Posts

Showing posts from 2019

অরফ্যানগঞ্জ

পা য়ের নিচে মাটি তোলপাড় হচ্ছিল প্রফুল্লর— ভূমিকম্পর মত। পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেন কেউ আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে— সেই প্রচণ্ড কাঁপুনিতে ফাটল ধরছে পথঘাট, দোকানবাজার, বহুতলে। পাতাল থেকে গোঙানির আওয়াজ আসছিল। ঝোড়ো বাতাস বইছিল রেলব্রিজের দিক থেকে। প্রফুল্ল দোকান থেকে বেরিয়ে নেতাজি মূর্তির দিকে দৌড়ল। চশমা চোখে টুপি মাথায় ফ্যাটফ্যাটে সাদা নেতাজি সেই কবে থেকে চৌমাথার মোড়ে— হাত, পা, ঘোড়াবিহীন। ছোটবেলায় প্রফুল্ল আর হেমন্ত বাবার হাত ধরে মূর্তির সামনে পতাকা তোলা দেখত; উঠো গো ভারতলক্ষ্মী গান হত। পুনঃ কনক-কমল-ধন-ধান্যে গাইতে গাইতে প্রফুল্ল ভাবত, ওদের পাড়ার মাটির তলায় ঘড়া ঘড়া মোহর রয়েছে আর নেতাজির মূর্তি আসলে জাস্ট একটা ছিপি— প্যাঁচ খুলে সরিয়ে নিলেই লাখে লাখে মোহর বেরিয়ে আসবে ফোয়ারার মত। তারপর মোহরের বন্যা— মোহরে মোহরে ডুবে যাবে এ পাড়ার পথঘাট, খানাখন্দ, ঘরদোর, শ্যাওলাধরা উঠোন— একটা মানুষ দাঁড়ানোর জায়গাও থাকবে না। নায়কের সেই সিনটার মত যেন— টাকায় টাকায় ডুবে যাচ্ছে উত্তমকুমার। এই সব বড় ভয়ের কথা— ভাবতে গেলে বুক কাঁপে প্রফুল্লর সেই ছোটবেলা থেকে। তারপর চারপাশের বাতাস কমে গিয়ে দম বন্ধ লাগে। বিনবিন করে ঘাম হয়। তখন শা

প্রাণগোপাল

রাস্তার আলো সামান্য ত্যারছা হয়ে লিপির শরীরে পড়েছে; ওর লম্বা ছায়া সরু গলির ওদিকের ফুটপাথ পর্যন্ত নিতান্ত অদরকারি ভাঙাচোরা এক সাঁকো তৈরি করেছে তার ফলে। এখন গভীর রাতে বড়রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ প্রায় নেই। একটা দুটো হেডলাইট লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে ওদের পাড়ার দিকে আসছে; সে আলোয়, ছায়ার সাঁকো ভেঙে গিয়ে নদী হয়ে যাচ্ছে, তারপর আবার জুড়ছে, ভাঙছে, আবার জুড়ে যাচ্ছে। মাঘের হাওয়া লিপির মুখের বাঁদিক কেটে নিলেও ছায়া নির্বিকার । ফলে লিপির নিজেকে আরো একা লাগছে। লিপি দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে, যে বাড়িতে গোপাল, অনিমেষ আর সে ছিল গতপরশু অবধি। এই মুহূর্তে বাড়িতে কেবল লিপি আর গোপালের খাঁচা, অনিমেষ ট্যুরে, আজ ফিরবে। অনিমেষ এখনও শূন্য খাঁচার কথা জানে না। ট্রেনের হুইশল কানে এল লিপির। চাদর দিয়ে আরও ঘন করে কান, মুখ ঢাকল , তারপর নিজেকে নিজেই আঁকড়ে ধরল দু’ হাতে দুই কনুই ছুঁয়ে। ফুলশয্যায় অনিমেষ নিজেকে ইন্ট্রোভার্ট বলেছিল প্রথমে। নিজেকে রাগী বলেছিল; ওর তেমন কোনো বন্ধু নেই, বলেছিল সে কথাও। তারপর লিপিকে গোপালের কথা বিশদে বলে। বস্তুত, লিপির বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ার দুমাসের মধ্যে, তাড়াহুড়োয় সম্বন্ধ করে বিয়ে; অনিমেষের মামার বাড়িতে

সদর স্ট্রিট জার্নাল

-' বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয় নি তো? -‘না না, ঠিকানা তো’ ছিলই; বাজারের কাছে এসে , শুধু একটু জিগ্যেস করতে হয়েছে –‘ -‘পোস্টাল অ্যাড্রেস যাই থাকুক, এ' রাস্তার নাম কিন্তু সদর স্ট্রীট। হা হা। অবাক হচ্ছেন? এই তো' লেখকের কাজ - স্থান কাল পাত্র নিয়ে খেলা করে করে পাঠককে ধন্দে ফেলে দেওয়া। ছোটোবেলা থেকেই কাজটিতে আমি পটু। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার স্বভাব বরাবরের; তার ওপর মানুষ, পশু, পাখি এমনকি জায়গার নাম বদলে দেওয়ার একটা ফেজও চলেছিল বহুদিন - আমিই এ' গলির নাম দিয়েছিলাম সদর স্ট্রীট।' -এই অবধি ব'লে কমলিকা সামন্ত কফিতে চুমুক দিলেন। রণজয় আর সুস্মিতা মুখ চাওয়াচায়ি করল। সুস্মিতারা মিনিট কুড়ি আগে এ' ঘরে ঢুকেছে। মফস্সলের পুরোনো বাড়ির বসবার ঘর - লাল মেঝে, বেতের সোফা, দেওয়াল জোড়া তাকে শুধু বই আর বই; বাঁধিয়ে রাখা গণেশজননীর এক কোণে কালচে ছোপ , প্রাচীন ঘড়ির সঙ্গে সুস্মিতার মোবাইলের সময় মিলছিল না। রণজয় ক্যামেরা বাগিয়ে এদিক ওদিক দেখছিল - বিকেলের রোদ, কমলিকা আর ঘরভরা বই এক ফ্রেমে ধরার ইচ্ছে। জানলা দিয়ে এলোমেলো ঘাস আর কিছু গোলাপ দেখা যাচ্ছিল- একটা কালো ছোপ ছোপ বিড়াল রোদে পিঠ দিয়ে গোলাপের দিকে

সূর্যমুখীর এরোপ্লেন

সূর্যমুখীকে অনেকদিন পরে এয়ারহস্টেসের মতো দেখাচ্ছে আবার। লম্বা গর্বিত গ্রীবা, কনুই অবধি ব্লাউজের হাতা, চোয়ালের কাছে মৃদু টেনশন— যেন একটু পরেই টেক্‌ অফ্‌, আর এই স্বল্প সময়ে ওভারহেড লকার বন্ধ করা, সেফটি ব্রিফিং এইসব কত কী হাসিমুখে সেরে ফেলতে হবে। সূর্যমুখীর পায়ের কাছে হ্যান্ডব্যাগ, হাতে একটা নীলচে রুমাল— আলতো ক’রে কপাল মুছে নিতে দেখলাম একটু আগে। আসলে, কলকাতার হাসপাতালে অঙ্কোলজিস্টের চেম্বারে বসে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার পাশেই সূর্যমুখী, আমার শাশুড়ি। সামনে ডাক্তার কথা বলছেন অনর্গল— মাঝে মাঝে লিখছেন, হিজিবিজি কাটছেন নোটপ্যাডে। সম্ভবত একই কথা নানাভাবে বলে চলেছেন— প্যালিয়েটিভ, মির‌্যাকল, আর ভগবান কানে এল শুধু। আমার মন অন্যখানে— পুরনো সব কথা ভাবছিলাম। সূর্যমুখীও আদৌ শুনছিলেন না; চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, অন্য কিছু ভাবছেন, একদম অন্য কোনও কথা কারণ সূর্যমুখীর চোখে এখন বিয়েবাড়ির রোশনাই– সূর্যমুখীর শ্বশুরবাড়ি কলকাতা থেকে দূরে, মফস্‌সলে। পঁচিশ বছর আগে সে’ বাড়িরই দোরগোড়ায় জীয়ল মাছ হাতে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি— আমার মাথায় শোলার মুকুট, সিঁথি জুড়ে লাল, আর দুধে আলতায় ভরা কষ্টিপাথরের থাল