বিরলপাতার গাছ
বিরলপাতার গাছ
মৃণাল শতপথী৯ঋকাল বুকস
দাম ২৫০ টাকা
সময়ের সঙ্গে, বয়সের সঙ্গে , বেঁচে থাকার যাবতীয় ঝুটঝামেলা অনুভূতিতে একটা সর ফেলতে থাকে। হাল্কা সর প্রথমে, না সরাতে পারলে, আর একটি সরের তল, তার ওপর আর একটি- সর জমে গাদ হয়ে যায়- সেডিমেন্ট- তখন অলীক এক অস্ত্রের সন্ধান করতে হয় যা একাধারে ধারালো, একটানে চেঁছে ফেলবে অনুভূতির ওপর জমে থাকা আস্তর, আবার একই সঙ্গে আশ্চর্য কোনো সঙ্গীত শোনার পরবর্তী অনুভূতির মতো হবে- শিশুর মতো টলমল পায়ে অনুভূতির এ ঘর সে ঘর যাব- নতুন করে আবিষ্কার করব আমারই অশ্রু, আমারই আনন্দ।
গুরুচণ্ডা৯র শারদ সংখ্যায় মৃণাল শতপথীর 'ডলফিন' পড়ে আমি সেই অলীক অস্ত্রের সন্ধান পাই যা বস্তুত মায়া। আলতো নয়, তীব্র আর আচ্ছন্ন কারী সে মায়া থেকে বেরোতে পারি নি বহুদিন। জনে জনে পড়িয়েছিলাম গল্পটি।
বইমেলায় মৃণালের গল্প সংকলনটি দেখেই কিনে ফেলি সঙ্গে সঙ্গেই। "But how could you live and have no story to tell? " দস্টয়েভস্কির উদ্ধৃতির পরে সূচিপত্র আসে। ১৩টি গল্প। অলংকরণ রয়েছে বই জুড়ে। আমি অক্ষরেই মনোযোগ দিয়েছিলাম। অন্য দিকে চোখ, মন ফেরাই নি।
ডলফিন এ যে অস্ত্রটির সন্ধান পাই, প্রথম গল্পেই (নীল মানুষ) তাকে আবার পেয়ে যাই- সেই তীক্ষ্ণতা, সেই মারাত্মক মায়া। পরের গল্পর (স্যাঙাৎ) স্বাদ একেবারে আলাদা। চরিত্রদের নাম নেই- ফুটো গেঞ্জি আর চেক জামা আর লেখক / অবলোকনকারী তাদের ঠিক পিছনে ক্যামেরা বসিয়েছেন। চরিত্রদুটির মুখ একবারও দেখা যাবে না, নামও নয়- গল্প তৈরি হচ্ছে দৃশ্য, শব্দ আর কিছু কথোপকথনে- বৃষ্টি নামলে শিলুটের ওপর ক্যামেরা ফ্রিজ করে। অনবদ্য ট্রীটমেন্ট। তৃতীয় গল্প অন্তরাত্মায় মায়ার তরবারি ঝলসে উঠছে- এই সংকলনের সেরা লেখা সম্ভবত। চতুর্থ গল্প 'বিরল পাতার গাছ' এ সেই মায়াই কাজ করেছে- বাস্তব থেকে আপাতদৃষ্টিতে জাদুবাস্তবে যাওয়া, ফিরে আসা। স্বাদ অন্য। তীক্ষ্ণ হয়ে কাটে নি, বাস্তবকে ভুলিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য-গল্পের চরিত্রর মতই। বিতংস গল্পটি আগে পড়েছিলাম - হাতী ছিল সে গল্পে, সমাপ্তিতে পাঠক আবিষ্কার করেছিল -ফাঁদ একটাই- মানুষ কী হাতির। অঝোর গল্পটিতে সেই আশ্চর্য মায়া আবার ফিরে আসে।
সংকলনের গল্পগুলির পটভূমি ভিন্ন ভিন্ন-গ্রাম, নগর, পুরাণ, কিছু অলীক সংলাপে মহাকাব্যের পুনর্নির্মাণ। গ্রাম থেকে নগরে পৌঁছে যাওয়ার অ-সুখ, বিষাদের একটি সুর ধরা পড়ে, পড়া শেষ হলে। স্পষ্ট নয়, উচ্চকিত নয়। নিহিত। যেন একটি দীর্ঘশ্বাস।
রমাপদ চৌধুরী লিখেছিলেন, “রণক্ষেত্রের দামামা বেজে উঠল। লক্ষ লক্ষ সিপাহী, সান্ত্রী, অশ্বারোহী সৈনিক ছুটে এল উন্মত্ত আক্রোশে। বিপরীত দিক থেকেও ঝাঁপিয়ে পড়ল লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা। ... ঔপন্যাসিক তখন কোনো মিনারের চূড়ায় উঠে নোটবুকে টুকে নেবেন সমস্ত দৃশ্যটা। রাজার অঙ্গে লাল মখমলের পরিচ্ছদ, মাথার মুকুটে মণিমুক্তাহীরের জ্যোতি, সেনাপতির দুঃসাহসিক অভিযান, সৈন্যদের চিৎকার, এসবের একটা কথাও বাদ দেবেন না ঔপন্যাসিক। ... যুদ্ধ জয়ের পর সৈন্যদল দেশে ফিরবে যখন, তখনও পিছনে পিছনে ফিরবেন ঔপন্যাসিক। শঙ্খধ্বনি আর সমারোহের আনন্দ ছিটিয়ে আহ্বান জানাবে গ্রামীণা আর নগরকন্যার দল। তাও লিখবেন ঔপন্যাসিক, বর্ণনা দেবেন তাদের, যারা উলুধ্বনির আড়ালে কলরব করে উঠল।
তারপর তিনি ছোটগল্প লেখককে দেখতে পাবেন পথের ধারে, একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন উদাস দৃষ্টি মেলে। এ কোন উন্নাসিক লেখক? — মনে মনে ভাববেন ঔপন্যাসিক। কোনো মিনারের চূড়ায় উঠল না, দেখল না যুদ্ধের ইতিবৃত্ত, শোভাযাত্রার সঙ্গ নিল না, এ কেমনধারা সাহিত্যিক! হয়ত এমন কথা বলবেনও তিনি ছোটগল্প-লেখককে। আর তখন, অত্যন্ত দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ চেয়ে তাকাবেন ছোটগল্পের লেখক, বলবেন হয়ত, না বন্ধু, এসব কিছুই আমি দেখিনি। কিছুই আমার দেখার নেই। শুধু একটি দৃশ্যই আমি দেখেছি। পথের ওপারের কোনো গবাক্ষের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করবেন তিনি, সেখানে একটি নারীর শঙ্কাকাতর চোখ সমগ্র শোভাযাত্রা তন্নতন্ন করে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছে, চোখের কোণে যার হতাশার অশ্রুবিন্দু ফুটে উঠছে — কে যেন ফেরেনি, কে একজন ফেরেনি। "
এই সংকলনের ব্লার্বে মৃণালের লেখনী প্রসঙ্গে মূলত এই কথা বলা হয়েছে সংক্ষেপে। যথার্থ।
Comments
Post a Comment