কোলক্লিফ, ২০২৩

 মোবাইলের আলোয় কাছের অন্ধকার গলে গলে পায়ের কাছে জমাট  বাঁধছেফলে  যে ছোটো ছোটো অন্ধকারের স্তুপ তৈরি হচ্ছিলনীলচে আলোয় তাদের গুঁড়ি মারা কালো বেড়ালের মতো লাগছিল - আমি সামনে এগোলেই কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়বে আবার।  দূরের অন্ধকার এখন  গাঢ় আর জমাটযদিও মন্থর, তবু অন্ধকার কেটে কেটে  নিরন্তর পথ তৈরি হচ্ছিল, অথচ কোনো গন্তব্য ছিল না। নেটওয়ার্কের আওতায় আসা এই মুহূর্তে খুব জরুরীআমি কিন্তু গল্পের কাছেই পৌঁছোতে চাইছিলাম। সকাল থেকেই

 

- জানো তো, সত্যজিৎ রায় আমার গল্পের বইকে ভালো বললেন।

-কে?

-সত্যজিৎ রায়-

-মানে? ফিল্ম মানে পথের পাঁচালি মানে ফেলুদা......?

আমি মাথা নাড়লাম।

-কবে? কোথায়?

-পরশু রাতে। ট্রামে।

নমিতাকে প্রচণ্ড কনফিউজড লাগছিল। ওর কথার পিঠে আমি কী বললে এই গল্পটা এগিয়ে যাবে - ভাবছিলাম। ভিজে মাটির  ওপর একমুঠো বীজ ছড়িয়ে  রাতারাতি অঙ্কুরোদগমের অপেক্ষায় থাকার মতো নমিতার দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে রইলাম - একটা গল্প তৈরি হোক এখানে।

এতখানি উঠে এসে এসে ঘাম জমেছিল কপালে- ঠান্ডা হাওয়া লেগে  আরাম লাগছে। খাড়াইতে  একটানা হাঁটতে  পারব কীনা -টেনশনও ছিল। সে সব এখন কেটে যাচ্ছে জ্যাকেট খুলে পাথরের ওপর বসে জুতোর ফিতে বাঁধছিলাম-এই তো খানিক আগে টয়লেটে বসে বাঁধলাম, আবার খুলে গেছে। দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে মেঘ নামেকখনও নদীকখনও আবার জলপ্রপাত মনে হয় তাদের। অনেক নিচে নবীনের  ঢাউস গাড়িকে বিশাল অথচ শান্ত প্রাণীর মতো লাগছে এখন   পাশেই ছোটো লাল গাড়ি পার্ক করল এইমাত্র, তারপর আবার বেরিয়ে এলো, দু চক্কর পাক খেয়ে আবার পার্ক করল- এত উঁচুর টপ ভিউতে লাল ফ্রিসবি ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে -মনে হচ্ছিল। " কে আবার এলো। আমি তো ভাবলাম, এসব জায়গা পাণ্ডববর্জিত। হুল্লোড়ে পাবলিক হলে মুশকিল।" নমিতা ঈষৎ ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করছিল, তারপর সরে এলো- "মাথা ঘোরে"

 রাতের ঠাণ্ডায় ঘাসজমিতে শিশির জমে গিয়েছিল। সকাল দশটার রোদে তাদের সাদা বালির মতো লাগে। নমিতা আমার পাশে ধুপ করে বসে বলল- "প্র্যাকটিকাল জোক? তুমি পারো বটে গল্প বানাতে । কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। নমিতা এই অ্যাবসার্ডিটিটা অ্যাকসেপ্ট না করলে গল্প আর এই লাইনে বিশেষ এগোবে না। সামান্য হতাশ লাগছিল। অন্যদিকে মাথা ঘোরালামকন্দর্প আর বিকাশ  অনেকদূর এগিয়ে গেছে- এখান থেকে দেখা যায় না; নবীন, ভারতীখুশিদি কুয়াশা আর মেঘের মধ্যে ঢুকে যেতে যেতে বলল- " কী এখনই টায়ার্ড লাগছে? আমরা দাঁড়াই?"  ওদের হাত নেড়ে চলে যেতে বলে নমিতা ফিসফিস করল, " ভারতী আর নবীন এর কেসটার আপডেট কি? লেটেস্ট গসিপ কিছু জানো?" আমি উত্তর না দিয়ে কাছের পাহাড়ের দিকে আঙুল তুললাম- " দেখো কয়লা।"

বাড়ির এত কাছে কয়লাখনি -জানতামই না। বিকাশ খোঁজ এনেছিল অফিসফেরত- কোন কলিগ উইকএন্ডে ঘুরে এসে গল্প করেছিল না কি।

-যাবে ?

- হঠাৎ?

- খুশিদি এসেছে নবীনের কাছে, বলছিল- সব দেখানো হয়ে গেছে গত পাঁচ বছরে - নতুন কোথায় যাওয়া যায়: কন্দর্পদের সঙ্গেও পুজোর পরে আর দেখা হয় নি। সবাই মিলে একটা লং ড্রাইভ-

- নমিতা-কন্দর্প, খুশিদি, নবীন আর আমরা, তাই তো?

- সুহাসকে বলি? নতুন এসেছে, কিছুই দেখে নি এখনওউইকএন্ডে  শুধু মল সে মল  ঘুরে বেড়ায়। নাথাক।  ইয়াং তো- আমাদের সঙ্গে অকোয়ার্ড ফীল করতে পারে-

- আমরা কি খুব বুড়ো?

- সুহাসের তুলনায় তো বটেই। কিন্তু ভারতীকে বলতে হবে-

- নবীনই বলবে-দেখো- ভারতীকে বাদ দিয়ে কোথাও যায় না- শম্পা বলছিল, ওদের বাড়িতেও নিয়ে গেছিল-

- সে বলতেই পারে, কিন্তু আমার তরফ থেকে যখন অ্যারেঞ্জমেন্ট, তখন তুমি বা আমি কেউ একজন ফোন করে বলব- আর ভারতীর যে বন্ধুর কেটারিংএর ব্যবসা, মনে আছে? ভারতীকে বলব, ওর থেকেই লাঞ্চ নিয়ে নিতে-

- ওখানে কী কী দেখার?

- গুগল করে নিও। অপছন্দ হলে যেও না।

- একা বাড়িতে বসে কী করব?

- ঘাড় গুঁজে উদ্ভুট্টে গল্প লিখবে- তাই তো করো সারাক্ষণ-

কথা বলতে বলতে গুগল করছিলাম ল্যাপটপে- গল্প পাবো খুঁজে? এখানে? এই  জল, পাথর, পুরোনো রেললাইন, বন্ধ খনিতে?...গল্প পাবো ?

বিকাশ চেঞ্জ করে ফিরে এসেছিল এই সময় -" কী বুঝলে?"

- গল্প পাবো ওখানে?

- গল্পহীন কোনো জায়গা হয় নাকি? কথা হল, সে গল্প আবার তোমার পছন্দ হবে কী না-

 

"অনেকখানি হাঁটতে হবে কিন্তু, এখান থেকে তিন চার কিলোমিটার মতো খাড়াই, তারপর খানিকটা সমতল- ফায়ার ট্রেল, তারপর সটান নেমে গেলে আমরা পুরোনো রেলব্রিজের নিচে পৌঁছে যাবো। একটা রকপুল - কাছেই। ওখানে বসে খেয়ে নিলে হবে। তারপর সবার দম থাকলে তখন আবার কোথায় যাব না কি ফেরার পথ ধরব-ভাবা যাবে..." মোবাইলে ম্যাপ দেখতে দেখতে নবীন গোঁফ চুমরেছিল। ভারতী নবীনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হেসে উঠে  বলেছিল-" কারোর হাঁটু নড়বড়ে থাকলে এখ্নই বলে দাও বাপু। একবার হাঁটতে শুরু করলে , ফিরে আসা টাফ হবে, এয়ার লিফ্ট করা ছাড়া গতি থাকবে না।"     "এই যাঃ লোকাল থানা থেকে লোকেটর বীকন আনা উচিত ছিল, নইলে হেলিকপ্টরও তো আসবে না রেসকিউ করতে - " কন্দর্প  আঁতকে উঠে এই প্রথম কথা বলেছিল।

নমিতা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ভারতীর দিকে, তারপর আমার দিকে ফিরে চোখ নাচালো। খুশিদিকে দেখেছিলাম   হাঁটুতে হাত বুলিয়ে নিতে।  বিকাশ  বলেছিল, -" বাথরুমের কী অবস্থা দেখাচ্ছে ম্যাপে? পথে আর টয়লেট পাবো তো? "

" পেটের অসুখ না কি? তাহলে এলে কেন আজ? তুমিও তো বারণ করতে পারতে"- নমিতা আমার দিকে ঘাড় ঘোরালো। বিকাশের আবার কী  'হতভম্ব লাগছিল আমারঅস্বস্তিকর পরিস্থিতি অ্যাভয়েড করতে কালো চশমা পরে খুচখাচ ছবি তুলছিলাম মোবাইলে।

নবীন হা হা করে হেসেছিল- "আরে চিন্তার কিছু নেই, ম্যাপে দেখাচ্ছে, টয়লেট আছে। আর না পেলে এত ঝোপঝাড় রয়েছে...গ্যাস্ট্রো স্টপ খেয়েছ তো? ব্যাস তাহলেই হবে।" টিপিকাল নবীন আর ওর সোয়াগ - যেন জগতের কোথাও কোনো প্রবলেম নেই। সব কুল, সব বিন্দাস। এই ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সেও তাই মেয়েরা ওকে দেখলে এখনও হামলে পড়ে... যেমন ভারতী। কিন্তু এতে কোনো অ্যাবসার্ডিটি নেই।  হাত তুললাম- "আমিও একটু বাথরুম ঘুরে আসি"

খুব কিছু খারাপ নয় টয়লেট। ঘ্যাসঘ্যাস  আওয়াজ করে  এক্জস্ট ফ্যান  চলছেমেঝেয় ধুলোবালিখড়কুটো, শুকনো পাতা এসে জমা হয়ে আছে। ট্যাপ খুলতে বুজবুজ করে ঘোলাটে জল বেরোলো খানিকটা। স্কাইলাইট দিয়ে সকালের আলো এসে পায়ের কাছে পড়েছে। একটা দুটো তিনটে কালো পিঁপড়ে ঘুরঘুর করছে ধুলো ভরা মেঝেয়। পাখির ডাকহাওয়ার শব্দ এই অবধি কোনো গল্পই নেইবোরিং লাগছিল; ঘটমান বর্তমানকে যেন  রোদে মেলে দেওয়া -আধা বুড়ো কিছু মানুষজন  ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে - সূর্যের আলোয় তাদের আগাপাশতলা দেখা যায় , যেখানে কোনো রহস্য নেই, কোনো গল্প নেই।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি, নমিতা আর খুশিদি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে- "আমরাও ঘুরে আসি- বাকি পথে কোথায় কেমন ফেসিলিটি টিটি..." নমিতা  বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিল।  জলের আওয়াজ, সাবানের গন্ধ, বেসিনে খয়রী হলুদ দাগ ধরে আছে, পুরোনো ট্যাপে মরচে - এই সব টপকে গিয়ে একটা গল্প শুরু করার জন্য মরিয়া  আমি  খুশিদিকে বলেছিলাম- " সত্যজিৎ রায় আমার লেখা ভালো বললেন। উপন্যাসটাও পড়ে জানাবেন।" খুশিদি হাঁ করে থেকে বলল- " তুমি লেখো নাকি? জানতাম না তো! নবীন পড়েছে? ওর কাছে তোমার কোনো বই আছে? নেই? দিও তো। পড়ব তাহলে। বই টই কিছু সঙ্গে আনি নি। "

" না তেমন কিছু ... "বলতে বলতে বাইরে এলাম।  তখনই ঠিক করেছিলামখাড়াইয়ে ওঠা শেষ করেই নমিতার ওপর ট্রিকটা ট্রাই করব। নমিতার ব্যবহারে কোনোদিন তারতম্য দেখি নি এই এত বছরে- সর্বদাই মৃদু হাসি মুখে- যেন  কোনো রাগ নেই দুঃখ নেই ক্ষোভ নেই; যদি  একটা অনুভূতিও চুঁইয়ে বেরোয় আজ... বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব লেখার সময়ে।

 

"কী ভাবছ কি?" নমিতার প্রশ্নে আমি মুখ নামিয়ে আবার ফিতে বাঁধতে লাগলাম।

-আচ্ছা বিকাশকে আজ খুব অন্যরকম লাগছে। এমনিতে কন্দর্পর সঙ্গে সারাক্ষণ শেয়ারদরের আলোচনা, আজ খুব চুপচাপ। এখন তো দেখতেও পাচ্ছি না" নমিতা আমাকে আলতো ঠেলা দিল।

সিগ্রেট ব্রেক নিচ্ছে হয়তো

- এতো ঘন ঘন সিগ্রেট টানতে তো আগে দেখি নি। চলো।  যাবে? সবাই এগিয়ে গেল তো-

সূর্য এখন প্রায় মাথার উপরে। ঠাণ্ডা হাওয়া, একবারও না থেমে  রোদের তেজকে মোলায়েম করে দিচ্ছিল - যেন এই অঞ্চলে আমাদের আরামে রাখা তারই দায়িত্ব।  এদিকটায় মূলত ঘাসজমি। মাঝখান দিয়ে ফায়ার ট্রেল। কুয়াশা সম্পূর্ণ উবে যাওয়ায় এখন সবাই দৃশ্যমান; বিকাশকেও দেখা যাচ্ছিল- আরো আগে, নবীন আর ভারতী পাশাপাশি, একটু পিছনে খুশিদি- পা টেনে হাঁটছে।

"কুকুর ডাকছে না?" নমিতা বলল।

-এখানে কুকুর আসবে কোথা থেকে?

- যারা গাড়ি পার্ক করল

-এখানে কি  আর কুকুর নিয়ে আসবে?

-আসতেও পারে। মানুষ যে কত বিভিন্ন কারণে কুকুর পোষে -

- গাইড ডগ নিয়ে এসেছে কেউ, বলছ?

- থেরাপির জন্যও কুকুর রাখে মানুষ, জানো?

- না তো-

"সাইকিয়াট্রিক থেরাপিতেও ... কোভিডের পরে অল্পবয়সীদের মধ্যে আজকাল -" আচমকা থেমে গিয়ে জল খেলো নমিতা-" তুমি জল খাবে?"

জল খেয়ে বোতলটা নমিতাকে দিচ্ছি, এমন সময়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে টগবগিয়ে দৌড়ে গেল একজোড়া যুবক যুবতী- দুজনেরই লাল জ্যাকেট, জীনস; তাদের কেটে যাওয়া বাতাস আমাদের গায়ে এসে লাগল আর আমরা দুজনেই একসঙ্গে শ্বাস ফেললাম। " আমরা কত বুড়ো হয়ে গিয়েছি, সত্যি" - নমিতা বলল -" লালগাড়িটায় এসেছে তার মানে, দেখো এর মধ্যেই  ওপরে উঠে এসে আমাদের টপকেও গেল-"

নমিতার গলার স্বরে সামান্য বেদনা আর ঈর্ষা ছিল যা আমি পাঁচ মিনিট আগেও বের করে আনতে পারি নি। কৌতূহলী হলাম -"কী যে বলো- তোমাকে দেখলে মনেই হয় না দুই ছেলে ইউনিভার্সিটিতে। কন্দর্প অবশ্য ইদানিং একটু ওয়েট গেন করেছে- তাহলেও যথেষ্ট ফিট- কী টানটান হাঁটা-সৌমিত্রর মতো অনেকটা-"

-কোথায় আর- সে ছিল আগে- এখন তো ড্রিঙ্ক করে করে কী ভুঁড়ি হয়েছে-

-বারণ করলে শোনে না?

" আমি বললে যেন শুনবে" নমিতার গলা তীক্ষ্ণ হতে গিয়েও মোলায়েম হল আবার- " তো রেলব্রিজ দেখা যাচ্ছে।"

 

ভাঁটার সময় এখন। ব্রিজের নিচে রকপুলের খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম আমরা। নীলচে বেগনি নুড়ি পাথর, হাল্কা সবুজ জলে স্টার ফিশ, ছোটো লাল কাঁকড়া।  ভারতী বাস্কেট থেকে চৌকো সাদা বাক্স বের করে আমাদের হাতে দিচ্ছিল - "বিকাশদা যেমন বলেছেন, ঠিক তেমন অর্ডার করেছিনিন বিকাশদা"

-সবাইকে দাও। আমি নিচ্ছি একটু পরে-

" এই জায়গাটা আবিষ্কারের গল্প জানো তো?" নবীন বলল।

"জানতামনা, এখানে আসার আগে পড়ে নিয়েছি -" নমিতা বলল, সায় দিল কন্দর্প। আমি মাথা নাড়লাম।

"আমি জানিনা। বলো গল্পটা"- নবীনের পাশে বসল ভারতী।

- সঠিক সাল তারিখ ভুলে গেছি, ১৮০০ সালের কাছাকাছি হবে- একটা জাহাজডুবি হয়েছিল- ব্রিটিশ জাহাজ। যাঁরা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে থেকে দুই সাহেব  কোস্ট বরাবর হাঁটা শুরু করে-সাহায্যর খোঁজে; এই জায়গাটায় এসে ওরা কয়লা দেখতে পায়, সেই কয়লায় আগুন জ্বালালে, রেসকিউ শিপ ওঁদের খুঁজে পেয়েছিল। তারপরে, প্রায় ১০০ বছর লেগে যায় খনির কাজ শুরু হতে-জেটি তৈরি হয় , জাহাজ আসতে থাকে। টাউনশিপ বসে। তারও বছর দশ পরে রেললাইন পাতা হলজেটির গুরুত্ব কমলঅবভিয়াসলি। খনি থেকে কয়লা তোলার কাজ চলেছে  একশো বছরেরও বেশিএই ধরো, বছর তিরিশ হবে বন্ধ হয়েছে। 

-টাউনশিপ তো বেশ বড়ই ছিল, আসার পথে যতটুকু দেখলাম-

-একটা বিরাট ডিপারটমেন্টাল স্টোরও ছিল - সব পাওয়া যেত- একবার  আগুন লেগেছিল - দোকান পুড়ে যায়।

-আবার আগুন?

- এটা অন্য আগুন; সম্ভবত সাবোটাজ -জ্বালানির তো অভাব হয় না- কয়লাই হোক কিম্বা

-তারপর?

-অনেক পরে নতুন দোকান হয় ওখানেইএখন রেসিডেন্সিয়াল প্রপার্টি। ফেরার সময় দেখাবো।

" খনি বন্ধ হওয়ার পরে মাইনারদের কি হল? কমপেনশেসন পেয়েছিল?" কন্দর্প জিজ্ঞেস করেছিল-

নবীন কাঁধ ঝাঁকালো- "জানি না, উইকিতে কিছু লেখা নেই।"

 

পুরোনো ব্রিজের ছায়ায় বসে স্যান্ডুইচ খাচ্ছিলাম আমরাসাদা বাক্স পাশ নিয়ে কাত হয়ে শুয়েছিল বিকাশ।

-কী শরীর খারাপ করছে না কি? খাবে না?

-টায়ার্ড লাগছে?

-খেয়ে নাও, বেলা হয়ে গেছে, এর পরে খেলে...

-কী হল কি গুরু তোমার? মার্কেটের মতো তুমিও ডাউন?

বিকাশ আড়মোড়া ভাঙতে গিয়েও থেমে গেল যেন মাসল পুল হয়েছে-তারপর থেমে থেমে বলল-" আসলে কদিন পেটে একটা অস্বস্তি, বললাম না? একদিন না খেলে কিছু হবে না।"

-হজমের ওষুধ টষুধ খেয়েছ? অ্যান্টাসিড?

- সে তো খেয়েই চলেছি-খুব একটা কাজ হয় নি এখনও-

-ডাক্তার দেখিয়ে নাও না

-দেখিয়েছি

-কী বললেন?

-স্টুল টেস্ট, ব্লাড টেস্ট সব করালাম

- নরমাল তো ?

- অকাল্ট ব্লাড পেয়েছে। এখন এন্ডোস্কোপি  করতে হবে-

অবাক হয়ে শুনছিলাম - সব কিছুই জানি না। বিকাশ কিচ্ছু বলে নি তো। যেন চেনা মলাট দেখে বই খুলেছি, অথচ একদম অন্য একটা গল্প। চোখ জ্বালা করছিল। কান গরম হয়ে যাচ্ছে।  আবার কালো চশমা পরে নিলাম দ্রুত।

" আরে ভাই ডাক্তারদের সব বেশি বেশি, পেট গরম হয়েছে, দুদিনে ঠিক হয়ে যাবে, সব স্কোপি টোপি করাতে হবে না-"

-না না, ভাইয়ের কথা শুনো না তো। সব টেস্ট করিয়ে নেবে- এই তো আমার মাসতুতো দাদার..

-চুপ করো না দিদি, পিন্টুদার গল্পটা আজ থাক।

- ভালোর জন্যই বলছিলাম

সবাই চুপ করে যায় একসঙ্গে। মাথা নিচু করে বসে থাকে যেন মারাত্মক কোনো অসুখের ডায়াগনোসিস অলরেডি হয়েই গেছে-শুধু নবীন গলা খাঁকরে বলে ওঠে-" দূর কিস্যু পাবে না স্কোপি টোপিতে"

নমিতা আমার কাঁধে হাত রাখল-" বলো নি কেন? "

 

লাল জ্যাকেটরা ফিরে আসছিল উল্টোদিক থেকে।

-ওদিকটায় কী আছে? কিছু দেখার মত?

"বীচের কাছাকাছি  মারমেডের একটা স্ট্যাচু রয়েছে, সুন্দর"- দৌড়তে দৌড়তে তারা দাঁড়িয়ে পড়ল আমাদের পাশে-  "ফিরবেন না? চারটে নাগাদ হাই টাইডের ফোরকাস্ট আছে"

-জল আসে কতদূর ?

- ব্রিজের পিলারের গায়ে দাগ দেখুন। আর দেরি করবেন না।

" আরে দূর যতো ফালতু" -নবীন হাত ঝাড়লো -"আর একটু বসি।"

না না, "এক্ষুণি চলো" ভারতী উঠে দাঁড়ালো-  "যা আস্তে হাঁটে সবাই, এমনিতেও গাড়ি অবধি পৌঁছোনোর আগেই সূর্য ডুবে যাবে-"

"সেটিং সানের সঙ্গে সেলফি চাও না?" নবীন ওর বেস্ট হাসিটা ভারতীকে উপহার  দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

 

নবীনের গাড়ির গায়ে ধুলোর লালচে সর পড়ে গিয়েছে- সামান্য দূর থেকেই নজরে আসে। নাছোড় সব পাতা ঝরছিল বনেটে, উইন্ডশিল্ডে - লালচে, হলদে, বাদামি। গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে নবীন পকেটে হাত দিয়েই চেঁচালো- " ভারতী, তোমার ব্যাগে গাড়ির চাবি?"

-আমার ব্যাগে কেন? তোমার পকেটেই তো ছিল। একটু আগেও তো-যখন সানসেটের ছবি নিলে মোবাইলে তখনও দেখলাম- মোবাইলের সঙ্গে পকেট থেকে বেরোলো-

-তারপর কী করলাম?

 -সে আমি কি জানি?

-প্লীজ তোমার ব্যাগ দেখো, দিদি তোমার ব্যাগে দিই নি তো?

নবীনের কপালে ঘাম জমতে দেখলাম।

- এখন কী হবে? এই অন্ধকারে বসে থাকতে হবে?

" চাঁদ উঠবে একটু পরেই- আজ পূর্ণিমানা?" নমিতা বলল।

- ধুস মেঘ করে আছে, আচ্ছা যেখানে ছবি তুলেছিলাম, ওখানেই কোথাও পড়েছে- একবার গিয়ে দেখব?

-স্পেয়ার কী নেই?

"বাড়িতে"- কপাল চাপড়ালো নবীন।

- তাহলে কী হবে?

-ইনসিওরেন্সে ফোন করলে হেল্প পাঠাবে-

"তবে তাই করো। সময় নষ্ট করছ কেন? কাল খুব ভোরে আমার ফ্লাইট আছে। উফ নবীন- তুমি এত ইরেসপনসিবল"-  ভারতীই ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল বের করল- " এখানে তো কাভারেজই নেই"

" আবার ওপরে না উঠলে কাভারেজ পাবে না" বিকাশ বলল-

- এই কন্দর্প, তুমি এসো তো আমার সঙ্গে-অল্প একটু উঠলেই হয়তো টাওয়ার পেয়ে যাবো, পুরোটা উঠতে হবে না। বিকাশ তুমি ওদের নিয়ে এখানেই থাকো।

"আমার কোমর এমনিতেই ফেটে যাচ্ছে ভাই - আর উঠতে পারবো নাএদিক ওদিক হেঁটে দেখছি-কোথাও টাওয়ার পেয়ে যাবো ঠিক।"

"বিকাশ, এখানে জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী ট্রাণী নেই তো?" নবীনকে প্রচণ্ড টেন্স লাগছিল।

- তা জানি না, তবে সাপ তো আছে ডেফিনিটলি

" সাপ! "আঁতকে উঠলো ভারতী

" সব ঘুমোচ্ছে। শীতকাল না? শান্ত হও ভারতী" খুশিদিকে দেখলাম ভারতীর হাত ধরে কথা বলতে।

" এত ঘাবড়াচ্ছ কেনচাঁদ উঠবে একটু পরেই" নমিতা  আবার বলল।

" ভ্যাট আজ অমাবস্যা। আর চাঁদ ওঠার সঙ্গে নেটওয়ার্কের কী সম্পর্ক? তুমি মাইরি !" কন্দর্প মোবাইল উঁচু করে হাঁটা মারল।

"আচ্ছা আমি একাই উঠছি"- নবীন দু আঙুলে কপালের রগ  চেপে ধরল-

- আমিও  আসছি সঙ্গে

বিকাশ হাঁই হাঁই করে উঠেছিল - " তোমার যাওয়ার কী দরকার? "

" আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না " - দাঁতে দাঁত ঘষলাম আমিনবীনের সঙ্গে খাড়াই বাইতে শুরু করলাম তারপর। কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেল বিকাশ। হেসে মাথা নাড়ল – “ গল্প পাও নি ? এখনও?"

 

সূর্য ডোবার পরে পাহাড়ে ওঠা ক্রমশ কঠিন থেকে অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল।  মোবাইলের আলোয় পাহাড় বাইছি আমি আর নবীন। ঘন ঘন হোঁচট খাচ্ছিলাম দুজনেই। হাত পা ছড়ছিল। নবীনের কপালের বাঁ দিকটা কাটল। দু মিনিট অন্তর থামছিলাম, নেটওয়ার্ক চেক করছিলাম আবার উঠছিলাম। ঠোঁট চাটছিলাম ঘন ঘন - খেয়াল হল, জলের বোতল আনি নি। অসম্ভব হাঁপাচ্ছিল নবীন।

"এখনও নেটওয়ার্ক নেই- স্ট্রেঞ্জ!" নবীন বলল

-আমরা খুব বেশি উঠি নি কিন্তু

-মনে হয় আমি আর পারব না, বুঝলেআর বেশিদূর উঠতে পারব না - গতবছর দুটো স্টেন্ট বসেছে আমারকলকাতায় গিয়েছিলাম যখন, ছোটো একটা অ্যাটাক হয়েছিল - তোমাদের বলি নি। আর ওঠা বিপদজনক হবে।

- তুমি নেমে যাও নবীন, আমি একা পারব

- সে হয় না। ভারতীকে কী বলব? বিকাশ কী বলবে?

- বিকাশকে নিয়ে ভেবো না। কিন্তু ভারতী  জানে না তোমার স্টেন্ট এর কথা?

" না" মাথা নামালো নবীনের শিল্যুয়েট -"বলি নি।  আচ্ছা সেই ছেলেমেয়ে দুটো ফিরে গেছে , না? ইশ.. ওরা যদি থাকত-"

-কিম্বা ওদের বয়সটা-

- আমরা এখন কী করব তবে?

-বললাম তো, আমি উঠে যাচ্ছি। কানেকশন পেলে ফোন করেই নামবো।

ফিরতি পথ ধরল নবীন। মোবাইলের আলোয় ওকে এক  বিষণ্ণ নিয়ান্ডাথলের মতো লাগে। এইটুকু অ্যাবসার্ডিটিকে  হাতের পাতায় তুলে মুঠি বন্ধ করি। তারপর নামিয়ে রাখি পাথরের পাশে।  গড়িয়ে দিই। নবীনের  সঙ্গে যাক।

বিকাশের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকি। কী বলতে চাইল? ওর কিছু হয় নি? ট্রিক? আমাকে গল্পের সুতো ধরাতে চাইছিল? না আরো বড়ো কোনো অ্যাবসার্ডিটির কথা বলতে চাইছিল, যার  মুখোমুখি হওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে? আলো আঁধারির খোপ কাটা এক লম্বা ফিতের মতো পথ।  নিকটবর্তী আঁধার গলে পড়ায় যে পথটুকু তৈরি হচ্ছিল, তা পরবর্তী অন্ধকারের দিকে যাচ্ছিল   কতদূর যেতে হবে জানা ছিল না।

পাথরের ওপর বসে পড়েছিলাম। এখনও নেটওয়ার্ক নেই। আর কতখানি হাঁটবোথেমে যাবো? ফেরার পথ ধরবগলা শুকিয়ে আসছিল, মাথা ঘুরছিল, কাফ মাসল  জুড়ে  ব্যথা ক্রমশ উঠছিল নামছিল।  লো ব্যাটারির ওয়ার্নিং দিয়ে মোবাইলের ডিসপ্লে সম্পূর্ণ কালো হয়ে গেল এই সময় অন্ধকার ঘিরে ধরেছিল। কী করবগত দুশো বছরে কত রকম আগুন দেখেছে  এই জঙ্গল পাহাড় উপত্যকা। জ্বালব আগুন ?

গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম- বি কা ...

পাশের জঙ্গলে সরসর আওয়াজ উঠল, জুতোর ওপর দিয়ে বুকে হাঁটা প্রাণী রাস্তা পেরোলো।

-বি কা ...

 

উপত্যকায় নেটওয়ার্কের খোঁজে ওদের মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটগুলি জোনাকির মত ইতস্তত ঘুরছিল। ঠিক  তখনই  পাহাড়ের ওপর বিশাল কমলা গোলক লাফ দিয়ে আকাশে উঠল কেউ তাকে আগুন ভেবেছিল। কেউ ভাবল- চাঁদ উঠছে।

 

 

[প্রথম প্রকাশ- চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম , ২০২৩]

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

সলস্টিস