শূন্যের ভিতরে ঢেউ
'কোন্টা যে প্রেমের কবিতা আর কোন্টা নয়, তার ঠিক হদিশ করতে পারি না আমি... তাই কোনো বন্ধু যখন বলেন প্রেমের কবিতা আমি লিখিইনি, কখনো সেই প্রস্তাবে আমার একটা সায়ই থাকে। অথচ, প্রেম ছাড়া লিখেছি আর ক'টা?'
শঙ্খ ঘোষ
১
'আনন্দে চিরায়ু চাও লগ্ন তুমি প্রত্যহের স্রোতে।
উদাত্ত প্রান্তর জুড়ে দুপুরের রৌদ্র পায় ছুটি-
বুকের অনন্ত ইচ্ছা ছুটে আসে ভূমিগর্ভ হতে
দুঃখের সবুজ গুচ্ছে তোমার সম্পূর্ণ হাত দুটি।'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
সে যদি হয় এমন কেউ, যাকে তুমি চেনো। অথবা জানো। হয়তো চেনো, কিন্তু জানো না। কিম্বা জানো, চেনো না। হয়ত একত্রে বসত। এক ছাদের তলায়। কিম্বা সাক্ষাৎ। শুধুই সাক্ষাৎ।কদাচিৎ। হয়তো প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত। ভীড়ে। কিম্বা নির্জনে। একান্ত নিভৃতির দর্পণে। হয়তো সে হেঁটে যায়। একা। আর তুমি রয়েছ তোমার নিভৃতির ব্যালকনিতে।অথবা হাঁটছ তার পাশে। সে হাঁটে । ভোর হয়। তুমি তাকে দেখ হেঁটে যেতে তার ছায়ার সঙ্গে। আর পংক্তিগুলি ভীড় করে আসে-
'আলো এক পাশে থাকে, সে আলোর ভিতরে থাকে না
জল তাকে ডাক দেয়, মাটি তার পায়ে পায়ে হাঁটে
তার কোনো দুঃখ নেই, আজ তার ভার আছে শুধু।
একাকার হয়ে আছে তার সব দিনে আর রাতে
প্রতিবিম্ব নিয়ে আজ একা একা দূরে গিয়েছে সে
...
তুমি তাকে একা বলো? স্বচ্ছতায় কতদূর একা?
সে দেখে দিগন্তময় স্থির তার ভবিতব্যরেখা
ঢেউএর উপরে ঢালে আলো, সেই আলো পাশে থাকে...'
কি বলে যায় এই পংক্তিনিচয়? স্বচ্ছতায় কেমন করে একা হয় মানুষ? দিগন্তময় তার যে ভবিতব্য লেখা, সেই কি তুমি? সে কি এই অনুচ্চার সম্পর্ক? এই কি ভালোবাসা? এই কি প্রেম?
অবধারিত মনে আসে আর একটি পংক্তিমালা, এইরকম-
'আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ঐ এক মেঘের মতো মানুষ
ওর গায়ে টোকা দিলে জল ঝরে পড়বে বলে মনে হয়
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ঐ এক মেঘের মত মানুষ
ওর কাছে গিয়ে বসলে ছায়া নেমে আসবে মনে হয়
ও দেবে, না নেবে? ও কি আশ্রয়? নাকি আশ্রয় চায়?
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ঐ এক মেঘের মতো মানুষ
ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমিও হয়তো কোনোদিন হতে পারি মেঘ!'
অনুভূতির দোলাচল, অনুভবে ছলাৎছল বানভাসি-'মনে হয়', 'হয়তো' শব্দের পৌনঃপৌনিক প্রয়োগ....
মানুষ, মেঘের মত মানুষ। নারী নয়, পুরুষ নয়, মানুষ। জল-ভরা মানুষ। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মানুষ। কি চাও তুমি তার থেকে? আশ্রয়? আবার তোমার মনে হচ্ছে সেও অবলম্বন চাইছে তোমার কাছেই।সেই মেঘ মানুষকে হৃদয়ে ধারণ করতে করতে তুমি হয়ে উঠছ সজল, ভালোবাসায় টইটম্বুর।মেঘ ছুঁয়ে বসছ আজ কতদিন পরে-
'অনেকদিন মেঘের সঙ্গে কথা বলো নি তাই এত শুকনো হয়ে আছো এসো তোমার
মুখ মুছিয়ে দি।'
২
'অসংখ্য আনন্দভরে দুহাতে জীবন দাও ওকে-
মোহ নয় মোহ নয় ঃ এ চাওয়াই সমুদ্র অবধি।'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
এই সম্পর্কে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজছ তুমি। কিছু কি স্পষ্ট হয় এইবার?
এই শহর , এই আলো জ্বলা স্কাই লাইন, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, একাকী ক্রেনটি-রোজকার শহর তোমার। কি অসম্ভব মায়াময় হয়ে উঠছে দেখো। অলৌকিক সোনালি আলোয় ভরে যাচ্ছ 'আঁকিবুঁকি গলি, পথ, দোকান-পসার, ছোটো সিঁড়ি..'
'বুঝতে পারি এ শহরে সমস্ত ধুলোরই মানে আছে
দীর্ঘ দীর্ঘ সূর্যরেখা ছিটকে গেলে ভাঙা টুকরো কাচে
যে আশ্চর্জ মনে হয় সোনালি সরু সুতো....
.. বুঝতে পারি এ শহরে আমারও বাঁচার মানে আছে।'
সোনালী সুতোয় বোনা সম্পর্ক। তারই ছোঁয়া তোমার জীবনের সর্বত্র, এই চিরচেনা জীবনে তারই গন্ধ।জীবনই বদলে যাচ্ছে আমূল।
ঠিক এমনভাবেই দুটি মানুষের 'শিরস্ত্রাণবিহীন' হেঁটে যাওয়া কেমন করে বদলে দিচ্ছে দেখো তোমার প্রতিদিনের চেনা শহরকে-
'এই সকলের লাঞ্ছিত কলকাতা
শ্রাবণের হঠাৎ বর্ষণে
সমস্ত মোচন করে খুলে দেয় অতর্কিতে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড
আর তার ঝাপসা শূন্যতায়
হালকা পায়ে ভিজে যায় ঐ দুটি মানব-মানবী
শিরস্ত্রাণবিহীন।'
'শিরস্ত্রাণবিহীন' শব্দবন্ধটি সম্পূর্ণ বদলে দিল 'লাঞ্ছিত কলকাতাকে'। তোমার শহরকে।লহমায়। সমস্ত অপ্রেম মুছিয়ে দিয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে।
৩
'জলের ডালায় যদি হৃদয় প্রসার করি, তোমারই বিকাশ।
মেঘের গুহায় ঢালি হৃদয় যখন, দেখি তোমারই বিকাশ।
কুয়াশা-উথাল জটা দিক দিক ভরে যদি, তোমারই বিকাশ।'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
ধরো, একত্রে বসত তোমাদের। প্রতিদিনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ।কলহ।অভিমান।
'যত তুমি বকোঝকো মেরেকুটে করো কুচিকুচি
আমি কিন্তু বলব এসবেই আন্তরিক রুচি;
ঘরে থাকতে অল্পমতি, রোদে রোদে পথে ঘুরে ফেরা
আকাশে বিচিত্রমেঘ নানা ছন্দে তোলে যে অপেরা
তাতে লুপ্ত হতে হতে রুক্ষ চুলে বাড়ি ফিরে আসা
পোড়া মুখে চিহ্ন তার অকুন্ঠ বিস্মিত ভালোবাসা!
ক্ষিদেয় তৃষ্ণায় টলে কন্ঠাবধি সমস্ত শরীর,
অভ্যাস মরে না জেনে দুই চোখে তোলো তুমি তীর
তা সত্ত্বেও বিনাস্নানে ভালো লাগে মধ্যাহ্নভোজন।
... সে যে মরে ছুটে বিবিধ অন্যায়ে
তাকে কী ফেরাব আমি! অসম্ভব অসম্ভব প্রিয়
আমাকে ভুবন দাও আমি দেব সমস্ত অমিয়।'
বকাঝকা, মেরেকুটে কুচিকুচি... দু চোখের শাসন চাও না তুমি মনে মনে? দৈনন্দিনের এই তো অমিয়।
পাশাপাশি রাখো এই পংক্তিগুলি-
'দুপুরে রুক্ষ গাছের পাতার
কোমলতাগুলি হারালে-
তোমাকে বক্ব, ভীষন বক্ব
আড়ালে।
...
মেঘের কোমল করুণ দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে
তোমাকে বক্ব, ভীষণ বক্ব
আড়ালে।'
'বক্ব' শব্দের পাশে একটুখানি লাজুক হেসে যেই বসল 'আড়ালে' শব্দ, তোমার বকুনির অর্থই বদলে গেল তার কাছে। একে কি তুমি বলো দৈনন্দিনের দগ্ধ প্রান্তরে আচম্বিতে জেগে ওঠা সসাগরা তৃতীয় ভুবন?
'আমাদের দেখা হলো আচম্বিতে
অধিকন্তু শীতে
পশ্চিমপ্রেরিত আমি, তুমি এলে পূর্বের প্রহরী
দুই প্রান্ত থেকে ফিরে আমাদের দেখা হলো ভূমধ্যসাগরে।
...
পরস্পরের অঞ্জলিতে রাখি যত উদ্যত প্রণয়
সে তো শুধু জলাঞ্জলি নয়, তারই বীজে
অসম্ভব তৃতীয় ভুবন এক জেগে ওঠে আমাদের ভেঙে।'
ধরো তোমাদের একত্রযাপন। নিবিড়। সেই জীবনে আঁধার ঘনায় কখনও নানাভাবে। হাত ধরে থেকেছ ।উচ্চারণ করেছ সেই বাক্যবন্ধ। বহুব্যবহৃত তথাপি মায়াময়।
'আবার যখন ফিরে আসে এরকম নিজের মধ্যে ভরে ওঠা দুপুর
যখন মাথার উপর নিকষকালো মেঘ
...
ছমছমে প্রান্তর জুড়ে খেলনা দুই মানুষ...
... শুধু ধরা থাকে হাত
হাতে হাত কথা নেই কোনো...
... আমাদের মাঝখানে প্রথম বৃষ্টির বিন্দু নীল
আর তুমি নিচু হয়ে তুলে নাও একমুঠো মাটি
শূন্যে ছড়াও, আর চোখে চোখে না তাকিয়ে বলো ঃ
ভেবো না। ভেবো না কিছু। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।'
এই স্নিগ্ধ আশ্বাস কি দিতে পারো তুমি যখন সে অনেকদূরে থাকে? যখন সে তোমার দৃষ্টির অগোচর, তোমার উচ্চারণ স্পর্শ করে তাকে?অদেখায় আছে কি অবগাহন?
'যন্ত্রের এপার থেকে কথা বলতে বলতে শব্দগুলি জলস্তম্ভ তোমাকে তারা ছুঁতে
পারে না আর তুমিও দেখতে পাও না মুখচ্ছবি কোথায় কীভাবে ভাঙে
কেননা কেবলই স্তম্ভ, জল নেই, স্নানজল নেই'
শব্দ যখন ব্যর্থ স্পর্শ করতে, অনুচ্চারণ মনে পড়ছে তোমার?অনুচ্চারণ-জলের ধারের নতমুখী কুসুমযথা।
'বলি নি কখনও?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
....
দীর্ঘ চরাচর,
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রূপালী ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলি নি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতর এত ঢেউ আছে
সে কথা জানো না?'
৪
'দাও ডুবে যেতে দাও ঐ পদ্মে, কোরকে, কোমলে
দাও চোখ ধুয়ে দাও ভোরের আভায়, জন্মভোর
শিরায় শিরায় বাঁধো, পাপড়িগুলি ঢেকে বলে যাও
ফিরে জাওয়া যওয়া নয়, সেই আরো কাছাকাছি আসা।'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
আজ আর কোনো উচ্চারণ নয়, কথা নয় কোনও, শরীরের আনন্দ-উদ্ভিদ আজ মাটি খুঁজছে। আশাবরী মাঘের কুয়াশায়।
আনন্দের মহাপদ্ম পাপড়ি মেলছে। শরীর জুড়ে।
'... তুমি আছো আমি আছি আমাদের ভয় ও বিবেক অনায়াসে
মসৃণ পাতার থেকে অনাবৃত জলে ঝরে যায়,
তবে তো তোমারই ভালো, এসো
ধন্য হও, এসো-
ব'লে সেই নারী নিজে আমার শরীরে ঝুঁকে পড়ে
আমার আনন্দ শুষে খায়।'
তন্মুহূর্তে আবার ফিরে আসে মেঘ, মেঘের মন্ডন এক-
' এই মেঘ আমাদের, মেঘের মন্ডনে বসে আছি
এক মুহূর্তের তাপে কেন্দ্র ও পরিধি কাছাকাছি
যা ছিল যা হবে তার দুই মুখ কথা বলে এসে-
বয়স? সে বেঁচে থাকে তোমার শরীর ভালোবেসে।'
আবার দেখো এই লাইনকটি-মিলনবর্ণনে অনিবর্য অঙ্গস্তব বর্জিত - আশ্চর্য চিত্রকল্পে তোমার শরীর কখনও অশ্ব , কখনও আদিগন্ত ধানক্ষেত-অথচ শরীর। অথচ মিলন-
'বলেছিলাম, এসো, নতুন হও আবার
খুলে ফেলো সব সাজ
রাখো কেবল শরীর
আর অমনি তুমি ঘুরে দাঁড়াও
চোখ পড়ে স্ফুরিত দুই চোখে
মুখে উঠে আসে হালকা ছায়া
লাগামে টান লাগার আগের মুহূর্তে
ঠিক যেভাবে
নিঃশ্বাস নেয় পুরোনো ঘোড়া।'
কিম্বা-
'কখনও মনে হয় তুমি ধানখেতে ঢেউ, তারই সুগন্ধে গভীর তোমার
উদাত্ত-অনুদাত্তে বাঁধা দেহ, প্রসারিত হিল্লোলিত
আমি ডুবে যাই নিবিড়ে নিমগ্ন বৃষ্টিরেণুর মত, শিউরে ওঠে সমস্ত পর্ণকণা
জীবনের রোমাঞ্চে, ধূপের ধোঁয়ার মতো মাটির শরীর জাগে কুন্ডলিত কুয়াশায়।'
এই মিলন, যাকে তুমি বল-মনের সঙ্গে ওতপ্রত , যাকে তুমি বল নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ-বোধহীন তাপী হলুদ শরীর তার সমস্ত মিথ্যে, তার সমস্ত পাপ সমর্পণ করছে তোমার কাছে।নেমে আসছে তোমার মেঘময় ঠোঁট । বুকের প্রপাত ঝরছে। বৃষ্টি নামছে-
'.... সমস্ত সারাৎসার অন্ধকার তুলে নাও, আর
বৃষ্টি করো দেহময় অন্ধকার করো ধারাময়
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।'
৫
'গিয়েছে আর সব, কেবল বাকি
বুকের ভিতরের মোরগঝুঁটি।
সেখানে হাওয়া দেয় অপরিণাম
শূন্যতায় ঘেরা তোমার নাম।
...তখনও কাঁপে তার পাঁজরতলে
আগুনে পোড়ে না যা ভেজে না জলে'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
সেই মুহূর্তে গোধূলিলগ্নে মাথার ওপর হাঁসের ঝাঁক, দাঁড়িয়ে আছ তুমি, শহর তার শরীর থেকে খুলে নিচ্ছে শীতের বল্কল, নতমুখী জবাটি ফিরে আসছে তোমার সই-এর নাম হয়ে। এই কি তবে ভালোবাসা? বুক কাঁপা সন্ন্যাস?
'... অমনি সবাই প্রান্তে মিলায়, ঝাপসা রেখে আমায়
সঙ্গিনী যায় বৈরাগীগৌরবে-
দুহাত দিয়েই ধরেছিলাম, রইল না তো তবু
হাতেই কোনো ভুল ছিল কি তবে?'
বা, ধরো সেই লোকটা-সংসারের দংশনের মাঝে সে কি এখনও তোমার চোখে তাকিয়ে নিঃসংশয় হয় আজও? এই কি ভালোবাসা তবে?
'...ধ্বংসের পাশে সংসার যদি
গোপন আলোয় দংশায়, তবু
তোমার চোখের সঞ্চারে সে কি আজও হয় নিঃসংশয়?আর
হঠাৎ সান্ধ্য গৈরিকে আজও
বুক কাঁপে সন্ন্যাসে?
না যদি, তাহেলে নিশ্চিত জেনো
লোকটার হয়ে গেছে!'
অথবা ভালোবাসা কি এক অপেক্ষা?নিবিড় অবগাহনের ?
'...মাটি ঘুরছিল সৃষ্টির কিনারাতে
বহুদূর থেকে দেখা জায় যেন ঘুম
পুঞ্জে পুঞ্জে ছেয়ে দেয় লোকযান
মনে পড়ে শুধু একটি বিন্দু আছে
যে আজ আমাকে জাগিয়ে তুলতে পারে,
জাগায়নি তবু, পাঠায় নি প্রতিঘাতও-
মাটি ভিজে গেছে, আমাকে এবার তবু
এত বৃষ্টিও রেখে গেছে অস্নাত!'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে- সে বলেছিল, পরশপাথর
তুমি ছুঁতে চেয়েছিলে-সে ছিল প্রজাপতির ডানা, রেণু রেণু হয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল....
'বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে
তোমার ধানের মুখে ধরে আছি আর্ত দুই ঠোঁট
তুমি চোখ বন্ধ করো, আমিও দুচোখ ঢেকে শুনি
যেন কোন্ তল থেকে উঠে আসে পাতালের শ্বাস
সমস্ত দিনের মূর্ছা সেচন পেয়েছে এইখানে
মুহূর্ত এখানে এসে হঠাৎ পেয়েছে তার মানে
নিজের পায়ের চিহ্ন নিজে আর মনেও রাখেনি
আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছুটান
মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে আছে জলে
এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে।'
শঙ্খ ঘোষ
১
'আনন্দে চিরায়ু চাও লগ্ন তুমি প্রত্যহের স্রোতে।
উদাত্ত প্রান্তর জুড়ে দুপুরের রৌদ্র পায় ছুটি-
বুকের অনন্ত ইচ্ছা ছুটে আসে ভূমিগর্ভ হতে
দুঃখের সবুজ গুচ্ছে তোমার সম্পূর্ণ হাত দুটি।'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
সে যদি হয় এমন কেউ, যাকে তুমি চেনো। অথবা জানো। হয়তো চেনো, কিন্তু জানো না। কিম্বা জানো, চেনো না। হয়ত একত্রে বসত। এক ছাদের তলায়। কিম্বা সাক্ষাৎ। শুধুই সাক্ষাৎ।কদাচিৎ। হয়তো প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত। ভীড়ে। কিম্বা নির্জনে। একান্ত নিভৃতির দর্পণে। হয়তো সে হেঁটে যায়। একা। আর তুমি রয়েছ তোমার নিভৃতির ব্যালকনিতে।অথবা হাঁটছ তার পাশে। সে হাঁটে । ভোর হয়। তুমি তাকে দেখ হেঁটে যেতে তার ছায়ার সঙ্গে। আর পংক্তিগুলি ভীড় করে আসে-
'আলো এক পাশে থাকে, সে আলোর ভিতরে থাকে না
জল তাকে ডাক দেয়, মাটি তার পায়ে পায়ে হাঁটে
তার কোনো দুঃখ নেই, আজ তার ভার আছে শুধু।
একাকার হয়ে আছে তার সব দিনে আর রাতে
প্রতিবিম্ব নিয়ে আজ একা একা দূরে গিয়েছে সে
...
তুমি তাকে একা বলো? স্বচ্ছতায় কতদূর একা?
সে দেখে দিগন্তময় স্থির তার ভবিতব্যরেখা
ঢেউএর উপরে ঢালে আলো, সেই আলো পাশে থাকে...'
কি বলে যায় এই পংক্তিনিচয়? স্বচ্ছতায় কেমন করে একা হয় মানুষ? দিগন্তময় তার যে ভবিতব্য লেখা, সেই কি তুমি? সে কি এই অনুচ্চার সম্পর্ক? এই কি ভালোবাসা? এই কি প্রেম?
অবধারিত মনে আসে আর একটি পংক্তিমালা, এইরকম-
'আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ঐ এক মেঘের মতো মানুষ
ওর গায়ে টোকা দিলে জল ঝরে পড়বে বলে মনে হয়
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ঐ এক মেঘের মত মানুষ
ওর কাছে গিয়ে বসলে ছায়া নেমে আসবে মনে হয়
ও দেবে, না নেবে? ও কি আশ্রয়? নাকি আশ্রয় চায়?
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ঐ এক মেঘের মতো মানুষ
ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমিও হয়তো কোনোদিন হতে পারি মেঘ!'
অনুভূতির দোলাচল, অনুভবে ছলাৎছল বানভাসি-'মনে হয়', 'হয়তো' শব্দের পৌনঃপৌনিক প্রয়োগ....
মানুষ, মেঘের মত মানুষ। নারী নয়, পুরুষ নয়, মানুষ। জল-ভরা মানুষ। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মানুষ। কি চাও তুমি তার থেকে? আশ্রয়? আবার তোমার মনে হচ্ছে সেও অবলম্বন চাইছে তোমার কাছেই।সেই মেঘ মানুষকে হৃদয়ে ধারণ করতে করতে তুমি হয়ে উঠছ সজল, ভালোবাসায় টইটম্বুর।মেঘ ছুঁয়ে বসছ আজ কতদিন পরে-
'অনেকদিন মেঘের সঙ্গে কথা বলো নি তাই এত শুকনো হয়ে আছো এসো তোমার
মুখ মুছিয়ে দি।'
২
'অসংখ্য আনন্দভরে দুহাতে জীবন দাও ওকে-
মোহ নয় মোহ নয় ঃ এ চাওয়াই সমুদ্র অবধি।'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
এই সম্পর্কে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজছ তুমি। কিছু কি স্পষ্ট হয় এইবার?
এই শহর , এই আলো জ্বলা স্কাই লাইন, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, একাকী ক্রেনটি-রোজকার শহর তোমার। কি অসম্ভব মায়াময় হয়ে উঠছে দেখো। অলৌকিক সোনালি আলোয় ভরে যাচ্ছ 'আঁকিবুঁকি গলি, পথ, দোকান-পসার, ছোটো সিঁড়ি..'
'বুঝতে পারি এ শহরে সমস্ত ধুলোরই মানে আছে
দীর্ঘ দীর্ঘ সূর্যরেখা ছিটকে গেলে ভাঙা টুকরো কাচে
যে আশ্চর্জ মনে হয় সোনালি সরু সুতো....
.. বুঝতে পারি এ শহরে আমারও বাঁচার মানে আছে।'
সোনালী সুতোয় বোনা সম্পর্ক। তারই ছোঁয়া তোমার জীবনের সর্বত্র, এই চিরচেনা জীবনে তারই গন্ধ।জীবনই বদলে যাচ্ছে আমূল।
ঠিক এমনভাবেই দুটি মানুষের 'শিরস্ত্রাণবিহীন' হেঁটে যাওয়া কেমন করে বদলে দিচ্ছে দেখো তোমার প্রতিদিনের চেনা শহরকে-
'এই সকলের লাঞ্ছিত কলকাতা
শ্রাবণের হঠাৎ বর্ষণে
সমস্ত মোচন করে খুলে দেয় অতর্কিতে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড
আর তার ঝাপসা শূন্যতায়
হালকা পায়ে ভিজে যায় ঐ দুটি মানব-মানবী
শিরস্ত্রাণবিহীন।'
'শিরস্ত্রাণবিহীন' শব্দবন্ধটি সম্পূর্ণ বদলে দিল 'লাঞ্ছিত কলকাতাকে'। তোমার শহরকে।লহমায়। সমস্ত অপ্রেম মুছিয়ে দিয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে।
৩
'জলের ডালায় যদি হৃদয় প্রসার করি, তোমারই বিকাশ।
মেঘের গুহায় ঢালি হৃদয় যখন, দেখি তোমারই বিকাশ।
কুয়াশা-উথাল জটা দিক দিক ভরে যদি, তোমারই বিকাশ।'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
ধরো, একত্রে বসত তোমাদের। প্রতিদিনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ।কলহ।অভিমান।
'যত তুমি বকোঝকো মেরেকুটে করো কুচিকুচি
আমি কিন্তু বলব এসবেই আন্তরিক রুচি;
ঘরে থাকতে অল্পমতি, রোদে রোদে পথে ঘুরে ফেরা
আকাশে বিচিত্রমেঘ নানা ছন্দে তোলে যে অপেরা
তাতে লুপ্ত হতে হতে রুক্ষ চুলে বাড়ি ফিরে আসা
পোড়া মুখে চিহ্ন তার অকুন্ঠ বিস্মিত ভালোবাসা!
ক্ষিদেয় তৃষ্ণায় টলে কন্ঠাবধি সমস্ত শরীর,
অভ্যাস মরে না জেনে দুই চোখে তোলো তুমি তীর
তা সত্ত্বেও বিনাস্নানে ভালো লাগে মধ্যাহ্নভোজন।
... সে যে মরে ছুটে বিবিধ অন্যায়ে
তাকে কী ফেরাব আমি! অসম্ভব অসম্ভব প্রিয়
আমাকে ভুবন দাও আমি দেব সমস্ত অমিয়।'
বকাঝকা, মেরেকুটে কুচিকুচি... দু চোখের শাসন চাও না তুমি মনে মনে? দৈনন্দিনের এই তো অমিয়।
পাশাপাশি রাখো এই পংক্তিগুলি-
'দুপুরে রুক্ষ গাছের পাতার
কোমলতাগুলি হারালে-
তোমাকে বক্ব, ভীষন বক্ব
আড়ালে।
...
মেঘের কোমল করুণ দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে
তোমাকে বক্ব, ভীষণ বক্ব
আড়ালে।'
'বক্ব' শব্দের পাশে একটুখানি লাজুক হেসে যেই বসল 'আড়ালে' শব্দ, তোমার বকুনির অর্থই বদলে গেল তার কাছে। একে কি তুমি বলো দৈনন্দিনের দগ্ধ প্রান্তরে আচম্বিতে জেগে ওঠা সসাগরা তৃতীয় ভুবন?
'আমাদের দেখা হলো আচম্বিতে
অধিকন্তু শীতে
পশ্চিমপ্রেরিত আমি, তুমি এলে পূর্বের প্রহরী
দুই প্রান্ত থেকে ফিরে আমাদের দেখা হলো ভূমধ্যসাগরে।
...
পরস্পরের অঞ্জলিতে রাখি যত উদ্যত প্রণয়
সে তো শুধু জলাঞ্জলি নয়, তারই বীজে
অসম্ভব তৃতীয় ভুবন এক জেগে ওঠে আমাদের ভেঙে।'
ধরো তোমাদের একত্রযাপন। নিবিড়। সেই জীবনে আঁধার ঘনায় কখনও নানাভাবে। হাত ধরে থেকেছ ।উচ্চারণ করেছ সেই বাক্যবন্ধ। বহুব্যবহৃত তথাপি মায়াময়।
'আবার যখন ফিরে আসে এরকম নিজের মধ্যে ভরে ওঠা দুপুর
যখন মাথার উপর নিকষকালো মেঘ
...
ছমছমে প্রান্তর জুড়ে খেলনা দুই মানুষ...
... শুধু ধরা থাকে হাত
হাতে হাত কথা নেই কোনো...
... আমাদের মাঝখানে প্রথম বৃষ্টির বিন্দু নীল
আর তুমি নিচু হয়ে তুলে নাও একমুঠো মাটি
শূন্যে ছড়াও, আর চোখে চোখে না তাকিয়ে বলো ঃ
ভেবো না। ভেবো না কিছু। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।'
এই স্নিগ্ধ আশ্বাস কি দিতে পারো তুমি যখন সে অনেকদূরে থাকে? যখন সে তোমার দৃষ্টির অগোচর, তোমার উচ্চারণ স্পর্শ করে তাকে?অদেখায় আছে কি অবগাহন?
'যন্ত্রের এপার থেকে কথা বলতে বলতে শব্দগুলি জলস্তম্ভ তোমাকে তারা ছুঁতে
পারে না আর তুমিও দেখতে পাও না মুখচ্ছবি কোথায় কীভাবে ভাঙে
কেননা কেবলই স্তম্ভ, জল নেই, স্নানজল নেই'
শব্দ যখন ব্যর্থ স্পর্শ করতে, অনুচ্চারণ মনে পড়ছে তোমার?অনুচ্চারণ-জলের ধারের নতমুখী কুসুমযথা।
'বলি নি কখনও?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
....
দীর্ঘ চরাচর,
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রূপালী ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলি নি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতর এত ঢেউ আছে
সে কথা জানো না?'
৪
'দাও ডুবে যেতে দাও ঐ পদ্মে, কোরকে, কোমলে
দাও চোখ ধুয়ে দাও ভোরের আভায়, জন্মভোর
শিরায় শিরায় বাঁধো, পাপড়িগুলি ঢেকে বলে যাও
ফিরে জাওয়া যওয়া নয়, সেই আরো কাছাকাছি আসা।'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
আজ আর কোনো উচ্চারণ নয়, কথা নয় কোনও, শরীরের আনন্দ-উদ্ভিদ আজ মাটি খুঁজছে। আশাবরী মাঘের কুয়াশায়।
আনন্দের মহাপদ্ম পাপড়ি মেলছে। শরীর জুড়ে।
'... তুমি আছো আমি আছি আমাদের ভয় ও বিবেক অনায়াসে
মসৃণ পাতার থেকে অনাবৃত জলে ঝরে যায়,
তবে তো তোমারই ভালো, এসো
ধন্য হও, এসো-
ব'লে সেই নারী নিজে আমার শরীরে ঝুঁকে পড়ে
আমার আনন্দ শুষে খায়।'
তন্মুহূর্তে আবার ফিরে আসে মেঘ, মেঘের মন্ডন এক-
' এই মেঘ আমাদের, মেঘের মন্ডনে বসে আছি
এক মুহূর্তের তাপে কেন্দ্র ও পরিধি কাছাকাছি
যা ছিল যা হবে তার দুই মুখ কথা বলে এসে-
বয়স? সে বেঁচে থাকে তোমার শরীর ভালোবেসে।'
আবার দেখো এই লাইনকটি-মিলনবর্ণনে অনিবর্য অঙ্গস্তব বর্জিত - আশ্চর্য চিত্রকল্পে তোমার শরীর কখনও অশ্ব , কখনও আদিগন্ত ধানক্ষেত-অথচ শরীর। অথচ মিলন-
'বলেছিলাম, এসো, নতুন হও আবার
খুলে ফেলো সব সাজ
রাখো কেবল শরীর
আর অমনি তুমি ঘুরে দাঁড়াও
চোখ পড়ে স্ফুরিত দুই চোখে
মুখে উঠে আসে হালকা ছায়া
লাগামে টান লাগার আগের মুহূর্তে
ঠিক যেভাবে
নিঃশ্বাস নেয় পুরোনো ঘোড়া।'
কিম্বা-
'কখনও মনে হয় তুমি ধানখেতে ঢেউ, তারই সুগন্ধে গভীর তোমার
উদাত্ত-অনুদাত্তে বাঁধা দেহ, প্রসারিত হিল্লোলিত
আমি ডুবে যাই নিবিড়ে নিমগ্ন বৃষ্টিরেণুর মত, শিউরে ওঠে সমস্ত পর্ণকণা
জীবনের রোমাঞ্চে, ধূপের ধোঁয়ার মতো মাটির শরীর জাগে কুন্ডলিত কুয়াশায়।'
এই মিলন, যাকে তুমি বল-মনের সঙ্গে ওতপ্রত , যাকে তুমি বল নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ-বোধহীন তাপী হলুদ শরীর তার সমস্ত মিথ্যে, তার সমস্ত পাপ সমর্পণ করছে তোমার কাছে।নেমে আসছে তোমার মেঘময় ঠোঁট । বুকের প্রপাত ঝরছে। বৃষ্টি নামছে-
'.... সমস্ত সারাৎসার অন্ধকার তুলে নাও, আর
বৃষ্টি করো দেহময় অন্ধকার করো ধারাময়
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।'
৫
'গিয়েছে আর সব, কেবল বাকি
বুকের ভিতরের মোরগঝুঁটি।
সেখানে হাওয়া দেয় অপরিণাম
শূন্যতায় ঘেরা তোমার নাম।
...তখনও কাঁপে তার পাঁজরতলে
আগুনে পোড়ে না যা ভেজে না জলে'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে-সে মাথা নেড়েছিল দুদিকে-জানা যায় না, জানা যায় না কিচ্ছু জানা যায় না-তুমি তার ঘ্রাণ পেতে চেয়েছিলে প্রেমে অপ্রেমে, শরীরে, মিলনে,বর্ণ গোচর করতে চেয়েছিলে তুমি-ছুঁতে চেয়েছিলে তাকে....
সেই মুহূর্তে গোধূলিলগ্নে মাথার ওপর হাঁসের ঝাঁক, দাঁড়িয়ে আছ তুমি, শহর তার শরীর থেকে খুলে নিচ্ছে শীতের বল্কল, নতমুখী জবাটি ফিরে আসছে তোমার সই-এর নাম হয়ে। এই কি তবে ভালোবাসা? বুক কাঁপা সন্ন্যাস?
'... অমনি সবাই প্রান্তে মিলায়, ঝাপসা রেখে আমায়
সঙ্গিনী যায় বৈরাগীগৌরবে-
দুহাত দিয়েই ধরেছিলাম, রইল না তো তবু
হাতেই কোনো ভুল ছিল কি তবে?'
বা, ধরো সেই লোকটা-সংসারের দংশনের মাঝে সে কি এখনও তোমার চোখে তাকিয়ে নিঃসংশয় হয় আজও? এই কি ভালোবাসা তবে?
'...ধ্বংসের পাশে সংসার যদি
গোপন আলোয় দংশায়, তবু
তোমার চোখের সঞ্চারে সে কি আজও হয় নিঃসংশয়?আর
হঠাৎ সান্ধ্য গৈরিকে আজও
বুক কাঁপে সন্ন্যাসে?
না যদি, তাহেলে নিশ্চিত জেনো
লোকটার হয়ে গেছে!'
অথবা ভালোবাসা কি এক অপেক্ষা?নিবিড় অবগাহনের ?
'...মাটি ঘুরছিল সৃষ্টির কিনারাতে
বহুদূর থেকে দেখা জায় যেন ঘুম
পুঞ্জে পুঞ্জে ছেয়ে দেয় লোকযান
মনে পড়ে শুধু একটি বিন্দু আছে
যে আজ আমাকে জাগিয়ে তুলতে পারে,
জাগায়নি তবু, পাঠায় নি প্রতিঘাতও-
মাটি ভিজে গেছে, আমাকে এবার তবু
এত বৃষ্টিও রেখে গেছে অস্নাত!'
তুমি তার নাম জানতে চেয়েছিলে- সে বলেছিল, পরশপাথর
তুমি ছুঁতে চেয়েছিলে-সে ছিল প্রজাপতির ডানা, রেণু রেণু হয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল....
'বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে
তোমার ধানের মুখে ধরে আছি আর্ত দুই ঠোঁট
তুমি চোখ বন্ধ করো, আমিও দুচোখ ঢেকে শুনি
যেন কোন্ তল থেকে উঠে আসে পাতালের শ্বাস
সমস্ত দিনের মূর্ছা সেচন পেয়েছে এইখানে
মুহূর্ত এখানে এসে হঠাৎ পেয়েছে তার মানে
নিজের পায়ের চিহ্ন নিজে আর মনেও রাখেনি
আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছুটান
মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে আছে জলে
এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে।'
Comments
Post a Comment