গল্পের কাছে
প্রত্যাশা নিয়ে গল্পের কাছে যাই নি তো। অক্ষরজ্ঞান হয়নি -প্রথম যখন গল্পের কাছে; মা রঙচঙে বই থেকে পড়ে শোনাচ্ছে, সেখানে একটা লাইন- আকাশ ভেঙে পড়েছে রে আকাশ ভেঙে পড়েছে; মা পড়ছে, আর বিশাল একটা কিছু আমাকে গিলে নিচ্ছে, মাথা, মুখ, নাক, কান আর চোখ ঢাকা পড়ছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে - এইরকম অনুভূতি হচ্ছে আমার; কিন্তু বিশাল ব্যাপারটা যে কী আর বিরাটত্ব ঠিক কতখানি - সেইটা বুঝতে পারছি না। খাবি খাচ্ছি, তারপর তারস্বরে কেঁদে উঠছি একসময়। অথচ মা কে বারবার বলছি ঐ লাইনটাই পড়তে- ডুবে যাওয়ার অনুভূতি আবার পেতে চাইছি ; মা যখন বাড়ি নেই, বই হাতে আমি ঠাকুমার কাছে যাচ্ছি,তারপর জেঠিমার কাছে, জেঠুর কাছে - বলছি, ঐ লাইনটা পড়- আকাশ ভেঙে পড়েছে রে , আকাশ ভেঙে পড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠছে।
সবে পড়তে শিখেছি, স্কুল শুরু হয় নি, জেঠু গল্পগুচ্ছ থেকে 'ছুটি' পড়ছে-এই নিয়ে বোধ হয় পঞ্চমবার- "ফটিক খালাসিদের মতো সুর করিয়া করিয়া বলিতে লাগিল, এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলে — এ — এ না। ” আমি আবার সেই খাবি খাওয়া কান্না শুরু করে দিয়েছি, কারণ , এরপর ফটিকের মা আসবে আর ফটিক বলবে, “ মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি। ”
সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বালকের জন্য হাহাকার করে আমি কাঁদছি- নিজেই অবাক হতাম- এ আমার বকুনি খেয়ে কান্না নয়, আছাড় খেয়ে কপাল কেটে কান্না নয়, ইঞ্জেকশন নেওয়ার কান্নাও নয়- কেন কাঁদছি, কার জন্য কাঁদছি কিছুই স্পষ্টই নয়। বস্তুত মরে যাওয়া ব্যাপারটাই তখন আমার কাছে অস্পষ্ট। শব্দের পরে শব্দ সাজানো একটা বাক্য আমাকে কাঁদাচ্ছে আর সেই আশ্চর্য কান্না বারবার কাঁদতে চাইছি আমি-
আবছা মনে হ'ত, এই অবোধ্য আশ্চর্য দাঁড়িয়ে থাকছে একটি কি দুটি লাইনের ওপর-বহু ক্ষেত্রেই তা কাহিনীর বা একটি পর্বের শেষ লাইন - "বড় হইয়া নীলকুন্তলা সাগরমেখলা ধরনীর সঙ্গে তাহার বড় ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটিয়াছিল। কিন্তু যখনই গতির পুলকে তাহার সারাদেহ শিহরিয়া উঠিত, সমুদ্রগামী জাহাজের ডেকে হইতে প্রতিমুহূর্তে নীল আকাশের নব-নব মায়ারূপ চোখে পড়িত, হয়তো দ্রাক্ষাকুঞ্জবেষ্টিত কোনো নীল পর্বতসানু সমুদ্রের বিলীনমান চক্রবাল-সীমায় দূর হইতে দূরে ক্ষীণ হইয়া পড়িত, অদূরে অস্পষ্ট-দেখিতে পাওয়া বনভূমি এক প্রতিভাশালী সুরস্রষ্টার প্রতিভার দানের মতো মহামধুর কুহকের সৃষ্টি করিত তাহার ভাবময় মনে--তখনই তাহার মনে পড়িত এক ঘনবর্ষার রাতে, অবিশ্রান্ত বৃষ্টির শব্দের মধ্যে, এক পুরনো কোঠায়, অন্ধকার ঘরে, রোগশয্যাগ্রস্ত এক পাড়াগাঁয়ের গরীবঘরের মেয়ের কথা--তাহার হারানো স্মৃতি। অপু, সেরে উঠলে, আমায় একদিন রেলগাড়ি দেখাবি?" অথবা "মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি", কিম্বা "দুঃসাহসিক ভবঘুরের উপযুক্ত সমাধি বটে। অরণ্যের বনস্পতিদল ছায়া দেবে সমাধির ওপর। সিংহ, গরিলা, হায়েনা সজাগ রাত্রি যাপন করবে, আর সবারই ওপরে, সবাইকে ছাপিয়ে বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্ব্বতমালা অদূরে দাঁড়িয়ে মেঘলোকে মাথা তুলে খাড়া পাহারা রাখবে চিরযুগ" বা হয়ত "মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখে নি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয় নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ ক'রো না।" ঐ সময়ে যে কোনো আখ্যানের কাছে গিয়েছি শেষ লাইনের জন্য।
প্রথম লাইন পেয়ে বসে আরো পরে -পার্ল বাকের গুড আর্থ আর দাফনে দ্য মুর এর রেবেকা পড়তে গিয়ে। ইট ওয়াজ ওয়াং লাংস ম্যারেজ ডে কিম্বা লাস্ট নাইট আই ড্রেমট আই ওয়েন্ট টু ম্যান্ডারলে এগেন - কাহিনীর প্রথম লাইন ছোটোবেলার সেই বিশাল আকাশের ভেঙে পড়ার মত অজানা সম্ভাবনার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।
গোটা স্কুলজীবন এইভাবে প্রথম লাইন কিম্বা শেষ লাইন কখনও বা শুধুই শব্দ টুকিয়ে নিয়েছি - অ্যাসফল্ট শব্দটা ননী ভৌমিকের রাশিয়ান গল্পের অনুবাদে পেয়েছিলাম, কিম্বা ম্যালাকাইট অথবা যেদিন পড়েছিলাম, সরণিতে গৃহকোণে যেন , সন্ধ্যায় জ্বলে ওঠে আলো, বায়োস্কোপের বাক্সে চোখ রাখার মত ব্যাপার ঘটেছিল- বরফ পড়া পথ, দুদিকে কাঠের বাড়িতে আলো জ্বলছে, আকাশে তারা- এই সবই দেখা হয়ে গিয়েছিল স্রেফ একটা শব্দে। সরণি, সরণি , সরণি- কী আশ্চর্য সুন্দর শব্দ- সমস্তদিন মাথার মধ্যে গুনগুন করল সরণি,তারপর রয়ে গেল।
ছোটোবেলায় আমরা বলতাম হরেকরকমবা জিবারুদে রকা রখানা। বঙ্গলিপিতে গোটা গোটা ক'রে লিখে বলতাম-বলত কী? তারপর কালিপুজোর দুপুরে আমরা বাজিগুলি রোদে দিতাম; ঠাকুমার ঘরে দু’খানি খুব ভারি আয়তক্ষেত্রাকার পিঁড়ি ছিল-আমাদের বাড়ির সব বিয়ে ঐ পিঁড়িতে; ফলতঃ সেই সব পিঁড়িতে অতীতের বিয়ের কিছু স্মৃতি লেগে আছে অবশ্যম্ভাবী - সে হয়ত গঁদের আঠায় সেঁটে থাকা রঙীন কাগজ কিম্বা প্রায় মুছে যাওয়া আলপনা-সেই পিঁড়ি রোদে এনে তার ওপর বাজি সাজাতাম-রং মশাল, ফুলঝুড়ি তুবড়ি চরকি ইলেক্ট্রিক তার সাপবাজি রকেট। দুপুরের রোদ সরে সরে যেত, আমরাও সেইমত পিঁড়ি সরাতাম-রোদ যেন লেগে থাকে বাজিতে। সেই সব হেমন্তের বিকেলে কালি পুজোর প্যান্ডেলে সন্ন্যাসী রাজার গান আর ডায়ালগ শুনতে পাচ্ছি-'যে বাড়িতেই যাওনা সখি'... পরক্ষণেই সুপ্রিয়া দেবীর ভারি গলা; এদিকে রোদ পড়ে আসছে, হাওয়ায় হিম টের পাওয়া যায়, বাজিতে তখনও রোদের গন্ধ। অন্ধকার হ'লেই বাজি পোড়ানো আর একবার শুরু হলেই মুহূর্তে শেষ তারপর আর কিছু নেই, স্রেফ আর কিছু নেই-শুধু পড়া আর পড়া-দুদিন পরে স্কুল খুলবে-অ্যানুয়াল পরীক্ষা -সব মিলিয়ে সেই সময়্টায় ভারি একটা বিষাদ জন্ম নিত।
স্কুলের শেষের দিকে ঐ বিষাদ একটা আলোর ময়ূরে বদলে গিয়েছিল-'অন্ধকার আকাশের তলায় দেখতে দেখতে একটি আলোর ময়ূর ফুটে উঠল। আলোর ফুলকিগুলো যেন ভাসছিল... ময়ূরটির আকার যতই বাড়ছিল তার প্রত্যঙ্গগুলি ততই গলে যাচ্ছিল-' অথবা জোনাকি-'চোখের পলকে, মাটির অন্ধকার এ একটি আলো দপ করে জ্বলে উঠল.. উঠল তো উঠলই, গাছের মাথা সমান উঁচু হয়ে রংমশালের তারার মতন তুবড়ির ফুলের মতন ফরফর করে পুড়তে লাগল।।দেখতে দেখতে চারপাশে যেন জোনাকির মেলা বসে গেল... মনে হচ্ছিল একদল লোক যেন অন্ধকারে জোনাকির পিচকিরি ছুঁড়ে মারছে আর পলকে অন্ধকারের বসনে জোনাকি ধরে যাচ্ছে।'
গল্প যে মনে রাখার মত লাইন আর শব্দের বাইরে আরো কিছু দিতে সক্ষম সেইটা বুঝলাম।
আসলে, এই সময় অবধি উপন্যাস, বড় গল্প, ছোটো গল্প আলাদা করি নি, শুধু লাইন কুড়িয়েছি, ঝিনুক খোঁজার মত শব্দ খুঁটে খুঁটে তুলে নিয়েছি ; তারপর কলেজ যেতে যেতে যেটা ঘটল- অজস্র ছোটো গল্প দেখতে শুরু করলাম চারপাশে-
যেমন ধরুন, তখন প্রাক মোবাইল কাল- সেইদিনই পুজোর ছুটি পড়েছে। ছাতা বাগিয়ে হাঁটছি শিয়ালদা সাউথ থেকে নর্থ সেকশনে। কাঁধের ঝোলায় হাত দিয়ে রেখেছি- গত তিনমাসে তিনদিন পার্স মান্থলি খোয়া গেছে ঐ ঝোলা থেকেই। মাথায় মাথায় ঝুড়ি ভর্তি সব্জি সাউথের থেকে নর্থের দিকে যাচ্ছে। কাঁধে কাঁধে মাছের চারা, ছানা ( দুগ্ধজাত)। পা পিছলোচ্ছে মাঝে মাঝে কফে, জলে, কাদায়, পচা পাতায় বা কলার খোসায়। হিসির গন্ধ চত্বর জুড়ে। প্রচুর রুমাল বিক্রি হচ্ছে। অ্যানাউন্সমেন্ট, হকার, ভিক্ষুক, ক্যাসেট সব জড়িয়ে জট পাকিয়ে। প্রচুর লোক হুড়হুড়িয়ে বেরিয়ে এল নর্থ সেকশনের ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিক থেকে। আর চটিটাও পটাং করে ছিঁড়ে গেল। ঠিক এই সময় হঠাৎ একরাশ বুদবুদ মাথায় মুখে এসে পড়তে লাগল। মুখ তুলে তাকাতেই ফ্লাইওভারের ব্যাকড্রপে ঢাকের ঝালর - ঢাকীরা ঘুরে ঘুরে ঢাক বাজাচ্ছে। সব আওয়াজ ছাপিয়ে শুধুই ঢাকের বোল। আর দুপাশ থেকে রাশি রাশি সাবান বুদ্বুদ উড়ে আসছে। সবই অবশ্য ফেটে যেতে লাগল এদিক ওদিক। একটাই শুধু বাউন্স খেয়ে এদিকে এল তারপর গুঁড়ি মেরে পায়ের কাছে পোষাটার মত দাঁড়াল। ছেঁড়া চটি পায়ে, ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে 'অমল মহিমা' শব্দটা মনে পড়ল আমার -এই 'অমল' হসন্ত দিয়ে বলতে নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে ঐ বুদবুদটা ঝোলায় পুরে নিলাম।
ছোটো গল্প পেড়ে ফেলল আমাকে।
সেই সময় অলরেডি পড়ে ফেলেছি, , "মেজদা সামান্য নড়ল। আকাশের দিকে তার মুখটি তোলা, অমল জ্যোৎস্না তার সমস্ত মুখ লেপে রেখেছে, তার দুই অন্ধ নয়ন নিবিড় করে সেই আলো মাখছিল। মেজদা তার সাদামাটা মেঠো সুরেলা গলায় বলল, .. মা যে কত অন্ধ আমি জানতাম। এই অন্ধ চোখ মাকে আর দিতে ইচ্ছে করে না। মা আমার হৃদয়ের চক্ষু পাক"; অথবা, "অমৃত দেখল, এখানে ভগবানের কোনও শেষ নেই। যতই এগোয় ততই বেড়ে যায়"।
বুঝতে পারছিলাম, এই সব গল্প পড়ার আগের মানুষ আর পরের মানুষ আলাদা- যেন পি সি সরকারের ম্যাজিক - বাক্সে ঢুকল একটা মেয়ে- হয় হারিয়ে গেল নয়ত বেরিয়ে এলো বাঘ হয়ে। গল্প সেই সময় থেকে আমার কাছে সার্কাসের আশ্চর্য তাঁবু। ঘুরে ঘুরে আবিষ্কার করতে থাকি সাইকেল মেসেঞ্জার, আবরণ, বিশ্বনাথের জাহাজ, সবুজ হিশেব, রৌদ্রশূন্যতা, হিরণ্যগর্ভ, বরফপড়া দিনগুলোয়, বর্ষামঙ্গল, ভূতজ্যোৎস্না, শঙ্খপুরীর রাজকন্যা, জন্ম, তোমার তুলনা তুমি, প্রাণ....
কখনও মনে হত যেন অন্ধকারে , নীল আলো জ্বালিয়ে ট্রাপিজের মারাত্মক খেলা শুরু হয়েছে - এই দোলনা থেকে অন্য দোলনায় ঝাঁপ দিচ্ছে কেউ- আধো আলোয় অন্য দোলনা বা নিচের সেফটি নেট অদৃশ্য মনে হচ্ছে দর্শকের, সে শিউরে উঠে চোখে হাত চাপা দিচ্ছে অথবা জাদুকর টুপি থেকে খরগোশ, রুমাল থেকে ফুল বের করে আনছে আর হাততালির ঝড় বইছে অ্যারেনায়। আমি যেন ফার্স্ট রোয়ে বসে জাদুকরকে দেখছি, ম্যানড্রেক টুপি, কালো রোবে লাল সোনালী তারার ডিজাইন- আমার হাতে জাদুকাঠি ছুঁইয়ে দিল; কখনও সার্কাসের বাজনা উদ্দাম হয়ে কানে আসে, বাঘ সিংহের গর্জন শুনতে পাই ; কখনও লাল নীল আলো জ্বলে তাঁবু জুড়ে আর আমার জাদুকাঠি ছোঁয়া হাতের তেলোর ওপর একটি স্বচ্ছ নীল ডিম দেখি- আমার শৈশব, কৈশোর, প্রথম যৌবন গুটিয়ে এইটুকুনি হয়ে হলুদ কুসুমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে।
গল্প একদম জ্যান্ত হয়ে এল অনেক পরে। ঝোলার মধ্যে টুকিয়ে আনা বুদবুদের নড়াচড়া টের পেলাম একদিন। খাঁচার দরজা খুলেই গিয়েছিল। আচমকাই হালুম করে গর্দান বরাবর ঝাঁপ দিয়েছিল গল্প। টুঁটি চেপে ধরেছিল। একদিন হাত ধরল। নতজানু আমিও কথা দিয়েছি, তোমায় যতনে রাখিব হে-
এইভাবে চলছে। ভালবেসে।
যে বীণা শুনেছি কানে, মনপ্রাণ আছে ভোর। আর কিছু চাহি না-
[গল্পপাঠ , ২০২১]
Comments
Post a Comment