কুহক
সম্পর্ক
থেকে বেরিয়ে আসার ঠিক আগে
মানুষ একটা ছবি হাতে
নেয়; ফ্রেম
থেকে খুলে, হাতের মুঠোয় পাকিয়ে ফেললে গোটানো ক্যানভাসকে রিলে দৌড়ের ব্যাটনের
মত লাগে । তারপর
কোথাও হুইশল বাজে, ব্যাটন হাতে সে এবার
এক পা দু পা
করে পিছু হটতে শুরু
করে; একটু থামে , হাতের
ছবি খুলে কিছু দেখে,
পিছোয় আবার; তারপর হাঁটার গতি বাড়ে, একটা সময় স্প্রিন্ট
টানে সে , উল্কার বেগে
সম্পর্ক থেকে বহু দূরে
চলে যায়। প্রতিটি শেষ
হওয়া সম্পর্কের সঙ্গে একটা করে ছবি
থাকে - আমার এরকম মনে
হয়; ফ্রেমহীন
ছবি সব - হয়তো পুরোনো
সম্পর্কের ওয়াটার কালার - লাল রঙে চুবিয়ে
তোলা, কিম্বা
পরের সম্পর্কের ঝকঝকে
প্রিন্ট- গ্লসি ফিনিশ; অথবা
হয়তো গোটাটাই অ্যাবস্ট্রাক্ট - একটা
অবয়ব হয়তো, আপাতদৃষ্টিতে যাকে মনে হয় নৃত্যরত
মানুষ, ডানা ঝাপটানো রাজহাঁস,
ছুটন্ত ঘোড়া - কেশর উড়ছে; অথবা
জাস্ট অন্ধকার, পিচ ডার্ক শূন্যতা।
সম্পর্ক পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবার
পরে, এই সব ছবিদের
আল্টিমেটলি কী হয় শান্তিপিসির
মরে যাওয়া অবধি আমার ধারণা
ছিল না। আসলে আমার
হাতেও ছবি
এসে গিয়েছিল। নিতান্ত ছোটোবেলায়। সে ছবিতে একটা
পাড়া দেখা যেত, সেখানে নতুন,
পুরোনো বাড়ি ঘর, ছাদে
ফুলের টব, অ্যান্টেনা, ধোয়া
কাপড় মেলা রয়েছে, গ্রিল
দেওয়া বারান্দা- দুপুরের রোদ চড়া হতে
হতে ছবির মূল রঙ
ক্রমশ কমলা হয়ে যাচ্ছে।
ছবিতে ঘরদোরের জানলা দরজা বন্ধ, শুধু
গোলাপী বাড়ির বারান্দার একপাশে খোলা দরজা - ভিতরে সিলিং
ফ্যান আর ঘড়ির কাঁটা
দুইই বনবন করে ঘুরছে।
প্রাচীন বে- রঙ ঘরদোর
সূর্যের আলো শুষে নিচ্ছে
যেন সন্ধ্যার দিকে সেই ধার
করা আলো দিয়ে মানুষজনকে
চমকাবে, আর
নতুন সব বাড়ি থেকে
আলো ঠিকরোচ্ছে এমন যে চোখ
ধাঁধিয়ে গিয়েছিল আমার।
ক্যানভাসের এক কোণে টাইম
কলের মাথা ভাঙা। ভেজা মসৃণ অ্যাসফল্ট
, কিছু খানাখন্দ দেখা যায়- সেখানে
জল জমে আছে; ঠিক তার পাশে
একটা হলুদ ট্যাক্সি ; পেট্রল
চুইঁয়ে পড়েছে সম্ভবত- জমা জলে রামধনু
দেখা যাচ্ছিল; আর লাল কালো
শাড়ি পরা একটি অল্পবয়সী
মেয়ে ট্যাক্সির দরজায় হাত রেখে ঘাড়
ঘুরিয়ে দেখছে- চাহনি ছবির ফ্রেমের বাইরে
যেন ট্যাক্সিতে ওঠার সময় কেউ
পিছু ডেকেছে তাকে ; আর টাইমকলের দিক
থেকে একজন ট্যাক্সির দিকে
এগিয়ে আসছে- আউট অফ ফোকাস,
অস্পষ্ট অবয়ব।
এক
দুপুরে আমার কাছে নিজেই
এসেছিল ছবিটা।
সম্ভবত, মেয়েটির ট্যাক্সিতে ওঠার প্রত্যক্ষদর্শী
ছিল ঐ আধঘুমন্ত
পাড়া, যেন ড্যাব ড্যাব
করে শুষে নিয়েছিল পুরো দৃশ্য;
তারপর, এক দিন ঘরবাড়িরা
তাদের আর্কাইভ ঘেঁটে বের করে এনেছিল
সেলুলয়েডের গোটানো রীল, প্রজেক্টর চালিয়ে
ছবি পাঠাচ্ছিল আকাশে, দেখছিল নিজেরাই। আমার
দেখার কথাই নয়; কিন্তু
কী করে কে জানে,
জানালার খড়খড়ি দিয়ে সে ছবি
আকাশ থেকে আমার ঘরে ঢুকে
পড়েছিল সটান। তখন ট্যাক্সিতে ওঠা
মেয়েটিকে আমার নিজের মা
মনে হয়েছিল, আমার
সত্যিকারের মা, যাকে আমি
কখনও দেখি নি।
আসলে,
মা-কে নিয়ে আমার
কনফিউশন ছিল বরাবর। বস্তুত
সন্দেহ। ছোটোবেলায় হাউজিংএর অন্য মায়েদের দেখেছি,
তারপর, স্কুলের
সামনে আরো অনেক মা - সবাই তাদের
ছেলে মেয়েদের আদর করছে; এই
চুল ঘেঁটে দিল, তারপরেই এগালে ওগালে চুমু, কিম্বা হয়তো কোলে করে
জমা জল পার করে
দিচ্ছে ছোটোখাটো রোগাভোগা মা, ঢ্যাঙা ছেলের
পা মায়ের হাঁটু পেরিয়ে ঝুলছে; পুজোর ছুটিতে ডলি, পলিদের বাড়ি
গেলে দেখতাম, ওরা
কাকীমার গায়ে ঠ্যাং তুলে
সুর করে বলছে- মায়ের
পায়ে পা দিয়ে ভাই,
ঘুমটি লাগাই, ঘুমটি লাগাই আর কাকীমা ডলি,
পলিকে চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়াচ্ছে ।
মা কোনো দিন এভাবে
আদর করে নি আমাকে।
সব সময় তুমি তুমি
করে কথা, চুমু খাওয়া
দূরে থাক, ঘুমের সময়
মার কাছে ঘেঁষটে এলে
ঠাণ্ডা গলায় বলেছে-সরে
শোও। রাস্তায় হাঁটছি মার পাশে পাশে,
হয়তো হাত ধরলাম মা
র, সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে মা
বলেছে- নিজে নিজে হাঁটো,
হাত ধরার দরকার নেই
তো। সংশয় জমছিল, যা
বস্তুত সন্দেহ।
ক্লাস
থ্রিতে চিকেন পক্স হয়েছিল আমার-
আলাদা থাকতে হয়েছিল প্রায় দু সপ্তাহ। ভাই
খুব ছোটো তখন। মা
ঢুকত না আমার ঘরে।
সেই সময় শান্তিপিসি দায়িত্ব নিলো আমার
। শান্তিপিসি
বাবার মাসতুতো দিদি, অনেক দূরে কোনো স্কুলে
পড়াত - একা মানুষ। আমার
পক্সের সময় ছুটি নিয়ে
আমাদের বাড়িতে ছিল। মাথা ধুয়ে দেওয়া , গা স্পঞ্জ- -সব শান্তিপিসি; খেতে
দিত, ঘুম পাড়াত গল্প
বলে। একটা মেয়ের গল্প
বলত খুব- তার মা
না কি তাকে হারিয়ে
ফেলেছিল, অনেকটা অলিভার টুইস্টের গল্পের মতো- আমার সেই
বয়সের পক্ষে গল্পটা জটিল আর সম্ভবত
অসুখের জন্য মস্তিষ্কের আলস্য-
সব মিলে, গল্পের মাঝপথেই ঘুমিয়ে পড়তাম রোজ। এমনও হতে
পারে, শান্তিপিসি গল্পটা সেই কারণেই বারবার
বলত। একদিন ঐ রকম গল্প
শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি দুপুরবেলা; আচমকা কারেন্ট অফ, ধড়মড় করে
ঘুম ভেঙে দেখি পাখা
ঘুরছে না, চারদিক কেমন
চুপচাপ, ঘরে কেউ নেই, বাইরের রোদের তাত কমে আসছে,
আর ভেজানো জানলার খড়খড়ি বেয়ে আলো ঢুকছে,
ছবি তৈরি হচ্ছে দেওয়ালে।
দেখলাম - একটা পাড়া, ঘরদোর,
হলুদ ট্যাক্সি, লাল কালো শাড়ি
পরা মহিলা। আমার দিকে ফিরে
ঘাড় ঘুরিয়েছিল স্পষ্ট। হেসেছিল। কোথাও একটা বেড়াল ডেকে
উঠেছিল তখন, বাসন পড়ার
শব্দ হয়েছিল, আর যেন কেউ
বনলতা বলে ডেকেছিল। সেই
মুহূর্তে ছবিটা লুফে নিয়েছিলাম সটান-
দেওয়াল থেকে হাতের মুঠোয়। আমার
মনে হয়েছিল- এই আমার নিজের
মা। নাম বনলতা। আমাকে
ফেলে চলে গেছে। আর
এখন যে মহিলা এই
বাড়িতে , ভাইকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে, সে
সৎমা। শিওর সৎমা। গল্পের বই তে সৎমাদের
যে সব বিবরণ সেই
বয়সে পড়েছিলাম, সব মিলে যাচ্ছিল
আমার মা র সঙ্গে-
মানে যাকে আমি মা
বলে জানি। কাউকে কিছু বলি নি,
বাবাকে নয়, শান্তিপিসিকে নয়,
ছবি হাতে নিয়ে স্রেফ
পিছু হটতে লাগলাম। আমার
মা র থেকে। দিনে দিনে সরে
আসছিলাম আমি, মা -ও
এগিয়ে আসার চেষ্টা করে
নি। তারপর, আমার আঠেরো বছর
হতে না হতেই রান্নাঘরে
মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল।
চৌকাঠে কপাল ঠুকে গিয়ে
সাঙ্ঘাতিক ব্লীডিং। ওভাবেই কতক্ষণ পড়ে ছিল জানি
না। আমরা
বাড়ি ফিরে অ্যাম্বুলেন্স ডাকি; ব্রট
ডেড- হাসপাতাল বলেছিল। যে স্থিরবিন্দু থেকে
দূরত্ব মাপছিলাম, সেটাই ভ্যানিশ করে যেতে, ছবিটা
তারপর আর খুলে দেখি
নি।
আমার
বিয়ের পর ছবিটা ফিরে
এল। সেম টু সেম।
হনিমুনে, প্রথম রাতেই।
কলকাতায়
এক বিয়েবাড়িতে আমাদের দেখা। দুজনেই ঝারি করছিলাম আগাগোড়া।
টুকটাক ছোঁয়াছুঁয়ি। এক সপ্তাহের মধ্যেই
বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল, অ্যাজ এক্সপেক্টেড।
হনিমুনে
গিয়ে উদ্দাম মিলন হয়েছিল আমাদের।
সমস্ত রাত পরস্পরকে আবিষ্কার
করছিলাম , চুমু খাচ্ছিলাম অজস্র
, ওর পিঠে নখ বসছিল
আমার, শরীর ঘষে ঘষে
আগুন জ্বালাচ্ছিলাম , সে আগুনের ফুলকি
জোনাকির মত ঘরময়
উড়ছিল , ছাই হয়ে মাটিতে
নামার আগেই আরো স্ফুলিঙ্গ
সৃষ্টি হচ্ছিল। সে যেন অনন্ত
আগুন। যেন
আমরা কেউই তাকে নিভতে
দিতে চাই না, যেন এ আগুন
নিভে গেলেই হিমযুগ আসবে-
হোটেলের দেওয়াল ফাটিয়ে গ্লেসিয়ার
এলে বরফের চাদরের নিচে আমরা যেন
ফসিল হয়ে যাবো। একসময় বাউন্সারের কাছে ঘাড়ধাক্কা খাওয়া
মাতালের মত বিছানায় ধমাস
করে পড়ে গিয়েছিলাম দুজনে-
সিক্ত, ঘর্মাক্ত। আমার দিকের বালিশে
মাথা দিতে গিয়েও ওর
বালিশের দিকে গড়িয়ে গেলাম,
হাত রাখলাম ওর বুকে। আমাকে
সামান্য ঠেলে দিয়ে পাশ
ফিরেছিল ও- সরে শোও।
হোটেলের ঘরের সিলিং থেকে
তৎক্ষণাৎ নেমে এলো সেই
ছবি যেখানে হলুদ ট্যাক্সির দরজা
খুলছে লাল কালো শাড়ি
পরা বনলতা। হাসল। ছবি গুটিয়ে
হাতের মুঠোয় নিলাম আবারও, তারপর এক পা দু
পা তিন পা- যেন
এক সোমনামব্যুলিস্ট পিছনে হাঁটছে-
এই
পাঁচ বছরে ক' পা
পিছিয়ে এসেছি - গুণি নি। স্থিরবিন্দুর
অবস্থান খেয়ালই করি নি বস্তুত।
২
শান্তিপিসি
মারা গিয়েছেন- পিসির বোন শিল্পীপিসি ফোন
করে খবর দিল। আমাকে
মুখাগ্নি করতে বলল বারবার।
বলছিল, দিদির ইচ্ছে ছিল। অফিস ফেলে
শ্মশানে গেলাম, কী জানি কেন,
ও ও এলো সঙ্গে।
শহরে মিছিল, জ্যামে
পড়ে দেরি হয়ে গিয়েছিল
আমাদের- পিসি ততক্ষণে চুল্লিতে
ঢুকে গেছে। দাহর সময় আগাগোড়া শিল্পীপিসির
পাশে বসে ; পিসি একবার আমার
মুখের দিকে তাকায়, আবার
মুখ নামায় যেন কিছু বলবে।
হাত
ধরলাম পিসির-"কিছু বলবে?"
-দিদি
তোকে নিজের মেয়ের মতই দেখত।
-জানি
তো। শান্তিপিসি আমার পক্সের সময়
যা করেছিল। ক্লাস থ্রীতে পক্স হয়েছিল। মা
তো তখন ভাইকে নিয়ে
ব্যস্ত। ঐ শান্তিপিসিই...
শিল্পীপিসি
নাক টানল। গলা খাঁকরালো, " একটা
কথা বলব তোকে-"
-কী?
-দিদির
একটা পাস্ট ছিল, জানিস তুই?
-পাস্ট?
-দিদির
একটা মেয়ে ছিল- মানে,
আছে হয়তো।
-শান্তিপিসির
মেয়ে? পিসি তো..
-একটা
অ্যাক্সিডেন্ট। চেনা
জানার মধ্যেই। এর বেশি আজ
নাই বা বললাম-
ঘাম
হচ্ছিল। ব্যাগ থেকে রুমাল বের
করে কপাল মুছলাম। কালো চশমা পরে
নিয়ে তুতলে বললাম, "স সে মেয়ে
এখন কোথায়?" শিল্পীপিসি হাত ওল্টালো-"একটা
অনাথ আশ্রমে রেখে আসা হয়েছিল।
এইটুকুই জানি।"
-সে
কী! এত বছরে কেউ
খোঁজ কর নি তোমরা?
আমি তো কিছুই জানতাম
না।
- বাবার
বারণ ছিল। গোটা প্রসেসটা
ম্যানেজ করেছিল বাবাই। অনেক কানেকশন ছিল
- তুই তো জানিস। আর দিদিও চায়
নি।
-কী
নাম ছিল সে মেয়ের?
"সদ্যোজাত মেয়ে।
অবাঞ্ছিত। তার আবার নাম!
" শিল্পীপিসি চোখ মুছছিল। আর
ছোটোবেলায় শান্তিপিসির বলা গল্প মনে
পড়ল আমার। সেই দুপুরটা। বাপের
বাড়ির জানলা, খড়খড়ি। হঠাৎ মনে হল,
ছবির ঐ লাল- কালো
শাড়ি আসলে,
মেয়েকে ছেড়ে চলে যাওয়ার
মোমেন্টের শান্তিপিসি। মনে হচ্ছিল, সম্পর্ক
থেকে ছবি হাতে বেরিয়ে
আসে মানুষ, তারপর
ব্যাটনের মত ধরিয়ে দেয়
আর কারো হাতে- হাত
বদল হয় ব্যাটনের আর
সম্পর্ক থেকে সম্পর্কে ছুটে
বেড়ায় মানুষ। হু হু করে
কাঁদতে লাগলাম - আমার মা র
জন্য, শান্তিপিসির জন্য। টিনের ছাদে ছাতিম ফুল
পড়ছিল টুপটাপ করে। কাক ডাকছিল।
ইলেকট্রিক চুল্লিতে শান্তিপিসি পুড়ে যাচ্ছিল। একটু
দূর থেকে ও দেখছিল
আমাকে, চায়ের ভাঁড় ফেলে উঠে
এল, হাত
রাখল পিঠে- " বাড়ি যাবে?"
ফেরার
পথে শুক্রবারের সন্ধ্যায় ট্রাফিকের ঢেউ খেলছিল। যাবতীয়
রাস্তা, উড়ালপুলেরা
এ ওর সঙ্গে জুড়ে
গিয়ে সাপলুডোর বোর্ড হয়ে যাচ্ছিল চোখের
সামনে- সরণিতে আলো জ্বলে উঠছিল;
দেখছিলাম, আপ, ডাউনের সারি
সারি বাস, ট্যাক্সি, গাড়ি
মন্থরগতিতে উঠছে, নামছে অথবা সম্পূর্ণ গতিহীন।
সামনের পথ আলোকোজ্জ্বল-
ট্রাফ আর ক্রেস্ট স্পষ্ট
বোঝা যাচ্ছে - ডাউনের
রাস্তায় ক্রেস্ট বেয়ে চলমান আলোর
মালা ট্যাক্সির উইন্ডশিল্ড আর সামনের সিটে বসা ওর চশমার
লেন্স ফুঁড়ে বেঁকে চুরে তীক্ষ্ণ ধাতব
নক্ষত্র হয়ে যাচ্ছিল যেন
গলন্ত তারারা গড়িয়ে নামছে। পিঠোপিঠি দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িদের শুঁয়োপোকার
মত লাগছিল। ট্রাফিকের
জট খুলে গেলে ছোটো
ছোটো আলোর বল যেন
উজ্জ্বল মুক্তার মতো ট্যাক্সির
পাশ দিয়ে হুশ করে
বেরিয়ে যাচ্ছিল। খুব
কাছে এলে মুক্তামালা রাক্ষুসে
হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল
আমার । ট্যাক্সির অভ্যন্তরে
আলো আর আঁধার খেলা
করছে। যেন তাস বাঁটছে
কেউ। যেন স্রেফ দুটো রংএরই তাস
রয়েছে গোটা পৃথিবীতে। শাফলিংএর
ফ্রিকোয়েন্সির ওপর বাজি ধরছিলাম
আমি , ট্রাফিকে দাঁড়িয়ে। ও চুপ করে
রইল গোটা
পথ।
রাতে
বালিশে মাথা রাখতেই পালকের
মত টুপ করে ছবিটা
গায়ে এসে পড়ল। এ
ছবি এখন আমি কাকে
দিয়ে যাব? অন্যের হাতে
ব্যাটন চালান না করতে পারলে
এই ছবি ফিরে ফিরে
আসবে - আমাকে হাঁটাবে, আরো হাঁটাবে যতক্ষণ
না দূরত্ব অগম হয়ে যায়; ডুকরে
কেঁদে উঠেছিলাম।
"কী হল?
ভয় করছে? " ও জড়িয়ে ধরেছিল
আমাকে। আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম
ওর ওপর। আগুন জ্বালাতে
চাইছিলাম । দু একটা
ফুলকি উঠে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিলাম
দুজনে যেন হাপর টানছি।
ধিকি ধিকি আগুন দেখা
দিল- প্রথমে ছোটো ফুলকি, ক্রমে
কমলা নীল শিখা ঘিরে
ফেলল দুজনকে। ভেবেছিলাম, এই আগুনে ছবিটা
পুড়ে ছাই হয়ে যাবে
অথচ শেষ রাতের দিকে
আবার ফিরে এল যেন
বালিশের তলায় চাপা পড়েছিল,
এখন তুলো , ওয়াড় সব ফেঁড়ে বেরিয়ে
এসেছে একদম চোখের সামনে
- রাস্তার
জমে থাকা জল ছুঁতে
পারা যায়- থিন ফিল্ম
ইন্টারফিয়ারেন্স এখনও ক্রিয়াশীল- জলে
রামধনু দেখা যাচ্ছিল; এক
দৌড়ে রান্নাঘর
থেকে ছুরি নিয়ে এলাম
- ক্যানভাস ফালা ফালা করতে
গিয়ে দেখি, মসৃণ অ্যাসফল্টে পিছলে
যাচ্ছে ছুরি। জল জমা গর্তে ছুরি ঢুকিয়ে টান
মারব- হামাগুড়ি দিয়ে এগোলাম
- গোটা
ক্যানভাস ত্যারছা দেখাচ্ছে এখন; বাঁ
হাঁটু রাস্তায় রেখে দেখি , লাল
কালো শাড়ি পরে আছি; খেয়াল
করলাম,ছবির কমলা
রঙ এতদিনে ফিকে হয়ে এসেছে,
অ্যাসফল্ট সামান্য ধূসর।
দূরে আরো অনেক খানাখন্দ চোখে পড়ছিল। হলুদ ট্যাক্সির গায়ে
সাদা ডোরা - আগে দেখি নি;
আরো কাছে যেতে চোখে
পড়ল, ট্যাক্সির জানলায়, উইন্ডশিল্ডে স্ট্যালাকটাইট স্ট্যালাগমাইট, যেন
এ গাড়ি সমুদ্র সাঁতরে
এসেছে আর তার গায়ে
লেগে থাকা নোনা জল
শুকিয়ে লবণ হয়ে যাচ্ছে।
কতদিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে
হলুদ ট্যাক্সি - সওয়ারির
জন্য অপেক্ষা করে করে স্থবির,
বিকল। মায়া হচ্ছিল।
হঠাৎ
মনে হ'ল, ট্যাক্সিটাকে
ক্যানভাস থেকে বের করে
দিলেই হবে- সম্পর্ক থেকে
পালানোর উপায় থাকবে না।
ছুরি ফেলে দিয়ে , ডানদিকের
সামনের দরজা খুললাম। কী
স্লটে চাবি ঝুলছিল, চাবি
ঘোরাতে স্টার্ট
নিলো না। ফ্ল্যাট
ব্যাটারি - লাইমস্টোন ফর্ম করে গেছে
সম্ভবত। মাথাভাঙা টাইমকল থেকে হুড়হুড় করে
জল বেরোচ্ছিল- ট্যাক্সি থেকে নেমে এসে একটা
পাইপ খুঁজছিলাম- হোস পাইপের জলের
তোড়ে নুনের এ আবরণ ঝরে
যাক, ডানা
গজাক গাড়ির গায়ে, তারপর উড়ে যাক। তখনই
দেখলাম দূরের আউট অফ ফোকাস
অবয়ব স্পষ্ট হচ্ছে- ও, আমার বর।
বালতি করে জল আনছে,
খুব যত্ন করে গাড়ির
গায়ে ঢালছে- যেমন করে ফুলের
টবে জল দেয় মানুষ।
যেন ও চাইছে, গাড়িটা
গাছ হয়ে যাক, শিকড় গজাক মাটিতে।
[প্রথম
প্রকাশঃ গুরুচণ্ডা৯, ২০২২]
Comments
Post a Comment