সিডনির পুজো, ২০০৯

ক্যালেন্ডারে মাসটি সেপ্টেম্বর। ঋতুটি শরৎ নয় যদিও।  লেপের আরাপ বিদায় নিচ্ছে ক্রমশঃ, বৃক্ষশাখা নিষ্পত্র নয় এই মুহূর্তে, জ্যাকারান্ডা বদলে দেবে আকাশের রং -কিছুদিন পরেই, ঘড়ির কাঁটার একঘন্টা এগিয়ে যাওয়া আসন্ন, পোলেন অ্যালার্জি আর হে ফিভার।  ভরা বসন্ত এই সময়। এই শহরে।  এই গোলার্দ্ধটিতে।
অথচ, কোথাও শরৎ এখন।  নীলকন্ঠ পাখিটি তার উড়ান শুরু করেছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ, অপেরা হাউজ, হারবার ব্রিজ। স্কাইলাইন বদলে যায় শুধু।  পুজো আসে । এই শহরেও। Ï শউলিবিহীন যদিও।
বছর আড়াই আগে , তুমুল অস্ট্রেলিয়ান সামারের তুঙ্গমুহূর্তে, যখন বুশফায়ারে ঝলসাচ্ছিল ভিক্টোরিয়া, ঘামে জবজবে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন যে সময়, এসেছিলেন তিনি। সিংহবাহিনী।  পদ্মটি ছিল না সে দিনও।  নিউ সাউথ ওয়েলস আর্ট গ্যালারিতে-'গডেস-দ্য ডিভাইন এনার্জি' প্রদর্শনীতে। থিম হয়েই এসেছিলেন-'দুর্গা -ক্রিয়েটিং আ গডেস। একচালা ট্রাডিশনাল প্রতিমাটি গড়েছিলেন কৃষ্ণনগরের নিমাই চন্দ্র পাল মশাই। মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছিলেন ঢাকি ছয়জনা। নির্মাণের জাদুতে, পুজো আর বিসর্জনের ঐশ্বর্যে বিদেশী দর্শককুল স্রেফ হতবাক হয়েছিলেন সেদিন।
সে অন্য গল্প।

এই সময়, এই শহরে ব্যস্ত বাঙালীর মোবাইল কেঁপেছে বারে বারে।  শুক্রবারের সকালে- শারদীয়া শুভেচ্ছার এস এম এসে। দেবীপক্ষের সূচনায়।  লাঞ্চব্রেকে, অফিসের কিউবিকল থেকে বেরোতেই নীলকান্তমণি আকাশে সিউরোকিউম্যুলাস।  মুহূর্তে বুকে পুজোর ঢাক। মিটিংএ আনমনা। ফ্রাইডে নাইটের হাতছানি উপেক্ষা করে সটান্‌ ঘরে ফেরা-এই শহরের বাসাটিতে। ওয়ার্ডরোব থেকে বেরিয়ে এসেছে ব্যোমকাই, বালুচরী, কাঁথাস্টিচ পাঞ্জাবি। মথবল আর স্মৃতিসমেত।
মহালয়া সপ্তাহান্তেই দুটি পুজো। কার্লিংফোর্ডে কাম্বারল্যান্ড হাই স্কুলে 'উত্তরণ'এর পুজো-'দাসেদের পুজো' নামেই পরিচিতি যদিও। আর ক্রয়ডনে 'সিডনি উৎসব'এর পুজো।সেখানকার বয়েজ হাই স্কুলে। বারো বছর আগেও 'উত্তরণ ' ছিল শুধুই পারিবারিক পুজো-সার্বজনীন হয়ে গেছে কবেই! পার্থ দাসমশাইয়ের নিজের হাতে গড়া প্রতিমাটি। নরম কাঠের। ক্রয়ডনের পুজোর প্রতিমাও সিডনিরই আর এক গুণী মানুষ আশিস ভটাচার্যের গড়া। সে পুজোরও দু বছর হ'ল এবারে।
দুই পুজোতেই একই দৃশ্য। ধুতিতে , শাড়িতে, যজ্ঞের ধোঁয়ায়, আরতির শিখায়, প্রসাদ আর ভোগের লম্বা কিউতে সরগরম পুজোচত্ত্বর। স্কুলের মাঠ জুড়ে বাচ্চারা -নতুন জামায়। হলুদ শাড়িতে অনভ্যস্ত খুকীটি ভ্যাঁ! ' আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্ট্যান্ড ইন দ্য কিউ!' নবীন প্রজন্মের ঈষৎ নাকি সুর।
সন্ধ্যায় দুটি পুজোতেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।আসর মাতাচ্ছেন স্থানীয় প্রতিভা। গানের সুরে শরীরে দোলা। মন্ডপের রাতের মেনুতে বিরিয়ানি, কালোজাম।

পরের সপ্তাহান্তটি নিউ সাউথ ওয়েল বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের। শনি রবি -দু দিনই। শনিবারের রাতে শুভমিতার গান। দ্বিবার্ষিক 'প্রবাসী পত্রিকাটি প্রকাশিত হবে। কনকর্ড চত্ত্বর ভরিয়ে দেবেন বাঙালী। দু দিনই। অবাঙালী ভক্তবৃন্দ, আগ্রহী বিদেশী উৎসবে অংশ নেবেন। পুজো সংখ্যা, বাংলা গানের সিডির স্টলে লম্বা লাইন পড়বে। দুপুরের মেনুতে খিচুড়ি , লাবড়া, বেগুণী, চাটনি , পাঁপড়? পায়েস হবে না? লুচি? বৃষ্টি হবে না তো?আলোচনায় উঠে আসবেই আকাশ লাল করা মহাপঞ্চমীর ভোরের আঁধি।
শনিবারেই রামকৃষ্ণ মিশনের অষ্টমীর পুজো। বাংলাদেশ সোসাইটি ফর পুজা অ্যান্ড কালচারের পুজো গ্রানভিলে। রোব্বার অ্যাশফিল্ডে বাংলাদেশ পূজা অ্যাসোসিয়েশনের পুজো। ইস্টউডেও একটি পুজো।
সমস্ত মন্ডপেই ভীড় জমাবে বাঙালী। ধুতি, শাড়ি, গুলতানিতে। জটলায় কান পাতলে শোনা যাবে রিসেশন, কারি ব্যাশিং, কেভিন রাড কিম্বা ড্যান ব্রাউনের সাম্প্রতিক হার্ড বাউন্ড। অঞ্জলি দেওয়ার সময় ফিরে আসবে প্রথম যৌবনকাল, সে সময়ের প্রাণের শহর, মৃত প্রিয়জনসকল। হয়তো। অথবা হয়তো রোদ, ধুনোর ধোঁয়া, কিম্বা প্রবাসীর ন্যাকামি কেবল। চোখ তবু ভেজেই। অবশ্যম্ভাবী।

নিউজীল্যান্ডের দুর্গাপুজোর খবর আসে। ফিজির দুর্গাপুজোরও। যদিও শরৎ নয় এখানে, কাশের গুচ্ছ মাথা দোলায় না যদিও, রিসেশনের কারণে কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ মেলায় না, তবুও উৎসবে সামিল বাঙালী। সর্বত্র। বাঙালী। ঠিকানা - ভুবনগ্রাম।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস