পদ্মসম্ভব

 বহুদিন পর আমাদের ঘরদোরে  আজ পাহাড়ের গন্ধ। এক চিলতে বারান্দায় আবার একটা পুরোনো ব্যাকপ্যাক, ছেড়ে রাখা ভারি জুতোয় নুনের সাদা সাদা ছোপ  - রোদ এসে পড়েছে তাতে। বারান্দার দিক থেকে পাহাড়ের গন্ধ উড়ে আসছিল, আর এই খাট বিছানা, সোফা, টিভি, ডাইনিং টেবল,  চেয়ারের আগাপাশতলা ছেয়ে ফেলছিল - আকাশে জমে ওঠা মেঘের মতো, যেন এখনই বৃষ্টি নামবে।  আমি কোনোদিন পাহাড়ে যাই নি। বীথিকাও নয়। একটা পিকচার পোস্টকার্ডে পাহাড়ের রঙীন  ছবি দেখেছিলাম প্রথম - বাচ্চুদার ভ্যারাইটি স্টোরে। দোকানে ফিল্মস্টারদের ছবি ঝুলত - গাঢ় নীল ব্যাকগ্রাউন্ডে মিঠুন, অমিতাভ, বিনোদ খান্না, জীনত, হেমামালিনী , রেখা- সাদা বর্ডার দেওয়া, পোস্টকার্ড সাইজ -স্ট্যান্ডার্ড।  ওখানেই একদিন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছিলাম- ঝাপসা একটা প্রিন্ট- ঋষি আর ডিম্পলের মাঝখানে ঝুলছিল। শ্রীদেবীর ছবির সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা ফ্রী দিয়েছিল বাচ্চুদা- " পাঁচবছর ধরে পড়ে থেকে  রঙ উঠে গেছে, কে  কিনবে ঐ ছবি? "

সে সময় স্কুলের  ছুটি হলেই মামাবাড়ি- বহরমপুরে।  বার দুই দীঘা গিয়েছিলাম, পুরীতেও। ক্লাস নাইনের পুজোর ছুটিতে দার্জিলিং যাওয়ার কথা হয়েছিল- টিকিট কাটার ঠিক আগে পাহাড়ে  গন্ডগোল। পোলিটিকাল আনরেস্ট। তারপর একসময় বরফ আর আনরেস্ট সমার্থক হয়ে গিয়েছিল অথবা আনরেস্টকে আমরা সমতলে নামিয়ে এনেছিলাম। শহরে গন্ডগোল লেগেই থাকতো। হয়তো মিছিল বেরিয়েছে বা মীটিং চলছে পাড়ার মোড়ে- বলা কওয়া নেই,  শুরু হয়ে গেল বোমাবাজি। আশপাশের দোকানের ঝাঁপ নামলো তৎক্ষণাৎ, গৃহস্থের জানলা দরজা বন্ধ ; তারপর ঘন্টাখানেক পরে  রাস্তায় পুলিশ জীপের টহল,  একটা কি দুটো ডেডবডি।  আমরা এতেই অভ্যস্ত তখন - পেটো, পাইপগান, চেম্বার সব চিনে গিয়েছি ঐ বয়সেই, গরমের ছুটিতে পাহাড়ের বদলে  সমুদ্র অথবা মামাবাড়ি  আর পাড়ার  গন্ডগোলে দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে দরজায় খিল। এসবের মধ্যেই জন্ম , মৃত্যু , বিবাহ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলি ঘটে যেত । স্বাভাবিকভাবেই। প্রেমও। আমি বীথিকার প্রেমে পড়ি ক্লাস টুয়েলভে। ও গার্লস, আমি বয়েজ স্কুল - কোচিং ক্লাসে প্রেম হয়ে গেল। বীথিকাকে ফার্স্ট লাভলেটার - ঐ কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিওলা পোস্টকার্ডে।

আমরা ভাবতাম, হানিমুনে পাহাড়ে যাব। কাঠের বাড়িতে ফায়ার প্লেসের সামনে খুব ভালোবাসব দুজনকে। পাকদণ্ডী বরাবর আলোদের জ্বলে ওঠা দেখতে দেখতে বারান্দায় বসে চা খাবো। " ততদিনে সব গন্ডগোল ঠিক হয়ে যাবে "-বীথিকা বলত।

-ততদিন মানে?

-যতদিন না পড়াশুনা শেষ হয়, চাকরি পাই দুজনে-

- এখনও কত দেরি- লুকিয়ে যাবে একবার?

-মানে?

-বিয়ের আগে?

-কী সাহস!

-কেন? যায় না? যায় তো-

-সে সিনেমায়।  চেনা জানার মধ্যে দেখেছ কাউকে?

-তুমি বাড়িতে বলবে, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে-কলেজের এক্সকারশন বা কিছু একটা-বটানির প্র্যাকটিকাল - মে বি। আমি কিছু একটা...

-এই বুদ্ধি নিয়ে আর চাকরি করেছ তুমি!

-যাবে না তাহলে?

"ও মা, যাবো তো, হানিমুনে" - বীথিকা এই সময় আমার গা ঘেঁষে বসত। ওর হাত ধরে বলেছি, "তোমার গায়ে কিসের গন্ধ বীথিকা?"

- পাউডার। পন্ডস। ভালো?

- যাঃ পাউডার নয়। পদ্মফুলের গন্ধ একদম-

- পদ্মের গন্ধ চেনো তুমি? 

- না। তাতে কী?  পদ্মফুল তো দেখেছি-

-তো?

- তো আবার কী? কাউকে ভালোবাসলে সব থেকে যা সুন্দর তার সঙ্গেই তুলনা করে মানুষ-  পদ্মের গন্ধ খুব সুন্দর- আমার মনে হল;  অত ব্যাখ্যা করতে পারব না, ব্যাস -

- যা খুব সুন্দর,  তাকে আমার ভয় করে জানো? মনে হয়, খুব কাছে না যাওয়াই হয়তো ভালো। তোমাকে সেই গল্পটা বলেছিলাম না? আমার ছোটোবেলার গল্প? যেই না শিয়াল বলত, আকাশ ভেঙে পড়েছে রে আকাশ ভেঙে পড়েছে - আমি কাঁদতে শুরু করতাম; অত বড় আকাশ - কী নীল, কী সুন্দর, সূর্য আছে, চাঁদ তারা- ভেঙে পড়লে তো কাছে চলে আসবে- খুব ভয় করত আমার-

-তাহলে আর বিয়ে করা হল না, হানিমুন তো' নয়ই -

বীথিকা মুখ ভেঙায়- আমি চুমু খাই ওকে। মায়ায় মায়ায় ভরে যেতে থাকে বুকের ভিতর।

-বীথিকা-

-উঁ

-আমরা খুব সুখী হবো,  দেখে নিও-

দুজনে পাশাপাশি বসে থাকি দীর্ঘক্ষণ। প্রস্ফুটিত শতদলের বাস ভেসে আসে যাকে আমরা সুখ বলে চিনে নিই তৎক্ষণাৎ।  

 

বুবুন বলত ম্যাজিক ভেকেশনের কথা- যে ছুটিতে গেলে নাকি সব অশান্তি মুছে যায়। এই সব আদ্যন্ত গুল আমরা জানতাম। তাও আমরা বুবুনকে যেতে দিয়েছিলাম। আমি আর আমার অন্ধ বৌ। এম এ ফাইনালের ঠিক আগে অন্ধ হয়ে  গিয়েছিল বীথিকা।  একটা শুক্রবার- ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছিল - শিয়ালদা থেকে ট্রেনে আধঘন্টা তারপর স্টেশন থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথ।  বরাবর একসঙ্গেই ফিরতাম। সেদিনই একসঙ্গে পড়ব বলে বেহালায় সুজিতের বাড়িতে থেকে গিয়েছিলাম।  সপ্তাহের শুরুতে পাড়ার  দুই পার্টির মারামারি হয়েছিল খুব;  একটি ছেলে, মাথায় গুলি লেগে কোমায় চলে গিয়েছিল - ঐ শুক্রবার বিকেলেই  মারা যায়। ঘটনার পরিণামে সন্ধ্যের মুখে যে বোমাবাজি শুরু হয় , বীথিকা তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। এম এ দেওয়া হয় নি, চাকরি করাও হ'ল না ওর। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েই বিয়ের দিন ঠিক করি। বীথিকা হনিমুনে যেতে চাইল না- "কী হবে?"

- সেদিন তোমার সঙ্গে থাকলে এমন হত না .. কেন যে!

-অন্ধ মেয়ে বিয়ে করে আপশোস হয় বুঝি?

- মোটেই না। তা কেন? রাগ হয়। রাগ হয় খুব। নিজের ওপর রাগ হয়-

-তুমি থাকলে, তোমারও চোখ যেত, নয়তো হাত, পা, কিম্বা মাথা। জানো, ছেলেটা দেখল আমাকে- দেখল , আমি  মোড়ের মাথায়, তবু ছুঁড়ল বোমাটা- পাড়ার ছেলে নয় জানো।  কোনোদিন দেখি নি। বেপাড়ার কেউ।  পাঁচ মিনিট পরে বোমা ফেললে কী এমন ক্ষতি হত ছেলেটার?

-সে ছেলেটা কী করে রাতে ঘুমোয় কে জানে! তোমার জীবনটা... একবার যদি হাতে পাই- শালার চোখ খুবলে নেব...

"রাগ পুষে  রেখে লাভ কী বলো-"  বীথিকা বলত। তারপর  চুপ করে যেত। ওর চোয়াল শক্ত হত, অন্ধ চোখের মণি  নড়া চড়া করত দ্রুত।

বছর দুই পরে বুবুন জন্মাল। আমাদের ঘরদোরে পাহাড়ের গন্ধ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ওর ঊনিশ বছর বয়সে। কলেজে  ট্রেকিংএর নেশা ধরল বুবুনকে-  বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে কোথায় কোথায় না গিয়েছে। বীথিকা আপত্তি করেছিল প্রথমটায়।  তারপর, ব্রহ্মতাল থেকে সাত দিন পরে ফিরল যেদিন- অপরিষ্কার জামা প্যান্ট, খ্সখসে চামড়া, ভুরুর ওপরে কাটা একটা দাগ-  ব্যাকপ্যাক বারান্দায় রেখে স্নানে ঢুকেছিল;  আমি বীথিকাকে দেখছিলাম, এক সপ্তাহের টেনশন কেটে গিয়ে ঝলমল করছে ওর চোখমুখ। একটু উত্তেজিতও হয়তো - দ্রুত শ্বাস  নিচ্ছিল, ছাড়ছিল।  হঠাৎ বড় করে নিঃশ্বাস নিল- একবার দুবার তিনবার পরপর-"পাহাড়ের গন্ধ পাচ্ছ?"

আমি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম।

- এদিকে এসো

বীথিকার পাশে বসে দেখলাম-  সামনে রৌদ্রবহুল বারান্দায় বুবুনের ঢাউস  ব্যাকপ্যাক,  এক কোণে ছেড়ে রাখা বুট - কাদামাটি, ঘাস শুকিয়ে রয়েছে।

- বড় করে শ্বাস টানো।

আমি ওর হাত ধরে চোখ বুজে শ্বাস নিলাম। বীথিকার চুলের গন্ধ পেলাম, রান্নাঘর থেকে ভাত ফোটার গন্ধ, বাথরুম থেকে শ্যাম্পুর গন্ধ এল প্রথমে, তারপর ডেটল সাবানের, তারপর... একটা আশ্চর্য গন্ধ - ছোটোবেলায় রোদ থেকে লেপ তুলে আনার সময়, লেপের ওয়াড় থেকে যেমন একটা গন্ধ পাওয়া যায়- নারকেল তেলের গন্ধ, তুহিনার গন্ধ, হয়তো শিমূল তুলোর গন্ধও -মিলে মিশে এমন একটা কিছু  যাকে  আরাম আর আশ্রয়ের গন্ধ মনে হয়;  সেই রকম বাস আসছিল বারান্দা থেকে - একটা আবাহনের মতো। এই ই পাহাড়ের গন্ধ?  বীথিকা বলছিল ওর শিলংয়ের মামার কথা- শীতে, সপরিবার সমতলে নেমে এলে, ওর মামাবাড়িময় এমন গন্ধ পাওয়া যেত।  

পরের বার এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে গেল বুবুন, তারপর দেওরিয়াতাল চন্দ্রশিলা, কেদারতাল- বীথিকা আর আপত্তি করে নি কখনো। বুবুন ফিরে এলে বীথিকা লম্বা নিঃশ্বাস নিত, আমরা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম যেন সামনেই হিমালয়ের রেঞ্জ- বরফে ঢাকা। পাহাড়ের গন্ধ বারান্দা থেকে বসার ঘরে ঢুকত সটান , তারপর ধূপের ধোঁয়ার মত, মেঝে থেকে খানিকটা ওপরে আমাদের নাক বরাবর থেকে যেত। একই সঙ্গে একটা নাম ঢুকেছিল বাড়িতে। তেনজিন। লাডাকের বাসিন্দা আদতে- বুবুনই বলেছিল। অধিকাংশ ট্রেকেই বুবুনের গাইড। যতদূর জেনেছিলাম, তেনজিনের নিজস্ব ভ্রমণ সংস্থা, ট্রেকিং ওর প্যাশন। তেনজিনের ওপর অসম্ভব ভরসা করত বুবুন। আমরাও। যে কোনো ট্রেকের আগে আমাদের মুখে মুখে ফিরত তেনজিনের নাম - যেন মুশকিল আসান। এমন হয়েছে, ট্রেক করতে গিয়েছে বুবুন - চার দিন পাঁচদিন হয়ে যায়- কোনো খবরই নেই, মোবাইলও বাজে না- তখন ফোন করেছি তেনজিনকে- শান্ত মৃদু স্বর, ঈষৎ সর্দি-বসা -  হিন্দি ইংরিজি মিলিয়ে বলেছে- " অল গুড স্যার জী, মা জী। সব একদম ফার্স্ট ক্লাস। বে ফিকর রহিয়ে।"

প্রথমদিকে আমরা  বলতাম- তেনজিং। বুবুন বলেছিল "তেনজিন। তেনজিন। দলাই লামার স্পিরিচুয়াল নাম -ওদিকে অনেকের নামই তেনজিন-

- কত কী জানি না, দেখ-

-না বেরোলে জানা যায় না বাবা-চলো না একবার তিনজনে একসঙ্গে যাই- কত বছর বাড়ির বাইরে যাও নি তোমরা-

-তোর মা কে নিয়ে....

দু'হাতের আঙুলে উদ্ধৃতি চিহ্নের ভঙ্গি করেছিল বুবুন, " বাবা ওয়ন্স অ ইয়ার, গো সামপ্লেস ইউ হ্যাভ নেভার বীন বিফোর। ম্যাজিক ভেকেশন হবে দেখো।" 

-কী ম্যাজিক হবে রে?

- একবার ঘুরে এলে, এতদিনের সব ক্ষোভ, দুঃখ মুছে যাবে, দেখো- এজন্যই তো বাইরে যাই এত, সব মুছে আবার নতুন হয়ে ফিরি-

আমরা অবাক হয়েছিলাম, " এই বয়সে কিসের এত দুঃখ তোর?"  চেয়ার থেকে উঠে ছেলের সামনে দাঁড়িয়েছিল বীথিকা, হাতড়ে হাতড়ে বুবুনের বুকের মাঝখানে দুই হাত  পাতল - যেন এক স্পর্শে বুঝে নেবে সন্তানের যাবতীয় অ-সুখ, আরোগ্য এনে দেবে অন্য হাতে। বুবুন হেসে উঠে নিজের ঘরে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। বুবুনের হাসিটা আমাদের পাহাড়ের গন্ধভরা ঘরদোরের একটা মিস্টিক পার্ট হয়ে গেল। তারপর ভ্যানিশ করে গেল। বরাবরের মতো।

 

গত এক বছরে বুবুনের হাসি বন্ধ হয়েছে, তারপর ট্রেকিং, শেষে কথা। 'ভালো লাগছে না, ভালো লাগছে না' করতে করতে গোমুখ তপোবনে গেল, আমরা বলেছিলাম, "যাস না, বুবুন।" শুনল না। 

দু' সপ্তাহ পরে ফিরেছিল - মাথার চুল জটা পাকিয়ে আছে, লাল টকটকে চোখ - একটি কথাও না বলে,  ঘরে দোর  দিয়েছিল;   প্রতিবেশী ক’জনকে  ডেকে দরজা খোলাতে হল, স্নান করাতে হল, খাওয়াতে হল।  ডাক্তার, ওষুধ কম হল না এক বছরে।  ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা বাড়ি এল কতদিন। অধ্যাপ্করা।  কোনো উন্নতি নেই। মাস্টার্স কনটিনিউ করল না।  মোবাইল বাজলে ধরে না, কথা বলে না। সমস্ত দিন ফ্যাল ফ্যাল করে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থাকে।  একটি ছেলে আসে রোজ- সমর। বাথরুমে নিয়ে যায়, স্নান করিয়ে খাইয়ে দেয়। বীথিকাকে আমি একই কথা বলি রোজ- "মেয়েটা কে?  যে মেয়েটা খুব ফোন করত? ট্রেকে যেত যে সব সময়? পারমিতা? সুভদ্রা? হিয়া? ভাণী মেহতা?"

- কী করে বলব?

-কেন বলল না আমাদের? কিছুই বলল না? আমরা ওর কেউ নই?

বীথিকার চোয়াল ওঠে নামে। আমি ওর  অন্ধ নয়নতারায় চেয়ে  থাকি- যেন কোনো নাম লেখা আছে।

 

এই দুদিন আগে বিকেলে বাজারে গিয়েছি- ওষুধ্পত্র , টুকটাক ডিম, কলা, পাঁউরুটি- পাঞ্জাবির পকেটে মোবাইল বেজে বেজে থেমে গেছে- বাজারের কোলাহলে বুঝতে পারি নি।  বাড়ি ফিরে তেনজিনের মিসড কল দেখে ফোন করি সটান; স্পীকারে দিয়ে, গলা খাঁকরে বলি," তেনজিন? কেমন আছেন তেনজিন?"

-নীলাম্বর কেমন আছে?

-ঐ রকমই।

-বাড়িতেই?

-হ্যাঁ, নিজের ঘরেই তো, সবসময়-

-আমি কলকাতায় এসেছি, আপনাদের বাড়িতে একবার আসব?

-অবশ্যই, অবশ্যই। এখানেই এসে থাকুন।

পাশ থেকে বীথিকা ফুঁপিয়ে ওঠে-" আপনি আসুন, আপনি এলেই বুবুন ভালো হয়ে যাবে।"

- কাল চলে আসব মা জী। থাকব। পরদিন ফিরে যাব।

 

 

 

বহুদিন পরে আমাদের ঘরদোরে আজ পাহাড়ের গন্ধ- তেনজিন এসেছে। কতদিন পরে ব্যাকপ্যাক বারান্দায় রেখে স্নান করতে গিয়েছে কেউ। বাথরুমে জলপড়ার আওয়াজ, ডেটল সাবানের , শ্যাম্পুর  গন্ধ ছাপিয়ে রৌদ্রস্নাত বারান্দা থেকে পাহাড়ের ঘ্রাণ ঘরে ঢুকছে। তেনজিনের ছেড়ে রাখা জুতোয়  পাহাড়ের ধুলো, মাটি, দুটো একটা মৃত পতঙ্গ, শুকনো ঘাস।

স্নান সেরেই বুবুনের ঘরে  গিয়ে বসে রইল তেনজিন।  বুবুনের কপালে হাত রাখল, তারপর মাথায়।

-কিছু খাবেন না, তেনজিন?

-টেক রেস্ট স্যার জী মা জী। আমি এ ঘরেই থাকি এখন। রাতে খাবো একেবারে।

জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, সমর বাইরের রোদে বুবুনের  পাজামা, গেঞ্জি মেলে দিচ্ছে।

- এই ছেলেটি নীলাম্বরের সব কাজ করে দেয়? ওকে আজ ছুটি দিয়ে দিন। আমি আছি, সব সামলে দেব।

দরজা ভেজিয়ে চলে আসার সময় দেখলাম তেনজিন বুবুনের বইয়ের তাক থেকে বই নামাচ্ছে।

- পার্টিকুলার কোনো বই খুঁজছেন?

- ইন সার্চ অফ লস্ট টাইম- নীলাম্বরের প্রিয় বই-

-পেলেন ? বাঁদিকের নিচের তাক, মনে হয়-

 

খেতে বসেছিলাম আমরা। বুবুনকে খাবার টেবিলে নিয়ে এলো তেনজিন। চেয়ারে বসিয়ে গলায় বিব বেঁধে দিল যত্ন করে। প্লেটে খাবার নিয়ে বুবুনের পাশে এসে বসল।

-নীলাম্বর এই টেবিলে খায় না?

- না, ওর ঘরেই … সমর খাইয়ে দেয়।

- জানেন, ট্রেকিংএ গেলে সবাই একসঙ্গে গোল হয়ে বসে খাই, গান গাই, নিজেদের অনেক কথা - যা কাউকে বলি নি, বলে ফেলি। কতবার এমন হয়েছে, একটা খুব কঠিন ট্রেকে মাঝপথে আটকে গেছি- হয়তো কেউ অসুস্থ হয়েছে, অথবা, ন্যাভিগেশনের সমস্যা- খুব টেনশন-  তখন কী ভাবতাম, জানেন? যেন দেখতে পেতাম আগুন জ্বালিয়ে,  রাতে একসঙ্গে গোল হয়ে খেতে বসেছি আমরা।  খুব হাসছি এই ডিফিকাল্ট টাইমের গল্প করতে করতে। এই ছবিটাই মোটিভেট করত - আসলে, ফ্রেন্ডশিপ, কমারাডারি, পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা- একটা ট্রেকিং টীম এ  যেটা খুব দরকার- সংসারেও।  বুবুনকে দু চামচ ভাত খাওয়ালো তেনজিন তারপর বীথিকার দিকে ফিরে বলল, "মা জী, নীলাম্বর আপনাকে বন্ধু ভাবত- জানেন?"

- আপনাকে বলেছে আমার কথা?

তেনজিন চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। বুবুনের দিকে তাকালো। হাতের চামচ নামিয়ে রাখল প্লেটে।

- একটা গল্প বলি। একবার এক অন্ধ মানুষ  বুদ্ধদেবের কাছে এলেন। জ্ঞানী । স্কিলড ইন আর্গুমেন্টেশন। জন্ম থেকেই অন্ধ।  তিনি তর্ক জুড়লেন বুদ্ধদেবের সঙ্গে, " আলো আছে, আমি বিশ্বাস করি না। কোথায় আলো? গন্ধ আছে? ছুঁতে পারি? স্বাদ নিতে পারি? আচ্ছা, আপনি আলোকে বাজাতে পারেন? পারেন বাজাতে? আমি শুনব তাহলে।  এই তো চার ইন্দ্রিয়- এরা তো কেউই  আলোকে পাচ্ছে না। বাকি যে পাঁচ নম্বর, আমার মতে কল্পনা, ইমাজিনেশন। আলো ব্যাপারটাই বিভ্রম। আসলে সবাই অন্ধ।  সব্বাই অন্ধ আমরা।"

- এ গল্প তো আগে শুনি নি- বুবুন জানে?

-হ্যাঁ নীলাম্বর জানে।

-তারপর?

-বুদ্ধদেবকে সেই অন্ধ মানুষ চ্যালেঞ্জ করলেন- প্রমাণ করুন দৃষ্টি বলে কিছু আছে। বুদ্ধদেব কী করলেন জানেন? এক চিকিৎসকের কাছে পাঠালেন মানুষটিকে।  মাস ছয়েক লেগেছিল তাঁর দৃষ্টি ফিরে পেতে। সুস্থ হয়ে বুদ্ধদেবের পায়ে এসে পড়লেন- ইয়োর আরগুমেন্ট ওয়র্কড।

জল খেল তেনজিন। আর এক চামচ ভাত দিল বুবুনের মুখে, ঝোল গড়াচ্ছিল কষ বেয়ে, মুছিয়ে  দিল।

- স্যারজী হয়তো অন্ধকার চেনেন না, আপনি তো আলো দেখেছেন মা জী, অন্ধকারও। একটা চেনা, অন্যটা অজানা।  আপনি দুইই চেনেন। আপনি জানেন, দুই ই আছে। অচেনাকে ভয় পাওয়ার কথা নয় আপনার।  নীলাম্বর তাই আপনাকেই বলেছিল, ভেবেছিল, আপনি ই বুঝবেন।

- কী বলেছিল বুবুন? কী বলেছিল তোমাকে বীথিকা?

বীথিকা উত্তর দিল না। ডাল মাখা ভাতে দু'আঙুল ছুঁইয়ে বসে রইল ঠায়।

- নীলাম্বর আপনাকে রাজেশের কথা বলেছিল, মা জী। আপনি বলেছিলেন, হয় না এমন, হয় না-

- আমাকে তো কিছু বলো নি তুমি? কে রাজেশ?

-বুবুনের বন্ধু। বুবুন ওকে ভালোবেসেছিল... আমি বারণ করেছিলাম। আমি ...

-কেন ? কেন? আমাকে একবার বললে না পর্যন্ত?

" আমরা পাহাড়ে যেতে পারি নি-  একটা কাঠের বাড়ি, ফায়ার প্লেস- আমরা যেমন ভাবতাম। বুবুন যাবে, বুবুন  আর একটা মেয়ে। কে রাজেশ? বলো, কে সে?  রাজেশকে আমার বেপাড়ার সেই ছেলেটা মনে  হয়েছিল - যেন বোমা ছুঁড়ে পালিয়ে যাবে আবার " বীথিকা কাঁদছিল। হেঁচকি উঠছিল ওর। জল ঢেলে দিল ভাতের পাতে-

অচেনা ঠেকছিল বীথিকাকে। সদ্য দৃষ্টিহীন মানুষ যেমন অনভ্যস্ত হাতে আকার বা অবয়বকে বুঝে নিতে চায়, বীথিকার নয়নপথ বেয়ে ওর মনের মধ্যে মগজের মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম - সূক্ষ্মজালের মতো শিরা উপশিরা বেয়ে প্রাণ প্রবহমান, তারই পাশে  কত বেদনা, রক্ত, অশ্রু, অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়ে গিয়েছে -

নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে আমাদের খাওয়ার ঘর;  ঘড়ির কাঁটার ঘুরে চলার আওয়াজ শুধু, পাখার হাওয়ায় পর্দা দুলছিল সামান্য। তেনজিন আর এক  চামচ ভাত খাওয়ালো বুবুনকে।

- রাজেশকে চেনেন আপনি? নিয়ে আসুন ওকে। কিম্বা ঠিকানা বলুন। বীথিকা আর আমি নিয়ে আসব। বুবুন সেরে উঠবে।

- ও আর নেই স্যারজী। রাজেশও ট্রেক করত - কখনও আমাদের সঙ্গে, কখনও আলাদা।  অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্ট হয় । আমরা তখন তপোবন গোমুখে...

আমি দেখছিলাম, বুবুনের হাত কাঁপছে- শীর্ণ শাদা হাত, সবুজ শিরা, গেঞ্জির ওপর দিয়ে কণ্ঠা বেরিয়ে আছে- কিছু বলতে চাইল। ওর  ঠোঁট কাঁপছিল, শব্দ করে কেঁদে উঠল তারপর।

- বুবুন, বুবুন বাবা

- আমি দেখছি স্যার জী,  আপনি বসুন।

ওর মুখ ধুইয়ে দিল তেনজিন। ঘরে নিয়ে গেল তারপর। লাঠি ঠুকে ঠুকে ভিতরে চলে গেল বীথিকা।

মনে হচ্ছিল, যেন অবিরাম ভূকম্পনের মাঝখানে বসে আছি; গুমগুম শব্দ উঠছে, এ' বাড়ির সমস্ত দেওয়াল ধ্বসে পড়ছে এক  এক করে - ছাদটুকুও যেন থাকবে না ।  খাবার ঘরে বসে রইলাম অনেকক্ষণ;   ছাল চামড়াহীন গোলাপী মাংসপিণ্ড -  যেন একটা ক্ষত বিক্ষত প্রাণী আমার অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এসেছিল- মানুষ বলে চেনা যায় না তাকে;   জবুথবু সে বসে রইল পায়ের কাছে- বেড়ালের মতো - আদর করা যায়, লাথিও মারা যায় তাকে। বারান্দায় এসে সিগারেট ধরালাম। ভেজানো দরজার ওপার থেকে তেনজিনের গলা - বুবুনকে পড়ে শোনাচ্ছে- “The universe is true for us all and dissimilar to each of us. ”

বুবুন বলেছিল, এমন জায়্গায় যেতে যেখানে আগে কোনোদিন যাই নি।  কোথাও পৌঁছোনোর জন্য  সময়ের  উল্টোবাগে প্রাণপণে  সাঁতার কাটছিলাম - কখনও  বীথিকার অন্ধ হয়ে যাওয়ার দিনটিতে গিয়ে ওর হাত ধরতে চাইছিলাম, কখনও এক বছর আগের কোনো দিনে ফিরে গিয়ে বুবুনের সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। কোথাও পৌঁছতে পারছিলাম না, দম  যেন ফুরিয়ে আসছিল আমার ;  দু’খানি মুহূর্তের মাঝে পেন্ডুলামের মতো দোল খেতে খেতে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিলাম শুধু।

 

তেনজিনের বাস সাতটায়।  খুব ভোরে বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছিলাম আমরা। চুপচাপ। সূর্য উঠে গিয়েছিল। আমাদের ছায়ারা হাঁটছিল সঙ্গে। রাস্তায় অটো, রিক্শা, সাইকেল, অল্প কিছু মানুষজন।  পার্ক পেরিয়ে চায়ের দোকানের কাছাকাছি এসে সামান্য হাঁফাচ্ছিলাম। বাসস্ট্যান্ডের শেড দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। "এবার ফিরে যান। নীলাম্বর একলা রয়েছে।"  দু হাত জড়ো করল তেনজিন। বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে লাগল।  ভারি ব্যাকপ্যাক , সামান্য ঝুঁকে হাঁটছে-

বীথিকা বলল, "একটু দাঁড়াবেন ?" বড় কাতর শোনাল ওর গলা। তেনজিন  ঘুরে দাঁড়াতে, রাস্তার ওপর হাঁটু মুড়ে নত হল বীথিকা।  প্রণাম করল। ঐভাবেই রইল মুখ নিচু করে। 

- মা'জী, কী করেন? আমি নগণ্য মানুষ। বেলা হয়েছে, ফিরে যান এবারে, নীলাম্বর অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য।

- ওঠো বীথিকা। বাড়ি চলো-

বীথিকা প্রণত হয়েছিল আবার। অঞ্জলিবদ্ধ  দুই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সামনে - এই রৌদ্রময় পথ যেন নদী হয়ে গিয়েছে,  আর বীথিকা একটি ভাসমান পদ্মকে তার করতলে তুলে নিতে চাইছে।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস