়েই  আছাড় খেলো রাস্তায়।  আলোর ডুম ফটাস করে বার্স্ট  করার ঠিক  আগের মোমেন্টে হেমাকে অষ্টমীর মত লাগল প্রফুল্লর -

-চল ধান্নো।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শীত-

 

বিকেল শেষ হওয়ার আধঘন্টা আগে স্মিতা  অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আসছে। ওর পিছন পিছন হাসপাতালের ইউনিফর্ম পরা দুটি ছেলে স্ট্রেচার ধরে জেম্মাকে নামিয়ে আনছিল যত্ন করে। সদর হাট করে খুলে পায়েল ছুটে বেরিয়ে এসেছিল-  দু’হাত কপালে ঠেকালো তারপর স্ট্রেচারের এক কোণ ধরল -"দিদা, দিদা- কত রোগা হয়ে গেছ-"

অক্সিজেন সিলিন্ডার , ফাউলার বেড, এয়ার ম্যাট্রেসের ব্যবস্থা করেছে স্মিতা। হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী আপাতত কিছুদিন ওষুধ, ইনজেকশন চলবে; 'পাড়ার ডাক্তারবাবুর রেগুলার চেক আপ - স্মিতা কথা বলে রেখেছিল। বাড়িতে ঢোকার সময় জেম্মা চোখ বুজেই ছিল। অ্যাম্বুলেন্সে স্মিতা আগাগোড়া পাশে- জেম্মার খালি হাত, কোঁচকানো চামড়া, নীল , সবুজ শিরা , কব্জির কাছে লিউকোপ্লাস্ট;    হাসপাতাল থেকে বাড়ি -অনেকখানি পথ, খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে শহরে- অ্যাম্বুলেন্স গাড্ডায় পড়তেই থরথর করে কাঁপছিল জেম্মা; এবার নিজের বিছানায় শুয়ে চোখ খুলে বলল- "নতুন নার্সিংহোম ?"

পায়েল জেম্মার শুকনো ঠোঁট মুছিয়ে দিচ্ছিল, জল খাওয়ালো তারপর। অ্যাম্বুলেন্সের  টাকা মিটিয়ে দিচ্ছিল স্মিতা,  পায়েলকে বলছিল এই চেয়ারটা সরাতে, টেবিলটা ঠেলতে- জেম্মার ঘরে আরেকটু জায়গা হোক। কাল পরশু  থেকেই  আত্মীয়স্বজন দেখতে আসবে- তাঁদের জন্য মিষ্টি টিষ্টি এনে ফ্রিজে রাখতে বলছিল। তারপর পূবদিকের জানলাটা খুলে দিয়ে বলল- "নিজের ঘর চিনতে পারছ না জেম্মা? দেখো এদিকে- যে বকুল গাছ, যে পুকুর- দ্যাখো দত্তদের ছাদ- দেখতে পাচ্ছ?"                                    " সব কেমন ঘোলা ঘোলা ", জড়িয়ে জড়িয়ে বলছিল জেম্মা। বাস্তবিকই অন্ধকার হয়ে আসছিল, স্মিতা ইতস্তত করে জানলা বন্ধ করল- মশা ঢুকে যাবে নয়তো।  পায়েল আলো জ্বালাচ্ছিল, তারপর জেম্মার পুজোর আসনের সামনে ধুপকাঠি নাড়াল, শাঁখ বাজিয়ে ছোটো ছোটো লাল কাপড় দিয়ে কালীর  ছবি, লক্ষ্মীর পট ঢেকে দিতে লাগল। সরস্বতীর পায়ের পাতা, হাঁসের মাথা আর পাখার খানিকটা বেরিয়েছিল। পায়েল বলল- "দিদি, থান কাপড় কিনে এনো এরপর। ধুতে ধুতে সব খেপে যাচ্ছে। আগেরবার ওকে বলেছিলাম, নতুন বাজার থেকে কিনে এনেছিল, কোয়ালিটি ভালো না- " 

- পরশু কিনে আনব। কাল হবে না। তুই ক্ষিতীশকে খবর দিস তো পায়েল, পুকুরের পাশে আবার জঙ্গলমত হয়েছে। পরিষ্কার  করে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়াতে হবে।

 -দিদাকে টিভি খুলে দেব, যদি গান শোনে?

 - খুলে দে। তবে আজ অনেক ধকল গেছে, এই শরীরে অ্যাম্বুলেন্সের ঝাঁকুনি- ঘুমিয়ে পড়বে এক্ষুণি। ভাত বসিয়ে দে বরং। ধনঞ্জয় ওষুধ নিয়ে ফিরলে খাইয়ে দেব। 

 -এসে যাবে দোকান থেকে ফোন করেছিল, যখন অ্যাম্বুলেন্স ঢুকল।

জেম্মার হাতের কালশিটেয় মলম লাগাচ্ছিল স্মিতা- আলতো করে আঙুল ঘুরিয়ে আনছিল- ওর প্রতিটি স্পর্শের সঙ্গে শৈশবের সুখস্মৃতি জড়িয়েছিল, আঙুলের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে স্মৃতির দল একটা বিন্দুতে এসে থামছিল ,  ছড়িয়ে পড়ছিল আবার জেম্মার চোখ বোজা, সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে;  একটু আগে যে জলটুকু খাইয়ে গেছে পায়েল, মুখ মোছানোর পরেও তার এক ফোঁটা লেগে আছে ঠোঁটে। পায়েল রান্নাঘরে  গিয়ে ভাত বসিয়েছিল। তারপর আটা মাখবে। দরজায় বেল বাজল এই সময়।

 -কে রে পায়েল? তুই দাঁড়া। আমি খুলছি।

 - এসেছে দিদি।  তোমাকে উঠতে হবে না। এই তো, আমি দেখছি।

স্মিতার হাতে ওষুধের প্যাকেট, প্রেসক্রিপশন দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল ধনঞ্জয়।  পায়েল চায়ের জল চাপাল- স্বামী স্ত্রীর কথা হবে এখন। স্মিতা টিভির রিমোট  নিল;  খবর শেষ হয়ে নাচ গান হচ্ছিল জোরদার- ভলিউম কমালো স্মিতা। ওর মোবাইলে মেসেজ ঢুকছিল  দুপুর থেকে - ছোড়দা, বিপ্পু, ফুলদি, মন্টি- জেম্মা কেমন আছে , জানতে চাইছিল সবাই। পঙ্কজ সকালে মেসেজ করেছিল-" আজ ছাড়া পাবে জেম্মা?"  স্মিতা হাসপাতালে রওনা হচ্ছিল সে' সময়-  এখন  মেসেজ পাঠিয়ে স্মাইলি দিল।

~*~

আজ সারাদিন ঝগড়া করেছে সনৎ। সকালে বাসে একপ্রস্থ, তারপর অফিসে তন্ময়ের সঙ্গে- অ্যাজ ইউজুয়াল। এই শহরে সবাই তেতে আছে  সনৎএর মত- যেন প্রতিটি লোক জুয়াড়ি , যেন প্রতিটি লোক  একটা হেরো ঘোড়ার ওপর নিজের জীবন বাজি ধরেছে,আর সেহেতু  প্রতিটি সেকন্ডে নিজের নাড়ি ধরে হার্টবীট মাপছে, তারপর তেড়েফুঁড়ে শ্বাস নিচ্ছে যেন এই শেষবার। সবার ঘোলাটে চোখ, ছুঁচোলো ঠোঁট, নিঃশ্বাস নেয় ঘন ঘন-  সনৎএর নিজেকে কানেক্টেড  মনে হয়। আজ সকালের বাসে লোকটা এনারসি, সি নিয়ে খুব চোপা করছিল, সনৎ কিছু বলে নি- জানলার বাইরে তাকিয়ে রাস্তা দেখছিল আপাতনিস্পৃহ, অথচ কান ছিল সজাগ- যেন লোকটার রেসের ঘোড়াকে চিনে  নিতে চাইছে। মালটা হঠাৎ টপিক চেঞ্জ করে বিক্রম আর প্রজ্ঞান তুলতে ওর মাথা গরম হয়ে গেল।  যেন লোকটা নিয়ম ভেঙে দুটো ঘোড়ার ওপর বাজি ফেলেছে -  যার মধ্যে একটা সনৎএর -যার ওপর বাজি ধরার আর কারোর এক্তিয়ার নেই। নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে লোকটার হাত সরাতে মরিয়া হ'ল সনৎ-“মহাকাশের তুই কী বুঝিস?”

সনৎ চোখ মুখ লাল করে চিৎকার করছিল। লোকটাও। বাসে দুটো সাইড তৈরি হয়ে গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে- যেন ডারবি ম্যাচ শুরু ' এইমাত্র, গ্যালারিতে মেক্সিকান ওয়েভ উঠেছে, তারই মধ্যে এক পক্ষের লোক ক্রমাগত শিফ্ট করছে অন্য পক্ষে; ফলত তালেগোলে পিণ্ড পাকানো কিছু অবয়ব তালি বাজাচ্ছে, সিটি মারছে;  সনৎ অনর্গল  বকে যাচ্ছিল- চাঁদের সত্তর ডিগ্রী অক্ষাংশের কথা বলছিল,  ক্রেটারদের কথা বলল- মানজিনাস সি, সিমপেলিয়াস  এন;  সফ্ট ল্যান্ডিংএর কথা বলতে বলতে ওর কপালের বাঁ দিকে শির ফুলে গেছিল, থুতু ছিটকোচ্ছিল-" ক্কী ক্কী জ্জানিস শ্শালা তোরা?" শিয়ালদা আসতে  না আসতে একটা ভীড়ের ঢেউএর সঙ্গে চেঁচাতে চেঁচাতেই নেমে গিয়েছিল।

তন্ময়ের সঙ্গে ঝগড়া অফিসের কাজকর্মের মধ্যেই পড়ে গেছে আজকাল।   ফুটপাথে চা খেতে খেতে একচোট হল ; তন্ময় আজ মিঠুর কথা তুলেছিল; বলেছিল- "বৌদি চলে গেছে গেছে বেশ করেছে। তুমি এক জিনিস মাইরি। কিছু না জেনে না বুঝে গাঁটের মত চেঁচাও। সায়েন্সের কিছু জানো তুমি?"  তন্ময় যেই বলল বৌদি, সনৎএর মুণ্ডুর  মধ্যে সিটি  মেরে ঢুকে পড়ল কনে চন্দন পরা হাইড্রোজেনের মেঘের দল, তন্ময়ের কলার ধরতে গিয়েও হাত ঢুকিয়ে ফেলল পকেটে।

সন্ধ্যায় একটা লতানো চারা কিনল সনৎ, নার্সারি থেকে বলেছিল - জুইঁ। শীত শেষ হয়ে আসছে- এই সময় শহরে জুইঁচারার লভ্যতা সম্বন্ধে সন্দিহান হলেও কিনেই নিল শেষ মেশ।  ছোটো মাটিমাখা টবে লকলকে সবুজ চারা লম্বা কাঠিতে লতিয়ে আছে। একটা সাদা  ফুল ফুটেছে, দু তিনটে কুঁড়ি- ফুলশয্যার বালিশের বাস পাচ্ছিল সনৎ। তারপর ডানকাঁধে ব্যাগ, বাঁ হাতে কালো প্ল্যাস্টিকে জুইঁচারা নিয়ে বাসে ওঠার চেষ্টা করল ফ্লাইওভারের সামনে থেকে- চারটে বাস ছেড়ে অগত্যা শেয়ারের ট্যাক্সি নিল; জুইঁচারাকে অক্ষত রাখতে গুঁতোগুঁতির পাশ কাটাল সন্তর্পণে। বেলগাছিয়ার পরে ট্যাক্সি এগোচ্ছিল না- বক্তৃতা হচ্ছিল মোড়ের মাথায়, বিশাল মিছিল আসছিল পতাকা টতাকা নিয়ে। সনৎ নেমে পড়ল- তারপর জুইঁচারা নিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটতে লাগল। সাহেবগলির মুখে গিয়ে দাঁড়াবে। মিঠু এই সময় ফেরে।

~*~

জেম্মাকে খাওয়াতে বসেছে স্মিতা। পায়েল আর ধনঞ্জয় সিরিয়াল দেখছিল। টুকটাক ফোন আসছিল ল্যান্ডলাইনে- জেম্মার খবর নিতে মূলত- স্বামী স্ত্রীতে সামলে নিচ্ছিল । জেম্মাকে সোজা করে বসিয়ে বাটিতে  ভাত মেখে চামচ করে খাওয়াচ্ছিল স্মিতা।  তৃপ্তি করেই খাচ্ছে জেম্মা-ছোটো ছোটো ঢেকুর তুলছে , আবার হাঁ করছে। নিজের ঘর, বিছানা, খাবার ভাল লাগছে জেম্মার- বুঝতে পারছিল স্মিতা। আর হাসপাতালে না রেখে বাড়ি নিয়ে আসার ডিসিশন ঠিকই হয়েছে। আজ ছোড়দাও বলছিল-" যে কদিন আছে, নিজের ঘরে তোর সেবাযত্ন পাক - এই তো চেয়েছে বড়মামী  সারাজীবন। তোর বৌদিকে নিয়ে রবিবার আসব। মামী কি হরলিক্স খায় রে? না আপেল আনব?"

গলিতে রিক্সা যাচ্ছে, রুটের অটো।  বড় রাস্তার দিকে কোথাও মীটিং হচ্ছে- আবছা আওয়াজ আসছিল, গলিতে কুকুরের ডাক, একটা মেয়ে চলে গেল মোবাইলে কথা বলতে বলতে; স্মিতার গত পঁচিশ বছরের জীবন ক্রমশ আবছা হয়ে  যাচ্ছিল- আবছা আর অলীক। স্মিতা মাথা নামিয়ে দেখছিল,  জেম্মার ঘরের লাল মেঝের দখল নিচ্ছে ভূগোল খাতার নদী, উপনদী, শাখানদীর মত ধূসর ফাটল সব; একটা  কালো পিঁপড়ে জেম্মার খাটের পায়া বেয়ে এসে স্মিতার বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে শাখানদীতে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।

সকালে জেম্মার মশারির খুঁট খুলছিল স্মিতা, ডায়াপার বদলালো। জানলার পাল্লা খুলতে  গ্রিলের ছায়া পড়ল প্রাচীন লাল মেঝেতে, সূর্যের আলোর পথ বেয়ে সূক্ষাতিসূক্ষ্ম ধুলোর কণা ঢুকতে লাগল ঘরে-

-দিদি, সরো। আমি করে দিচ্ছি।

- দিকের জানলাটা  টাইট করে বেঁধে রেখেছিস কেন রে? খুলতে পারলাম না কিছুতেই

- পাশের বাড়ির যে লোকটা- লম্বা মত- বৌ ছেড়ে চলে গেছে বললাম না সেদিন?

স্মিতার মাথার  মধ্যে ঠকঠক আওয়াজ শুরু করল শব্দগুলো- কান গরম হল ওর, একটু কাশল। জল খেলো,  তারপর  গলা ঝেড়ে বলল- "হ্যাঁ, তো? কী হয়েছে তাতে?"

- লোকটা ছাদে একটা ইয়াব্বড় দূরবীন লাগিয়েছে

-দূরবীন?

-একটা লম্বা চোঙার মত ; বলল- দূরবীন। ওখানে চোখ লাগালে আমাদের ঘরের ভিতর অবধি দেখা যাবে না নাকী-

-কে বলল? ধনঞ্জয়?

-হ্যাঁ, ও বলল। দিদি , লোকটা কিন্তু হেব্বি বদ। জানো ?

- সে কী করে জানব? তোরই বা অত খবরে কী দরকার?

-মন্টুর মা আছে না? বাড়িতে কাজ করে তো - আমাকে বলেছে।  লোকটা আগে এখানে থাকত না দিদি- অন্য ফ্যামিলি ছিল-  ভাড়াটে বোধ হয়।

- জানি। শিখাজেঠিমার ছেলে।  মামাবাড়িতে মানুষ-

-তুমি চেনো?

-পাশের বাড়ি, চিনব না? অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল শিখা জেঠিমা। স্টোভ ফেটেছিল। আমরা তখন স্কুলে পড়ি। সোনুকে  ওর মামারা নিয়ে যায়- আর দেখি নি তারপর।

জানলার পাল্লার সঙ্গে গ্রিলে বাঁধা দড়ির গিঁট খুলতে যতটা সময় নেয়, তার মধ্যে শিখা জেঠির মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছিল স্মিতা। পুড়ে যাওয়া শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল, কপাল ভরা সিঁদুর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্মিতারা দেখেছিল। সোনু হাঁ করে দাঁড়িয়ে, পাশে কেউ ওর হাত ধরে ছিল-                                                 সেই ছেলেটা বদ লোক? সময় কত বদলে দেয় সব - আশ্চর্য লাগছিল স্মিতার, যেন এই প্রথম মনে হল কথাটা।

-পায়েল, ধনঞ্জয় বাজারে বেরিয়ে গেছে?

-- না দিদি ডাকব?

-ওকে একটা নাম, ঠিকানা দিয়েছিলাম, খোঁজ  নিয়েছে? 

-সাহেব গলি তো? খোঁজ করছে বলল। ওদিকে পুজোর পরে সেই যে বোমা ফেটেছিল না?  তারপর অচেনা লোক  ঘুরঘুর করছে দেখলেই পুলিশ হুড়ো দিচ্ছে - তো তাই বলল। দু' তিনদিন গিয়ে ফিরে এসেছে।

- আমাকে বললেই তো পারত-

- হাসপাতালে এত ছোটাছুটি চলছিল, আর বলে নি। আবার যাবে বলেছে- ক’টা দিন যাক।

~*~

ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে  দাঁড়িয়েছিল সনৎ - থিওরি অ্যাবাউট এভরিথিংএ হকিং যেমন দাঁড়িয়েছিল জেনের জন্য- হুবহু সেই ভঙ্গি -যেন মিঠু এসে দাঁড়ালে পকেটে হাত দিয়ে একটু ঝুঁকে ওকে দেখে নেবে সনৎ তারপর হাত ধরে গ্র্যান্ড বলে ঢুকবে। সেখানে একটা বেগুনি নীল আলোর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকবে দুজনে- মুখ টিপে হাসবে মিঠু- ব্যাকড্রপে ঘুরপাক খাবে ক্যারোসেল।  সনৎ বলবে- “হোয়েন স্টারস আর বর্ন, হোয়েন দে ডাই, দে এমিট ইউভি রেডিয়েশন। সো ইফ উই কুড সী দ্য নাইট স্কাই ইন আল্ট্রাভায়োলেট লাইট, দেন অলমোস্ট অল দ্য স্টারস উইল ডিজ্যাপীয়ার। অ্যান্ড অল দ্য হোয়াট উই সী আর দীজ স্পেক্টাকুলার বার্থস অ্যান্ড ডেথ” ... তখন বাজি পোড়ানো হবে এই গলির  মোড়ে।  বাস , অটো, মানুষজন থমকে গিয়ে আকাশে তাকাবে- হুউশ করে আকাশে আলোর বিন্দু উঠবে একটা, তার থেকে সহস্রবিন্দু- আকাশ ফুঁড়ে আগুনের গাছ গজাবে;  আর সনৎ তখন মিঠুর সামনে হাঁটুমুড়ে বসবে-" সফ্ট ল্যান্ডিং হয়ে গেলে ফিরে আসবে তো মিঠু? ফিরে এসো। তারপর  আমাদের  দুটো ছেলে হোক - বিক্রম আর প্রজ্ঞান? প্লীজ মিঠু। প্লীজ।  কী রাজি?  এই , এই মিঠু, রাজি তুমি?"

 

বসন্ত-

 

টুম্পা চা পাঁউরুটি খেয়ে কাপ টাপ ধুচ্ছিল। জল ভরল ফিল্টারে। টুম্পার মুখে মাণিকের আদল। ছন্দা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে খবরের কাগজ নাড়াচাড়া করল খানিক। রাশিফল দেখল। তারপর আলনা থেকে শাড়ি ব্লাউজ নিল , বারান্দার তার থেকে তোয়ালে টানল- 

- টুম্পা, স্নানে গেলাম রে। বেরিয়েই রান্না বসিয়ে দেব। মামা বাজার থেকে ফিরলে লাউটা কেটে রাখিস। আর যদি মোচা আনে, আজ আর কুটিস না। ঝুড়িতে রেখে দিবি। মাছ ধুয়ে নুন হলুদ মেখে রাখিস। গুলগুলেটা মহা চোর। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করবি খেয়াল করে।  বুঝলি?

- মামা আজ বড্ড দেরি করছে , না মাসি?  অন্যদিন এই সময়ে তো এসে যায়। একবার ফোন করে দেখো না-

- আসবে এখনই।  পকেটে ফোন বেজে উঠলে বাজারের ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে সামলাতে পারবে না- মাঝখান থেকে এক কেলেঙ্কারি হবে রাস্তায়। তোর দেরি হলে তুই বরং  বেরিয়ে পড়িস।

-সে ঠিক আছে, আসলে আজ একবার কাউন্সিলরের কাছে  যেতে হবে- মা তো এসব পারে না-

- টাকা পয়সার ব্যাপারে?

- হ্যাঁ। মামা আজ  একটা চিঠি লিখে দেবে বলেছে, সেটা নিয়ে  যাব-

-তাহলে  মামা ফিরলেই চলে যাস , দেরি করিস না।  আমি সব  কেটে কুটে নেব- তিনটে প্রাণীর তো রান্না, মিঠু হয়তো রাতে খাবেও না; আরে, এতদিন তো সবই করেছি একা হাতে- এখন যত ইয়ে..

ছন্দা গজগজ শুরু করল।

- মাসি? একটা কথা জিগ্যেস করব?

- বল

-মামা তোমার নিজের ভাই ?

- না

বাথরুমে ঢুকে গেল ছন্দা।

~*~

- রিক্সা নেন না কেন? ভারি ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছেন?

বিপ্লব মুখ তুলে দেখল,  থানার এস আই- ব্লাস্টের পরেই একবার বাড়িতে এসেছিল ডিসেম্বর নাগাদ। এখন কথা বলতে বলতেই সিগ্রেট ধরাল,  তারপর দেশলাইয়ের পোড়া কাঠি জুতোয় পিষে  এগিয়ে এল । সিগ্রেটের ধোঁয়া বিপ্লবের নাকে ঢুকে যাচ্ছিল,  বাজারের ব্যাগ ভারি লাগছিল ; পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে কপাল মুছে নিল সে রাস্তায় ছাই ঝাড়ল এস আই:  "আজই ফোন করতাম; দেখা হয়ে ভালই হল।  কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল আপনাকে। বিকেলে বাড়ি থাকবেন?"

- কী প্রশ্ন বলুন।

- রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কথা হয়? কিছু ইনফরমেশন লাগবে আর কি-

- ইনভেস্টিগেশন  শেষ হয় নি এখনও?

-'সব মামলার  অত সহজে কিনারা হয় না বিপ্লববাবু। আরে আপনি নার্ভাস হচ্ছেন কেন? 

- কী ইনফরমেশন দেব বলুন তো?  কোথা থেকে বোমা এল, কে বোমা রাখল মাণিকের ঝুড়ির পাশে- আমি কী করে বলব? পার্টির মধ্যে গন্ডগোল,  না ডাকাত টাকাতের ব্যাপার..

- আরে সে আমরা বুঝে নেব- ' তো আমাদের কাজ ; আপনি ব্যস্ত হবেন না। অন্য প্রশ্ন আছে।  বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়া করুন। বিকেলে আসি? না আপনি একবার আসবেন থানায়?

- আমিই যাবো। এই পাঁচটা নাগাদ গেলে হবে? কতক্ষণ লাগবে?

-থ্যাঙ্ক ইউ। একঘন্টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারবেন। জাস্ট  দু' একটা ব্যাপার ক্লীয়ার হলেই-

~*~

শীত চলে গেছে , তবু বাস থেকে নেমেই হাল্কা চাদর  দিয়ে মাথা ঢাকল মিঠু। আর লাইটপোস্টের তলা থেকেই ওর সঙ্গ নিল মশারা-ঝাঁক বাঁধল মাথার ওপর।  গলির বাতাসে ধোঁয়া আর  ড্রেনের গন্ধ চাপ ধরে ছিল। রাস্তার বাতি জ্বলে উঠছিল এক এক করে। অন্ধকার আকাশের গায়ে নতুন সব ফ্ল্যাটবাড়ি- তাদের ঘরে ঘরে নীলচে সাদা আলো তারার মত জ্বলে;  তারারা এত কাছে চলে এলে  চমকে ওঠে মিঠু- কী বদলে যাচ্ছে গলি; অথচ বেদনার পরিবর্তে নির্ভার লাগে তার-  আর 'বছর পরে 'পাড়ার কেউ তাকে চিনবে না, কে তার বাবা, মা, মামু - জানবেও না কেউ,  মিঠুর বরকে নিয়ে ,  মোটা হওয়া নিয়ে কারোর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকবে না- বস্তুত কেউ তার দিকে তাকিয়েও দেখবে না ;  অচেনা মানুষেরা একই গলি, একই পাড়ায় পাশাপাশি ঘুরে বেড়াবে দিনের পর দিন- যেন মাল্টি লেন হাইওয়ের সাদা কালো সোনালী রূপালী লাল নীল সবুজ গাড়ি সব।পাশের বাড়ির মীনা আর সুধীন গলির মুখে ফুচকা খাচ্ছিল, লেন চেঞ্জ করল মিঠু

এদিকটায় ত্রিফলা লাইট আসে নি,  মিটমিটে আলোয় গলির বাঁকগুলো রহস্যময় লাগছিল;   এক এক দিন এরকম হয়- যেন প্রথম বাঁকের মুখে যে স্টেশনারি দোকান, সেটা জাস্ট নেই হয়ে যেতে পারে  মিঠুর পৌঁছোনোর আগেই, অথবা, তিন নম্বর বাঁক থেকে বাঘ বেরিয়ে আসতে পারে হঠাৎ। আলো খুঁজল সে । মিষ্টির দোকানে ফ্যাটফ্যাটে সাদা আলো- আজ অমৃতি ভেজেছে- ঘোর কমলা ,  ডাঁই করে রাখা; দোকানের সামনে ভীড় ছিল- খুরি, ঠোঙা, প্লাস্টিক হাতে মানুষজন যাওয়া আসা করে;  বাঁ দিকে জটলা করে দাঁড়িয়ে মিষ্টি খাচ্ছিল জন- রসে চুমুক মেরে বাটিটা টান মেরে ফুটপাথে ফেলল খয়েরী শার্ট ; মিঠুর পেটে মোচড় পড়ল হঠাৎ- সনৎ ? একেবারে সনৎএর হাইট- চুলের ছাঁট, শার্টের রঙ, কাঁধের ব্যাগ- সব মিলে যাচ্ছিল;  মিঠু  চাইছিল  সটান দৌড় মারতে -ইচ্ছেকে পায়ে  ট্র্যান্সফার করতে গিয়ে বুঝল-পারবে না।  দ্রুত  মুখ ঘুরিয়ে রিক্সা খুঁজল তখন- বলাই  আসে নি। এবারে   সটান উল্টোবাগে, বাস রাস্তার দিকে হাঁটা লাগাল,   বাস স্টপের ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে  পিছন ফিরল তারপর।  দেখল, দোকানের সামনে সিগ্রেট ধরাচ্ছে লোকটা - সাদা আলোয় চাপ দাড়ি দেখল স্পষ্ট -  সনৎ নয়।

"দিদি 'দিকে কোথায় যাচ্ছেন?  এই তো আমি এসে গেছি।" বলাই হর্ন বাজালো।

নিশ্চিন্ত হয়ে রিক্সায় উঠল মিঠু।  অমৃতি থাক।  সামনের দোকান থেকে ক্রীম রোল নেবে -

-বলাই, একটু থামবে কৃষ্ণা স্টোর্সের সামনে?

-বাঁদিক সাইড করে রাখি দিদি।  আমাকে বলে দিন না কী আনতে হবে-আমি নিয়ে আসছি।

প্লাস্টিকের ঠোঙায় ক্রীম রোল আনলো বলাই।

-তুমি একটা প্যাকেট রাখো। মেয়েকে দিও।

হ্যান্ডেলে ক্রীমরোল ঝুলিয়ে প্যাডেল করছিল বলাই। মুখ ঘুরিয়ে কথা বলছিল টুকটাক- এখনই গরম পড়ে গেল, পর্শু সকালে জল আসবে না; তারপর তিন নম্বর বাঁক পেরিয়ে বলল, " দিদি, মামাবাবুকে পুলিশ হেনস্থা করছে কেন?"

- হেনস্থা? কে বলল?

- ক্লাবের ছেলেরা বলছিল। আজও এস আই কথা বলছিল-বাবলা দেখেছে

মিঠু ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল বের করে অন করল- ছন্দার মিসড কল তো নেই

- কই, মা তো ফোন করে নি। বাবলা কাকে দেখেছে -

-না দিদি, সবাই বলছে-  আপনি মামাবাবুকে জিগ্যেস করে নিন। তারপর ক্লাবে বলুন- পুলিশকে  একটু কড়কানি দিলেই হবে-

- তাড়াতাড়ি চালাও বলাই, শরীর খারাপ লাগছে।

বলাইকে টাকা দিয়ে  কলিং বেল বাজাল মিঠু টুম্পা দরজা খুলতেই ভাত ফোটার গন্ধ রান্নাঘর থেকে বসার ঘর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নেমে এল। 

- কী রে টুম্পা, মা কই?

-মাসি বেরিয়েছে। মামাও। থানায় গেছে। চা খাবে তো?

- থানায়?

শঙ্কিত দেখাচ্ছিল টুম্পাকে। বাইরের আলো জ্বেলে জানলার পাল্লা খুলতে খুলতে মিঠুকে  বলল- " পার্টির ছেলেরা পেটো  রেখেছিল। সেই ফেটে মরল বাবা। পুলিশ মামাকে কেন ডাকছে বারবার?"

-কী করে বলব! তুই বাড়ি চলে যা টুম্পা। আমি ভাত নামিয়ে নিচ্ছি। কাল সকালে আসিস।

-আমার তাড়া নেই। দুটো মুড়ি দিই দিদি? চায়ের সঙ্গে খাও।

~*~

ঘন্টাখানেক পরে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিল বিপ্লব। একটু পিছনে ছন্দা। টুম্পা ওড়না গুছিয়ে নিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে নামল। ছন্দা জিগ্যেস করল- “ভাত হয়ে গেছে?” বিপ্লবের ঘাড় ঝুঁকে পড়েছিল। হা- ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। পাপোষে পা মুছছিল এমন যেন গত ঘন্টাকে শরীর থেকে বের করে দিতে চাইছে। ঘরে ঢুকেই  ছন্দা চেঁচাতে  শুরু করবে-  আশঙ্কা করছিল মিঠু। কিন্তু ছন্দা চুপ, কিছুটা থমথমে-হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গেল রান্নাঘর থেকে  আওয়াজ আসছিল- কড়াই  খুন্তি আর গরম তেলের কম্বিনেশনে যেমন হয়।

ছন্দার কাছে মিঠুর শৈশব আজও কাটে নি ।  সে জানে, বেশি প্রশ্ন করলে মা তাকে কিছুই বলবে না, উল্টে  বিয়ে, সনৎ এই সব তুলে কান্নাকাটি শুরু করবে।  মামুকে জিগ্যেস করে সব জেনে নিতে মিঠু সামান্য  দ্বিধাগ্রস্ত ছিল- ওর মনের একটি অংশ এই মুহূর্তে জেনে নিতে চাইছিল থানায় কী হল- অন্য অংশ সময় দিতে চাইছিল বিপ্লবকে।

বেগুন ভাজার গন্ধে ঘরের পরিবেশ সহজ হয়ে আসছিল। টিউব লাইটের আলো ঘরময়, বারান্দার আলোর নিচে টবের ক্যাকটাস;  কুন্তী, গুলগুলে সোফায় গোল্লা পাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল, পুরোনো সব  ছবির আড়াল থেকে মুখ বের করছিল গায়ে ছিট ছিট টিকটিকি- এই সব মুহূর্তগুলো অদ্ভুত - মিঠুর খিদে পাচ্ছিল আবার;  মনে হচ্ছিল, যেন কিছুই ঘটে নি, যেন যাবৎ মৃত লোকজন বেঁচে বর্তে আছে-  যেন অফিসফেরতা  ট্রেন থেকে নেমে কমলালেবু, সন্দেশ কিনছে স্টেশনের কাছে, একটু পরেই বাড়ি ঢুকবে কড়া নেড়ে। বারান্দা থেকে মুখ বাড়ালেই যেন দেখা যাবে,  মাণিক বেগুন বিক্রি করছে কুপি জ্বেলে। মুড়ি খাচ্ছে। মায়া জমছিল মিঠুর গলায়।  গলা খাঁকরে নিল সে-

-আমার কলীগ যে মৈনাক- দেখেছ তো- ওদের ফ্যামিলিতে বড় বড় উকিল, ব্যারিস্টার। ওকে বলি বরং। পুলিশ এত হ্যারাস করছে কেন তোমাকে -

- দ্যাখ মিঠু, সে তুই বলতে পারিস। কিন্তু একদিন কথা বলতে যে ফীজ নেবে- আমার তো এক পয়সা রোজগার নেই।  এ’সবের কী দরকার বল?

- টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমার- কথা বলে রাখা ভালো। হঠাৎ যদি অ্যারেস্ট করে-

-না না সে কেন করবে? বলল তো, সময় টময়্গুলো মিলিয়ে  নিচ্ছে কল লিস্ট ধরে-

-তাই বলল থানায়? এতক্ষণ ধরে?

-থানায় গেলে সময় লাগে।  জানা কথাই। গেলাম। তো, বসতে বলল। চা দিল।  এস আই নেই, নেই, নেই-কোন কেসে বেরিয়েছে- তারপর বাবুরা এলেন, কথা বললেন- ভয়ের কিছু নেই মিঠু-

- এতবার করে সময় মিলিয়ে নেওয়ার কী তাও তো বুঝি না। তুমি তো বলেই দিয়েছ, পরদিনের বাজারের ব্যাপারে ফোন করেছিলে-

- আসলে অনেকগুলো কল তো- আমি কেন মাণিককে অত কল করি- সেইটা বুঝতে চাইছে-

-করি মানে? রোজ ফোন করতে?

-সে তো করতামই। বাজার তো রোজই লাগে-

বিপ্লবের মুখের  দিকে তাকিয়ে মিঠুর অস্বস্তি হতে থাকে- মুখ লালচে হয়ে উঠেছে, কপালের দুপাশে দপদপ করছে সবুজ শিরা- চোখ একবার দেওয়ালে , একবার মাটিতে, পরক্ষণেই মিঠুর মুখে- না কামানো পাকা দাড়ি, চুল কাটে নি কত দিন।

-মামু, কী হয়েছে? আমাকে বলতে পারো- আমি মৈনাককে বলে-

-কিছু হয় নি  রে মিঠু। বলছি তো, কিছু হয় নি, ঘাবড়াস না। আসলে একটা বয়সে পৌঁছে, অতীতের সামনে দাঁড়াতে সবাই তো চায় না। তুইও হয়ত  চাইবি না একদিন।  তোর মা, তোর বাবা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। নইলে-

বিপ্লব চুপ করে গিয়ে জল খেল। তাড়াহুড়োয় বিষম খেয়ে কাশল , তারপর সামলে নিল।  টিভি চালিয়ে চ্যানেল বদলাতে লাগল তারপর। একটা কথাও বলল না আর।

মিঠু বিপ্লবের অতীত জানে না।  নিজের শৈশবের স্মৃতি বিশেষ নেই। বাবার বদলির চাকরি - মিঠুর শৈশব ঘুরে ঘুরে কেটেছিল। তারপর , আবাল্য বিপ্লবকে ' বাড়িতে দেখেছে। মামু বলে ডেকেছে তাকে। গল্প বলা, স্কুলের পড়া দেখিয়ে দেওয়া-   ভাবতে গেলে বাবার থেকেও  মামুর কথাই বেশি মনে হয় মিঠুর। ছোটোবেলা মানে অতীত। বিপ্লব অতীতের কথা বলছিল। ঘরে টিউব লাইটের আলো। সাদা দেওয়াল। সবুজ জানলার পাল্লা  খোলা। ফ্যান ঘুরছে। ডালে ফোড়ন দেওয়ার গন্ধ   আসছিল। চার দেওয়ালের মাঝে  এই সব সময় এক খাবল দার্শনিকতা আসে গৃহস্থের। সে আয়নায় নিজেকে দেখে,  ছোটোবেলার কথা ভাবে, বেড়ালছানাকে আদর করে খেতে বসে।  রাস্তার আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে তার পিঠে পড়ে তখন।

খবরের কাগজের হেডলাইনের ওপর চোখ চালিয়ে নেওয়ার মত, মিঠু দ্রুত  নিজের অতীত ভাবল- তার শৈশব, স্কুল, কলেজ, বাবা, মা, মামু।  তারপর চাকরি পাওয়ার দিনের  কথা ভাবল , আর বিয়ের কথা। সনৎএর  মুখ মনে করতেই ছ্যাঁত ছ্যাঁত  করল বুকের ভিতর। বসে থাকতে  পারছিল না মিঠু। অস্থির লাগছিল। খয়েরী শার্ট, চাপদাড়ি লোকটার কথা  মনে হল - সত্যি যদি সনৎ হত? বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল মিঠু-রান্নাঘর থেকে বসার ঘর, আবার রান্নাঘর। কুন্তী ঘুম ভেঙে ওর পায়ে পায়ে ঘুরছিল। ল্যাজ তুলে  পিঠ বেঁকিয়ে মিঠুর গায়ে গা ঘষছিল আগাগোড়া।  অতীত কতদূর বিস্তৃত হয় ভাবছিল সে; ভাবছিল  তার কাছের অতীত কী ভাবে দূরের অতীতকে খেয়ে ফেলেছে। মামুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়ত উল্টো- মিঠুর মনে হচ্ছিল।

 টিভিতে খবর শুরু হয়ে গিয়েছে - দশটা বাজল।

- মা, খেতে দেবে না?

এই সময় দরজায় বেল বেজেছিল। সনৎ, নিশ্চয়ই সনৎ -  বাথরুমে ঢুকে সটান ছিটকিনি তুলে দিল মিঠু। ছন্দার চটির আওয়াজ পেল - রান্নাঘর থেকে বাইরের ঘরের দিকে যাচ্ছে। আলো জ্বালল প্যাসেজের। মামুকে কিছু বলল দরজা খোলার আওয়াজ পেলো তারপর। ছন্দা এসে বাথরুমে ধাক্কা দিল- “শম্পা আর ওর বর এসেছে। বেরো। বেশিক্ষণ বসবে না ওরা।

"দেরি হয়ে গেল রে। বিকেলেই বেরিয়েছি। মাসিমাকে আর মামুকে কার্ড দিতে এসেছিলাম। তোর শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা নিতাম মাসিমার থেকে।  তোকে এখানে পেয়ে যাব ভাবি নি"-কার্ড বাড়িয়ে দিল শম্পা-  "ছেলের অন্নপ্রাশন। সবাই আসবি।  তুই, তোর বর, মামু, মাসিমা আপনি। তোর বরকে তো দেখিই নি।"  ছন্দা নিজের আর বিপ্লবের প্রেসার, সুগারের ফিরিস্তি শুরু করল গুনগুন করে- যাওয়া হবে না হয়ত, এই সব বলছিল।

খাম খুলে কার্ড বের করতেই যেন  নিজেকে দেখতে পেল  মিঠু- পাত পেড়ে রাধাবল্লভি, আলুর দম খাচ্ছে, ঘন ছোলার ডালে নারকেলের কুচি, এর পর ফিস ফ্রাই আসবে , সঙ্গে কাসুন্দি- সে যেন হাত তুলে আরো দুটো রাধাবল্লভি  দিয়ে যেতে বলছে- সাদা প্লেটের এক পাশে শেপ করে কাটা সবুজ শশা, বেগনে পেয়াঁজ - মুখ ভরে জল আসে। সনৎএর ভয় তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল মৃত লোকদের ছবির পিছন মুখ বের করেছিল টিকটিকিরা, কুন্তী আর গুলগুলে গা ঘষছিল পায়ে; আচম্বিত  বড় সুখবোধ হল মিঠুর,  বলল- "যাব তো। নিশ্চয়ই যাব।"

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বসন্ত-

 

লিপিরা নদী পেরোচ্ছিল। টানা লম্বা ব্রিজ বেয়ে এবারে ঢালুর দিকে  নামছে গাড়ি; দূর থেকেই জলের বিস্তার চোখে পড়ছিল, কাছে এসে ছলাৎ ছলাৎ শোনা  যাচ্ছে-  সকালের রোদ পড়েছে জলে, নিচু নিচু ঢেউ উঠছিল সার দিয়ে, তারপর ভেঙে যাচ্ছিল ; নদীর পাশের রাস্তা ধরে বোটশেড, ছোটো ক্যাফের সামনে উইকএন্ডের সামান্য দেরিতে ঘুম ভাঙা মানুষজন- তাদের ঢিলে ঢালা পোষাক, চপ্পল, অক্ষৌরিত,  মেকাপবিহীন মুখ- কালো চশমায় সকালের রোদ ঝিলিক দিচ্ছিল, সঙ্গে কুকুর, অথবা বই কিম্বা বাইসাইকল, আর বসন্তদিনের রৌদ্রসঞ্জাত এই খুশিটুকু ; বড় একটা পার্ক দেখা যাচ্ছিল- ঘন সবুজ ঘাস, লাল, নীল স্লাইড, দোলনা টোলনা। জিপিএসের কথামত গাড়ি ঘোরাচ্ছিল সুবিমল; কিছুদিন ধরে বাড়ি কেনার সাইটগুলোতে সার্চ করছে - এলাকা, দাম এই সব খুঁটিয়ে দেখে, লিস্ট করেছে। এজেন্টের সঙ্গে কথা বলেছে তারপর। এখন প্রতি উইকএন্ডে লিপি আর তিন্নিকে নিয়ে একটা, দুটো  বাড়ি দেখে আসা রুটিন হয়ে গেছে; হয়তো বড় রাস্তার ওপরে বাড়ি - উফ বড্ড আওয়াজ;  কিম্বা হয়ত  সে বাড়ি নির্জন রাস্তায়, গাছ ভরে ফুল টুল- তো, তিন্নি একা স্কুল থেকে ফিরবে কী করে! কোনো বাড়ি ছায়া ছায়া- রোদ ঢোকে না, কোনো বাড়ির সব ভালো- বড্ড দাম- এই সব চলছে-

লিপির ভালো লাগছিল এই নতুন ধরণের শনিবারগুলো- কত রকম ঘর দোর হয়; ঝাঁ চকচকে নতুন বাড়ি হয়তো - সে সব ঘরে ঢুকতেই রঙের গন্ধ পাওয়া যায়, নিঝুম সাদা দেওয়াল ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকে লিপিদের দিকে; আবার কিছু বাড়ি যথাবিহিত প্রাচীন, কাঠের মেঝেয় পেরেক উঠেছে, খেয়াল করলে দেওয়ালে হাইট চার্ট দেখা যায়- পেন্সিলের রেখা আবছা হয়ে এসেছে যদিও; পিছনের ঘাসজমিতে রঙ চটা কেনেল,  লাল নীল বল, ঝুপসি গাছে  লম্বাটে ফল ধরে আছে - কত কী ভেবে বাড়ি করে মানুষ, তারপর বেচে দেয়-

ড্রয়িংখাতায় ছবি আঁকছিল তিন্নি; এমনই নিমগ্ন যে মনে হচ্ছিল, এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত তাদের অক্ষাংশ , দ্রাঘিমাংশ সমেত ধরে রাখার গুরুদায়িত্ব ওর ওপর বর্তেছে। গাড়ির পিছনের সিটে খাতার ওপর ঝুঁকে পড়ে ছবি আঁকছিল সে, স্কেচপেন ঘষে ঘষে রং লাগাচ্ছিল - বাড়ি , গোল্লাকাঠি মা, বাবা, খুকী, সূর্য, পাখি , গাছ টাছ, নদীর জলে নীল হলুদ মাছও দেখা যাচ্ছিল।  সেই সব ছবিতে বাড়ি ঘরের ছাদ সমতল , কোনো চিমনি ছিল না তাতে- লিপি খেয়াল করে দেখেছিল।

রোদ, ছায়ার নকশায় দূরে টিলার ওপরে সবুজের বিচিত্র শেড-   লিপি ছবি তুলল তারপর জানলার কাচ নামাল; উল্টোদিক থেকে গাড়ি আসছিল সাঁ সাঁ করে, হাওয়া কাটার আওয়াজে মনে হচ্ছিল পাখা ঝাপটাচ্ছে গাড়িরা, নদীর ওপর সেতু যেন রানওয়ে হয়ে গেছে আচমকাই যা পেরিয়ে গিয়েই টেক অফ করবে গাড়ি; উইন্ডস্ক্রীনের ওপর তুলোর আঁশ উড়ে আসে- এই বসন্তে হঠাৎ তাদের পাখি বলে ভ্রম হয়ে যায়। লিপি এক বুক হাওয়া টেনে ছেড়ে দিল-

সুবিমল লিপিকে আড়চোখে দেখলঃ "কেমন বুঝছ?"

-ভাল তো- কী সুন্দর। নদী, গাছ...বাড়িটা ঠিকঠাক হলেই-

- আরে আসল কথাই তো বললে না! দামটা যদি সাধ্যে কুলোয় তবেই না!  স্পেসিফাই করেনি কিছু-

- সাধ্যের মধ্যে 'লে হবে। না হয় তো না- কিছু না হোক, আউটিং তো হল।

মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গেল সুবিমল।

-আর কত আউটিং লিপি?

-বেশ লাগে ঘুরতে- কত নতুন জায়গা, কত রকম বাড়ি- ভালো লাগে না?

-নিজের পয়সায় তেল পুড়িয়ে ঘুরো।

 দুম করে ইউ টার্ন নিয়ে গাড়ি  ঘোরালো সুবিমল।

"যথেষ্ট হয়েছে। আমারই ভুল। এখানে সেটল করতে চাও না তুমি"- নাটুকে ভঙ্গিতে স্টীয়ারিং ছেড়ে হাত জোড় করল -সামান্য টাল খেলো গাড়ি-

" কী হচ্ছে কী?"- ইঙ্গিতে তিন্নিকে দেখাল লিপি -"সেটল যে করতে চাই না যে তুমি জানো, জানো না ?

-কী আছে তোমার এঁদো গলির বাড়িতে?  ভেঙে ভেঙে পড়ছে- কী মধু ছিল শুনি? কিসের এত টান? কিসের?

গলা চড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে  বাক্যের শেষটা গিলে নিল সুবিমল। শিসের মত শোনাল। লিপি জানলার কাচ তুলে দিতে শিসটুকু বদ্ধ গাড়িতে শঙ্কুর মত ঘুরতে ঘুরতে তিনজনকে গিলে নিল একসময়।

~*~

একটু আগে পঙ্কজকে বিলে করার টেকনিক শেখাচ্ছিল বুল্টি- এখন হারনেস পরতে সাহায্য করছে। ক্যারাবিনার লক করে চেক করে নিতে বলছিল। পঙ্কজ নার্ভাস ছিল প্রথমে। "ভেরি ইজি বাবা, ভেরি ইজি -শুরু করলেই হাত সেট হয়ে যাবে"- মেয়ে তাকে বলেছিল।

এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি এসেছে বুল্টি। পঙ্কজ ছুটি নিল। আজ রক ক্লাইম্বিং করতে এসেছে বনময়ূর সমেত।  সাত আটটা উঁচু বোল্ডার পাশাপাশি- নিচে মাটি, ঘাস, জংলা লাল, হলুদ ফুল ফুটে রয়েছে - সেইখানে  বাবা মেয়ে দাঁড়িয়ে;  বনময়ূর থাবার ওপর মাথা রেখে বসেছিল - একটা প্রজাপতি দেখে মাথা ঘোরালো এইমাত্র।

-রেডি বাবা?

বুল্টি নিজের হারনেস পরেছিল।  তারপর দড়িতে গিঁট দিয়ে পঙ্কজকে বলল-" চেক করো তো"

-ফিগার অফ এইট নট?

-ওয়াও!! তুমি জানো বাবা? ওভারহ্যান্ড, ক্লোভহিচ জানো?

লাজুক হেসে মাথা নাড়ল পঙ্কজ- " ক্লাইম্ব আপ"-

দুপুরের পরে টিলার ওপর বসে স্যান্ডুইচ খাচ্ছিল বাবা, মেয়ে।  বনময়ূর পাশে বসে ল্যাজ  নাড়ছে- পঙ্কজ ওকে পাঁউরুটির টুকরো দিচ্ছিল মাঝে মাঝে। টিলার  নিচে জল দেখা যাচ্ছে আর  সারি সারি গাছের মাথা- সূর্যের আলোয় সব কমলা এখন।  দুটো সাদা বক উড়ে  গেল পায়ের তলা দিয়ে-

-ম্যাজিকাল ইভনিং। না বাবা?

-ভালো অ্যাডজেক্টিভ বুল্টি, কিন্তু ম্যাজিকটা ঠিক কোথায়? তুই, আমি , বনময়ূর কি বদলে গেলাম, হ্যাঁ রে? না বদলালে ম্যাজিক কই?

"কেন এই যে তোমার গোমড়া মুখে হাসি, মাথাটা কমলা হয়ে গেছে"-হা হা করে হাসছিল বুল্টি।

পঙ্কজও হাসল।

-এই কমলা রংটা অবভিয়াসলি সূর্য থেকে। যা অবভিয়াস , তা তো ম্যাজিক নয় বুল্টি-

-উফ তুমি যেন কী- সব রুইন করে দাও- আচ্ছা এই যে তুমি খুশি, আমি খুশি, বনময়ূর খুশি- এটা?  হ্যাঁ, অনেকদিন পরে আমি এসেছি, দেখা হয়েছে- অবভিয়াস ফ্যাক্টর , কিন্তু এটাই তো সব নয়- তাই না?

- ছোটোবেলায় তোর একবার খুব জ্বর হয়েছিল। ভয়ের স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠতি থেকে থেকে- একটা বিরাট গাছ তোকে হাঁ করে খেতে আসছে-এই সব বলতি। জ্বর ছেড়ে গেল যখন, পরদিন সকালে বললি- জঙ্গল দেখেছিস, পাহাড়, ঝর্ণা, জল বয়ে যাচ্ছে- তার তলায় মাছ,  আর অনেক  পাথর - একজন বুড়ো মানুষ পাথরগুলো  বাজাচ্ছে- পিয়ানোর মত - অদ্ভুত একটা সুর-  ঘুম থেকে উঠে তুই সুরটা মনে করতে পারছিলি না- কী বোর্ড বাজাতে বসেছিলি- সুরটা মনে করতে- সেই প্রথম একলা বাজালি নোটেশন না দেখে, নিজের মত-

-মনে আছে তোমার?

-তুই বুঝি ভুলে গেছিস? ঐটা ম্যাজিক মোমেন্ট বুল্টি। ঐটা ম্যাজিক।

-স্বপ্নে পাওয়া সুর- মা বলেছিল , খুঁজে যেতে হবে- সারাজীবন-

-কী খুঁজতে হবে? সুর?

-সুর। মা কী খুঁজতে কলকাতা গেল?

পঙ্কজ কথা ঘোরালো-" আচ্ছা স্বপ্নের জায়গাটা কেমন ছিল? এই রকম?"

- মনে নেই

-ভাব না

- আই কান্ট বাবা।

-কেন? ভাবলেই মনে পড়বে-

- এক কথা বার বার বলছ কেন? চুপ করো। আমার অসুখ করেছে-

-অসুখ!! কী অসুখ?

- আই অ্যাম সাফারিং ফ্রম আফ্যান্টেসিয়া। ডু ইউ নো হোয়াট ইজ দ্যাট? ডু ইউ? ইউ নো নাথিং। কবে আসবে মা? কবে আসবে?

তেড়েফুঁড়ে উঠে দাঁড়ালো বুল্টি- "ভালো লাগছে না"

পরদিনই ডর্মে ফিরে গিয়েছিল সে।

-আবার কবে আসবি রে?

-আসব -

-বনময়ূর খুব মিস করে তোকে-

বনময়ূরের মাথায় হাত বোলালো বুল্টি, পিঠ চাপড়ে দিল-" ওকে স্নান করাও না? কী রকম একটা গন্ধ। গিভ হিম নাইস বাথ বাবা।"

ব্যাগ পিঠে বেরিয়ে গেল মেয়ে।

~*~

 -লিপি?

-উঁ? ঘুমাও নি?

- সরি লিপি। আমি জানি,  তোমার খারাপ লাগে- আমার রুড বিহেভিয়ার- সরি লিপি। সরি সরি সোনা। আমরা খুব ভালো থাকব লিপি। দেখো তুমি। একটা বাড়ি , তিন্নি, তিন্নির ভাই, বোন।  বাগান করব ফুল গাছ। লেবু গাছ।  একটা পাপি আনব তিন্নির জন্য। বনময়ূরের মত। তোমার বাবা মা কে নিয়ে আসব এখানে। দেখো। আজই  কথা বলছিলাম তোমার মা সঙ্গে- মেট্রোর কাজ পুরোদমে চলছে তো- বলেছি এবারে নিয়ে আসব।  লিপি লিপি লিপি আমার লিপি সরি লিপি সরি-

লিপি মুখ ঘুরিয়ে আনল সুবিমলের দিকে- বুকে মাথা গুঁজে দিল। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল তারপর। লিপির লম্বা বিনুনী বনময়ূরের ল্যাজের মত লাগছিল একটা অ্যাঙ্গল থেকে নড়ছিল , নড়ছিল আর নড়ছিল।

~*~

আজ অফিস থেকে ফিরে আঁশটে গন্ধ পাচ্ছিল পঙ্কজ। জানলা খুলে দিল সব কটা, দরজাও- একদম হাট করে। কীসের গন্ধ বুঝতে পারছিল না পঙ্কজ। কিচেনের কাবার্ড, ফ্রিজ খুলে খুলে দেখছিল - আলু পচেছে? মরা ইঁদুর টিঁদুর নাকি? ছায়ার মত পঙ্কজের পিছু নিয়েছিল গন্ধটা।  পঙ্কজ যেখানেই যাচ্ছিল, ওর  ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে থাকছিল - নড়ছিল না একটুও   ফিকে গন্ধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল , পঙ্কজের নাসারন্ধ্র পেরিয়ে মস্তিষ্কের  গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছিল যেন-

মাথার থেকে গন্ধটা তাড়ানোর জন্য বনময়ূরকে বেবি পাউডার মাখাতে বসল পঙ্কজ। উইকেন্ডে স্নান করাবে। পাউডার মাখাল, ব্রাশ করল, কান পরিষ্কার করে দিল। কুটকুট করে পঙ্কজের আঙুল কামড়ানোর চেষ্টা করছিল বনময়ূর - পঙ্কজ ওর কান নেড়ে দিল, নাকে আদর করল আর তখনই  গন্ধটা যেন ঝাপট মারল সটান-

-হাঁ করত আর একবার। কী এটা,  এটা কী? দেখি- কিছু খেয়ে এলি নাকি বাগান থেকে?

মুখে আঙুল ঢুকিয়ে বড় করে হাঁ করাল বনময়ূরকে।  মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে মুখের ভেতরটা দেখল।  মাড়ির ঠিক ওপরে ফুলে গেছে অনেকখানি, ফ্ল্যাশলাইটের তলায় টকটকে লাল দেখাচ্ছে , পচা গন্ধ পাচ্ছিল পঙ্কজ-

সার্জারির তিন দিন পরে বনময়ূরকে দেখতে পেল পঙ্কজ। ওকে হাসপাতালে রেখে আসতে পঙ্কজের বুক ফেটে গিয়েছিল- এই তিনদিন খায় নি, ঘুমোয় নি, অফিস যায় নি;  ডাক্তার আজ দেখা করতে বলায় , পঙ্কজ দাড়ি কাটলো, স্নান করল;  বনময়ূরের জন্য একটা খেলনা কিনে রওনা হয়েছিল তারপর। হাসপাতালের ওয়ার্ডে দেখা হয়েছিল বনময়ূরের সঙ্গে। পঙ্কজের গন্ধ পেতেই উঠে বসার চেষ্টা করল - এলিজাবেথান কলার পরানো ছিল বনময়ূরকে, গোটা মুখ, গলা ফুলে গিয়েছে- খয়েরী  রঙের লালা কফ অঝোরে ঝরছিল; পঙ্কজ ওকে  জড়িয়ে  মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল, কান্না গিলছিল শব্দ করে-

" ক্যানসার। খুব খারাপ ধরণের দ্রুত ছড়িয়েছে।" ভেট বলছিলেন –" আর কিছু করার নেই। ইউথ্যানেসিয়া, পুটিং হিম টু স্লিপ-আই সাজেস্ট।

" আর থাকবে না!  কী বলছেন! কত বয়স ওর! ছয়ও হয় নি- কী করে হয়! কী করে হয়! ভাবার সময় দিন আমাকে। প্লীজ। প্লীজ"-  হাহাকার করছিল পঙ্কজ- যেন ওর শরীর থেকে হৃদয় উপড়ে নিয়ে কাপড় মেলার দড়িতে  উল্টো করে শুকোতে দেওয়া-  খোবলানো বুক নিয়ে পঙ্কজ নিজের হৃদয়ের দিকেই তাকিয়ে আছে -টপ টপ করে জল অথবা রক্ত ঝরে পড়ছে সেখান থেকে -

সুবিমল এসেছিল। লিপি, পরাশর, শান্তা।

 - পঙ্কজদা, বুল্টিকে জানাবেন না?

চোয়াল শক্ত করল পঙ্কজ-"কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। পরে.."

- হোয়াট অ্যাবাউট  স্মিতা? তো খুব ভালবাসত-

-বলব। আজ রাতেই বলব।

ভেট ঘুমের ওষুধ পুশ করেছিলেন-" পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে। কিছু বুঝতে পারবে না। কিচ্ছু ফীল করবে না। নিশ্চিন্ত থাকুন।"

পঙ্কজের কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল বনময়ূর। ওর মাথায় গায়ে হাত বোলাচ্ছিল পঙ্কজ। অন্য হাতে ধরে রইল বনময়ূরের ছোট্টো থাবা। হু হু করে কাঁদছিল লিপি। সুবিমল  চোখে রুমাল চেপে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। খুব ল্যাজ নাড়ছিল বনময়ূর। চোখ বুজে আসছিল ওর ল্যাজ নাড়ছিল তবু। নেড়েই গেল ঘুমোনো পর্যন্ত। গাঢ় সবুজ তরল বনময়ূরের শরীরে ঢোকার পরে জাস্ট এক মিনিট তারপর। বাঁ পাটা একটু কেঁপেই থেমে গেল।

-হি ইজ গন

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে, পঙ্কজ  আকাশের দিকে  তাকাল- চাঁদ টাঁদ যথারীতি উঠেছে, বসন্তের হাওয়াও ফুলের গন্ধ বয়ে আনছিল একদম ঠিকঠাক; পঙ্কজের মনে '- স্নান করা হল না বনময়ূরের। বাড়ির ঘেরা বারান্দা রোদে রোদে ভরে ছিল পরদিন সকালে- আনাচে কানাচে বনময়ূরের লোম চিকচিক করছিল। পঙ্কজ এক বাটি জল রাখল বারান্দায়। অফিসে বেরিয়ে গেল তারপর।

~*~

ফ্রী ওয়ে ধরে ড্রাইভ করছিল লিপি - চাকরির প্রথম দিন।ছোটোমাপের ফার্মাসিউটিকাল প্রডাকশন কম্পানির ল্যাব- সেখানে কনিষ্ঠ ম্যানেজার লিপি, রিপোর্ট লিখবে, সই টই করবে। ল্যাবের অবস্থান  শহর থেকে দূরে। যদিও রেলস্টেশনের কাছে অফিস,  ট্রেনেই যাওয়া যেত- গাড়ি নিতে বলেছিল সুবিমল।  আধঘন্টা মত ড্রাইভ করল লিপি - এবার একজিট নেবে। এইখানে যেটা ঘটল , তা লিপির কাছে খানিক আকস্মিক -

পুরীতে প্রথম সমুদ্র দেখার কথা লিপির মনে ছিল,  মোড় ঘুরতেই রাস্তার ওপরে আকাশ নেমে আসে - গোটা নীলটুকু গলে জল হয়ে  দিগন্ত ছুঁয়ে দেয়,  মেঘ হয়ে যায় ঢেউ- ছোটো বাড়ি, ছোটো রাস্তা,  ট্রেনের ছোটো কামরা, বাথরুম, রিক্সার  ছোটো সীট থেকে একদমে বিরাটের সামনে পড়ে যাওয়া- দৃশ্য মানুষ শেষ দিন অবধি মনে রাখে। আজ একজিট নিতে  যেন একদম উল্টোটা হল- বস্তুত এর উল্টো ব্যাপার যে হতে পারে যেন আবিষ্কার করল লিপি-  এত নীল, আকাশ, বাতাস, ফুলের গন্ধ হুট করে  মিলিয়ে গিয়ে  কালচে ইঁটের ছোটো ছোটো বাড়ী, দোকান,  ধূ ধূ মাঠময় চোরকাঁটা শুধু। বন্ধ ক্যাফের জানলায়  ধুলো জমা ভারি পর্দা ঝুলছিল। পুরোনো  গ্যাস স্টেশনের  পাশ দিয়ে ক্রীক বইছিল। মহানগরের পেটের ভেতর থেকে যেন একটা অন্য শহর বেরিয়ে এল লিপির চোখের সামনে।  আরো তিন মিনিট ড্রাইভ করল লিপি- অফিস পৌঁছে গেল। অ্যাক্সেস কার্ড ঢোকালে একপাশে সরে গেল ভারি গেট,  সঙ্গে ধুলো,শুকনো  পাতা ,খড়কুটো। লবিতে  আদ্যিকালের কার্ড পাঞ্চিং মেশিন যত্ন করে রাখা ;আর একটা ঘড়ি- দুটো কাঁটার একটাও নেই।  পুরোনো  কার্পেটে ধুলোর গন্ধ ছিল। সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে  লিপির কিউবিকল ; যেন মাত্রিওশকা পুতুলের প্যাঁচ খুলে ক্রমাগত বেরিয়ে আসছে  এক দুই তিন চার-  এইবারে শেষতম ক্ষুদে পুতুল- যার চোখ মুখ, জামার কারুকাজ ঈষৎ ঘষা খাওয়া - যেখানে লিপি চাকরি শুরু করল এই বসন্তে।

~*~

পঙ্কজের মনে ' বনময়ূর এসেছে। সকালে পঙ্কজের উঠতে দেরি 'লে যেভাবে ওর পায়ের পাতায় মুখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকত আর  ভেজা ঠান্ডা নাকের ছোঁয়া লেগে  চমকে জেগে উঠত সে-  সকালের দিকে ঠিক সেভাবে জেগে উঠেছিল পঙ্কজ ; দেখেছিল পায়ের ওপর চাদর সরে গিয়েছে, শেষ রাতের বৃষ্টিতে বাতাস জোলো আর ঠান্ডা।  জানলার পর্দা সরিয়ে দেখল,  ভেজা ঘাস , ভাঙা ডাল পাতা;  ছোটো গর্তে  জল জমে আছে  অযত্নের বাগানে - কোথা থেকে ঝুঁটি ওলা পাখি এসে মাথা ভেজালো, ডানা ঝাড়ল, পঙ্কজের দিকে ঘাড় ঘোরালো। পঙ্কজ দরজা ঠেলে বাইরে এসে ডাকল- "বনময়ূর, আয় বনময়ূর আয়।" পাখিটা বাগানময় ঘুরে বেড়ালো নাচের ভঙ্গিতে তারপর নিজের ডানার কথা যেন মনে পড়ল তার- হুস করে উড়ে গেল।

খালি পায়ে বাগানে এসেছে পঙ্কজ- পায়ের তলা ভিজছে; কত দিন ঘাস ছাঁটা হয় না- একরাশ ভিজে সবুজে গোড়ালি ডুবে যাচ্ছে ওর। পাখি উড়ছে, সামনের গাছে বসছে , একটা দুটো তিনটে চারটে পাখি-  বনময়ূর তুই পাখি হয়ে এলি? বনময়ূর বনময়ূর...

অফিসফেরত বার্ড ফীডার আর  বাথ কিনে এনে বাগানে বসাল পঙ্কজ। সন্ধ্যা  হয়ে গিয়েছিল, এখন আর কোনো পাখি আসবে না- তবু বার্ডফীডারে এক মুঠো শুকনো সূর্যমুখীর বীজ রাখল সে। মাথার ওপরে বিশাল এক আকাশ রং বদলাচ্ছিল- ঘননীল থেকে কালো হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ,  তারা ফুটছিল-  কতদিন পরে আজ তারা দেখছে পঙ্কজ , যেন  সাহেবগলির বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ওকে তারা চেনাচ্ছে মা, খিড়কীর দরজা খুলে সাইকেল দিয়ে বাড়ি ঢুকছে বাবা। এই সময় স্ট্রীট লাইট জ্বলে উঠছিল,  রাস্তার উল্টোদিকে লাল ডাকবাক্স এখন কালো দেখাচ্ছে, তার ছায়া লম্বা  হয়ে পড়েছে রাস্তায়-

মাথা টলটল করে পঙ্কজের; সে মাথা ঝাঁকাল দুবার যেন সব চিন্তা সব দুঃখ ঝরে পড়ে যাবে এইভাবে, তারপর লম্বা ছায়াদের দিকে  তাকিয়ে ডাকল,  " আয়, খেতে আয়";  বোকার মত অপেক্ষা করে রইল যেন একটা ম্যাজিক হবে এখনই- যেন ঘন অন্ধকার চিরে টগবগিয়ে বেরিয়ে আসবে বনময়ূর-

 

 

বসন্ত-

 

মাটির নিচে দিনভর তুলকালাম টি বি এম চণ্ডী পশ্চিমের দিকে  টানেল খুঁড়ছে, উর্বীর মুখ পূবে ফেরানো। মৌলানা আজাদ কলেজের কাছ থেকে নির্মলচন্দ্র স্ট্রীটের দিকে বাঁক নিচ্ছে টি বি এম-বৌবাজার মোড়ের নিচে ডান দিকে বেঁকে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রীটের তলা দিয়ে শিয়ালদা পৌঁছবে।

অজয় নদ এই মুহূর্তে যেন বিস্তীর্ণ মরুভূমি ধু ধু বালির চরে মার্চ মাসের রোদের তাত ঠিকরোচ্ছে। একটু পরেই দেখা যাবে সারে সারে উট চলেছে- কঙ্কণার মনে হচ্ছিল। বালির ওপর বাজার বসেছে -একটা চিল সাঁ করে নেমেই আবার আকাশে উঠে গেল। সমুদ্রের কথা মনে হল - এই বালির ওপর সার দিয়ে কয়েকটা ক্যাসুরিনা লাগিয়ে দিলে কেঁদুলি দীঘা হয়ে যাবে এক্ষুণি। সমুদ্রে গেলেই কি ভালো '? কাটা ডাবে স্ট্র ডোবালো সে। বাজারে  ঝুড়ি, চুবড়ি, কুলো, মোড়া, ঘর গৃহস্থালির জিনিস। বালির চর পেরিয়ে লোকজন যায় আসে, কেনাকাটি করে, চা খায়, গল্প জোড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায়, বেলা '; ঘাম মুছে বাড়ি যায় তারপর। কঙ্কণা আর সাহিল রাধাবিনোদের মন্দির ঘুরে এসেছে একটু আগে। ছবি নিয়েছে অজস্র। তারপর ডাব কিনতে বাজারে এসেছে। সাহিলের  মাত্রই 'দিনের ছুটি - আজ নানুর, কেঁদুলি ঘুরে কাল সকালে মল্লারপুর।

"ইলেকশন হয়ে যাক। তারপর যাব" কঙ্কণা চাইছিল। 

-মাত্র তিনটে দিন। প্লীজ চলো। এরপর আর ছুটি পাবো না সহজে।

প্রথমে গাঁইগুইঁ করেছিল- ইউনিভারসিটির কাজ, মীটিং আছে পরপর, মিছিলে হাঁটবে পরের সপ্তাহে- এই সব। ইলেকশনের আগে ওদিকে স্রেফ বেড়াতে যাওয়াটা কতখানি সেফ- সেটাও বলল বার কয়েক। কিন্তু ট্রেনে ওঠার পর থেকেই উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল কঙ্কণাকে - দ্বিধাটুকু হাওড়া স্টেশনে ফেলে রেখেই ট্রেনে উঠেছে যেন। কঙ্কণা রাজনগর ঘুরে আসার কথা বলেছিল আগেই;  এখন স্ট্রয়ে ঠোঁট ঠেকিয়েই মুখ তুলল,  ঘাড় ঘুরিয়ে বলল - মোতিচুর মসজিদ দেখবে। কিন্তু মল্লারপুর যাওয়ার জেদ করল সাহিল।

-রাজনগর পরের ট্রিপে। শীতে আসব সিউড়ির দিকটা শিওর। রাজনগর, দুবরাজপুর, মামা ভাগ্নে পাহাড়...

-মল্লারপুরে স্পেশাল কী?  সেই তো শিব মন্দির 'টা- আর অবশ্য রামপ্রসাদের গুরুর সমাধি, কাছারি বাড়ি ...আর ,মনে নেই, বাঘ বেরিয়েছিল মাস দুই আগে?

-“তুমি বুঝি বাঘকে ভয় পাও খুকী? বাঘ দেখা ভালো কিন্তু।  ধরো,  বাঘের পিছন পিছন ভূতের রাজা এসে বর দিয়ে গেলমজার মুখ করল সাহিল।

-কী বর চাইব আমরা?

-আমার লেখা হোক আর তোমার…. তোমার দল যেন ইলেকশনে জেতে-

সাহিলটা বড় ছেলেমানুষ- কঙ্কণা খুব হাসছিল। তারপর চোখ মুছল দোপাট্টায়। হাসলে কঙ্কণার চোখে জল আসে।  ওর দিকে তাকিয়ে রইল সাহিল যেন শিমূল পলাশ টলাশ নিয়ে বসন্ত একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

-"স্পেশাল কী বললে না তো!" হাসি থামিয়ে কঙ্কণা জানতে চাইল।

-আরে স্পেশাল মানে গল্প- নইলে মন্দির লইয়া কী করিব?

-সে তো রাজনগরেও ভূরি ভূরি...

-তা  আছে, গল্প আছে, কিন্তু মল্লারপুরে মাটির নিচের গল্প-

-তারপর চাণ্ডী মুখনের গল্পের সঙ্গে জুড়বে?

- বুদ্ধিমতী মাশা আমার,  শিওর নই কী করব। ভাবতে হবে।

- কী ভাবছ শুনি?

- এই যে ধর,  মাটির ওপরে আর নিচে- দুটো আলাদা দুনিয়া যখন সাবস্ট্রাকচারে কাজ করতে হয়, খুব ফীল করি। মানে ফিজিক্যালি ফীল করি।  যেন প্যারালেল দুটো জগত। পাশাপাশিই আছে- একদম পাশে, অথচ কেউ কারো সম্বন্ধে কিছু জানে না। 

সাহিল একটানা এত কথা বলে না। ওর হাতে চক ডাস্টার , পাশে ব্ল্যাকবোর্ড দিলে দারুণ মানাবে এখন- বলতে গিয়েও গিলে নিল কঙ্কণা-  সাহিল যদি খেই হারায়।

-অথবা ধরো,  মাটির নিচে কী থাকে? সমাধি। হাড় গোড়। মানে অতীত।  বর্তমান যার সবটুকু জানে না। কল্পনা করে, আন্দাজ করে, ইতিহাস লেখে, কিন্তু সবটুকু জানে না তো। ব্যাপারটা রূপক হিসেবেও দেখা যায়- জাস্ট রূপক- যেন চেতন আর অবচেতন; আমাদের অবচেতনে কী আছে তা কী জানি?

-ইন্টারেস্টিং-

- এই ব্যাপারগুলো ধরতে চাইছি আর কি-

- জন্যই তো বলছি- চাকরি ছাড়ো। নইলে লিখতে পারবে না। সিরিয়াস হও সাহিল। সেদিন স্যার যে বিজনবাবুর নম্বর দিলেন, ফোন করেছিলে?

- 'বার করেছি। বেজে গেল। আবার করব -

- আমিও ট্রাই করতে পারি। নীলকমলকে  খোঁজা নিয়েই একটা আস্ত গল্প হয়ে যাবে তোমার। আচ্ছা একটা কথা বলবে? এখানে জাদুকরের রোলটা কী? তার ইন্টারভিউ নেওয়া এত  ক্রুশিয়াল কেন?

- কানেকশনের টেকনিক শিখব  - পাঠকের সঙ্গে কানেকশনের টেকনিক-

- হোয়াই জাদুকর?

-এই যে তুমি মিছিল করে এলে, পোস্টার আঁকলে। আঁকলে না?

-হ্যাঁ, আঁকলাম, স্লোগান দিলাম, হাঁটলাম, তারপর পায়ে ব্যথা হল-

- সবই তো কানেক্ট করার জন্য, তাই না? মানুষের সঙ্গে কানেক্ট করলে তুমি-

-চেষ্টা করি আমরা-চেষ্টা করি, বলতে পারো। তাহলে, জাদুকর কেন? আমার থেকেই শিখতে পারো-

কঙ্কণা হাসল সাহিলের দিকে তাকিয়ে। রোদ পড়ছিল চোখে।

সাহিলকে সিরিয়াস দেখাচ্ছিলঃ " খোলা মাঠে, রাস্তায়  জাগলারি দেখেছ?"

-ফটিকচাঁদ….

সাহিল হেসে ফেলল-"জাগলারি তারপর ধরো, টাইট রোপ ওয়াকিং,  বা আরো বিপজ্জনক কিছু- একদম খোলা মাঠে খেলা দেখায়। আর তাদের ঘিরে কত লোক হয় -দেখেছ?  তুমি পি সি সরকারের ইন্টারভিউ নিতে বলেছিলে একদিন। দেখো , এখানে সাজ নেই পোষাক নেই, বাঘ , সিংহ , আলো বাদ্যি- কিচ্ছু নেই। আঁকা সীন- তাও নেই। না আছে  কথা, না আছে গান, বাজনা। তোমার মিছিলের মত কোনো ইস্যু নেই, থীমও নেই- কিন্তু কানেকশন হয়। এগারোজন নয়, জাস্ট একটা মাত্র লোক খেলা দেখায়- সবাই হাঁ করে দেখে। সময়টা অন্য কিছু ভাবে না, জানো? শুধু ভাবে বলটা ধরে নিতে পারবে তো? ফস্কাবে না তো?  দড়ি থেকে পড়ে যাবে না?  কী লেভেলের কানেকশন ভাবো! কী করে সম্ভব? খুঁজে খুঁজে গিয়েছি কয়েকজনের কাছে- কেউ কিছু বুঝিয়ে বলতে পারে নি।  বা আমিই বুঝতে পারি নি।  শুধু একটা জিনিস বুঝেছি, কঙ্কণা- লেখাকে বিপজ্জনক পথে হাঁটাতে হবে আমাকে;   যে আশঙ্কা, যে বুক ঢিবঢিব -ওটাই কানেক্ট করে সম্ভবত। সেদিন স্যারের সঙ্গে কথা বলে মনে হল- নীলকমল শেখাতে পারবে।  ওর সঙ্গে কথা বলতেই হবে। কানেকশনের টেকনিক শিখতেই হবে আমাকে-"

বালির ওপর দাঁড়িয়ে দুদিকে হাত ছড়িয়ে কথা বলছিল সাহিল, আবেগ ভরে  আসছিল ওর গলায়, চোখ চিকচিক করছিল। বড় একটা পাখির মত লাগছিল ওকে, কিম্বা এরোপ্লেন- টেক অফ করার জন্য রেডি; আবার কখনও অপুর মত লাগছিল সাহিলকে-  সিনেমায় অপু যখন পুলুকে নিজের লেখা নিয়ে বলছিল - সেই রকম। কঙ্কণা তাকিয়ে রইল - সাহিলকে অচেনা লাগছিল ওর।

কঙ্কণাকে দেখছিল সাহিল। বালির ওপর ছায়া পড়েছে ওর- ছায়াপিণ্ডর থেকে হাতে ধরা ডাবের স্ট্রর ছায়া  যেন সামান্য পৃথক - ঈষৎ উঁচু হয়ে রয়েছে -সানডায়ালের মত দেখাচ্ছিল  অনেকটা-

~*~

প্লাস্টিক গুটিয়ে রেখে ঘ্যাস ঘ্যাস করে গা চুলকোচ্ছিল প্রফুল্ল। সুনীলের থেকে তেল চাইবে ভাবল,  স্নান করে নেবে তারপর। অন্ধকার কাটে নি এখনও।  শহরের ঠিক মাঝখান দিয়ে  সরু নদীর মত যে হাওয়া বইছিল এই সময়, তাতে কোনো গন্ধ না থাকায়, হাওয়া বাতাস টের পাচ্ছিল না কেউ। আসলে, আকাশের গা চুলকে দিচ্ছিল বসন্তের বাতাস- চাঁদ তারা ঘন নীল রং এক এক করে মুছে যাচ্ছিল। ভোর হচ্ছিল শহরে। গন্ধহীন এই হাওয়াটুকুর আয়ু শেষ হয়ে আসছিল। গোটানো প্লাস্টিক আবার  টান টান করল প্রফুল্ল।  ফুটপাথেই পেতে রাখল, ইঁট চাপা দিল দু'দিকে   রোদ কড়া হলে পোকা মরে যাবে।

এদিকের ফুটপাথ রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিল একসময়- পথচলতি মানুষজনের বড় তাড়া, লোহার গরাদ হাওয়া করে ফুটপাথ থেকে সটান রাস্তায় নামার পথ করে নিয়েছে অনেকদিন। ধাতব বেড়া যেটুকু বাকি রয়ে গেছে, পুজো নাগাদ রঙের পোঁচ লেগেছিল তাতে, ব্যানার ঝুলেছিল- এখন ছিঁড়ে গিয়ে পুরোনো ন্যাতার  মত দেখাচ্ছিল। বসন্তের হাওয়া তার গায়েও লেগেছিল- নিচের দিকটা পত পত করে উড়ছিল - বাড়ি খাচ্ছিল রেলিংএ। একটু পরে বাস টাসের আওয়াজে এই ঝাপটানোর শব্দটুকু হারিয়ে যাবে।

 সুনীলের কাছে যেতে রাস্তা পার হতে হয়। প্রফুল্ল রেলিং এর কাছেই ছিল। ফুটপাথ থেকে  নেমে রাস্তায় পা রেখেছে দু সেকন্ড,  রাস্তা পেরোবে;  ডান দিক থেকে গোঁ গোঁ করে ছুটে এল কালো গাড়ি , প্রচন্ড স্পীডে টার্নিং নিতে কাত হয়ে গেল একদিকে,  বিকট শব্দে ধাক্কা খেলো ফুটপাথে তারপর উল্টে গেল। চোখের নিমেষে রেলিংএ হাত রেখে রাস্তা থেকে পা তুলে নিয়েছিল প্রফুল্ল,  মরচে ধরা রেলিংএ হাতের তালু রেখে শরীরের ভার ট্রান্সফার করেছিল চকিতে ,ঝাঁপ খেয়ে ফিরে এসেছিল ফুটপাথে। শরীর কাঁপছিল প্রফুল্লর- নাথু, কপিল ছুটে এসেছিল। গাড়ির দরজা ভেঙে গিয়ে ড্রাইভারের সীট থেকে পিছলে বেরিয়ে এসেছিল মৃত আরোহী। বিচূর্ণ শকট , থ্যাঁৎলানো মাথা , রক্তে ভেজা ফুটপাথ দেখতে ভীড় জমছিল এই সকালেই।

"পাঁড় মাতাল শালা। মেয়েছেলে নিয়ে ফূর্তিতে বেরিয়েছিল" - দাঁতন করতে করতে কে যেন বলল।

অ্যাম্বুলেন্সের হুটার শোনা যাচ্ছিল। পর পর তিনটে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। ঝটপট করে আকাশে উড়ল কাকগুলো। পাক খেতে লাগল।প্রফুল্ল বসে পড়েছিল ফুটপাথে। নাথু একটা খুরিতে দুধ এনে দিল।

-ঘাবড়াও মৎ। সারে কুছ বিলকুল ঠিক হ্যায় রে।  তোকে কে মারবে? মিস্টার ইন্ডিয়া হ্যায় না তু? ক্যা? পী লে-

গা, হাত পা চুলকোচ্ছিল বড্ড - প্রফুল্ল উঠে পড়ল আবার। সুনীলের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল- তেল নেবে। ওর পিছন পিছন প্রবল উৎসাহে, ল্যাজ নেড়ে নেড়ে শোভাযাত্রা করে চলল কাঁসি আর পটল - - আধঘুমন্ত এই শহরে প্রফুল্লর মারাত্মক স্পীড ভল্টের একমাত্র দর্শক এবং ফ্যান।

~*~

সাহিল মোড়ার দর করছিল , হাতে ঝুলিয়ে দেখে নিচ্ছিল ওজন। আবার রেখে দিচ্ছিল।

-কঙ্কণা, এদিকে দেখো, বাড়ির জন্য নেবে না কি?

-ফেরার পথে ইলামবাজারের ওদিক থেকে কিনে নেব-

-খয়েরবুনির মোড়া। হ্যাঁ, সেও করা যায়। তবে কেঁদুলির একটা স্মারক হত, হত না?

- বরং সিদ্ধাসন পাথরটাই নিয়ে চলো- তোমার উপন্যাস শেষ  হয়ে যাবে আপসে- উনিই শেষ করে দেবেন-

- আমার মত লেখকের পাণ্ডুলিপিতে উনি হাত ছোঁয়ান না- তাছাড়া, উনি সংস্কৃত ছাড়া আর কিছু জানেন না।  আমার লেখা পড়তেই পারবেন না-

- চুপ করো অবিশ্বাসী, কথা কোয়ো না।একটা চুবড়ি নিলাম। দ্যাখো। রং করে নেব- ল্যাম্পশেড হবে। হাতপাখা নেব? দ্যাখো, এদিকের গুলো-কেমন ঝালর দেওয়া-

সাহিলকে  মোড়া বেঁধে দিচ্ছিল দোকানী। মাটির একচালা দোকান- পুরোনো খবরের কাগজ, পাতলা বই থেকে পাতা ছিঁড়ে মুড়ে দিচ্ছিল চুবড়ি, হাতপাখা। কঙ্কণা আঁতকে উঠেছিল, “ওমা বই ছিঁড়ছেন কেন? যাঃ ছিঁড়েই ফেল্লেন তো- -দেখো কী লেখা-  কত চিঠি- এডিটরকে লেখা চিঠি সব

-কী ম্যাগাজিন?

- জানি না, মলাট  নেই,  ছিঁড়ে গেছে-  ওমা,এই দেখো  কী লেখা আছে- পড়ি?  'প্রিয় সম্পাদক,  পুজো সংখ্যা পেয়েছি। বেশ ভালো হয়েছে। সেরা গল্প লিখেছেন'- এখানটা পড়া যাচ্ছে না , দূর। তারপর লেখা,  'সেটি সেরা কেন, সে লেখার সময় নেই। কারণ এখন রাত্রি ১টা ২০মিঃ। সুযোগ  দিলে একটা গল্প লিখব আগামী সংখ্যায়। 'অজয়ের কুলে' লেখাটা পাঠিয়ে দিলাম'

- হা হা -এই জন্যই উপন্যাস শেষ করছি না- শেষ করলেই ঠোঙা। একটা লেখার আয়ু আর কতদিনের?

-আগে তো লেখো। এই দেখো  দেখো , এই মোড়কে একটা কবিতা-

সাহিল তাকালো না, জিগ্যেস করল-" এই বুদ্ধিমতী মাশা, এস্কোবারের হিপ্পোদের কথা জানো?

- না-

- আরে সেই পাবলো এস্কোবার

-লাভিং পাবলো?

-হ্যাঁ সেই পাবলো- পারসোনাল জু ছিল একটা। সেখানে জলহস্তী এনেছিল কোথা থেকে যেন- কলম্বিয়ায় কোনো হিপ্পো ছিল না তখন। তারপর পাবলোকে তো মেরে ফেলল। কিন্তু জলহস্তী রয়ে গেল।  সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে ম্যাগডালেনা নদী ছেয়ে গেছে। মেরে না ফেললে , ইকোসিস্টেম চেঞ্জ করে দেবে। এই ব্যাপারটাকে এখন কী বলে জানো?

-কী?

-ইকোলোজিকাল টাইম বম্ব। টাইম বম্ব। আমার লেখা  যেন পাবলোর জলহস্তীর মত হয় - যা আগে ছিল না, তারপর ছেয়ে নিল- যেন ঠোঙা না হয় কঙ্কণা, যেন ঠোঙা না হয়- টাইম বম্ব হোক বরং

সাহিলের  কনুই ছুঁলো কঙ্কণা-হবে। কেঁদুলির বালির চরে, সূর্যের নিচে  কঙ্কণার চোখে  চোখ রাখল সাহিল-

 " That kisses are not contracts and gifts are not promises,

and you start to accept defeat with the head up high and open eyes,

and you learn to build all roads on today,

because the terrain of tomorrow is too insecure for plans…

and the future has its own way of falling apart in half."

~*~

ইলেকশনের মুখে এখন রোজই মীটিং।  সকাল থেকে মিষ্টির দোকানের সামনে ম্যারাপ বাঁধছিল পার্টির ছেলেরা। সাউন্ড বক্স, চেয়ার ডাঁই করে রাখছিল। দুপুরে কচুরি , মিষ্টি খেল। জল চেয়ে খেলো অনেকবার। সুনীল  দুটো প্লাস্টিকের জাগ ভরে জল রেখে গেল। চা দিল দুবার। কচুরি, মিষ্টির দাম নিলো না। রঘু ঠেলা মারল প্রফুল্লকে- "পার্টির ছেলে তো। তোয়াজ করছে হেব্বি। তোর বাড়িটা দখলে রাখতে হবে না? -" প্রফুল্লর মাথা দপদপ করে- একদিন নাথুকে এই কথা শুনে মারতে উঠেছিল - "শালা আমি মিস্টার ইন্ডিয়া। ঘর নেই, বাড়ি নেই, কেউ নেই।  ঘর দোর থাকলে শ্রীদেবী আসে না-"

-মিস্টার ইন্ডিয়ার মত উড়তে পারিস তুই?

-মিস্টার ইন্ডিয়া উড়ত না, ভ্যানিশ হয়ে যেত-

- উড়ত পাক্কা উড়ত আমি দেখেছি।

প্রফুল্ল এই সব সময়ে চুপ করে যায়। যে টাঙ্গায়  বীরু আর বাসন্তীকে দেখেছে- এই কথা পেট থেকে গলা বেয়ে জিভের কাছে বুড়বুড় করে।  গিলে নেয়। চেপে যায় বেমালুম। প্রফুল্ল  জানে, নাথুও ওর মত স্টার দেখেছে।  রাতের দিকে এই সব সীন দেখা যায় - সারা শহর যখন ঘুমায় , সিনেমাহল থেকে টিভি থেকে স্টাররা বেরিয়ে আসে - টাঙ্গা চড়ে, আকাশে ওড়ে। শুধু শ্রীদেবীকে কেউ দেখে না-  জলের তলায় ঘুমিয়ে আছে শ্রীদেবী- জলভর্তি একটা বাক্স- যাকে ওরা বাথটাব বলছিল টিভিতে।

প্রফুল্ল ফুটপাথে চকখড়ি নিয়ে বসে যায়। সূর্য আঁকে, মেঘ আঁকে, পাখিদের উড়ে যাওয়া আঁকে- পাখির ঝাঁকের পাশে একটা টুপি পরা লোক আঁকলে টুপটাপ পয়সা পড়ে। খুচরো কুড়োতে কুড়োতে নাথুর কথা মনে ধরে ওর। ফুটপাথের ওপর দুবার ছোটোলাফ দিয়ে একটা মস্ত বড় লাফ দেয়- দুপাশে দু হাত ছড়িয়ে;  এরপর সে দৌড়ে গিয়েছিল রাস্তায়।  ভর দুপুরে  বড় রাস্তায় ট্রাক, টেম্পো, বাস, রুটের অটো থিকথিক করছিল। প্রফুল্লর মনে হয়েছিল- ওর একটা লম্বা রানওয়ে দরকার -যার ওপর দিয়ে সে প্রথমে দৌড়ে যাবে অনেকখানি , আস্তে আস্তে স্পীড বাড়াবে তারপরে দুহাত দুদিকে দিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে পা তুলে নেবে রাস্তা থেকে- তারপর সম্ভবত একটা ঘুড়ির আকাশে ওঠার মত ফড়ফড় আওয়াজ করে আকাশে ভাসবে ; ব্যালান্স এসে গেলে মিস্টার ইন্ডিয়ার মত  রাস্তার প্যারালেল উড়বে - নিচে নাথুর মাথার ওপর ছায়া পড়বে ওর। এইজন্য একটা ফাঁকা লম্বা রাস্তা ওর খুব দরকার।  আজ পার্টির ছেলেদের কাজ দেখতে দেখতে প্রফুল্লর মনে হল , একটা  বড়া হরতাল হলে ভালো হয়।  তখন ফাঁকা রাস্তায় টেক অফ ট্রাই মারবে প্রফুল্ল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বসন্ত-

 

ইদানিং ঘন ঘনই অফিস ফেরত মিঠুদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিল সনৎ। ছুটির দিনে মিঠু বাড়ি থেকে বেরোয় না সচরাচর, সোমবার ওর অফ ডে ; ফলে সনৎ একরকম নিশ্চিত ছিল যে সপ্তাহের মাঝামাঝি মিঠুর সঙ্গে ওর দেখা হয়ে যাবে বাস স্টপে কিম্বা রিক্সা স্ট্যান্ডে, অথবা গলির  মুখেই। অথচ তা ঘটছিল না। দিন সময়ের অঙ্কে কোথাও যে ভুল হচ্ছে- সনৎ বুঝতে পারছিল।  চাঁদের দক্ষিণ গোলার্দ্ধে বিক্রম নেমে পড়লেই মিঠু ফিরে আসবে সনতের কাছে- তার এই নিজস্ব ধারণা সে মিঠুকে জানাতে উদগ্রীব ছিল, মিঠুর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে ফিরে আসার কথা বলতে আকুল হয়ে ছিল বস্তুত। অথচ মিঠুর বাড়ি বা কলেজে সটান পৌঁছে যাবার সাহস তার ছিল না।  মিঠুর ফোনও বন্ধ সর্বক্ষণ। সনতের  মাথার মধ্যে যে গ্রহ তারা ছায়াপথ ঘুরে বেড়ায়, আশেপাশের মানুষজন  তার হদিশ পায় না;  সনৎ তাদের সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখে অফিস যায়, বাজার করে, মন্টুর মা কে মাইনের টাকা গুণে দেয়।

বিয়ের পরে মিঠুর সামনে প্রথম নিজের সমস্ত আবরণ খুলে ফেলেছিল সনৎ, মগজেরও। ফলে অ্যান্ড্রোমেডা গ্যালাক্সি তার সমস্ত নক্ষত্র নিয়ে ফুলশয্যার খাটের ওপর আছাড় খায়। বিশাল এত সামনে এসে দাঁড়ালে মানুষ তো ভয় পাবেই। মিঠুও পেয়েছিল। মারাত্মক ভয় পেতে শুরু করেছি সনৎকে। ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর সব মানুষের মতই মিঠুও চাঁদ তারা আকাশকে দূর থেকেই দেখতে চায়-  শোবার ঘরের ছাদ ফুটো করে চাঁদ সূর্য নেমে আসুক- কেউ তো চায় না।  মিঠু চলে যাওয়ার পরে, সনৎ 'কথা বুঝতে পেরেছিল। বুঝেছিল, বিশালের সামনে আচমকা কাউকে দাঁড় করাতে নেই, সময় দিতে হয়।   চন্দ্রযানের লঞ্চিং, ল্যান্ডিং নিয়ে নিজস্ব উত্তেজনার সঙ্গে মিঠুকে যুক্ত করতে চাইছিল সনৎ। মনে হচ্ছিল, এটাই কানেকশনের উপায়, হয়ত বা লাস্ট চান্স।

সনৎএর ঘরের জানলা দিয়ে জল দেখা যায়। বাড়ির পাশে ভাঙা পাঁচিল, ঝোপ ঝাড় , তারপর পুকুর। একলা, মলিন জানলা দিয়ে সনৎ পুকুর দেখে। শ্যাওলায় শ্যাওলায় পুকুরের জল সবজেটে ; জলের আশেপাশেও বিস্তর সবুজ - ঝোপঝাড়, আগাছা পেরিয়ে চোখে পড়ে কচুপাতার নিচে হলুদ ব্যাং; ধূসর রঙ বলতে দুটো ঘুঘু, গোসাপ; মাঝে মধ্যে একটা দুটো হলুদ কালো জলঢোঁড়া, কালচে দাঁড়াশ, আর এদিকের জানলায় সনৎ - প্রাণ বলতে এই। ঠাকুমা বলত, পুষ্করিণী।  মনে মনে দীঘি বলতে ভালো লাগে সনৎএর। জানলা থেকেই দেখছিল, দীঘির পাশের কচুগাছ, আগাছা, জংলা লতাপাতা পরিষ্কার করছে ক্ষিতীশ, কার্বলিক অ্যাসিড ঢালছে। এই পাড়ার লোকজনের টুকটাক কাজ  করে দেয় ক্ষিতীশ- দুধ এনে দেয় , বাজার করে, ঘাস কাটে।

বাড়িটা পোড়ো মত ছিল অনেকদিন- একতলায় আলো জ্বলত, দোতলা অন্ধকার। সনতের জানলা দিয়ে পুকুর পেরিয়ে দোতলার জানলা দেখা যায় বাড়ির। এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়- পরপর ছটা জানলা  বন্ধ ছিল এতকাল।  ইদানিং খোলা থাকে। আজ অফিস থেকে ফিরে  'বাড়ির  জানলার আলো জ্বলতে দেখেছিল সনৎ। এতদিনের অন্ধকার পুকুরপাড়ে জানলা দিয়ে আসা আলোটুকুকে ভালো লাগছিল তার। নিজের ঘরের বাতি জ্বালালো সনৎ।  তারপর চন্দ্রযানের আপডেট পেতে ইসরোর ওয়েবসাইট খুলল ওর ডেস্কটপে। আজ সাইটে  সনৎ দেখছিল, লঞ্চিংএর ডেট আরো মাস তিন পরে, তার এক মাসের মাথায় চাঁদের অর্বিটে ঢুকবে  চন্দ্রযান , তারপরে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামবে বিক্রম।  এই সমস্ত তথ্য সে তৎক্ষণাৎ মিঠুকে জানাবার জন্য আকুল হয়ে উঠছিল   সাউথ পোল, সেভেন্টি ডিগ্রী ল্যাটিচিউড, সফট ল্যান্ডিং- উফ- মিঠু মিঠু মিঠু- সফট ল্যান্ডিং মিঠু-সফট ল্যান্ডিং- -ছট্ফট কোরো না এত- সেভেন্টি ডিগ্রী ল্যাটিচিউডে নামতে হবে- ওঃ।  অবশ হয়ে যাচ্ছিল ঊরু, ফেটে যাচ্ছিল ওর পুরুষাঙ্গ। পাজামা টেনে নামানোর আগে আলো নিভিয়ে দিল সনৎ।

~*~

সকালে জেম্মার মশারির খুঁট খুলছিল পায়েল। রাতে ঘুম হয় নি জেম্মার- ছটফট করছিল। স্মিতা প্রেশার মেপেছিল,  অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক করল; তারপর কনসেন্ট্রেটর থেকে জেম্মার নাক অবধি নল টেনে অক্সিজেন চালু করেছিল। পায়েল আর ধনঞ্জয় বলেছিল- "দিদি, তুমি শুয়ে পড়, আমরা আছি তো।" শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল জেম্মা। তারপর  স্মিতা  শুতে গেছে- এখনো ওঠে নি। ধনঞ্জয় চা বসিয়ে টিভি খুলে দিল -খবর শুনবে। এন আর সি নিয়ে ধনঞ্জয় ভয় পাচ্ছে ইদানিং। স্মিতার কাছে ছুটি চাইছিল কাল- দেশের বাড়ি গিয়ে সব কাগজপত্র খুঁজবে।

নিম্নচাপের মেঘ শহরের ওপর জমা হয়েছে গত দুদিন; রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল জোরে। আজ খিচুড়ি করবে - পায়েল ভাবছিল। জেম্মার জন্য আলাদা  রান্না করে আগে নামিয়ে নেবে,  তারপরে ওদের সবার জন্য রাঁধবে। ডিম আছে কী না দেখার জন্য ধনঞ্জয়কে চেঁচিয়ে ডাকল পায়েল। টিভির আওয়াজে ঘরের কথা ঘরে পৌঁছচ্ছিল না- মশারি ভাঁজ করে রেখে নিজেই রান্নাঘরে গেল। এই সময় জেম্মার জানলায়  একটা পাখির ছানা এসে বসেছিল-তার ছোট্টো মাথা জলে ভিজে কদম ফুলের মত;  ব্যাঁকা ঠোঁট দিয়ে জেম্মার জানলায় টোকা দিল দুবার। যেন জেম্মাকে একলা পেতে চেয়েছিল, কোন গোপন কথা বলবে বলে, অথবা এমন একটা ভাষায় কথা বলবে, যা কেবল জেম্মাই বুঝবে জেম্মা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিল পাখিকে। হাসল তারপর।

ডিম  নেই বাড়িতে- ধনঞ্জয়কে ডিম আনতে বলে , ঘরে ফিরে এসে পায়েল দেখেছিল, জেম্মার মাথা বালিশ থেকে হেলে গেছে, জানলার দিকে ঘাড় ঘোরানো- কপাল, হাত , পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। ধনঞ্জয়কে ডেকে, স্মিতাকে ডেকে তুলে ডাক্তারবাবুকে ফোন করল পায়েল।  সার্টিফিকেট, মালা, গাড়ি জোগাড় করে রওনা হতে হতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। বাবলুদা, বৌদি, ঝিমলি,  এমনকি পল্টনও এসে পৌঁছোলো বৃষ্টিতে।

- তুই তো অনেক করেছিস। শেষটুকু আমরাই করি।

জেম্মার কপালে চন্দনের ফোঁটা আঁকল স্মিতা; তারপর মাথা হেলাল - 'আচ্ছা'

বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল দুপুরের পরেই। রোদ উঠল দিব্যি। এখন সূর্য পাটে বসছিল। স্মিতা বিকেল থেকেই পুকুরের পাশে বসে আছে। বাবলুদারা এখনও ফেরে নি। একটা মানুষের পুড়ে যেতে কতক্ষণ লাগে স্মিতা জানে না।  অস্থিরতা কমাতে সে জলের কাছে বসেছিল। রোদ কমে আসায় জলের রঙ ঘন সবুজ এখন; পাখির ছানা টুই টুই টুই টুই করে ডাকছে।  ভাঙাচোরা ইঁটের গাঁথনির ওপর কালো পিঁপড়ের সারি- স্মিতা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে যাত্রার শুরু বা শেষ কিছুই দেখা যায় না, যেন এক অনন্ত ক্যারাভ্যান। স্মিতার পায়ের কাছে দু চারটে ফাটা নিমফল- পিঁপড়ের সারি নিমফলের পাশ কাটাতে সামান্য বেঁকে যাচ্ছিল যেখানে, স্মিতার চটি পরা পায়ের পাতা তার খুব কাছে। স্মিতা ওর পায়ের পাতা পিঁপড়ের লাইনের একদম ওপরে নিয়ে আসছিল, সরিয়ে নিচ্ছিল পর মুহূর্তে-  অনিত্যতাকে স্পর্শ করতে চাইছিল এইভাবে, সম্ভবত।

~*~

সনৎ আজ সমস্তদিন ধুলো ঘেঁটেছে। ডেস্কটপ সারানোর কথা প্রদীপকে বলে রেখেছিল অনেকদিন। এই শনিবার না পরের রবিবার, এখন ব্যস্ত-পরের মাসে আসব-  এই চলছিল। অবশেষে, কাল রাতে প্রদীপ এসে কম্পিউটার নিয়ে গেছে;  ছুটির দিন সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে সনতের মনে হচ্ছে যেন সমস্ত ঘর খাঁ খাঁ করছে। দেওয়ালের প্লাগ পয়েন্ট থেকে কালো মোটা তার টেবিলের ওপর  মরা সাপের মত পড়ে - তাদের ওপর এযাবৎ  জমা ধুলো শুঁয়োর মত দেখাচ্ছে, সেখানে সকালের রোদ এসে পড়ায় একটা মাকড়শাকে সন্তর্পণে হেঁটে যেতে দেখল সনৎ।  চা খেতে খেতে একবার ভাবল-মন্টুর মাকে ডেকে পরিষ্কার করতে বলে। তারপর নিজেই ছেঁড়া কাপড় খুঁজে আনল সিঁড়ির ঘর থেকে -যত্ন করে মুছল মলিন প্লাগপয়েন্ট, অ্যাডাপটার, প্যাঁচানো তার; পালকের ঝাড়ু দিয়ে টেবিল ঝাড়ল। ধুলো উড়ছিল ঘরময়। ক্রমান্বয়ে চারবার হেঁচে, পঞ্চমবারে নাক সুড়সুড় করে উঠতেই ফ্যান বন্ধ করল সনৎ  তারপর হাতে ঝাড়ন নিয়ে সমস্ত ঘরে চোখ বোলাল - সে দেখছিল, ঘরময় রোদ আর ধুলোর ডোরা কাটা, জানলার পাল্লায়, গ্রীলে ধুলোর পরত , বন্ধ ফ্যানের ব্লেড কালো হয়ে আছে- সনৎ কাজ শুরু করল।  মন্টুর মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে "আমি করে দেব" বলেছিল- দৃকপাত করে নি সনৎ। নাকে মাথায় গামছা জড়িয়ে নিয়েছে, কাঁধে ঝাড়ন, হাতে লম্বা ঝুলঝাড়ু, চোখ মুখ জেদী অথচ শান্ত - যেন এমন এক অভিযানে নেমেছে সে, যার শেষে  কোনো প্রাপ্তি থাকে না। খ্যাপার মত কাজ করছিল সনৎ- ঘরের ধুলো ঝেড়ে, পাশের ঘরে গেল। সবশেষে চিলে কোঠায়। সেখানে  ডাঁই করা পুরোনো খবরের কাগজের স্তূপ- তিন মাস অন্তর মন্টুর মা নিয়ে যায় , পার্ট টাইম বিড়ি বাঁধার কাজে দরকার হয়; দেওয়াল ঘেঁষে  ফাটা বালতি, পুরোনো দেওয়ালঘড়ি, ফ্রেমে বাঁধানো কাচফাটা ফাঙ্গাস ধরা ছবি দেওয়ালের দিকে ঘুরিয়ে রাখা। তার পাশে পুরোনো সুটকেশে  বালক বয়েসের স্ক্র্যাপবুক, ডাকটিকিট জমানোর খাতা- যা সে মামাবাড়ি থেকে বাড়িতে নিয়ে আসে। সনৎ চিলেকোঠার মেঝেয় থেবড়ে বসে সুটকেশের ডালা খুলে কাগজপত্র দেখছিল- পুরোনো খাতার পাতায় পাতায় বিনোদ কাম্বলির ছবির কোলাজ - কোথাও বাঁ হাঁটু মাটিতে রেখে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে বল ওড়াচ্ছে কাম্বলি, কোথাও পুল শট অথবা কভার ড্রাইভ,  অন্য খাতায় দিব্যা ভারতী -মামাবাড়িতে  বালক সনৎ যাদের ওপর বাজি ধরেছিল; হঠাৎমনে হল, যেন সমস্তজীবন কোনো সুন্দরকে চেয়ে পথের ধারে বসে আছে- সে সুন্দর কখনও কাম্বলি কখনও দিব্যাভারতী, অথবা চাঁদের মাটিতে নিখুঁত সফট ল্যান্ডিং ; যাবৎ সুন্দরের অপেক্ষায় হাঁ করে চেয়ে থেকেছে  সনৎ, বাজি ধরেছে তার  আগমনের,  আর  সেই সুন্দরের রথের চাকা মাটিতে বসে গিয়েছে বারবার;  হেরে গিয়ে বিদ্রূপ শুনতে শুনতে  মুখ কালো করে দরজা বন্ধ করেছে সনৎ । আবার কপাট খুলেছে, অপেক্ষা করেছে- আবার হেরেছে। ধুলোমাখা হাতে স্ক্র্যাপবুক ওল্টাচ্ছিল সনৎ। সে যে নিজের অজান্তেই আবার দুয়ার খুলে অপেক্ষা করছে- 'ভাবনা তাকে যুগপৎ বিস্মিত সুখী করছিল। 

~*~

সন্ধ্যের মুখে জেম্মার ছোটো রেডিও চালিয়ে রাখে পায়েল। রান্নাঘরে আটা মাখে,  রুটি করে। ধনঞ্জয় বাজার নিয়ে ফিরলে টিভি চালায় তারপর। স্মিতা তখন দোতলায় নিজের ঘরে মেল টেল করে, সময় মিলিয়ে বুল্টি আর পঙ্কজের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলে। আজ বিকেলে এফ এমে আমি যামিনী  তুমি শশী হে বাজছিল। কবেকার  গান কানেক্ট করছিল স্মিতার ছোটোবেলাকে- এ’বাড়ির বড় ঘরে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছে, সাদা কালো টিভির স্ক্রীনে উত্তম আর তনুজা- জেম্মা এক হাতা ভাত এনে স্মিতার থালায় দিল, মা টেবিলে বসে খাতা দেখছে, বাবা  যেন টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিল টুক করে-

সকলের মত এতদিন সেও জানত মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যুর দিকে যায়, যেন ডাউনের গাড়িতে উঠে পড়া , গাড়ি বদলে, আপের ট্রেন ধরার আর কোনো উপায় নেই; অথচ ইদানিং তার মনে হয়,  এই যে তার মাঝবয়স- এই অবধি সে কেবল ডাউনের গাড়িতে ছিল, আর এই যে এখন সে এখানে এসেছিল জেম্মার কাছে,  সে যেন এই সুযোগে ট্রেন বদল করে নিয়েছে। ডাউনের ট্রেন থেকে নেমে আপের গাড়ি ধরেছে- এখান থেকে ডাউন এর রুট অলীক দেখাচ্ছে আর আপের পথ সে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পাচ্ছে- পঙ্কজ আর তার সম্পর্কের মধ্যে  একটা কুয়াশা ছিল বরাবর- পঙ্কজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও তার মনে হয়েছে এই মানুষের একটা বেদনার  জায়গা রয়েছে- যা সে আড়াল করে রেখেছে তার থেকে। অথচ হাসি খুশি মৃদুভাষী পঙ্কজ  তাকে অসুখী রাখে নি কোনোভাবে। স্মিতার মত সংসারী মানুষের এই সব নিয়ে ভাবালুতার সময় থাকে না। এত বছর  সে তার ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, পঙ্কজের বেদনার জায়গা খুঁজে দেখতে দ্বিধায় থেকেছে; হয়ত অজানা কিছু আবিষ্কারের ভয়ও পেয়েছিল সে

দূর প্রবাসে স্মিতা পঙ্কজকে দ্রুত চিনে নিতে চেয়েছিল। মানুষকে চিনতে গেলে তার ছোটোবেলা জানতে হয়- একথা তার মনে হত বিয়ের পরে পঙ্কজের সঙ্গে তার কথায় নিজের ছোটোবেলা  ভরে ছিল- জেঠু, জেম্মা, মা, বাবা, বাগান, পুকুর আর পুকুরের তলার আস্ত শহর। পঙ্কজও বলেছে গল্প- কলেজ, ইউনিভার্সিটির র‌্যাগিং, ক্লাস বাঙ্ক, বন্ধুরা, প্রথম নেশা করে নাজেহাল হওয়া- এসবই খুব মামুলি গল্প যা সব ছেলেদের ঝুলিতেই থাকে- সব গল্প এক ছাঁচের, এক রংএর- অন্যের গল্প নিজের বলে চালিয়ে দিলে তা ধরাও যায় না, মিথ্যে বলাও হয় না বস্তুত।

আসলে, মানুষের  একদম নিজের একটা গল্প থাকে যা আঙুলের ছাপ কিম্বা জেব্রার ডোরার মত ইউনিক- স্মিতার পুকুরের গল্পের মতো।   পঙ্কজের নিজস্ব একটা গল্প  স্মিতা এক্সপেক্ট করেছিল বিয়ের পরে। অপেক্ষা করেছিল।  অতঃপর  নিজের মত করে চেষ্টা চালায় স্মিতা - যেন এ’ গল্প তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। শ্বশুর শাশুড়ি, শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীস্বজনের সঙ্গে হাজার গন্ডা ঘরোয়া  কথা চালিয়ে গিয়েও সে পঙ্কজের নিজস্ব গল্পের সন্ধান পায় নি। এর থেকে তার দুটো কথা মনে হয়েছিল- হয় পঙ্কজের কোনো গল্প নেই  কিম্বা পঙ্কজের গল্প স্মিতার পুকুরের নিচের শহরের মতো কোথাও ডুবে আছে-  সে গহীন পুকুরে অথৈ জল, বেদনা এমনকি রক্তের সম্ভাবনাও সে দেখেছিল।

পঙ্কজ কোনোদিন স্মিতার কাছে সাহেবগলির কথা বলে নি। ও’ দেশে পঙ্কজের বন্ধুদের কেউ তাকে আবাল্য চেনে- তাদের সঙ্গে ছোটোবেলার সামান্য যেটুকু কথা হত, সেখান থেকেই স্মিতা সাহেবগলির নাম পায়। পঙ্কজকে জিগ্যেস করলে- ' এইট টেইট অবধি পড়েছিলাম  ওখানকার স্কুলে,  ভুলে গেছি সব।' বলে চুপ করে যায়। এই অদ্ভুত ভুলে যাওয়া স্মিতাকে ভাবিয়েছিল। স্মিতার মনে হয়েছিল, পঙ্কজের গল্প সম্ভবত সাহেবগলির কোথাও লুকিয়ে,  যদিও 'ধারণার কোনো যৌক্তিকতা সে নিজের মনকেও বুঝিয়ে উঠতে পারে নি।

 স্মিতা সন্দেহপ্রবণ  নয়, সে শুধু মনে করত- এই সব নিজস্ব গল্প দুটো মানুষকে কানেক্ট করে পুরোপুরি। কানেকশান তৈরি করতে সে নিজেকে ব্যর্থ ভাবত ইদানিং, দুজনের সম্পর্কে শৈত্য এনে দিয়েছিল সেই ভাবনা। জেম্মার অসুখের  খবর পেয়ে প্রথম সুযোগেই সে ফিরে আসে- তার মনে হয়েছিল জেম্মার   চিকিৎসা করানো ছাড়াও তার  উল্টো পথে হাঁটা জরুরী। আপের পথে পঙ্কজের গল্প খুঁজে পেয়ে গেলে আবার ট্রেন বদলাবে সে?

রেডিওর গান বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ।স্মিতা ভাঙা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জল দেখছিল। শৈশবে যেখানে সে এক প্রাচীন নগরীকে হেঁটমুন্ড ঝুলে থাকতে দেখেছিল, এই গোধূলিতে একটি জলঢোঁড়াকে দেখছিল সেখানে। কখনও মনে হচ্ছিল,  সাপ একই জায়গায়,  নিরাবলম্ব, ভাসমান, পরক্ষণেই মনে হচ্ছিল এগোচ্ছে; ঠিক সেই সময় হাওয়া উঠেছিল- উপরের তল ভেঙে ভেঙে ছোটো ছোটো তরঙ্গ উঠছিল জলে, তখন জলের তলায় ঠাহর হচ্ছিল না। স্মিতার ছায়া লম্বা হয়ে জলে পড়ছিল যখন, সাপকে ভাঙা ডালের মত লাগছিল, আরো অন্ধকার ঘনিয়ে এলে সব ছায়া জমাট বেঁধে যাচ্ছিল- আলাদা করার যো থাকছিল না। শীতের সেই সকালের কথা ভাবতে চাইছিল স্মিতা। সে কুয়াশার সকালের স্মৃতি সংশ্লিষ্ট আর কেউই রইল না- স্মিতা ছাড়া- এই ভাবনা মনে আসতেই ওর ছোটোবেলা, বিয়েবাড়ির সকাল, কুয়াশা, বনময়ূর, জেম্মা  সব মিলেমিশে জট পাকিয়ে দুঃখের জমাট পিণ্ড হয়ে জলের তলায় ডুবে  গেল যেন -  বিষাদ, স্মৃতি , মৃত্যুশোক সে পিণ্ডকে এত ভারি করে তুলছিল যে স্মিতা তাকে ভাসিয়ে রাখতেই পারছিল না। নিজের অবিচ্ছেদ্য সে দুঃখের ড্যালা কালচে জলের তলায় ঠাহর হচ্ছিল না এই মুহূর্তে।   বস্তুত  জলের তলায় সত্যতা বলে কিছু হয় না- এইরকম মনে হচ্ছিল স্মিতার।

গ্রীষ্ম-১

 

ঘামতে ঘামতে আইলাইনার লাগাচ্ছিল মিঠু, লিপস্টিকের শেড বাছছিল; বড় টিপ - যেমন পরে। লম্বা ঝোলা দুল লাগাতে লাগাতে আয়নায় দেখল-  খানিকটা ছিপছিপে মনে হচ্ছিল বাঁ পাশ থেকে দেখল একবার, ডানদিক ফিরে  দেখে নিল তারপর । এ’ভাবে নিজেকে দেখতে ভালো লাগছিল আজ। মৃন্ময়ীর নতুন বাড়িতে, বন্ধুরা আজ ওর শাড়ি দেখে জিগ্যেস করবে কোথা থেকে কিনলি, ঝোলা দুল আঙুল দিয়ে পরখ করবে, টোকা দিয়ে দুলিয়ে দেবে , ওর হাত ধরে বলবে-এখনও কী নরম রে তোর হাত, আমাদের হাত তো..  বলে ফোঁস করে শ্বাস ফেলবে- আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই সব কল্পনা করছিল মিঠু । নিজে নিজে হাসছিল। অথচ শম্পার ছেলের অন্নপ্রাশনের সকাল এরকম ছিল না-টেনশনে অস্থির রাত থেকেই ।  আলমারি ছত্রখান করে খাটের ওপর সাজিয়েছিল শাড়ি, লং স্কার্ট, প্যালাৎজো -তারপর ভোর হতে না হতেই কোন্ আবরণ  যাবতীয় চর্বি টর্বি থলথলে ভাব আর সনতের সঙ্গে ওর সম্পর্কের সমস্ত কথা লুকিয়ে রাখতে পারবে পরখ করে দেখে নিচ্ছিল ; দরজা বন্ধ করে একের পর এক পোষাক গায়ে চড়াচ্ছিল,  আয়নায় দেখছিল নিজেকে আর পরমুহূর্তেই খুলে  ফেলে  ছুঁড়ে ফেলছিল খাটের ওপর। নতুন জামাকাপড়ে নিজের শরীরের গন্ধ মিশলে, তা তখন নতুন থেকে নিজের হয়। ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু ঘটছিল- মিঠুর শরীরের যাবতীয় রাগ বিরক্তির গন্ধ নিজেদের গায়ে মেখে সেই সব ছুঁড়ে ফেলা জামাকাপড় যেন কুঁকড়ে ছোটো হয়ে যাচ্ছিল- যেন সব সুদূর অতীতের পোষাক, এখন আর মিঠুকে ফিট করবে না। " কী রে আর কত দেরি করবি?" -ছন্দা চেঁচিয়ে ডেকেছিল। দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিল মিঠু, সঙ্গে গুলগুলে, কুন্তী আর আগুনের হলকার মত রাগ।

-যাব না অন্নপ্রাশনে ।

-ওমা কী হল হঠাৎ? শরীর খারাপ লাগছে?

-কী পরে যাব? কিছুই মানায় না আমাকে। সবাই হাসাহাসি করবে।

ছন্দা আর বিপ্লব মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল।

তারপর ছন্দাই বলেছিল-“আমার একটা শাড়ি পরে যাবি? পুরী থেকে যেটা কিনলাম গতবার? নাকি মঙ্গলগিরি টা ? হালকা হবে - যেটা তুই দিলি এবারে ।

-কোনটা? বুঝতে পারছি না

-চল, দেখাচ্ছি।

ছন্দার শাড়ির থেকেই একটা বেছে নিয়েছিল মিঠু - মায়ের শাড়ির আঁচলের তলায় যেন সব লুকোনো গেল।

শম্পার বাড়ি পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল এই সব করে। নূপুর, বকুল, মৃন্ময়ী ওকে জড়িয়ে ধরে হই হই করে উঠেছিল- "কী সুন্দর হয়েছিস রে! বর কোথায়?" মিঠু সনৎএর ট্যুরের কথা বলেছিল। উৎসববাড়িতে এই সব কথা সবাই স্রেফ অজুহাত জেনেও মেনে নেয়, তারপর ব্যস্ততায় ভুলে যায়। মিঠুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। এর ওপর নূপুর আর মৃন্ময়ীও  মিঠুর কথায় সায় দিয়ে ওদের বরদের ট্যুরের ঘনঘটার রোমহর্ষক বিবরণ  পেশ করতে শুরু করে দেয়। মিঠুর  হাসি পেয়েছিল;  আড়ষ্টতা কেটে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। শম্পার ছেলেকে কোলে নিল, আদর করল, শম্পার  শাশুড়ির সঙ্গে হাত লাগিয়ে আসন পাতল, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালল। অনুষ্ঠানবাড়ি গমগম করে উঠছিল ক্রমশ, ক্যাটারারের ছেলেরা চা কফি দিচ্ছিল হাতে হাতে, দুপুরের খাওয়ার জায়গায় টেবিলে ছোটো ফুলদানিতে  গোলাপ রাখছিল। এই সব কোলাহলে, আনন্দে, ভীড়ে মিঠু মিশে যাচ্ছিল যেন আলাদা করে ওর  আর কোনো অস্তিত্বই নেই- এই উৎসব বাড়ি, ফিসফ্রাইয়ের গন্ধ, বাচ্চার কেঁদে ওঠা , শাঁখ , উলু, হাসির শব্দ সুতোর গুছির মত ওর গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। যেন চিকের আবরণ তৈরি করছিল মিঠুর সামনে। সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিল , আবার কোথাও যেন ছিলই না। এই সব আবরণ চিরস্থায়ী হয় না- ' তো জানাই। পর্দা ছিঁড়ল গার্গী; ওর হাত ধরে টানল-"ওমা তুই! কখন এসেছিস? তোর বর কে তো দেখলামই না বিয়ের পর। এখানে কী ভীড় রে, চল ঘরে বসি"

সনৎএর কথা জিগ্যেস করেছিল গার্গী- কী নাম, কী করে টরে এইসব মামুলি কথার পরে দুম করে ছবি দেখতে চাইতেই চিকের আবরণ ছিঁড়ে কুটিকুটি হয়ে উৎসব বাড়ির মেঝেয় লুটিয়েছিল। ছেঁড়া টিস্যু, কফির কাপ, গিফ্ট র‌্যাপারের সঙ্গে সেই সব টুকরো ঝেঁটিয়ে বাইরে ফেলে এসেছিল ডেকরেটরের লোক। গার্গীর মুখোমুখি হয়েছিল মিঠু।

-ছবি কি সঙ্গে নিয়ে ঘুরব নাকি?

- ব্যাগে রাখিস না? মোবাইলে নেই?

- দূর, আমার তো পুরোনো ফোন- ছবিটবি কী করে থাকবে?

-তুই যেন কী! ব্যাগে এক পিস ছবি ফেলে রাখতে কী হয়? আজ জানিস আমরা আসব, দেখতে চাইব ছবি- কী রে?

- ব্যাগে থাকে তো। আজ ব্যাগ বদলেছি এখানে আসব বলে। ছবি কলেজের ঝোলায় রয়ে গেছে-

-কেমন দেখতে রে? তোর মত সুন্দর? হ্যাঁরে গোঁফ আছে? দাড়ি? আজকাল আবার সব দাড়ি রাখা ফ্যাশন হয়েছে। আমার ভালো লাগে না। তপনকে বলে দিয়েছি ...

অক্লান্ত বকছিল মেয়েটা। গার্গীর এই মুণ্ডুকাটা  অবয়বহীন বকবক আবার একটা নতুন আবরণ তৈরি করছিল এই ছোটো ঘরে যে পর্দার আড়ালে মিঠু এখন বলে বলে ছক্কা মারবে। ব্যাগে ছবি থাকার কথা বলে ফেলার পরেই মিঠুর হাত খুলে গিয়েছিল।  প্রতিটি বল খেলছিল ব্যাটের মাঝখান দিয়ে- বাউন্ডারি পার হয়ে যাচ্ছিল বল আর তা কুড়িয়ে আনতে আনতে  ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল গার্গী। মিঠুর কেমন নেশার মত হয়ে গিয়েছিল। তার বিবাহিত জীবন একেবারে রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসছিল, সনৎএর রূপগুণ বর্ণনা করতে গিয়ে সে আর থামতে চাইছিল না। ফলে, সেদিন দুপুরের খাওয়া শুরুর আগেই সনৎ কার্তিক আরিয়ান, স্টিফেন হকিং আর রতন টাটার কম্বিনেশন  হয়ে গিয়েছিল।

~*~

আজকের দিন সেদিনের চাইতে একদম আলাদা। অনর্গল মিথ্যে বলার যে একটা আনন্দ আছে- তা আবিষ্কার করে মিঠু হতবাক হয়ে যায় প্রথমটায়, তারপর নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ায় - ব্রাভো মিঠু ব্রাভো। বস্তুত, শম্পার বাড়িতে হাত খুলে খেলার পরে  মিঠুর কনফিডেন্স এমনই বেড়ে যায়, যে সে রোদচশমা, চাদর ছাড়াই কলেজ যেতে শুরু করে। কলেজের বাইরেও আজকাল বেরোচ্ছিল মিঠু। অন্নপ্রাশনের দুপুরে পুরোনো সহপাঠীদের সঙ্গে আবার যোগাযোগে ঘন ঘনই বিবিধ আমন্ত্রণ পাচ্ছিল সে- সিনেমা থিয়েটার গানের জলসা সত্যনারায়ণ পুজো। বিয়ের দিনের একটা দুটো ছবি এবার সে সঙ্গে নিতে থাকে;  সে ছবি বার বার দেখে  আর সনৎএর দেশ বিদেশে ট্যুরের গল্প একনাগাড়ে  শুনতে শুনতে, গার্গীসহ সবাই মিঠুর বরপ্রসঙ্গ আড্ডার অ্যাজেন্ডা থেকে একরকম বাদ দেয়। বস্তুত আজ মৃন্ময়ীর গৃহপ্রবেশে যাওয়ার আগে তার ব্যাগে বিয়ের ছবি, রোদ চশমা , কালো চাদর কিছুই ছিল না। নির্ভার লাগছিল মিঠুর। ঝোলাদুল পরল, লিপস্টিক লাগাল, ব্যাগ নিয়ে  বেরোতে যাবে, ছন্দা এসে দাঁড়ালঃ

-এই গরমে না বেরোলেই নয়? কালও বমি করলি। বাথরুমে গেলি। আয়নায় চেহারাটা দেখ।  তোর রেস্ট দরকার। যাস না আজ। সেই তো হাবি জাবি খাবি। কথা শোন মিঠু।

- যাব বলেছি। এখন না গেলে হয়?

-কেন হবে না? শরীর খারাপ হয় না মানুষের?

-শুধু দুপুরটুকুই তো, সন্ধ্যার মুখে ফিরে আসব-

- বললেই ফিরতে পারবি? রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখ। ভোটের আগে রোজ জ্যাম। এখানে গন্ডগোল, ওখানে মারামারি। কেন বাড়িতে বুঝি মন টেঁকে না? আমি আছি, মামু আছে - দুটো গল্প তো করতে পারিস ছুটির দিনে-

- আবার কী শুরু করলে? সর্বক্ষণই তো কথা হচ্ছে-

-বাড়িতে কতক্ষণ থাকিস ? সারাদিন কলেজ, খাতা দেখা; আগে ছুটির দিনে বাড়ি থাকতি, এখন .. যাস না মিঠু আজ-

-সরো, বেরোবো-

- একটা কথাও যদি শুনিস তুই-

- কথা শুনি না তোমার? কোন্‌ কথা শুনি না মা? কোন্‌ কথা? এই বয়সে কটা মেয়ে তার মার সব কথা শুনে চলে? কথা শুনেই তো বিয়ে করেছিলাম-

- অমনি বিয়ের কথা তুললি-

-তুমিই বাধ্য করলে। চুপ করো এখন প্লীজ। বেরোবো।

হাত জোড় করল মিঠু। ছন্দা চোখে আঁচল দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

~*~

মিঠুর স্মার্ট ফোন নেই। উবের ডাকা সম্ভব নয়। বড় রাস্তার মুখ থেকে ট্যাক্সি নেবে। এসি বাস পেলে উঠে পড়তে পারে। সকালেই চড়া রোদ। গলি দিয়ে বড় রাস্তার দিকে হাঁটছিল মিঠু। ছন্দার সঙ্গে চেঁচামেচি করে, বলাইকেই ফোন করা হয় নি।  রিক্সা করে গলির মুখ অবধি যাওয়া যেত।  রাগ হচ্ছিল খুব- প্রথমে ছন্দার, তারপর গোটা পৃথিবীর ওপর - ঘাড় মাথা দপদপ করছিল   রাগ সামান্য কমতে, ছন্দার অধিকারবোধ তাকে  বিস্মিত করছিল, পীড়া দিচ্ছিল অসম্ভব; আচমকাই  ঘন বনের মধ্যে একটা বড় গাছের কথা মনে ' মিঠুর, যে গাছে বাচ্চাদের একটা সাইকেল আটকে আছে। মিঠু এই ছবিটা নেটে দেখেছিল- কেউ ফরোয়ার্ড করেছিল ওকে, বোধ হয় দিব্যেন্দু। ছবিটায় একটা মিথ্যে গল্প ছিল যেখানে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে তরুণ সৈনিকের ছোটোবেলার সাইকেল গাছে হেলান দিয়ে রেখে চলে যাওয়া এবং এই সব করুণ গল্পের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অনুযায়ী সেই তরুণের আর ফিরে না আসার কথা ছিল। সেই থেকে সাইকেল ঐখানে এবং গাছ  তাকে গ্রাস করে নিয়েছে ক্রমশ -এই রকম কথিত ছিল দিব্যেন্দুর ফরোয়ার্ড করা গল্পে;  পরে দেখা যায় কাহিনী বেবাক আলাদাঃ এক স্থানীয় বালক উপহার পেয়েছিল সাইকেল, পছন্দ না হওয়ায়, জঙ্গলে ফেলে রেখে সে বাড়িতে বলেছিল-  সাইকেল হারিয়ে গেছে।  নিজেকে গাছের গায়ে আটকে থাকা সাইকেল মনে হচ্ছিল মিঠুর- পরিত্যক্ত আর একলা। নিজেই যুক্তি সাজিয়ে তার এই মনে হওয়া খণ্ডন করার চেষ্টা করছিল। পারছিল না, ফলে  বৈশাখের খটখটে আকাশের নিচে  নিজের যে ছায়া পড়ছিল , তাকেই সব থেকে আপন মনে হচ্ছিল। রাগ দুঃখ ক্ষোভ মাথা থেকে গলায় নামছিল; প্রথমটায় গলায় বিঁধছিল কাঁটার মত, ঢোঁক গিলছিল সে, তারপর গিলে নিচ্ছিল। বড় রাস্তার মুখে পৌঁছতেই ট্যাক্সি পেয়ে গিয়েছিল মিঠু। গাড়ির জানলার কাচ তুলতে গিয়ে গলির দিকে চোখ গেল ওর রোদে রোদে গলির রহস্যময় বাঁক উধাও এখন- বড়রাস্তার মুখ থেকে  কৃষ্ণা স্টোর্স অবধি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে; মামু আর টুম্পাকে একসঙ্গে হাঁটতে দেখল ও ।  মামুর হাতে বাজারের ব্যাগ, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে টুম্পার সঙ্গে, মাথা নাড়ছে টুম্পা। এই দৃশ্যে অস্বাভাবিকত্ব কিছু নেই। অথচ অস্বস্তি হচ্ছিল যার কারণ তার জানা ছিল না।  চোখ সরিয়ে নিল মিঠু। রাগের সঙ্গে অস্বস্তিটুকুও গিলে নিয়ে ,মৃন্ময়ীর নতুন বাড়ির ঠিকানা ঝালিয়ে নিল মনে মনে। ড্রাইভারকে বলল-"চলুন দাদা।"

~*~

বিপ্লব আর ছন্দা পায়চারি করছিল ছাদে। মিঠু বলেছিল সন্ধ্যে নাগাদ ফিরবে। টুম্পা রুটি করে চলে যেতে 'টা বাজল।  মিঠুর মোবাইল যথারীতি সুইচড অফ।

"অফই যদি করে রাখে,  মোবাইল ফোন গলায় ঝুলিয়ে বেরোনোর কী অর্থ , বুঝি না"  ছন্দা গজগজ করছিল।

-লাস্ট কখন কথা হয়েছে?

-সকালে যখন বেরিয়ে গেল। বাবা,  কী মেজাজ!  তারপর তো আর কথা হয় নি। অদ্ভুত মেয়ে। আমাদের কথা ভাবেই না।

- মনে হয়, ওখানে খেয়ে উঠতে দেরি হয়েছে। গল্প টল্প করে হয়ত  সন্ধ্যা নাগাদ বেরিয়েছে। তারপর রাস্তায় আটকে গেছে। মৃন্ময়ীর নম্বর জানো?

-না। ফোনের খাতায় থাকতে পারে। তবে সে তো ওর বাপের বাড়ির নম্বর, এখনকার নম্বর জানি না। আচ্ছা, পথে সনৎ ধরল না তো? বলাইকে ফোন করো একটা।

-নটা বেজে গেছে, এখন আর বলাইকে পাবে না-

- আরে বাবা, সবেতেই না। সবেতেই না। ফোন করে দেখবে তো- মনে হচ্ছে সনতের সঙ্গে দেখা হয়েছে-

- বলাইকে ফোন করে কী লাভ? বা কী জানবে? আর রাস্তাঘাটে তো লোক থাকে, সনৎ কী করবে?

-কী করবে? কী করতে পারে দেখো নি? তুমি এনেছিলে এই সম্বন্ধ- ভালো ছেলে, বিদ্বান, ভালো চাকরি, মিঠুর সঙ্গে মানাবে।

-কী করে বুঝব?

-সেই। বুঝবে কী করে। নিজের মেয়ে হলে ঠিক বুঝতে- বেছে বেছে নোংরা লোক ধরে আনতে না-

- তোমরাও তো দেখেছিলে, দেখো নি?

-দেখে কি 'সব বোঝা যায়? খোঁজখবর কিছুই নাও নি। তুমি নিজে নোংরা, তোমার পছন্দও তাই- ছন্দার গলা চড়ায় উঠে থরথর করে কাঁপছিল। কথার পিঠে কথা উঠে আসছিল। বল্লমের ডগার মত তীক্ষ্ণ সব কথা বার্তা। একসময় ককিয়ে উঠেছিল বিপ্লব-" চলে যাব। আর এখানে থাকব না। মিঠু ফিরুক। আজই চলে যাব।"

-কোথায় যাবে? কেউ আছে তোমার? কে বসে আছে বাড়া ভাত সাজিয়ে, আমিও দেখব। চলে যাবে! মুরোদ কত!

ছন্দার গলা উত্তরোত্তর চড়ছিল।  টিভিতে সিরিয়াল দেখা বন্ধ রেখে এক দুই  তিন করে ছায়াপিণ্ডরা সব পাশের বাড়ির ছাদে উঠে আসছিল। অন্ধকারে লাল বিন্দু দেখতে পেল বিপ্লব- সিগারেট ধরিয়ে মজা দেখছে সুধীন। এই সময় বাড়ির সামনে বলাইএর রিক্সা এসে দাঁড়িয়েছিল।মিঠুকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল বলাই। টেনে টেনে প্যাডেল করছিল। কমজোরি আলোয় 'পাড়ার প্যাঁচালো গলি আবার তার সমস্ত রহস্যময় বাঁক নিয়ে  উপস্থিত। অসম্পূর্ণ এক্কাগাড়ির মত লাগছিল বলাইএর রিক্সাকে। ভৌ ভৌ করল কালু। রিক্সার পিছনে দৌড়োলো খানিকক্ষণ। ছন্দা দ্রুত নামছিল সিঁড়ি বেয়ে - দরজা খুলে দেবে। বিপ্লব ওর পিছনে।  মিঠু ঘরে ঢুকে  ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলল সোফায়- সকালের পারফিউমের গন্ধ উবে গিয়ে অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে- অচেনা আর অস্বস্তিকর। শাড়ির পিছনদিকটা ভিজে দেখাচ্ছিল,  গলার নিচ থেকে অনেকটা জায়গা খয়েরি হয়ে আছে- ঠোঁটের কোণে শুকনো দানা দানা - বমির দাগ মনে হচ্ছিল ছন্দার।

"এত দেরি হল। একটা ফোন তো করতে পারতি-" মেয়ের মুখ দেখে বাকি কথা গিলে নিল ছন্দা । ইতিমধ্যে,বাইরের ঘর থেকে বারান্দায় স্প্রিন্ট নিয়েছিল মিঠু। তারপর পেট চেপে বাথরুমের সামনে বসে পড়ল উবু হয়ে। মিঠুর শরীর কাঁপিয়ে বাতাস বেরিয়ে এল অনেকখানি। তারপর বর্জ্য। আলকাতরার মত কালো, দুর্গন্ধময়।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

গ্রীষ্ম-

 

শেষ বিকেলে বোলতার চাক ভাঙতে পঙ্কজ বাগানে এল কয়েক ফালি রোদ এখন ওর মাথায় আর পিঠে পড়ছে-  জ্বালা করছিল ঘাড়, পিঠ। আজ রবিবার। ছুটির দিনে  বাড়িতে তিষ্ঠোতে পারে না- অফিসে গেলে তাও দিন কেটে যায় এক রকম;  উইকএন্ডে পরাশর , শান্তারা ওদের বাড়ি যেতে বলেছে বার কয়েক -সুবিমল লিপিও। পঙ্কজের ইচ্ছে করে না।  উপরোধে,পরাশরের কাছে গিয়েছিল একদিন সন্ধ্যের দিকে, কিছুক্ষণ পরেই বিরক্ত লাগতে শুরু করল- সেই এক কথা, এক রসিকতা, এক প্রশ্ন;  তার মধ্যে  সুবিমল আর পরাশরের কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে  গিয়েছিল।  দেশে ইলেকশনে কী হবে সেই নিয়ে প্রথমে হাল্কা কথা, তারপর তর্কাতর্কি ঝগড়ার দিকে টার্ন নেয়; পরাশর তেড়ে যায় সুবিমলের দিকে- লিপি মাঝখানে পড়ে ম্যানেজ করে শেষ অবধি। বন্ধুদের আড্ডায় এই সব হরবখত হয়েই থাকে, বিশেষত ইলেকশন  নিয়ে যখন তেতে আছে সবাই। পঙ্কজ তর্ক করতে ভালোবাসত-হয়ত কথা বলত একটু বেশিই- তীক্ষ্ণতার বদলে ভার  থাকত সেই সব কথায়-  ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যোগ ছিল, ফলে নিজস্ব চিন্তা আর উৎসাহ নিয়েই যোগ দিয়েছে তর্কে - লিপি বলত, "আরো বলুন, পঙ্কজদা", সুবিমল বলত- "জ্জিও বস, পড়ানো উচিত ছিল তোমার।" ইদানিং যেন সব কিছু অর্থহীন লাগছে; অবয়বহীন এক শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে পঙ্কজ, যার শুরু দেখা যায় না,  শেষও নেই সম্ভবত - যেন এক অতল  খাদ, ঘোর কুয়াশা উঠে আসছে সেখান থেকে পঙ্কজ দুই হাত নেড়ে নেড়ে কুয়াশা সরানোর চেষ্টা করে,  কুয়াশার ঘনীভবনে তার চশমার কাচে জলবিন্দু জমা হয়, সে বারে বারে চশমা খোলে, কাচ মোছে, ফোকাস করার চেষ্টা চালায় আর একটি চারপেয়ে প্রাণী স্রেফ তার ল্যাজ নেড়ে নেড়ে নস্যাৎ করে দিতে থাকে সব- বৃহত্তম গণতন্ত্রের পার্লামেন্টারি ইলেকশনের ফোরকাস্ট, একজিট পোল,  ডান আর বাঁ দিক ঘেঁষা রাজনীতির চাপানউতোর- সব, সব, সব।  বন্ধুদের বাড়ি অ্যাভয়েড করছিল পঙ্কজ- কেউ যেতে বললে,  অফিসের প্রচুর চাপ, গোটা উইকএন্ড জুড়েই  কাজ করতে হবে বলে কাটিয়ে দিচ্ছিল ইদানিং; অথচ বাড়িতে থাকলেই ঘরের আনাচে কানাচে বনময়ূরের ঝরা লোম, সোফায় বনময়ূরের গায়ের গন্ধ, চিবোনো খেলনা, খাওয়ার বাটি পঙ্কজকে অস্থির করে তুলছিল- নিজের ছায়াকে বনময়ূর ভেবে চমকে উঠছিল,  সামান্য  আওয়াজেই  মনে হত   বুঝি বনময়ূর হাঁটছে, আর কাঠের মেঝেয় নখ ঠোকার আওয়াজ উঠছে - ঠকঠক ঠকঠক ঠকঠক ... তখন ঘর থেকে বাইরে পালিয়ে এলে আবার রোদের তাতে পুড়ে যেতে  হচ্ছিল ইদানিং-

এবারের গ্রীষ্ম শুরু থেকেই তার যাবতীয় পরাক্রম দেখাতে সক্রিয়।  এত বছরে পঙ্কজ সূর্যের এই তেজ দেখেনি এই দেশে।  পাড়ায় ঢোকার মুখে কাঠের প্যানেলে বুশফায়ারের ডেঞ্জার রেটিংএ কোড অরেঞ্জ দেখাচ্ছে গত দু সপ্তাহ। আজ   এখন রোদ পড়তে বাগানে এসেছে। পরশু অফিসে বেরোনোর সময়  বাগানের দিকের দরজায় চাক তৈরি হতে দেখেছিল। তারপর অফিস ফেরত স্প্রে কিনে এনে উইকএন্ডের অপেক্ষায় ছিল। এখন স্প্রের ক্যান হাতে নিয়ে বোলতার চাক নিরীক্ষণ করছিল পঙ্কজ- প্রাইমারি স্কুলের  ছাত্রর তৈরি কাগজের ফুলের মত লাগছিল বোলতার  বাসাকে- একটু ভারি কাগজ দিয়ে কোণা খোপের পাশে খোপ জুড়ে জুড়ে তৈরি করা ফুল যেন। এই মুহূর্তে কোনো বোলতা দেখা যাচ্ছিল না আশে পাশে। দূর থেকে স্প্রে করতে শুরু করল পঙ্কজ। বার চারেক স্প্রে করার পরে, পরের স্টেপ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল , তারপর হাতে প্লাস্টিক জড়িয়ে এক টান মারল চাকে- যেন ফুল ছিঁড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে, সেই কোণা কাগজের ফুল থেকে বেরিয়ে এল গোটা দশ মিনিয়েচর ফাইটার প্লেন- "আঃ আঃ" ককিয়ে উঠল পঙ্কজ- প্লাস্টিকের ওপর দিয়ে হুল বসিয়েছে এক ফাইটার। জ্বালা ব্যথায় অস্থির হয়ে ওদিকে কিছু বোলতা মাটিতে ঝরে পড়ছিল  টুপটুপ করে, তাদের দেহ নিঃসৃত ফেরোমন সম্ভবত  কনেক্ট করছিল বাকিদের-  তারা পাক খাচ্ছিল মাথার ওপর, উড়ে আসছিল  পঙ্কজের দিকে। এলোপাথাড়ি স্প্রে করছিল পঙ্কজ - যেন একের পর গুলি করছে ওর নিজের যাবতীয়  অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কে।

~*~

- লাফটার কানেকট্স পীপল

- আর নতুন কথা কী হল?

- নতুন কথা নয় বলছ? তুমি জানতে?

 লিপি উত্তর দিল না। অফিস বেরোনোর জন্য রেডি হচ্ছিল। কথা শুরু হলেই দেরি হয়ে যাবে। চটপট তিনজনের লাঞ্চবক্স প্যাক করছিল। তিন্নি বাথরুম থেকে বেরোলেই মা মেয়ে বেরিয়ে পড়বে।  তারপর মেয়েকে স্কুলে  ড্রপ  করে  অফিস যাবে লিপি। সুবিমলের অফিস ডাউনটাউনে- পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সুবিধে। তিন্নি বেরোলে স্নানে ঢুকবে সুবিমল ;  এখন ল্যাপটপে খুটখাট করতে করতে কথা বলছিল - টীম বিলডিং এর কী ওয়র্কশপ অ্যারেঞ্জ করার দায়িত্ব পাওয়ার কথা- সেই নিয়ে এক্সাইটেড ;  নানা  আইডিয়া মাথায় কিলবিল করছে, এই নেট ঘাঁটছে, তো এই একে তাকে জিগ্যেস করছে;  লিপিকে চেঁচিয়ে ডাকল-

-আরে বলবে তো?

-কী বলব?

-লাফটার দিয়ে কানেকশনের আইডিয়াটা কেমন?

-নতুন কিছু নয় তো বললাম-

- সে তো লাফিং ক্লাব  ট্লাব  হয়েছে অনেক, তাই বলবে তো?  আরে এটা অন্যরকম-  টীম বিল্ডিং, বুঝলে লিপি? খুব ইন্টারেস্টিং।

লিপি কথা বাড়াল না, পিঠে ব্যাগ নিয়ে তিন্নি এসে দাঁড়াতেই বেরিয়ে পড়ল দুজনে। আর ল্যাপটপ নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল সুবিমল।

অফিস চত্ত্বরে ঢুকে ছায়া খুঁজতে সময় লাগে লিপির। কারপার্কে  গোটা কয়েক ঝাঁকড়া গাছ- ইতস্তত ছায়া। সেই সব গাছের নিচে গাড়ি রাখার  অলিখিত কম্পিটিশন চলে। লিপি অজান্তেই নাম লিখিয়েছে কম্পিটিশনে। চোখ মুখ সুঁচোলো করে অখণ্ড মনোযোগে ছায়া খুঁজছিল সে। টয়োটা থেকে মুখ বাড়ালো সুধা- "এই তো এখানে পার্ক করো।"

-আর তুমি?

- আমি শেড লাগিয়ে নিচ্ছি।

- না না ঠিক আছে। তুমি এখানেই পার্ক কর। আমি অন্য জায়গা দেখে নিচ্ছি।

- আরে একদিনই তো। কাল আর ছাড়ব না।

লিপি হেসে ফেলল।

গাড়ি লক করে অফিসে ঢুকেছিল লিপি।  সুধা হাঁটছিল পাশে পাশে - সামান্য হাঁফাচ্ছে।

-শরীর খারাপ লাগছে?

ফিক  করে হাসল সুধা-" চার মাস চলছে। সকালে এই সময়টা একটু টায়ার্ড লাগে।  তোমার 'টি? সরি। আমার জিগ্যেস করা উচিত হচ্ছে না। "

লিপি তিন্নির কথা বলছিল। সুধা বলছিল," আমিও মেয়ে চাই। মেয়েই হবে, দেখো।" নিজের পেটের ওপর আলতো  হাত বুলিয়েছিল তারপর।

- তুমি তো ল্যাবে।  এত সব কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করা কি ঠিক হচ্ছে? কথা বলেছ হেল্থ অ্যান্ড সেফটির সঙ্গে?

-বলেছি। কিছু কিছু কেমিক্যাল ইউজ করতে পারব না।  বাকি কাজে অসুবিধে নেই। গ্যাব্রিয়েলা, আমাদের সুপারভাইজর।  সেই মত কাজ অ্যালট করে।

-কোনো অসুবিধে হলে বোলো।

পাশাপাশি হাঁটছিল ওরা। ধুলোভরা সুপ্রাচীন কার্পেট মাড়িয়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠল দুজনে। তারপর লিপি ঢুকল নিজের কিউবিকলে। সুধা চলে গেল ল্যাবে- ওর আলাদা অফিস নেই। কিউবিকলের জানলা দিয়ে বাইরে দেখ্ল লিপি। দেখছিল,  ঝাঁকড়া গাছের তলায় কী ভাবে  স্পীড কমিয়ে কমিয়ে একদম দাঁড়িয়ে পড়ছে গাড়িরা। সকালের আলো  সেই সব গাড়িদের শরীরে প্রতিফলিত হয়ে লিপির চোখে পড়ছিল। সকালকে দুপুর মনে হচ্ছিল লিপির। মনে হচ্ছিল, এই গ্রীষ্মে সুভাগা যেন সূর্যমন্ত্র উচ্চারণ করেই চলেছেন আর পাথরের দেওয়াল, লোহার দরজা আগুনে আগুনে গলিয়ে সূর্যদেব দর্শন দিয়েছেন; সুভাগা যথারীতি  দুহাতে মুখ ঢেকে বলছেন , হে দেব রক্ষা কর, সমস্ত পৃথিবী জ্বলে যায়। সূর্যদেব বয়সজনিত কারণেই কানে শোনেন না। ফলত সুভাগার প্রার্থনায় যখন তাঁর আলো ক্ষীণ হয়ে আসার কথা, তিনি তাঁর জ্যোতি বাড়িয়েই চলেছেন- সে আলো মানুষের  চোখে সহ্য হচ্ছেনা। লিপি ব্লাইন্ড নামিয়ে দিল।

~*~

বুল্টিকে একটা পার্সেল পাঠানোর ছিল। মলে যেতে হয়েছিল সেই সব কারণে। কাজ সেরে ফিরে আসছে, হঠাৎ মনে হল, কী হবে এখন বাড়ি ফিরে !  একটা কোণা খুঁজে বসে পড়ল পঙ্কজ।  পরের উইকএন্ডেও তাই পরপর রবিবার গুলো জমজমাট শপিং মলে টানা বসে থাকতে শুরু করল পঙ্কজ। ছুটির দিনে ভীড়ে  ভীড়ে গমগম করে দোকানপাট, বিউটি পার্লার, আইসক্রীমের স্টল, ক্যাফে,  ফুডকোর্ট। উজ্জ্বল, হাসি খুশি মানুষ , হাতে বাহারি ব্যাগ , অথবা উপচে পরা ট্রলি ঠেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে-  এদের মধ্যে একজনও এই মুহূর্তে  পঙ্কজের মত খাদের সামনে দাঁড়িয়ে নেই?  নাকি গোটা পৃথিবী  জাস্ট দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে- ' এক আলোর জগত, আনন্দ, হাসি , স্বাস্থ্যের দীপ্তি ফুটে ফুটে বেরোচ্ছে, আর এক  মলিন  দুনিয়া কোথায় মুখ লুকিয়ে বাদুড়ের মত ঝুলে আছে,  সেই ম্লান, অন্ধকার জগৎ থেকে পঙ্কজ যেন ভুল করে এখানে এসে পড়েছে-

এখন রাত হয়েছে অনেক। পঙ্কজের চোখের সামনে শপিং মলের আলো নিভে যাচ্ছিল এক এক করে। ঘড়ঘড় শব্দে শাটার নামছিল, কোথাও ভাঁজ করা পেল্লায় দরজা দু দিক থেকে টেনে এনে তালা পড়ছিল এবং  কিওস্কগুলি ঢেকে যাচ্ছিল ঘন নীল  ভারি কাপড়ে।  কিম্ভূতকিমাকার অন্ধকারের স্তূপের তলায় ঝলমলে পশরা চাপা পড়ে যাচ্ছে-  অনেকটা মৃত্যুর মত।  ফুড কোর্ট, গ্রসারি এখনও খোলা। খদ্দেরের সংখ্যা কমে আসছে। কর্মচারীরা ন্যাতা আর স্প্রে নিয়ে বাসি খাবারের গন্ধ মুছছে, ঝকঝক করে তুলছে কাউন্টার, ছোটো কিচেনের চিমনি-  শাটার পড়বে একটু পরেই। পঙ্কজের বাঁ দিকে মাছের দোকান বন্ধ হবে এখন, স্টীলের বড় বড় ট্রের ওপর জমে থাকা পুরোনো বরফ পরিষ্কার করছিল টুপিপরা তরুণ। বেলচা প্রথমে বরফ স্পর্শ করছিল তারপর বরফ কেটে ধাতব তল ছুঁয়ে হাওয়া কাটছিল - দুটো আওয়াজের ফারাক  করতে পারছিল পঙ্কজ। নিজের হৃদপিণ্ডের ওপর রকম একটা আঘাত চাইছিল সে। চাইছিল একটা বেলচার ঘা পড়ুক; এতদিনের জমাট  বাঁধা বরফের চাঁই -যেমন ভারি তেমনই ঠান্ডা- কেউ বেলচা দিয়ে তাকে সরিয়ে নিক, প্রাচীন বরফ স্তূপ হয়ে পড়ে থাকুক রাস্তায়, তারপর গলে যাক-

গ্রীষ্মের রাতে নদীর দিক থেকে হাওয়া বাতাস খেলে যায় শহরের বুকে। মল থেকে বেরিয়ে তিনবারের চেষ্টায় সিগারেট ধরালো পঙ্কজ।  পার্কিংএর দিকে হাঁটল। গাড়ির দরজা খুলতে যাবে, যেন হাওয়া ফুঁড়ে  বেরিয়ে এল  এক মূর্তি- ফাটা জুতো, মলিন জামা প্যান্ট, গোঁফ দাড়ি, লম্বা চুল- মুখ থেকে ভকভক করে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, একহাত পঙ্কজের দিকে এগিয়ে দিয়েছে, অন্যহাত পিছনে। পঙ্কজের হৃদয়ের বরফ আতঙ্কের উত্তাপে গলতে শুরু করেই আবার জমাট বেঁধে গেল। পার্কিং লটের আলোয় লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, যে নিরানন্দ জগত থেকে আগত একমাত্র  মানুষ মনে হচ্ছিল নিজেকে , লোক সেই জগতেরই কেউ। এই আলোয়, এই নিয়ন সাইনের নিচে যাকে মানায় না। পঙ্কজের সামনে দাঁড়িয়ে হাত পাতল  সেই লোক। সিগারেট চাইল। তারপর যেন হাওয়ায় অন্য হাত ঘুরিয়ে এনে  পঙ্কজের সামনে ধরল  শীর্ণ চারাগাছ, বেগনে সাদায় একটা ফুল  ধরেছিল সম্ভবত সকালে, এখন শুকিয়ে গেছে।

-নেবে তুমি?

পঙ্কজ স্পষ্ট দেখল, টবের গায়ে মলেরই এক দোকানের প্রাইস স্টীকার সাঁটা। চুরি করে এনেছে নাকী? সামান্য দ্বিধা করেছিল প্রথমে তারপর নিজের জগতের দ্বিতীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে মোলাকাত হওয়ার স্বস্তিতে টবটা নিয়েই নিল পঙ্কজ; স্টার্ট দিল গাড়িতে। পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল গাড়ি, আর রিয়র ভিউ মিররে ছোটো হতে হতে মিলিয়ে  গেল লোকটা। 

~*~

অফিস যাওয়া এখন নেশার মত। ফ্রী ওয়ে থেকে  বাঁ হাতি একজিট নিলেই বড় পুতুল থেকে মেজ পুতুল, সেজ পুতুল, শেষে ছোটো পুতুল বেরিয়ে আসে; এতই আলাদা  সে দুনিয়া-  লিপির নিজেকে অ্যালিস মনে হয় সেই জগতে কালচে ইঁটের ছোটো ছোটো বাড়ী, দোকান, ধূ ধূ মাঠ জুড়ে চোরকাঁটা; বন্ধ ক্যাফে,  পুরোনো গ্যাস স্টেশনের পাশ দিয়ে ক্রীক বয়ে যায়;  সকালে ছায়া খোঁজার কম্পিটিশন চলে পার্কিং লটে আর কাঁটাহীন ঘড়ির পাশের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করে লোকজন। সাদা ওভার-অল,  আই প্রটেকশন, নীল নাইট্রাইল গ্লাভস্ পরে প্রডাকশন থেকে স্যাম্পল নিয়ে আসে মাইকেল। "আর্জেন্ট,  "ভেরি ভেরি আর্জেন্ট"- গ্যাব্রিয়েলা বলে যায়। সে পিছন ফিরলে লরেল মুচকি হাসে, চোখ মটকায়। স্টীভ হাই তোলে, ঘাড় রগড়ায়, স্ট্রেচ করে-  কাল লেট নাইট গেছে। স্টীভ যযাতির গল্প জানে না , অথচ বুড়ো হওয়াকে ভয় পায়;  সে ভয় এমন পর্যায়ে, যে লিপি পর্যন্ত টের  পেয়ে যায় - বুড়োদের  কী মারাত্মক ঘেন্না করে স্টীভ। লিপি ওকে মেটলারের টলারেন্স চেক করতে বললে, রাউলের ঘাড়ে দোষ  দেয়-  "রাউল কাজ জানে না, সত্যযুগের ট্রেনিং, মেটলার ইউজ করতেই জানে না, ভুলভাল করে রেখেছে।" তারপর  পিঠ রগড়ায় খানিক।  মেটলার ছেড়ে কম্পিউটারে বসে, চাকরি খোঁজে আর বিড়বিড় করে -"লাইফ সাকস ম্যান। লাইফ সাকস। এই করে করেই বুড়ো হয়ে যাব না কী! আই ওয়ান্ট মোর মানি, মোর মানি। "  গলার জোর এমনই লিপির কিউবিকল অবধি পৌঁছে যায়  সেই সব কথা। স্টেফানি বাফারের পিএইচ চেক করে, মোবাইল ফেজ ফিলটার করে আর অবিশ্রান্ত কথা বলে যায়-'আই ওয়ান্ট ভেকেশন , আই ওয়ান্ট সী বীচ, অনলি সী বীচ। নাথিং এলস্। নো মানি, নো ম্যান, নাথিং।' হৃদয়রাম এখানে হার্ডে। কোয়ারেন্টাইন স্লিপ টাইপ করে। প্রিন্ট নেয়। কমলা রঙের চৌকোনা, আঠালো স্লিপ।একের পর এক। মেরি চুং প্যাকেজিং থেকে ল্যাবে আসে- পেপার ওয়ার্ক খোঁজে। হাঁসফাঁস করে। এরমাঝে লিপির সেলফোন অবিরাম বাজে। ফিলিং লাইন নাম্বার থী নট ওয়ার্কিং। টেম্পারেচর ডাউন। ক্যাথি খুরখুরিয়ে হাঁটে-হাতে পেন,কাগজ-'লটো? লটো? এইটি মিলিয়ন ডলার টু নাইট। এইটি মিলিয়ন।' একটা গাঢ় নীল কাগজে একরাশ সংখ্যা-জোড়ায় জোড়ায়। ক্যাথি পাঁচজোড়া সংখ্যা বেছে নেয়। 'সপ্তাহের পাওয়ার বল-'হু উইল প্লে? ইয়ু? ইয়ু?'  লিং ফ্যাসফেঁসে গলায় গল্প শোনায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের। হাই স্টুলে বসে। পা দোলায়। স্লীভস গুটিয়ে ক্ষত দেখায়।

এই জগতে  লাঞ্চরুম অপরিচ্ছন্ন। দাগধরা সিঙ্ক, মাইক্রো-ওয়েভের ভিতরে মরচে ধরা। এখানে ফ্রিজের দরজা খুললেই ধাক্কা দেয় বাসি গন্ধ-  লিপির খিদে মরে যায়।  লাঞ্চ আওয়ারে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় লিপি। সাপোর্টিং ফ্রেমের ওপর ঈষৎ ঢালু ছাদের নিচে মেটেরিয়াল ওয়ারহাউজ-  সেখানে সাবানের গন্ধ, কখনও জোয়ানগুঁড়োর,কখনো মোমপোড়া গন্ধ ক্যাফের পাশে রেলস্টেশন; টানেলের ওপারে পুরোনো পেট্রল পাম্প। স্টেশনের বেঞ্চে, পশ্চিমের রোদ মুখে বসলে পরিত্যক্ত ওয়ারহাউজ- স্প্রে পেইন্টিংএ সবুজ নারকেল গাছ আর নীল সমুদ্র। তলায় কালো রঙের খুলি, হাড়-গোড়। টানেলের দেওয়ালে   বেগুণী, সবুজ, লাল, কালো অক্ষর আর  ছবি-  ইয়েলো ব্রিক রোড ধরে হেঁটে যাচ্ছে ডরোথি, টিনম্যান,স্কেয়ারক্রো আর লায়ন, উইজার্ড অফ অজের চাপ দাড়ি, মাথায় বেসবল ক্যাপ। তলায় লাল টকটকে মোটা হরফ-'ফাক ইয়ু পোলিস',  তার নিচে, 'ডেভিড ওয়াজ হিয়ার'- যেন কেউ রেগে উঠেই চুপ করে গেল, চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করল, হাত মুঠো করল শক্ত করে-

- সুধা, আর ইয়ু তামিল?

-শ্রীলঙ্কান তামিল আমি , লিপি। রেফিউজি হয়ে এসেছিলাম।

~*~

বাগানের সেই সব মৃত বোলতারা আকাশে উঠে হলুদ কালো মেঘ ফর্ম করেছে- পঙ্কজের মনে হচ্ছিল। মোবাইলে এমবার অ্যাটাকের ওয়ার্নিং এসেছে কাউন্সিল থেকে-  আশেপাশের জঙ্গলে আগুন লেগেছে। ঘন ধোঁয়ার স্ফীত কুন্ডলী ব্যাংএর ছাতার অবয়ব নিচ্ছিল, আকাশ বদলে দিচ্ছিল অত্যন্ত দ্রুত- নীল থেকে ধূসর হতে হতে কালো;  হলুদের ছিটে ক্রমশ কমলা হয়ে গেল- সেই আকাশের তলায় পঙ্কজের পড়শিরা জড়ো হচ্ছিল এক এক করে। সাদা ছাই এর সঙ্গে পোড়া পাতা, বাকল, গুটিয়ে ছোটো হয়ে যাওয়া মৃত শুঁয়োপোকারা উড়ে আসছিল। জ্বলন্ত  কাঠের টুকরো উড়ে আসতে লাগল তারপর। কাঠের ছাদ বা ডেকে  পড়লেই  আগুন ধরে যাবে-  সতর্ক থাকুন- মোবাইলে ওয়ার্নিং আসছিল ঘন ঘন। 'তলা বাড়ির হাইট থেকে ড্রোন দিয়ে ছবি নিলে 'দৃশ্য  শিয়োর উল্কাপাতের মত লাগবে।  ঘোর কমলা অ্যাপোক্যালিপটিক আকাশের তলায় জলের হোস হাতে অপেক্ষা করছিল পঙ্কজের পড়শিরা-  যেন পৃথিবীর দখল নিতে পাইরোকিউম্যুলাস ফাটিয়ে নেমে আসবে ভিনগ্রহীর দল - আর 'পাড়ার লোকজনের ওপর যেন তাদের প্রতিহত করার দায়িত্ব বর্তেছে। " ইয়ু হ্যাভ টু প্রটেক্ট ইয়োর প্রপারটি, ম্যান"- অ্যালেন, বব , ডাফনি ওকে বলছিল।  বাগানের জলের কলের মুখে লাগানো পাইপ ময়াল সাপের মত পড়ে ছিল, তার প্যাঁচ খুলে  দু হাতে ধরে দাঁড়িয়ে রইল পঙ্কজ। ওর কোনো অপেক্ষা ছিল না।

~*~

তিন্নিকে নিয়ে বাড়ি  এল লিপি। সুবিমল ফিরে এসে ল্যাপটপ খুলে বসেছে।

- ভাত বসিয়ে দিয়েছি। চট করে স্টারফ্রাই করে নেব খাওয়ার আগে। না কি রুটি খাবে? হ্যাঁ লিপি? আজ এত দেরি হল? তোমার ফোন পেলাম না। বিজি বলছিল।পঙ্কজদাদের ওদিকে বুশফায়ার ,  টেনশন হচ্ছিল। ভাবছিলাম, আমিই তিন্নিকে নিয়ে আসব কী না-

এক আশ্চর্য জগৎ থেকে ফিরেছে লিপি, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সেনানীর সঙ্গে চা খেয়েছে, সুধার পালিয়ে আসার গল্প শুনেছে - কাল আবার তিন্নিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েই আবার জগতে ঢুকে পড়বে - এই সব বুড়বুড় করছিল মনে। সুবিমলের কথার তোড়ে কিছুই বলা হয়ে উঠছিল না- সুবিমলের অফিসের কানেকটিং ইভেন্ট, শহরের বাড়ির দামের ওঠা পড়া, রুটি না ভাত, চিকেন না মাটন-যেন গোটা দুনিয়ায় এর বাইরে  আর কিছুই ঘটে নি, ঘটছে না। যেন সুধা তাড়া খেয়ে দেশে এসে লুকোয় নি, যেন স্টীভ বার্ধক্যকে ভয় পায় না, যেন ভিয়েতনামের যুদ্ধই হয় নি- গোটা জগতে অনন্তকাল শুধু সুবিমল, তিন্নি আর সে স্টারফ্রাই খেয়ে চলেছে-

গলা খাঁকরে কথা চালিয়ে গেল লিপি-

-বাড়িতে ফোন করেছিলাম, কথা হল অনেকক্ষণ

-কী খবর? তোমার মা প্রেশারের ওষুধ খাচ্ছেন নিয়মিত? দেয়াল টেয়াল আর দুলছে না তো?

- বলল তো খাচ্ছে।

-গুড। আচ্ছা সেই যে কানেক্টিং ইভেন্টের কথা বলছিলাম না, সেই যে লাফটার কানেক্টস...

-শোনো

-কথাটা শেষ করতে দাও-

- আমার এক মিনিট লাগবে বলতে। কাল থেকে তুমি তিন্নিকে নিয়ে ফিরো। পারবে?

-পারব, কিন্তু কী হল? দেরি হবে ফিরতে? 

-কাল থেকে গাড়ি নেব না। ট্রেনে যাব, আসব।

-কেন? প্রবলেমটা কী ?

লিপি মুখে বলল, স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল- "কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা, হেঁটে দেখতে শিখুন- কী বুঝলেন, সাহেব?" মনে মনে বলল- ফাক ইয়ু লাইফ, ফাক ইয়ু।

 

 

 

 

 

 

গ্রীষ্ম-

 

নির্মল চন্দ্র আর বি বি গাঙ্গুলির অবস্থান নিখুঁত সমকোণে; এইখানে টানেলের কারভেচার বাড়াতে, দুশো বছরের পুরোনো ঘরদোরের চোদ্দো মিটার নিচে মাটি খুঁড়ছে বোরিং মেশিন। সেই সব পুরাতন ঘর দোর উঠান গলি ঘুঁজি পেরিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটছিল দু'জন - যেন সরস্বতী ঠাকুর আর এক পাতাখোর।

সূর্য ডুবে গেলে, কঙ্কণা আর সাহিল একসঙ্গে হাঁটে- সাহিলের গোঁফ, দাড়ি, ঝাঁকড়া চুল, রোগা একহারা শরীরে সারাদিনের ময়লা লাগা শার্ট,  জীনসে মাটি তেলকালি আর চায়ের দাগ- পরশু চায়ের ভাঁড় উল্টেছিল ; কঙ্কণার অপার্থিব গ্রীবায় কয়েক ফোঁটা ঘাম, সরু চেন। সাহিল আড়চোখে দেখল। সে জানে না এই মেয়ের সঙ্গে তার ভবিষ্যৎ- শরীরের খেলার সময়  সাহিলের মনে হয়, এই মেয়েটি তাকে ভালবাসে। সে ও।  একসঙ্গেই থেকে যাবে বাকি জীবন। আবার বাকি জীবন কথাটাই তার আশ্চর্যরকম অতল মনে হয়, যা মনে মনে উচ্চারণ করলেও যেন দমবন্ধ হয়ে ডুবে যেতে হয়; আলটিমেটলি, কথাটা মাথার ভেতর থেকে একদম শিকড়সমেত উপড়ে ফেললে, কিছু রক্তপাত ঘটে, কিন্তু  ভেসে ওঠা যায়। কঙ্কণাও ভালবাসা , বাকি জীবন জাতীয় শব্দ মুখে আনে না; যদিও কঙ্কণারও দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয় কী না- সাহিলের অজ্ঞাত। ভালোবাসা সম্বন্ধে, নিজের  উপন্যাসের প্লটের মতই সাহিলের  ধারণা এখনও স্পষ্ট নয়।  এই সব অস্পষ্টতা তাকে ঘন ঘন এক সংশয়ের সামনে দাঁড় করায়- সে সংশয়কে কখনও অনতিক্রম্য সুবিশাল পাহাড় মনে হয়;  সাহিল ভয় পায়, হতাশ হয়, কঙ্কণার শরীরের কাছে যায়, তারপর আবার লিখতে বসে।  সে সংশয় লেখে, ভয় লেখে, অন্ধকার লেখে, তারপর ছিঁড়ে ফেলে;  সাহিলের লেখা শেষ হয় না কারণ তার কোনো গন্তব্য নেই, সে কোথায় যাবে -জানে না।

আপাতত দুজনে স্টেশন অবধি যাচ্ছিল। ইউনিভার্সিটি ফেরত কঙ্কণা এলে , দুজনে হাঁটে। তারপর একই ট্রেনে উঠে কঙ্কণা আগে নামে; সাহিলের স্টেশন আসতে আরো এক ঘন্টা। ডাউনের পরপর দুটো ট্রেন বাতিল হওয়ায় আজ প্ল্যাটফর্মে অন্যদিনের তুলনায় ভীড় বেশি, তার মধ্যে বার কয়েক প্ল্যাটফর্ম নম্বর ভুল ঘোষণায় নিত্যযাত্রীর ভীড় একটা অগোছালো প্যাটার্ন ফর্ম করছিল- বাইরে থেকে মানুষজন ধীরে সুস্থে স্টেশনে ঢুকছিল , প্ল্যাটফর্মের ওপর মানুষ তখন হুড়মুড় করে একদিকে ছুটছে;  ধীরগতির মানুষের একাংশর গতি কমে যাচ্ছিল, অন্যদল দ্রুতগতির দলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। গতিহীন যাত্রীদের মধ্যে  দাঁড়িয়ে সাহিল আর কঙ্কণা চা খাচ্ছিল তখন।

"আমি তখন ক্লাস ওয়ান, বোন আরো ছোটো, বাবা , মা সঙ্গে চিড়িয়াখানা দেখে ফেরার পথে এই রকম হট্টমেলার মধ্যে পড়েছিলাম" সাহিল  বলল। " ভেবেছিলাম হারিয়ে গেছি-এত লোক চারদিকে -লম্বা লম্বা লোক- কে বাবা কে মা গুলিয়ে গিয়েছিল- সবাইকেই মনে হচ্ছে বাবা- আমাকে খুঁজে  নিতে হবে সত্যিকারের বাবাকে - সে কী কান্না! আসলে হারাই নি-কী অদ্ভুত না?

- ছোটো বাচ্চা ভীড় দেখে ভয় তো পাবেই-

- এখন অবাক লাগে। এত ভয়ের কী ছিল  - ভাবি। কী মনে হয় জানো? মানুষের মুখ দেখতে না পারলে ভয় তৈরি হয় একটা-

-সব বয়সেই। ছোটো বেলায় অবভিয়াসলি বেশিই-

- একটা হাইটের ব্যাপার আছে কোথাও। কোন হাইট থেকে দেখছ- ধরো , মানে তর্কের খাতিরে ধরো, আমি যদি একটা লম্বা বাচ্চা হতাম মানে ভীড়ের মধ্যেও বাবার মুখ মা মুখ দেখতে পেতাম-

- মানে এই ভীড়ে আজ আমি হারিয়ে গেলে তুমি একটা লম্বা বাচ্চা -কাঁদবে না। তাই তো?

হাসতে গিয়েও গম্ভীর হ'ল সাহিল।

~*~

আজ চায়ের দোকানে প্রফুল্ল ছিল না। রঘুর সঙ্গে সুনীলের দোতলার  ঘর পরিষ্কার  করছে সকাল থেকে। সুনীল কখনই প্রফুল্লকে কোনো কাজ করতে বলে না; সকালে, রাতে নিজে থেকেই সামান্য খেতে দেয়, তারপর হাত জোড় করে নমস্কার করে- যেন ঠাকুরকে  ছোটো থালায় ভোগ দিচ্ছে। আজও সুনীল প্রফুল্লকে  কিছু বলে নি, বরং রঘুকে ঘর সাফ করতে বলেছিল- কোন দূর দেশ থেকে কারা এসে থাকবে নাকি। রঘু বলেছিল, "বিলাতী লোক হোটেলে থাকবে , এখানে কেন?"  সুনীল ধমকে উঠেছিল- "যা বলছি, তাই কর। দু' বেলার খোরাকি, তিনশো টাকা দেব।"  রঘু প্রফুল্লকে বলেছিল, "তুইও চল"

প্রফুল্ল এর আগে 'বাড়ির দোতলায় ওঠে নি। দোলের দিনে,  কয়েকবার একতলার উঠানে চৌবাচ্চার জল তুলে  স্নান করেছিল। দোতলায় ওঠার চওড়া সিঁড়ি, লোহার রেলিঙে কলকার কাজ, দোতলার বারান্দায় টবে গাছ-  প্রফুল্ল ঘাড় ঘুরিয়ে  দেখছিল। রেলিংএ হাত বোলাচ্ছিল। মিস্টার ইন্ডিয়ার বাড়ির মত  লাগছিল প্রফুল্লর, আর রঘু যেন ক্যালেন্ডার;  জিন্দগি কি ইয়ে রিত হ্যায় গাইছিল প্রফুল্ল-  গলা ছেড়ে। রঘু বলছিল- কাটে নাহি টা গা।

লম্বা টানা বারান্দা, তারপর একটা দুটো তিনটে চারটে পাঁচটা ঘর-  পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে আরো ওপরে-  তিনতলায়। রঘু পরপর চারটে ঘরের তালা খুলল- দরজায় ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে জানলা খুলতে শুরু করল; "হাত লাগা"- প্রফুল্লকে বলল। জানলা খুলে দিতে রোদ এসে পড়ছিল  সাদা কালোয় ফুলকাটা মেঝেতে। সামান্যই আসবাব ঘরে- চেয়ার, গোল একটা টেবিল, ছত্রীওলা  খাট - সবই ভারি কাপড় দিয়ে ঢাকা , ধুলোর গন্ধ ঘর জুড়ে। রঘু হাঁচল চারবার। তারপর নাকে মুখে গামছা জড়িয়ে  কাপড়ের ঢাকা সারাতে লাগল টেনে টেনে।  ধুলো বালি কিচকিচ করছিল ঘর জুড়ে- মেঝের ওপর ধুলোর স্তর এতই পুরু যে রঘু আর প্রফুল্লর পায়ের ছাপ স্পষ্ট ঠাহর করা যাচ্ছিল। রঘু চেঁচিয়ে  বলল-" ডান্ডা মপ লাগেগা সুনীলদা-"

-নিচে এসে নিয়ে যা। তোর মিস্টার ইন্ডিয়াকে বলিস তো ওর থলিটা নিয়ে যেতে-

-কোন সা থলিয়া?

-বারান্দার কোণে পড়ে আছে কবে থেকে। নিয়ে যেতে বলিস।

- প্রফুল্ল, তু ইধার রুক  জারা , বালতি , মপ লানা হ্যায়

প্রফুল্ল ঘুরে ঘুরে দেখছিল। ঘর থেকে বারান্দায়, আবার ঘরে ঢুকছিল, এক ঘর থেকে অন্যঘরে- আসবাবের ওপর জমা ধুলোয় আঙুল দিয়ে ছবি আঁকছিল- তিনটে চোখের নিচে লম্বা একহাত জিভ, পাখি, ঘুড়ি, চাঁদ, সূর্য-

দুই নম্বর ঘরে দেওয়ালের তাকে থাক দেওয়া বইখাতার পাশে কবেকার এক ট্র্যানজিস্টর রেডিও - চৌকো এবং ঘন নীল, ইয়া লম্বা অ্যান্টেনা - প্রফুল্ল অ্যান্টেনা ওঠালো নামালো, নব ঘোরালো - একটা সবুজ আলো জ্বলে ওঠার কথা ছিল। প্রফুল্ল নব ঘোরালো বাঁদিকে, আবার ডানদিকে, হাতে তুলে  নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল।  এই সময় রঘু একটা  বালতি হাতে ঢুকেছিল, অন্যহাতে চটের থলি - দড়ি দিয়ে মুখ বাঁধা- ' প্রফুল্ল, ইয়ে তেরা হ্যায়- হ্যায় কেয়া ইসমে? ' প্রফুল্ল মাথা চুলকালো, তারপর হাত বাড়িয়ে থলিটা নিল। রঘু বালতিতে জল ভরতে বাথরুমে গিয়েছিল। প্রফুল্ল থলির মধ্যে ঢুকিয়ে নিল নীল ট্র্যানজিস্টার-  এতই অক্লেশে , যেন নিজের জিনিস ভুলে রেখে গিয়েছিল, আজ ফিরে পেয়ে তুলে নিল।

ঘর মুছছিল রঘু। বালতির জল ঘোর কালো হয়ে উঠলে, সে প্রফুল্লর হাতে বালতি দিয়ে, কোমরে হাত রেখে দম নিয়ে নিচ্ছিল; প্রফুল্ল  ময়লা জল বাথরুমের নালীতে ঢেলে, পরিষ্কার জল নিয়ে এলে, রঘু কাজ শুরু করছিল আবার। রঘুর হাতে জলভরা বালতি দিয়ে বারান্দা থেকে সুনীলের একতলা দেখছিল প্রফুল্ল। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে উঠোন, বড় চৌবাচ্চায় টাইম কলের জল আসছে- উঠোন থেকে দু ধাপ সিঁড়ি, তারপর দোতলার মতই টানা বারান্দা, পর পর ঘর- কোনো ঘরের দরজা খোলা- ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা  উড়ে আসছিল বারান্দার দিকে। পাশাপাশি দুটো বন্ধ দরজা একতলায়, বারান্দার দিকের জানলার পাটও ভেজানো। প্রফুল্ল তাকিয়ে আছে- কপাল বেয়ে ঘাম নামছে, মাথা চুলকোচ্ছে আর চোখ পিট পিট করছে; একটা দরজা খুলে গেল আচমকা - ফ্যানের হাওয়ায় পর্দা উড়ে গেল অনেকখানি-  প্রফুল্ল তখন একটা মেয়েমানুষ দেখল সেই ঘরে- স্রেফ  শায়া পরা মেয়েমানুষ-  ঘরের ভেতর থেকে বারান্দার দিকে আসছিল যেন।  এক ঝলক দেখতে পেয়েছিল-  প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল কপাট প্রফুল্ল মাথা চুলকে নিল- ভরদুপুরে সিনেমা শুরু হওয়ার কথা নয়, সাদাকালো ছবিও  ছিল না- শায়ার রঙ সবুজ ছিল , মেঝের রঙ লাল- সে হলফ করে বলতে পারে।  প্রফুল্ল কেমন লজ্জা পেল-  যেন এই দৃশ্য তার দেখার কথা নয়;  সরে এসে তিনতলার সিঁড়ির রেলিংএ হাত রাখল এবারে  আর ওর আচমকাই  মনে  ,  সিঁড়ি বেয়ে উঠলে  বিরাট ছাদ , ছাদের কোণে একটা ঘর আর বিস্তর পাখি থাকার কথা-  প্রফুল্ল  যেন '  রকম কোনো একটা সীন  রাতের দিকে সিনেমায় দেখেছে-

~*~

সাইটের তপন বলল- "তোমাদের কাগজপত্র সব ঠিক আছে তো? চারদিকে যা চলছে টলছে। বাবা কী বলছেন? অ্যাঁ? সাবধানে থেকো কেমন? দিনকাল ভালো নয়।" সাহিল জবাব দিল না। এই সব কথোপকথন  সে এড়িয়ে যায়। এই ধরণের কথা তাকে যে খুব ঘন ঘন শুনতে হয় - তা নয়। কিন্তু যখন শোনে  যেন একটা আগুনের শলা ওর বুক ফুঁড়ে,  জ্বলন্ত ভয় ভরে দিয়ে বেরিয়ে যায়। সাইটে কাজের চাপ  অবশ্য ওকে এফোঁড় ওফোঁড় হতে দিল না আজ  সকালে; তবে,  সন্ধ্যার দিকে কনস্ট্রাকশন সাইটে  দাঁড়িয়ে  সাহিলের  মনে হল  সে যেন হারিয়ে গিয়েছে- তার চারপাশে হলুদ হার্ডহ্যাট আর হাই ভিসিবিলিটি জ্যাকেট, অর্ধসমাপ্ত টানেলে আলো জ্বলছে, অজস্র  সরু মোটা নল ঢুকেছে, বেরিয়েছে;  কেবল, ল্যাডার, অর্ধ সমাপ্ত  কিম্বা অস্থায়ী  কাঠামো দীর্ঘ সব ছায়া ওকে ঘিরে- যেন ভিন গ্রহের যান  ল্যান্ড করেছে ওর সামনে, ওকে ঘিরে ভিন গ্রহের লোক - যেন এই শহরের দখল নেবে এখনই কিম্বা ওকে নিয়ে উড়ে যাবে। সাহিলের মাথা ঝিমঝিম করে। চাকরি ছাড়ার  কথা মনে ঢুকেই বেরিয়ে গেল- একটা খোঁচার মত। চাকরি তো ছেড়ে দেওয়াই যায় - এই  ভাবটা  মুঠোয় নিয়ে সাইটের বাইরে এলো সে-  চা খাবে। কঙ্কণা এই সময় ব্যস্ত থাকে , তাও ওর নম্বর ডায়াল করল - কী গান দিয়েছে কলার টিউনে কৌতূহল হচ্ছিল ; কিছুই শুনতে পেলো না আজ - বিজি বিজি বিজি।  কিছুক্ষণ পরে, নিজেই ফোন করেছিল কঙ্কণা।

-'এই আজ বাড়ি চলে যাচ্ছি সটান।  কালবৈশাখী আসছে তুমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিও। রাত কোরো না।

সাহিলের মনমরা লাগে।

-ফোন করেছিলাম তোমাকে কতবার-

- আরে, সেই বিজনবাবুকে ফোন করছিলাম -লাইন পাচ্ছিলাম না কিছুতেই।  তারপরে এই  তো একটু আগে কথা '-

-এনি লাক?

-চট করে বলে নিই  এখন। রাতে ডিটেলে বলব। নীলকমল কোথায় থাকতেন- বিজনবাবু শিওর নন। শিয়ালদার দিকে অনেকবার দেখেছেন; সম্ভবত ট্রেন ধরে মফস্বলে গ্রামে গঞ্জে শো করতে যেতেন সাহেবগলি নামে একটা রাস্তা আছে নর্থের দিকে। বিজনবাবু বললেন, ওদিকেও স্কুলে শো করতেন এক সময় - সবই যে হুডিনির সেই খেলা তা নয়,  অন্য ম্যাজিকও দেখাতেন;  বিশেষ করে, স্কুল টুলে কুসংস্কার, গুরুদেবদের ভাঁওতাবাজি এই সব নিয়েও শো করতেন-

-কোনো বিজ্ঞান মঞ্চ বা যুক্তিবাদী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? জিগ্যেস করেছিলে?

- করেছিলাম। নীলকমল কোনো সংস্থা বা মঞ্চর সঙ্গে কাজ করেন নি কোন দিন - সম্পূর্ণ একলার শো, একলার স্ক্রিপ্ট। শুধু হুডিনির খেলা দেখানোর সময় , একটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সঙ্গে রাখতেন-  হাত পা বাঁধা, বস্তায় ঢোকানোর জন্য- বেসিকালি।

-ফোটোর কথা জিগ্যেস করেছিলে?

-ছবি নেই। শো সময় চড়া মেক আপ নিতেন, পাগড়ি টাগড়ি পরতেন, ঘোরাঘুরির সময়ও বোধ হয় কিছুটা সেজেগুজে থাকতেন- বিজনবাবু  বেশ 'বার  খোঁজ করতে গিয়েছিলেন- সাহেবগলিতেও গেছেন ;  ডেস্ক্রিপশন দিয়েছিলেন চেহারার- কেউ কিছু বলতে পারে নি। হয়তো  লোক সাজগোজ করা  চেহারাটাই চেনে। তবে সেদিন স্যার যা বলেছিলেন, সেটাই কনফার্ম করলেন বিজনবাবু। একটা সময়ের পরে  শো যে আর করেন নি সেটা শিওর- ভ্যানিশ হয়ে গেলেন যেন; জেলে যাওয়ার একটা রিউমার উনিও শুনেছিলেন- সত্যি কী না জানেন না।

- থ্যাঙ্কিউ।

-দূর বাবা- কিছুই তো করতে পারলাম না।  তবে বিজনবাবু বললেন, কয়েকজনকে জিগ্যেস করবেন;  এই,  তুমি আর দেরি কোরো না। ঝড় আসছে।

~*~

দুপুরে কালীমন্দিরের সামনের ফুটপাথ তেতে ছিল। মিষ্টির দোকানের ফুটে রোদ পড়ে না। আজ ওখানেই বসেছিল প্রফুল্ল। পটল আর কাঁসি হ্যা হ্যা করে হাঁফাচ্ছিল। সুনীলের দোকান থেকে মাটির হাঁড়ি নিয়ে এসেছিল প্রফুল্ল , তাতে জল ভরে পটলের সামনে রেখে আকাশ দেখছিল তারপর রঘু সকালে বলছিল- "আজ ঝড় আসবে , টিভিতে বলেছে;  বিকেল হলেই সুনীলের বাড়ির একতলায় ঢুকে যাবি। তোর সঙ্গে আমিও।  শালা, নিজের বাড়ি থাকতে ঝড়জলে কষ্ট পাস বেকার"- প্রফুল্ল পাত্তা দিল না। রাতের ফুটপাথে স্টাররা নামে - সুনীলের বারান্দায় শুলে সব মজা মাটি। সেই মেয়েমানুষটার কথা মনে ' হঠাৎ- সবুজ শায়া পরা- রঘুকে বলতে গিয়েও বলে নি সেদিন। 

বিকেল থেকে মেঘ জমছিল আকাশে , বেগুনী বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছিল  মন্দিরের ওপরে। গুমগুম করে মেঘ ডাকতেই প্রফুল্ল প্লাস্টিক হাতে মন্দিরের সামনে এলো। চায়ের দোকানে দাড়ি গোঁফ অলা ছেলেটা অনেকক্ষণ বসে আছে আজ। মোবাইলে  লিখছে না।  মন্দিরের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করল প্রফুল্ল। দুপুরের তেতে যাওয়া শান ঠান্ডা হয়েছে অনেক- পেট পেতে আরাম হচ্ছিল প্রফুল্লর।হাওয়া উঠেছিল।  চোখের সামনে ধুলোর বৃত্তে ঝরা পাতা, প্লাস্টিক, শালপাতা ঘুরতে দেখছিল সে। আকাশ ফাটিয়ে বাজ পড়ল একটা। রাস্তার বাতি জ্বলে গিয়েছিল। দোকানে দোকানে শাটার  নামচ্ছিল এক এক করে কাঁসি , পটল প্রফুল্লর গা ঘেঁষে কেঁউ কেঁউ  করছিল।

দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি হয়ে গেল এক পশলা।  আবার ঝেঁপে আসবে। প্রফুল্ল টুক করে সুলভে ঘুরে এল। মন্দিরের সামনের ফুটপাথে কতগুলো গর্ত। সেই সব গর্তে বৃষ্টির জল জমে ছিল। ফুটপাথ আর রাস্তার মাঝখানের অংশে অনেকখানি জল। জল পেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল কাঁসি আর পটল। মুখ নামিয়েছিল জলের দিকে। ওদের পিছন পিছন প্রফুল্ল -দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। বৃষ্টি আসবার আগেই  প্লাস্টিক খাটিয়ে সেঁদিয়ে যেতে হবে। "জলদি কর পটল, জল খাবি বাদ মে" বলেই থতিয়ে গেল প্রফুল্ল। কাঁসির ঠিক সামনে পটল- নিজের  মুখ দেখছে জলে।  প্রফুল্ল  থেবড়ে বসে পড়ল পটলের পাশে- নিজের মুখ দেখার চেষ্টা করল জমা জলে। আর তখনি বৃষ্টি জলের দর্পণ ভেঙে দিয়ে জোরে জোরে হেসে উঠল। প্রফুল্ল  এক দৌড়ে ফুটে উঠে দেখে সেই ছেলেটা এখনও বসে আছে-  মাথায় টুপি, দাড়ি, গোঁফ-  অগোছালো মত। ছেলেটাও ওর দিকে তাকিয়েছিল। হাসল তারপর।

~*~

-কঙ্কণা?

-হ্যাঁ। বলো।

- একটা কথা মনে হল, যে স্কুলগুলো-

-কোন স্কুল সাহিল?

-নীলকমল শো করতেন যেখানে -  ঝড়ের দিনে যে বললে-

-হ্যাঁ হ্যাঁ-

- সেখানে গেলে হয় না? পুরোনো খাতাপত্র ঘেঁটে , সেই সময়ের ছাত্র, স্যারদের নাম টাম  যোগাড় করে, এক এক করে তাদের ..গোটা ব্যাপারটা ডকুমেন্টেড থাকবে আমার লেখায়।

-সাহিল

-কী?

-আজও তুমি নীলকমল নীলকমল করবে?

-কেন কী হয়েছে?

-ইলেকশনের রেজাল্ট শোনো নি?

-শুনেছি।  জানাই তো ছিল এই রেজাল্ট।

-এত খেটেছিল সবাই... কিছুই হল না। হয়ত তুমিই ঠিক, জানো? আমরা কানেক্ট করতে পারি নি-

- সরি কঙ্কণা। তোমার মন খারাপ। আমার আগেই ফোন করা উচিত ছিল

- নীলকমল নীলকমল করে তুমি অবসেসড হয়ে গেছ। আচ্ছা- নীলকমলকে না পেলে কী হবে?

-উপন্যাসই হয়তো লেখা হবে না আমার- 'দিন ধরেই  মনে হচ্ছে, পারব না আমি-

নীলকমলকে খোঁজার বাইরেও সাহিলের আরো কথা ছিল।  কঙ্কণাকে সেই সব খুলে বলতে সে দ্বিধা করছিল। কেঁদুলিতে অজয়ের তীরে সাহিল তার নিজের উপন্যাস টাইম বম্ব হোক চেয়েছিল অথচ  কী লিখবে সে সম্পর্কে তার ধারণা তৈরি হয় নি- সাহিলের মনে হত , সে যা দেখছে, যা শুনছে, তার বাইরে আরো কিছু যেন তার অগোচরে রয়ে যাচ্ছে। সেই সব শব্দ, ধ্বনি আর দৃশ্যর জন্য তার আকিঞ্চন বাড়ছিল দিন দিন।  সে একই সঙ্গে  এই সাইটের জুনিয়র এঞ্জিনিয়র, আর মন্দিরের সামনের লোকটা হতে চাইত- যে লোকটা ফুটপাথে  সাষ্টাঙ্গে শুয়ে থাকে , চকখড়ি দিয়ে ছবি আঁকে। সাহিলের মনে হত, সে যা  দেখতে পায় না, শুনতে পায় না- লোকটা  পায়।

-কঙ্কণা, দ্য আওয়ার দেখেছ?

লাইন কেটে গেছে কখন যেন। অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছিল ফোনে যেন কলসী থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। পাশে কেউ নেই জেনেও বিড়বিড় করে গেল সাহিল -

"আই ওয়ান্টেড টু বি রাইটার, দ্যাট্স অল- আই ওয়ান্টেড টু রাইট অ্যাবাউট  ইট অল। এভরিথিং দ্যাট  হ্যাপেনস ইন মোমেন্ট- দ্য ওয়ে দ্য ফ্লাওয়ার্স লুকড হোয়েন ইউ ক্যারেড দেম ইন ইওর আর্মস- দিস টাওয়েল , হাউ ইট স্মেলস, হাউ ইট ফীলস, দিস থ্রেড.. এভরিথিং ইন দ্য ওয়র্ল্ড। অ্যান্ড আই ফেলড। আই ফেলড। নো ম্যাটার হোয়াট ইউ স্টার্ট উইথ, ইট এন্ডস আপ বীইং সো মাচ লেস। সো মাচ লেস কঙ্কণা, সো মাচ লেস।"

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

গ্রীষ্ম-

 

বারান্দা থেকে বাগান দেখছিল স্মিতা। ঘর থেকে মোড়া এনে বসেছে। মামুলি ছোট বাগান। ক্ষিতীশ এসে ঘাস কেটে দিয়ে যায়, মরসুমি ফুলের চারা বসায় টবে। এখন আগাছা তুলছে ধনঞ্জয়। জল দিচ্ছে। রোদ চড়ে যাওয়ার আগেই বাগানের কাজ সেরে ফেলবে। স্মিতা বুগেনভিলিয়া গাছের দিকে তাকিয়েছিল। বাগানের পুরোনো গাছ- রথের মেলা থেকে জেঠু আর জেম্মা এনেছিল। গাছ ভরে ফুল এসেছে 'বছর। তার পাশে জবা, টগর , করবী আর শিউলি।  আজ এই সব গাছ, এই ফুল স্মিতার স্মৃতির দরজা খুলে দিচ্ছিল একের পর এক-  মুক্তি সিনেমার কথা মনে পড়ছিল ছোটোবেলায় টিভিতে  মুক্তি দেখেছিল স্মিতা- হাতীর মরে যাওয়া দেখে খুব কেঁদেছিল; সেই সিনেমায় প্রথম সীনে একটার পর একটা দরজা খুলে যাচ্ছিল এই রকম-  ঠাকুমার কথা মনে ' স্মিতার, মা' কথা, বাবা জেঠু কীভাবে একবার ঝড়ের পরে ভাঙা শিউলিগাছকে  খাড়া করেছিল- সেই সব স্পষ্ট  দেখতে পাচ্ছিল সে - এই যেন সেদিন । দিন কীভাবে কেটে যায়- মানুষ  সহজে একথা বলে।  এবার স্মিতার এখানে পৌঁছোনোর দিন, গেট খুলে ঢুকতেই বাগানে পায়েলকে দেখেছিল- ভেজা জামা কাপড় দড়িতে মেলে দিচ্ছে ; জেম্মার শাড়ির পাশ দিয়ে ট্রলি ব্যাগ টেনে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে প্রথমে ডিটারজেন্টের হাল্কা গন্ধ তারপর শিউলির বাস পেয়েছিল সে। এই সব গন্ধ স্মৃতির অংশ হয়ে গেল। সময় যে কী দ্রুতগামী- ভাবতে মাথা টলটল করছিল স্মিতার।

এর আগে স্মিতা যখন কলকাতায় এসেছে, মাসখানেকের বেশি থাকে নি- পঙ্কজ একা কী করে সব সামলাবে, বুল্টি, বনময়ূর, ওর সাজানো ঘরদোর …. এবারে এলো যখন,  এতদিন থেকে যেতে পারবে ভাবে নি। স্কুলের চাকরি ছেড়ে এসেছিল, ফিরে গিয়ে আবার কিছু একটা পেয়ে যাবে -এরকম ভেবেছিল। আসবার সময় বনময়ূরের মাথায়  হাত বুলিয়ে, পঙ্কজ আর বুল্টিকে  বিবিধ নির্দেশ দিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে আগামী অনিশ্চয়তার কথা ভেবে চোখ মুছেছিল। জেম্মা নেই- একমাস হয়ে গেছে; পায়েল আর ধনঞ্জয়ের  দায়িত্বে ' বাড়ি রেখে সে এখন ফিরে যেতেই পারে- অথচ আজ বিকেলে এই মুহূর্তে স্মিতা  যেতে চাইছে না। সে যেন এখন দেখতে চাইছে,  আপের গাড়ি তাকে কোথায় নিয়ে যায়। পুষ্করিণীর জলের তলায় যে শহর সে শৈশবে দেখেছিল, সে শহরকে কখনও তার গন্তব্য মনে হয়;  কিন্তু সে শহরের  অবস্থান আপের না ডাউনের লাইনের শেষে স্মিতা জানে না। চাকরি ছেড়ে, সংসার ছেড়ে যেন তার সন্ন্যাস নেওয়া- পঙ্কজের নিজস্ব গল্প খুঁজে পাওয়া কী সত্যিই এত জরুরী- জেম্মা চলে যাওয়ার পরে সে সংশয়ে ভোগে আজকাল। কখনও মনে হয়, ফিরে যায়। তারপর ভাবে, ফিরেই তো এসেছে। কাকে যাওয়া বলে? ফেরা বলে কাকে?

-দিদি, ঘুগনি করেছি, খাবে?

-অল্প দে-

-কাঁচা লংকা, পেঁয়াজকুচি  দেব তো?

-দিস

-দিদি, কাল রাতে সাহেবগলির দিকে গিয়েছিল। তুমি দোতলায় ফোনে কথা বলছিলে, তাই আর ডাকে নি -

পঙ্কজের নিজস্ব গল্প খুঁজতে চাইছিল স্মিতা। অথচ কীভাবে শুরু করবে -জানা ছিল না। সাহেবগলির জীবন নিয়ে পঙ্কজের আড়ষ্টতাহেতু স্মিতা অঞ্চলকেই স্টার্টিং পয়েন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিল। অথচ জেম্মার অসুস্থতা তাকে হাসপাতাল, আর বাড়ির চৌহদ্দিতে বেঁধে রেখেছিল দীর্ঘদিন। উপায়ান্তর না দেখে, সে ধনঞ্জয়কে পঙ্কজের বাবা, মা নাম লিখে দিয়েছিল;  বলেছিল, সাহেবগলি অঞ্চলে চেনা জানা কেউ থাকলে খোঁজ নিতে - যদি কোনো পুরোনো বাসিন্দা এঁদের মনে করতে পারেন। এইটুকুই বলেছিল স্মিতা। এই দুটি নামের সঙ্গে তার সম্পর্ক ধনঞ্জয়ের কাছে খুলে বলে নি। ধনঞ্জয়ের মামাতো ভাইয়ের দোকান অঞ্চলে - সেখানে খোঁজ নেবে বলেছিল ধনঞ্জয়। কিন্তু সাহেবগলির বিস্ফোরণ সে পথে বাধা হয়- ধনঞ্জয়ের ভাইয়ের দোকান বন্ধ ছিল  বহুদিন। উপরন্তু গলির মুখে পুলিশের ব্যারিকেড। অবশেষে এই সপ্তাহে ধনঞ্জয় দিকে যেতে পেরেছে।

ধনঞ্জয় হাতের মাটি ধুয়ে বারান্দার দিকে আসছিল। কোনো খবর আনতে পারে নি ধনঞ্জয়-  হাঁটার ভঙ্গিতেই টের পেয়েছিল স্মিতা।

-ভাই নামে কাউকে চেনে না। খদ্দেরদের মধ্যে যারা বুড়ো মানুষ, তাদেরও জিগ্যেস করেছিল কেউ কিছু বলতে পরে নি। আর একদিন যাব দিদি?

- না। লাভ নেই। দেখি, আমিই একদিন ঘুরে আসব-

রোদের তাত বাড়ছে ।  স্মিতা বারান্দা থেকে ঘরে এল, দোতলায় উঠল সটান। রোদে  রোদে ঘর 'রে আছে- তেতে উঠবে এবার। স্মিতা পর্দা টেনে দিল।

~*~

বিক্রম চাঁদে পৌঁছে গেলে, মিঠু ফিরে আসবে - ধারণা সনৎ এর মনে বদ্ধমূল হচ্ছিল দিন দিন। ধারণার গোড়ায় কোনো শিকড়বাকড় নেই-  সনৎ সেদিকে চোখ ঠেরেছিল বরং আগায় ঝুলে থাকা ফুল ফলের সম্ভাবনাকে আঁকড়ে ধরছিল- যতই সে' সম্ভার তার দিকে নুয়ে আসছিল; তাদের স্বাদে গন্ধে ক্রমশ সে গোড়ার কথা বিস্মৃত হচ্ছিল, চন্দ্রযানের লঞ্চিংএর জন্য নিজেও প্রস্তুত হচ্ছিল - একটা বড় উৎসবের  আগে যা করে মানুষ। লঞ্চিংএর ডেট জুলাই মাসের চোদ্দোই সনৎ সময় দুদিন ছুটি নিয়ে নিল। নিজের বিয়ের কথা মনে হচ্ছিল সনতের।  যেন বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে, কার্ড ছাপা হচ্ছে, সনৎ লজ্জা লজ্জা মুখে অফিসে ছুটির অ্যাপ্লিকেশন দিচ্ছে। সে ইদানিং সর্বত্র এই উৎসবের প্রস্তুতি দেখতে পাচ্ছিল যেন। সবাইকেই মনে হচ্ছিল, তৈরি হচ্ছে এমনকি তন্ময়ের সঙ্গে ঝগড়াকেও  সেই এই প্রস্তুতির অঙ্গ  ভাবছিল।  গত সপ্তাহেই সনতের তাড়ায় প্রদীপ ডেস্কটপ দিয়ে গেছে। সনৎ ডেস্কটপের সামনে বসল। মোবাইল রাখল টেবিলে। হোয়াটস্যাপ গ্রুপে জোর আলোচনা চলছে- সেখানে লিখবে।

ইসরোর সাইটে এলকিউ কোয়াড্র্যাঙ্গলে দুটি ল্যান্ডিং সাইটের কথা বলা ছিল। সনৎ খুঁটিয়ে পড়ছিল সব। নোট নিচ্ছিল।  ইসরোর সাইট দেখছে, নেট ঘাঁটছে, দু একটা বই কিনেছে সম্প্রতি- তার পাতা উল্টে দেখছিল, লাইনের পর লাইন হাইলাইট করছিল;  কখনও পাতা মুড়ে রেখে নিজের খাতায় ডায়াগ্রাম আঁকছিল পর পর; এক ফাঁকে নেট ঘেঁটে  ইউ এস জিওলজিকাল সার্ভের তিরিশটা লুনার কোয়াড্র্যাঙ্গলের লেআউট দেখে নিল টুক করে।

ইসরোর সাইটে সফট ল্যান্ডিং এর খুঁটিনাটি লেখা - তিনটে ক্যামেরা  - এলপিডিসি, এলএইচভিসি, এলএইচডিএসি;  দুটো কারট্জ অ্যাবাভ ব্যান্ড অলটিমিটার , একটা লেজার অল্টিমিটার, পাঁচটা লিকুইড থার্স্টার, টাচডাউন সেনসর।  বিড়বিড় করছিল সনৎ- শব্দগুলো জিভের ডগায় নিয়ে এমনভাবে উচ্চারণ করছিল, যেন সে নিজেই ওখানে উপস্থিত আর বিক্রমের নিরাপত্তার সব দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে চেকলিস্ট হাতে টিক মারছে- গলায় উত্তেজনা আর দায়িত্ববোধ। চাঁদের পিঠ থেকে একশো কিলোমিটার ওপরে রাফ ব্রেকিং শুরু হবে , তখন  বিক্রমের চারটে এঞ্জিন,  দুটো অল্টিমিটার এলপিডিসি অন হয়ে যাবে। চারশো মিটার দূরত্বে হোভারিং, তারপরে রি-টারগেটিং স্টেজ; ঠিক  দশ মিটার ওপর থেকে সেন্ট্রাল এঞ্জিন চালু হওয়ার কথা - প্যারাবোলিক ডিসেন্ট শুরু হবে। আরো দুটো ডায়াগ্রাম খচাখচ এঁকে নিল সনৎ। এবারে লম্বা পোস্ট করবে গ্রুপে । ফুরফুরে লাগছিল যেন নিজের বিয়ের কার্ডে লাল হলুদ ফোঁটা লাগিয়ে তন্ময়কে দিচ্ছে।

জানলার পাল্লা খোলা ছিল- সনৎএর এই টেবিল থেকে হলুদ বাড়ির পুকুর  দেখা যায়। আজ পুকুরের কাছে ক্ষিতীশ অনেকক্ষণ ধরে কাজ করছে, যেমন প্রায়ই করে- ছোটো দা  দিয়ে ঝোপ ঝাড়, কচুগাছ সাফ করছিল, কার্বলিক অ্যাসিড ছড়াছিল - যেন এখানেও কোন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে; মঞ্চ তৈরি হবে- পুরস্কার বিতরণের অথবা ফাঁসির।

~*~

মানুষ মারা যাওয়ার পরেও, জগৎ তাকে সহজে ছাড়ে না। মৃত্যুর প্রমাণপত্র তার নিকটজনকে হাতে করে পৌঁছে দিতে হয়, বেশ কিছু জায়গায় - নিয়মমতো। তারপর মুক্তি। স্মিতা আজ সেই সব কাজ নিয়ে বেরিয়েছে-  মিউনিসিপালিটির, বাড়ির কাছের ব্যাঙ্কের সমস্ত  ফরমালিটি  আজই  শেষ করবে। কাজ সেরে, ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়েছে,  রোদের তেজে মনে হচ্ছে আবার ভেতরে ঢুকে যায় - এসির ঠান্ডায় বসে থাকে - এমন সময় কেউ ডাকল ওর নাম ধরে।  স্মিতা প্রথমে ভাবল ওর সেই পুরোনো রোগ - 'কোন কোন দিন এমন হয়' মোডে চলে গেল স্বভাবতই। তারপর খেয়াল করল, নামের পরে দিদি জুড়ে কেউ ডাকছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল প্রণব। পাড়ার ছেলে। স্মিতার জুনিয়র ভালো ফুটবল খেলত। ফার্স্ট ডিভিসন , স্টেট লেভেল। সন্তোষ ট্রফিতে মারাত্মক ইনজুরি হয়। খেলার সূত্রেই চাকরি পেয়েছিল। এখন প্রোমোটর। স্মিতা প্রস্তুত ছিল- আজ হোক, কাল হোক, প্রোমোটারকে ফেস করতে হবেই-

-হ্যাঁ বলুন-

-আমাকে তুমি বলুন দিদি। আমি তো পল্টনদের ব্যাচ। একটা কথা ছিল, ব্যস্ত থাকলে বাড়িতে যাব সন্ধ্যার দিকে-

- না না এখানেই বলুন

-প্লীজ, আপনি বলবেন না। দিদি, বাড়ির ব্যাপারে ভাবলেন কিছু?  মাসিমা চলে গেলেন -শুনেছি।  আপনারা কি আর এখানে এসে থাকবেন? এরপর বাড়ি তো ফাঁকাই থাকবে, বরং...

-ভাবি নি কিছু। আমি তো আছি এখন-

-কতদিন থাকবেন আর?

- ঠিক নেই

-কিছু ঠিক করলে জানাবেন আমাকে।  সেদিন মা খুব বলছিল আপনার কথা- কী না করল জেঠিমার জন্য-ঘর বর ছেড়ে-

স্মিতা আর শুনতে চাইছিল না। হাসল। হাত তুলে নমস্কার করে অটো নিল।

 

বিকেলে সনৎকে খেয়াল করল স্মিতা। সাদা গেঞ্জি পাজামা, দীর্ঘদেহী মানুষ  ছাদে পায়চারি করছে। শিখাজেঠির মৃতদেহের পাশে বালক সোনুর কথা মনে হল আবার। পায়েলকে ডাকল স্মিতা -" এই লোকটার কথাই বলছিলি?"

- এই লোকটাই। অফিস যায় নি আজ। নইলে এই সময় বাড়ি থাকে না-

-কোথায় টেলিস্কোপ লাগিয়েছে বলছিলি?

-পুকুরের দিকটায়, এখান থেকে দেখতে পাবে না

-দিদি, সেদিন লোকটাকে সাহেবগলিতে দেখেছে

-যেদিন ধনঞ্জয় গিয়েছিল, সে দিন?

- তিন চারদিন গিয়েছিল রোজই গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে

-সে তো হতেই পারে-

-আমার দেওরের দোকান আছে ওখানে- স্বপন-

-হ্যাঁ জানি

- স্বপন বলেছে,  লোকটার শ্বশুরবাড়ি ঐদিকেই কোথাও নাকী- আচ্ছা দিদি, বৌ তো ছেড়ে গেছে, তাও ওখানে ঘুরঘুর করা কি ঠিক? বলছিল...

এই বিকেলে জগতের যাবতীয় পথঘাট যেন সাহেবগলির দিকে যাচ্ছে।  অবাক লাগছিল স্মিতার। কৌতূহল হচ্ছিল সনতকে নিয়ে। পায়েলের সঙ্গে আলোচনা করতেও ইচ্ছা করছিল না অথচ।

- লোকটা তোদের কখনও ডিস্টার্ব করেছে? পুলিশে একবার জানিয়ে রাখব নাকি?

- না, কিছু করে নি। তাছাড়া আমরা তো জানলা দরজা সব বন্ধই করে রাখি। জানলা থেকে সরে এসো দিদি। লোকটা তাকাচ্ছে।

~*~

সনৎকে আলসেমিতে পেয়েছিল -সকালে জ্বর জ্বর লাগছিল, বেলা বাড়লে বুঝল -স্রেফ আলসেমি। সমস্ত দিন ঘুমিয়েই কাটালো আজ। অফিস মায়া, তন্ময় মায়া, ঝগড়া মায়া , চন্দ্রযান, বিক্রম সবই মায়া হয়ে গেল গভীর ঘুমে।  নিশ্ছিদ্র ঘুম- সিকিখানা স্বপ্নও উঁকি মারে নি। ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখে বিকেল হয়ে গেছে। মন্টুর মা চাবি খুলে রান্নাঘরে ঢুকে রুটি করছে।

-খুব ঘুমাচ্ছিলেন দাদা। অফিস বেরোন নি? চা খাবেন?

সনৎ মাথা নেড়ে ছাদে এল। এতগুলো ঘন্টা সে যে স্রেফ ঘুমিয়ে কাটালো - অবিশ্বাস্য লাগল প্রথমে। তারপর ভয় করে উঠল- এরকম যদি হয় বাকি জীবন? চন্দ্রযান নেই। বিক্রম নেই। কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা নেই। শুধু ঘুম আছে-  একবার শুধু চোখের ওপর এসে বসবে- প্রথমে আলতো করে বসবে, যেন পালকের মত হালকা ,  তারপর ভারি হবে আস্তে আস্তে- চোখের পাতা খুলে রাখা যাবে না, আরও ভারি হবে একসময়, তখন অনুভব লুপ্ত , বোধ লুপ্ত, সমস্ত চিন্তা অপনোদিত। মৃত্যু কী এইরকম? সনৎ বুকে হাত বোলালো, ডান হাত ভাঁজ করে বুকের বাঁ দিকে রাখল কিছুক্ষণ- 

সনৎএর চোখের সামনে বিকেল থেকে সন্ধ্যা হয়ে রাত্রি নামছিল। গোটা আকাশের রং বদলে যাচ্ছিল নীল থেকে কমলায়, হলুদে, তারপর ঘন নীলে- খানিকটা ধূসর নাছোড়ের মত লেগেছিল আকাশের মাথার দিকে।  ' বাড়ির জানলা থেকে আলো এসে পড়ছিল পুকুরপাড়ে। শঙ্খ বাজল কোথাও। আবছা কাঁসর ঘন্টা। কুকুর ডাকল।  রিক্সার হর্ন বেজে উঠে চুপ করে গেল।  খেয়াল করলে তারাদের একে একে ফুটে ওঠা দেখা যায় এই সময় - সনৎ তারা গুণছিল -এক দুই তিন চার পাঁচ …. একটা দলছুট পাখি ডানা ঝাপটে বাসায় ফিরল এইমাত্র। পুকুরের ঠিক ওপরে আকাশের একফালি অংশে কমলা হলুদ আর নীলের স্তর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর কালো হয়ে গেল। কারমান লাইন যেন  এখান থেকে শুরু হচ্ছে-  ট্রোপোস্ফীয়ার, স্ট্র্যাটোস্ফীয়ার, মেসোস্ফিয়ার শেষ হয়ে  স্পেস শুরু হয়ে যাচ্ছে এই পুকুরের ঠিক ওপরের আকাশে কোথাও- সনৎএর মনে হচ্ছিল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বর্ষা-

 

প্রায় আধ ঘন্টা ' মিঠু অপেক্ষা করছে ডাক্তারের চেম্বারে। এই শহরের নামকরা গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট-  অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে সময় লেগেছিল পাড়ার ডক্টর দাস থেকে বড় রাস্তার ডক্টর নাগ, আবার ব্যাক টু ডক্টর দাস এই রকম চলছিল- এঁর প্রেসক্রিপশনে হয়ত এক সপ্তাহ ভালো থাকল মিঠু, আবার যে কে সেই, তখন আবার অন্যজনের কাছে। মিঠুর  খেতে ইচ্ছে করে, খায়, খাওয়ার পরেই বমি - রুটিন হয়ে গিয়েছে এখন। ওজন কমছিল খুব দ্রুত। অথচ স্পেশালিস্ট দেখাতে গড়িমসি - আজ ইনভিজিলেশনের ডিউটি, কাল খাতা আনতে যেতে হবে, পরশু প্র্যাকটিকাল, এই কাজের চাপ কমে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে- স্ট্রেস আর কী, বুঝলে না... এই সব চলছিল।  মূলত মামু  আর কোলীগদের  চাপে মিঠু স্পেশালিস্ট দেখানোর উদ্যোগ নিল শেষমেশ;  কলেজের দিব্যেন্দু আর রোহিনী এই ডাক্তারকে রেকমেন্ড করে,  সঙ্গে 'বহুৎ বিজি ' -ট্যাগ লাগায়।  মিঠুরও মরিয়া ভাব এসে গেল- লেগে রইল এবার- ‘ধুর কী সময় নষ্ট’ বলে পালালো না- যেন এসপার কী উসপার; ' কিছুনা, হজমের গন্ডগোল' - সার্টিফিকেট পাড়ার ডাক্তারের বদলে স্পেশালিস্টের থেকেই আসুক- সকলের মত এবার মিঠুও চাইছিল খুব।  অবশেষে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে এই মুহূর্তে সে ওয়েটিং রুমে আরো পনেরো কুড়ি জনের সঙ্গে বসে। একাই এসেছে কলেজফেরত। ডাক্তারবাবুর আসতে দেরি হয়েছিল আধঘন্টা, ফলে এক নম্বর পেশেন্ট সবে ঢুকেছে , মিঠু আটে।

আজ বাইরে বৃষ্টি, কলেজের দোরগোড়া থেকেই ট্যাক্সি পেয়েছিল মিঠু। জ্যামে আটকে প্রথমে টেনশন করল খানিক। ঘন ঘন ঘড়ি দেখল। ঘামল প্রচুর। ক্লিনিকে পৌঁছে, ডাক্তার দেরিতে ঢুকেছেন জেনে  বাথরুমে গেল প্রথমেই। তারপর ডাক্তারের নাম লেখা দরজা ঠেলে ঢুকল। ঠান্ডা ঘর- প্রথমে দিব্যি আরাম-ঘাম টাম শুকিয়ে ফুরফুরে লাগে , কিছুক্ষণ পরেই চাদর খোঁজে মানুষ। গলার বোতাম আটকায়। আঁচল টানে। ওড়নায় কান ঢাকে।  এ ঘরে ওয়েটিং- সাদা রঙে লেখা আছে;  ডাক্তারবাবু ভিতরের ঘরে। একটি ছেলে চশমা চোখে ডেস্কটপ নিয়ে বসে- সময় হলে, সেই নাম ডাকবে , ভেতরে যেতে বলবে।

মিঠু আশপাশ দেখছিল-  বেশিরভাগই মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছে, দু'জন বই পড়ছিল, একজন বৃদ্ধকে এক সপ্তাহ আগের পুরোনো খবরের কাগজ পড়তে দেখল সে;  একটা বাচ্চা প্রতিটি চেয়ার ছুঁয়ে ছুঁয়ে কিচ্ছু চাইনি আমি গাইছিল- ঘরের এ’মাথা থেকে ও’মাথা যাচ্ছিল, ফিরে আসছিল। দেওয়ালে ফ্ল্যাটস্ক্রীন টিভি- শব্দহীন।  মিঠু কিছুক্ষণ সংবাদপাঠকের লিপ রিড করল, নিউজ টিকার, স্টক মারকেট ইনফর্মেশনে চোখ বুলিয়ে আবার মানুষজন দেখতে শুরু করল। একটি অল্পবয়সী মেয়ে সামনের টেবিল থেকে একটা সিনেমার পত্রিকা তুলে  নিয়ে সঙ্গের বৃদ্ধাকে দিচ্ছিল। কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছিল একটি ছেলে। কাউকেই অসুস্থ মনে হচ্ছিল না  মিঠুর- যেন সবাই ' হজমের গন্ডগোল, তেলটা কম খাবেন' প্রেসক্রিপশন নিতে এসেছে। কে রোগী, কে সঙ্গে এসেছে, কিম্বা রিপোর্ট করতে- বোঝার  চেষ্টা করল কিছুক্ষণ - একটা খেলার মত। তারপর হাল ছেড়ে দিল   তাকে নিয়েও কি কেউ খেলছে এখানে?

পেশেন্ট দেখতে সময় লাগছিল। মিঠু সামান্য অধৈর্য  হয়ে ঘড়ি দেখল;  তারপর টেবিলের ডাঁই করা ম্যাগাজিন ঘাঁটতে শুরু করল। বাংলা, ইংরিজি, হিন্দি ভাষায় খবরের কাগজ, পত্র পত্রিকা - চকচকে মলাট।  খানিক অন্যমনস্ক মিঠু ম্যাগাজিন তুলে নিল, প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতায় তার আঙুলের দ্রুত চালনা ম্যাগাজিনকে ফ্লিপবুকে পরিণত করল অচিরেই- সে বইয়ের গল্প হাস্যমুখ দীপিকা রণবীর, গাঁদা ফুলের মালা গলায় অমিত শাহ  নরেন্দ্র মোদী  আবার দীপিকার হাতের মেহেন্দি, রণবীরের গোঁফ হয়ে বক্তৃতারত রাহুল গান্ধীতে ফিরছিল। ফ্লিপবুকের এ গল্প থেমে যেতে জাস্ট পাঁচ মিনিট লেগেছিল এরপর;  পত্রিকায় চন্দ্রযানের আসন্ন অভিযান নিয়ে বেশ কটি প্রবন্ধ- সঙ্গে পুরোনো কোনো  লঞ্চিংএর ছবি- আকাশ ফুঁড়ে উঠছে রকেট,  কমলা আগুন ছিটকোচ্ছে- ছিঁড়ে খুঁড়ে যাচ্ছে মেঘ - মিঠুর হাত আটকে গেল খানে। এত লোকের মাঝখানে  সে একা হয়ে গেল আচমকা।  একটা ফুল সাজানো খাটের ওপর কমলা বালুচরী আর ফুলের গয়নায় সেজে গুজে বসে রইল আর দরজা বন্ধ করেই সনৎ বাঘের মত ঝাঁপিয়ে  পড়ল মিঠুর ওপর -টান মারল শাড়ি ধরে। ছিঁড়ে ফেলল ব্লাউজ।  ঘরের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল ফুলের পাপড়ি,  ছেঁড়া মালা, নতুন বরের পরিধান। সনৎ কামড়ে দিল ওর ঠোঁটে , গলায়, বুকে। সম্পূর্ণ নগ্ন সনতের উত্থিত পুরুষাঙ্গ থেকে তরল  গড়াচ্ছিল, ঠোঁটের কোণে গ্যাঁজলা- বিড়বিড় করে কী বলে চলেছে মিঠু তার কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না। আটচল্লিশ ঘন্টা আগেই যে হৃদয় মন্ত্র পড়ে সনৎএর হোক বলেছিল, সেই হৃদয় রক্ত মাংস চামড়া শিরা ধমনীর  হৃদপিণ্ড হয়ে গলার কাছে চলে এল  স্রেফ আতঙ্কে। চোখ বুজে ফেলল মিঠু। সনৎ নখ বসাল, দাঁত বসাল ওর শরীরে- মিঠুর  ঠোঁট গলা, বুক , পেট, ঊরু ফালা ফালা করে দিল- কতবার কতবার কতবার

ম্যাগাজিনের  কমলা আগুনের দিকে তাকিয়ে এই সব খুব দ্রুত ভাবছিল সে। ঢাউস বেডকভার, লেপের ওয়াড়, শাড়ি টাড়ি যতক্ষণ বাইরে, হাওয়ায়, রোদে কেমন ফুলে ফেঁপে থাকে, অথচ ভাঁজ করে ইস্ত্রি করতেই এক হাতে এঁটে যায়, এতদিনের সুখ দুঃখ হাসি কান্নাও তেমন গুটিয়ে এইটুকুনি হয়ে গেলমিঠু যেন তার গোটা জীবনটাই দেখে নিল ডাক্তারের অফিসে বসে। কেটে গেল, ছড়ে গেল, রক্ত ঝরল কত বার।  তারপর শূন্যতা এল, মিঠু দুহাতে জড়িয়ে ধরল নিজেকে। চোখ মুছে নিয়ে 'ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখল।  দেখল, একজিট লেখা সবুজ আলো, অপেক্ষারত মানুষজনের নিস্পৃহ দৃষ্টি, চেয়ার বেঞ্চ, টেবিলে ম্যাগাজিন;  দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক কানে আসছিল, এসির গোঁ গোঁ, বাচ্চাটা এখন মহারাজ একি সাজে গাইছে, চশমাচোখে ছেলেটি  গলা খাঁকরে হেঁকে উঠছিল -নাম্বার থ্রী, নেক্সট  নাম্বার ফোর...

ক্রমশ এসির ঠান্ডা, নরম গদীর চেয়ার ওকে আবার স্থিতিজাড্যে ফিরিয়ে আনছিল। পুরোনো কথা, ছবি, কান্না, রক্তপাত প্রাচীন টিকটিকির মত লুকিয়ে পড়ছিল  ক্যালেন্ডারের তলায়। মিঠুর মনে হচ্ছিল, বসে বসে পুরোনো কথা ভাবার জন্য  ডাক্তারের চেম্বারের মত জায়গা আর হয় না-

~*~

মিঠু না ফেরা অবধি হাওয়া গরম ছিল। টুম্পা চলে যাওয়ার পর, ছন্দা রান্নাঘর থেকে বারান্দায় যাচ্ছিল, উঁকি দিচ্ছিল নিচে, রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে ছ্যাঁক ছোঁক করছিল আবার। ঝনঝন করে বাসন আছড়ানোর শব্দ হল বার তিনেক। বিপ্লব টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিল।

আটটার খবর শুরু হতে মিঠু বাড়িতে ফিরল ।

-"ডাক্তার কী বললেন? ওষুধ কিনে আনব না কি এনেছিস?" টেবিল থেকে মানিব্যাগ পকেটে নিয়েছিল বিপ্লব।

"তোমাকে এই অন্ধকারে বেরোতে হবে না। বলাইকে বলছি- এনে দেবে"- ছন্দা চ্যাঁচালো।

মিঠুকে ক্লান্ত দেখায়। ঘাম মুছল- " ব্যস্ত হোয়ো না তো, অম্বলের, হজমের ওষুধ দিলেন। বাড়িতেই আছে, আনতে হবে না-

- এতেই সেরে যাবে বললেন?

- আল্ট্রাসাউন্ড আর এন্ডোস্কোপি করিয়ে আবার যেতে হবে শনিবার। ততদিন এই ওষুধ চলবে। আগেই করানো উচিত ছিল। ডক্টর নাগ কেন টেস্ট করাননি - এই সব বললেন।

-বলবে কি? জানে কিছু যে বলবে? তবু তোর মত বোকারা যাচ্ছে দেখাতে-

-থাক না মা, যা হয়ে গেছে ...

-কোথায় করাবি? বুক করতে হবে তো-

-বুক করেই এসেছি। ক্লিনিকেই এই সব করে দেরি হল।

"ওষুধ খা। হাবিজাবিগুলি আর গিলিস না, ঠিক হয়ে যাবি" ছন্দা বলল।

-এন্ডোস্কোপি কবে?

-পরশু। ছুটি নিতে হবে আবার

"আমি যাব তোর সঙ্গে, একা যাস না"  ছন্দা আর বিপ্লব আলাদা আলাদাই বলেছিল। ক্লান্ত মিঠুর কানে ঢুকল মার্জ করে- কানে হাত দিল মিঠু। ক্লান্ত গলায় থেমে থেমে বলল, " আরে না না। এর আগেও এন্ডোস্কোপি করিয়েছি। পারব। একাই পারব। তোমাদের যেতে হবে না।"

অম্বল আর হজমের ওষুধের প্রেসক্রিপশনের কথায় গৃহস্থ সহজে আশ্বস্ত  হয়। আবার এন্ডোস্কোপি, আলট্রাসাউন্ডের মত শব্দ তাকে অস্বস্তিতে রাখে, ঘুমোতে দেয় না । সে বারে বারে ওঠে, জল খায়, বারান্দায় দাঁড়ায়। গলির ঘুমভাঙা কুকুর তার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার নিজের মত কুণ্ডলী পাকায়। বারান্দার রেলিঙ ছুঁয়ে গাছের ডাল -তাতে ঘন সবুজ পাতা - রাস্তার আলো রিফ্লেক্ট করে। সে শশীবাবুর সংসারের তিনতলায় আলো জ্বলা ঘর দেখে। ঝাঁপফেলা দোকান দেখে। আকাশে তাকায়। হাই তোলে। একটা অটো বড়রাস্তার দিকে গেল। তারপর একটা স্কুটার । একসময়  তার চোখের সামনে জঞ্জালের ভ্যাটের ওপর আলোর ডুম নিভে যায়। কালো আকাশ রঙ পালটে  ঘোলা হতে থাকে। মোড়ের মাথা থেকে গলির ভিতরে কাগজ নিয়ে সাইকেল ঢোকে। আবার একটা ভোর। আজ মেঘ করে আছে।

~*~

শনিবার বাড়ি থেকে সরাসরি ডাক্তারের কাছে গিয়েছে মিঠু। বিপ্লব আর ছন্দা ওর সঙ্গে আজ; ফেরার পথে কেনাকাটা প্ল্যান রয়েছে- পুজোর বাজার এখনই শুরু না করলে পরে বড় ভীড় হয়। আল্ট্রাসাউন্ড, এন্ডোস্কোপি হয়ে গিয়েছিল; টিস্যু স্যাম্পল কালেকশন হয়েছে সমস্ত রিপোর্ট এখন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের কাছে।

আজও সেই কনকনে ঠান্ডা চেম্বার, অপেক্ষারত জনা পনের মানুষ, চশমা চোখে ছেলেটি আর তার কমপিউটার-ঘড়ির কাঁটা টিকটিক ঘুরছিল।

-সেদিনও এতক্ষণ তোকে বসতে হয়েছিল?

-হ্যাঁ

"একা একা বসে ছিলি-ইশ, বড্ড স্লো না এই ডাক্তার" ছন্দা বিজবিজ করল।

-স্লো কেন? যত্ন করে পেশেন্ট দেখেন- সময় লাগে।

-বেশি দেরি হলে, আজ আর কেনাকাটা হবে না, সব বন্ধ হয়ে যাবে। শনিবার না?

পাঁচ নম্বরে ডাক পড়ল মিঠুর। 

ডাক্তার আজ গম্ভীর। মাথা নামিয়ে মিঠুর রিপোর্ট দেখছিলেন।

সব রিপোর্ট এসে গেছে? ভালো তো সব?" ছন্দা আগ বাড়িয়ে বলল।

মুখ তুলে তাকিয়ে চশমা ঠিক করলেন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট।

-শুনুন। রিপোর্ট ভালো নয়। অনেক আগে আসা উচিত ছিল আপনার। কী করছিলেন এতদিন? কিচ্ছু বোঝেন নি? অংকোলজিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিন। সম্ভব হলে আজই। এই  ক্লিনিকেই পাবেন। রিসেপশনে বলুন দাঁড়ান আমি বলে দিচ্ছি। না ফীজ দিতে হবে না। আর সময় নষ্ট করবেন না, প্লীজ-

যেন গো গো গো গো স্ট্যাচু খেলায় স্ট্যাচু বলল কেউ।  হাত পা মাথা কবন্ধে লাগানো রইল - জোর নেই, অসাড়, চিন্তা করার শক্তি নেই।  শুধু ধকধক্ধকধক্ধক্ধক আওয়াজ হচ্ছিল মাথার মধ্যে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে পড়েছিল ছন্দা। বিপ্লব ধরে নিল। রিসেপশনের উল্টোদিকের বাথরুমে দৌড়ে  ঢুকেছিল মিঠু।

ছন্দাকে রিসেপশনে বসতে বলে অংকোলজিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিল বিপ্লব। টেনশন কাটাতে রিসেপশনের মেয়েটির সঙ্গে টুকটাক কথা চালাল কিছুক্ষণ। ব্রোশিওর নিল খান দুয়েক। ছন্দার কাছে এসে বলল- " কাল সকাল দশটায় দেখবেন ।  খুব নামকরা অংকোলজিস্ট। ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধরতে হবে, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। চল। মিঠু বেরোয় নি টয়লেট থেকে?"

ছন্দা মাথা নাড়ল- "না।"

-এখনও বেরোয় নি? দেখো একটু।

ছন্দা  উঠে গিয়ে দরজা ধাক্কালো, তারপর রিসেপশনের মেয়েটি।  তারপর আবার ছন্দা। ভিতর থেকে জল পড়ার আওয়াজ আসছিল। বিপ্লব দৌড়ে সিকিউরিটিকে ডাকতে গেল ।  ছোটো একটা ভিড় জমে উঠল বাথরুমের সামনে ….

তখন বেসিনের ট্যাপ খুলে সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছিল মিঠু। আর ফেনায় ফেনায় ভরে যাচ্ছিল বেসিন। মিঠু হাত ধুচ্ছিল আর ধুচ্ছিল। এই ছোট্টো বাথরুম তার অতি নিরাপদ আশ্রয় মনে হচ্ছিল। নিরন্তর জল ঝরে যাওয়ার আওয়াজ যেন এক অস্বচ্ছ পর্দা যার বাইরে সে এন্ডোস্কোপি, আল্ট্রাসাউন্ড, অংকোলজিস্ট আর তার অবয়বহীন ভবিষ্যতকে  দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইছিল- যতক্ষণ পারে।

~*~

আজ টুম্পা আসে নি। ছন্দা রান্নাঘরে ওর এখনও মনে হচ্ছে, ডাক্তার কিচ্ছু জানে না, অংকোলজিস্টের  ডায়াগনসিস ভুল, যাবতীয় টেস্টের রেজাল্ট মিঠুরই নয়। বিড়বিড় করতে করতে রান্না করছিল ছন্দা, ফ্যান গালছিল। খুন্তি ঠুকছিল কড়াইতে। মিঠু কলেজে গিয়েছে সকালে। ছুটি নেবে কেমো শুরু হবে পরশু। বাজার এনে আবার বেরোচ্ছিল বিপ্লব।

-কোথায় চললে?

-মাণিকের বাড়ি-

- জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। তার মধ্যে আবার পুলিশের ঝামেলা আনতে চাও? আমরা সবাই মরি-তাই চাও?

- পুলিশের ঝামেলা কেন হবে? ওদের যা জানার ছিল, সবই তো ….

-ন্যাকামি কোরো না। কী দরকার সেখানে?

- অনেকদিনই তো বলেছি, কাজকর্ম আবার শুরু করব। কিছু কন্ট্যাক্ট মাণিক জোগাড় করেছিল। টুম্পাকে খুঁজে রাখতে বলেছিলাম-

-পাগল হয়ে গেছ তুমি- একদম ঘোর উন্মাদ- কী সব বলছ!!

-অনেক টাকা লাগবে মিঠুর চিকিৎসায়। লাখ লাখ টাকা। মিঠুর সেরকম সেভিংস আছে? ক' দিন আর চাকরি করল। বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাব, দরকার হলে-

-কটা টাকা রোজগার করবে তুমি? অ্যাঁ? কটা টাকা? আর এই বয়সে, এই শরীরে পারবে তুমি? কী করবে?

-চেষ্টা করব। আমারও তো মেয়ে-

ছন্দা খুন্তি ছুঁড়ে ফেলল। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিপ্লবের মুখোমুখি দাঁড়াল

-তোমার মেয়ে! তোমার মেয়ে!  চেয়েছিলাম তো।  পারলে দিতে?  সে ক্ষমতা আছে? মগা একটা। মগা মগা মগা- সব শেষ  করে দিল- সব শেষ করে দিল-

কাঁদতে কাঁদতে বিপ্লবের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ছন্দা। চুলের মুঠি ধরে নখ বসিয়ে দিল বিপ্লবের গালে-

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বর্ষা-

 

একতলা ছিমছাম বাড়ি, সাদা রং, ঢালু ছাদে লাল টালি,  সামনে ছোটো বাগান, ব্যাকইয়ার্ডে ভেজি প্যাচে টমেটো, কুমড়ো ফলে আছে- পছন্দ হয়ে গেল সুবিমলদের।  ফাইনাল করে ফেলবে। ফুরফুরে লাগছিল- মাটির এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে হাঁটছিল সুবিমল। এজেন্টের অফিস থেকে ফেরার পথে আইসক্রীম খেলো তিনজন। এখন ফেরার পথ ধরেছে গাড়ি; পিছনের সীটে ব্রোশিওর উল্টেপাল্টে দেখছিল তিন্নি, ফেল্ট পেনের ঢাকনা খুলে ' রং সে রং চাপাচ্ছিল সাদা বাড়ির গায়ে;  একটা কুকুরছানা আঁকল বাড়ির সামনে, বাড়ির রঙে আর কুকুরের রঙে মিশে গেলে, সাদা কুকুরকে বাদামি করে দিল দুমিনিটে; আকাশে পাখি, সূর্য,  চাঁদ, তারা সব পাশাপাশি সাজিয়ে রং করল পটাপট, তারপর সবুজ বাগানে দুজন লম্বা, একজন ছোটো মানুষ এঁকে ঘুমিয়ে পড়ল। লিপি সুবিমলকে দেখছিল-  ওর দিক থেকে সুবিমলের সাইড প্রোফাইল দেখা যাচ্ছে-  সানগ্লাসের ডাঁটির নিচে জুলফি, চোয়াল, চিবুক - আনন্দ আর গর্ব গাল বেয়ে গড়িয়ে চিবুকে জমেছে। সুবিমল ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েকে দেখল দুবার-  মায়ায় নরম ' চোয়াল- শিস দিয়ে এক্সিট নিল এবার, স্পীড না কমিয়েই।

" সাবধানে ", লিপি বলল।

" একদিন  পঙ্কজদাকে খেতে বলি ? আর রাঘবদের?  হুঁ? লেটস সেলিব্রেট" -স্টীয়ারিংএ  তাল ঠুকল সুবিমল।

~*~

পেঁপে গাছের ফুল যে রজনীগন্ধার মত দেখতে হয় পঙ্কজের ধারণা ছিল না। এই  গ্রীষ্মে, দাবানলের তাত সমস্ত সবুজ  ঝলসে দিয়ে, প্রথমে হলুদ তারপর ধীরে ধীরে খয়েরি করে দিয়েছিল;  ঘাসজমি, গাছের পাতা- সব মরে কাঠ, মনে হয়েছিল পঙ্কজের  অথচ  এখন, বর্ষার জল পড়তে না পড়তেই  ওর বাগানকে ঘন সবুজ আর জঙ্গুলে দেখাচ্ছে। পাখিরা বার্ড ফীডারে জল খেয়ে যেত, ঠোঁটে ঠোঁটে এদিক ওদিক বীজ পড়েছিল- সে সব থেকে চারা গজিয়েছে; পেঁপে গাছ অবশ্য পুরোনো- স্মিতা লাগিয়েছিল। বেগনে সাদা ফুল ধরা চারাগাছ রোদে নেতিয়ে ছিল- এখন লকলক করে বাড়ছে; পঙ্কজ  দুটো কাঠি ঠেকনো দিয়ে বাড়ির পিছনের দরজা খুলে ক্লথ লাইনার স্ট্যান্ডের  কাছে রেখে দিয়েছিল টবটা- এ’দিকটা অত রোদ পড়ে না। এখন সবে ভোর হয়েছে। পঙ্কজ  অফিসে বেরিয়ে  যাচ্ছিল- একটা ডেডলাইন মীট করতে হবে। বাড়ি থেকে কাজ করতে অসুবিধে হয় - কনসেন্ট্রেট করতে পারে না। পেঁপে ফুলের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে পড়ল।

অফিসে ক্লীনাররা সাধারণতঃ খুব ভোরে আসে-  করিডোরে ভ্যাকুয়াম ক্লীনার চলার আওয়াজ হচ্ছিল গুনগুন করে, পঙ্কজ ইয়ারফোন লাগিয়ে নিল। কফিতে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপে লগ অন করল। তখনই গ্রাহাম এসে দাঁড়িয়েছিল - ট্র্যাশ নিতে।

-গুড মর্নিং।

" মর্নিং" ,পঙ্কজ  ইয়ার ফোন খুলে  নিল কথা বলার সময়।

এই সকালে যখন আলো টালো ফুটেছে, বড় কাচের জানলার ব্লাইন্ড ওপরে গুটিয়ে তোলা, আর ভোরের রোদ সেই সুযোগে পঙ্কজের ডেস্ক ছুঁয়েছে সবে- এই নিমেষ সম্ভবত মানুষকে কিছু মনে করায়- পুরোনো কথা, স্বপ্ন ট্বপ্ন; সে তখন কিছু বলতে চায়, শোনার  মানুষ খোঁজে। গ্রাহামও কিছু বলতে চাইছিল। কালো বিন লাইনার হাতে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ তারপর বলল, " কী শুনছিলে? কী ধরণের গান শোনো?"

সকালের রোদ সবাইকে এক ভাবে ছোঁয় না। পঙ্কজ এই মুহূর্তে ওর ল্যাপটপের স্ক্রীনে কনসেন্ট্রেট করতে চাইছিল- ফার্স্ট আওয়ারের মধ্যেই  কাজটা  অর্ধেক সেরে নিতে হবে, তদুপরি, ধরা বাঁধা কিছু শোনে না- এই মান্না দে তো এই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে এড শীরানে গেল হয়ত, অথবা অতুলপ্রসাদী শুনল খানিক। কী বলবে ভাবতে ভাবতেই, গ্রাহাম গল্প  শুরু করেছিল-" হ্যাভ ইউ ওয়াচড দ্য বোট দ্যাট  রকড?"  পঙ্কজ কিছুক্ষণ ভেবে " না" বলতে,  গ্রাহাম কোকের ক্যান তুলে বিন লাইনারে ফেলেছিল তারপর মৃদুগলায় বলেছিল সিনেমায় ওকে এন্সেমবল করা হয়েছে। " আই ওয়জ ডিজে, অ্যান্ড পাইরেট রেডিও অপারেটর।  ডু ইউ নো এনিথিং অ্যাবাউট পাইরেট রেডিও?"

পঙ্কজের উত্তরের প্রত্যাশী ছিল না গ্রাহাম, তার আজ সকালে সম্ভবত অনেক কিছু বলার ছিল; সে শুরু করে দিয়েছিল  বিস্কুটের টিনের মধ্যে  ট্র্যান্সমিটার বানানোর কথা। আসলে সবই ছিল  ষাটের দশকে ব্রিটেনের গান শোনার গল্প।  কালো বড় ট্র্যাশব্যাগ হাতে গ্রাহাম অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। পঙ্কজের কিউবিকলে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গল্প বলছিল। সমুদ্র আর গান। বলছিল পাইরেট রেডিওর কথা।  বলছিল, গ্রাহামরা কয়েকজন  সমুদ্রের ওপরে জাহাজ থেকে রক, পপ বাজাত। ব্রডকাস্ট করত ব্রিটেনে। রেডিওয়। গ্রাহাম বলেছিল সেসব অবৈধ ব্রডকাস্ট ছিল। ইল্লীগাল। লীর ওপর খুব জোর দিয়েছিল, হেসেছিল। পঙ্কজের কাঁধে রোদ পড়ছিল, কাজ ফেলে কথা বাড়াল সে -"ইল্লীগাল? টেল মি অ্যাবাউট ইট।"

~*~

ফিউমহুডে রিফ্লাক্স চলছে। লরেল হিটিং অ্যাডজাস্ট করে জলের ফ্লো দেখছিল। তারপর সলভেন্টে টি এল সি প্লেট ঢুকিয়ে জারের মুখ চাপা দিল। কাজটা সীতারই করার কথা।  গ্যাব্রিয়েলা সীতার কিছু কাজ লরেলকে অ্যালট করেছে।  সীতার পাঁচ মাস  চলছে - সলভেন্ট নিয়ে কাজ করা বারণ। লিপি জয়েন করার পর সীতার সঙ্গেই সামান্য ভাব - কাছাকাছি বয়স, গায়ের রংও। সীতার একটি ছেলে- বছর চারেকের , মেয়ের খুব শখ। মেয়েই হবে- সীতা একদিন লিপিকে  বলেছিল।

খুব মন দিয়ে কাজ করছিল সীতা। সকাল থেকে মর্টার পেসেলে স্যাম্পল গুঁড়ো করছে। শক্ত আর  হলদেটে সাদা স্যাম্পেলের ফ্লেক। অ্যাপিয়ারেন্স কমপ্লায়েড লিখে  সই করে উঠল- বাথরুম যাবে। গ্যাব্রিয়েলা যেন ওঁত পেতে ছিল-" দিস ইজ দ্য টেনথ টাইম। হাউ মেনি টাইমস ডু ইউ নীড টু ভিজিট দ্য টয়লেট? উই আর লুজিং টাইম হিয়ার।" বাঁ হাতের কবজি তুলে ঘড়ি দেখাল গ্যাব্রিয়েলা ,ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ডায়াল ঠুকল। সীতার মনে ঘাই মারল একটা শব্দ। দরজা পেরোতে পেরোতে মন থেকে কণ্ঠনালীতে  তুলে নিল, তারপর  বাথরুমের দরজা বন্ধ করে জিভ আর দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের  করে দিল-  বিচ্”-

~*~

এই কদিন প্যাট্রিক আসছিল ট্র‌্যাশ নিতে। পঙ্কজ জিগ্যেস করেছিল গ্রাহামের কথা। প্যাট্রিক  বলেছিল,  গ্রাহাম সি ওর অফিস পরিষ্কার করে। তারপর মুখ বেঁকিয়ে বলল -"সি ওর অফিসের কাজ তো ওকেই দেবে।"

পঙ্কজ হেসে ফেলেছিল, "কেন?" 

-বলব একদিন।

আজ গ্রাহাম  এসেছে।

পঙ্কজ গুড মর্নিং বলল, চোখ নাচাল।

কালো বিন লাইনার ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিল গ্রাহাম, পকেটে হাত ঢুকিয়ে চকোলেট বের করে পঙ্কজকে দিল- " নাও।"

-কী হল হঠাৎ?  হোয়াটস দ্য অকেশন? আসো নি তো অনেকদিন। প্যাট্রিককে জিগ্যেস করছিলাম..

- চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি আর দেখা হবে না।

-তাই?  উইল মিস ইউ। কোথায় জয়েন করবে ? ঠিক করেছ কিছু?

-বাকিংহাম প্যালেস থেকে একটা অফার আছে। দেখি।

~*~

লিপি প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিল সমস্তদিন, এখন কাজ গুটিয়ে ফেলবে- বিকেল পড়ে আসছে; ওর ল্যাপটপে পর পর ফাইল খোলা, রিপোর্টের প্রিন্ট নিচ্ছিল লিপি, সই করছিল- গ্যাব্রিয়েলা নিয়ে যাবে একটু পরে। কিছু ইমেলের উত্তর দেওয়া এখনও বাকি। হঠাৎ লরেল টোকা দিল ওর দরজায়, তারপর মাথা গলাল ঘরের ভেতর; হাঁফাচ্ছিল লরেল: " সামথিং ইজ ভেরি রং- সীতা টয়লেট থেকে মেসেজ করছে-ওখানে যেতে বলছে, কী ব্যাপার লেখে নি; তোমাকে কল করেছে নাকি, তুমি ধরোনি।" মোবাইল বের করল লিপি - পাঁচটা মিসড কল।  গ্যাব্রিয়েলা গোটা কয়েক কাগজ হাতে লিপির অফিসের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল; " সরি, একটু পরে দেখছি" - গ্যাব্রিয়েলার পাশ কাটিয়ে মেয়েদের টয়লেটের দিকে দৌড়োলো লিপি, পিছনে লরেল। লিপি অফিসের দিকের টয়লেটের দিকে টার্ন নিতে যাবে, লরেল আঙুল তুলে  উল্টোদিক দেখালো- অফিস পেরিয়ে উঠোন, উঠোন পেরিয়ে ল্যাব,তারপর  মেয়েদের বাথরুম।  সারি সারি দরজা। একটা বন্ধ। ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছিল। দরজায় ধাক্কা দিয়ে সীতাকে ডাকল দুজনে। 

-"দরজা খোলো, কী হয়েছে?"

- হেল্প মি লিপি, হেল্প মি। আই থিন্ক আই হ্যাভ লস্ট হার।

হাউ হাউ করে কাঁদছিল সীতা। সাদা কমোড রক্তে মাখামাখি হয়ে  রয়েছে।

অ্যাম্বুলেন্স এসে সীতাকে  নিয়ে গিয়েছিল। লিপি কপালে হাত দিয়ে বসেছিল, খোলা ল্যাপটপের দিকে তাকালো- এবার বাড়ি যেতে হবে। এই সময় , লরেলের সঙ্গে ওর অফিসে ঢুকছিল ক্যাথি, মেরি চুং, স্টীভ;  লিপির অফিসের পশ্চিমের জানলা দিয়ে রোদ আসছে - যেন একদল কমলা মানুষের লাইন-  মনে হচ্ছিল  লিপির-

-কী ব্যাপার?

ইতস্তত করছিল সবাই। লরেল মুখ খুলল প্রথমে- " লুক, উই অল নো হাউ গ্যাব্রিয়েলা ট্রীটেড সীতা। আমরা এইচ আরকে ডিসক্রিমিনেশনের কেস হিসেবে ব্যাপারটা জানাতে চাই। আর স্টীভ বলছিল, গ্যাব্রিয়েলা সীতাকে কিছু স্যাম্পল হ্যান্ডল করতে দিয়েছিল, যেগুলো হ্যাজার্ডাস। স্টীভের কাছে লিস্ট আছে। আমরা জানি না কীভাবে অ্যাপরোচ করা উচিত। উই নীড ইয়োর হেল্প হিয়ার লিপি। প্লীজ একটা ড্রাফট করে দাও। লিপি এক সেকন্ডও সময় নিল না-“বোসো। লিখে দিচ্ছি। লিস্টটা আছে, স্টীভ?”

" কাজ কর্ম ফেলে কী হচ্ছে এখানে?" দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছিল গ্যাব্রিয়েলা- লরেল, স্টীভ, মেরির সুপারভাইজর।  লিপির দিকে আঙুল তুলে বলল- "ব্লাডি ইন্ডিয়ান, লোক খ্যাপাচ্ছ?"

~*~

ল্যাপটপের ব্যাগ ঝুলিয়ে বাসস্টপ থেকে বাড়ির দিকে হাঁটছিল পঙ্কজ।  গাড়ি সার্ভিসিংএ  দিয়েছে- ফলে, দিন তিনেক বাসে যাতায়াত করবে। এইখানে ট্রাফিক লাইটে গাড়ি থামলে, রোজই দোকানটার দিকে  চোখ যায় পঙ্কজের, সস্তা জিনিষের দোকান - বার্গেন ওয়ার্ল্ড। একটেরে অন্ধকার- দোকানের ভেতর  কোনদিনই দেখা যায় না গাড়ি থেকে। দোকানের বাইরে প্লাস্টিকের ফুল, নাইলনের দড়ি, চটি, পাপোষ রাখা থাকে,  হ্যালৌইনের ছদ্মবেশ দিনের পর দিন হ্যাংগারে ঝোলে; টেরাকোটার  টবে মানিপ্ল্যান্ট, ছোটো বাঁশ। তার পাশে দাঁড়িয়ে দোকানী উদাস চোখে সিগারেট  টানে।পঙ্কজ এইরকমই দেখে রোজ। আজ হাঁটতে হাঁটতে দেখল,  গমগম করছে এলাকা- দোকানের সামনে  অজস্র বেলুন, রঙীন শিকলি, লোকের ভীড় আর ভীড়ের মধ্যে গ্রাহাম। চমৎকার সুট, বো, চকচকে জুতো। মাথায় টুপি। হাতে মাইক্রোফোন। স্প্রুইকিং করছে। অনর্গল বলে যাচ্ছে শস্তার চটি পাপোষ ফুলদানির আশ্চর্য গুণাবলীর কথা; লোক ডাকছে, গান গাইছে, রসিকতা করছে চোখ মটকে-এই সব চটি, এই পাপোষ, ফুলদানি যে বস্তুত জাদুভরা - এসব বলছিল। বলছিল ম্যাজিকাল, বলছিল বাড়ি বদলে যাবে।   গমগম করছিল ওর গলা।  একটা সুর ছিল , যা লোক টানে। ওকে ঘিরে ভীড় জমছিল। সরু সাইডওয়াক। তবুও। রাজার মত লাগছিল ওকে। কিম্বা খুব শক্তিশালী কেউ একজন। কবি বা বিপ্লবী। অথবা ম্যাজিশিয়ান।  পঙ্কজকে দেখতে পেয়েছিল গ্রাহাম।  টুপি খুলল, হাত নাড়ল তারপর আবার বকবক করতে শুরু করেছিল পঙ্কজ চোখ নামিয়ে নিয়েছিল- আর কোনো ম্যাজিশিয়ানের চোখের দিকে তাকাবে না কখনও। পঙ্কজ জুতো ঘষল ফুটপাথে,  অকারণ; হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। রাস্তার আলো জ্বলে যাওয়ায়, স্ট্রীট লাইটের তলায় পঙ্কজের চারটে ছায়া পড়ছিল যথারীতি।

~*~

আজ সুবিমল অফিসে দীর্ঘসময় কাটিয়েছে। লিপিকে মেসেজ করে দিয়েছিল তিন্নিকে নিয়ে ফেরার জন্য। টীম বিল্ডিংএর ইভেন্ট অর্গানাইজ করার দায়িত্ব পেয়ে গেছে - স্ট্রেস ফ্রি ওয়র্কপ্লেস ফোকাস করে একটা প্ল্যান খাড়া করে ফেলেছে অলরেডি;  প্রেজেন্টেশন বানাবে আজ রাতে। সামনে বাড়ি বদলানো- ঈষৎ চিন্তা রয়েছে সেই সব নিয়ে। চাপ কাটাতে শিস দিচ্ছিল জোরে জোরে। এই সময় ল্যান্ডিং , সিঁড়ি ভরে থাকে রাঁধাবাড়ার গন্ধে- বারবিকিউর গন্ধ , দুধ ওথলানোর , ভাত ফোটার  গন্ধ কিম্বা মাছভাজার , কখনও পুড়ে যাওয়া তেলের, কাফির লাইমের অথবা ভিনিগারের;  এত গন্ধের ভীড়ে নিজের  দরজার নিচ দিয়ে আসা গন্ধ সে ঠিক চিনে নেয় এই সময়- তার খিদে পায় , তিন্নি আর লিপিকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে হয়- ভালবাসি, বড্ড ভালবাসি

আজ  দরজার  বাইরের আলো জ্বলছিল না- বাল্বটা কেটে গেছে হয়ত, দেখতে হবে ;  পরক্ষণেই মনে হল- আর তো মাসখানেক মোটে-  সিঁড়ি দিয়ে আর উঠবে নামবে না সে চাবি ঘুরিয়ে সুবিমল ঢুকল অ্যাপার্টমেন্টে।  কিছুদিন ধরেই  বাধাছাঁদা চলছিল। বসার ঘরের মেঝেতে আট দশটা কার্ডবোর্ডের বাক্স পড়ে আছে আজ কয়েকদিন- কোনোটা ভর্তি- দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়ে গিয়েছে; কোনো বাক্স বাঁধা হয়েছিল, আবার খোলা হয়েছে- তিন্নি তার ভিতর থেকে খেলনা বের  করেছে আবার ঢুকিয়ে রেখেছে সুবিমল দেখল, আজ ঘর অন্ধকার, রাশিকৃত বাক্স ছড়ানো ছেটানো- তার মধ্যে চুপ করে বসে আছে লিপি।

-কী হল আলো জ্বালাও নি কেন? কী হয়েছে? তিন্নির জ্বর না কি? অ্যাঁ?

-তিন্নি পাশের ঘরে , ঠিক আছে।

-কী হয়েছে বলবে তো-

- আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি আজ-

-কী বলছ কী!  পাগল হয়ে গেছ?  এই বাজারে আবার কবে চাকরি পাবে তুমি? আমি তো তোমার চাকরির ওপর ভরসা করে বাড়ি  কিনেছি লিপি। অ্যাতো মর্টগেজ- আমি একা পারব কী করে? এটা কী করলে? এই ক্রিটিকাল সময়ে ছেড়ে দিলে? আর তুমি চাকরি ছাড়বে কেন তাও তো বুঝতে পারছি  না- কেন? লিপি? আন্সার মী নাউ।

সুবিমলের গলা চড়ছিল। মেঝেতে বসেছিল লিপি-গোঁজ হয়ে; দু হাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে, ঈষৎ দুলছিল। এই সময় পুতুল কোলে দরজায় এসে দাঁড়াল তিন্নি। বাবা মা মুখের দিকে তাকাল তারপর কেঁদে উঠল জোরে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

বর্ষা-

 

বারো বাই পঁচানব্বই মিটারের টিবিএম চণ্ডী তার কাটিং হুইলে  মাটি,পাথর খন্ড খণ্ড করে এগোচ্ছিল ক্রমশ। সেইসব কাদা,  মাটি, পাথরের টুকরো স্ক্রু কনভেয়র দিয়ে পোঁছে দিচ্ছিল বেল্ট কনভেয়রে;  লস অফ স্টেবিলিটিকে কমপেনসেট করছিল সাপোর্ট প্রেশার। চব্বিশটা হাইড্রলিক মোটর  গিয়ার  র‌্যামে  র্টর্ক তৈরি করছিল।  আর ইনজেকশন সিস্টেম জল দিয়ে  সামনের মাটি ভিজিয়ে নিচ্ছিল, প্রয়োজনমত।

মন্দিরের  সামনের রাস্তায় পায়ের পাতা ডোবা জল- রুটের বাস, ট্যাক্সি গেলেই চাদর বিছিয়ে দেওয়ার মত করে ফুটপাথে উঠে আসছিল; এক কোণে প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরাটোপ বানিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে প্রফুল্ল- সেই রাত থেকে। একবার  মুণ্ডু বের করে আকাশ দেখেছিল- চারদিক সাদা হয়ে বৃষ্টি পড়ছে, বেলা বোঝা যায় না। কাঁসি আর পটল ওর পাশেই কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল- প্রফুল্লকে মুখ বের করতে দেখে গা মোড়ামুড়ি দিল , আবার ঝিমোতে লাগল। গতকাল দুপুরে ফুটপাথে পটলকে এঁকেছিল প্রফুল্ল। শ্রীদেবী যেন পটলকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে হাঁটতে বেরিয়েছে, আর সমুদ্র থেকেই সটান সূর্য উঠেছে আকাশে; শ্রীদেবীর চোখে গোগো সানগ্লাস,  মাথার ওপর বিশাল ছাতা,  তার পিছনে মা কালীর এই অ্যাতো বড় লাল জিভ- একটাকা, দুটাকার কয়েন পড়ছিল ছবিতে- পাঁচ টাকার কয়েনও - দুটো এখন বৃষ্টির ছাঁটে সে সব ছবি ধুয়ে গেছে, নতুন করে আঁকার জন্য এক ইঞ্চি শুকনো জায়গাও নেই;  দু দিকে হাত ছড়িয়ে  হুইইই বলে যে  রাস্তা ধরে একবগ্গা দৌড়বে- সে উপায় নেই;  ডিগবাজি খেতে গেলেও ছপাৎ করে কাদাজলে পড়বে -  কী করা যায় ভেবে পাচ্ছিল না প্রফুল্ল। কাঁসি আর পটলের গায়ে চাপড় দিতে দিতে সুরময়ি আঁখিয়ো মে ভাঁজল গুনগুন করে, হালকা ফুলকা শবনমিতে এসে গলা  শুকিয়ে এল।  কাশল দুবার। পটল আর কাঁসি বেজায় খুশি হয়ে ল্যাজ নাড়ছিল। প্রফুল্ল মাথা চুলকে বলল - "', নৌকো ভাসাই।" তারপর ঝোলা হাতড়ে পুরোনো খবরের কাগজ টেনে বের করে, ছিঁড়ল প্রথমে, প্লাস্টিকের তলার শানে বিছিয়ে  ভাঁজ করল; দু দিকের কোণা  টেনে  নামাতে , পাশাপাশি  দুটো ত্রিভুজ হয়ে গেল- এবারে তলার দিকে ভাঁজ করে, আড়াআড়ি টান দিলেই একটা টোকা কিম্বা নৌকো হয়ে যাওয়ার কথা। নৌকো বানাল ঢাউস এক নৌকা  জলে ভাসাতেই টাল খেয়ে কেতরে গেল। তারপর নিমেষে কাগজের মণ্ড হয়ে জলের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে ঝাঁঝরির মুখে আটকে রইল। চোখ পিট পিট করল প্রফুল্ল, মাথা চুলকোলো- জলপথের এই  সব বিপদজনক ব্যাপারস্যাপার শ্রীদেবীকে জানিয়ে রাখা দরকার- তার মনে হচ্ছিল।

~*~

পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ভারি হয়ে  নেমে আসছিল বয়েজ হাইস্কুলের ওপরে।  দু ঘন্টা  ধরে সাহেবগলি বয়েজ হাইস্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে সাহিল - উঁচু পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ড, জং ধরা সবুজ গেট বন্ধ রয়েছে। পেল্লায় গেট চোখে পড়তেই সাহিলের মনে হয়েছিল, একজন বুড়ো মানুষকে টুলে বসে থাকতে দেখবে।অথচ  ধারে কাছে একজনও নেই। বস্তুত  বিকেল চারটেয় একটা স্কুলের সামনে যা যা চোখে পড়ার- সে সব কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সাহিল। উপরন্তু ঘন কালো মেঘ নেমে আসছিল মাথার ওপর-  মনে হচ্ছিল, সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে   সাহিল ফটক ঝাঁকাল,  জোরে জোরে ধাক্কা  দিল ,তারপর সবুজ দরজার খুব কাছে গিয়ে  কান পাতল- সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ ওদিকটা। বড় ফটকের একপাশে আয়তাকার ছোটো দরজা- ঠেলাঠেলি করেও  খুলতে পারল না সাহিল। স্কুলের সামনের রাস্তা শুনশান- উল্টো দিকে পাশাপাশি দোতলা বাড়ি সব-  বারান্দায় ভিজে  শাড়ি, গেঞ্জি ঝুলছে; একটি বাড়ির নিচে জয়গুরু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছিল। এবারে  মোবাইলে স্কুলের নম্বর সার্চ  করল সাহিল- গোটা চারেক নম্বরে পরপর চেষ্টা করল কেউ ধরে না। কঙ্কণার দুটো ফোন এল এই সময়- কেটে দিল সাহিল। ঘাড় গোঁজ করে ডায়াল করে যেতে লাগল।

একসময় জলরঙের ক্যানভাসে যেন দু ফোঁটা জল পড়তেই মেঘেরা গলে গিয়ে নেমে এল - সাহিল চমকে উঠে মোবাইল পকেটে পুরল তারপর এক দৌড়ে ক্রস করল রাস্তা। জয়গুরু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে শেডের তলায় দাঁড়িয়ে ছাতা বন্ধ করে জল ঝাড়ল।  দোকানের ভিতরে যতখানি দেখা যাচ্ছিল- মৃত মানুষের ছবিতে কালিঝুলি মাখা শোলার মালা, বিস্তর মাছি টাছি আর বাসি রসগোল্লার টোকো গন্ধে মলিন দোকান;  গামছা আর গেঞ্জি পরা দুজন নির্লিপ্ত মুখে কাগজের বাক্স খাপে খাপে ভাঁজ করে ডাঁই করে রাখছিল।

-ভিতরে আইস্যা দাঁড়ান। এই বিষ্টি এখন ধরব না।

-না না ঠিক আছে। অসুবিধে হচ্ছে না।

 -কই যাইবেন আপনি?

- এই স্কুলে এসেছিলাম। হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দরকার-

-ভালো দিনেই আইছেন, আইজ তো ইস্কুল বন্ধ। এক ছাত্র মারা গ্যাসে -

-মারা গেছে!

-অ্যাক্সিডেন্ট। দোষ পোলাডারই,  বোঝলেন? বয়স কম, রক্ত গরম হইলে যা হয়। রেস দিতাসিল এক লরির লগে। এই তো বড় রাস্তায়। পেপারে দিসে। দ্যাখেন নাই বুঝি? ভোগান্তি আপনের।

"অনেকদিনের দোকান ? "দোকানের ছিরি সাহিলের মুখ থেকে প্রথম প্রশ্ন বের করে আনল।

-দোকান তো পুরাতন। মালিকের ঠাকুর্দার।

-আপনারা কাজ করছেন কদিন?

- আমার দুই , হারুদার ছয় বচ্ছর হইছে। নয় গো হারুদা?

এখানে জিগ্যেস করার অর্থ নেই। সাহিল, তবু খড়কুটো আঁকড়ে ধরেছিল-"নীলকমল নামে কাউকে চেনেন?"

"সে তো  রূপকথার রাজপুত্তুর গো- আমার মেয়ের ইস্কুলে সেদিন ঠাকুমার ঝুলি হল, মেয়ে শুকপাখি না কী হয়েছিল- সেই নীলকমল?"  এই প্রথম কথা বলল হারুদা, হাসতে লাগল।

- নীলকমল জাদুকর একজন। ম্যাজিক শো হত  এই স্কুলে, অনেকদিন আগে।

- না শুনি নাই। বসেন না। যান কই?  বড় রাস্তা অবধি যাইতে যাইতে ভিইজ্যা যাইবেন।

অন্ধকার রাস্তাঘাট, অঝোর  বর্ষণ, আবার এক কানাগলির মোড়ে এসে পড়েছে সাহিল। হাতের ভাঁজ করা ছাতা থেকে টুপটুপ করে জল ঝরে ঝরে লম্বা লাইন তৈরি করছিল- সাহিলের জুতোর সামনে থেকে সেই রেখা শুরু হয়ে রাস্তায় পড়ে ঢাল বেয়ে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছিল। সেই দিকে তাকিয়ে সাহিল জিজ্ঞেস কর,  "সাহেবগলি রাস্তাটা কোথা থেকে শুরু?"

-এই যে দোতলা বাড়ির পাশ দিয়া গলি শুরু হইল।  বড় রাস্তার দিক থিক্যা আর একখান  মুখ আছে অবশ্য। বিস্তর লম্বা গলি। প্যাঁচ মারতে মারতে সেই কারখানার মাঠ অবধি গ্যাসে। সব নতুন নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠতাসে। এই ইস্কুলের দুই একজন মাস্টারমশাই ফ্ল্যাট কিনসেন; তয় আজ যা অবস্থা,  কাওরে পাইবেন না। আর একদিন আইস্যেন। সকাল কইর‌্যা।

~*~

কপিল আজ প্রফুল্লকে রেডিওর ব্যাটারি এনে দিয়েছে। মাঝে মাঝে শিয়ালদার দিকে কোথাও গাড়ি ধুতে যায় কপিল।  সেখান থেকে পুরোনো জামা প্যান্ট নিয়ে আসে নাথু আর প্রফুল্লর জন্য, চটি আনে, ঝলঝলে সোয়েটার, চাদর- বলে, মালিক দিয়েছে। কখ্নও গোলাপী বাক্সে কেক , ক্রীমরোল এনে ওদের দেয়- সে বাক্সের কাগজেরই  কী সুবাস! কী কাগজ কে জানে! সেদিন শ্রীদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা মনে হতেই প্রফুল্ল ওকে ব্যাটারি  আনতে বলেছিল। চক দিয়ে ব্যাটারি এঁকে সাইজ বুঝিয়েছিল।

-ক্যা করোগে বেটারি লে কে?

প্রফুল্ল উত্তর দিল না। চক দিয়ে প্রথমে একটা  আয়তক্ষেত্র আঁকল ফুটপাথে। পিছনে আর একটা। ওপরে আর নিচে ছোটো সমান্তরাল লাইন দিয়ে চৌখুপি দুটো জুড়ে দিয়ে , এখানে ওখানে গোল চৌকো আকার , আর লম্বা টিকির মত অ্যান্টেনা আঁকল।

-রেডুয়া না কি রে? কাঁহা সে মিলা? কাঁচড়া সে উঠা লিয়া ক্যা?

প্রফুল্ল উত্তর না দিয়ে প্রণিপাত করল মন্দিরের সামনে। কপিল কিছু বুঝল না। প্রফুল্লর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়েছিল- এনে দেবে।

এখন রাতের দিকে, মন্দিরের সামনে প্রফুল্ল নীল রেডিওর তলার ছোটো খোপে ব্যাটারি ভরছিল।  নব ঘোরাতেই সবুজ আলো জ্বলে উঠে ঘ্যাসঘ্যাস আওয়াজ হচ্ছিল। অ্যান্টেনা টেনে লম্বা করে দিতে গম্ভীর গলায় কথা শোনা গেল - খবর হচ্ছে। প্রফুল্ল শুনছিল না, নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গানের স্টেশন খুঁজতে লাগল-

~*~

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বক্তার পরে চতুর্থও যখন তাঁর ভাষণের শুরুতে গলা কাঁপিয়ে  'আজকের এই বর্ষণমুখর শ্রাবণ সন্ধ্যা' বললেন, সাহিল বেরিয়ে এল সভাঘর ছেড়ে।  পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো - বৃষ্টি  থেমে গেলেই হাঁটা মারবে। সবাই একই শব্দ  দিয়ে কথা শুরু করছে যেন প্রত্যেকেই আজ সকালে শব্দটা আবিষ্কার করেছে আর সেই আবিষ্কারের আনন্দে শব্দটা মুখ থেকে প্রথমেই বেরিয়ে আসছে। এই ভাবনায় যথেষ্ট কৌতূকের উপাদান ছিল না , খুবই বিরক্ত লাগছিল সাহিলের।  কঙ্কণাও বেরিয়ে এল।

- কী '?

-এক কথা আর কত শুনব? এঁরাই  সব এখন হর্তাকর্তা বিধাতা তাহলে!

-ওভাবে কেন বলছ?  হর্তা কর্তা হয়ত নন। নামডাক আছে। ওঁদের কথাবার্তা তোমার মত নবীন লেখকের ভালো লাগতে পারে ভেবে তোমাকে আসতে বলেছিলাম- নীলকমলের বাইরে যদি কিছু ভাবতে পারো-

-ভাবতে যে পারছি না- এটা ফ্যাক্ট। আর নীলকমল মানে স্পেসিফিকালি নীলকমলই হতে হবে তা তো নয়- এমন কেউ যে আমাকে কানেকশনের টেকনিক শেখাবে।  এই বক্তৃতা শেখাতে পারবে না- সেটা তো অবভিয়াস-

-আচ্ছা বেশ, এবারে রাগ না করে বলো, সেদিন যে বললে, নীলকমলকে না পেলে তোমার লেখাই হবে না- সেটা কী রাগের কথা ছিল? সিরিয়াসলি বলেছিলে?

-না না রাগ কেন হবে? মে বি  হতাশা -

"লিখবেই না তাহলে? নীলকমলকে পাওয়ার কোনো উপায়ই তো দেখছি না।" কঙ্কণা চুপ করে গেল। সাহিল কিছুক্ষণ ইতস্তত করল , ধোঁয়া ছাড়ল- "-একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম -ইনটু গ্রেট সাইলেন্স। জার্মান ডিরেক্টর। ফ্রান্স, সুইট্জারল্যান্ড আর জার্মানির কো প্রডাকশন ছিল-  ফ্রেঞ্চ আল্পসের একটা মনাস্টারিতে কাথ্যুজীয়ান মঙ্কদের নিয়ে। পুরো ন্যাচারল লাইটে শুট করেছিলেন পরিচালক- একা শুট করেছেন, রেকর্ডিং করেছেন।  আমি অবাক হয়েছিলাম, কেন জান? এই ভদ্রলোক, ফিলিপ গ্রুঁনিং ষোলো বছর অপেক্ষা করেছিলেন মঙ্কদের অনুমতি পেতে। ষোলো বছর! ভাবো।  এতবছর উনি এই ইচ্ছেটা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন- বাঁচিয়ে শুধু নয়, সজীব রাখা-এই ব্যাপারগুলো, জানো খুব ইনস্পিরেশনাল। আমি হয়তো অপেক্ষা করব।"

-শোনো, 'দিন ধরে  একটা কথা মনে হচ্ছে আমার। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, তুমি ভুল জায়গায় অপেক্ষা করছ-

-মানে?

-তুমি যে বাসের জন্য অপেক্ষা করছ, সেই রুটের বাসস্টপে না দাঁড়িয়ে অন্য কোথাও দাঁড়ালে সে বাস তো পাবে না কোনদিন।

-সে তো বুঝলাম। কিন্তু ঠিক কী বলতে চাইছ?

-ধরো তুমি  যদি আমাদের সঙ্গে  থাক- আমরাও তো কানেক্ট করছি- চেষ্টা করি অন্তত- মানছি, আমরা স্ক্র্যাচ থেকে শুরু করি না, খানিকটা ইস্যুভিত্তিক আমাদের কানেকশন- তবু কানেকশনই তো- তুমিও জানো।

-হ্যাঁ তা তো বটেই কিন্তু আমি কী করব?

-কদিন না হয় থাকলে আমাদের সঙ্গে, ঘুরলে , কাজকর্ম দেখলে, হয়ত নীলকমলকে আমাদের মধ্যে থেকে পেয়ে গেলে-

"মাফ করো ভাই, এই দলাদলি, মারামারি, গুণ্ডামি, মাইকের সামনে কান ফাটিয়ে চেঁচানো- আমার কুৎসিত লাগে- তুমি জানো- আমি পারবই না- লেখাই বন্ধ হয়ে যাবে আমার", কপালে হাত ঠেকালো সাহিল।

-জানি।

-তবে বললে কেন?

- র‌্যাফট অফ দ্য মেডুসা পেন্টিং টা ভাবো। তোমার বয়সী একটা ছেলেই তো এঁকেছিল।  মর্গে মর্গে ঘুরেছিল, মুমূর্ষু মানুষ, মৃত মানুষের চামড়ার রং স্টাডি করত-  সবই তো অসুন্দর তাই না? সেসব  থেকে  ছবি -মাস্টারপিস-

সাহিল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কঙ্কণার দিকে-"তুমি আমার মাথা গুলিয়ে দিচ্ছ। হয়ত ঠিক বলছ- কিন্তু ...   জানি না.. আরে ভিজে যাচ্ছো তো, এদিকে সরে এসো।"

কঙ্কণা সরল না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল- “ সাহিল, একটা কথা বলার আছে-“

-কথা বলার অনুমতি চাইছ? ' কী?

-একটা কথা মানে ডিসিশন নিয়েছি-অনেক ভাবলাম, তারপর-

সাহিলের সর্ব শরীর কেঁপে উঠল-"-ক্কী ডিসিশন?"

-আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি-

-মানে ?কোথায়? কী ইয়ার্কি করছ?

-দিল্লিতে একটা স্কলারশিপ পেয়েছি। আপাতত সেটাই নিচ্ছি কয়েক মাসের জন্য। কিন্তু যেটা ঠিক করেছি- ফুলটাইম রাজনীতি করব; তার আগে একটা খুব বড় কাজ- সেটাই বলারপ্রিয়ম, আমি আর শিখা- চেনো তো তুমি- আমরা গোটা ভারত ঘুরব- মানুষের সঙ্গে কথা বলব, থাকব- কানেকশন গড়তে হবে; কতদিন লাগবে জানি না- প্ল্যান করছি  বিরাট করে-হয়তো আরো দু তিন জন  জয়েন করবেন-  তারপর  হয়তো আরো -পথে আমাকে বেরোতেই হবে-

এটা কী তোমাদের পার্টি অ্যাপ্রুভড কর্মসূচী না মোটরসাইকেল ডায়ারিজ ইন্সপায়ার্ড? সাহিল হাসার চেষ্টা করেছিল। গলা বুজে আসছিল অভিমানে - কঙ্কণা এত বড় কথা তাকে না বলে রইল এতদিন!

-সত্যি বলি, তুমি ইন্সপায়ার করেছ- তোমার কানেকশনের টেকনিক শেখার জন্য নীলকমলের খোঁজ করে যাওয়া আমাকে ইন্সপায়ার করেছে- ইন্সপায়ার বললে কিছুই বলা হয় না- আরো বড় কিছু সাহিল-

-কবে চলে যাবে?

-পুজোর পরেই

"এত বড় ডিসিশন নিলে, কিচ্ছু বলো নি আগে!" সাহিলের গলা আবার কেঁপে গেল।

কঙ্কণা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। দুজনেই চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। সিগারেটের ধোঁয়া আর  না বলা কথারা অনেকক্ষণ ঝুলে রইল হাওয়ায়, তারপর বৃষ্টির ছাঁটে ভিজতে ভিজতে মাটিতে পড়ে কাদা হয়ে গেল। দুজনে সে দিকে তাকিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।  কেউ কারো হাত ধরল না, কাছে সরে এলো না; যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সে জায়গা ছেড়ে নড়লনা একচুল। তারপর  আর কোনো কথা না বলে কঙ্কণা হাঁটতে শুরু করল বৃষ্টির মধ্যে-

সাহিল পিছু ডাকে নি। দেখছিল। দেখছিল, জনশূন্য রাস্তার দুদিকের দেওয়ালে বৃষ্টিতে ভেজা দেওয়াল লিখন, আধছেঁড়া পোস্টার, ঝোড়ো হাওয়ায় লটপট করছে ফ্লেক্স , চেন ফ্ল্যাগ ছিঁড়ে গিয়ে  রাস্তায় লুটাচ্ছে - আর  এসবের মধ্যে দিয়ে ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় একটা  মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে সটান

বর্ষা-

 

তন্ময়ের পাঠানো মিম দেখতে দেখতে হাসছিল সনৎ। কনফিডেন্ট ছিল সে - পরীক্ষার আগের রাতে সারাবছর পড়াশোনা করা ছাত্র যেমন রাত না জেগে ঘুমিয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে,  সনৎএর মুড আজ সেই রকম- রাগের বদলে মজা পাচ্ছিল । শেষ রাতে চন্দ্রযান লঞ্চিং - সনৎ দুদিন ছুটি নিয়েছে ; সারাদিন  ঘুমিয়ে নেবে  তারপর অ্যালার্ম দিয়ে উঠে টিভি খুলবে। লঞ্চ হয়ে গেলে আবার ঘুমোবে বেলা অবধি। মন্টুর মাকে ছুটি দিয়ে দিল সনৎ- বিকেলে আর আসতে হবে না- মোড়ের মাথার দোকানে ফোন করে রুটি আনিয়ে নেবে। মন্টুর মাকে অখুশি দেখাচ্ছিল এই ব্যবস্থাপনায় - গজগজ করতে করতে চলে গেল। খালি বাড়িতে  মহালয়ার আগের রাতের মত একটা ফীলিং হল সনৎএর - দুপুরে খেয়ে দেয়ে  ঘুমোতে  যাচ্ছিল  যেন যা চন্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী শুনে ঘুম ভাঙবে, যেন সে শৈশবে ফিরে গেছে, ঘুম থেকে উঠে মহালয়া, আর তারপরই পুজোর ছুটি। মোবাইলে, টেবিলের ঘড়িতে পাঁচ মিনিট পর পর অ্যালার্ম দিল । তন্ময়  মিম পাঠাচ্ছিল নানারকম- টুং টাং আওয়াজ হয়েই চলছিল। তন্ময়কে মিউট করে জল খেলো সনৎ। আধখানা ঘুমের ওষুধ মুখে দিল সঙ্গে।  জানলা দিয়ে দিনের আলো আসছিল ঘরে, পাল্লা বন্ধ করতে গিয়ে পুকুরের দিকে তাকালো  সনৎ। হলুদ বাড়িটা, সবুজ রঙের জানলা , কতদিনের পুরোনো পুকুর- ঠাকুমা বলত পুষ্করিণী। লম্বা লম্বা ঘাসের মধ্যে  একটা  ডাহুক ঘুরে বেড়াচ্ছে একলা-  কী যেন খুঁজছে।  বর্ষার জল পড়তেই  ঘাস যেন তলোয়ারের ফলা, আগাছায় আগাছায় ছেয়ে গেছে মাটি, আবার জঙ্গলের মত দেখাচ্ছে পুকুরের চারপাশ।  মাথায় গামছা বেঁধে ঘাস ছাঁটছিল, আগাছা পরিষ্কার করছিল ক্ষিতীশ-

আজকাল সেতার শোনা যায়  হলুদ বাড়ি থেকে- আজও বাজছিল। লয় বাড়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল সনৎ । ওর বোজা চোখের মণি দ্রুত নড়ছিল- এবড়োখেবড়ো জমিতে একটা বাচ্চাকে খেলতে দেখছিল সে , প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি পড়ে যাবে, অথচ বারে বারেই  টাল সামলে নিচ্ছিল বাচ্চাটা আর সনৎ হাত বাড়িয়ে  ডাকছিল- প্রজ্ঞান, প্রজ্ঞান। বাচ্চাটা  হোঁচট খেল না কী খিলখিলিয়ে হেসে  উঠল! জেগে গেল সনৎ- দুটো অ্যালার্মই বাজছে। তড়াক করে উঠে টিভি চালালো। ডাইরেক্ট টেলিকাস্ট শুরু হয়ে  যাওয়ার কথা অথচ মীরার ভজন হয়ে চলেছে একের পরে এক। সনৎএর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল- তবে কী লঞ্চ  হয়ে গেছে? সে সময় ভুল করল ? মিস করল? সনৎ চ্যানেল বদলাতে শুরু করল- কোথাও গান হচ্ছিল, কোথাও সিনেমা, কোনো চ্যানেলে স্ক্রীন সম্পূর্ণ কালো হয়ে থাকছিল, কোথাও দীর্ঘাঙ্গী মেয়েরা হাঁটছিল র‌্যাম্প বরাবর। পুরোনো চ্যানেলে ফিরে এলো  সনৎ-  যেখানে ভজন হচ্ছে । এবারে স্ক্রীনের তলায় নিউজ টিকার খেয়াল করল - ফুয়েল লীকেজের কারণে বাহুবলী জি এস এল ভি থ্রী র  লঞ্চিং স্থগিত। সে চেঁচিয়ে উঠে মোবাইল ছুঁড়ল টিভির স্ক্রীনে -  মুখ ফাটিয়ে দিল গায়িকার।

সকালে মন্টুর মা গজগজ করতে করতে ঘরদোর পরিষ্কার করছিল আর সনৎ জি এস এল ভি থ্রীর লিকুইড প্রপেল্যান্ট চেম্বারের ও রিংএর কথা  ভাবছিল । ফুয়েল লীকের সমস্যা বুঝতে রাত থেকেই ইসরোর সাইট তন্ন তন্ন  করে পড়েছে,  গুগল করেছে তেড়ে; এই মুহূর্তে  সায়েন্স না পড়ার জন্য আপশোষ হচ্ছিল - যেন সায়েন্স নিয়ে পড়লেই ,  দৌড়ে গিয়ে সে সারিয়ে দিতে পারত ও রিং,  জি এস এল ভির লিকুইড প্রপেল্যান্ট চেম্বারে বাষ্প তৈরি হত তখন, প্রেসার বাড়ত, শুরু হত কাউন্টডাউন - আর সনৎএর  চোখের সামনে চোদ্দোতলা বাড়ির মত উঁচু  বাহুবলী আকাশ ফুঁড়ে উঠে যেত । অফিসে কাল তন্ময় কী বলবে  ভাবতেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল- অলরেডি মিম পাঠাতে শুরু করেছে। কার সঙ্গে ও রিংএর ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যায় এখন?  মিঠুর কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে একবার?  সনৎ ছাদে গেল,  দু পাক হেঁটে নিচে নেমে এল ,  আবার ছাদে গেল, আবার নামল,  ইসরোর সাইট রিফ্রেশ করল বারবার। হলুদ বাড়িতে আজও  সেতার বাজছিল-  জানলায় গিয়ে দাঁড়ালো সনৎ।  পুকুরপাড় তকতকে দেখাচ্ছে এখন- ঘুরে ঘুরে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়াচ্ছে ক্ষিতীশ।

ঠিক আটদিন পরের এক দুপুরে জিওসিনক্রোনাস স্যটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল মার্ক থ্রী শ্রীহরিকোটা  থেকে লঞ্চ করেছিল। এক মাস পরে চন্দ্রযান লুনার অরবিটে ঢুকবে। নতুন টিভি কিনল  সনৎ , রামকৃষ্ণ ইলেকট্রিকের বাপিকে ফোন করে  টুনি বাল্বের অর্ডার দিল- সমস্ত বাড়ি আলো দিয়ে সাজাবে।

~*~

সাহেবগলিতে ছাতা মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল স্মিতা। শেষ রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। এখন টানা তিনদিন এ'রকম চলবে- ফোরকাস্ট রয়েছে। গত সপ্তাহের আবহাওয়া এরকমই ছিল- আলিপুর থেকে বলেছিল- নিম্নচাপ। এই বর্ষায় বাড়ির পুকুর জলে টইটম্বুর হয়ে আছে। কখনও পুকুর উপচে যেতে দেখে নি স্মিতা। কাল সারাদিন বৃষ্টি হয় নি। কিন্তু ভোর রাতে এমন বৃষ্টি এল,  যে ওর মনে হচ্ছিল, এইবারে পুকুর ভরে গিয়ে জল উপচে আসবে ঘাটের সিঁড়িতে; জল বাড়তে  বাড়তে ঘাট পেরিয়ে বাগানে উঠবে তারপর এ বাড়ির দোরগোড়া ছুঁয়ে ফেলবে। পুকুরের জলের সঙ্গে  কিছু শ্যাওলা, এমনকি মাছ টাছও খলবল করে উঠে আসবে দরজার সামনে, হয়ত জলঢোঁড়াও। কিন্তু হেঁটমুণ্ড হয়ে যে শহর লুকিয়ে রয়েছে জলের তলায়, সে কি ভেসে আসবে স্মিতার বারান্দার সামনে? যা লুকিয়ে থাকতে চায়, আধার উপচে পড়লে, তা হয়ত আরো গভীরে সরে যায়, ক্রমশ অগম হয়ে যেতে থাকে।  সমস্ত জল শুষে নিয়ে পুকুরকে একদম খটখটে শুকনো করে দিলে, সে শহর মাটির তলায়  সেঁধিয়ে যাবে নির্ঘাৎ - সটান পাতালে চলে যাবে হয়ত। 

স্মিতা এই অঞ্চলের পথঘাট চেনে না। ধনঞ্জয়কে সঙ্গে নেবে ভেবেছিল একবার; পায়েলও বলছিল- "এই বৃষ্টিতে যেও না দিদি।" শেষ অবধি একলাই বেরোলো - একটা ট্যাক্সি নিয়ে সটান সাহেবগলি।  ধনঞ্জয় বলেছিল, "গলির ভেতরে একটা পোস্টাফিস আছে, ভাই বলছিল- ওখানে জিজ্ঞেস করলে কিছু জানা যেতে পারে।"   ক্লাস সেভেন এইট  অবধি পঙ্কজরা এ'পাড়ার ভাড়া বাড়িতে, তারপর  শহর বদলেছিল-  স্মিতা এইটুকুই জানে। আজ  এই বৃষ্টিতে অচেনা গলিঘুঁজিতে এলোপাথাড়ি ঘুরে সে পঙ্কজের অতীতকে খুঁজে পাবে না- নিজেও বোঝে । তবু সে সাহেবগলিতে আসার ডিসিশন নেয় গতরাতে।

রাতে খাওয়া সেরে স্মিতা দোতলায় উঠছিল; জেম্মার ঘর থেকে পায়েল ছুটে বেরোল- "দিদি, দেখে যাও একবারটি।" পায়েলের চোখ মুখ আনন্দময়- যেন খুব সুন্দর স্বপ্ন দেখে সদ্য জেগে উঠেছে,  যেন এখনও স্বপ্নের ঘোরে।

-কী রে?

-দেখই না এসে।

জেম্মার ঘরের দুটো জানলা খুলে দিয়েছিল পায়েল ,"ঐ দেখো"।

স্মিতা আশ্চর্য হয়ে দেখল ওদের গলি বদলে গেছে। দেখল , শিখাজেঠিদের বাড়ির বারান্দার রেলিঙ জুড়ে টুনি বাল্ব রং বদলাচ্ছে- লাল থেকে নীল হয়ে সবুজ হয়ে যাচ্ছে আবার লালে ফিরছে । বাড়ির ছাদ থেকে কার্নিশ অবধি উল্লম্ব আলোর মালা দোল খাচ্ছে।  জেম্মার একতলার জানলা থেকে যতখানি দেখতে পাচ্ছিল স্মিতা, তাতে মনে হচ্ছিল, ছাদের ওপর লাল রঙের একটা ফাঁপা চোঙ, তার ওপর গম্বুজ গোছের কিছু-তার ভিতরে আলো জ্বলছে-

-ওটা কী রে পায়েল?

-রকেট দিদি রকেট- ঐ যে চাঁদে যাবে না!

সন্ধ্যে হলেই বিশেষ করে এই বর্ষায় আলো মরে গেলেই গলিতে ছ্যাতলা পড়ে যায়,  অন্ধকার রাস্তায় প্লাস্টিকের ঘেরাটোপে রিকসা, রুটের অটো চলে ফেরে, রাস্তার আলো তলায় তাদের একটানা চলন্ত ছায়া গলিকে আরো মলিন করে।  আজ শিখাজেঠিদের বারান্দার লাল নীল সবুজ আলো  নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নিবু নিবু হয়ে  ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হচ্ছিল, ঝিকমিক করছিল তারপর- সেই কালক্রমের উজ্জ্বলতম মুহূর্তে গলিতে আলোর বান ডাকছিল;  ভেজা হাওয়ায় আলোর মালা দোল খাচ্ছিল -  যেন এক সহস্রবুটি শাড়ি -ছাদ থেকে ঝুলিয়ে  দেওয়া-  অনুকূল হাওয়া পেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠে নৌকোর পাল হয়ে যাচ্ছে।  স্মিতাদের চোখের সামনে শিখাজেঠিদের আদ্যিকালের বাড়ি একটা আলো দিয়ে সাজানো বজরা হয়ে  গেল,  এক বহমান আলোর নদী হয়ে গেল  ওদের গলি। ধনঞ্জয় বলছিল - শিখাজেঠির ছেলে সমস্ত দিন ধরে বাড়ি সাজিয়েছে - একমাস ধরে এই আলো জ্বলবে। পায়েল আর ধনঞ্জয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আলো দেখছিল। স্বামী স্ত্রীর মুগ্ধ চোখে আলোর নদীর প্রতিফলন দেখল স্মিতা। পায়েলও খেয়াল করছিল , দিদিকে অন্যরকম দেখাচ্ছে । বস্তুত স্মিতা পঙ্কজকে পেতে চাইছিল সেই মুহূর্তে -উৎসবের রাতে আলো দেখতে বেরিয়ে মানুষ তার প্রিয়জনের হাত ধরে। স্মিতা পঙ্কজের হাত ধরতে চাইছিল খুব।মুহূর্তের  আবেগ ওকে বিহ্বল করেছিল -চোখে জল আসছিল বারবার। রাতে জানলা খুলে শুয়েছিল স্মিতা। শিখাজেঠির বারান্দায় টুনি বাল্বের জ্বলা নেভা দেখতে দেখতে সাহেবগলি যাওয়ার ডিসিশন নিল তখনই।

সাহেবগলিতে ঢোকার মুখে  নীল রঙের টিনের পাতের ওপর রাস্তার নাম লেখা হয়েছিল সে কোন কালে- খুব খেয়াল করলে লেখাটুকু এখনও  পড়া যায়। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল স্মিতা।  গলির মুখে  সাধারণ দোকানপাট- মিষ্টির দোকান, মনিহারি স্টোর্স, ফার্মেসি, ডেকরেটারের অফিস;  সামনের ওষুধের দোকানে জল কিনতে ঢুকল স্মিতা, ট্যাক্সিতে জলের বোতল ফেলে এসেছে; একবার ভাবল  পোস্টাপিসের অবস্থান এখানে জিজ্ঞাসা করে নেয়। পর মুহূর্তেই মত বদলে সে তার প্রশ্ন গিলে ফেলে,  জলের বোতল কিনে রাস্তায় নামে এবং মিনিট দশের মধ্যেই বুঝতে পারে এ গলির পেটে পেটে কত প্যাঁচ। দিক গুলিয়ে যাচ্ছিল স্মিতার; ল্যান্ডমার্ক ধরে এগোনো চেষ্টা করছিল সে- বাঁয়ে ওষুধের দোকান রেখে ডানদিকের শাখাগলিতে এক চক্কর ঘুরে বেরিয়ে এলে ওষুধের দোকান তার ডাইনে থাকার কথা- অথচ ঠিক উল্টোটাই ঘটছিল। আবার গলির এক নম্বর বাঁকে যে পানের দোকান দেখেছিল, সেই একই  দোকান দেখল তিন নম্বর বাঁকে- স্মিতা হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর  একই দোকান -  সরু গোঁফ ওলা দোকানী যত্ন করে এক বর্ষাতি পরা বাইক আরোহীকে পান সেজে দিচ্ছিল । যে একটেরে বই খাতার দোকান চোখে পড়েছিল কিছুক্ষণ আগেই, তাকে আর এখন খুঁজে পাচ্ছে না স্মিতা। জমা জল ঠাহর করতেও অসুবিধে হচ্ছিল ওর। শুকনো জায়গা ভেবে ফুটপাথ থেকে গলিতে পা রাখতেই গোড়ালি অবধি ডুবে গেল বার দুয়েক, তারপর হাল ছেড়ে ছপছপ করে হাঁটতে শুরু করল। একটিই হুডতোলা রিক্সা ওর গা ঘেঁষে গেল কতবার গেল আর এল - যেন সওয়ারি নামিয়ে বড় রাস্তার মুখে যাচ্ছে, নতুন সওয়ারি নিয়ে আবার গলিতে ঢুকছে। স্মিতার মনে হল একই রিক্সা, একই চালক- টেনে টেনে প্যাডেল করছে, হুডের পিছনে দুটো গোলাপ আর ভিদ্যা বালনের ছবি। স্মিতা ভাবল, সওয়ারি নামিয়ে রিক্সা ফিরে এলে, রিক্সাওলাকেই বলবে পোস্টাপিসে নিয়ে যেতে। স্মিতা  দাঁড়িয়ে পড়ল। অথচ এবারে রিক্সার ফিরতে বিস্তর দেরি হচ্ছে। 

বৃষ্টি বাড়ছিল। ছাঁটে ভিজে যাচ্ছিল স্মিতা। হাওয়ার এমন জোর যে ছাতা ধরে রাখাই মুশকিল। আকাশ ঘোর কালো, আর একটাও মেঘের পুঁটলিকে রাখার জায়গা নেই যেন। এই বিকেলেই রাস্তার আলো জ্বলে উঠছিল। সেই সব কমজোরি আলো জমা জলে রিফ্লেক্ট করছিল। স্মিতা ভাবল, ওষুধের দোকানে ফিরে গিয়ে পোস্টাপিসের সুলুক সন্ধান নেয়। সে বাঁদিকে তাকালো, তারপর ডানদিকে- একটা ব্যায়াম সমিতির বোর্ড চোখে পড়ল শুধু , আর এদিকে একটা শিরীষ আর একটা নিম। । স্মিতার ভয় করে উঠল হঠাৎ- এ গলি যেন একে একে সমস্ত অভিজ্ঞান গিলে নিচ্ছে। পঙ্কজের অতীতের কাছে পৌঁছোনোর কোনো উপায়ই রাখছে না। এদিকে  তীরের ফলার মত বৃষ্টি নামছিল আকাশ থেকে, সাহেবগলির ইঁট, খোয়া, পাথরকুচিতে ঠোক্কর খেয়ে গুঁড়ো  গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিল প্রতিটি জলবিন্দু, স্মিতাকে ঘিরে ধরছিল- যেন প্রতিটি বিন্দুরই পঙ্কজকে নিয়ে স্মিতাকে কিছু বলার আছে, যেন স্মিতাকে ওরা পঙ্কজের অতীত না জেনে ফিরতে বাধা দিচ্ছে।  স্মিতার মাথায়  বৃষ্টি, কাঁধে বৃষ্টি, শরীরে বৃষ্টি, হাঁটু অবধি ঘিরে নিচ্ছে বৃষ্টি-

মানুষ এসব গূঢ় বার্তা কবেই বা বুঝেছে।  স্মিতা ফোন করে উবের ডাকল- ফিরে যাবে। অসহায় লাগছিল। নিজেকে নির্বোধ মনে হচ্ছিল- পঁচিশ বছর ধরে যা তার কাছে গোপন, এক বিকেলে সে সবই জেনে যাবে- এই চিন্তা এখন মূর্খামি মনে হচ্ছে। আবার কখনও  এই  বৃষ্টিকে দায়ী করছিল সে, যেন রৌদ্রবহুল দিনে এলেই সাহেবগলির দু ধারে পঙ্কজের অতীত শুকোতে দেওয়া দেখতে পেত-

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শরৎ-১

 

সকাল হতেই মিঠু ছাদে চলে আসে। অ্যালার্ম দিয়ে ভোরে উঠছে আজকাল, হাল্কা স্ট্রেচিং করে নেয় প্রথমে। ও ঘুম থেকে উঠলেই কুন্তী আর গুলগুলে চোখ পিটপিট করে, আড়মোড়া ভাঙতে থাকে। মিঠু বাথরুম ঘুরে এসে বিছানা পরিপাটি করে, রাতের বিনুনী খুলে চুল আঁচড়ায়, এলো খোঁপা বাঁধে। তারপর ছাদে চলে যায়।  মিউ মিউ করে কুন্তী পিছু নেয়। গুলগুলে আরো দু দফা গা মোড়ামুড়ি করে সিঁড়ি ভাঙে। মিঠুদের ছাদে  জলের ট্যাংক, আর গোটা দশ ফুলের টব;  কাপড় মেলার দড়িতে ভেজা শাড়ি, পাজামা, নাইটি আর পেগক্লিপ ঝুলে আছে। আগে এই ছাদ থেকে অনেক দূর দেখা যেত, এমনকি ট্রেনের আওয়াজ শুনেছে মিঠু, নারকেল গাছের আড়ালে ট্রেনের এক ঝলক দেখাও গেছে ছোটোবেলায়। এখন চারদিকেই ফ্ল্যাটবাড়ি মাথা তুলেছে - ওদের ছোটো ছাদের দিকে ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে রয়েছে সারাক্ষণ। ট্যাংকের কল খুলে মিঠু ছোটো বালতিতে জল ভরে,  হাতল ভাঙা মগে এ টবে, ও টবে জল  দেয়; ছোটো বড় টবে  মরসুমি ফুল, জবা, আর ক্যাকটাস। লঙ্কা গাছ ছিল- শুকিয়ে গেল গত বছর। জল দিতে দিতে হাঁফায় মিঠু , ছাদের পাঁচিল ধরে দাঁড়িয়ে গলির দিকে তাকিয়ে বড় শ্বাস ফেলে। শমিতাদির কথা ভাবে, তারপর আলতো করে জল ঢালে ডালিয়া চারার গোড়ায়। 

কলেজের শমিতাদির ক্যান্সার ধরা পড়েছিল বছর পাঁচেক আগে; মিঠুকে নিয়ে এখন যেমন হা হুতাশ শুরু হয়েছে সর্বত্র, সেই সময় শমিতাদিকে নিয়েও একই অবস্থা। শমিতাদি ছুটিতে, কেমো নিচ্ছে, আর স্টাফরুমে রোহিনী বলছে- "ভাবতেই পারছি না", সংযুক্তা মাথা নাড়তে নাড়তে চোখ মুছছে, দিব্যেন্দু নাটকীয়ভাবে গলা তুলেছে,  "কেন কেন কেন হোয়াই?"। শমিতাদি কলেজ জয়েন করল বছর ঘুরতেই- মাথায় স্কার্ফ;  চিকিৎসায় কাজ হচ্ছে, সাবধানে থাকতে হবে- এই যা; এখন তো পুরো সুস্থ- পুজোতে নৈনিতাল বেড়াতে যাওয়ার কথা। আজকাল  মিঠুকে রোজই ফোন করে ,  নিজের গল্প বলে। একটা  কথাই  বারবার বলে- " মনের জোর হারাস না, ওটাই সব।" শমিতাদি ফোন করলে মিঠুর ভালো লাগে।  শমিতাদিই ওকে একটা রুটিন মেনে চলতে বলেছে- " এখন কলেজ নেই বলে বেলা অবধি শুয়ে থাকবি না। সকালে উঠবি, হাল্কা কাজকর্ম করবি ঘড়ি ধরে।"  সকালে বিকালে ছাদে হাঁটা, টবে জল দেওয়া মিঠুর রুটিনে ঢুকে গেল এইভাবে।

শরতের  আকাশে যথারীতি হাল্কা নীলের  উজ্জ্বলতম শেড সকালের দিকে- ত্যারছা রোদ এসে জবার টবে পড়েছে আপাতত, ঘুরে ঘুরে অন্য গাছের কাছে যাবে বেলা বাড়লে। এই একফালি রোদটুকু যেন মিঠুর ডাস্টার- যেন ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ডে বড় করে লেখা আছে ক্যান্সার, লেখা আছে মৃত্যু, হাড়গোড়, নরকঙ্কাল এই সব আঁকা রয়েছে যেন- দুষ্টু ছাত্ররা যেমন শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে বোর্ডে আকথা কুকথা লেখে- কোনো শিক্ষক রিয়াক্ট করেন, কেউ নির্লিপ্ত মুখে মুছে দেন, যেন কিছুই হয় নি- সকালের এই রোদ, এই নীল রং হাতে নিয়ে মিঠু  সব মুছে দেয়, নতুন কিছু লিখবে বলে চক নেয় হাতে; রোদ চড়া হলে ছাদের দরজা বন্ধ করে নিচে নামে। সিঁড়িতে ওর চটির শব্দ হতেই ছন্দা এসে ল্যান্ডিংএ দাঁড়ায়, তারপর মিঠু শেষ ধাপে পৌঁছলে, ওর দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে  তাকায়।  ছন্দার চোখে  বিষণ্ণতা আর টেনশন চিরকালই, এখন সে' চাহনিতে ভয়কে খুঁজে পাওয়া যাবে খুব সহজে। ইদানিং মা'র চোখে চোখ রাখলে প্রবল শোককেও চিনতে পারে মিঠু- সে যে তার মায়ের সামনে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে, ছন্দা যেন তা বিস্মৃত হয় ;  ওর মনে হয়, ছন্দা যেন সিঁড়ির  ধাপের নিচে দাঁড়িয়ে ঘোলা চোখে মিঠুর শব দেখছে।

সকালের এই সময়টা বিপ্লব বাড়ি থাকছে না আজকাল- আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে যায় একটা ব্যাগ নিয়ে। দুপুরে ফেরে। "গঙ্গাস্নান করি, ভাল লাগে" -বিপ্লব নিজেই এক্সপ্ল্যানেশন দিয়েছিল।  স্পষ্টতই মামুর আচমকা এই গঙ্গাস্নানের বাসনার কারণ অবভিয়াস মনে হয়েছে- শমিতাদির কট্টর নাস্তিক স্বামী পুত্রকে মন্দিরে, দরগায় মাথা কুটতে দেখেছে মিঠু।  বিপ্লব টুম্পাকে সকালের বাজারের দায়িত্ব দিয়েছে অনেকদিন।  ছন্দার এই নিয়ে চেঁচামেঁচি করা স্বাভাবিক ছিল - অথচ বিপ্লব, তার গঙ্গাস্নান, সকালের বাজার নিয়ে আগাগোড়া উদাসীন ছন্দা ; যেন  সে  ঝড়ের রাতে প্রদীপ নিয়ে বেরিয়েছে, দু হাতের চেটো দিয়ে আড়াল করে আছে  শিখাকে - হাওয়ার ঝাপ্টা আসছে,  সে গতি কমাচ্ছে ঈষৎ, তারপর হাতের পাতা আরো ঘন করে গুটিয়ে আনছে , আবার গতি বাড়াচ্ছে, একমনে হাঁটছে- আর কোনো দিকে মন নেই তার।

শরতের রোদ জবার টবের ডানদিকে ক্যাকটাসের রোয়াঁয়  পড়েছে এখন। গুলগুলে আর কুন্তীকে নিয়ে মিঠু নিচে নামল। আজ ওর সেকন্ড কেমোর দিন। আজ বেরোনোর আগে,  বিপ্লব বলেছিল," হাসপাতালে যাওয়ার সময় টুম্পা তোমাদের ট্যাক্সি ডেকে দেবে। সেরকম মনে করলে আজ টুম্পাকে সঙ্গে নিও। আমার ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।"  ছন্দা চোয়াল শক্ত করে রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিল। 

~*~

তিনতলা সাদা ইয়ট বেলুন, আলো, ফুলে মালায় সেজে গঙ্গার  ঘাটে দাঁড়িয়ে। লাগোয়া অ্যামিউজমেন্ট পার্ক।  নদীর পাড় ধরে টানা রাস্তা, মানুষজন বেঞ্চে বসে জল দেখছে। ছবি তুলছে। সেলফির জন্য পোজ দিচ্ছে। সার দিয়ে বাহারি লাইট পোস্ট - রাত হওয়ার অপেক্ষায়।  ইয়টের একতলা আর দোতলার ডেকে হৈ হৈ করছে লোকজন। বাচ্চারা সিঁড়ি দিয়ে উঠছে নামছে,  মাথা ঝুঁকিয়ে জল দেখছে কেউ। গান চলছে। নাচও। লোকজনের আসা যাওয়া । দুপুরের আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসে গঙ্গার জল আরও ঘোলাটে এবং কালচে। হাওয়া রয়েছে। ছোটো ছোটো ঢেউ ইয়টের গা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে- কোলাহল বন্ধ হলে তার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাবে ডেক থেকে। দোতলার ডেক পেরিয়ে ডানদিকের  ঘেরা জায়্গায় সোফা, ঢাউস টেবলে তিন লেয়ার চকোলেট , ক্রীম ঠাসা কেক - আইসিং করে হ্যাপি বার্থডে লেখা।

পার্কের অন্যদিকে আরও তিনজনের সঙ্গে বিপ্লব একটা ছোটো নৌকায় উঠছিল। তিনজনেরই লাল টি শার্ট- হলুদ রং  দিয়ে তাতে অ্যাবরাকাড্যাবরা লেখা। সঙ্গে নানাবিধ সরঞ্জাম- দড়ি, শিকল,  চৌকো ধাতব রেলিং;  নৌকা টলমল করে উঠে স্থির হল। বিপ্লবকে আজ  রাজার মত দেখাচ্ছে- নীল পালক লাগানো ঊষ্ণীষ, সিল্কের চোস্ত পাঞ্জাবিতে জরির কাজ, চড়া মেকাপে বয়স ঢাকা পড়েছে- কুচকুচে কালো চুল, পাকানো গোঁফ। নৌকায় উঠে বড় করে নিঃশ্বাস নিল বিপ্লব, বুক টান করে দাঁড়ালো । নৌকা ছেড়ে দিয়েছিল-  ইয়টের কাছাকাছি গিয়ে থামবে। বার্থডে স্পেশাল হুডিনি ট্রিক বিকেল পাঁচটায়- ফ্লেক্স ঝুলছিল ইয়টে, ডেকের রেলিংএর পাশে একে একে জমা হচ্ছিল সবাই।  ছোটো নৌকায় একনম্বর লাল শার্ট  হ্যান্ড মাইক টেস্ট করছিল।  লাল শার্ট- নাম্বার টু  চারটে আলাদা  ধাতব অংশ জুড়ে জুড়ে খাঁচা তৈরি করে ফেলল। বিপ্লবের পায়ে শিকল জড়িয়ে তালা লাগাচ্ছিল তৃতীয়জন- জোলো বাতাসের ঝাপটা মুখে লাগল- শিরশির করল শরীর, দুহাতের চেটো ঘষে নিল। বিপ্লব কনসেন্ট্রেট করার চেষ্টা করছিল-  শিকল বেঁধে খাঁচার মধ্যে স্টান্ট দেখায় নি কোনদিন;  ওর হাতে পায়ে দড়ি বাঁধত  মাণিক, বিপ্লবের সেই সময়ের চেলা -হাতে ধরে দড়িতে গিঁট বাঁধার বিবিধ কৌশল শিখিয়েছিল বিপ্লবই।  হুডিনি নট ব্যবহার করত মাণিক - তারপর বিপ্লবকে বস্তায় ঢুকিয়ে  জলে ফেলে দিত। বাকিটা দম ধরে রাখার খেলা - জলের নিচে শ্বাস বন্ধ রেখে বিপ্লব দ্রুত খুলে ফেলত হাত পায়ের বাঁধনের গিঁট। ছোটো ছুরি গোঁজা থাকত কোমরে- বস্তার মুখ কেটে বেরিয়ে আসত এক দমে। ইদানিং মাণিক সবজির  ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলত;  বিবিধ হুল্লোড়ের পার্টিতে না কি স্টান্ট শোর ডিম্যান্ড বাড়ছে- মাণিক খোঁজখবর রাখতে শুরু করেছিল। নিজস্ব একটা ব্যবসা শুরু করার জন্য বিপ্লবকে খোঁচাত অহরহ; বস্তুত, আবার সেই সব বিপজ্জনক দিনে ফিরে যেতে চাইছিল মাণিক। তিনটে কম্পানির ঠিকানা  মাণিকের খাতা খুঁজে পেয়ে যায় বিপ্লব- টুম্পা হেল্প করেছিল যথেষ্ট।  অ্যাবরাক্যাড্যাবরা কম্পানি জলের তলায় স্টান্ট দেখানোর জন্য রীতিমত ট্রেনড লোক খুঁজছিল হন্যে হয়ে- ভালো টাকা দেবে। বিপ্লব  ওর পুরোনো কিছু ছবি, খবরের কাগজের কাটিং, সার্টিফিকেট দেখাতে কাজটা হয়ে যায় ; কম্পানির মালিক, চোখ  নাচিয়ে বলেছিল- "বস্তা , দড়ি দিয়ে খেলা দেখিয়েছেন যখন, নকল তালা বেঁধে স্টান্ট তো আপনার কাছে নস্যি মশাই। বয়স কোনো ব্যাপারই না। মনোহর আইচ এই সেদিন অবধি ...আসল কথা হল দম রাখতে পারবেন কী না- ঐ টা আমরা একটু দেখে নেব। বড় অসুখ টসুখ হয় নি তো রিসেন্টলি?"

এরপর এক নম্বর আর দু'নম্বর লাল শার্ট ট্রেনিং দিয়েছিল বিপ্লবকে-  লুকোনো বোতামে হাত বাঁধা অবস্থাতেও কীভাবে চাপ দিতে হয়, প্রথমে হাতের তারপর পায়ের তালা খুলে খাঁচার নিচ দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়,  এই সবের কায়দাকানুন। গঙ্গায় প্র‌্যাকটিস করাচ্ছিল  টানা।  জলের তলায় দম রাখার ব্যাপারে কনফিডেন্ট ছিল বিপ্লব। মাইক টেস্টিং শেষ করে এক নম্বর লাল শার্ট চোঙা  ফুঁকে হাঁকল - "গুড আফটারনুন লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, বয়েজ অ্যান্ড গার্লস...."

~*~

টুম্পা ট্যাক্সি ডেকে এনেছে বড় রাস্তা থেকে। ছন্দা রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে। মিঠু বাথরুম থেকে বেরোলেই ট্যাক্সিতে উঠবে।

-আমি সঙ্গে যাই, মাসি? দিদির শরীর হঠাৎ খারাপ করলে , তুমি একা ট্যাক্সি নিয়ে আসতে পারবে?

- না পারার কী আছে? হাসপাতালের  সামনেই ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। তুই বরং এখানেই থাক, বাড়ি যাস না। স্নান করে খেয়ে নে।  আমরা ফেরার আগে যদি তোর মামা আসে, খেতে দিয়ে দিস। না খেয়ে বেরোলো  কোন সকালে।

-আচ্ছা, মাসি, তুমি ভেবো না একদম।

মিঠু বাথরুম থেকে বেরিয়ে চটি পরছিল - তিনদিন হ'ল পায়ের পাতা ফুলে রয়েছে- চটি গলাতে সময় লাগছে। ল্যান্ডলাইনে ফোন বাজল তখনই। "টুম্পা, ফোন ধরে বল আমরা বেরিয়ে গেছি", ছন্দা চেঁচিয়ে বলেছিল। মিঠু তার আগেই রিসিভার তুলল --"হ্যালো"।

"মিঠু, মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিস কেন? চিন্তায় মরে যাচ্ছি আমরা। কত কাঠখড় পুড়িয়ে ল্যান্ডলাইনের নম্বর পেলাম অতসীর কাছ থেকে"- গার্গী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল-

-একটু বেরোচ্ছি। পরে কথা বলব রে।

-কোথায় বেরোচ্ছিস এখন? তোর অসুখের কথা শুনলাম।  এ কী হল, মিঠু?

-অসুখ হয়েছে, সেরে যাবে। চিন্তা করিস না।  রাখি এখন। কেমো নিতে যাচ্ছি-

" কেমো"?  এমন আঁতকে উঠল গার্গী যেন কোনো চিকিৎসাবিভ্রাটের কথা শুনেছে। আরো তারস্বরে অ্যাড করল, "ওরে বাবা! কেমো নিলে সব চুল টুল পড়ে যায় । মিঠু তোর এত সুন্দর চুল।“

-চুলই তো, আবার গজাবে। রাখি রে-

- শোন শোন, কার সঙ্গে যাচ্ছিস? বর ফিরেছে ট্যুর থেকে?

“হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই তো যাচ্ছি। লম্বা ছুটি নিয়েছে ..” গার্গীর ইয়র্কারকে হাফ ভলিতে মাঠের বাইরে ফেলে ট্যাক্সিতে উঠল মিঠু।

~*~

হাওড়া ব্রিজকে পিছনে রেখে বিপ্লব এখন খাঁচার মধ্যে সটান দাঁড়িয়ে। ইয়টের সমস্ত দর্শকের চোখ এখন ওর দিকে- হাতে হাতে মোবাইল,  ভিডিও উঠছে। এক নম্বর লালশার্ট হ্যান্ড মাইকে অবিশ্রান্ত বকে যাচ্ছিল-  কম্পানির বিজ্ঞাপন , এ'খেলার ইতিহাস, চটকদার সব  লাইন, মাঝে মাঝে দু কলি গান গুঁজে দিচ্ছিল। বিপ্লবকে কলকাতার হুডিনি বলছিল লালশার্ট- এক। বাকি দুই লালশার্ট কপিকল দিয়ে খাঁচা নামিয়ে দিচ্ছিল গঙ্গায়।হিসেব করা সময়ের পরে শূন্য খাঁচা তুলে আনবে আর স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী, এক নম্বর লাল শার্টের কাজ তখন,  ঐ মুহূর্তকে নাটকীয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দেওয়ার- সে সব রিহার্স করাই আছে। হাততালিতে ফেটে পড়ছিল কলকাতা। বুক টান করে জলের তলায় নেমে যাচ্ছিল বিপ্লব - যেন উঠে আসবে মিঠুর জন্য বিশল্যকরণী নিয়ে;  বড় করে শ্বাস নিয়ে দম বন্ধ করল নাক ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে - হই হই করে উঠল শহর। গঙ্গার ওপরে কৌতূহলী বিকেলের আলো মেঘ সামান্য ফাঁক করে মুখ বাড়ালো এই সময়।

~*~

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি পেয়ে গেল মিঠুরা। বাইপাস পেরোচ্ছে এখন। গা হেলিয়ে বসেছিল মিঠু। অবসন্ন। চোখ বুজে আসছিল ওর।

-শরীর খারাপ লাগছে, মিঠু?

-মামু এলো না কেন আজ?

-কী সব কাজ আছে, ব্যাঙ্কে যেতে হবে। আরে বাদ দে- তোর মামুর কথা। ভীতু একটা।  ভীতু লোক। মহাভীতু। আজ এত বছর দেখছি তো-

সীট ঘষটে মায়ের দিকে সরে এল মিঠু।  ছন্দার মুখের সাইড প্রোফাইল - কপালে, চুলে, গালে, চোখে, চিবুকে অনন্ত বিষাদ; মা'র  কাঁধে মাথা রাখল মিঠু। চোখ বন্ধ করল। খুলল। জানলার বাইরে তাকালো। দেখল চলন্ত গাড়ি, শহরের পিচঢালা চওড়া রাস্তা, চায়ের দোকানের জটলা আর একটুকরো ঘাসজমি-  ঘন সাদা কাশ ফুটে আছে। সে মাথা তুলে আঙুল বাড়ালো-"মা, এদিকে, দেখো দেখো, কী সুন্দর"। ছন্দার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল।  ড্রাইভার রিয়র ভিউতে তা দেখতে পাচ্ছে  মনে হতেই, চোয়াল  শক্ত করল -" একটু তাড়াতাড়ি চালান না দাদা,  দেখছেন তো শরীর ভালো নয় মেয়ের। "

-কী জ্যাম দেখছেন না-উড়ে যাব না কি ?

-এইভাবে কথা বলছেন কেন?" গলা চড়াচ্ছিল ছন্দা। ওর কনুই ছুঁলো মিঠু-" থাক না , মা।" বাস্তবিকই ট্যাক্সির সামনে বাস, ট্যাক্সি অটো জট পাকিয়ে, সম্ভবত  মিছিল বেরিয়েছে কোথাও- স্লোগান শোনা যাচ্ছিল।  স্তব্ধগতি ট্রাফিকের সামনে হাত ধরাধরি করে রাস্তা পেরোচ্ছিল  মা বাবা বাচ্চা, হাতে বেলুন-আনন্দময়, হাস্যময় মানুষজন- পুজোর বেশি দেরি নেই-

ছন্দা দাঁতে দাঁত ঘষল- "এত লোক চারদিকে। এত লোক। এত লোক। মরেও না,  মরেও না!"

~*~

এই খেলায় সময়কে হারাতে হয় - "টাইম ইজ ইওর এনিমি", মনে মনে আওড়াচ্ছিল বিপ্লব। দম ধরে রেখে বোতামে চাপ দিতেই হাতের শিকল খুলে গেল। এবারে পায়ের শিকলের বোতাম টিপলেই পায়ের শিকল আর ফল্স মেঝে এক সঙ্গে খুলে গিয়ে বিপ্লব বেরিয়ে আসবে খাঁচা থেকে - ভুস করে উঠে এসে হাত নাড়বে। তালা  খুলল না।  কিছুতেই খুলল না । দম ধরে রেখে আবার চাপ দিল বোতামে। আবার।  আবারও। খাঁচা ধরে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁকি দিল সে । এর ফলে জলতলে যতটুকু আলোড়ন হয়েছিল, তিনজন লাল টিশার্ট, এবং দর্শককুল তাকে খুব স্বাভাবিক ভেবেছিল।  লালশার্ট অঙ্গভঙ্গি সহকারে তার ডায়ালগ আউড়ে যাচ্ছিল, দর্শকরা পশ্চিমের সূর্যকে ব্যাকড্রপে রেখে কলকাতার হুডিনির জল থেকে উঠে আসার শট নেবে বলে রেডি-

বিপ্লব শ্বাস নেওয়ার জন্য খাবি খাচ্ছিল। জল ঢুকছিল শ্বাসনালীতে, গলায়; যন্ত্রণায় মনে হচ্ছিল সমস্ত শরীর ফেটে চৌচির হয়ে যাবে এইবার, চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করছিল বিপ্লব, খাঁচা ঝাঁকাচ্ছিল - রঙেরা দ্রুত মুছে যাচ্ছিল ওর চোখের সামনে- কমলা রঙের ছিটেটুকু প্রথমেই উধাও হয়েছিল, তারপর গেল নীলের আভাস; এবার জলের রঙ ঘোলা থেকে ঘন কালো হয়ে গেল পুরোপুরি।

কপিকল গুটিয়ে খালি খাঁচা তুলে আনার কথা এই সময়। দুই আর তিন নম্বর লালশার্ট দড়ি টানছিল সময় নিয়ে- যাতে উত্তেজনায় ফেটে পড়ে দর্শক; পুলির চাকা ঘুরছিল, খাঁজের ওপর দড়ি সরছিল মসৃণভাবে। দর্শক হর্ষধ্বনি করে উঠবে এইখানে। অথচ সমবেত চিৎকার  চড়ায় উঠেই খাদে নামল। খাঁচা উঠে এসেছে গঙ্গার ওপরে - জল ঝরছে। আর খাঁচার শিক শক্তমুঠিতে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজার পোষাক পরা বিপ্লব- চোখ বিস্ফারিত, মুখ হাঁ হয়ে আছে। কপিকল জলের নিচ থেকে খাঁচা তুলে এনেছে - কলকাতার হুডিনির মৃতদেহ সমেত।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শরৎ-২

 

অফিস যাওয়ার আগে পঙ্কজ কলকাতার খবর পড়ছিল ল্যাপটপে। প্রথমে হেডলাইন, তারপর এডিটোরিয়াল দেখে নিয়ে  অন্যান্য খবরে চোখ বোলাচ্ছিল-  জাস্ট আর একবার স্ক্রোল করেই  বেরিয়ে যাবে;  একটা খবর - তাড়াহুড়োয় চোখে না পড়ারই কথা - জাদুকর শব্দই চোখ টানল সম্ভবত-  ল্যাপটপের ডালা বন্ধ করতে গিয়েও পঙ্কজ পড়ে ফেলল- 'জাদুকরের মৃত্যু'; পড়ল,  'সংবাদসংস্থার খবর অনুযায়ী, মাঝগঙ্গায়  হুডিনি ট্রিক দেখাতে গিয়ে গত রবিবার সন্ধ্যায় এক জাদুকরের মৃত্যু হয়েছে। একটি সংস্থার পক্ষ থেকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মৃত ব্যক্তি ঐ বিপদজনক খেলা দেখাতে যান। সুরক্ষাব্যবস্থায় গাফিলতির অভিযোগে ঐ কম্পানির তিন কর্মচারী ও মালিককে পুলিশ আটক করেছে। সংবাদসংস্থার সূত্রে প্রকাশ, মৃত ব্যক্তির নাম বি পালিত।  পুলিশের তরফে মৃত জাদুকরের সম্বন্ধে আর কোনো  তথ্য জানানো হয় নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া বিবরণে প্রকাশ,…."। তারপর হুডিনি, জলের তলার স্টান্ট নিয়ে কয়েক লাইন আরও।  পঙ্কজ ঘামতে শুরু করল, বিন বিন করে ঘাম জমছিল কপালে, পিঠ ভিজে উঠছে টের পাচ্ছিল নিজেই;  সে শার্টের গলার বোতাম খুলল, আস্তিন গোটাল, তারপর কপাল মুছে অন্য নিউজ সাইটে গেল তৎক্ষণাৎ, তারপরে আরো এক সাইটে-ইংরিজি, বাংলা, আবার ইংরিজি - একের পর এক উইন্ডো খুলে যাচ্ছিল ওর ল্যাপটপের স্ক্রীনে- পঙ্কজ জানতে চাইছিল জাদুকরের পরিচয়- সম্পূর্ণ নাম, বয়স, অতীত-  অথচ কোথাও বিশদ কিছু নেই। নেট সার্চ করেই চলছিল পঙ্কজ,  অফিসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, সে বোধ আর ছিল না- ল্যাপটপের স্ক্রীনটুকু ছাড়া বাকি জগৎ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে এই মুহূর্তে। বেশ কিছুক্ষণ লাগল একটা  ছবি পেতে - সম্ভবত ব্লগ সাইট- গঙ্গার জলের ওপর খাঁচা, মৃত যাদুকরের দণ্ডায়মান  অবয়ব, ব্যাকগ্রাউন্ডে হাওড়া ব্রিজ আর আকাশে বুড়ো মানুষের পাঁজরের মত শরতের মেঘ। ছবির তলায় সেদিনের ঘটনার বিবরণ।  পঙ্কজের হাতের মাউজ থমকে গেল।  মৃত ব্যক্তির দাঁড়ানোর ভঙ্গি, পোষাক তার চেনা মনে হয়েছিল, অথচ তার পরিচয় সম্পর্কে নিঃসংশয় হতে দ্বিধা হচ্ছিল পঙ্কজের। তার নিজস্ব অনুমান নিশ্চিত বলে জানলে, এই মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়। পঙ্কজ এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে জুম করে যাদুকরের মুখ আরো কাছ থেকে দেখতে চাইছিল। পিক্সেল রেজোলিউশন সে পথে বাধা হওয়ায় পঙ্কজ একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন  হচ্ছিল ও স্বস্তি বোধ করছিল। এক সময় স্বস্তি হেরে গিয়েছিল তার আশঙ্কার কাছে । শুধু মৃত ব্যক্তির দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে,  যে অতীতকে পঙ্কজ গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা  করেছে এতদিন এবং একসময় ভেবেছে যে সে মরে গেছে, সেই অতীত আজ এক মুহূর্তে বেঁচে উঠেই মারা গেল পঙ্কজের চোখের সামনে, নিতান্ত অফিসবেলায়। এই এক মুহূর্তের বেঁচে ওঠায় পঙ্কজের মাঝবয়সী হৃদয়ের সব থেকে নরম জায়গায় একটা হাতুড়ির ঘা পড়ল প্রথমে- ভোঁতা অস্ত্র, অথচ ব্যথা বিষম, বুক কেঁপে উঠে থরথর করতে লাগল সমস্ত শরীর।  ঐ একই জায়গায় যেন পেরেক মারলো কেউ তারপর, রক্ত বেরিয়ে এল। প্রথমে বিন্দু বিন্দু রক্ত, তারপর রক্তের ধারা তারপর যেন আগল খুলে গিয়ে রক্তের স্রোত- সেই স্রোতে ভেসে  এল ওর পনেরো বছর বয়সের স্মৃতি - যাদের ও গলা টিপে মেরে রেখেছিল এতদিন।  সেই সব স্মৃতি প্রথমে ঢিপি হল, তারপর স্তূপাকৃতি-  কপালের রগ টিপে বসে রইল পঙ্কজ, মাথা ঝাঁকাল; সমস্ত শরীর উথালপাথাল করছিল -মাথা , বুক,  পেট, হাত , পা।  দু বার বাথরুমে গেল, চোখে মুখে জল থাবড়াল তারপর এই সব রক্তপাত সমেত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।এইখানে বসে থাকলে স্মৃতিরা ওকে চেপে ধরে ডুবিয়ে দেবে নির্ঘাৎ।  গলগল করে স্মৃতিরা বেরিয়ে আসছিল- বেবাক ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল মন এবং মাথা।  অথচ এই শূন্যতায় যে  হৃদয়ের ভার উজাড় করে দেওয়ার অনুভূতি মিশে থাকছিল, পঙ্কজ নিজে তা বুঝতে পারছিল না। ঝাপসা চোখ, ঝাপসা মন নিয়ে গাড়ি ছোটাচ্ছিল শুধু।

অফিসের কাছাকাছি একটা ট্রাফিক সিগনালে রোজ দাঁড়াতে হয়। অভ্যাসের বশে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে, অথচ আজ সিগনালের রঙ সবুজ। একশো কিলোমিটার স্পীডের রাস্তায় সবুজ আলোয় দাঁড়িয়ে পড়েই বুঝল ভুল করেছে, তবু, শোধরানোর চেষ্টা করল না,দাঁড়িয়েই রইল,  দাঁড়িয়ে রইল ঠায় - যেন সে চলচ্ছক্তিহীন; চোখ যতদূর যায়, ঢালা পিচরাস্তায়  খন্ড খন্ড জলতল, বাষ্প উঠছে সেখান থেকে। পঙ্কজ তার ভাগ্যের কাছে নিজের হৃদপিণ্ড বন্ধক দিয়ে বসে রইল- যা কিছু ঘটে যেতে পারে এই মুহূর্তে - হয়ত একটা কলিশন , হয়ত চুরচুর হয়ে যাবে গাড়ি, তালগোল পাকিয়ে যাবে পঙ্কজ নিজে - শেষ হয়ে যাবে সব। অথচ তা ঘটছিল না। ওর পিছনের গাড়ি হর্ন দিয়ে পাশ কাটালো, আশে পাশের সমস্ত গাড়ি ওকে পেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে  হর্ন বাজাচ্ছিল, জানলার কাচ নামিয়ে মধ্যমা দেখাচ্ছিল অথবা অশ্রাব্য গালি দিয়ে স্পীড তুলছিল। নদীর বুকে একটা ঢ্যাঁটা পাথরখণ্ডের মত লাগছিল পঙ্কজ আর তার গাড়িকে; লাল আলো জ্বলে উঠতে পঙ্কজের খেয়াল হল, রক্তপাতের সঙ্গে ওর হৃদয়ের খোলস গলে যাচ্ছে। খোলস ছাড়ানো দগদগে হৃদপিণ্ড ধুকপুক করছিল। এবার সবুজ আলোয়, সে স্পীড তুলেছিল, পেরিয়ে যাচ্ছিল জল আর বাষ্পের মরীচিকা-

~*~

তিন্নি নতুন বাড়ির ছবি আঁকছিল একের পর এক। রাঘবকে, শান্তাকে দেখাচ্ছিল। ড্রয়িং খাতার পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে উপহার দিচ্ছিল সব নিমন্ত্রিতদের।  রান্নাঘর থেকে সুবাস আসছিল -সুবিমল যথারীতি বিরিয়ানিতে ফাইনাল টাচ দিচ্ছে।  ট্রেতে পকোড়া আর কফি নিয়ে এ ঘর ও ঘর করছিল লিপি। কেউ একজন প্লে লিস্ট ঘেঁটে গান চালালো- প্যারা এক বাংলা হো, বাংলে মে গাড়ি হো;  'কবেকার গান'- কে যেন বলে উঠল; 'রেখা ছিল না?' উত্তর নয়। তবু উত্তরের মত শোনাল। কেউ জোক শেয়ার করল, প্রথমে একটা তারপর দুটো, তিনটে চারটে- হাসির ছররা ঘরের দরজা ফুঁড়ে বাইরে এল।    

সুবিমলদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করে উত্তরের আকাশে তাকালো পঙ্কজ। স্কাইলাইনে শহরের আলো জ্বলে উঠছে - বিশাল ক্রেন আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। এখনও  ওর মনে পড়ছিল না এই রকম একটা ক্রেন আগে কোথায় দেখেছে। আজ উত্তর খুঁজতে  পকেট হাতড়ালো না পঙ্কজ - সুবিমলরা  নতুন বাড়িতে গেলে আর আসা হবে না এই রাস্তায়- এই ক্রেনটাকে আর দেখবে না ; কত রকম আত্মীয়তা যে জন্মায়-

-এত দেরি করলেন পঙ্কজদা?

-পঙ্কজ, আজকাল খুব বাগান করছিস শুনলাম

-এই, এই গানটা কোন সিনেমার বলো তো

-পকোড়া নিন, একদম গরম-

- বৌদি কবে আসছেন পঙ্কজদা?

লিপি সুবিমলের অ্যাপার্টমেন্ট সিগারেট, কফি, ভাজা পোড়া খাবার আর অ্যালকোহলের গন্ধে ভরে আছে, ধোঁয়া, হাসি আর হুল্লোড়ে সবাইকে একরকম দেখাচ্ছে- লাল নীল সবুজ সাদা অবয়ব ঘুরে ঘুরে কথা বলে, নাচে, এক কলি গেয়ে ওঠে, অকারণ প্রশ্ন করে, উত্তর জানার আগেই হেসে ওঠে হো হো করে । আজ পঙ্কজ বর্ম পরবে না ঠিক করেছে। লোকে বড়জোর পাশ কাটাবে, মধ্যমা দেখিয়ে গালি দেবে; সিগনালের রং বদলাবেই - এইটুকু সময় শুধু ঠোঁট টিপে থাকা। হাসল পঙ্কজ।

"এর পর তাহলে হাউজ ওয়ার্মিং  পার্টি- দুবাড়িতেই" রাঘব বলল-

-দু’ বাড়িতেই?

-তিন্নির নতুন বাড়ি- এক নম্বর। আর পঙ্কজদার বাড়ি-দুই নম্বর।তাড়া নেই। বৌদি এলেই-

হাসছিল সবাই। বিবিধ টপিক উঠে আসছে আসরে- একের ওপর এক -যেন অন্ত্যাক্ষরী চলেছে- এক টপিকের ল্যাজা থেকে অন্যবিষয়ের মুড়ো শুরু হচ্ছে অটোম্যাটিক।  সমস্ত ঘরে আনন্দের  হিল্লোল বইছিল- যাকে ছুঁয়ে দিচ্ছিল, সে তৎক্ষণাৎ এই আনন্দের অংশীদার হয়ে যাচ্ছিল। এই সন্ধ্যায় ডুবে যাওয়া জাদুকরের কথা কেউ বলবে না - জানা কথাই। পঙ্কজের অতীতও যেন ডুবে গেল এইখানে - লোকের ভীড়ে , হাসির শব্দে আজ তার আড়ষ্ট লাগছিল না।দগদগে হৃদপিণ্ডকে আড়াল করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল পঙ্কজ, জোরে  জোরে হাসল, পকোড়া গালে ফেলে তিন্নিকে কোলে তুলে নিল ।

-তুমি পাপি আনতে গেলে, আমাকে নিয়ে যেও।

-তুমিও পাপি নেবে? বনময়ূর টু?

রাত অনেক। তিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরদোর পরিষ্কার করে সোফায় বসেছিল সুবিমল, লিপি। এবার শুতে যাবে।

- আজ পঙ্কজদা দারুণ ফর্মে ছিল।

-হয়ত বৌদি ফিরছেন।

-কিছু তো বলল না।

-কতদিন একা রইলেন, বৌদিও তো ওখানে একাই-

-আমি এতদিন থাকতেই পারতাম না তোমাকে ছাড়া-

-প্র্যাকটিশ করে রাখা ভাল কিন্তু-

-কী?

-আমাকে ছেড়ে থাকার-

-মরেই যাব তাহলে, ফিরে এসে আর আমাকে দেখতে পাবে না- আজ এত ভালো কাটল, এরপর শিফটিং এর ঝামেলা, এখন আর হাবিজাবি কথা বলতে হবে না-

-তাহলে এদেশে সেটল করে গেলাম আমরা? ফিরব না কোনদিন? কোনদিন নয়?

- তোমাকে নিয়ে ভয় হয় আমার লিপি-কখন কী কর- এই চাকরি ছেড়ে দিলে, কোনদিন আমাকে ছেড়ে- কী হল? কী ভাবছ?

-একটু আগে আমিই বললাম, হয়ত স্মিতাবৌদি ফিরে আসছেন।  ফিরে আসছেন। আবার এই আমিই বলছি,  ফিরে যাওয়ার কথা। কী অদ্ভুত না? ফিরে আসাও হয়, ফিরে যাওয়াও হয়।

সুবিমল চুমু খেল লিপিকে-"পাগলিটা।"

স্বপ্নে আজ আবার ট্রেনে চড়েছিল লিপি। জানলার  বাইরে সরে সরে যাচ্ছিল গাছ নদী পাহাড় জনপদ। লিপি জানলার দিকে ফিরে বসে আছে।  টিটি এসে টিকিট চাইতেই ব্যাগ হাতড়াতে লাগল। তার ব্যাগ যেন তলহীন। অতল গভীর  সে ব্যাগে টিফিন বক্স, জলের বোতল, বাড়ির চাবি, রুমাল, মোবাইল, ঘাস , পাতা, নুড়ি পাথর, একটা টেডি বেয়ার। টিকিট নেই। লিপি আবার ব্যাগ হাতড়াল- পার্স নেই, টিকিট নেই। টিটির সামনে গোটা ব্যাগ উপুড় করল লিপি- কামরার মেঝে ভরে গেল লিপির ব্যাগের জিনিসে , কিন্তু পার্স নেই;  লিপি আবার ব্যাগ ঝাড়ল, মোবাইল আছ্ড়ে পড়েই বেজে উঠল  রী রী করে। ধড়মড় করে উঠে লিপি দেখল- ফোন বাজছে।

-বাবা, কী হয়েছে?

"কী হল লিপি" সুবিমল উঠে বসে বেডসাইড ল্যাম্প জ্বালাল।

- বাবার ফোন। সত্যি বাড়ি কাঁপছে। ছাদের চাঙড় খসে মাথা ফেটে গেছে মা'র। আমি বাড়ি যাব। আমি বাড়ি যাব।

~*~

টেবিলে দুধ আর কর্নফ্লেক্স;   একটা ভেজা তোয়ালে হাতে খিড়কির দরজা খুলছিল পঙ্কজ- বাইরের তারে মেলে দেবে।  স্নান সারা। ব্রেকফাস্ট খাবে। এ'বাড়িতে আসার পর ভেজা তোয়ালে বাইরের দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া একরকম নিয়ম করে দিয়েছিল স্মিতা। ব্যাপারটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। গত সাতদিন তুমুল বৃষ্টি- অভ্যাসের কাজে বাধা পড়েছে; আজ রোদ উঠতে দেখেই ভেজা তোয়ালে তুলে নিয়ে পিছনের দরজা খুলল।  থ হয়ে গেল পঙ্কজ। ইদানিং খিড়কির দরজা পঙ্কজের অবসেশনে দাঁড়িয়েছিল। রাতের দিকে প্রায়ই মনে হয়, এই বুঝি কেউ বলবে- দরজা খোলো, আমি এসেছি। বিশেষত ঝড়জলের রাতে শুয়ে শুয়ে পঙ্কজের মনে হয়েছে, দরজায় ধাক্কা দিল কেউ; এরপর  আধোঘুমে ভাবতে চেয়েছে, দরজা খুলে কাকে ও দেখতে চায়- ওর মন এইখানে দুভাগে বিভক্ত হয়েছে- এক অংশ চেয়েছে বাস্তবকে,  অন্য অংশ ম্যাজিকের দিকে টার্ন নিয়েছে  -যে পথে বনময়ূর বা সাহেবগলির গতায়াত সম্ভব।  সকালে তোয়ালে মেলতে গিয়ে  কতদিন ভেবেছে দরজা খুলে দেখবে বনময়ূর এসে বসে আছে -

গত ক'দিন এই দিকটায় আসেই নি পঙ্কজ, আজ রোদের তেজ প্রত্যাশা করে চোখ কুঁচকে গেছিল দরজা খোলার আগেই। অথচ দরজা খুলতেই দেখল বাড়ির পিছনের ঐ ছোট্টো অংশে যেন অন্য এক সকাল- আলোর রঙ সবুজ। অবাক হয়ে সে দেখল, ক্লথ লাইনে লতিয়ে উঠেছে ঘন সবুজ লতা, সরু সরু আকর্ষ আঁকড়ে আছে ওর তোয়ালে মেলে দেওয়ার দড়ি, সবুজ চাঁদোয়া চুইঁয়ে সূর্যের আলো ঘন ছায়া  হয়ে মাটিতে পড়ছে। সবুজের মধ্যে একটি দুটি বেগুনি সাদা বিন্দু- ফুল ধরে আছে। পঙ্কজ পাতার দিকে হাত বাড়িয়েছিল। পাতার গা মসৃণ, সামান্য সিক্ত, শীতল। ওর আঙুল কাঁপছিল- বহুদিন পরে জীবন্ত কিছু স্পর্শ করছে সে। ওর ঘরদোরে রোদ ঢুকছিল- দেওয়ালের ছবিতে পঙ্কজ, স্মিতা, বুলটি, ছোটো বনময়ূর -ব্যাকড্রপে সমুদ্র, বালি, রৌদ্রময় আকাশ; রোদ আর ছায়ার দড়ি টানাটানি খেলা শুরু গিয়েছিল পঙ্কজের চোখের সামনে - কখনও আলো জিতছিল, কখনও ছায়া।  পঙ্কজের খোলসবিহীন দগদগে হৃদয় একটুখানি ছায়া চেয়ে কেঁদে উঠল অকস্মাৎ - তারপর নিজেই লুফে নিল এই মুহূর্ত- মাটিতে পড়ে চৌচির হতে দিল না;  ও মোবাইল তুলে নিল, স্মিতার কলকাতার নম্বরে গেল-

~*~

তিন্নিকে নিয়ে লিপি গাড়ি থেকে নামছিল - এয়ারপোর্টের সামনে এয়ার ইন্ডিয়ার চেক ইন শুরু হবে একটু পরেই। ওদের নামিয়ে সুবিমল অফিস দৌড়বে- লেটস কনেক্ট বাই লাফটারের ইভেন্ট আজ দুপুর থেকে।

-লিপি, পৌঁছে ফোন কোরো। আমি সামলে নেব শিফ্টিং। পঙ্কজদা, রাঘবদের ডেকে নেব। তুমি ফিরে ঘরদোর গুছিও। তাড়াতাড়ি ফিরবে তো লিপি?

তিন্নি হাত নাড়্ছিল বাবাকে। "সাবধানে থেকো"-  লিপি চোখের জল আড়াল করল।  ট্রলি ঠেলে ঢুকে গেল ভেতরে।

সুবিমলদের অফিসের অনুষ্ঠান চলছিল - কোট টাই পয়েন্টেড শু স্কার্ট হিল পরা মানুষজন - কখনও দু হাত তুলে হাসতে হচ্ছিল হা হা করে , কখনও দুলে  দুলে , কখনও দু পাশে দু হাত ছড়িয়ে।  নতুন খেলা শুরু হয়েছিল তারপর - সহকর্মীর দিকে ফিরে চোখে চোখ রেখে নিচু হয়ে গ্রীট করতে হচ্ছিল তারপর চোখ না সরিয়ে হা হা করে হেসে উঠতে হচ্ছিল সব কর্মীদের। সুবিমল ঘুরে ঘুরে মাথা ঝোঁকাচ্ছিল, হাসছিল , হাসছিল আর হাসছিল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শরৎ -৩

 

ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল বৌবাজারে। পর পর আস্তর খসা বাড়ি পশ্চিমের আলো রিফ্লেক্ট করায় গোটা পাড়া এখন গাঢ় কমলা। ছাদ থেকে শুকনো কাপড় তুলে নিল সাবধানী গৃহস্থ। এবারে জলের পাইপ বেয়ে সাঁৎ সাঁৎ করে ছায়া নামবে রাস্তায়। কালো মোটা কেবল দোতলার গ্রিল পেরিয়ে ঘরে ঢুকে টিভি সিরিয়াল চালু করে দেবে। রাস্তার বাতি জ্বলে উঠলে, মানুষজন ভাত বসিয়ে নিউজ দেখবে, তারপর দাদাগিরি;  দোকানপাট বন্ধ হবে এক এক করে। এই গলির ঠিক নিচে টিবিএম চাণ্ডী তার আর্থ প্রেসার ব্যালান্স শিল্ড সমেত তিনশো ষাট মিটার ব্যাসার্ধের বক্ররেখা বরাবর মাটি খুঁড়ে চলেছে-  আর আটশো মিটার এগোলেই শিয়ালদা পৌঁছে যাবে টানেল।

সন্ধ্যার শিফ্ট সবে শুরু হয়েছে। তপন বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল- শেষ দুটো টান মেরে কাজ শুরু করবে; মোবাইল বাজছিল অনেকক্ষণ, ফোন সাইলেন্ট ছিল - দুটো কল মিস করে গেছে ;  তিন নম্বরটা ধরে নিতেই ওদিকে বিকাশ:  টিবি এমের কাটার হেড দিয়ে ঘোলা জল ঢুকছে টানেলে-বিকাশ, পারমিন্দার দৌড়োদৌড়ি শুরু করেছে অলরেডি- লেবারদের ইন্স্ট্রাকশন, বড়কর্তাদের ফোন করা - তপন এসে চার্জ নিল; আফটারনুন শিফ্ট কংক্রীট আর কেমিক্যালের মিক্সচার দিয়ে গ্রাউটিং শুরু করে  দিয়েছিল,  ঘন্টাখানেক পরে জল আসা বন্ধ হয়েছে দেখে তপন সবে ফোন তুলেছে- বলবে, 'সিচুয়েশন আন্ডার কনট্রোল', সঙ্গে সঙ্গে হুড়হুড় করে আবার জল ঢুকতে শুরু করল।  ভাদ্রের গুমোট গরম আর টেনশনে ঘাম হচ্ছিল তপনের, মেজাজ সপ্তমে; সার্টের হাতা দিয়ে কপাল  মুছে বলল- "আজই সাহিলটা এলো না দেখলেন?" "এই নিয়ে এখন আর শুরু করবেন না তো, এলো না আবার কী? আপনাকে বলেই তো ছুটি নিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে আসবে বলেছে। বলে নি? ছাড়ুন ওসব। চৌহান সাব, আর মিস্টার দত্তকে ফোনে ধরুন- বলুন অ্যাকুইফার। হ্যাঁ হ্যাঁ কনফার্মড। অ্যাকুইফার ছাড়া আর কী। পারমিন্দার, উয়ো মিকসচার কা প্রোপোরশন চেক কিজিয়ে জারা। ওয়েট এ মিনিট, আমিই যাচ্ছি " বিকাশ আবার দৌড়োলো।

~*~

সারা বর্ষা ভিজে ভিজে কাজ করে সাহিলের সর্দি কাশি সারছিল  না। হালকা জ্বর আসছিল প্রায়ই। সাইটে কম্পানির রেনকোট, গামবুট, ফেরার পথে নিজের অথবা কঙ্কনার ছাতা- তবু সে ভিজেছিল প্রচুর। একজন ভালো ডাক্তার দেখানো, চেস্ট এক্স রে সব ডিউ থেকে ওভারডিউ হয়ে যাচ্ছিল। আধারকার্ডের কিছু কাজও বাকি অনেকদিন-  বাবা তাগাদা দিচ্ছে রোজ। এবারে জ্বর আসতেই, দুদিন ছুটি চাইল-  ডাক্তার, এক্সরে, আধার কার্ড -সব  সেরে ফেলবে। তপন গাঁই গুইঁ করেছিল, একটা ড্রয়িংএর কাজ শেষ করার চাপ দিচ্ছিল।  ডাক্তার দেখানোর পরে  আজ একবার সাইটে যাবে ঘন্টা দুয়ের জন্য -এইরকম রফা হ'ল শেষমেষ। গতরাতে ড্রয়িং নিয়ে বসতেই কঙ্কণার ফোন এসেছিল - ”কাল একবার দেখা করা যায়?”

"কেনাকাটা করবে, সঙ্গে যেতে হবে, তাই তো? তুমি যেন কবে চলে যাচ্ছ...." সাহিল কেটে কেটে কথা বলছিল-

- সাহিল, ঝগড়া কোরো না এখন। খবরটা দেখলে?

- কোন্ খবর?

-হুডিনি ট্রিক দেখাতে গিয়ে গঙ্গায় ডুবে যাওয়ার খবরটা...

-হ্যাঁ। দেখলাম তো।

-আমি যা ভাবছি, তুমিও তাই ভাবছ?

-আশ্চর্য, তুমি কী ভাবছ, তা আমি কেমন করে জানব? আমি কি জ্যোতিষী?

-বলছি যে, পরে ঝগড়া করলে হয় না?

-পরে মানে কবে? তার আর পর নেই, নেই কোনো ঠিকানা- কী যেন গানটা-

-প্লীজ সাহিল।

-ঠিক আছে, কী ভাবছ বলো -

-ইনিই নীলকমল নন তো? একবার পুলিশের কাছে গিয়ে কথা বললে হয়… যাবে?

-প্রথমতঃ পুলিশ আমাকে ইনফরমেশন দেবে কেন? দু নম্বর মানে সব থেকে বড় কথা- হয়ত এই বি পালিতই নীলকমল। হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কী হবে জেনে? দ্য ম্যাজিশিয়ান ইজ ডেড-

-লং লিভ দ্য ম্যাজিক। হয়ত ইনি নীলকমল নন। অন্য কেউ। সেটা জানতে হবে না?

সাহিল চুপ করে রইল।

-তুমিই তো বলেছিলে, নীলকমল জাস্ট প্লেসহোল্ডার- খুঁজে যেতে হবে-

-বলেছিলাম। এখন সব বকোয়াস মনে হচ্ছে- আসলে, লেখক মরে গেছে- রাইটার ইজ ডেড কঙ্কণা-

- কী যা তা বকছ! কাল একবার দেখা করা যায়? একটা কথা বলার আছে। জরুরী কথা।

-কী কথা? এখনই বলো- কাল সময় হবে না।

- হবে, একটু সময় ঠিক হবে।

- এখন বলতে কী হয়?

- দেখা হলে বলব, কোথায় আসব?

-সাইটে আসতে পারবে? সন্ধ্যার দিকে? রোজ যে সময়টায় আসতে-

~*~

কালীমন্দিরের সামনের ফুটপাথে সাষ্টাঙ্গে  শুয়েছিল প্রফুল্ল। তেতে ওঠা শাণ এখন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। দিব্যি আরাম হচ্ছিল, হাত পা টানটান করল সে। তখনই মাটি কেঁপে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল পেট,  বুক, সর্ব শরীর। অন্যদিনের মত হাল্কা দুলুনি নয়। টানা কাঁপুনি - থরথর করে উঠছিল সর্বাঙ্গ।  রঙীন চকখড়ি ফুটের একদিক থেকে অন্য দিকে গড়িয়ে গেল। রঘু বলল- "কী বে ভোচাল নাকি?" গুমগুম করে আওয়াজ উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দমকলের ঘন্টা। একটানা। পটল আর কাঁসি কুঁইইই করে উঠেই চুপ করে গেল। প্রফুল্ল  দু হাতের চেটো ফুটে রেখে মাথা তুলল। শ্বাস টানল বড় করে। ওর মনে হ'ল, এতদিনে শ্রীদেবীর ঘুম ভেঙেছে। এবার সময় হয়েছে-  জাহাজ আসবে গলিতে- ডেকে দাঁড়িয়ে থাকবে শ্রীদেবী - হলুদ শাড়ি পরে; এই ফুটে এসে জাহাজ থামবে মন্দিরের ঠিক সামনে। প্রফুল্ল লাফিয়ে উঠল। প্ল্যাসটিক, ঝোলাঝুলি গুটিয়ে রাখলো একপাশে। ওর ছোটো বালতি আর সাবান নিয়ে  সুলভের দিকে দৌড়োলো - স্নান করে রেডি হবে।

~*~

আধারকার্ডের কাজ সেরে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে মোবাইল অফ করে রেখেছিল সাহিল। বেরিয়ে গুচ্ছের অ্যান্টিবায়োটিক আর মাল্টিভিটামিন কিনল ফার্মেসি থেকে। তারপর ফোন অন করল ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। টুং টাং টুং টাং অনবরত মেসেজ ঢুকছিল সাহিলের মোবাইলে। গোটা কুড়ি মিসড কল- সাইট থেকে, বন্ধুদের মেসেজ, বাবার মেসেজ, মা'র মিসড কল – ‘তুই কোথায়?  ঠিক আছিস তো? মেসেজ কর এক্ষুণি।‘ কী ব্যাপার বুঝতে পারছিল না সাহিল। সাইটে কিছু হল? তপনকে ফোন করতে যাবে, ওষুধের দোকানের ছোটো টিভিতে খবর শুরু হয়ে গিয়েছিল- " আজ সন্ধ্যায় , কলকাতার বৌবাজার এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ চলাকালীন টানেল বোরিং মেশিন  ভূগর্ভস্থ জলাধারে ধাক্কা মারে। টানেলে জল ঢোকা এখনও বন্ধ করা যায় নি। এই ঘটনায়, অঞ্চলের বসতির ভিত ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানা গেছে। ক্ষয়ক্ষতির সম্পূর্ণ বিবরণ এখনও এসে পৌঁছোয় নি। ঘটনাস্থল থেকে একটু পরেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন আমাদের প্রতিবেদক। সঙ্গে থাকুন। চোখ রাখুন চ্যানেলে।“ বাকি মেসেজ চেক করল সাহিল- কঙ্কণার কোনো মেসেজ নেই। ফুটপাথে দাঁড়িয়েই কঙ্কণার নম্বর ডায়াল করল - কল থ্রু হচ্ছে না - কোনো আওয়াজ নেই ওদিকে। সাহিল ডায়াল করল আবার আবার আবার; তারপর মাথা ঘুরে উঠল - ফুটপাথেই বসে পড়ল ধপ করে। কঙ্কণা কি সাইটে গেছে?

~*~

সুলভের সামনে কেউ নেই তখন। ভেতরে, মেঝে জুড়ে ভাঙা কাচ। দেওয়াল কাঁপছিল, দরজা,  স্কাইলাইট- সব; ঘুলঘুলির সামনে পাখির বাসা মাটিতে ঠিকরে পড়তে তিনটে ডিমই ভাঙল। বাথরুমে ঢুকে কল খুলল প্রফুল্ল - লালচে জল চড়বড় করে পড়ছিল বালতির ভিতর। তারপর প্রফুল্লর চোখের সামনে কলের মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে জল বেরোলো, চিড় ধরল দেওয়ালে। পাশের স্নান করার খোপ থেকে জল বেরিয়ে আসছিল গব গব করে , মাথার ওপরে ছাদের আস্তর খসে পড়ল এইবার; জাহাজ তাহলে গলিতে ঢুকেছে - সাবান মাখা আদুল গা প্রফুল্ল দৌড় মারল মন্দিরের দিকে।

~*~

তপনকে ফোনে ধরার চেষ্টা করছিল সাহিল , তারপর পারমিন্দার, বিকাশ, শাহিদুল আর খগেনের নাম্বার ট্রাই করল- কোনো ফোনই বাজছিল না;  লাইনের ওপারে জমাট নিস্তব্ধতা, যেন এক বোবা জগত ওদিকে, যেন ভারি মোটা কম্বলে সমস্ত কথা আষ্টেপৃষ্ঠে মোড়া - তারা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে আর তাদের নড়াচড়ায় খসখস শব্দ হচ্ছিল লাইনে। সাহিল ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামল - সন্ধ্যার জমাটজমাট ট্রাফিক- গাড়ি, বাস, অটোর লাল টেল লাইট, সিগনাল যথাবিহিত লাল, হলুদ , সবুজ হচ্ছে, যেন কোথাও কিছু ঘটে নি- শুধু একা সাহিলই দুঃস্বপ্ন দেখে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে ঘুম চোখে; সামনে খালি ট্যাক্সি দেখে হাত নেড়ে দাঁড় করাল - 'বৌবাজার যাবেন?' গন্তব্য শুনেই ট্যাক্সি বেরিয়ে গেল ধোঁয়া ছেড়ে- ' দাদা, আজ কোনো গাড়ি যাবে না ওদিকে । বাসও পাবেন না'। কানে ফোন চেপে সাহিল হাঁটতে শুরু করল-একটানা ডায়াল করে যেতে লাগল কঙ্কণার নম্বর।

ঘন্টাখানেকের মাথায় সাইটের কাছাকাছি পৌঁছল সাহিল। গোটা এলাকা কর্ডন করা- পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ।  সাহিল এগিয়ে গেল- বোঝাতে চাইল নিজের কথা, সাইটের কথা, কঙ্কণার কথা।গলা তুলেই কথা বলতে শুরু করেছিল সে, আবেগে আর টেনশনে গলা আরো চড়ছিল ক্রমশ। ওয়াকি টকি হাতে অফিসার গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ল-'প্লীজ। সম্ভব নয়। এখানে ভীড় করবেন না , রাস্তা খালি করুন। সহযোগিতা করুন আমাদের সঙ্গে।'  সাহিল পকেট হাতড়ে ওর আই ডি কার্ড বের করে গলায় ঝুলিয়ে নিল, আবার সাইটে ঢোকার অনুমতি চাইল। এবারে, অফিসার ওকে হাত নেড়ে সরে যেতে বলতেই সাহিল শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারল পুলিশকে, পা স্লিপ করল নিজেরই, ব্যালান্স রাখতে চেপে ধরল পুলিশের কলার ;  ঘামে চপচপে উর্দিতে হাত পড়তেই সে বুঝেছিল, ভুল করেছে, ছেড়ে দিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। দুজন পুলিস লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল - সাহিল হাত জোড় করল, কপালে ঠেকাল। তারপর পিছনে হটে গেল- স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

~*~

ঘুরঘুট্টি  অন্ধকারে প্রফুল্ল ওর ভুরু বরাবর  হাতের পাতা রেখে ঠাহর করতে চাইছিল জাহাজ কতদূর।  রাস্তার সমস্ত আলো নিভে গেছে। অন্ধকার ঘরবাড়ি। একটু আগে কোণের দিকের বাড়ি পুরোনো ছাদ, থাম, বারান্দা সমেত ভেঙে  পড়ল। দমকলের ঘন্টা, হেলিকপ্টারের আওয়াজ, আর গুমগুম  শব্দ; সাইটের দিকটা ফ্লাডলাইট দিয়েছে- সে আলোয় লাল সাদা ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠে , থিতিয়ে যাচ্ছে। মিষ্টির দোকানের দিক থেকে সুনীল আর ওর বৌ দৌড়ে বেরিয়ে এল- পিছনে কয়েকজন অচেনা মেয়েমানুষ। কালীমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে ওরা কজন- নাথু, প্রফুল্ল, রঘুবীর, কপিল। সুনীল প্রফুল্লর পায়ের কাছে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছিল- ওর পা ধরছিল-  জড়ানো গলায় যা বলছিল তাতে পাপ, ক্ষমা এই সব শব্দের আধিক্য ছিল। সুনীলের বৌ চোখ মুছছিল নিঃশব্দে। তিনজন অচেনা মেয়েমানুষ পুঁটলি বুকে চেপে আকাশ দেখছিল। কাঁসি, পটল ভৌ ভৌ করে ডাকছিল- রাস্তার এ মুড়ো ও মুড়ো দৌড়ে বেড়াচ্ছিল।

~*~

স্টেশনের সামনের সিঁড়িতে বসেছিল সাহিল - জামা প্যান্টে ময়লা, হাতের প্লাস্টিকে ওষুধ ছিল- ধাক্কাধাক্কিতে কোথায় পড়ে গেছে -মোবাইলের স্ক্রীনে চিড় ধরেছিল।  গোটা ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছিল সাহিলের- যেন সিনেমা দেখছে। ও চাইছিল সিনেমা শেষ হয়ে পর্দায় ক্লোজিং ক্রেডিট আসুক এবার, থিয়েটারের আলো জ্বলে উঠুক, আধো অন্ধকার থেকে বড় রাস্তায় বেরিয়ে ওর চোখ ধাঁধিয়ে যাক। চাণ্ডী মুখনকে এখন খুব দরকার- ওর মনে হচ্ছিল। স্টেশনের সামনের চত্ত্বর শুনশান। শারদোৎসবের প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন এতক্ষণ আলোর মালায় সাজানো ছিল - দপ দপ করে নিবে গেল এই মাত্র;  অন্ধকারে হুটার আর দমকলের ঘন্টির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে শুধু। প্যান্টে মোবাইল ঘষে নিয়ে কঙ্কণার নম্বর আবার ডায়াল করল সাহিল- একবার দুবার তিনবার- এবারে ফোন বাজছে- বেজেই চলেছে; কঙ্কণার রিংটোনে শর্মিলা রায়ের গলায় শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা শোনা যাচ্ছিল । সিঁড়ির ধুলোয় বসে তরুণ প্রেমিক শৃণ্বন্তু বিশ্বে শুনতে পাচ্ছে প্রেমিকার রিংটোনে এই রকম সুপার ড্রামাটিক সিচুয়েশন কোনোদিন আসবে না সাহিলের উপন্যাসে - তৎসত্বেও, যতবার সে তমসো পরস্তাত শুনছিল - ত এ ত ঠেকছিল শর্মিলার গলায়- ততবার তার চোখ বেয়ে জল নামছিল, ঠোঁট কামড়ে ধরছিল নিজের।

শরৎ, তবু কাটে নাহি কাট্টের সীনের মত বৃষ্টি নেমেছিল ঝমঝম করে। মন্দিরের সামনে থেকে পুলিশ প্রফুল্লদের হটিয়ে দিয়েছিল অনেকক্ষণ । পটল আর কাঁসিকে নিয়ে প্রফুল্ল স্টেশনচত্ত্বরে বসেছিল। এতক্ষণে জাহাজ ভিড়েছে নিশ্চয়ই - শ্রীদেবী ওকে খুঁজছে- এইখানেই বসে থাকা ভালো -শ্রীদেবী খুঁজে খুঁজে এখানেই আসবে। সিঁড়ির একদম ওপরের ধাপে গিয়ে বসল প্রফুল্ল। ছেলেটাকে তখনই দেখল, একা বসে আছে; বার বার ফোন কানে দিচ্ছে, নামিয়ে এনে খুটখাট করছে আবার কানে ধরছে - অস্থির দেখাচ্ছিল ছেলেটাকে - যেন প্রফুল্লর মতই অপেক্ষা করছে অনেকক্ষণ- এখন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ওকে দেখে হাসল। হাত দিয়ে বৃষ্টি দেখাল- কাঁধ ঝাঁকিয়ে যেন বলতে চাইল- ফেঁসে গেছে। প্রফুল্ল আজ খুব কাছ থেকে দেখছে ছেলেটাকে। কত আর বয়স? ছোটা ভাই য্যায়সা- ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হল প্রফুল্লর, ও বলতে চাইল ধৈরজ রাখ, মেরে ভাই, শান্ত হো যা; এই সব কথা প্রফুল্লর মন থেকে পাক খেয়ে গলায় এসে বদলে গিয়েছিল। সে বলল, "বারিষ মে কাঁহা যাওগে? খেল দেখোগে কেয়া?"ছেলেটা অবাক হয়ে তাকালো। থলি হাতড়ে প্রফুল্ল বের করে আনল নীল ট্র্যানজিস্টর রেডিও- সেদিন সুনীলের ঘর সাফ করতে গিয়ে পেয়েছিল- বেটারি ফুল একদম। প্রফুল্ল রেডিও চালালো, পুঁটলি থেকে বের করে আনলো চারটে বল, বাঁশি, লম্বা টুপি- সাজিয়ে রাখল পরপর;  এফ এম স্টেশনে গান দিয়েছিল-লাগি আজ শাওন কি। তালে তালে প্রফুল্ল বলগুলো ওপরে ছুঁড়ে লুফে নিচ্ছিল হাঁটু গেড়ে বসে। পটল, কাঁসি আর বৃষ্টি ওদের ঘিরে রইল বাকি সময়- পিচরাস্তায় হাজার হাজার জলের মুকুটে স্ট্রীট লাইট আর বিদ্যুতের আলো ঠিকরোতে লাগল। একটা বলও মিস করছিল না প্রফুল্ল- হাঁ করে দেখছিল সাহিল। কভি টুট কর চীজ কই জুড়ি হ্যায় এর জায়গাটা যখন হচ্ছিল, প্রফুল্ল শ্রীদেবীকে দেখতে পেল স্পষ্ট - নীল শাড়ি পরে, ভাঙা ঘরদোরের দিক থেকে বৃষ্টিতে  ভিজে ভিজে এদিকেই আসছে । সাহিলও দেখেছিল, সে আসছে। ফ্লাড লাইটে হলুদ আকাশ, তুমুল বৃষ্টি আর অন্ধকার এই শহরকে ব্যাকড্রপে রেখে সে আসছে। সে ওর কাছেই আসছে। মুহূর্তরা নদীর মত বয়ে যাচ্ছিল সাহিলের সামনে  । সাহিল শব্দ খুঁজছিল, লিখতে চাইছিল । ওর আঙুল নিশপিশ করছিল, অক্ষর, শব্দ, বাক্য ছেনে ও আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছিল এই গান, এই বৃষ্টি, এই খেলা, এই আশ্চর্য আবির্ভাব-এই যে মুহূর্তরা একটু আগেই ঘটমান বর্তমান ছিল, ওর চোখের সামনে অতীত হয়ে যাচ্ছে - এই সব মুহূর্তদের ধরে রাখা দরকার - সাহিলের মনে হচ্ছিল। গলায় ঝোলানো সাইটের আইডি কার্ড  টান মেরে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিল সে-

~*~

ধরা যাক, একগাদা তারা, ছায়াপথ, চাঁদ টাঁদ পরে আকাশ খুব সেজেছে আজ রাতে। ভ্যান গগের ছবির মত দেখাচ্ছে। আকাশের তলায় এই মুহূর্তে একটা রাস্তা, একটু আগে নদী ছিল। রাস্তায়  দুজন- দূর থেকে পিঁপড়ের মত দেখাচ্ছে। একজন লেখক। পাঠক অন্যজন। কথা বলছে -

- সব পাড়াতেই একজন ম্যাজিশিয়ান থাকে

- সব পাড়াতেই ?

- না কী জীবনে ?

- সবার জীবনে ?

- একজন যাদুকর - জাস্ট ম্যাজিকওয়ান্ড  হাতে জাদুকর - থাকে না ?

- কী জানি! কী করে বুঝব!

- পাড়া বদলে যায় যখন -

- সে তো সময়

- জীবন বদলে যায় যখন -

- সে তো প্রেম

- তুমি নিজেই যখন -

- মানে তুমিই জাদুকর ?

- জানি না।

- সময়ই জাদুকর তবে?

-না কি প্রেম?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

শরৎ-৪

 

স্মিতা একটা কাঠের বেঞ্চে বসে লম্বা শ্বাস নিল; খুব কাছেই কোনো ফুল ফুটেছে সম্ভবত, হাওয়ায় ভেসে ভেসে সেই সব ফুলের বাস একবার স্মিতার কাছে আসছে, আবার চলে যাচ্ছে – দোল খাওয়ার মত ঘটছে ব্যাপারটা এবং এই দোলনের সময়কাল নিয়ে ওর স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ; ফুলের গন্ধ পেলেই বুঝতে পারছে কখন তা মিলিয়ে যাবে, আবার সঙ্গে সঙ্গেই আন্দাজ করে নিচ্ছে তার ফিরে আসার সময়। অথচ স্মিতা এখনও বুঝতে পারছে না ওর অবস্থান – প্রথমে মনে হয়েছিল, কোনো পার্কের বেঞ্চে বসে রয়েছে,  গাছের দিকে পিঠ ফেরানো- মাথা ঘুরিয়ে দেখতে গেলে ঘাড়ে টান লাগছিল;  তারপর খেয়াল করল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল- মাথায় পরী, আর খোদ মহারাণীর মূর্তির সামনে ও একটা বেঞ্চে বসে, পায়ের কাছে বনময়ূর; স্মিতার হাঁটুর কাছাকাছি বনময়ূরের বাদামী কান – মাথা ঘোরালেই হাঁটুতে সুড়সুড়ি লাগছিল। ঘাড় নুইয়ে পা চুলকোতে গিয়ে স্মিতা খেয়াল করেছিল, চৌখুপি মার্বেলের মেঝে, আর তার ওপর বনময়ূরের থাবা অসম্ভবরকম কেঠো আর নির্লোম; খুব অবাক হয়ে সামনের থাবা ছুঁতে গিয়েছিল স্মিতা – দেখল, বনময়ূর নয়, পিচবোর্ডের তৈরি কুকুরের একটা কাট আউট শুধু। রিফ্লেক্সে মাথা তুলেছিল সে – দেখেছিল, ঘুলঘুলি দিয়ে আলো আসছে – শঙ্কুর শেপ নিয়ে নিচ্ছে ক্রমশ; সে আলো মুখে পড়তেই স্মিতার বয়স ছ’বছর হয়ে গিয়ে ফ্রিজ করে গেল, ও জেম্মার পাশে শুয়ে ঘুমোতে লাগল অঘোরে, একসময় জেম্মা উঠে পড়ল, বাথরুমে গেল, তারপর সদর খুলে বাগানে। স্মিতা শুয়ে শুয়ে জলের আওয়াজ পেল স্পষ্ট, খিল নামানোর আওয়াজ আর শিউলির গন্ধ পেল তারপর। জেম্মার সঙ্গে ফুল তুলবে ভেবে উঠে পড়বে ভাবতেই বুঝল, ওর শরীর এখন অনেক ভারি, লম্বা হাত-পা গোটা বিছানা জুড়ে, যেন জেম্মার শোওয়ার জন্য কোনো জায়গাই ছিল না কোনোদিন; তখন মনে হল, ও পঙ্কজের সঙ্গে ওদেশের বাড়িতে, তারপরেই ভাবল, ও হাসপাতালে, বুল্টি জন্মাবে আজ। তখনই ধনঞ্জয় আর পায়েলের গলা শুনল স্মিতা, একটা অটো গেল পাশের রাস্তা দিয়ে এই ভোরে, কুকুর ডেকে উঠল, তারপর কাক; বিছানায় উঠে বসে মনে হল – এখনও সুটকেশ প্যাক করা হয়নি – আজ রাতে ফ্লাইট।

~*~

চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে পড়েছিল চন্দ্রযান। তন্ময় আজকাল চুপচাপ  – তর্ক করে না, শুধু মিম পাঠায় মাঝে মাঝে; একদিন হঠাৎ বলেছিল, “বৌদির কোন খবর রাখ?” সনৎ চুপ; বহুদিন মিঠুদের বাড়ির দিকে যায়নি – বস্তুত অফিস থেকে ফিরে সারাক্ষণ ইসরোর সাইটেই পড়ে থাকছিল আর চন্দ্রযান নিয়ে ইংরিজি, বাংলা কাগজ, ম্যাগাজিনের যাবতীয় লেখা কেটে কেটে স্ক্র্যাপবুকে জমাচ্ছিল। সনৎএর ঘাড় পর্যন্ত চুল নেমেছে ইদানিং – যেন একটা বড় পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে সে; ঘরবন্দি হয়ে এতই পড়াশোনা করছে, যে চুল কাটার সময় অবধি হচ্ছে না। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলে শিওর প্রাইজ সঙ্গে সঙ্গে – সনৎ সটান মিঠুর বাড়ি গিয়ে ওকে ল্যান্ডিং-এর খবর দেবে হাঁটু মুড়ে, ফিরতে বলবে ওর কাছে আর মিঠু তৎক্ষণাৎ একটা ট্যাক্সি ধরে রওনা হবে, ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়েই সুটকেশ নিয়ে দোতলার ঘরে। তারপর, দরজা বন্ধ করলেই শুধু পুরোনো পালঙ্ক, আর ওরা দু’জন – পর্দাটানা জানলা, আধো অন্ধকার ঘরে হাইড্রোজেন মেঘেরা নেমে আসছে, কতদিন পরে মিঠুর অভ্যন্তরে ঢুকছে সনৎ; কোলবালিশে মিহি ধুলোর গন্ধ – নাকে এলে নেশা ধরে যাচ্ছে আরও; ইমিডিয়েট পাজামা নামাল সে; তারপর আবার ইসরোর সাইট, স্ক্র্যাপবুক আর নিজের আঁকা যতেক ডায়াগ্রামের ওপর ঘাড় গুঁজে রইল।

~*~

পাড়া জুড়ে আজও আলোর নদী- শিখাজেঠিদের বারান্দায় আলোর মালা দুলছিল। হলুদ-কালো ট্যাক্সি এক হাঁটু আলোয় দাঁড়িয়ে– তার রিয়ার উইন্ডস্ক্রিনে টুনি বাল্ব রিফ্লেক্ট করছে – লাল-নীল-সবুজ আলোর বিন্দু জ্বলছে, নিভছে। স্মিতার দুটো সুটকেস উঠে গিয়েছিল ট্যাক্সিতে। ডিকি বন্ধ করে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করেছিল; স্মিতা তখনও কথা বলছিল পায়েল আর ধনঞ্জয়ের সঙ্গে, বিবিধ নির্দেশ দিচ্ছিল – যেন পরিপাটি থাকে বাড়ি, বাগান, পুকুরপাড়, ক্ষিতীশ যেন কার্বলিক ছড়ায় নিয়মিত, জঙ্গল সাফ করে। বলছিল, প্রণবের সঙ্গে কথা হয়েছে, পায়েলদের বিরক্ত করবে না কোনো প্রোমোটার। “দিদি, আবার কবে আসবে?” পায়েল চোখ মুছছিল – “জামাইবাবু আর বুল্টিকে নিয়ে এসো দিদি।” স্মিতা চুপ করে রইল। বাগান থেকে শিউলির গন্ধ আসছে, ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে ননস্টপ। দুটো পটকা ফাটল দূরে। পাঁচিলের ওপর সারি দিয়ে পিঁপড়ে বাইছিল–জেম্মা থাকলে বলত, আজ রাতে বৃষ্টি হবে। স্মিতা মুখ তুলল, দেখল – একফালি চাঁদ আর তারায় তারায় ভরে আছে আকাশ; “দিদি, এরপর জ্যামে পড়ে যাবেন”, ধনঞ্জয় তাড়া দিয়েছিল। স্মিতা বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ – যেন চোখে চোখে কথা হল ওর আর বাড়ির; যেন কথা হয়ে গেল, এ’বাড়ি-পুকুর-পিঁপড়ে ওকে আবার ডাকবে নাম ধরে – শাওয়ারে, ফুটপাথে, ট্র্যাশ ফেলার সময়। ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল স্মিতা, যাই বলতে গিয়ে শুধরে নিল -  “আসি তবে?

~*~

সনৎএর ঘাড় মাথা পিঠ টনটন করছিল; চোখ লাল, মাথা ধরে আছে। কাল থেকে ডেস্কটপে ইসরোর সাইট আর টিভির স্ক্রিনে নজর রেখে যাচ্ছে অবিরাম। মন্টুর মা সকালে লুচি আর মোহনভোগ করেছিল, তারপর রান্না করে খাবার বেড়ে রেখে গেছে দুপুরে। এই মধ্যরাতে সেই বাড়া ভাত, আর মাছের ঝোল থেকে আঁশটে গন্ধ সনতের ঘরদোরে ছড়িয়ে পড়ছিল। পিঁপড়ে ধরেছিল বাসি লুচি, মোহনভোগে। গালে হাত বোলাল সনৎ –ল্যান্ডিং হয়ে যাক, কালই দাড়ি কামাবে, চুল কাটবে;  ফিটফাট হয়েই মিঠুর বাড়ি। ঘড়ি দেখল – আর আধঘন্টা। জাস্ট আধঘন্টা পরে ল্যান্ডিং – চেয়ার টেনে টিভির সামনে বসল সনৎ।

সেই সময় গতি কমাচ্ছিল বিক্রম – সতেরোশ’ মিটার পার সেকন্ড থেকে একশ’ ছেচল্লিশ মিটার পার সেকন্ড – চাঁদের খুব কাছে এসে পড়েছে ল্যান্ডার – আর মাত্র সাড়ে সাত কিলোমিটার। বিক্রমের ঠিক মাথার উপরে থেকে ছবি তুলে পাঠাচ্ছিল অরবিটার। সনৎ হাততালি দিয়ে উঠছিল। আরও গতি কমাল বিক্রম; তারপর লোকাল নেভিগেশন শুরু করে দিল। পাড়ার ভেতরে পটকা ফাটছিল টানা,  এখন চাঁদের মাটি থেকে মাত্র দু’কিলোমিটার ওপরে বিক্রম। সনৎ একবার উঠে দাঁড়াচ্ছিল, পরক্ষণেই বসে পড়ছিল, দাঁত দিয়ে নখ কাটছিল, আঙুলের চামড়া টেনে টেনে তুলছিল। টিভিতে ইসরোর কন্ট্রোল রুম দেখাচ্ছে – ঢাউস স্ক্রিনে সংখ্যারা বদলে যাচ্ছে হুড়হুড় করে।

~*~

স্মিতার ফ্লাইট শেষ রাতে। চেক-ইন হয়ে গিয়েছিল। আনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে; বই ওল্টাল, হ্যান্ডিক্রাফটের দোকানে দু’-একটা জিনিস হাতে তুলেও রেখে দিল। পুজো উপলক্ষ্যে এয়ারপোর্টের সাজ খুব – ছবি নিল মোবাইলে। একবার ফোন করল বাবলুদাকে, তারপর পায়েলকে; শীত শীত করছিল – হাতব্যাগ থেকে চাদর বের করে গায়ে জড়াল। সারাদিনের ব্যস্ততায় খবরের কাগজ পড়া হয়নি – কাগজ আর জল কিনে ডিপারচার টাইমের ডিসপ্লে স্ক্রিন ঘেঁষে বসল। উল্টোদিকে, টিভির সামনে ভিড় দানা বাঁধছিল – একটু পরে বিক্রম চাঁদে নামবে। স্মিতা ভাঁজ করা কাগজ খুলল। প্রথম পাতায় বিক্রম আর চাঁদ নিয়ে প্রতিবেদন, বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকার, প্রধানমন্ত্রী আর শিভনের হাসিমুখের বড় ছবি। চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল স্মিতা, পাতা উল্টাচ্ছিল, আবার প্রথম পাতায় ফিরছিল। ভিতরের পাতায় একটি ফিচার দেখল মৃত জাদুকরকে নিয়ে; খবরটা জানা – টিভিতে দেখেছিল। ফিচারে জাস্ট চোখ বুলিয়ে পাতা উল্টোতে যাবে, তখনই সাহেবগলি শব্দে চোখ আটকে গেল; স্মিতা পড়েছিল, ‘আমাদের প্রতিনিধি, মৃত বি পালিতের সাহেবগলির বাড়িতে গেলে, মৃতর পরিজন সংবাদমাধ্যমকে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করেন।’ ফিচারের শুরুতেই দুর্ঘটনার তারিখের উল্লেখ ; স্মিতা আবার দেখল সেই তারিখ, সময়, পঙ্কজের মেসেজের দিনক্ষণ মনে এল অটোম্যাটিক – যে মেসেজে পঙ্কজ আকুল হয়ে ওকে ফিরে আসার কথা বলেছিল। যাদুকরের ঠিকানা, দুর্ঘটনার তারিখ, পঙ্কজের মেসেজের সময় – একটা আবছা নকশা তৈরি করছিল – যেন পাজল বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে স্মিতা, হাতে জিগস পাজল পিস – মাত্র কয়েক টুকরো – বাকি সব টুকরো মিসিং, কেউ যেন কোনো অগম স্থানে লুকিয়ে রেখেছে। স্মিতার বড় ক্লান্ত লাগল অকস্মাৎ; এই মধ্যরাতে  এয়ারপোর্টের টারমিনালে বসে ওর মনে হ’ল, বেলা ফুরিয়ে আসছে- এই লুকোচুরি খেলা এবারে শেষ হোক; জেতার আশা সে আর করছিল না, বরং এই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, খেলা বন্ধ করে ওদের দু’জনেরই বাড়ি ফিরে যাওয়া দরকার। বাড়ি ফিরবে, হাত পায়ের কাদামাটি ধুয়ে ফেলবে, ভাত খেতে বসবে একসঙ্গে। ভাতের ওপর ডাল ঢালবে, লেবু চিপে গরাস মুখে দেবে দু’জনে, তারপর খুব ঘুমোবে। চশমা খুলে চোখ মুছে নিতে গিয়ে টিভি স্ক্রিনে তাকিয়েছিল স্মিতা – কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বিক্রমের ল্যান্ডিং-এ। লোকজনের তুমুল আক্ষেপ শুনতে পাচ্ছিল সে।

~*~

টিভি অফ করে বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দিয়েছিল সনৎ- সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিল অন্ধকারে; কেউ যেন ভ্যাকুয়াম ক্লিনার অন করে ওর মাথার ভিতর খালি করে দিচ্ছে;  ও কিছু দেখছিল না, শুনছিল না, শুধু এক গোঁ গোঁ আওয়াজ মাথার মধ্যে – যেন সবাই একসঙ্গে দুয়ো দিচ্ছে – হেরো, হেরো, হেরো হেরো। হলুদ বাড়ির পুকুরের আশপাশ যেদিন ক্ষিতীশ পরিষ্কার করেছিল, কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিয়েছিল, সেদিনই ওর পরিণাম যেন স্থির হয়ে গিয়েছে – সনতের মনে হয়েছিল। ও দরজা খুলল;  টুং টাং মেসেজ আসছিল মোবাইলে – সনৎ তাকিয়েও দেখল না; সটান বেরিয়ে এল।পুকুরের দিকের পথ এবড়োখেবড়ো, অন্ধকার, সামান্য কাদা- সনৎ হোঁচট খাচ্ছিল, পাতলা চপ্পলের  নিচে ইঁটের টুকরো, ভাঙা ডালের খোঁচা লাগছিল, দু বার  পিছলে পড়তে পড়তে সামলে নিল।  তারপর, ভাঙা পাঁচিলের ফোকর দিলে শরীর গলালো, ঘাটের ধাপ বেয়ে দ্রুত নেমে পুকুরের জলে পা ভিজিয়ে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা জল ওর পায়ের পাতার ওপর বইছে, এবারে জলে নেমে এগোতে হবে, জল উঠবে ওর হাঁটু ছাপিয়ে কোমর, বুক, গলা, নাক চোখ- তারপর হুশ করে চুয়ান্ন নটিক্যাল মাইল পেরিয়ে কারমান লাইন ক্রস করে যাবে সনৎ- ওদিকটায় তন্ময় নেই, মন্টুর মা নেই, বিক্রম, প্রজ্ঞান, মিঠু - কেউ কোত্থাও থাকবে না। লম্বা শ্বাস নিল সে। আধ-খাওয়া লজেন্সের মত চাঁদ ঝুলে রয়েছে – “ভিলেন শালা”- হিসহিস করল সনৎ। ওর পায়ের আঙুলে ঠোক্কর দিয়ে গেল জলজ প্রাণী, ঝোপঝাড়ে সরসর শব্দ হল একটা। তারা খসল একটা। দুটো। সনৎ শিউরে উঠল। রাতের পুকুর থেকে আঁশটে গন্ধ উঠছে। মাঝপুকুরে ঘাই দিল মাছ। আর তখনই শেষরাতের আকাশের নিচে, পায়ের কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যু নিয়ে দাঁড়িয়ে সনতের খুব খিদে পেল। সকাল থেকে খাওয়া হয়নি – মন্টুর মা পাবদা মাছ রেঁধেছিল – দুপুরের ভাত এখনও ঢাকা দেওয়া – পড়ে রয়েছে। ফিরে গিয়ে আর একবার টিভি খুলবে? যদি বিক্রম সফট ল্যান্ডিং করে থাকে? যদি কমিউনিকেশন রি-এস্টাবলিশড হয়? হয়তো এতক্ষণে কে শিভান আঙুল তুলে বলছেন – কমিউনিকেশন রি-এসটাবলিশড। কমিউনিকেশন রি-এসটাবলিশড, কমিউনিকেশন রি-এসটাবলিশড – বিড়বিড় করল সনৎ, তারপর ঘাটের সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল। তখন অন্ধকার আকাশের নিচে পুকুরের জলে একটা দরজা খুলে গিয়েও আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। পাল্লার ফাঁক দিয়ে মুহূর্তের জন্য দেখা গিয়েছিল হেঁটমুণ্ড এক শহর, তার নিজস্ব আকাশ আর চাঁদ সমেত । সনৎ সে কথা জানল না। তার পিঠ পুকুরের দিকে ফেরানো ছিল। সে বাড়ির দিকে হাঁটছিল।

~*~

বোর্ডিং অ্যানাউন্সড হলে, বিনবিন করে যাত্রীরা ডিপার্চার গেটের সামনে জমা হচ্ছিল;  টার্মিনালের কাচ জানালার বাইরে রানওয়ের নীল, সবুজ, হলুদ আলো চোখ মটকাচ্ছিল তাদের,  রাতের উড়োজাহাজ  টেক অফ করছিল, কিম্বা ল্যাণ্ডিং লাইট জ্বেলে নেমে আসছিল পর পর;  নিকষ কালো আকাশ এয়ারপোর্টের আলোয় ঘন নীল আর তারাহীন দেখায়, ধাতব ডানা রাতের বাতাস কাটে,  গোঁ গোঁ আওয়াজ ওঠে- এই সব অনিবার্যতার মাঝে তাদের চোখ লেগে আসে,  ঘুমচোখে লাইনে দাঁড়িয়ে  তারা হাই তুলে চলে ক্রমাগত, চাপা গলায় কথা বলে মোবাইল আঁকড়ে, ফিসফিস করে-"ভালোবাসি"; তারপর, চোখ মুছে, “আসি তবে?” বলে ফোন অফ করে দেয়।  টার্মিনালের  আলোয় সবাই একরকম – শুকনো আর ধূসর খুব; পা টেনে টেনে যেন মানুষের ছায়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের সমস্ত গোপন আখ্যান এই শহরে গচ্ছিত রেখে উড়ে যাবে অন্য কোথাও।  শিকল পরা শহর তার পাখা ঝাপটায়, দু ডানায় লুফে নেয় সেই সব কথা, আগলে রাখে,  আর অপেক্ষা করে যেন সব গল্প ফিরিয়ে দেবে কোনো একদিন। রানওয়ে ছাড়িয়ে পেল্লায় বিলবোর্ডের তলায় একলা শহর হাঁটুতে মাথা রেখে বসে থাকে, ধুলো বালি কুয়াশায় সর্বাঙ্গ ঢাকা -  এলইডির আলোয় তাকে সেলোফেন মোড়া পরিত্যক্ত  উপহারের মতো দেখায় তখন। সরণিতে আলোগুলি জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে , রানওয়ে জুড়ে এরোপ্লেনরা ওঠে আর নামে-  ক্লান্ত লাগে তার ; সে হাই তোলে, আড়মোড়া ভেঙে ডানা গুটিয়ে ফেলে । তারপর ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগে জাদুকাঠি ছুঁইয়ে সেই সব গোপন কথাদের ভ্যানিশ করে দেয়।

 

(শেষ)

 

[২০১৯ এর বর্ষা এবং শরৎকালীন তিনটি বাস্তব ঘটনা এই আখ্যানের বীজ; যদিও সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক।]

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

পদ্মসম্ভব

কোলক্লিফ, ২০২৩