সলস্টিস

 সাপ তার ছেড়ে আসা খোলসে আর ঢোকে না। ঢুকতে পারে না।  সেই সব খোলস , শরীরের মাপের সঙ্গে মেলে না, কখনও গভীর ক্ষতচিহ্নও তাতে লেগে থাকে । স্নান সেরে পাঞ্জাবি গলাতে গিয়ে মনে হ'ল। পাটেপাটে ইস্ত্রি করা সাদা পাঞ্জাবিতে সব ক'টা বোতামই লাগানো ছিল;  তিনটে বোতাম খুলে মাথা গলাতেই কাঁধের দিকটা টাইট লাগল- টেনে টুনে বুক অবধি যাও বা গেল , পেটের দিকে নামতে গিয়ে পাঁজরে আটকালো। তখন আয়নায় তাকিয়ে দেখি, পাজামা পরা একটা আধবুড়ো শরীর; ফোলা পেট আর বুকের মাঝখানে আটকে থাকা পাঞ্জাবি ফাঁসতে শুরু করেছে-একটা সাপ যেন তার ছেড়ে যাওয়া খোলসে ঢুকতে যাচ্ছে আর ফেটে ফেটে তারপর গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে শুকনো সাদা চামড়া, আঁশ। খেয়াল করলাম, চশমার তলায় আমার চোখ সরু আর ছুঁচোলো - সাপ দেখলে যেমন হয়।  আসলে,একটা মানুষ কুকুর ভালোবাসে,  তারপর বিড়াল, গরু, ছাগল, খরগোশ, বাঁদর ,বাঘ, সিংহকে ভালোবেসে ফেলে;  কিন্তু, সাপ দেখলে, সে-ই  বদলে যায়- চোখ সরু আর ছুঁচোলো করে লাঠি খোঁজে তখন, কিম্বা আধলা ইঁট। চোখ সরিয়ে  সুটকেশ থেকে টি শার্ট বের করে পরলাম। এই দু বছরে বেশ মোটা হয়েছি। লকডাউনে বাড়িতে বসে কাজ, অনলাইন বাজার,  হাঁটা নেই চলা নেই - সর্বক্ষণ চেয়ারে; মনিটরে চোখ,  আর মুখ চলছে। কুচি আমার মোটা হওয়ার কথা জানত না-  দু'বছর আগের ছেড়ে যাওয়া পাজামা পাঞ্জাবি কেচে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে তুলে রেখে দিয়েছিল। ভিজে চুপ্পুস হয়ে বাড়ি ঢুকতেই তোয়ালে , পাজামা, পাঞ্জাবি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, " আগে স্নান করে নে "।

-ভর সন্ধ্যায় স্নান করব? মাথা মুছে চেঞ্জ করে নিলেই তো হয়-
-দিদা বলত , বৃষ্টিতে ভিজলেই স্নান করে নিতে হয়- মনে নেই? সেই যে তুই ফুটবল খেলে ফিরেছিলি, আমি নাচের স্কুল থেকে...
কুচি চুপ করে গেল। চোখ নামিয়ে নিলাম আমি। দেখলাম, দেওয়ালের তলার দিকে নোনা ধরেছে, লাল মেঝেতে ফাটা দাগ; সেই সব দাগ জুড়ে জুড়ে ছবি আঁকা যায়- জীবিত বা মৃত আত্মজন, পশু, পাখি, মেঘ। মুখ তুলে বললাম, " মিস্ত্রি লাগাতে হবে রে। দেওয়ালটা দেখেছিস?"
- বর্ষাটা কাটুক, তারপর।

বস্তুত মৌসুমী বায়ু পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে কাঁটায় কাঁটায় পয়লা আষাঢ়, ষোলই জুন। আজ বাইশ। কাল খুব ভোরে  দিল্লি থেকে  রওনা হয়েছিলাম - এন এইচ নাইনটিন ধরে টানা চালিয়েছি;  রাতে ঘন্টা পাঁচেক ঘুমিয়ে নিলাম গাড়িতেই; শুয়ে শুয়ে রেডিওর নব ঘোরাচ্ছিলাম, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে  আগামী পাঁচ দিন ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা - এফ এমে বলছিল। আজ  যখন ধানবাদ ক্রস করছি- সকাল হচ্ছে, হালকা কমলা আকাশ রং বদলাতে শুরু করল- হলদে হয়ে পাঁশুটে ,  ঝেঁপে  বৃষ্টি  শুরু হতেই ধূসর , তারপর একদম পিচ ডার্ক। গুমগুম আওয়াজ উঠছিল গোটা আকাশ জুড়ে যেন কংক্রীটের মেঝেতে শয়ে শয়ে ভারি ডাম্বেল গড়িয়ে যাচ্ছে।  অন্ধকার আকাশ থেকে জলে বোনা ঝুলন্ত চাদর নেমে এসেছিল চোখের সামনে; হেডলাইট, ওয়াইপার  অন করে স্পীড কমিয়ে দিলাম -  এই ভাবে চালালে পৌঁছতে  রাত  হয়ে যাবে, শিয়োর। 
আসানসোল আর দুর্গাপুরের মাঝখানে একটা স্ট্রেচ আচমকা শুকনো পেয়ে স্পীড তুলেছিলাম;  বিশাল বিশাল জলভরা বেলুন নিয়ে আকাশ  এখানেও মোটামুটি রেডি, সাদা জামা পরা শুকনো মানুষজন  দেখলেই ছুঁড়তে শুরু করবে ; কালো অ্যাসফল্টে  সেই সব সুযোগসন্ধানী মেঘেদের ছায়া  -  ভেজা টায়ারের দাগ  ভূতুড়ে দেখাচ্ছিল তাতে,  আলো কমে আসছিল ক্রমশ।

দু'বছর বাড়ি আসি নি কোভিডের অজুহাতে। বাড়িও  ফাঁকা হয়ে গেছে এই সময়ে- কুচি এখন  একাই থাকে। আরতিদি পুরোনো লোক,  সকাল -বিকেল এসে ধোয়া কাচা করে দিয়ে যায়। রাতেও থাকতে চেয়েছিল- কুচি ওকে না বলে দিয়েছে। এসবই কুচি আমাকে ফোনে বলেছিল।  আসলে, শেষবার যখন বাড়ি আসি, বাবাকে  উইল করতে বলেছিলাম - একটা ঘর, বাথরুম আমার জন্য রেখে বাকিটা কুচির নামে লিখে দিক। বাবা বলেছিল, 'কুচি-ই  তো আমাকে দেখছে,  খুব যত্ন করে,  বুঝলি? এই মেয়েটা না থাকলে আমার যে কী দশা হ'ত! পুরো বাড়ি কুচির নামে লিখে দেব।' আমি গলা তুলেছিলাম, ' আমি এলে থাকব কোথায়?'
-কুচি কি তোকে থাকতে দেবে না?
"দেবে। কিন্তু পরে ওর যদি সংসার টংসার হয়, তবে..." , শেষের দিকে আমার গলা বালি-কাগজের মত হয়ে গিয়েছিল, যেন পুরোনো সব রঙ ঘষে ঘষে তুলে ফেলবে এখনই ।
-কুচির সংসারে তুই আসবিই বা কেন?
-বাঃ বাড়ি আসব না আমি? কলকাতায় আমার থাকার জায়গা কোথায়?
আমি কোনদিনই  গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, সেদিনও পারছিলাম না , গলা চড়িয়েছিলাম অকারণ - "একটা ঘর আর বাথরুমই তো। এ'বাড়িতে এটুকুও থাকবে না আমার?" বাবাও কী জানি কেন, খুব জেদ করছিল। তারপর কাশতে লাগল। কুচি  জল নিয়ে ঘরে এসে বলল," দাদা তুই ঘরে যা। আমি মামাকে বোঝাব। এ বাড়ি তোর, আমার কিছু চাই না। " বাবা জল খেয়ে আমার দিকে চোখ সরু করে তাকাল , আধলা ইঁট খুঁজছিল সম্ভবত; তারপর চেঁচিয়ে উঠল, "তুই এলেই সমস্যা। কেন আসিস?  দিদি ঠিকই বলত।"

দিদি মানে কুচির মা, আমার পিসি। জানি না কী বলত পিসি। তবে তপন বলত স্পষ্ট করে- " তোর কমিউনিকেশন স্কিল জিরো মাইরি। জিরো-ও নয়। নেগেটিভ পুরো। লাইফে চাপ নামবে তোর, দেখিস।  ঐ দ্যাখ, ঐ মেয়েটা, ঐ যে শিল্পী, আচ্ছা মেয়ে বাদ দে, ঐ দ্যাখ হাসি হাসি মুখে মৃন্ময় যাচ্ছে, ফার্স্ট হয়েছে, সবাই হ্যান্ডশেক  করছে, নিদেনপক্ষে, পিঠে চাপড়, তুই যা দেখি একবার , কনগ্র্যাচুলেট করে আয়-"
-খামোকা কনগ্র্যাচুলেট করতে যাবো কেন?  পড়াশোনা করেছে, খেটেছে, ফার্স্ট হয়েছে।
-দেখলি তো তোর প্রবলেম টা কী?
-কী?
-কমিউনিকেট করতে পারিস না-
- কী আবার কমিউনিকেট করব!
-যা বললি, সেটাই-
-এ’ আবার বলার কী আছে, মৃন্ময় নিজেই জানে-
-দ্যাখ ভাই, এ দুনিয়ায় থাকতে গেলে এই এক্স্ট্রা কথা বলতেই হয়-
-বলতেই হয়?
- হ্যাঁ বলতেই হয়, নইলে কী হয় জানিস?
- না। কী?
- ধর, পরের সেমে মৃন্ময়ের  রেজাল্ট খারাপ হল-
- যত্তো ইমাজিনারি সিচুয়েশন ভাই-
- শোন না। মনে কর, ওর রেজাল্ট খারাপ হল, হয়তো ফ্যামিলি প্রবলেম বা অসুখ বিসুখ, কেউ ল্যাং মারলো- হতে তো পারে , আর ও পরীক্ষায় ছড়ালো- কী হবে জানিস?
-তোর হাতে প্রচুর টাইম, আটভাট বকছিস। কী আবার হবে?
-অনেকে খুশি হবে। ধরে নে, এই আজ এই যারা ওর পিঠ চাপড়াচ্ছে, সব্বাই খুশি হবে। কিন্তু তোর কষ্ট হবে-
-মাইন্ড রীডার  হ'লি নাকি? টিয়াপাখি নিয়ে বসগে যা-
-এবার তুই হয়তো দেখলি মৃন্ময় মনমরা হয়ে বসে আছে, তোর খারাপ লাগলো, তুই বলতে গেলি-  কৈ বাত নেহি, পরের সেমে  ফাটিয়ে দিবি শ্লা-
- হ্যাঁ, তো?
- মৃন্ময় তোর কথা বিশ্বাস করবে না। যারা মুখে চুক চুক করছে মনে মনে খুশি, ও তাদেরই ইয়ে ভাববে, সমব্যথী আর কী- তোকে  হিংসুটে বলে চিনবে-
-কেন?
-ভালো দিনে মানে এই ফার্স্ট হওয়ার দিনে, কোনো কথা বলিস নি অথচ খারাপ দিনে ..
-কী জটিল বে!
-এইটাই লাইফ। এখন থেকে শেখ। নইলে পস্তাবি । কাউকে ভালোবাসতে গেলে, সে ভাববে তাকে খুন করতে আসছিস..
-যাঃ যত্তো ফালতু-
মৃন্ময় এখন অ্যামেরিকা- রেজাল্ট টসকায় নি কোনোদিন। শালা  তপনও ওখানেই।  আমিও ছিলাম। ডিভোর্সের খবর পেয়ে ফোন করেছিল তপন, বলল, "জানতাম, শালা। তোর দ্বারা হবে না।"
আমিও জানি এখন। বাবা বলেছিল, আমি এলেই সমস্যা। আসলে আমিই সমস্যা।
তপন আমাকে ঠিক চিনেছিল। সাবধান করে দিয়েছিল। পাশে থাকে নি। থাকার কথা ছিল না। আমিই বা কার পাশে থেকেছি কবে? কিন্তু কুচি ছিল। বরাবর। বাবার উদ্দাম ঠ্যাঙানি খেয়ে অন্ধকার ঘরে বসে আছি, রাতের খাওয়া বন্ধ; ছোট্টো কুচি গুটগুট করে এসে বলল-"দাদা কাঁদছিস? কেক খাবি? মুখ খোল"। ঐটুকু তো মুঠি। খাবলা দিয়ে টিফিন কেক এনেছে, ঘামে ভিজে মুঠির চাপে সে কেক তখন গুঁড়োগুঁড়ো।  ঘরে লাইট জ্বালিয়েছিল কুচি।
-অন্ধকারে  বসে থাকে না-
কেকের গুঁড়োয় আমার মুখ ভর্তি, গেঞ্জিতে , মেঝেয় কেকের গুঁড়ো। একটা দুটো পিঁপড়ে আসতে শুরু করেছে। 
-খা দাদা, খেয়ে নে।


দুর্গাপুর পেরোতে , বৃষ্টির তোড়ে বাকি আলোটুকু ধুয়ে যাচ্ছিল। পিচরাস্তায়  ঠিকরে ওঠা বৃষ্টি এ গাড়ি, ও গাড়ির টায়ারে ছোটাছুটি করছিল, জলবিন্দুরা কুয়াশার মত আবরণ তৈরি করছিল , সামনের গাড়ির লাল টেললাইট ফলো করে এগোতে হচ্ছিল বড় সাবধানে। একটা একজিট নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম শুনশান গলিতে।  এফ এম বন্ধ করে দিলে এখন শুধু মেটাল বডি আর জলের ঠোকাঠুকি, ওয়াইপারের সুইশ সোয়াশ, সুইশ সোয়াশ  আর রেনওয়াটার পাইপ থেকে গবগব করে জল বেরোনোর ননস্টপ আওয়াজ।  লাল, হলুদ, নীল, সবুজ একতলা, দোতলা, তিনতলা বাড়ির দেওয়াল বেয়ে জল নামছিল  নিঃশব্দে, গড়ানো ঢালের গলি বেয়ে বড় রাস্তায় পড়ছিল। ওদিকের দেওয়াল ঘেঁষে একটা শেড, তার পাশে আগাগোড়া প্লাস্টিক ঢাকা ঠ্যালাগাড়ি-  ট্রেনে কাটা পড়া ডেডবডি যেন। শিউলিদের গলির কথা মনে হ'ল।

এক বৈশাখের দুপুরে,  মা যখন মারা যাচ্ছিল, আমি তখন শিউলির সঙ্গে উদ্দাম প্রেম করছি ওদের বাড়িতে। মা বহুবছর শয্যাশায়ী- সেদিন সকাল থেকেই হেঁচকি উঠছিল; পিসি বলছিল, "আজ আর কলেজ যাস না ";  আর আমি অ্যাভয়েড করতে চাইছিলাম মা'র মরে যাওয়ার টাইমটা, লোকজন, কান্না, বল হরি হরিবোল; কলেজ শব্দটা লুফে নিয়ে বলেছিলাম, " আজ পরীক্ষা, যেতেই হবে"। প্রথমে কলেজ, তারপর শিউলির সঙ্গে ওর বাড়ি। ওকে আঁকড়ে ধরে , শরীর ঘষেছি যেন বালির স্তুপে উটপাখি। তখন মোবাইল ছিল না- রক্ষে। কলেজের অফিসে ফোন করেছিল বাড়ি থেকে- পরীক্ষার ভাঁওতাবাজি বুঝে গিয়েছিল। বালি টালি ঝেড়ে , অনেক রাতে  ফিরেছিলাম, মা ততক্ষণে পুড়ে গিয়েছে। সবাই চোখ সরু করে তাকিয়েছিল-  আলজিভের কাছাকাছি আমার বিষদাঁত দেখা যাচ্ছিল সম্ভবত। টানা তিনদিন কথা বলে নি বাবা, পিসি। কুচি এক বাটি  মুড়ি আর  শশা নিয়ে এসেছিল  আমার ঘরে, সকালবেলা, "তোর বড্ড নরম মন, দাদা, তুই পালিয়ে  গিয়েছিলি;  ওরা তোকে ভুল বুঝেছে। খেয়ে নে । খা দাদা। মামার কাছে গিয়ে দাঁড়া। অনেক কাজ সামনে।"
শিউলির সঙ্গে  আমার সম্পর্ক টেঁকে নি- কাটা পড়ে ডেডবডি হয়ে গিয়েছিল ;  মার শ্রাদ্ধের পরে কলেজ গিয়ে দেখলাম শিউলির  চোখ সরু আর ছুঁচোলো- আসলে,  মা'র মৃত্যুর দিনক্ষণ ওর কানে এসেছিল। 
মাধুরীর সঙ্গে আমার বিয়ের দিন, কুচি তত্ত্বের মাছাভাজা খাইয়ে গিয়েছিল- "না খেয়ে অতক্ষণ থাকতেই পারবি না। খেয়ে নে দাদা। " তারপর একটু থেমে বলেছিল, " শিউলিদি তোকে বুঝতে পারে নি, বৌদি ঠিক পারবে। খুব সুখী হবি তুই দাদা। "

বৃষ্টি সামান্য ধরেছে। গলির পিছনের বাড়ি থেকে একটা অল্টো বেরোবে- হর্ন দিচ্ছিল। ঠেলাগাড়ির পাশ কাটিয়ে বড় রাস্তায় পড়ে হাইওয়ের দিকে টার্ন নিলাম। ট্রাফিকে আটকে আছি; সিগনাল রং পাল্টাচ্ছিল- লাল থেকে হলুদ হয়ে সবুজ হতেই গাড়ির লাইন এগোল নতমুখী পিঁপড়ের সারির মতো। সবুজ আবার যখন  হলুদ হয়ে লাল হয়েছে,  সামনের দুটো গাড়িতে  ছোটো করে ধাক্কা লাগল। গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল দু'জন - হাতা গুটিয়ে পরস্পরের দিকে এগোলো; গন্ডগোল পেকে উঠছিল ঝড়জলের রাস্তায়। সাইড মিররে দেখছিলাম, পিছনের গাড়ি লেন চেঞ্জ করছে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম-  রিভার্সে গিয়ে, লেন চেঞ্জ করতে হবে;  রিভার্স করতে এখনও ভয় পাই।
স্টেটসে তখন মাধুরী, আমি, বিল্টু। বিল্টুর তিন সবে। অফিস মায়া করে দুপুর দুপুর বাড়ি এসেছি। রিভার্সে গাড়ি ঢোকাচ্ছিলাম । মাধুরীকে সারপ্রাইজ দেওয়ার ছিল- অস্থির ছিলাম, উত্তেজিতও। মিরর দেখি নি।  বিল্টুর চিৎকার, নেবারের হাঁ হাঁ করে ছুটে আসায় ঘাবড়ে গিয়েছি। বিল চেঁচিয়েছিল, 'হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান ম্যান? কান্ট ইউ সী?" হৃদপিণ্ড লাফ দিয়ে গলায় ঠেকেছিল- বিল্টুর পায়ের ওপর গাড়ি চালিয়ে  দিয়েছি;  ভর দুপুরে বাড়ির বাইরে কী করছিল ছেলেটা!  'স্টপ স্টপ ডোন্ট মুভ ' বলতে বলতে বিল ছুটে আসে, আর ওর বৌ জেনিফার; উল্টোদিকের  বাড়ির টোনি।  " ইউ আর লাকি ম্যান" বিল্টুকে কোলে তুলে নেয় টোনি, কপালে বুকে যোগ চিহ্ন এঁকে বলেছিল - " প্রভু যীশুর কৃপায় সফ্ট টিসু ছুঁয়ে গেছে। আর একটু হলেই হয়েছিল। এনিওয়ে,  লেট্স টেক হিম টু ইমার্জেন্সি।  এক্স রে তো করতেই হবে। পেনকিলার লাগবে।  আর ইউ ব্লাইন্ড, হে?"  বিল্টু তারস্বরে কেঁদে যাচ্ছিল। ঘামে ভিজে গিয়েছিল  শার্ট, পেট মুচড়ে উঠেছিল;  বাথরুমে গেলে হাসপাতালে যেতে দেরি হয়ে যাবে- আরো ঘামছিলাম ফলত।  হাত কাঁপছিল। বিল বলেছিল, "আমি চালাচ্ছি, তুমি বিল্টুকে নিয়ে পিছনে বোসো। "
এই সময় দরজা খুলে এসে দাঁড়িয়েছিল মাধুরী; ও চোখ কচলালো, এদিক ওদিক তাকালো, ওর চোখ আরো বড় হল যেন সকেট থেকে এক্ষুণি ছিটকে বেরিয়ে আসবে। বিল বলল, "মাধুরীকে নিয়ে এসো, ও যাবে না সঙ্গে?" বিল্টুকে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেছি,  মাধুরীর দিকে এগোচ্ছি, ;  আমার সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা, বিল্টু অক্লান্ত চেঁচাচ্ছে, ওর পায়ের পাতার রং লালচে থেকে বেগুণী হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, তখন , ভরা বিকেলের আলোয় স্পষ্ট দেখেছিলাম, মাধুরীর চোখ বদলে যাচ্ছে, বিস্ফার কমে গিয়ে সরু হ'ল , তারপর ছুঁচোলো।


বাড়ি ঢুকতে রাত। সরু গলিতে গাড়ি ঢোকে না, বড় রাস্তা থেকে এ'টুকু দৌড়ে আসতে আসতে ভিজে একসা;  কুচি বলল, " একটা ফোন করতি, ছাতা নিয়ে যেতাম-" , তারপর স্নান করে নিতে বলেছিল।  ছেঁড়া পাঞ্জাবি বিনে ফেলে টি-শার্ট পরতে পরতেই , কুচি ডাকল, " খেয়ে নিবি আয়। সেই কখন বেরিয়েছিস। খিদে পায় নি?"
নিচের বড় ঘরে খেতে বসেছিলাম আমি আর কুচি।  টিভির খবরে বৃষ্টির কথা বলছিল। স্ক্রীন জুড়ে,  জলে ডোবা পথঘাট, ভেঙে পড়া গাছ, পুরোনো বাড়ির বারান্দা ধসে পড়েছে;  খবর চলতে চলতেই, বাইরে, দু বার বাজ পড়ল বিকট আওয়াজ করে- কুচিকে কেঁপে উঠতে দেখলাম।  ডানদিকের জানলা নিয়ে জোলো হাওয়া আর বৃষ্টির আওয়াজ ঢুকছিল। পুরোনো গ্রিল থেকে মরচের গন্ধ  মিশে যাচ্ছিল তাতে।কুচি আঁচল টানল গায়ে, “জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি, দাঁড়া। “
দুর্যোগের জন্য গোটা পাড়া নিঝ্ঝুম  - একটা কুকুরও ডাকছিল না কোথাও। আশেপাশের বাড়ির টিভির শব্দ , ঝগড়ার আওয়াজ, রাস্তায়  রিক্সার হর্ন  -কিচ্ছু নেই। যেন , বাইরের পৃথিবী ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে  গেছে। জানলা বন্ধ করে দিতে,  বৃষ্টির আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল না। দেওয়ালে দেওয়ালে এ ‘বাড়ির মৃত মানুষদের ছবি, শুকনো মালা ঝুলছিল তাতে-  জলবেষ্টিত দ্বীপের মত লাগছিল খাওয়ার ঘরকে , যেন এক  জাহাজডুবির পর,  আমি আর কুচি এই দ্বীপে এসে উঠেছি - পৃথিবীর শেষ  দুইজন জীবিত প্রাণী। টুকটাক কথা, তারপর আবার  মাথা নামিয়ে নিঃশব্দে খাচ্ছি আমরা-  পাঁউরুটির ফাঁক ফোকরের মতো, এই সব নীরবতার বড় বড় ছ্যাঁদা একটা শেপ নিয়ে নিচ্ছিল ক্রমশ,  তার ছায়া পড়ছিল নোনা ধরা দেওয়ালে।
আমি উশখুশ করছিলাম, " সত্যি তোর ভয় করে না কুচি? আরতিদিকে রাতে থাকতে বললেই পারতি।"
-দরকার নেই। রাতটুকুই তো। সকাল হলেই তো চলে আসে।
-আজ তো আসে নি বললি-
-সে তো বৃষ্টির জন্য, এই রকম বৃষ্টি চললে কালও হয়তো আসবে না
-এখন চারদিন এরকমই চলবে-
"  তুই তো আছিস ক'দিন, আছিস তো?" কুর্চি হাসল," তাহলে আর ভয় কী?"
মাথা নামিয়ে ফলফুল আঁকা টেবিল ক্লথ, চিনেমাটির  থালা, বাটি দেখতে লাগলাম। কুচি উঠে গিয়ে জলের জাগ ভরে আনল। গুচ্ছের রান্না করেছে- পটল ভাজা, মোচার ঘন্ট, মাছ, চিকেন, চাটনি।
-এই বাদলায় এত সব রান্না করতে গেলি কেন? বাজার করলি কী করে?
-ওমা, আজ বাজার করেছি না কি? আরতিদি করে দিয়ে গেছে কাল । আজ সকালে চঞ্চল চিকেনটা দিয়ে গেল শুধু-
-কে চঞ্চল?
-ঐ তো গলির মুখের বাড়ি,  তোর দু ব্যাচ পরের ছেলেটা। ভালো ক্রিকেট খেলতো, মনে নেই?
"সে কেন চিকেন এনে দিতে গেল তোকে?"  - আমার গলায় খসখসে ভাব এসে গেল । অটোম্যাটিক।
"ওকে বলেছিলাম এনে দিতে" কুচি রুটি ছিঁড়তে  ছিঁড়তে চোখ তুলেছিল- ওর  রোগা ফরসা মুখ; কালচে বাদামী মণিতে টিভির নীল আলো।
"ওকে মানে চঞ্চলকে? তোর বন্ধু না কি ও ও করে বলছিস? বাইরের লোককে বলতেই বা যাবি কেন, আরতিদি থাকতে?  আর,  দোকানে ফোন করলেও তো দিয়ে যেত",  আমার গলা চড়ে গিয়েছিল সামান্য।
কুচি উঠে গিয়ে জানলা খুলে দিয়ে এল -" গুমোট লাগছে।"
বৃষ্টির আওয়াজ আবার ঘরে ঢুকতেই আমি গলা নামিয়ে ফেললাম,  যেন বৃষ্টি আমার  দিকে চোখ সরু করে তাকাবে এখনই।  কুচি গায়ে আঁচল টেনে থালায় আঁকিবুঁকি কাটল কিছুক্ষণ, তারপর মুরগীর ঝোলে রুটির টুকরো  ডোবালো। আমি চাটনির ছোটো বাটিতে চুমুক দিচ্ছিলাম । খাওয়ার বাকি সময়টুকু আমরা বন্যা পরিস্থিতি আলোচনা করলাম গলা নামিয়ে।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বাথরুমে গিয়েছিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল সেই একভাবে, অঝোরে। দমকা হাওয়ায় নারকেল গাছের মাথা নড়ছিল-  জানলা দিয়ে দেখলাম । জল খেয়ে আবার শুয়েছি, দরজায় টোকা । লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখি কুচির উস্কোখুস্কো চুল , গালে একটা সাদাটে দাগ-নুনের মনে হ'ল।
-কী রে কুচি, কী হয়েছে?
-কিছু না। তুই আলো জ্বালালি দেখলাম।  ঘুম আসছে না? কিছু লাগবে?
-ক্কী? কী আবার লাগবে?
-এত কম খেলি। খিদে পাচ্ছে?
"পাগল না কী! এই বয়সে মাঝরাত্তিরে কারোর খিদে পায়?" আমি হাসার চেষ্টা করলাম।
কুচি দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,  বুড়ো আঙুল ঘষছিল মাটিতে;  গলায় আঁচল জড়ানো- বরাবর ঠান্ডা লাগার ধাত। রোগা মুখ, পাতলা ঠোঁট, নাক, ভীতু চোখ। কেমন মরিয়ার মত গলা তুলল কুচি , " তুই কেন এসেছিস এ’বাড়িতে , এতদিন পরে? বললি না তো!"
এই সময়ে বিদ্যুৎ চমকেছিল, বাজ পড়েছিল জোরে;  নীল আলোয় আমার চোখ কুঁচকে গেল।
কুচির কথা জানি না। আমি নিজেকে খোলসে ঢুকিয়ে নিচ্ছিলাম- চামড়া ছিঁড়ে যাচ্ছিল। লাল মেঝেয় ছেঁড়া খোলসের টুকরো মাড়িয়ে সদর খুলে বেরিয়ে এলাম গাড়ির চাবি নিয়ে। গলির মুখে দাঁড়িয়ে গাড়িটা ভিজছিল - যেন তার সওয়ার পদাতিক হয়ে যুদ্ধে গিয়েছে, ফিরবে কী না ঠিক নেই; এঞ্জিন চালু করতেই কেশর ঝাঁকিয়ে গা ঝাড়া দিল।  কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলাম। রাস্তার জমা জলে কিছু গাড়ি থেমে ছিল। জলের ফোয়ারা তুলে বেরিয়ে আসছিল কেউ । দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের মুখে নিজস্ব জলপ্রপাত তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমাদের সবার। কেউ নির্জনতা খুঁজেছিল সেখানে , অন্যরা তাকে বিপজ্জনক ভেবেছিল।

[প্রথম প্রকাশঃ যতি, ২০২২]

Comments

  1. গল্পগুলো ব্লগে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভালো করেছেন, ইন্দ্রাণী। পাঠকদের পক্ষে সুবিধে। আসব নিয়মিত।

    ReplyDelete
  2. আস্তে আস্তে বাকি সব তুলব। নতুন পুরোনো সব।
    অবান্তর আমার অনুপ্রেরণা..

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩