দয়াময়ীর কথা
বুধমন্ডলী আজ্ঞা করেন গ্রন্থ পর্যালোচনা, সম্পাদক দাবী করেন পুস্তক সমালোচনা, বন্ধু জানতে চান পাঠপ্রতিক্রিয়া– এক্ষণে আপনার মনোভাবটির প্রত্যাশী, পাঠক। হে পাঠক, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে দৌড়চ্ছেন আপনি, বঙ্গভাষায় লেখাপত্তরের সুলুকসন্ধানে আপনার আগ্রহ কম- জানি তা। উপরোধে অথবা সময়ে কুলোলে বড়জোর ব্লার্বে চোখ বুলোন আলতো। তবু, হে নবীন পাঠক, আসুন, আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিই এই বইটির সঙ্গে। সংক্ষেপে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৮ সালের লীলা পুরস্কারপ্রাপ্ত বইটি– দয়াময়ীর কথা। লেখক– সুনন্দা সিকদার। প্রকাশক গাঙচিল। নয়নশোভন প্রচ্ছদখানি। সুচারু। মুদ্রণে পরিপাট্য। বিনিময়মূল্য দেড়শো টাকা।
এ লেখার প্রথম প্রকাশ ‘অন্তঃসার’ পত্রিকায়। পরবর্তীসময়ে আরো কিছু সংযোজনে– এই বইটি। ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালের পুববাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের শৈশবস্মৃতি- এক বালিকার। আসুন, বইটি খুলি। পাতা ওল্টাই।
শৈশবের দশটি বছর পূর্ববঙ্গে, নিঃসন্তান পিসিমার কাছে। তারপর পশ্চিমবঙ্গে মা বাবার কাছে আসা। শৈশবস্মৃতির দশটি বছর। স্মৃতি যেমন হয়– শৈশবের স্মৃতি যেমনটি হয়– কিছু কথা, কিছু দৃশ্য অতিতীব্রতায় প্রোথিত হয় অন্তরে– বাহিত হয় জীবনভর। কিছু স্মৃতি– সামান্য আবছা– নিজের মত করে নির্মাণ করে নেওয়া পরবর্তীতে– নিটোল কোনো গল্প তো নয়– আজমদাদা, মাজমদাদা, সমসেরচাচা, রাধিয়াদি, ঝুমিয়াদি, ভুলিপিসিমা, ফালানি, আচিয়া, আছরভাই, মনিরাচাচী, মাইগা সুধীরদাদা, আইলাকেশী, রাতকান্দুচোর, জয়জ্যাঠা, ইয়েদালিকাকা– বালিকার স্মৃতির মানুষজন… কালাজিরা চাল, হাঁসখোলের ভাত… সোনটিয়া, হরিদ্রাটা, বংশনদী, দিঘপাইত গাঁ, ছোঁয়াছুঁয়ি, জাতপাত, দিঘপাইত জুনিয়ার হাই ইসকুল…
মাজমদাদার কথা শুনুন, পাঠক।
আজমদাদা, মাজমদাদারা ছিলেন ‘দে বাড়ি’র বর্গাদার। তাঁরা ‘হিন্দুস্থানে’ চলে যাওয়ায় জমি কিনেছেন কাষ্ঠসিঙ্গার শেখরা– তাঁরা নিজেরাই চাষ করেন। সেহেতু আজমদাদা, মাজমদাদার অনিয়মিত আয়। মাজমদাদা দয়াময়ীর পিসিমার ‘কামলা’– তাঁর কোলেপিঠেই দয়াময়ীর শৈশব। সেই স্মৃতিতে, ধরা পড়েছে মাজমদাদা সঙ্গে কর্মকারদের মেজকর্তার কথোপকথন।
শুনবেন একটু?
শুনুন তবে…
মাজমদাদা মেজকর্তার পায়ের ওপর পড়ে বলছেন, ‘…আমাগো এট্টু জমি দ্যান কর্তা। আপনের গোলাম হইয়া থাকমু।’
মেজকর্তা বললেন, ‘দ্যাখ মাজম, ভগবানের দয়ায় আমার জমিজায়গা বাড়তাছে, কায়েতরা সস্তায় জমি বেইচা যাইতাচে, মা লক্ষী আমার দিকে একটু কিপাদিষ্টি দিচে।… তয় আমার পুরান বর্গাদারদের আমারে আগে দেখতে হোব। ওমেদের হাল-বলদ অনেকগুলা, আর তগো তো দুইখান বলদ, একখান হাল।’
-দুইখান বলদেই অনেক চাষ করমু কর্তা, জান দিয়া করমু।
-ক্যান? এত বছর বনোভুঁইয়ার বাড়িতে রইলি তারা তগো কিছু দিব না?
-তেনারা তো সব বেইচা চইলা যাইতাছেন হিন্দুস্থান। তগো জমি কিনব সরষাবাড়ির লালন শ্যাখ।
-……সইরষাবাড়ির শ্যাখেরা কিনব এত বড় সম্পত্তি? শ্যাখেদের তো বর্গার ঠ্যাকা হয় না। নিজেরাই হাল বলদ রাখে। নিজেরাই লাঙল ঠ্যালে। আমাগো হিন্দুগো আবার এইডা চলে না… চক্ষুলজ্জা আছে, সনমান আছে…’
এই মাজমদাদার নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসটি–
শুনুন তবে পাঠক, বইটি থেকে পড়ি।
‘দাদাকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘দাদা, আল্লাহরে কি কইলি?’ জবাবে দাদা বলে, ‘কইলাম, খোদাতালা, দুনিয়ায় তুমি যাগোরে পাঠাইচ, তাগো জন্য বিষ্টি দিয়ো, অন্ন দিয়ো, তাগো পোনাইপানরে ভালো রাইখো। মানুষ, জন্তুজানোয়ার, গাছপালা, পোকামাকড়, সগগলেরে ভালো রাইখো। যে মাইনষে চুরি করে, খুনখারাবি করে তাগো মাপ কইরো, তাগো সুবুদ্ধি দিয়ো।’ আমি জানতে চাই, ‘দাদা, যারা হিন্দু, দুগ্গা কালী লক্ষ্মীপূজা করে, তাগরে আল্লাহ কি করব?’ জবাবে দাদা বলে, ‘ও মা দয়া, তুই কি পাগুলনি! আল্লাহ-র সঙ্গে দুগগা লক্ষ্মীর কুন কাজিয়া নাই। বেহশতে সগগলের মইধ্যে ভাব-ভালবাসা। কুন কাজিয়ার জায়গা নাই। ও সব মাইনষে করে।”’
মাজমদাদার ধর্মটি বলাই বাহুল্য সর্বজনে অর্জিত হয় নাই। শিশুটি দরজা পেরিয়ে ঘরের পইঠাতে, পইঠা থেকে উঠানে নামতে শিখছে, বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। বসতবাড়ি বদলে যাচ্ছে ভিটাতে। পুববঙ্গ ছেড়ে হিন্দুরা চলে যাচ্ছেন। আবার উত্তরবঙ্গ থেকে বাড়িজমি বদল করে পুববঙ্গে আসছেন যে মুসলমান– ভূমিপুত্রদের সঙ্গে তাঁদের এক করে দেখছেন না কেউই। শুনুন তবে।
‘…মা খেদের সঙ্গে উত্তর করেছিল, ‘গাঁয়ের হিন্দুরা সব চইল্যা গেল। হিন্দুদেরই তো জমিজায়গা আছিল, পয়সাকড়ি, শখসাধ আছিল। একজন হিন্দুর জমি পাঁচজন মোসলমানেও কিনতে পারল না। রিপুচিদের দ্যাখস না, ইদে এরা একখান গামছা কিনতে পারে? সব লেংটিপরার জাত।’ আমি বলি, ‘মা। লেংটি পরার জাত কও ক্যান? তফন জোটে না তাই লেংটি পরে। লেংটি রিপুচিরা ক্যান, আমাগো আজিমভাইরাও পরে।’ মা খুব রেগে গিয়েছিল গ্রামের ভূমিপুত্র মুসলমানদের সঙ্গে রিফিউজি মুসলমানদের তুলনা করায়। মায়ের বোধ ছিল না, পশ্চিমবঙ্গে মায়ের গর্বের ভাইও উদ্বাস্তু হয়েই আশ্রয় নিয়েছিল।’
ডুলি পালকি বাহকদের পরিবারের রান্না ‘খাওয়াটাই অপরাধ’– শিশুটিও জানত। শুনুন, পাঠক।
‘সব থেকে গোপন একটা অপরাধ, আমি রাধিয়াদির রান্না অনেক কিছু খেতাম। ওদের চালের খুব অভাব, সেই জন্যে ওরা পেঁয়াজ দিয়ে কচুরলতি চচ্চড়ি করত ঝাল করে। …প্রথম যেদিন আমি ওদের বাড়ি কচুরলতি চচ্চড়ি খাই, সে দিন ওই অপরাধ করে এসেই স্লেটে সে কথা লিখেছিলাম।… স্লেটে লিখলে পাপটা বোধহয় কমে যেত, আর লিখতে পেরে খুব আনন্দও হত।… ঝুমিয়াদি আমায় বলল,… ‘তুমি খাও, দয়া। এখনও তর আট বছর বয়স হয় নাই, তর কুন পাপ হবে না। আর একশো আটবার নারায়ণ লিখবি সেলেটে, সব পাপ ধুইয়া যাইব গা।’
ধান ঝাড়ার সময়, এই রাধিয়াদি, ঝুমিয়াদি সরিয়ে ফেলত অল্পস্বল্প ধান। আমি ওদের বলতাম, ‘দিদি, তোরা এত পাপ করছিস। পরের জিনিস না বলে নেওয়া পাপ। মাকে না হয় ফাঁকি দিলি, কিন্তু আকাশ থেকে ভগবান তো দেখতে পাচ্ছে।’ উত্তরে তারা বলে… ‘দয়া, আমার ঠাকুরদার বাপ প্যাটের লাইগ্যা নিজের দ্যাশ দ্বারভাঙ্গা জেলা ছাড়চিল অনেক বছর আগে। তখন থিক্যা আমাদের জাইত, ধর্ম সব গেছে। এখন খালি আছে পরান বাঁচানোর ধর্ম। পরানে যদি নাই বাঁচলাম, ধর্ম দিয়াই বা কি হোব, জাইত দিয়াই বা কি হোব। আমরা হিন্দু, সিন্দুর পরি, গণেশ-লক্ষী আছে ঘরে, কিন্তু জাইত জানি না। আকালের বছর আমার শ্বশুর মোসলমানের বাড়ি ভাতের মাড় খাইয়া বাঁচছিল।”’
গ্রামের বিদ্যাচর্চার অবস্থাও সঙ্গীন ছিল, হে পাঠক। একটি জুনিয়ার হাই ইসকুল ছিল, তাতে না ছিল শিক্ষক, না ছিল বই, ছাত্র সংখ্যাও খুব সামান্য। ‘… আমি জানতাম না রবীন্দ্রনাথ কে, তাঁর কোনো লেখা পড়ি নি গাঁয়ে থাকতে। পরে ইয়েদালিকাকার কাছে শুনেছিলাম, হিন্দুস্থানে খুব বড় একজন কবি ছিলেন, যিনি জগতের সেরা কবিদের একজন।… সব থেকে লেখাপড়ার খারাপ অবস্থা ছিল মেয়েদের। মেয়েরা কেউ কেউ পড়তে জানতেন। লিখতে পারতেন না। অথচ তেঁতুলবিচি সাজিয়ে সাজিয়ে স্বরবর্ণ ব্যাঞ্জনবর্ণ পুরোটাই লিখতেন। কলম ধরার শিক্ষাটুকু ছিল না বলে তাঁরা লিখতে পারতেন না। এর জন্যে পুরুষ অভিভাবকদের থেকে কোনো সাহায্য ওঁরা পান নি। আমার মাও তেঁতুল কাটতে বসে বিচি দিয়ে সব অক্ষর সাজাত। কিন্তু বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে লিখতে চেষ্টা করলে হাত থেকে কলম ছিটকে যেত।’
এই ‘মা’ শিশুটির নিঃসন্তান বিধবা পিসিমা। এঁর কাছেই বেড়ে ওঠা বালিকার। পিসিমা– বালবিধবা। স্বামীর সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগেই যুবক স্বামীটি কলেরায় মারা যান। দেশভাগ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, মহামারী, মৃত্যুর এই মিছিল পার হয়েও এই মৃতদেহটি ঘুরে ঘুরে আসে পিসিমার কাছে।
‘বুঝলিরে দয়া, সে কি দেখছিলাম আইজও মনে হইলে গায়ে কাঁটা দেয়, কী তরতাজা চেহারা রে। বন্ধুর কান্ধ থিকা নামাইয়া উঠানে শোয়াইল। মনে হইল যেন এখনই উইঠ্যা বসব। কে কয় মরা মানুষ। সগগলে আছাড়ি পিছাড়ি কইরা কান্দে, আমি ভাবি ই কি সত্যি মরা নাকি তাজা মানুষ রঙ্গ করতাছে। বিয়ার সময় দেখছিলাম একটুখানি পোলা, আমিও তখন বাচ্চা আছিলাম। হায় রে, কবেই বা এতডা বড় হইল, মোছ দাড়ি গজাইল। মরবই যদি তাইলে ভগবান শরীরডারে আস্তে আস্তে এমুন কইরা বানাইল ক্যান?… দেখলাম যদি একেবারে মরামানুষডারে দেখলাম। এ কি ধন্দ রে বাপ।’
যদিও দয়াময়ীর এই শৈশবস্মৃতিচারণে বার বার ফিরে আসবেন সিরাজদাদা, সোবহানদাদার যন্ত্রণা– ‘দ্যাখ দয়া, হিন্দুরা কুনদিন মুসলমানদের ঘরে ঢুকতে দেয় নাই। ছুঁইলে জাইত যায়। আলাদা হুঁকা, আলাদা বাসন… ‘বাবা কয়, তাই তগরে দেখবার আহি। তরা হিন্দুস্থান চইল্যা গেলে আমি আর কুন হিন্দুর বাড়িতে পেচ্ছাপ করতেও ঢুকমু না। যারা বর্ষার ঢলের সময় মাইনষেরে ঘরে ঢোকায় না, তাগো সঙ্গে কিসের আত্মীয়তা?’, এরই পাশে বার বার ফিরে আসবেন বালবিধবা ভুলিপিসিমা- …‘দয়া, মানুষ কত ভালো হয় রে, অচেনা মানুষরে ডাইকা চটি দেয়।… বুঝলি রে দয়া, মাঝে মইধ্যে এমুন সময় আইসে, যখন মাইনষের ভিতরের শয়তানটা জাইগা উঠে, তাখন তারে ঘুম পাড়ান যায় না। তবে বেশিরভাগ সময় ভগবানটাই মাইনষের মধ্যে জাইগা থাকে। দেখস্ না, মানুষ মানুষরে কত ভালোবাসে।’
বইটি হাতে দিলাম আপনার। পাঠে নিমগ্ন হোন, হে পাঠক। চোখে ভাসুক ছিড়াজাঙ্গাইল পুল, ঝিনই নদী, জেনে নিন কারে কয় ‘মাটি চাইট্যা’ খাওয়া, ফকিরের আগম নিগম, রহিমাবিবির তিনমুঠি মাটি, মাইগা সুধীরদার অপমৃত্যুর কাহিনীটি, কান্দুচোরের গল্প, সোনাঢুলির ‘শাস্তর’, সমসেরচাচার গল্প, পাগলিনী মোদিভাবি আর তার শেষ না করা নকশিকাঁথা, আর… বালিকাটির মৃত্যুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়খানি- …‘দেখলাম, উনি কী সুন্দরভাবে খাটে শুয়ে আছেন। তাঁকে ঘিরে কাঁদছে সবাই। আর গাছের পাতা ঝরে-ঝরে উঠোনটা পুরো ঢেকে গেছে। নিশ্চয় সেটা চৈত্র মাস ছিল। আমি খুব কেঁদেছিলাম। তবে মনে হয় কান্নাটা ভট্চায্যিমশাইয়ের জন্য ছিল না। পাতা-ঝরা গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশ কেমন যেন বড় বেশি ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল। গাছের ডাল অত শূন্য হয়ে গেছিল বলেই কি কেঁদেছিলাম…’
গুণীজন বলতে পারেন– মানবীবিদ্যাচর্চার দলিল, পণ্ডিত বলবেন– দেশভাগপরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের মূল্যায়নে প্রয়োজনীয়, বুধচক্রের তর্কে উঠে আসতে পারে বিষাদবৃক্ষ, উজানি খালের সোঁতা… আপনি কি বলেন পাঠক? জীবন? আনন্দ? ভালোবাসি?
লিখেছেন – ইন্দ্রাণী দত্ত
Comments
Post a Comment