সোয়ান লেক

 মরা মানুষদের জন্মদিনে, তাদের ছবির তলায় মোম রেখে পিছন ফিরলে নিজের দীর্ঘ ছায়ার মুখোমুখি হতে হয় বরাবর। তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে, প্রমীলার আজকাল মনে হয়, এই ছায়াটাও শিগগিরই গায়েব হয়ে যাবে। তারপর হয়তো একটা নতুন ছায়া  আসবে অথবা শূন্যতা। জাস্ট ভয়েড স্পেস। আসলে সব মানুষের মধ্যে একটা মরা মানুষ থাকেই, খোলসগুলো ঝরে ঝরে শেষমেষ ঐ ডেডবডিতে পৌঁছে  যেতে হয়।  মোম জ্বালতে এলে এই সব মনে হয় ইদানিং, যা তাকে ক্ষণিক বিবশ করে। আজও করল, তবে হাতও অবশ হ'ল সেইসঙ্গে,  ফলে মুঠি থেকে মোমদানি স্লিপ  করে  আগুন ধরে গেল শ্যামলেশের ছবির সামনের কার্পেটে। দপ করে নীল শিখা লাফ দিল যেন এই ছুঁয়ে ফেলবে শ্যামলেশের ছবি অথবা প্রমীলার শাড়ির পাড়ের সোনালি বর্ডার।  দীর্ঘ প্রবাসজীবনে প্রমীলা আগাগোড়া শাড়িতে  -  ঘরে ও বাইরে,  বরফে, জলে ,কাদায়, এবড়ো খেবড়ো ট্রেলে এবং অবশ্যই যৌবনে বিবিধ নাচের অনুষ্ঠানে; শাড়ি সামলানোর টেকনিক তার রিফ্লেক্স অ্যাকশনে পর্যবসিত বহুদিন, তদুপরি অতীতের নৃত্যচর্চা ,বর্তমানের হাল্কা ব্যায়াম তাকে সচল ও ক্ষিপ্র রেখেছিল ; ফলে চকিতে শাড়ির কুঁচি কার্পেটের উপরিভাগ থেকে তিন আঙুল পরিমাণ টেনে তুলল সে , বারান্দার দিক থেকে ভারি পাপোষ টেনে আগুন চাপা  দিল দ্রুত। যদিও একটা বৃত্তাকার  দাগ হয়ে গেল  কার্পেটে যার ধোঁয়া ওঠা পরিধির ভিতরে অবর্তমানের কালো, তার যাবতীয় শূন্যতাসমেত, তৎসহ  দু'একটি পোড়া ফাইবার,  গালিচার বাকি অংশটুকু এলইডির নিচে এখন ছিমছাম ও নির্জন, যেন মুহূর্তগুলি চুপচাপ শুষে নিচ্ছে,  আর কাউকে  দেখতে পেলেই সবটুকু বলে দেবে বিশদ ; সাদা দেওয়ালেও  আগুনের শিখার শেপের একটেরে বাদামি ফালি - তার অসাবধানতার এই সব যাবতীয় চিহ্ন সকালেই লোক ডেকে সারিয়ে নেবে- ভেবে নেয় প্রমীলা। দ্রুত ফোন করে কতিপয় কার্পেট ও রং বিশেষজ্ঞকে;  মেরামতির দিনক্ষণ ফাইনাল হওয়ার আগেই নোটন বেল বাজাল সদরে পরদিন, ভোর না হতেই। প্রমীলা তখন বাড়ির পিছনের প্রাচীন সুইমিং পুলের জল মাপছে। হাতে গজফিতে আর রঙীন পেনসিল যা দিয়ে দেওয়ালে আঁচড় কাটা যায়।


একসময় শ্যামলেশের চিকিৎসায় দৈনিক সন্তরণ আবশ্যক হয়ে উঠেছিল। সার্বজনীন সুইমিং পুল খানিক দূরে- নিয়মিত যাওয়া আসা শ্যামলেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না সেই সময়; অতঃপর যুদ্ধকালীন তৎপরতায়, বিল্ডার ডেকে বাড়ির পিছনের বাগানে নিজস্ব পুল তৈরি করে সে ও প্রমীলা যাকে তারা ব্যক্তিগত কথোপকথনে পুকুর বলে অভিহিত করতে ভালোবাসত। শ্যামলেশের স্বাস্থ্যোন্নতিতে কতিপয় ছোটো বড় সার্জারি, ঔষধাদি এবং সাঁতার কাটার কম বেশি ভূমিকা সত্ত্বেও তারা দুজনে এই জলাধারটিকেই নিরাময়ের মূল কারণ হিসেবে গণ্য করতে থাকে পরবর্তীতে । অতঃপর,  তারা পুলের পাশে রঙীন নুড়ি ফেলে পথ বানায়, ল্যান্ডস্কেপিং করে, বাহারি আলো লাগায়;  বস্তুত মৃত্যুর দিন সাতেক আগেও প্রমীলাকে পাশে নিয়ে পুলের জলে পড়ে থাকা চাঁদ দেখেছিল শ্যামলেশ। 

মৃত প্রিয়জনের চশমা, ঘড়ি , কলম চিরকালই দেরাজে সংরক্ষণ করে মানুষ;  কিম্বা গোটা দুই রুমাল, একটি পাঞ্জাবি, শাড়ি ন্যাপথালিন দিয়ে আলমারিতে রাখে;  সেই মতো, প্রমীলা সংরক্ষণ করছিল এই পুল, এই বাড়ি, এই বাগান- একা হাতে। ইদানিং পুলের জলতল নেমে যাচ্ছিল ঘন ঘন; ক'দিন টানা পর্যবেক্ষণ ও মাপজোক করে প্রমীলা বোঝে, প্রাকৃতিক বাষ্পীভবনের সঙ্গে পুলের জল কমার হার সমানুপাতিক নয়, বরং অনেকটাই বেশি। এই অঙ্ক কষে সে ঘাবড়ে যায় ও নোটনকে ফোন করে ফেলে- " পুল লীক করছে , একবার এসে দেখে যাবি?"  নোটন তার মা কে আশ্বস্ত করেছিল। তারপর আবহাওয়া, এবং বৌমা, নাতি, নাতনি সংক্রান্ত চিরাচরিত পারিবারিক কথোপকথনের পরে ফোন  রাখার ঠিক আগে নোটন তার দুশ্চিন্তার কথা জানায়, ক্যাজুয়ালি- "এবার ও'বাড়ির মায়া কাটাতে হবে আস্তে আস্তে , এই বয়সে একা এত কিছু মেন্টেন করা সম্ভব নাকি? দুর্দান্ত একটা রিটায়ারমেন্ট  ভিলেজ দেখে এলাম সেদিন। ব্রোশিওর এনেছি, দিয়ে  আসব তোমাকে। ফ্যান্টাস্টিক প্লেস, ফেনোমেনাল। আমি আর গুঞ্জা ভাবছিলাম, বুড়ো বয়সে ওখানেই ..."। প্রমীলা এই সময়, "মেলা কাজ পড়ে  আছে" বলে ফোন রেখে দেয়, তারপর  অকারণ ভ্যাকুয়াম করে ঘরদোর, স্প্রে করে কাচ জানলা, ধোয়া, শুকনো কাপড় আবার ওয়াশিং মেশিনে ঢোকায় আর পুল লীকের কথা নোটনকে বলার জন্য নিজেকে দোষারোপ করে মনে মনে। অতঃপর বিরক্তি কমলে অথবা ক্লান্ত হয়ে সে রাতের খাবার গরম করে, মিউজিক সিস্টেম অন করে বিসমিল্লা আর ভি জি যোগ চালায় ও নিজের ছায়াকে পায়ের কাছে নিয়ে চামচে দিয়ে ভাত মুখে  দিতে থাকে।

আজ নোটন পুল দেখতে এসেছে। দরজার ঘন্টা বাজিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, সাড়া না পেয়ে প্রমীলাকে ফোন করে অতঃপর। ফোন বেজে গেলে নব ঘুরিয়ে  ঈষৎ ঠেলা দিতে সদর হাট হয়ে খুলে যায়। নোটন গলা তুলে " মা তুমি কোথায়" বলে দুবার চেঁচায় ; তারপর বসার ঘর পার হয়ে বেডরুমে প্রমীলাকে খোঁজে, বাথরুমের দরজা টোকা মেরে  কিচেনে উঁকি দেয়; স্লাইডিং ডোর ঠেলে বাগানে নামার আগে কার্পেটের পোড়া দাগে চোখ পড়ে গেলে বিস্মিত হতে হতে সে রেগে যায়। অতঃপর পুলের দিকে তাকাতেই তার হৃদপিণ্ড যেন পাঁজরের দেওয়ালে দুবার ড্রপ খেয়ে গলায় ওঠে। সেইসময় ড্রোন থেকে ছবি নিলে দেখা যেত, উপবৃত্তাকার নীল রঙের ওপর লম্বাটে সবুজ শেপ , ওপর দিকটা সামান্য রুপোলি। হাইট কমিয়ে ভার্টিকালি ফোকাস করলে প্রমীলার সবুজ শাড়িতে সুতোর কারুকাজ, জলের দিকে ফেরানো মুখ দেখা যাবে; নোটন সাইড থেকে দেখছিল, তার বৃদ্ধা মা শীর্ণ দেহ নিয়ে পুলের পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে;  সে হতচকিত হয়, তারপর  দৌড়ে  যায়,  এবং অবাক হয়ে দেখে, প্রমীলা জলতলে গজকাঠি ছোঁয়াচ্ছে।
-কী করছ কী তুমি? এইভাবে শুয়ে আছ? আমি তো ভাবলাম-
-এত চেঁচাচ্ছিস কেন? জলের লেভেল চেক করছিলাম-
- দরজা খোলা - খেয়াল ছিল?
- তাতে কী ? ক্ষতি কিছু নেই-
- যে কেউ ঢুকে যেতে পারে- তাতে ক্ষতি নেই?
- কে আর  ঢুকবে বল? এত বছরে দেখেছিস এরকম কিছু এই পাড়ায়?
- কোন সময়ে পড়ে আছ মা!  কী হচ্ছে চারদিকে একটু খবর রাখো অন্তত। মিশবে না কারোর সঙ্গে, সোশালাইজ করবে না, টিভি দেখ না- নিজেকে নিয়ে আর এই বাড়ি নিয়ে পড়ে আছ; জানো এই এরিয়ায় কটা ব্রেক ইন হয়েছে গত মাসে ? জানো কিছু?
-  ব্রেক- ইন করে কী পাবে শুনি? নেবার আছেই বা কী?  লাঞ্চ করে যাবি তো? এত রেগে গেছিস, কটা ভাত বেশি খা। ফ্রায়েড রাইস করে দিই, দাঁড়া।
-এখনও রান্নাই করো নি?  কখন খাও তুমি আজকাল?
"আজই দেরি হল। এটা সেটা করতে গিয়ে- এই তো টুক করে স্নান করে নেব এখন, তারপর রাঁধতে আর কতক্ষণ লাগে"- হেসে উঠল প্রমীলা, আঙুলের মুদ্রায় যাদুদন্ড ছোঁয়ানোর ভঙ্গি করল।
-এটা সেটা ? কী এত কাজ? ঐ তো উল্টে পড়ে জল মাপছিলে-
- সেইজন্যই তো ডাকলাম তোকে -তুই কী বলিস, কী করা যায়?
-তার আগে একটা কথা বলো, কার্পেট পুড়ল কী করে?-
-হাত ফসকে মোম উল্টে পড়ল রে। নিভিয়ে ফেলেছি তো সঙ্গে সঙ্গে-
- মোম জ্বালানোর দরকার কী? জানি , বাবার জন্মদিন ছিল। ফেয়ারি লাইট এনে দিয়েছিলাম না? সে'গুলো কোথায়? গ্যারাজে ফেলে রেখেছ, তাই না? আমার কোনো কথাই শুনবে না ঠিক করেছ।
-তোর কথা আমাকে শুনতে হবে কেন?
-হবে । তোমার সেফটির জন্য-
- আমার সেফটি আমি বুঝে নেব ঠিক। তুই এখন মাথা ঠান্ডা করে পুলের ব্যাপারটা কী করব  বল-
-আমার কোনো কথাই যখন শুনবে না, তখন তোমার পুলের ব্যাপারে কথা বলতেই বা যাব কেন? বিল্ডারকে ফোন করো কিম্বা পুল মেন্টেন্যান্স কম্পানিকে ফোন করে আসতে বলো। অনেক বড় কাজ। সব জল বের করে তারপর আস্তে আস্তে আবার ভরতে হবে। কোন হাইটে এসে জল নেমে যাচ্ছে, সেইটা দেখতে হবে আগে-
- বিল্ডার বলবে, ব্যস্ত আছি। এদিকে নেক্স্ট উইকে তেড়ে বৃষ্টির ফোরকাস্ট। তুই যা বললি, তাতে কাজটা শুকনো ওয়েদার ছাড়া হবে না।  আর ঐ পুল কম্পানি? আগেরবারে কী সব করেছিল,  মনে নেই? পুরো জল সবুজ হয়ে গিয়েছিল। তুই এসে সামলেছিলি তখন-
-আর সামলাতে পারব না। কোনো কথাই যখন শোনো না; বারবার বলছি, এবার  রিটায়ারমেন্ট ভিলেজে গিয়ে থাকো।  কিম্বা ছোটো একটা অ্যাপার্টমেন্ট- ভেবে দেখো-
-ভেবে দেখার কিছু নেই। আমি যথেষ্ট  সচল ও সক্ষম। এখনই বাড়ি ছাড়ার প্রশ্ন নেই-
-নিজের বয়সটা স্বীকার করো মা। আয়নায় দেখো কী চেহারা হয়েছে। একদিন একটা অঘটন ঘটাবে আর সেই দায় আমাকে নিতে হবে-
-কাউকে কোনো দায় নিতে হবে না-
"যা ইচ্ছে তাই করো তবে", গটগটিয়ে বেরিয়ে গেল নোটন। তারপর দরজার বাইরে গিয়েও ফিরে এলো, " কাল আসব, যা করার করব তখন।  দয়া করে এসবে হাত দিতে যেও না। বয়স হয়েছে তোমার।  বয়স  হয়েছে বুঝলে?  সত্তর পেরিয়ে গেছ।  সেটা স্বীকার করো।"


দুপুরে প্রমীলা আয়নায় নিজেকে দেখছিল- সাদা চুল, গাল ভাঙছে, গলার চামড়া কুঁচকে যেতে শুরু করেছে। সে চুলে হাত চালালো, টান হয়ে দাঁড়ালো, দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে জিভ ভ্যাংচালো আয়নাকে।  তারপর গ্যারাজে ঢুকে রোলার ডোর তুলতেই  রোদ এমনভাবে ঝাঁপিয়ে ঢুকল, প্রমীলা কোমরে হাত দিয়ে সেই রোদে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ;  স্প্রিন্ট শুরুর আগে প্রতিযোগীর পিঠ যেমন নুয়ে থাকে পরমুহূর্তে টানটান ছিলা হয়ে ওঠে , প্রমীলার শিথিল পেশীরা তেমনভাবে শুষে নিচ্ছিল রোদ যেন এক্ষুণি একটা বড় ইভেন্ট শুরু হবে।

শ্যামলেশের মৃত্যুর পর থেকে  গ্যারাজে কোনো গাড়ি নেই; প্রমীলা চিরকালই পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করত- এখন সেটাই নিয়মিত;  গাড়ির  জায়গায় টুলবক্স, লন মোয়ার, বিবিধ হোস,  দড়ি দড়া, নানা রঙের ক্যান, জলঝারি, পুরোনো রুমহীটার, ছোটো বড় এক্সটেনশন কর্ড - অগোছালো।  সেখানে, প্রমীলা একটা সাবমার্সিবল পাম্প খুঁজছে এখন, যা সে বছর দুই আগে কিনেছিল- প্রবল দুর্যোগের পরে বাগানের জমা জল বের করে দিতে;  ঘন্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর শ্যামলেশের ওয়াকার, নোটনের ক্রিকেট ব্যাট, ছোটনের মেয়ের পুতুল, পুরো টেনিস র‍্যাকেট , ফুটবল বেরিয়ে এলো আর লাল টুকটুকে সাবমার্সিবল। ছোটো পাম্প হাতে ঝোলালো প্রমীলা, পুলের কাছে এসে ইনবিল্ট পুলপাম্প রিভার্সে চালালো প্রথমে। হুড় হুড় করে জল বেরিয়ে আসছিল ড্রেনের ঝাঁঝরির ওপর।  ঘড়ি দেখল সে -ঘন্টাখানেক লাগবে এখনও, এই ফাঁকে টুক করে খেয়ে নেবে।

বিকেল হচ্ছিল। রোদের তেজ কমে যাচ্ছিল, সেই সঙ্গে পুলের জলতল। । ভরা পুলের তিন চতুর্থাংশ খালি হতে পুলপাম্পে ঘর ঘর আওয়াজ শুরু হ'ল- হাওয়া টানছে এবার। প্রমীলা বাইরের ঘরের প্লাগ পয়েন্টে একসটেনশন কর্ডের রীল জুড়লো ; লম্বা কর্ড টেনে নিয়ে এলো পুলের পাশে, রীলের পয়েন্টে সাবমার্সিবলের প্লাগ জুড়ে , লম্বা আউটলেট হোস রাখল ঝাঁঝরিতে। তারপর পাম্প হাতে দিয়ে পুলে নামল। এখন বাড়ির বারান্দার প্রায় বারো হাত নিচে প্রমীলা- পায়ের গোছ পর্যন্ত জল; একবার ভাবল সত্যিই গোয়াঁর্তুমি হয়ে যাচ্ছে, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে জল ভেঙে এগোলো। পুলের ঠিক মাঝখানে লাল পাম্প রেখে আবার জল পেরিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়ালো। একটা বড় শ্বাস ফেলে এক্সটেনশন বোর্ডের সুইচ অন করল। পাম্প চালু হয়ে জল বেরিয়ে ঝাঁঝরিতে পড়ছিল; বারো ফুট নিচে জলের বৃত্তকে   ক্রমশ গুটিয়ে যেতে দেখতে দেখতে ঘরে ঢুকল প্রমীলা। সূর্য ডুবে গেল সেই সময়। প্রমীলা বাইরের আলো জ্বেলে দিয়েছিল।  ঠান্ডা নামছিল দ্রুত। সঙ্গে অন্ধকার।  আলোর ডুমের সামনে মথ উড়ে বেড়াচ্ছে।  বারো ফুট নিচ থেকে উঠে আসা জলভরা মোটা পাইপকে সন্ধ্যার মুখে গর্ভিনী ময়ালের মত লাগছিল - নিরন্তর জল উগরে দিচ্ছে  লেবুগাছের পাশের ঝাঁঝরিতে। পাশের বাড়ির বারান্দায় সম্ভবত  একটা বাচ্চা দোলনা চড়ছে অথবা যেন কেউ বন্ধ জং ধরা দরজার পাল্লা ঠেলছে আর ঠেলছে - আওয়াজ আসছিল , 'ক্যাঁচ, কোঁচ, ক্যাঁচ"।

চাঁদ উঠলে সাবমার্সিবল থেমে গিয়েছিল ড্রাই রান শুরুর আগেই- প্রমীলা সুইচ অফ করে বারো ফুট নিচে নামল। জল থেকে পাম্প তুলে নিয়ে  ছ'ধাপ উঠে বারান্দায় এক্সটেনশন কর্ড , পাম্পের হোস গুটিয়ে রাখল । এখনও জল রয়ে গেছে বেশ খানিকটা;  বারান্দার আলো এতখানি নিচে পৌঁছয় না- কালো জলের বৃত্তে পূর্ণচন্দ্রকে দোল খেতে দেখা যাচ্ছিল। এই জলটুকু সম্পূর্ণ তুলে ফেলে তবেই পুল ভরতে হবে আবার।  প্লাস্টিকের ছোটো বালতি মগ হাতে আবার বারো ফুট নামতে গিয়ে একবার থমকালো- সে কি বাড়াবাড়ি করছে? তারপরই নোটনের কথাবার্তা চোখে ভাসল;  সকালের আগেই সমস্ত জল তুলে ফেলতে হবে - নোটন এসে যেন অবাক হয়ে যায়;  ছেলের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ ভাবতে ভাবতে হাসল প্রমীলা তারপর কাজে নেমে পড়ল।  শুকনো পুলে হেঁটে যেতে অস্বস্তি হচ্ছিল প্রথমে ; মনে হচ্ছিল , অদৃশ্য জল ঠেলে চলেছে সে, পা ব্যথা করছে ফলত;  জোরে জোরে শ্বাস নিল প্রমীলা, পুলের গভীরতম অংশে, ছোটো জলবৃত্তের খুব কাছে গিয়ে বালতি ডোবালো জলে। কনকনে ঠান্ডা জল ভরে নিয়ে  ছ' ধাপ উঠে এল, লেবুগাছের পাশের ঝাঁঝরিতে বালতি খালি করে দিল। আবার নেমে গেল সটান, বালতি ভরে ওপরে উঠে জল ঢেলে দিল গাছের পাশে। গভীরতা যত কম ভেবেছিল, তার থেকে ঢের বেশি জল।  থেমে যেত পারত সে। বালতি রেখে ঢুকে যেতে পারত বাড়িতে, গান শুনতে শুনতে  রাতের খাওয়া সেরে নিতে পারত অনায়াসেই। কিন্তু,  প্রমীলার জেদ  নেশায় দাঁড়িয়ে গেছে এখন; কড়া নেশা যা আশপাশ, ঠান্ডা গরম, এমনকি নিজেকে ভুলিয়ে দেয়। প্রমীলা আবার নামল নিচে, আবার উঠল জলভরা বালতি নিয়ে , আবার নামল, আবার উঠল। ঐটুকু জল তাকে যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে আর সেই চ্যালেঞ্জ জিততে সে মরীয়া।

প্রমীলা বারো ফুট নিচে নেমে জল তুলে আবার উঠে এসে ড্রেনে জল ঢেলে দিচ্ছে  -এই গোটা প্রক্রিয়া এখন অবধি পনেরোবার সম্পন্ন । পাশের বাড়ির ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ থেমে গিয়েছিল বহুক্ষণ। শিশুর খেলা শেষ হয়ে গেছে অথবা দরজাটা ঠেলতে ঠেলতে খুলেই গিয়েছে হয়তো। এই মুহূর্তে শুধুই অজস্র ঝিঁঝিঁর ডাক এক অবিশ্রান্ত জলস্রোতের মত ঢুকে যাচ্ছিল প্রমীলার কানে, আর বেরোচ্ছিল না;  তারপর কান পেরিয়ে মাথার অভ্যন্তরে পোঁছে যাচ্ছিল, তুলকালাম ঘটাচ্ছিল মগজে- ওর শাদাচুলের নিচে, কপালে অথবা অক্ষিকোটরের তলায় ঝিঁঝিঁর দল অবিরাম ডেকে চলছিল।  খাড়া সিঁড়ির চতুর্থ ধাপে বালতি হাতে জিরিয়ে নিতে চাইছিল প্রমীলা। ওর শরীরের সমস্ত শক্তি যেন কেউ শুষে নিচ্ছে আর প্রমীলা তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে প্রাণপণ। হাঁটুর ব্যথা ঊরু কোমর বেয়ে  উঠে এসে পিঠ আর ডানায় গেঁড়ে বসেছে। প্রমীলা হাঁফাতে হাঁফাতে আকাশে তাকালো-  শাদা , গোল চাঁদকে ব্যাকড্রপে রেখে একটা বাদুড় গাছ বদল করল দ্রুত। আর দু'ধাপ উঠলে লেবুগাছ। ঘাম হচ্ছিল প্রমীলার। এক হাতে বালতি নিয়ে অন্য হাত সিঁড়ির ওপরের ধাপে রেখে ঈষৎ নুয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ -চাঁদের হাইট থেকে হাতল ওলা প্রাচীন ছাতার মত লাগছিল ওকে, যেন ভাঁজ করে ঘরের কোণে ঠেস দিয়ে রেখে গেছে কেউ। প্রমীলা ঘাড় ঘুরিয়ে জল দেখল- এই উচ্চতা  থেকে  জলবৃত্ত সংক্ষিপ্ত দেখাচ্ছিল, রোদে পিঠ দিয়ে কাগজ পড়তে পড়তে নিজের যৌবনকে যেমন লাগে।  আর কতটুকুই বা  জল! এক বালতি ? হাতের জলটুকু ঢেলে দিয়ে প্রমীলা আবার নিচে নামল। নিচু হয়ে জল ভরতে ভরতে প্রমীলা দেখছিল, জলের স্তর ওর নুয়ে পড়া ছায়ার পিঠ থেকে কাঁধ বরাবর নামল কেবল। আরও জল বাকি? প্রমীলা বিস্মিত হল, রেগে গেল, তারপর  বড় অসহায় লাগল তার। প্রমীলার হাতের মৃদু ঠেলায় জলতলে আবর্ত তৈরি হচ্ছিল- যেন জলরাশি ঘুরে ঘুরে তাকে দুয়ো দিচ্ছে, খলখল করে হাসছে। ও বালতি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো, তিন ধাপ উঠে টের পেল, নিজের ছায়াটাকে হারিয়ে ফেলেছে এবারে। আলোর একটা জোরালো সোর্স খুঁজে পাওয়া দরকার ওর মনে হল; তারপর চাঁদ খুঁজে, বারান্দা ঢুঁড়ে ফাইনালি দেখতে পেল,  ওর বসার ঘরের আলো জ্বেলে দিয়েছে কেউ । এখন নোটন এলো?  ভয় পেলো প্রমীলা-  মা কে এইভাবে জল তুলতে দেখে চেঁচাতে শুরু করবে।  যৎসামান্য বাকি  জলটুকু তুলতে আর হয়তো  দু'বার ওপর নিচ করতে হবে - নোটন খেয়াল করার আগেই সেরে নিতে হবে এইটুকু কাজ । বালতির জল ঢেলে দিয়েই আবার নামতে শুরু করল সে। হাতের পা, পাতা কনকন করছে- ঠাণ্ডা জলে ভিজে ভিজে সাড় কমছে সম্ভবত; প্রমীলা হাতের তেলো ঘষল কার্ডিগানে।  এই জলটুকু ফেলে আর একটা ট্রিপ । ব্যাস।

লাস্ট ট্রিপের জন্য বালতি ভরতে লাগল প্রমীলা। ছোটো মগ দিয়ে জল তুলতে তুলতে একসময় জল আর উঠছিল না।  প্রমীলা নিশ্চিন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো-এইবারে জিতে গেছে সে। আর ঠিক তখনই পায়ের নিচ থেকে ছলছল করে জল উঠতে লাগল। প্রথমে পায়ের পাতা ছুঁল , তারপর ধীরে ধীরে উঠতে লাগল প্রমীলার শরীর ঘিরে ;  ও ভয় পেলো প্রথমে,  নোটনকে ডাকতে চাইল , তারপর  দৌড়ে গেল পুলের অন্য কোণে যা সামান্য  আগেও খটখটে শুকনো ছিল। প্রবল বিস্ময় নিয়ে সে দেখছিল, সমস্ত পুল আবার জলে ভরে যাচ্ছে , জল উঠছে তাকে ঘিরে - সে তখন এমনভাবে জল ছুঁল যেন এখানে ভর দিয়ে টপকে যাবে জলতল,  ভল্ট দিয়ে উঠে যাবে বারান্দায়। পা উঠল না অথচ। সে আবার হাত ছোঁয়ালো জলে -অসাড় হয়ে এলো হাত। প্রমীলা হাত তুলল ওপরে, নামিয়ে নিল দু’ হাতই , জলের নিচে পা সরাল এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক, যেন অনুমান করতে চাইছে জলের গতিবিধি;  তারপর হাউইএর মতো উড়ে যাবে বলে পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল  আর জল যেন তাকে কোলে তুলে নিয়ে আবার নামিয়ে দিল আলতো করে - ওর ভালো লাগল জলের এই আলিঙ্গন। দু হাত তুলে পয়েন্ট পোজিশনে আবার দাঁড়ালো সে।

এই মুহূর্তে, রাতের আকাশের তলায় প্রমীলা হাত তুলছে মাথার ওপর, আবার নামিয়ে নিচ্ছে, যেন তার কাঁধের ওপর ডানা আর সে তা ঝাপটে চলেছে ;  জলের তলায় ওর পা স্থান বদলাচ্ছিল ঘন ঘন, যেন সে তার ব্যালে ক্লাসের প্রথম দিনে ফার্স্ট পোজিশন থেকে ফিফথ পোজিশন করে চলেছে - ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর , ফাইভ, ওয়ান, টু, থ্রী, ফোর , ফাইভ;  দ্রুত, প্রাণবন্ত মুভমেন্ট ; লয় বাড়ছিল, প্রমীলার পা  ক্রমান্বয়ে গতি বাড়াচ্ছিল- যেন ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে গিয়ে চাইকোভোস্কি বাজছে ওর মাথার মধ্যে। চাঁদ আর ছেঁড়া  মেঘ লাইটিং ডিজাইন করেছে- নীলচে শাদা আলোয় ভরে যাচ্ছিল চরাচর। আচমকা যেন টিমপানি বেজে উঠল কোথাও,  ছপ করে লাফিয়ে উঠল পুঁচকে ব্যাঙ- এতক্ষণ ঘাপটি মেরে বসেছিল জলটুকুর মধ্যে। চাঁদের  আলোয় প্রমীলা দেখল ব্যাঙের  গায়ের রং ধূসর, কালো পুঁতির মতো চোখ-  প্রমীলা  আঙুল বাড়িয়ে ছোটো ব্যাঙের মাথা ছুঁয়ে দিতেই সে মস্ত লাফ দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাঙকে খুঁজতে গিয়ে  প্রমীলা  দেখল, তার মাথার বারো ফুট ওপরে  বসার ঘর আলোকোজ্জ্বল,  শ্যামলেশকে  টিভি চালাতে দেখল সে- নোটনের পিঠ চাপড়ে খুব হাসছে এখন , হাসির আওয়াজ বাইরের ঘরের জানলা ফুঁড়ে বাগান পেরিয়ে এই বারো ফুট নিচে প্রমীলার কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল।  শ্যামলেশ এসেছে। তার মানে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। জলের আলিঙ্গন থেকে  বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করে উঠল প্রমীলা।


রেনোভেশন বিল্ডারের লোক নিয়ে নোটন ঢুকছিল বাড়িতে।  আজও সদর খোলা, বাগান পেরিয়ে বাইরে এসে ড্রোন শট নিলে  দেখা যায় শুকনো খটখটে পুলে শাদাচুল নীল শাড়ি ঘুরে ঘুরে নেচে চলেছে।
 
[প্রথম প্রকাশঃ ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম , অগাস্ট ২০২২ ] 

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস