কাজলের ঘনত্ব
কাল রাতে আমি সম্ভবত রামেসিস হয়ে গিয়েছিলাম, আর কেয়া যেন নেফারতরি। অন্তত সেরকমই মনে হয়েছিল তখন। সকালে আবার তত শিওর নই। নিজের থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকেই দেখা তো। তাছাড়া উচ্চতা বদলে যাওয়ার একটা ব্যাপার ছিল যাতে সংশয় তৈরি হয়। প্রথমে দেখছিলাম, যেন ভিক্টোরিয়ার সামনে বসে গল্প করছি দুজনে; কেয়ার মুখের বাঁ পাশ দেখা যাচ্ছিল - রোদ পড়েছে গালে , ওর কানে ঝোলা দুল, ময়দানের হাওয়ায় হাওয়ায় চুল উড়ছে; দু হাতে হাঁটু বেড় দিয়ে বসেছে কেয়া- ঘড়ি, হাল্কা গয়না, পায়ের পাতা - চটির স্ট্র্যাপবিহীন; নিজেকেও স্পষ্ট দেখলাম- শরীরের ভার দুহাত মারফত ঘাসে রেখে পা টানটান ছড়িয়ে দিয়েছি। আমাদের পিছনে ঘন সবুজ ঘাস পেরিয়ে থামওলা অট্টালিকা- ভিক্টোরিয়াই হয়তো- ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে খেয়াল করলাম থামগুলো ক্রমশ উঁচু হচ্ছে -হচ্ছে তো হচ্ছেই- সেই সঙ্গে আমিও লম্বা হয়ে চলেছি, ঘাস টাস, কেয়ার প্রোফাইল কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। চোখের সামনে শুধু নীল পর্দা সরে সরে যাচ্ছে, যেন একটা গল্পের অতি দ্রুত পট পরিবর্তন ঘটছে- কী হতে চলেছে আন্দাজ করতে না পেরে পাঠক বিমূঢ় হয়ে পড়ছে ফলত। আমার মাথা টলটল করছিল, মনে হচ্ছিল পড়ে যাব। তারপর লিফট থামার মত ঝাঁকুনি লেগেছিল হঠাৎ - দেখলাম একটা বড় চেয়ারে বসে আছি, হাত পা ঘাড় সব অবশ- কিচ্ছু নাড়ানো যাচ্ছে না; চোখের কোণ দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, পাশে কেউ একজন - কোলের ওপর দুই হাত জড়ো, মুখ দেখা যায় না- মেয়েদের পারফিউমের হাল্কা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল শুধু। আমার সামনে তখন শুধুই নীলে নীল আকাশ- রোদ ঠিকরোচ্ছে তাতে, কপাল মাথা সমস্ত শরীর চিটপিট করছিল , জ্বালা করছিল- তখনই হঠাৎ মনে হল আমি রামেসিস, পাশে নেফারতরি । এত উঁচুতে সম্রাট সম্রাজ্ঞী ছাড়া আর কে বসবে, মুকুটের ভারে যাঁদের ঘাড় মাথা সব অবশ। পারফিউমের টপ নোটের মতো ভাবনাগুলো আসছিল, উবে যাচ্ছিল তৎক্ষণাৎ, বেস নোটের হদিশ পাচ্ছিলাম না। নেফারতরিকে এখন মনে হচ্ছে কেয়াই। আবার নাও হতে পারে।
কেয়া। আমার সহকর্মী। কবি। লেখালেখি নিয়ে আমাদের কথা হয় কাজকর্মের ফাঁকে। বইমেলায়, সাহিত্যসভায় দেখাও হয়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ। কোভিডের সময় কেয়া আমার জন্য অনেক করেছে, মা বাবার জন্য হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স , অক্সিজেন সিলিন্ডার, শ্মশান, সান্ত্বনা। তখন থেকেই আমার তরফে টান তৈরি হয়েছিল সম্ভবত। প্রথম প্রথম খুব চাইতাম, ও আমার সব লেখা পড়ুক, মতামত দিক। তারপর মনে হল, কেয়াকে আমি পাঠক হিসেবে চাইছি না। আসলে চেনা পাঠক নিয়ে একটা সংশয় রয়েছে বরাবর। আগে মা ছিল, বাবাও, এখন মূলত বন্ধুবান্ধব, ছোটো পত্রিকার সম্পাদক কয়েকজন - একটা গণ্ডীর মতো। কেয়া হয়তো সেই খড়ির দাগকে একটানে সম্পূর্ণ বৃত্ত করে দেবে যার কেন্দ্রে আমি, পরিধিতে ঐ গোণাগুণতি ক'জন পাঠক, সকলেই চেনা মুখ, প্রিয় জন। কোথাও আটকে গিয়েছি বুঝতে পারি।
আজ বিকেলে কেয়ার সঙ্গে দেখা হবে। একটা অনুষ্ঠানে আমার গল্পপাঠ আছে সন্ধ্যায়। ঘন্টা তিনেকের আসর- সাহিত্যের বসন্তোৎসব- অনুষ্ঠানের নাম। মূলত তরুণ লেখকরা গল্প পড়বেন, একজন বিখ্যাত লেখক শুনবেন , উৎসাহ দেবেন, নিজের সম্পাদিত পত্রিকার জন্য গল্পও চেয়ে নিতে পারেন - উদ্যোক্তারা সেরকমই জানালেন। এই ধরণের অনুষ্ঠানে আগে কখনও ডাক পাই নি। গল্প পাঠের সময়সীমা, গল্পের শব্দসংখ্যা বেঁধে দেওয়া আছে, কারণ ঠিক আটটায় সভাগৃহ ছেড়ে দিতে হবে। ওখানেই কেয়া আসবে। আজ ওর জন্মদিন। একটা গিফ্ট কিনে রাখা উচিত ছিল আমার। নতুন গল্পের একটা প্রিন্ট আউট ব্যাগে নিয়েছি;আসলে ভাবছি, গল্পটাই কেয়ার জন্মদিনের উপহার হোক।
রাতের স্বপ্নের কথা ভুলে গিয়েছিলাম - চাপা টেনশন সকাল থেকে- শহরের সাহিত্যসভায় নামকরা লেখকের সামনে গল্পপাঠের সুযোগ, তার ওপর কেয়ার জন্মদিনের উপহারজনিত সংশয় ও দ্বিধা। তবে টেনশনের ওপরে নিচে লেয়ার ছিল বিবিধ - একদম নিচে দমবন্ধ উত্তেজনা, তার ওপরে টেনশন, তার পর আবার হাল্কা উত্তেজনার প্রলেপ, আইসিংএর মতো আমার স্বভাবগত গড়িমসি উত্তেজনাকে দমিয়ে রাখছিল। কোথাও পড়েছিলাম, আমাদের ব্রেন নিরাপদ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায় স্বাভাবিকভাবে, সেখান থেকেই আলসেমি পেড়ে ফেলে মানুষকে, নিজের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করে নিয়ে মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ কব্জা করে ফেলতে হয় এই সময়। বিকেলের সভাস্থল অনেকটাই দূরে- দুপুর দুপুর বেরিয়ে পড়তে পারলে ভালো, স্নান টান এখনই সেরে নেওয়া দরকার জেনেও একটা টবকে ঘর থেকে বারান্দায় সরিয়ে আনতে শুরু করলাম।
ঠিক তখনই দু নম্বর ফিকাস ইলাস্টিকা তার শেষ পাতাটি ঝরিয়ে যেন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। আর সেই বাতাস আমার চুল ঘেঁটে দিয়ে কপাল বেয়ে চোখের পাতা ছুঁয়েছিল যখন, ওকে নিজের মতো লাগল আমার। একা, অগোছালো, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আসলে হাওয়ার ঝাপট লাগতেই প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় মুখ সরিয়ে নিতে এক নম্বর ফিকাস ইলাস্টিকাকে দেখতে পেয়েছিলাম- ঘরের মধ্যে ঝলমল করছে - যেন এক্ষুণি ওর সামনে বল নাচের মস্ত আসর বসবে, আলো জ্বলবে, বাজনা বাজবে, ভাজা মাংস, পানীয়র গন্ধে ম ম করবে বাড়ি ঘর, যতেক অভ্যাগত আর নাচিয়ের দল ঘাড় ফিরিয়ে শুধু ওকেই দেখবে দু নম্বরের দিকে ফিরেও তাকাবে না- এক নম্বরের টানটান কান্ড, শাখা প্রশাখার ক্লোরোফিলের সবুজে যেন রক্তমাংসের গোলাপীর আভা, চওড়া মসৃণ পূর্ণতাপ্রাপ্ত পাতার ভাঁজে এযাবৎ অপ্রস্ফুটিত পাতার অঙ্কুর। এক নম্বর নিজেও বেঁটে পাতা খসা দুনম্বরের দিকে তাকিয়েও দেখে না - টব সরাতে গিয়ে সেরকমই মনে হচ্ছিল আমার, কারণ ঘরের দিক থেকে বারান্দার দিকে কোনো হাওয়াই বইছিল না। দীর্ঘনিঃশ্বাস একতরফাই ছিল খুব সম্ভব। স্বপ্নটা তখনই মনে পড়ে গিয়েছিল- ভিক্টোরিয়ার মাঠ থেকে সাঁ সাঁ করে আকাশে উঠে যাওয়া অবধি- পুরোটাই। উচ্চতার সঙ্গে দৃষ্টিগোচরতার সম্পর্ক ঠিক সরলরৈখিক নয়- এই রকম মনে হচ্ছিল।
রাবার গাছগুলো আদতে মা বাবার। যেমন এই ঢাউস অ্যাকোরিয়াম, পুরোনো রেডিও, স্টিরিও প্লেয়ার, আরামকেদারা, এই দোতলা বাড়ি, আমি। শখের। যাদের ফেলে যখন খুশি চলে যাওয়া যায়। দুটো গাছ মুখোমুখিই ছিল এত দিন। মা বলত রাবার গাছ নাকি জায়গা বদলানো পছন্দ করে না। লকডাউনের সময় হাসপাতালের ছেলে দুটো আর আমি যখন মা বাবাকে স্ট্রেচারে তুলে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলাম, আমারই পা লেগে একটা টব সরে গিয়েছিল; মা বাবাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দৌড়ে আসি, টব সোজা করে ফেরত যাই। একই জায়গায় ছিল দুটো টব এতদিন। কদিন ধরেই বাঁদিকের গাছটার পাতা কুঁকড়ে যাচ্ছিল তারপর ঝরে পড়ছিল । প্রথমে একটা দুটো পাতা ঝরা স্বাভাবিক ভাবছিলাম- তারপর দ্রুত পাতার রঙ বদলে যেতে শুরু করল, চওড়া সবুজ পাতা ছোটো আর বাদামি হয়ে গিয়ে ঝরে পড়তে লাগল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আলো জ্বালালে দেওয়ালে একটা লাঠির ছায়া পড়ছিল -কুঁকড়ে যাওয়া পাতাদের চেনা যেত না-লাঠির গাঁট ভ্রম হচ্ছিল। গাছটাকে দিশেহারা আর অসহায় লাগত আমার। নেট ঘেঁটে এসব গাছের যত্ন আত্তির ব্যাপারে বেশ কিছু আর্টিকল আর ভিডিও দেখে মনে হল গাছটার আরো আলো দরকার। খেয়াল করছিলাম, জানলা দিয়ে আসা আলো ডানদিকের গাছের কাছে যতটা পৌঁছোয়, অন্য গাছটায় ততখানি নয়।ঐ গাছটাকেই সরাচ্ছিলাম বারান্দায়। গাছের শেষ পাতা ঝরে পড়তেই টবের পাশে কিছুক্ষণ বসে রইলাম ঠায়, খেয়াল করলাম একটা ডালের আগা সামান্য সবুজ- পাতার কুঁড়ি দেখা যাচ্ছে। জল দিলাম গাছে, ম্যানিওরের পেলেট ছড়িয়ে রাতের স্বপ্নটার রিপ্লে দেখতে শুরু করলাম চোখ বুজে। এবার নিজের ইচ্ছামত এগিয়ে পিছিয়ে আনছিলাম দৃশ্য গুলো। কখনও পজ করছিলাম, কখনও রিওয়াইন্ড কিম্বা ফাস্ট ফরোয়ার্ড। কেয়ার একটা মেসেজ এলো ঠিক এই সময় - "গল্পটা একবার জোরে জোরে পড়ে নিও অন্তত।" আমার ফোনেই গল্পটা সেভ করা। টাইমার সেট করে বারান্দায় সরিয়ে আনা গাছের সামনে গল্প পড়তে বসলাম। কোথায় যেন পড়েছিলাম, গানবাজনার সঙ্গে গাছের বাড়বৃদ্ধির একটা যোগ আছে। গল্পটা শুনলে ফিকাস ইলাস্টিকায় পাতা গজাবে? এই গল্পে কি কোনো সুর আছে যা প্রাণকে ছোঁয়?
গল্পের নাম দিয়েছিলাম- জগদীশ ও শ্রীদেবী। জগদীশের বাবা নেই, মা মাথায় ফুল গুঁজে পাড়ার মোড়ে 'নাচ মেরি বুলবুল' গাইবার সময় নিজেকে শ্রীদেবী বলে ক্লেম করত - এলোমেলো শাড়ি, জট পাকানো চুল; তারপর জগদীশকে ফেলে একদিন হাওয়া হাওয়াই পুরো। ঠাকুমার কাছে বড় হল জগদীশ; ক্লাস এইট অবধি পড়ে স্কুল ছেড়ে দেয়; ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল, বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পেয়েছিল দুবার। রাতের দিকে, ফুটপাথে শ্রীদেবীর ছবি আঁকত জগদীশ; মায়ের মনোবিকলন সন্তানে বর্তেছিল- ফলে বাথটবে ডুবে শ্রীদেবীর মৃত্যুর পরে জগদীশের ধারণা হয় কোনো একদিন পেল্লায় জাহাজে চড়ে ওর মা ফিরে আসবে। এক বর্ষার রাতে নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটবাড়ি ভেঙে পড়ার সময় সবাই পালাতে থাকে, শুধু জগদীশ ফুটপাথ ছাড়ে না, জাহাজের ডেকে দাঁড়ানো শ্রীদেবীর সানগ্লাসে নীল রঙ করে চলে।
২
ছোটো সভাঘর লেখকে পাঠকে ভরে গিয়েছিল। কেয়া অনেক আগেই পৌঁছেছে। সেজেছে খুব। দুল, টিপ, বাহারি ক্লাচার। আমি লম্বা শ্বাস ফেলে পিছনের সারিতে বসলাম। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ হয়েছিল নির্ঘাৎ - কেয়া পিছন ফিরে হাত নাড়ল , উঠে দাঁড়াল আচমকা। মনে হল, আমার পাশে এসে বসবে, কিন্তু রয়ে গেল ওখানেই । মঞ্চের কাছে। প্রবীণ লেখককে দেখা যাচ্ছিল- কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন। জল খেলেন দুবার। দুটি মেয়ে লেখকের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে গেল, তিনটি ছেলে তারপর। একজন বয়স্ক মানুষকে দেখলাম, লেখকের অটোগ্রাফ নিয়েই বেরিয়ে গেলেন। চায়ের কেটলি থেকে ভাঁড়ে চা দেওয়া হচ্ছিল সবাইকে, আর একটা সিঙাড়া - আমি কিছুই নিলাম না। পেটের ভিতরে প্রজাপতিরা পাখা মেলে দিয়েছে ততক্ষণে।
'হ্যালো হ্যালো মাইক টেস্টিং '- শুরু হয়ে গেল এই সময়। সাউন্ড সিস্টেমে কিছু গোলমাল রয়েছে বোঝা যাচ্ছিল- ঘরঘর শব্দে ঘোষকের কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে। প্রায় দশ পনেরো মিনিট গেল এই সব ঠিক করতে। লেখক ঘড়ি দেখে ঘাম মুছলেন, কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললেন ঘাড় হেলিয়ে- উদ্যোক্তাদের সামান্য নার্ভাস দেখাচ্ছিল। এরপর চারজনের একটি দল সংকোচের বিহ্বলতা আর সবারে করি আহ্বান শেষ করে হারমোনিয়াম আর তবলা গুছিয়ে নিল। লেখক আবার কর্মকর্তাদের ডেকে কথা বলছিলেন; আচমকা " আমার তাড়া আছে , শুরু করে দিন, গান টান পরে হবে"-লেখকের এই কথা পিছনের সারিতে পৌঁছে গেলে বোঝা গিয়েছিল সাউন্ড সিস্টেম এখন মারাত্মক রকম ভালো কাজ করছে । তবু, আরো মিনিট কুড়ি গেল লেখককে মালা আর উত্তরীয় পরাতে, উদ্যোক্তা আর লেখকের ভাষণে। নবীন লেখকদের নাম ধরে ডাকা হচ্ছিল এরপর, মঞ্চে উঠে গল্প পাঠ করে তাঁরা নেমে আসছিলেন একে একে। প্রতিটি গল্পের শেষে প্রবীণ লেখক হাসিমুখে ঘাড় হেলাচ্ছিলেন, ঘড়ি দেখছিলেন পরমুহূর্তেই, তাঁর হাসির দৈর্ঘ্য প্রস্থ ক্রমশ কমছিল। সময় দেখছিলাম আমিও -পাঠের সময়সীমা ধার্য ছিল পনেরো মিনিট, খেয়াল করছিলাম, কুড়ি মিনিটের কমে কেউই মঞ্চ ছাড়ছেন না। গল্প শুনতে ভালো লাগছিল প্রথমটায়- আমারই সমবয়সী ছেলে মেয়ে সব- অনেকের লেখাই আগে পড়ি নি কোথাও। তারপর ঘন্টাখানেকের মাথায় ক্লান্ত লাগতে শুরু করল; দেখলাম, লেখক একটা হাই তুললেন লুকিয়ে।
এদিকে ঘড়ির কাঁটা আটটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল অবশ্যম্ভাবী। আমার গরম লাগছে এখন, হাতের তেলো ঘামছে- আর কখন ডাকবে? আমার এক পাশে খয়েরি পাঞ্জাবি, নীল শাড়ি অন্য পাশে। খয়েরি পাঞ্জাবিকে উঠে গিয়ে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখলাম। নীল শাড়ি মোবাইলে কাউকে মেসেজ করছিল একের পর এক। এবার খয়েরি পাঞ্জাবির নাম ডাকা হতেই কেয়া পিছন ফিরল - ঈষৎ ম্লান দেখাচ্ছিল ওকে। আমার চোখে চোখ রেখে হাতের ভঙ্গি করল, যেন আর কত দেরি জিজ্ঞেস করছে- আমি কাঁধ ঝাঁকালাম। মোবাইল রেখে দিয়ে নীল শাড়ি বলল, "আটটা মানে কি আর আটটা দাদা, দেরিতে শুরু করেছে, দেরি করেই শেষ করবে। আপনি আর আমিই তো লাস্ট। ঠিক হয়ে যাবে। " পৌনে আটটা নাগাদ লেখক মঞ্চ থেকে নেমে উদ্যোক্তাদের কিছু বলতে , একজন আমাদের কাছে দৌড়ে এলেন- "লেখক বেরিয়ে যাচ্ছেন, হলও ছাড়তে হবে , আপনারা দু জন অণুগল্প পড়তে পারবেন? এনেছেন কিছু সঙ্গে?" মনে হল সবার সামনে কেউ টেনে চড় কষাল আমাকে। কান ঘাড় গরম- মাথা নিচু করে নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম। নীল শাড়ি ওর ঝোলার ভিতর কী খুঁজছে খেয়াল করলাম।
- কী, বলুন, আছে অণুগল্প? পাঁচ মিনিট পাবেন, জাস্ট পাঁচ মিনিট কিন্তু-
নীল শাড়ি মৃদুকণ্ঠে বলল-"অণুগল্পই সই, তবু তো ওঁকে কিছু শোনাতে পারব"।
আমি বেরিয়ে এলাম। কেউ পিছু ডাকে নি। ডাকার কথাও নয়।
বাইরে এসে সিগ্রেট ধরিয়েছিলাম; সভাঘরের বারান্দায় অনুষ্ঠানের ব্যানার, লেখকের ছবি, সে সব ঘিরে টুনিবাল্ব জ্বলে নেভে জ্বলে নেভে ; শহরের পাঁজর বেয়ে বিক্ষুব্ধ সব বাতাস বয় বসন্তের রাতে- বৃদ্ধ মানুষের শ্বাস টানার মতো শব্দ ওঠে তখন। অডিটোরিয়ামের দরজা খোলার আওয়াজ হল - দেখলাম কেয়া বেরিয়ে আসছে।
- ঠিক করেছ। গল্প না পড়ে ঠিক করেছ তুমি। ডেকে এনে অপমান করবে! দু কথা শুনিয়ে এলাম। লেখক দুঃখপ্রকাশ করলেন। এখনই বেরিয়ে যাবেন । কথা বলবে? গল্পটা অন্তত ওঁর হাতে দাও, পড়তে বলো।
-দূর -
-দিয়েই দেখো না-
মাথা নাড়লাম-" ওঁর হাতে দেওয়ার জন্য তো আনি নি।"
কেয়া একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল- রাস্তার আলোয় আমাদের ছায়া দুটি পাতা ঝরা ফিকাস ইলাস্টিকার মত। ওকে এখন বলব স্বপ্নের কথা?
- কিছুই তো খাও নি, চা সাধছিল, নিলে না দেখলাম; বাসগুমটির পাশে একটা চায়ের দোকান আছে। ভাঙাচোরা মত। ভীড় নেই। যাবে?
৩
" আরে দেখো দেখো সাবধানে পা ফেলো- ওমা কী সুন্দর ছবি ! "- কেয়া আচমকা চেঁচিয়ে ওঠে আনন্দে। দেখি, সভাঘরের ছায়া শেষ হয়ে যেখানে বড় রাস্তার আলো শুরু হয়েছে, সেইখানে ফুটপাথ জুড়ে লাল নীল সাদা হলুদ সবুজ চক খড়িতে বন জঙ্গল নদী পাহাড় হাতি ঘোড়া উট চাঁদ তারা সূর্য আর উড়ন্ত সব পাখির ঝাঁক - তার তলায় লেখা হেল্প মী আর থ্যাংক ইউ। কয়েন, খুচরো টাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। লম্বা জটাধারী একজন উবু হয়ে বসে সেই সব ছবিতে দাগা বুলায়, মোছে আবার আঁকে-
- জগদীশ!
- তুমি চেনো ওঁকে?
উত্তর না দিয়ে ফুটপাথে থেবড়ে বসি আমি- "খুব ভালো আঁকেন তো । কী নাম আপনার?"
"সুলেমান"- জটাধারী একমনে নীল নদীতে লাল নৌকা আঁকতে থাকে।
- কোথায় থাকেন?
" ইধারই "- সে প্লাস্টিকের ছাউনির দিকে আঙুল দেখায়-
- এখানেই বরাবর? কী করেন?
- ছবি আঁকি।
- এতে চলে?
- লোকে খুশি হয়ে যা দেয়, আমার বিবি কাজ করে। দুজন মানুষ। চলে যায়।
- কোভিডের সময় ? এখানেই ছিলেন?
"কোথায় যাব? পুলিশের লোক খাবার দিয়ে যেত। দুবেলা দিয়েছিল প্রথমদিকে। তারপর একবেলা।" হাসল সুলেমান।
"আপনি বাংলা পড়তে পারেন ?" ঝোলার অভ্যন্তরে গল্পের প্রিন্ট আউটে হাত রাখি আমি-
- বিবি পারে। খুব খাটে সারাদিন। বহোত কুছ কাম করে দিনভর। সকালে বিড়ি বাঁধতে যায়। রাতে আবার ঠোঙা বানায়, ঢের সারে পুরানা পেপার পড়ে নেয় তখন; বাংলা পড়ে, হিন্দি ভি, সিলাইএর কাম করে- টেলারের দোকান থেকে অর্ডার পায়, পুঁতির মালা বানায়, কাজল তৈরি করে - ঐ যে কাজল বানাচ্ছে -
প্লাস্টিকের তাঁবুর সামনে শীর্ণ নারীমূর্তি, সামনে জ্বলন্ত প্রদীপ - যেন প্রার্থনায় বসেছে সে। কাছ থেকে দেখি তাকে- ছোটো ছোটো চামচে তেল মাখিয়ে প্রদীপের শিখার ওপর ধরছে আর কালির পরে কালি জমছে চামচে; পোড়া গন্ধ বাতাসে; সে নাক টানছিল, ছোটো বাটিতে রেখে দিচ্ছিল কালিমাখা চামচ, তাপমাত্রা নেমে গেলে আঙুল দিয়ে সেই কালি পাতায় মাখিয়ে মুড়ে নিচ্ছিল, সরিয়ে রাখছিল একপাশে। আবার চামচ ধরছিল শিখায়। চোয়াল ভাঙা হাই ওঠে তার দিনের শেষে। সে চোখ ডলে, আবার চামচ ধরে আগুনের ওপর।
হাত পাতি তার সামনে - "কাজল নেব", মানিব্যাগ খুলি।
-দিনের শেষ কাজল, আপনি এমনি নিয়ে যান, টাকা দিতে হবে না।
পাতায় মোড়া কাজল ঝোলায় ভরে রাখি। গল্পের প্রিন্ট আউট হাতে দিই তার। সে অবাক হয়ে তাকায় , হাত বোলায় কাগজে, কাজলের কালি গল্পের গায়ে লেগে গেলে সে লজ্জা পায়, আলতো করে আঁচল ঘষে গল্পে, তারপর প্রদীপের সামনে টান টান করে কাগজ মেলে ধরে, চোখ ডলে নেয় দুবার।
আমি আর দাঁড়াই না সেখানে। হাল্কা লাগে খুব, রাগ, বেদনা আর যাবতীয় অপমান যেন হঠাৎ ভ্যানিশ করে গেছে, আর যেন ফিরে আসবে না। কত ফালতু ওজন বয়ে বেড়াচ্ছিলাম এতক্ষণ। কেয়ার পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। একদম নির্ভার। রাস্তা পেরিয়ে চায়ের দোকান। বাইরে একফালি বেঞ্চ। কেয়া আমার পাশে বসে - "তোমার গল্প পড়াবে না ? হোয়াটস্যাপ করে দিও।"
আমি হাসি। ওর হাতে পাতায় মোড়া কাজল তুলে দিই তারপর থেমে থেমে বলি - "হ্যাপি বার্থডে , কেয়া।" আ টানটা ভাসিয়ে দিই বাতাসে -
আমরা চা খাই । মিয়োনো বিস্কুট। পুরোনো ট্রানজিস্টরে গান বাজায় দোকানী, গুনগুন করে সুর ভাঁজে - হোলি আয়ি রে , পিয়া জি রে দেশ-
"দোল যেন কবে? " কেয়া আপনমনে বলে ওঠে, যেন উত্তরের প্রত্যাশীই নয় এই মুহূর্তে, যেন স্রেফ রঙের কথা ভাবতেই ভালো লাগছে ওর।
দোকান ছাড়িয়ে ডানদিকের বাসগুমটি। প্ল্যাকার্ডে ঢাকা বটের চারা গজানো পাঁচিল- আলো আঁধারে তাকে দুর্গপ্রাকার ভ্রম হয় সহসা-যেন কোন গোপন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে শহর জুড়ে। রাতের ট্রিপের বাসেরা ঢোকে, বেরোয়, ঢোকে, ভাঙাচোরা রাস্তায় পাক খেতে খেতে ধুলো ওড়ে খানিক; পরস্পরের হেডলাইটে তাদের যুদ্ধাশ্ব মনে হয় তখন । বাসের মেটালবডিতে গাঢ় লালে লেখা - রাজচন্দ্রপুর। "কী সুন্দর নাম! যাবে একদিন?” কেয়া বলে। আমরা উঠে দাঁড়াই।
দোকানের অভ্যন্তরে উঁকি দিই। সেখানে মলিন আলোর কতিপয় বৃত্ত ঘিরে ছোটো ছোটো টেবিল, সেখানে চা খায়, গল্প করে কাজ-ফেরত মানুষ, মলিন বেশ, ধুলো পা, তারা জোরে জোরে হেসে ওঠে, গলা চড়ায়, গানের তালে মাথা নাড়ে কখনও। আমরা দুজন ভিতরে ঢুকি, কেয়ার করতল স্পর্শ করি, তর্জনী দিয়ে অক্ষরদের লিখি পরপর। জিজ্ঞাসা চিহ্ন আঁকি। ও আমার চোখে চোখ রাখে।
মোবাইল হাতে নিয়ে গলা তুলি ,"গল্প শুনবেন?"
"জগদীশ ও শ্রীদেবী" পড়তে শুরু করি। ছায়ারা ঘুরে বসে।
[প্রথম প্রকাশঃ সৃজনেষু, ২০২৪; খানিক বদলেছি তারপর]
Comments
Post a Comment