মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত

 

পাহাড়তলির ছোটো শহরে এত গরম বহুদিন পড়ে নি।  ঝলসানো আকাশে কোনো মেঘ নেই, রং নেই; কাক, চিল, ঘুড়ি ওড়ে না;  নিচে ছোটো পাহাড়, নদী, জনপদ- স্কুল, কলেজ, হাট বাজার, স্টেশন, হাসপাতাল।  চৌমাথা পেরিয়ে নেতাজির পুরোনো বাস্ট,  তারপর সরু রাস্তা,  পাশাপাশি দুটো বাড়ি, একচিলতে জমি , ছোটো বাগান - গাছপালা রোদের তাতে নেতিয়ে , পাতা কুঁকড়ে কালচে, ফুল শুকিয়ে পুরোনো ছেঁড়া কাগজের মত দেখাচ্ছে। 
দু'দিন হ'ল বাইরে বেরোন অসম্ভব- ফোরকাস্ট  ছিলই, খবরের কাগজে, টিভিতে  বলছিল টেম্পারেচর চল্লিশ ছুঁয়েছে; আমার তো মনে হচ্ছে  আরো বেশি - পঞ্চাশ টঞ্চাশ- যাতে আগাপাশতলা ঝলসে যায় একটা মানুষ । জ্বালা করছিল, চিটপিট করছিল শরীর। সন্ধ্যায় নদীর দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস আসে একটা;  আসছিলও বরাবরের মত,  কিন্তু মানুষজনের  যা অবস্থা- নদী টদি দিয়ে হবে না , উত্তরমেরু থেকে হাওয়া আসা দরকার - একদম ডাইরেক্ট।  সকাল থেকেই রোদের তাতে মাথা ঝিমঝিম করে, একটু বেলায় ছাতা , সানগ্লাস নিয়ে অফিস যেতে চোখে সর্ষেফুল দেখি ।  আজ অবশ্য রবিবার। 

এই গরমে আজ পাড়াতেই দু’দুটো বিয়ে। মৃদুলা কী সব গিফট টিফট কিনে এনেছে চন্দ্রাদের সঙ্গে গিয়ে। তারপর ঘ্যান ঘ্যান:  কী পরে যাই এত গরম,  তারপর তুমি কী পরবে  হ্যানা ত্যানা- যেও না তবে কে যেতে বলেছে; আজও খেতে বসে সেই একই কথা- ধুস,  দুপুরের ভাত ফেলে উঠে পড়লাম- "যাবো না বিয়ে বাড়ি। যেতে হয় তুমি যাও। চন্দ্রারা তো যাচ্ছে, যাচ্ছে না?  ওদের সঙ্গে চলে যাও"।  চন্দ্রা আর সুবিমল আমাদের  একেবারে নেক্স্ট ডোর নেবার যাকে বলে। অনেকদিন এই পাড়ায়। মৃদুলার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব।  আমার সঙ্গেও ভালই জমে। ওদেরও কোনো ছানাপোনা নেই, বাগানের শখও আছে ।  মৃদুলা প্রায়ই যায় ওদের বাড়ি, আমি দূর থেকে দেখি - কী রকম  মনে হয়, আমাদের বাড়িটাও ও’রকম হতে পারত- যেন গলির ওদিকে অন্য জগত  আর ওদের বাড়িটা আমাদের বাড়ির একটা ভার্চুয়াল ইমেজ - স্থির জলে প্রতিবিম্বর মত লাগে- বেশি কাছে গেলে  নড়ে চড়ে সব ভেঙে যাবে যেন। জাস্ট একটু আগেই জানলা দিয়ে দেখছিলাম,  এই গরমেও ওদের বাগান দিব্যি রয়েছে, আমাদের মত নয়, বেল ফুল টুল  ফুটেছে টবে। কিছু খাটে মাইরি  বাগানের পিছনে - দুজনেই। ওদের বাড়ির ভেতরটাও ঠান্ডা ঠান্ডা- বহুত শান্তি -বোঝা যায়। আমাদের শালা ….  আজ খাওয়া অবধি হ'ল না। তো, এই সব টাইমে বাগানের কাজ  করলে মাথা ঠান্ডা হয় - ফুলের চারা বসাই, সার টার দিই-  তা, বাগানেরও কী হাল!  এই সকালে জল টল দিয়ে বেরোচ্ছি- মাটিতে জল পড়তেই শোঁ শোঁ করে টেনে নিচ্ছে মাটি , বাড়ি ফিরে দেখছি  আবার যে কে সেই - শুকনো খটখটে মাটি ফেটে চৌচির।  মৃদুলার রোজ এক কথা, "চন্দ্রাদের তো এরকম হয় না,  তুমি সবেতেই অকর্মা-  কিছুই পার না"।পারি না তো পারি না, তুমি লেকচার না কপচে বাগান কর না, মাটি কোপাও, সার দাও, বালতি টেনে টেনে জল দাও- কে বারণ করেছে! তারপর দেখি কত ছাপান্ন ইঞ্চি  গোলাপ ফলাও! এ’ আর সহ্য হয় না- 
বাই দ্য ওয়ে,  সেদিন একটা মিউজিক ভিডিও দেখছিলাম ইউ টিউবে- রবীন্দ্রসঙ্গীত-  সে আমার গোপন কথার সঙ্গে ক্লারিনেট বাজছিল - মাঝখানে হঠাৎ থেমে গেল- সে যেন আসবের জায়গাটায়- একদম  আনএক্সপেক্টেড,  তারপর  শেষটুকু মৃদঙ্গ- ভেতরটা কেঁপে উঠল কীরকম;  মনে হ'ল আমাদের এই এত বছরের তাবৎ অশান্তি হয়তো এমনই আচমকা থেমে যাবে-
মৃদুলা কে ফরোয়ার্ড করেছিলাম ভিডিওটা- কিস্যু বলল না- দেখেই নি সম্ভবত,  ডিলীট করে দিয়েছে ।

নিজেরাই বিয়ে করেছিলাম, ভালোবেসে। অন্তত তাই তো মনে হয়েছিল। এক পাড়ার ছেলে মেয়ে - প্রেম টেম করার জায়গা ছিল না বিশেষ,  চারদিকে চেনা কাকা , মামা, পিসে গিজগিজ করছে;  তো, ওকে প্রথম চুমু খেয়েছিলাম একটা পুকুরের মধ্যে। মানে, শুকনো পুকুর আর কী-  পুকুর বুজিয়ে বাড়ি টাড়ি উঠছিল চার দিকে- এই পুকুরটার জল পাম্প করে বের করেছে সবে;   সন্ধ্যেবেলা, আশেপাশে বিল্ডার প্রোমোটারদের লোক নেই, শুকনো পুকুরটা ঠা ঠা করছে- মৃদুলার হাত ধরে নেমে গিয়েছিলাম পুকুরের একদম মাঝখানে - রাস্তা থেকে কেউ আমাদের দেখতে পাচ্ছিল না- জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলাম, অনেকক্ষণ। 
মৃদুলা বলেছিল- "কিছু একটা মিসিং- কী বল তো?"  তারপর নিজেই বলেছিল- " জলে প্রতিবিম্ব। নিদেন পক্ষে শুকনো মাঠে  ছায়া। ভূত ভূত লাগছে।"
একটা লরি মাটি টাটি নিয়ে আসছিল- জোরালো হেড লাইট চোখে পড়তেই আমরা ছুট দি। চড়াই বেয়ে উঠতে হল কতখানি-হাঁফাতে হাঁফাতে যেন খাবি খাচ্ছিলাম দুজনে। বড় রাস্তায় উঠে মৃদুলা একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলঃ
-মানি ক বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাওয়ার সময় হাত তুলে লেখার ভঙ্গি করেছিলেন, জানো?
-পড়েছিলাম, মনে হয়। সত্যি ?
-আমিও কোথাও একটা পড়েছি। এখন মনে পড়ল।সত্যিকারের প্যাশন বলো, প্রেম বলো, ভালবাসা বলো- আমৃত্যু থেকেই যায়, না?
আজকাল মাঝে মাঝে  স্বপ্ন দেখি,  শুকনো পুকুরে একলা দাঁড়িয়ে আমি- আচমকা জল উঠতে শুরু করল  মাটির তলা থেকে- প্রথমে বুঝতেই পারি নি- হঠাৎ খেয়াল হল পাজামা ভিজে যাচ্ছে। এদিকে আমার পা যেন মাটিতে গাঁথা, নড়তে চড়তে পারছি না- অথচ জল উঠছে- কনকনে ঠান্ডা জল হাঁটু, কোমর, বুক , কাঁধ,  গলা ছাড়িয়ে মাথার  ওপর। আমি হাত তুলছি- নাড়াচ্ছি প্রাণপণ -হেল্প হেল্প বলে চীৎকার করছি-


আজও চরম অশান্তি হ'ল। বিয়েবাড়ি টাড়ি সব ক্যানসেলড। কেউই খেলাম না দুপুরে। টেবিলে এখনও সব ছত্রখান হয়ে পড়ে আছে- থাক।   কেন যে রয়েছি একসঙ্গে সেটাই বুঝি না- এসপার উসপার কিছু একটা হয়ে যাক ভেবে দুজনেই দাঁতে দাঁত  ঘষেছি  কতবার । তারপর সম্ভবত মেনে নিয়েছি  একসময়। ঝগড়া,  অশান্তি আমাদের সংসারে বহুদিন অঙ্গাঙ্গী; জলের ট্যাঙ্কের তলায় শ্যাওলা যেমন , অথবা কাপড় শুকোনোর দড়িতে মরচে ধরা ভাঙা ক্লিপ, কিম্বা ফ্যানের ব্লেডের  কালো লম্বা ঝুলটুলের মত- প্রথমে ঘষে ঘষে পরিস্কারের চেষ্টা ,তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে মেনে নেওয়া; ছোটো চারাগাছ, ফুল, সার, জল,  আর টবের গাছপালা দিয়ে সেই সব শ্যাওলা , মরচেকে সামান্য আড়াল- আবডাল;  বসার ঘরে ডোকরা, বাঁকুড়ার ঘোড়া, অ্যাকুয়ারিয়ামের গোল্ড ফিশ টিশ এই সব। ভালবেসেই বিয়ে করেছিলাম ।  এখন মনে হয়, বিয়ে না করলেই হ'ত ।

ডিসেম্বরে পিকনিকে গিয়েছিলাম অফিস থেকে । মানে আমাদের সেকশন আর কি। ফ্যামিলি নিয়ে গিয়েছিল প্রায় সবাই। আমি একা। যেমন যাই বরাবর।  নদী পেরিয়ে ছোটো একটা  গঞ্জে পিকনিক স্পট-বাসে যেতে হয়; নদীর পাশে বাগান, ছোটো দুটো ঘর, লাগোয়া বাথরুম। আমাদের বাস নদী পেরোচ্ছে, জানলা দিয়ে ছবি টবি তুলছি আমরা;  তো, আমাদের  স্বপ্না দু হাত ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল- "কী সুন্দর, দ্যাখ দ্যাখ-কী সবুজ, কী শান্ত- এখানে যদি আমার শ্বশুরবাড়ি হত!" তারপরই শান্তনুর দিকে তাকিয়ে চুপ করে গিয়েছিল। স্বপ্নার বরের ছোটোবেলার বন্ধু শান্তনু-  স্বপ্নার বিয়ের যোগাযোগ শান্তনুরই। তারপর খাওয়া দাওয়ার পরে আমরা  মেয়েদের একটা দল গুলতানি করছিলাম- বাড়ি ফেরার আগে  বাথরুম টুম- চোখে মুখে জল দেওয়া, চিরুণি চালানো; ঠোঁটে ভেসলীন মাখতে মাখতে সুমিত্রাদি-ই স্বপ্নাকে বলেছিল, "তা শ্বশুরবাড়ি বুঝি বিশেষ সুবিধের হয় নি? তোমাকে দেখে তো কিছু বোঝা যায় না বাপু। "

স্বপ্নাকে কিছুটা অপ্রস্তুত লেগেছিল। বিনুনীর তলার জট ছাড়াচ্ছিল লম্বা দাঁড়ার চিরুনী দিয়ে- সুমিত্রাদির দিকে না তাকিয়েই বলেছিল," না না  তা নয় ওরা লোক ভালো - কীসে  যে মন ভরে গেল নদী পেরোতে- নিজেও বুঝি নি"। মুহূর্তের একটা স্তব্ধতা এসেছিল- যেন গো গো গো গো স্ট্যাচু খেলছি সবাই। অথবা যেন একটা সিনেমা শুরু হতে চলেছে-  যেন এই  জলের কল টল  বেসিন , বাথরুমের দরজা ব্যাকড্রপে নিয়ে একের পর এক মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি কেমন হতে পারত বলে উঠবে  - তারপর চুপ করে মিলিয়ে যাবে- যেন একদল ভূত- শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচারিত এবং মৃত। অথচ ঘটনা তা নয় -  আমি জানি, আমরা সবাই স্বপ্নার মতই বলব - না না লোক ভাল, কী জানি কেন...  আমার বরং অন্য একটা কথা মনে হচ্ছিল।  মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে মনে হয়েছিল, মানুষ নিজেকে বোঝে না, হয়ত যা পেয়েছে তা সে চায় নি অথচ  সেই অপ্রাপ্তিও খুব একটা স্পষ্ট নয় তার কাছে- সেই থেকে একটা  বদলে নেওয়ার ইচ্ছে- যে জন্য হয়ত পরজন্মের কথা বলে মানুষ; বলে, এজন্মে তো হোলো না-হয়তো পরের জন্মে;  একদিন আচমকা সেই ইচ্ছেটা স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসে- স্বপ্নার মত,  তারপর হয় সেই ইচ্ছায় সায় দাও নয়তো লুকিয়ে রাখো বাকি জীবন।  আমার মনে হচ্ছিল, অনীক আর আমার সমস্যাটা যেন কিছুটা বুঝতে পারছি- আবছা আবছা- যেন  একটা মাকড়শার জালের মতো, গাছের দুটো ডালের মাঝখানে আঠালো সুতোর একটা নকশা হচ্ছিল আস্তে আস্তে ।  আরো মনে হচ্ছিল, স্বপ্নার নদী পেরোনোর  ঐ মোমেন্টটার মত  আমরাও একটা মুহূর্তর সন্ধানে আছি- দ্য স্বপ্না মোমেন্ট- আমি আর অনীক, দুজনেই। মুহূর্তটা এসে গেলেই  আমরা আর একসঙ্গে থাকতেই পারব না।

এর মধ্যে একদিন কী হয়েছিল…সেদিন অফিস ফেরত বাসে অন্যমনস্ক ছিলাম। অথবা ক্লান্তি।  হঠাৎ খেয়াল হল,  রোজ যেখানে নামি, মানে বাড়ির  বাসস্টপ পেরিয়ে যাচ্ছি - "আরে রোককে রোককে" বলতে গিয়ে চুপ করে গেলাম- ঐ যে নীল রঙের শেড - রং জ্বলে গিয়েছে, তার তলায় বেঞ্চ, চায়ের দোকান পাশে, কেষ্ট দা কাগজ পড়ছে একমনে - ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে যেতে খুব মজা লাগছিল - যেন নিজের গোটা জীবন পিছনে ফেলে  আসছি;  আসলে সামনে যেটা দেখা যায়, সেটাই পিছন ফিরে দেখতে এত অন্যরকম- মাথা টলটল করে - এই কী সেই স্বপ্না মোমেন্ট?  ঠিক তখনই কাঁধে হাত রেখেছিল চন্দ্রা - " এ কী, নামলে না?" 
কথা না বাড়িয়ে  হেসেছিলাম।  চন্দ্রা বলেছিল, বাজার যাচ্ছে-  চারটে স্টপের পরে।  তো ওর সঙ্গেই বাজার করে,  আবার ফিরতি বাস  ধরেছিলাম।  অনর্গল কথা বলছিল চন্দ্রা।   সুবিমলের কথা বলছিল, ওদের বাগানের কথা -কী কী চারা আনল, সার টার। হুঁ হাঁ করছিলাম । বাসে চন্দ্রা না থাকলে আমি অন্য কোথাও চলে যেতাম? ফিরতাম না?  একটু আগেই  ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তার বাঁ দিকটা দেখছিলাম- চায়ের দোকান, নীল শেড , এখন ফেরার পথে ডান দিক-সিনেমার পোস্টার, নতুন শপিং মল, কলেজবাড়ি।  অন্য রকম লাগছিল। আপ ডাউনের যেন দুটো আলাদা রাস্তা। একদম আলাদা। আলাদা দৃশ্য, আলাদা মুড।


আজ দিনের তাত সন্ধ্যার দিকে খানিকটা কমেছে। বিয়েবাড়ি থেকে সানাই এর সুর ভেসে আসছিল। ছাদে উঠলে টুনিবাল্বের মালা দেখা যাবে।  শুয়ে শুয়ে গান শুনছিলাম। মৃদুলা একতলায়, রান্নাঘরে- দুমদাম বাসন ফেলছিল - আমাকে চেঁচিয়ে ডাকল-ভাত বেড়েছে। সাড়া দিলাম না। আবার ডাকল। ধুস্স-
ও গজগজ করতে করতে উঠে আসছিল- সিঁড়িতে ওর পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। এবার কানের গোড়ায় চেঁচাবে। দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম- আচমকা সদর দরজায় দুমদুম আওয়াজ - কে রে বাবা, দরজা ধাক্কাছে এত রাতে!  তারপর নাগাড়ে বেল- থামছেই না ;  মৃদুলা মাঝ-সিঁড়ি  থেকেই ব্যাক করল- দরজা খুলবে। আমি খালি গায়ে ছিলাম- তবু ঘর থেকে বেরোলাম, সিঁড়ি দিয়ে নামছি - কে জানে কে! মৃদুলার সবেতেই তড়বড়,  সিঁড়ির মাঝখান পৌঁছতেই  শুনতে পাচ্ছি মৃদুলা ছিটকিনি ঘুরিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছে;  তারপরই একতলাটা ভরে গেল পারফিউমের গন্ধে;   চন্দ্রা এসেছে- গয়না, দামি শাড়ি, খোঁপায় ফুলের মালা, খালি পা, কাজল ধেবড়ে আছে -
-অনীক বাড়িতে আছে? শিগ্গির এসো, ও কেমন করছে! 
- সে  কী ? কী হয়েছে?
- সন্তোষদার বাড়ি থেকে ফিরে বলল জল খাবে- ফ্রিজ খুলে জলের বোতল বের করতে গিয়ে - হাউ হাউ করে কাঁদছিল চন্দ্রা।

মোবাইল হাতে নিয়ে চন্দ্রাকে টপকে দৌড়োলাম।  ভাপ উঠছিল রাস্তা থেকে-খালি পায়ে ইঁটের টুকরো বিঁধে যাচ্ছিল। ভৌ ভৌ করে উঠল দুটো কুকুর।  ওদের সদর  দরজা  হাট করে খোলা, বারান্দায়   বেলফুলের  টবের পাশে  নতুন  হিলচটি,  কোলাপুরী ছেড়ে রাখা, পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিলাম ;  বসবার ঘরে একটা কাচের ফুলদানি টুকরো টুকরো, সুবিমলের মোবাইল মাটিতে- স্ক্রীন ফেটে চৌচির। অথচ সুবিমল এঘরে নেই। ছড়ানো  কাচের টুকরো বাঁচিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।  খাওয়ার ঘরে ফ্রিজের সামনে সুবিমল - বিয়ে বাড়ির পোষাক- ঘিয়ে পাজামা  পাঞ্জাবি;  উপুড় হয়ে শুয়ে, ঘাড় ঘোরানো, ফ্রিজের দিকে মুখ, চোখ খোলা  - ওর একটা পা ফ্রিজের ডালা বন্ধ হতে দেয় নি; হুড় হুড় করে ঠান্ডা হাওয়া বেরোচ্ছিল, সেই সঙ্গে নিরন্তর ঘনীভবন ;  ফ্রিজের ভিতর থেকে স্পটলাইটের মত আলো পড়ছিল সুবিমলের মুখে।  নিঃশ্বাস পড়ছে কী না বোঝা যায় না।
মৃদুলা চন্দ্রাকে নিয়ে ঘরে ঢুকছিল, কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠছিল চন্দ্রার, কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল- কখনও বিয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পর কী কী হল, কখনও  শুধুই বিলাপ, কখনও  বাচ্চু বাচ্চু বলে ডেকে উঠছিল যেন ডাকনামে সাড়া দিয়ে উঠে বসবে সুবিমল। চন্দ্রাকে একটা চেয়ারে বসালো মৃদুলা,  তারপর ভাঙা কাচের টুকরোগুলো জড়ো করতে লাগল একসঙ্গে। খান খান প্রতিবিম্বকে টুকিয়ে তুলছে যেন- 
কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না- আগে অ্যাম্বুলেন্স না কী ডক্টর বসাককে ফোন করব? দৌড়ে গিয়ে ক্লাবের ছেলেদের খবর দেব?  সুবিমল কি বেঁচে নেই? কী করব আমি, কী করব? ঠিক এই সময় আমার চোখের দিকে তাকাল মৃদুলা, একদম চোখে চোখে- ওর চোখের ঘন কালো মণি, তাকে ঘিরে কালচে বাদামী বৃত্ত,  সূক্ষ্ম রক্তজালিকা - কতবছর পরে? কতবছর পরে? 
মৃদুলা কিছু বলতে চাইছিল কী না জানি না, বুঝি নি সেভাবে; কেবল মনে হ'ল- এই আমাদের শেষ সুযোগ, সুবিমল বাঁচলে  যেন আমরাও বেঁচে যাব। সময় বয়ে যাচ্ছিল। ফ্রিজের ভেতর থেকে  ঠান্ডা হাওয়া উড়ে আসছিল আমার দিকে, বারান্দা থেকে বেলফুলের বাস।  হাসপাতালের বেডে মুমূর্ষু লেখকের  ডান হাত আঁচড় কাটল বাতাসে-


অনীক  পাগলের মত মোবাইলের বোতাম টিপছিল- একের পর এক- অ্যাম্বুলেন্স, ডক্টর বসাক, কাউন্সিলর, পরেশবাবু;  ফোন ছুঁড়ে ফেলে  তারপর দৌড়ে এল  সুবিমলের কাছে, পাল্স বুঝতে চাইল, আঙুল ছোঁয়ালো কান আর গলার সন্ধিদেশে কোথাও, তারপর  সুবিমলকে  সোজা করে শোয়ানোর চেষ্টা  করতে লাগল । কাঁধের নিচে হাত দিয়ে চাড় দেওয়ার চেষ্টা করল, কোমরের দিকটা ধরল।   আমাকে বলল - "পায়ের দিকটা ধরবে?"  
বরফের মত ঠান্ডা সুবিমলের  পায়ের পাতা- বেঁচে নেই না কি ফ্রিজের ঠান্ডায়... 
অনীক  চেঁচিয়ে উঠল- "ওভাবে না, ওভাবে না, সময় নষ্ট  কোরো না,  প্লীজ প্লীজ হেল্প মি"।  ওর গলায় অসহায়তা আর মরিয়াভাব ছিল  -  আমি দু হাত দিয়ে সুবিমলের হাঁটুর নিচটা বেড় দিলাম,  কোমর ফেটে যাচ্ছিল আমার, তবু চেষ্টা করছিলাম খুব,  সুবিমলের দুটো পা তুলে ধরলাম যতটা পারি, এবারে  সুবিমলকে সোজা করে শুইয়ে দিল অনীক ।  চশমা ছাড়া সুবিমলকে বালকের মত দেখাচ্ছে,  আধখোলা চোখ, ঠোঁটের কোণে গ্যাঁজলা- ঘরঘর একটা শব্দ আসছিল। অনীক এদিক ওদিক তাকাল।  সোফার একটা কুশন নিল তারপর। সুবিমলের মাথার পিছনে দেবে কী দেবে না ভাবল এক সেকন্ড তারপর কুশন ছুঁড়ে ফেলে ফ্যারফ্যার করে ছিঁড়ল সুবিমলের পান্জাবি- দু হাত দিয়ে ম্যাসাজ শুরু করল বুকের মাঝখানে ; পাখা ঘুরছিল মাথার ওপর,  দরদর করে ঘামছিল অনীক- কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছিল সুবিমলের চোখে, মুখে;  ওর  কাঁধ আর  ডানার  পেশি উঠতে নামতে  দেখছিলাম -  খোলা পিঠে ঘামের দানা;  আমার  শরীর শিরশির করছিল,  সুবিমলের জায়গায় নিজেদের আট বছরকে শুয়ে থাকতে  দেখছিলাম আমি।  আমি জানি, চেষ্টা করছে,  চেষ্টা করছে অনীক, প্রাণপণ।
ডক্টর বসাক ঢুকেছিলেন তখনই। হুটার বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্সও এসে দাঁড়িয়েছিল ।


সুবিমলকে  অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে গলি পেরিয়ে বাড়ি ঢুকছিলাম।  চন্দ্রার বাপের বাড়ির দিকের লোকজন, সুবিমলের দাদা  খবর পেয়ে  চলে এসেছিলেন ইতিমধ্যে ।
এত রাতে কোনদিন এই পথে হাঁটিনি আমরা । রাতের আকাশ পরিষ্কার, নদীর দিক থেকে  অবিরাম বাতাস বইছিল, চাঁদের আলোয় ফেরার পথ অন্যরকম; আমাদের  লম্বা কালো ছায়ারা পাশাপাশি পড়ছিল, গলির পাটকিলে কানঝোলা কুকুরছানাটা আসছিল পিছন পিছন;  চন্দ্রাদের বাড়ির দিক থেকে বেলফুলের বাস, চাপা কান্নার আওয়াজ।
বিয়েবাড়ির সানাই থেমে গেছে অনেকক্ষণ,  টুনিবাল্ব জ্বলে নেভে, জ্বলে নেভে।  চাঁদের আলোয় উল্লম্ব সব মেঘ আর জেট চলে যাওয়ার ঘন সাদা লাইন, বাঁ দিক থেকে ডাইনে- হাওয়ার ইরেজার মুছে দিয়েছে খানিকটা।  তার ওপরে, নিচে মেঘ ভেসে যায়,  আকাশকে চলন্ত মনে হয় তখন। ওপরের দিকে তাকালে ঘোর ঘোর লাগে- মাথা টলটল করতে থাকে। কী বড় আকাশ!  
 
[প্রথম প্রকাশ : পরিচয় ২০২১] 

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস