গল্পবায়োগ্রাফি
গল্পবায়োগ্রাফি
সব্যসাচী সরকারকবিতা আশ্রম
দামঃ ৩৭৫ টাকা
মণিপুর থেকে সাংবাদিক শ্রী সব্যসাচী সরকারের সরাসরি প্রতিবেদন সদ্যই পড়েছি। 'গল্পবায়োগ্রাফি' তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। বইয়ের গল্পগুলি ১৯৯৪ থেকে ২০১৬র মধ্যবর্তী সময়ে লেখা।
প্রথম গল্প 'নীরবপুর' যেখানে গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ নেই, হাসি কান্নার কোনো শব্দ নেই, শব্দহীন রিকশা চলাচল করে, মানুষজন এ ওর দিকে তাকিয়ে হাসে - তাতেই যেন সব বলা হয়ে যায়। পাখির ডাক, পায়ের শব্দ শোনা যায়। গল্পের শেষে হিয়া র জোরে হাসির শব্দ শুনি, হাত নেড়ে নীরবপুর থেকে বিদায় জানায় কথককে। পাঠকের ধন্দ লাগে - কথক কি মৃতজনের সঙ্গে দেখা করে ফিরছে না কি এ আদতে হৃদয়পুর, নিজের সঙ্গেই কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে আসছে কথক? এই ধন্দ বজায় থাকে 'মোহ' গল্পের ত্রিভুবন ও ব্রজগোপালের কথোপকথনে যেখানে রিক্শাওলা ত্রিভুবন ঘরের ভেতরে এক ঘর তৈরি করে, আর কেউ সে ঘরে আসতে যেতে পারবে না। ত্রিভুবন, তার স্ত্রী আর ব্রজগোপাল যেন আবার ঢুকে পড়ে 'শ্যাম্পেনের যুগীদর্শনে', ভিন্ননামে ভিন্নবেশে অবশ্যই, যেখানে শ্যাম্পেনদা কুপি জ্বালিয়ে নেতাজী মূর্তির কাছে স্ত্রী মায়ার ফিরে আসার অপেক্ষা নিয়ে পাহারায় বসে, যাতে কেউ সেখানে যুগী র মূর্তি বসাতে না পারে। 'আর্ট গ্যালারি' গল্পে যেই মুহূর্তে পাঠকের মনে হচ্ছে, আঙ্গিকের লম্বা ছায়া ভাবকে গ্রাস করে নিচ্ছে ঠিক তখনই, আশ্চর্য লাইন লেখা হচ্ছে আখ্যানে - "বর্ষার পরে যে রোদ কলকাতার আকাশে প্রাণ এনে দেয়, সেই আলোতে জলবিন্দু দুটোকে কোনো শিশুর চোখের মতো মনে হচ্ছিল... শৈলী আঙুল দিয়ে পিষে ফেলল জলবিন্দু, যাতে কেউ না দেখতে পায়।""কল্পতরু উপাখ্যানে" রেলস্টেশন হওয়ার গুজব ঘিরে মানুষের ছোটো ছোটো আশা আকাঙ্খা। অবিনাশ নামটি ঘুরে ফিরে আসে "সংশয়, সমীপেষু" তে, "প্রবহ মুহূর্তগুলি", "বিশুদ্ধ বিস্ময়", "পীতরহস্য', " নিয়তির স্বভাবচরিত্র' আখ্যানগুলিতে যে বস্তুত একলা মরণশীল সাধারণ মানুষ যার সমস্ত প্রার্থনায় এবং স্তবে আকাঙ্খা মিশে থাকে।
এই সংকলনের প্রতিটি গল্পের সমাপ্তি অনন্য - শ্লেষে বিষাদে অথবা আনন্দে। ধরুন "সাদা খুনের কাহিনী"র সমাপ্তিতে তে যেমন আদর্শবাদী মৃত যুবকের বিপরীতে পলাতক অথবা মুখ গুঁজে থাকা মানুষটি বলে ওঠে - "আমি শুধু একটা জিনিষ পেয়েছি। ভাবছি, দান করে যাব কাউকে। একপাটি বাঁধানো দাঁত। মানুষের জন্য। সে দাঁতটা দিয়ে যাব যাতে কেউ আখ চেবানোর মতো করে ব্যবস্থাটাকে চিবিয়ে দেয়। একবার অন্তত।"
এই বইতে কোনো ভূমিকা নেই, কোনো সূচিপত্র নেই, পাঠককে হাত ধরে গল্পের কাছে পৌঁছে দেওয়া নেই, যেন এক অচেনা বাড়ির বন্ধ দরজায় কড়া নেড়ে আশা ও আশঙ্কা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। ক্রমশ বুঝতে পারি, কড়া নাড়ার প্রয়োজনই ছিল না, মৃদু করাঘাতেই দরজা খুলে যাচ্ছে, উৎসর্গের পৃষ্ঠা উল্টোতেই গল্প নিজেই এসে হাত ধরছে পাঠকের, চিনিয়ে দিচ্ছে বাড়ির আনাচ কানাচ "শ্যাওলালাঞ্ছিত জানলা", দরজা বাগান ছাদ - সেই সব জানলা দিয়ে কানে আসছে 'শিল কাটাও', কুকুরের ডাক, ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছে দূরের রেলগাড়ি, বস্তির আগুন, "কঙ্কালের হাড়ের মতো ভোরের রং"।
Comments
Post a Comment