মজলিশ ২০১১
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে এখন। রোদ আছে। তবে প্রবল নয়। শেষ দুপুরে একফালি বারান্দাটি। একলা। গ্রীল বেয়ে মাধবীলতা। ছায়া পড়ছে বারান্দায়। সামনে বাগান। গেট।
গেট খুলে একজন ঢুকলো। উস্কোখুস্কো চুল। চশমা, ঝোলা। আনমনা পাগলাটে ধরণ। বাগান পেরিয়ে বারান্দায় এসে বসল সটান। ঝোলা হাতড়ে বের করল মিষ্টির বাক্স। বারান্দায় রাখল। মাধবীলতার গুচ্ছ দুলে উঠল। সামান্য ধুলো-ও উড়ল কোথাও। কথা শুরু হ'ল। বারান্দা আর পাগলের।
- এক বছর পরে, তাই না? তাই তো?
-এই দিনেই আসি প্রতিবছর। বসতে আসি তোমার কাছে। বছরভর কাছেই থাকি। তবে গেটের ওধারে। দূর থেকে দেখে যাই। কেমন আছ?
-তুমি? লেখা কি ছেড়ে দিলে?
-লেখাই ধরে আমাকে, ছেড়েও যায়।
-সে কেমনতরো?
-সে এক রকম.. শুনবে?
-শোনাও।
-(পাগল গেয়ে ওঠে) আমি দেখি নাই তার মুখ আমি শুনি নাই তার বাণী/ শুধু শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার পায়ের ধ্বনিখানি/আমার দ্বারের সমুখ দিয়ে সে জন করে আসা যাওয়া/ শুধু আসন পাতা হ'ল আমার সারা জীবন ধরে/ ঘরে হয় নি প্রদীপ জ্বালা তারে ডাকব কেমন করে/আছি পাবার আশা নিয়ে, তারে হয় নি আমার পাওয়া-
(পাগল আপন মনে হাসতে থাকে। চুলে হাত চালায়। ঝোলায় হাত ঢোকায়। বার করে।)
-তাকে চেনো না, তবে কেমন করে লেখো?
-বীজ ওড়ে। বাতাসে বীজ ওড়ে। লেখার বীজ। মাঝে মাঝে আশ্চর্য এক বাতাস ওঠে। লেখার আঁশ, লেখার সুতো। মুখে পড়ে। চুলে জড়ায়। চশমায়। হাতে ঠেকে।
-ধরে ফ্যালো তখন, হুঁ?
-ঠিক ওরকম নয়। একটু পড়ে শোনাই? কে কি বলেন?
-হ্যাঁ। পড়ো।
(পাগল ঝোলা হাতড়ে গোটা দুই বই বের করে আনে)
- পড়ছি শোনো। 'প্রত্যেক মানুষই দ্রষ্টা। কিন্তু লেখক, তিনি যেমনই লিখুন, দ্রষ্টার সংজ্ঞা পার হয়ে স্রষ্টার ভূমিকায় আসেন শুধুমাত্র ঐ বীজবপন করার ক্ষমতার ফলে। যে সমাজে লেখকের শেকড়, যে বাতাসে তার রেসপিরেশন, সেই মাটির গর্ভে চলে যায় তার বোধের শেকড়। দু চোখ দু কান দিয়ে শুষে নেওয়া এইসব উপাদান ...রক্তের ভেতরে ঘোরাফেরা করে। গোপনে একটি বীজের জন্ম হতে থাকে। সৃষ্টির জন্য একটা প্যাশন কাজ করতে শুরু করে। একটি শায়ক তৈরি হয়। তারপর অপেক্ষা। বাসের ভেতরে দেখা কোনো ঘটনা, ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা একঝলক কোনো দৃশ্য, অথবা খবরের কাগজে পড়া কোনো খবর হঠাৎ মগজে আলোড়ন তোলে। সেই বীজের ঘুম ভাঙে। বিদ্ধ করবে বলে তার গমন শুরু হয়।'
-তারপর?
-তারপর? 'এরপর লেখকের কেরামতি। বাক্যবিন্যাস, শব্দচয়ন, ফর্মের চতুরালি। ভ্রূণের হাত পা গজায়। জীবনবোধের জিন ঠিক করে সেই গল্পের চোখের রং, চুলের বৈশিষ্ট্য, সেই গল্পের মেজাজ.... আস্তে আস্তে একমেটে হয়, দোমেটে হয়... ডাকের সাজ ও গর্জনতেলে একটি সার্থক গল্প ঝলমল করে ওঠে।'
- আচ্ছা এই যে এত লেখা এতজন লেখেন সবার লেখার ধরণও আলাদা যেমন এই যে পড়লে বাক্যবিন্যাস, শব্দচয়ন- সেইসঙ্গে প্রত্যেকের লেখালেখির কারণও তো আলাদা-
- পড়ে শোনাই আবার?
যেমন ধরো কেউ বলেন- 'প্রাণের রসায়ন দেখে আমার ভীষণ অবাক লাগে। কত বিপর্যয় পার করে টিঁকে আছে আরশোলা,সিলাকান্থ মাছ। পদ্মফুলের বীজ একশো বছর বেঁচে থাকে সুদিনের অপেক্ষায়....ডারউইন, ল্যমার্ক, মার্কস , ফ্রয়েডের বিশ্লেষণের পরেও আরও কিছু আছে কি? এ প্রশ্ন আমার অনেকদিনের। এই যে বীজের অপেক্ষা করে থাকা সুসময়ের জন্য...এই যে লক্ষ বছর টিঁকে থাকার লড়াই..এসব আমি লিখতে চাই।'
-বাঃ।
- হ্যাঁ, আবার অন্য কেউ বলেন, ' আমি যে জীবনে আছি সে-ই জীবনের নানা টানাপোড়েন প্রতি মুহূর্তে আমাকে যেন শৃঙ্খলিত করে। ... সেই শৃঙ্খল মোচনের উপায়ই তো আমার লেখা। হয়তো হয়ে ওঠে না ঠিকঠাক, কিন্তু আমাকে তো লিখতে হবে। না লিখলে বেঁচে থাকাই যেন অর্থহীন, জীবন পানসে, বিবর্ণ... যে বিষয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করি সেই বিষয়ে লিখি। বিষয় নিয়ে ও তো লিখি না। লেখার পরে তা হয়তো বিষয় হয়ে যায়। লেখার আগে তা তো থাকে সামান্য বেদনার অনুভূতি। হয়তো কিছুই না। শূন্য থেকে যাত্রা। খরাদীর্ণ মাটিতে অবিরাম কর্ষণ আর আকাশমুখী হওয়া, যদি মেঘ আসে,ফসল হবে। আমি সর্বক্ষণ মেঘের আশায় থাকি।'
-আর তুমি? কেন লেখো?
-আমি তো লেখক নই। মাঝে মাঝে এক একটা বীজ। উড়ে আসে। লিখিয়ে নেয়। যেমন ধরো- একটা গন্ধ- রঙের গন্ধ হয়তো বা দুধ ওথলানোর - বীজ হয়ে এলো। অথবা একটা দৃশ্য-একটা পিঁপড়ে-কালো পিঁপড়ে একটা-কালো পিঁপড়ে ঘাসজমি পেরিয়ে আসছে-একটি দুটি ড্যান্ডেলায়ন, সিগারেটের খালি প্যাকেট, কোকের তোবড়ানো ক্যান পার হয়ে সে আসছিল-ঘাসজমি পেরিয়ে কার্ব বেয়ে রাস্তায় নামছিল। অথবা একটি পূর্ণ জলপাত্র, তলায় নীলচে বেগুণী নুড়ি। নুড়ি ছুঁয়ে উঠে আসছে -সাঁতার দিচ্ছে ওপর থেকে নীচ-নীচ থেকে ওপর- সিয়ামিজ ফাইটার- নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে লড়ছে। কিম্বা দেওয়াল জুড়ে গ্রাফিতি-বেগুণি সবুজ লাল কালো তীক্ষ্ণ তির্যক অক্ষরমালা। অজস্র যৌন শব্দের মাঝে লেখা ছিল ডেভিড ওয়াজ হিয়ার-পাশে আঁকা নীল সফেন সমুদ্র-তার নিচে কালো কালিতে খুলি হাড়গোড়। এই সব বীজ ছিল।
আবার ধরো, এই বারান্দাতেই একবার-হিন্দুমুসলমান নিয়ে তর্কাতর্কি-শিক্ষিত ভদ্র মানুষের মুখোশ খসে পড়ছিল-তীব্র রাগ বীজ হয়ে এসেছিল-একটি ঘূর্ণন আছে আমাদের গোপনে,গভীরে/ মাথাও জানে না পা-টিরে, পাও কি জেনেছে মাথাটিরে? রুমি । জালাল্লুদিন রুমি। ঠবভক্ষরভশফ ঈনক্ষৎভড়বনড়। ও লেখা আমার প্রতিবাদ ছিল। লেখা নয়। লেখা বোলো না । বোলো 'টেখা'। লেখার সঙ্গে দেখা হয় নি আজও। আজও ফোটে নাই সে ফুল/ শুধু বহেছে এক হাওয়া-
-আরও একটা কথা মনে হচ্ছে-বলি?
-বলো।
-এই যে ধরো-একটা দৃশ্য,বা শ্রুতি, বা গন্ধ - একই দৃশ্য ধরো -দুজন দেখছেন, দুজনকেই আলোড়িত করল অথচ দুজনের প্রকাশ একেবারে আলাদা-শুধু প্রকাশভঙ্গি-ই নয়-দুজনের দৃষ্টিকোণ আলাদা ছিল। এমনও তো হয়।
-এ তো চিরকালের কথা।
-তোমার হয়েছে এমন? হয়তো একই বীজ, তুমিও লিখেছ, আরেকজনও লিখেছেন..
-একটা 'টেখা' মনে পড়ে গেল। বীজ যদি বলতে হয় তবে তা ছিল একটি সিনেমা-সব চরিত্র কাল্পনিক। দেখার আগে অনেক লেখা পড়েছিলাম - অনেক লেখা। কেউ কবিতা ও সিনেমার সম্পর্ক খুঁজেছিলেন,কেউ কেউ দেখেছিলেন ধাঁধা লাগা সময় খেলা, সম্পর্ক খেলা, কেউ নতুন করে মনে করতে চাইছিলেন ইতালীয় ছবি ইল পোস্তিনোর গল্প যেখানে নেরুদার অজ্ঞাতবাসে তাঁকে নিয়মিত চিঠি দিতে আসত এক ডাকপিয়ন, আশ্চর্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কবির সঙ্গে, একসময় সে নিজেই কবি হয়ে গিয়েছিল। কেউ স্মৃতিতে আত্মান্বেষণ দেখেছিলেন সে ছবিতে আবার কারোর লেখা বিষয়কে ছাপিয়ে নিজেই একটি আশ্চর্যরকম স্বতন্ত্র কবিতা হয়ে গেল । অথচ আমি যখন দেখলাম সে ছবি, আমার কাছে বীজ এল কিন্তু একদম অন্যভাবে। কবিতাকে দেখতে পেলাম না । দেখলাম দুটি মাছ-একটি প্রাচীন দীঘির মাছ-পিঠে শ্যাওলা, অন্যটি অ্যাকোরিয়ামের শৌখীন মাছ। এঁদের একত্রযাপন। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সে বাহারি মাছের চোরাটান। সে লালন করে অগাধ জলাশয়ে সাঁতারের ইচ্ছে, অথচ তা গোপন রেখে দানা গেলে, অগভীর ক্লোরিন জলে এ দেওয়াল ও দেওয়াল সাঁতরায়। একদিন সে ঘাই দিল অবশেষে , জলপাত্র খান খান করে বেরিয়ে এল। সেরকমই লিখলাম। লেখা নয়, টেখা।
হা হা করে হাসে পাগল। মাথা চুলকোয়। ঝোলা কাঁধে নেয়।
বলে- ফিরে যাওয়ার সময় হ'ল এবার। বলো, তোমার জন্মদিনে কি দেব?
-এই যে মিষ্টির বাক্স রেখে গেলে।
- অচিন ময়রার দুটাকার সন্দেশ। দিও সবাইকে। আর এই নাও...
সেই সব বীজ..রোপণ করা হয় নি আজও..জল পায় নি, মাটি পায় নি.. সেই সব বীজ। ট্রাফিক লাইটে দাঁড়িয়ে আছ, দেখলে একটা হলুদ বেলুন ভেসে ভেসে রাস্তা পেরোলো। অথবা একটি শবদেহ -শিশুর শব - গোলাপি টুপি গোলাপি সোয়েটার। চরাচর ভেসে যাওয়া জ্যোৎস্নায় ফলন্ত লেবুগাছ, ঝমঝম করে পিয়ানো বাজছে কোথাও-ফুটপাথে ডাঁই করা পুরোনো আসবাব, ল্যাম্পশেড, কীটদষ্ট বই-কে যেন চলে যাবে এই জ্যোৎস্নায়। কিম্বা এক প্রাচীন জলাশয়। সে জলাশয়ের পাশে সারিন্দা বাজে-ভোরে, সন্ধ্যায়। সদ্য আলো ফোটা আকাশ অথবা উল্টোটা -আলো নিভে আসছে , তারা ফুটছে। এক আকাশ পাখি। বাসায় ফেরা ডানার শব্দের নিচে আবৃতমুখ সে কোন বৃদ্ধ সারিন্দা বাজিয়ে চলেছে-কেশরুয়া বালমা...
এই সব বীজ - কোথাও রোপণ করার ছিল-কোথাও যেন মেলানোর ছিল সব-জন্মদিনে তোমাকে দিলাম। নাও তুমি।
পাগল ঝোলায় হাত ঢোকায়। বের করে। হাতের পাতায় আলতো ফুঁ দেয় ।
-দিলাম। নাও।
বীজগুলি ইতস্ততঃ ওড়ে। বীজ, আঁশ, সুতো।
- আসবে তো আবার?
-আসব। এইদিনেই। আবার।
পাগল বাইরে আসে। হাঁটতে থাকে। তারপর আকাশমুখী হয়। মেঘ খোঁজে।
গেট খুলে একজন ঢুকলো। উস্কোখুস্কো চুল। চশমা, ঝোলা। আনমনা পাগলাটে ধরণ। বাগান পেরিয়ে বারান্দায় এসে বসল সটান। ঝোলা হাতড়ে বের করল মিষ্টির বাক্স। বারান্দায় রাখল। মাধবীলতার গুচ্ছ দুলে উঠল। সামান্য ধুলো-ও উড়ল কোথাও। কথা শুরু হ'ল। বারান্দা আর পাগলের।
- এক বছর পরে, তাই না? তাই তো?
-এই দিনেই আসি প্রতিবছর। বসতে আসি তোমার কাছে। বছরভর কাছেই থাকি। তবে গেটের ওধারে। দূর থেকে দেখে যাই। কেমন আছ?
-তুমি? লেখা কি ছেড়ে দিলে?
-লেখাই ধরে আমাকে, ছেড়েও যায়।
-সে কেমনতরো?
-সে এক রকম.. শুনবে?
-শোনাও।
-(পাগল গেয়ে ওঠে) আমি দেখি নাই তার মুখ আমি শুনি নাই তার বাণী/ শুধু শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার পায়ের ধ্বনিখানি/আমার দ্বারের সমুখ দিয়ে সে জন করে আসা যাওয়া/ শুধু আসন পাতা হ'ল আমার সারা জীবন ধরে/ ঘরে হয় নি প্রদীপ জ্বালা তারে ডাকব কেমন করে/আছি পাবার আশা নিয়ে, তারে হয় নি আমার পাওয়া-
(পাগল আপন মনে হাসতে থাকে। চুলে হাত চালায়। ঝোলায় হাত ঢোকায়। বার করে।)
-তাকে চেনো না, তবে কেমন করে লেখো?
-বীজ ওড়ে। বাতাসে বীজ ওড়ে। লেখার বীজ। মাঝে মাঝে আশ্চর্য এক বাতাস ওঠে। লেখার আঁশ, লেখার সুতো। মুখে পড়ে। চুলে জড়ায়। চশমায়। হাতে ঠেকে।
-ধরে ফ্যালো তখন, হুঁ?
-ঠিক ওরকম নয়। একটু পড়ে শোনাই? কে কি বলেন?
-হ্যাঁ। পড়ো।
(পাগল ঝোলা হাতড়ে গোটা দুই বই বের করে আনে)
- পড়ছি শোনো। 'প্রত্যেক মানুষই দ্রষ্টা। কিন্তু লেখক, তিনি যেমনই লিখুন, দ্রষ্টার সংজ্ঞা পার হয়ে স্রষ্টার ভূমিকায় আসেন শুধুমাত্র ঐ বীজবপন করার ক্ষমতার ফলে। যে সমাজে লেখকের শেকড়, যে বাতাসে তার রেসপিরেশন, সেই মাটির গর্ভে চলে যায় তার বোধের শেকড়। দু চোখ দু কান দিয়ে শুষে নেওয়া এইসব উপাদান ...রক্তের ভেতরে ঘোরাফেরা করে। গোপনে একটি বীজের জন্ম হতে থাকে। সৃষ্টির জন্য একটা প্যাশন কাজ করতে শুরু করে। একটি শায়ক তৈরি হয়। তারপর অপেক্ষা। বাসের ভেতরে দেখা কোনো ঘটনা, ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখা একঝলক কোনো দৃশ্য, অথবা খবরের কাগজে পড়া কোনো খবর হঠাৎ মগজে আলোড়ন তোলে। সেই বীজের ঘুম ভাঙে। বিদ্ধ করবে বলে তার গমন শুরু হয়।'
-তারপর?
-তারপর? 'এরপর লেখকের কেরামতি। বাক্যবিন্যাস, শব্দচয়ন, ফর্মের চতুরালি। ভ্রূণের হাত পা গজায়। জীবনবোধের জিন ঠিক করে সেই গল্পের চোখের রং, চুলের বৈশিষ্ট্য, সেই গল্পের মেজাজ.... আস্তে আস্তে একমেটে হয়, দোমেটে হয়... ডাকের সাজ ও গর্জনতেলে একটি সার্থক গল্প ঝলমল করে ওঠে।'
- আচ্ছা এই যে এত লেখা এতজন লেখেন সবার লেখার ধরণও আলাদা যেমন এই যে পড়লে বাক্যবিন্যাস, শব্দচয়ন- সেইসঙ্গে প্রত্যেকের লেখালেখির কারণও তো আলাদা-
- পড়ে শোনাই আবার?
যেমন ধরো কেউ বলেন- 'প্রাণের রসায়ন দেখে আমার ভীষণ অবাক লাগে। কত বিপর্যয় পার করে টিঁকে আছে আরশোলা,সিলাকান্থ মাছ। পদ্মফুলের বীজ একশো বছর বেঁচে থাকে সুদিনের অপেক্ষায়....ডারউইন, ল্যমার্ক, মার্কস , ফ্রয়েডের বিশ্লেষণের পরেও আরও কিছু আছে কি? এ প্রশ্ন আমার অনেকদিনের। এই যে বীজের অপেক্ষা করে থাকা সুসময়ের জন্য...এই যে লক্ষ বছর টিঁকে থাকার লড়াই..এসব আমি লিখতে চাই।'
-বাঃ।
- হ্যাঁ, আবার অন্য কেউ বলেন, ' আমি যে জীবনে আছি সে-ই জীবনের নানা টানাপোড়েন প্রতি মুহূর্তে আমাকে যেন শৃঙ্খলিত করে। ... সেই শৃঙ্খল মোচনের উপায়ই তো আমার লেখা। হয়তো হয়ে ওঠে না ঠিকঠাক, কিন্তু আমাকে তো লিখতে হবে। না লিখলে বেঁচে থাকাই যেন অর্থহীন, জীবন পানসে, বিবর্ণ... যে বিষয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করি সেই বিষয়ে লিখি। বিষয় নিয়ে ও তো লিখি না। লেখার পরে তা হয়তো বিষয় হয়ে যায়। লেখার আগে তা তো থাকে সামান্য বেদনার অনুভূতি। হয়তো কিছুই না। শূন্য থেকে যাত্রা। খরাদীর্ণ মাটিতে অবিরাম কর্ষণ আর আকাশমুখী হওয়া, যদি মেঘ আসে,ফসল হবে। আমি সর্বক্ষণ মেঘের আশায় থাকি।'
-আর তুমি? কেন লেখো?
-আমি তো লেখক নই। মাঝে মাঝে এক একটা বীজ। উড়ে আসে। লিখিয়ে নেয়। যেমন ধরো- একটা গন্ধ- রঙের গন্ধ হয়তো বা দুধ ওথলানোর - বীজ হয়ে এলো। অথবা একটা দৃশ্য-একটা পিঁপড়ে-কালো পিঁপড়ে একটা-কালো পিঁপড়ে ঘাসজমি পেরিয়ে আসছে-একটি দুটি ড্যান্ডেলায়ন, সিগারেটের খালি প্যাকেট, কোকের তোবড়ানো ক্যান পার হয়ে সে আসছিল-ঘাসজমি পেরিয়ে কার্ব বেয়ে রাস্তায় নামছিল। অথবা একটি পূর্ণ জলপাত্র, তলায় নীলচে বেগুণী নুড়ি। নুড়ি ছুঁয়ে উঠে আসছে -সাঁতার দিচ্ছে ওপর থেকে নীচ-নীচ থেকে ওপর- সিয়ামিজ ফাইটার- নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে লড়ছে। কিম্বা দেওয়াল জুড়ে গ্রাফিতি-বেগুণি সবুজ লাল কালো তীক্ষ্ণ তির্যক অক্ষরমালা। অজস্র যৌন শব্দের মাঝে লেখা ছিল ডেভিড ওয়াজ হিয়ার-পাশে আঁকা নীল সফেন সমুদ্র-তার নিচে কালো কালিতে খুলি হাড়গোড়। এই সব বীজ ছিল।
আবার ধরো, এই বারান্দাতেই একবার-হিন্দুমুসলমান নিয়ে তর্কাতর্কি-শিক্ষিত ভদ্র মানুষের মুখোশ খসে পড়ছিল-তীব্র রাগ বীজ হয়ে এসেছিল-একটি ঘূর্ণন আছে আমাদের গোপনে,গভীরে/ মাথাও জানে না পা-টিরে, পাও কি জেনেছে মাথাটিরে? রুমি । জালাল্লুদিন রুমি। ঠবভক্ষরভশফ ঈনক্ষৎভড়বনড়। ও লেখা আমার প্রতিবাদ ছিল। লেখা নয়। লেখা বোলো না । বোলো 'টেখা'। লেখার সঙ্গে দেখা হয় নি আজও। আজও ফোটে নাই সে ফুল/ শুধু বহেছে এক হাওয়া-
-আরও একটা কথা মনে হচ্ছে-বলি?
-বলো।
-এই যে ধরো-একটা দৃশ্য,বা শ্রুতি, বা গন্ধ - একই দৃশ্য ধরো -দুজন দেখছেন, দুজনকেই আলোড়িত করল অথচ দুজনের প্রকাশ একেবারে আলাদা-শুধু প্রকাশভঙ্গি-ই নয়-দুজনের দৃষ্টিকোণ আলাদা ছিল। এমনও তো হয়।
-এ তো চিরকালের কথা।
-তোমার হয়েছে এমন? হয়তো একই বীজ, তুমিও লিখেছ, আরেকজনও লিখেছেন..
-একটা 'টেখা' মনে পড়ে গেল। বীজ যদি বলতে হয় তবে তা ছিল একটি সিনেমা-সব চরিত্র কাল্পনিক। দেখার আগে অনেক লেখা পড়েছিলাম - অনেক লেখা। কেউ কবিতা ও সিনেমার সম্পর্ক খুঁজেছিলেন,কেউ কেউ দেখেছিলেন ধাঁধা লাগা সময় খেলা, সম্পর্ক খেলা, কেউ নতুন করে মনে করতে চাইছিলেন ইতালীয় ছবি ইল পোস্তিনোর গল্প যেখানে নেরুদার অজ্ঞাতবাসে তাঁকে নিয়মিত চিঠি দিতে আসত এক ডাকপিয়ন, আশ্চর্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কবির সঙ্গে, একসময় সে নিজেই কবি হয়ে গিয়েছিল। কেউ স্মৃতিতে আত্মান্বেষণ দেখেছিলেন সে ছবিতে আবার কারোর লেখা বিষয়কে ছাপিয়ে নিজেই একটি আশ্চর্যরকম স্বতন্ত্র কবিতা হয়ে গেল । অথচ আমি যখন দেখলাম সে ছবি, আমার কাছে বীজ এল কিন্তু একদম অন্যভাবে। কবিতাকে দেখতে পেলাম না । দেখলাম দুটি মাছ-একটি প্রাচীন দীঘির মাছ-পিঠে শ্যাওলা, অন্যটি অ্যাকোরিয়ামের শৌখীন মাছ। এঁদের একত্রযাপন। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সে বাহারি মাছের চোরাটান। সে লালন করে অগাধ জলাশয়ে সাঁতারের ইচ্ছে, অথচ তা গোপন রেখে দানা গেলে, অগভীর ক্লোরিন জলে এ দেওয়াল ও দেওয়াল সাঁতরায়। একদিন সে ঘাই দিল অবশেষে , জলপাত্র খান খান করে বেরিয়ে এল। সেরকমই লিখলাম। লেখা নয়, টেখা।
হা হা করে হাসে পাগল। মাথা চুলকোয়। ঝোলা কাঁধে নেয়।
বলে- ফিরে যাওয়ার সময় হ'ল এবার। বলো, তোমার জন্মদিনে কি দেব?
-এই যে মিষ্টির বাক্স রেখে গেলে।
- অচিন ময়রার দুটাকার সন্দেশ। দিও সবাইকে। আর এই নাও...
সেই সব বীজ..রোপণ করা হয় নি আজও..জল পায় নি, মাটি পায় নি.. সেই সব বীজ। ট্রাফিক লাইটে দাঁড়িয়ে আছ, দেখলে একটা হলুদ বেলুন ভেসে ভেসে রাস্তা পেরোলো। অথবা একটি শবদেহ -শিশুর শব - গোলাপি টুপি গোলাপি সোয়েটার। চরাচর ভেসে যাওয়া জ্যোৎস্নায় ফলন্ত লেবুগাছ, ঝমঝম করে পিয়ানো বাজছে কোথাও-ফুটপাথে ডাঁই করা পুরোনো আসবাব, ল্যাম্পশেড, কীটদষ্ট বই-কে যেন চলে যাবে এই জ্যোৎস্নায়। কিম্বা এক প্রাচীন জলাশয়। সে জলাশয়ের পাশে সারিন্দা বাজে-ভোরে, সন্ধ্যায়। সদ্য আলো ফোটা আকাশ অথবা উল্টোটা -আলো নিভে আসছে , তারা ফুটছে। এক আকাশ পাখি। বাসায় ফেরা ডানার শব্দের নিচে আবৃতমুখ সে কোন বৃদ্ধ সারিন্দা বাজিয়ে চলেছে-কেশরুয়া বালমা...
এই সব বীজ - কোথাও রোপণ করার ছিল-কোথাও যেন মেলানোর ছিল সব-জন্মদিনে তোমাকে দিলাম। নাও তুমি।
পাগল ঝোলায় হাত ঢোকায়। বের করে। হাতের পাতায় আলতো ফুঁ দেয় ।
-দিলাম। নাও।
বীজগুলি ইতস্ততঃ ওড়ে। বীজ, আঁশ, সুতো।
- আসবে তো আবার?
-আসব। এইদিনেই। আবার।
পাগল বাইরে আসে। হাঁটতে থাকে। তারপর আকাশমুখী হয়। মেঘ খোঁজে।
Comments
Post a Comment