শূন্য থেকে যাত্রা

 শ্রী অমর মিত্র,

সাহিত্যিক,
পশ্চিমবঙ্গ,
ভারত।

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

লেফাফায় আপনার ঠিকানা লিখতে গিয়ে থমকালাম- কলকাতা লিখব? না কি শুধু পশ্চিমবঙ্গ  লিখলেই হবে? আচ্ছা, পশ্চিমবঙ্গের কোথায়?  শহর না গ্রাম?
আয়তাকার সবুজ মলাটের বইটি আবার উল্টে দেখলাম; আপনি লিখেছেন,  " আমি মূলত নগরের মানুষ। এই কলকাতা শহরে সাত বছর বয়স থেকে আছি। এই শহর আমার নিদ্রায় জাগরণে জড়িয়ে থাকে সর্বসময়। ... এই নগরে আমি চোখ মেলতে শিখেছি, এই নগর আমার পা দুটিকে সবল করেছে। দুর্গম গ্রামাঞ্চলে নিঃসঙ্গ বসবাস, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বারংবার পরিভ্রমণ আমাকে দেশ চিনিয়েছে, আমার দেখায় একটি আদল দিয়েছে... ফলে আমার লেখায় নগর এবং নগরের বাইরে পড়ে থাকা জীবন দুই-ই ঘুরে ঘুরে আসে।"
এইবার, কলকাতা লিখেও কেটে দিলাম। শুধু পশ্চিমবঙ্গই  লেখা থাকুক - গ্রাম, নগর দুইই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল, আপনার লেখার মত।  চিঠি পৌঁছে যাবে ঠিকানায়।
দেখুন স্যার, আপনার লেখা নিয়ে বলতে গেলেই আমার দিদার বাড়ির বইয়ের আলমারির কথা মনে পড়ে। দিদার বাড়ির উঠোন থেকে  দুটি উঁচু ধাপ পেরিয়ে বারান্দা ছিল, সেখানে মাটির টবে স্নেক প্ল্যান্টের ডগায়  ডিমের খোলা-  তাতে রং করা মানুষের মুখ- চোখ মুখ হাসি  টুপি ঘোমটা টিপ  গোঁফ। দিদা এঁকে রাখত - যেন গল্পের সব চরিত্র , যেন তাদের জানতে গেলে ঐ বারান্দায় উঠে ঘরে ঢুকতে হবে।  আমার দিদার ঘর- কড়িবরগা, সোফা, পুরোনো বিশাল আয়না আর পর্দা টানা বইএর আলমারি-
পরে কোনোদিন যখন পড়ব,
"আমার ভাই একটি মথ,
সে বারবার বইয়ের মধ্যে সেঁধোতে চাইত,
বোনেরা ছিল ধুনোর ধোঁয়া
পাতায় পাতায় জড়ানো।
আর আমি কাচের আলমারি।
দক্ষিণ গোলার্ধের ছায়া ছোট ঘরে।"
আমার মনে পড়বে দিদার বই এর আলমারির কথা- যার পাল্লা খুললে ধুনো আর ন্যাপথালিনের গন্ধ আর অমৃত পত্রিকা পাওয়া যেত। অমৃতের সেই সব লালচে নিউজপ্রিন্টের পাতায় প্রথম আপনার নাম আবিষ্কার করি। আপনি তরুণ লেখক তখন।  নাম ই দেখেছিলাম । আপনার  লেখা পড়তে আরো দেরি হয়।
১৯৯৪ এর বইমেলায় প্রকাশিত হয় আপনার গল্পের সংকলন- 'অমর মিত্রর ছোটগল্প'- প্রতিক্ষণ থেকে।  ছোটো আয়তাকার সবুজ মলাটের বই, সর্বমোট এগারোটি গল্প ছিল- সেই সময় দাম ছিল তিরিশ টাকা। দশ নয়, বারো নয়, এগারোটি গল্প- ব্যাপারটা আমাকে অবাক করে।  তারপর আপনার ভূমিকা ' সামান্য কথা' আমার স্টাম্প নড়িয়ে দেয়, ক্লীন বোলড করে- গল্প পড়ার আগেই। তারপর বইটি হারিয়ে ফেলি।
অথচ  হারায় না আপনার 'সামান্য কথা'র  এই লাইন- ' বিষয় নিয়ে তো লিখি না। লেখার পরে তা  হয়ত বিষয় হয়ে যায়। লেখার আগে তা তো থাকে সামান্য বেদনার অনুভূতি। হয়ত কিছুই না।  শূন্য থেকে যাত্রা।"
তারপর কী হয়, এই লাইনগুলি  পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকি-  যেন  তারা পকেট বেয়ে আমার মুন্ডুতে ঢুকে যাবে একদিন, তারপর রক্তে মিশবে। শূন্য থেকে বিষয়ে যাওয়ার কৌশল কোনোদিন শিখে যাব এইভাবে-
কী জানেন, এই সময় একটা ম্যাজিক ঘটে। বিশ্বাস করুন, আমি পরশপাথর খুঁজে পাই অকস্মাৎ এবং আমার প্রবাসজীবনে ঘষে নিতে থাকি। ঠিক তখনই সবুজ বই ফিরে আসে আমাকে অবাক করে। আমার মত ততদিনে তারও বয়স বেড়েছে। পাতার কোণার দিকে ভাঁজ, ভিতরের পাতায় একটু মরচের দাগ মত-
তখন কী হল বুঝলেন স্যার, আমার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই গল্প মনে পড়ে গেল - সেই যে  কৈশোরের পাঠ পরিণত মন কীভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল।  কী করলাম তখন?  কিছুদিন সরিয়ে রেখে, সবুজ বইকে আমি অন্যভাবে পড়তে শুরু করলাম । পকেট থেকে 'শূন্য থেকে যাত্রা ' শব্দবন্ধ বের করে এনে  সামনে রাখলাম-   এই ছটি অক্ষর থেকে যে আলো বেরোচ্ছিল, সেই আলোয় আমি আবার সবুজ বই খুললাম।
প্রথম গল্প - 'সাইকেল মেসেঞ্জার' যার প্রথম লাইন '"ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার শিশির সিংহ তিনদিন জয়েন করেছেন এখানে।" এই তবে সেই লাইন, আপনার কথিত  সেই শূন্য যার থেকে গল্পটি জন্ম নেবে, এগোবে পরবর্তী ন'টি পাতায়। আমি খেলা শুরু করি স্যার এইখানে আপনার সঙ্গে। লাইনটি আবার পড়ি- সম্ভাবনাগুলি নিজে খুঁজে নিতে চাই গল্প পড়বার আগে- প্রথম লাইন আমাকে বলছে মূল চরিত্র সম্ভবত শিশির সিংহই- ‘জয়েন করেছেন’  শব্দদুটি আমাকে তার ভারিক্কিভাব বোঝায় - আর তিনদিন শব্দটি যেন অ্যালিসের চাবি- কোন  দরজা খুলবে এই চাবিতে- আমি সে ঘরে  বেঁকে চুরে ঢুকব, না কি সে ঘরের মেঝে অনেক নিচেয়- ধপাস করে পড়ে  যাব তারপর অবাক হয়ে দেখব তার ছাদ কত উঁচুতে-
অতঃপর’ তিনদিন’ শব্দটি থেকে তিনটি কুঠুরির সন্ধান পাই- একটি কুঠুরি তিনদিনের গন্ডি ডিঙিয়ে শুধুই ভবিষ্যতের দিকে যায়- অতীতশূন্য। অন্য কুঠুরি অতীতে ফেরা। তিন  নম্বর কুঠুরিতে  শিশিরের অতীত আর আগামী।  শূন্য থেকে যাত্রা লাইনটি আমার ত্বকের তলায় সেঁদিয়ে যেতে থাকে এইভাবে,  শিরা ধমনী ফুটো করার তাল করে সম্ভবত-
এই অবস্থায় আমি 'দমবন্ধ' গল্পে যাই যার প্রথম লাইন -"শার্টের কলারে এখনও, এই ষাট বছর বয়সেও ময়লা নেই"। গল্পের বাকি অংশে সাদা কাগজ চাপা দিই এবং অ্যালিসের চাবির গোছা নাড়াচাড়া করতে বসি। প্রধান চরিত্রের নাম নেই প্রথম লাইনে- শার্টের কলার শব্দ থেকে অনুমান করি ইনি পুরুষ, ষাট বছর বয়স। ময়লা শব্দটি আমাকে অনন্ত সম্ভাবনার সামনে দাঁড় করায়- কলারে যাঁর ময়লা  নেই, তিনি কী তাঁর অতীতও ধুয়ে ফেলার পক্ষপাতী? গল্প কী তবে অতীত নিয়ে, তাকে ধুয়ে ফেলা অথবা জমিয়ে রাখা অথবা দুয়ের সংঘাতে? আমার নিজের মত করে সম্ভাবনাগুলি ভাবি ও লিখে ফেলি তারপর পড়তে শুরু করে দিই।
তৃতীয় গল্প 'আবরণ'- আমাদের খেলার স্টার্টিং পয়েন্ট " লাল হলুদ  নীল সবুজ বেগুনি সোনালি খয়েরি কতরকম যে রঙ আছে বেগমপুরের আধবুড়ো কাশীনাথ দাসের ঝুলিতে।" এইখানে বেগমপুর শব্দটি আমাকে প্রার্থিত সূত্র দেয়- আমি দান দিই।
তারপর ধরুন , 'উড়োমেঘ' - আপনি লিখলেন "নিচের তলায় জল আসে টালার জলাধার থেকে সরাসরি।" "উড়োমেঘ" নামটি এইখানে আমাকে বলল- যা হবে সাময়িক। শূন্য থেকে যাত্রা শুরু হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ।
এইভাবে খেলা চলে এগারোটি গল্প জুড়ে- আপনার সঙ্গে এক পাঠকের যে শূন্য থেকে যাত্রার সঙ্গে  কানেক্ট করতে চাইছে।  তখন কী হয় -আকাশের মত অনন্ত সম্ভাবনার তলায় খেলার ছক নিয়ে লেখকের সামনে বসে পড়ে পাঠক- দান ফেলে, ভুল করে, শিখতে থাকে, আবার দান দেয়-
আমার খাতায় লেখা ভুল সম্ভাবনাগুলিকে  কাটা পড়া গুটির মত লাগে এক সময়। খেলার বোর্ড থেকে উঠে গিয়ে তাদের দু হাত ভরে নিয়ে আসি- আমার মুঠো থেকে পিছলে পড়ে তার খানিক, কিছু কাটা পড়া গুটি আঁশের মত হালকা -তারা উড়ে যায়; মুঠোয় যা বাকি থাকে, তাদের আমি মাটিতে পুঁতি।  আকাশের দিকে তাকাই- " খরাদীর্ণ মাটিতে অবিরাম কর্ষণ আর আকাশমুখী হওয়া, যদি মেঘ আসে ফসল হবে।"
নিমগ্ন পাঠক আর লেখককে ঘিরে অতঃপর কতিপয়  চারা গজায়, অগুন্তি হয়ে যায় একসময়, লকলক করে বাড়ে তারা, সেখান থেকে গল্প ঝুলতে থাকে - কখনও কেউ পেড়ে নেয়,  কখনও ডাল থেকে খসে পড়ে ক্রমে মাটিতে মেশে। আত্মমগ্ন যে জন সে  ফিরেও দেখে না। তার চোখ খেলার বোর্ডে, তার রক্তে তখন সিঁধ কাটছে ' শূন্য থেকে যাত্রা'।
এই খেলায় হারজিত হয় না, রেগেমেগে ছক ছত্রাখান করে উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা যদিচ থেকেই যায়। খেলা চলে। খেলা অফুরান ।
নমস্কার জানবেন।
ইতি -
 
[ইরাবতী অগাস্ট ২০২১ ] 

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস