প্রাণগোপাল
রাস্তার আলো সামান্য ত্যারছা হয়ে লিপির শরীরে পড়েছে; ওর লম্বা ছায়া সরু গলির ওদিকের ফুটপাথ পর্যন্ত নিতান্ত অদরকারি ভাঙাচোরা এক সাঁকো তৈরি করেছে তার ফলে। এখন গভীর রাতে বড়রাস্তায় গাড়ির আওয়াজ প্রায় নেই। একটা দুটো হেডলাইট লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে ওদের পাড়ার দিকে আসছে; সে আলোয়, ছায়ার সাঁকো ভেঙে গিয়ে নদী হয়ে যাচ্ছে, তারপর আবার জুড়ছে, ভাঙছে, আবার জুড়ে যাচ্ছে। মাঘের হাওয়া লিপির মুখের বাঁদিক কেটে নিলেও ছায়া নির্বিকার । ফলে লিপির নিজেকে আরো একা লাগছে। লিপি দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে, যে বাড়িতে গোপাল, অনিমেষ আর সে ছিল গতপরশু অবধি। এই মুহূর্তে বাড়িতে কেবল লিপি আর গোপালের খাঁচা, অনিমেষ ট্যুরে, আজ ফিরবে। অনিমেষ এখনও শূন্য খাঁচার কথা জানে না। ট্রেনের হুইশল কানে এল লিপির। চাদর দিয়ে আরও ঘন করে কান, মুখ ঢাকল , তারপর নিজেকে নিজেই আঁকড়ে ধরল দু’ হাতে দুই কনুই ছুঁয়ে।
ফুলশয্যায় অনিমেষ নিজেকে ইন্ট্রোভার্ট বলেছিল প্রথমে। নিজেকে রাগী বলেছিল; ওর তেমন কোনো বন্ধু নেই, বলেছিল সে কথাও। তারপর লিপিকে গোপালের কথা বিশদে বলে। বস্তুত, লিপির বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ার দুমাসের মধ্যে, তাড়াহুড়োয় সম্বন্ধ করে বিয়ে; অনিমেষের মামার বাড়িতে বৌভাত, ফুলশয্যা। নিমন্ত্রিত আত্মীয়স্বজন চলে গেলে , ফুল সাজানো খাটে বসে অনিমেষ বলেছিল- 'গোপালের কথা তোমার জানা দরকার। গোপাল আমার প্রাণ। আর আমার কেউ নেই।'
ফুলশয্যায় কেঁদে ফেলেছিল অনিমেষ ।
-' ছোটোবেলায় মা বাবাকে মরে যেতে দেখেছি; মরতে আমার বড় ভয় লিপি। '
রজনীগন্ধা এবং গোলাপের গন্ধ ছিল ঘর জুড়ে। লিপি অনিমেষকে দেখছিল; ছোটোখাটো নিরীহ মানুষ, মাথার সামনে টাকের আভাস; আঙুলে গ্রহরত্নের আংটি-দু চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। এক অস্পষ্ট আকারবিহীন মায়া ক্রমে ঘন হয়ে উঠেছিল তারপর আচমকা ঘাই দিয়েছিল লিপির বুকে। এই প্রথম , সে তার নতুন বরের হাত ধরেছিল; গত দু'মাসে শোনা আপ্তবাক্যগুলি আউড়ে গিয়েছিল একে একে। প্রথমে বলেছিল-'জন্মিলে মরিতে হবে'। তারপর আবার গলা খাঁকরে বলেছিল-'সেই গল্প জানো তো? এক মুঠো সর্ষে দানার গল্প?' তারপর থেমে গিয়ে আর কী বলবে ভাবতে বসেছিল।
অনিমেষ কথা বলছিল অনর্গল-' ছোটোবেলা থেকে এই রকম ভয় আমার। তুমি হাসবে শুনলে। একবার তো বুদ্ধদেবের মত তপস্যা করব ভেবে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম । ছোটোমামা অনেক খুঁজে ফিরিয়ে আনে। মামাবাড়িতে ছিল গোপাল। বিশাল কুকুর। সে মারা গেলে আর এক গোপাল এনেছিল মামা মামী। এক রং, এক চেহারা। আমার গোপাল ওদেরই ছেলের ছেলে।'
লিপির সামান্য গুলিয়ে যাচ্ছিল, বলেছিল- 'সবার নাম গোপাল?'
-'বড়মামা বলত, 'গোপাল অমর। এক গোপাল গেলে অন্য গোপাল আসবে....এই কথাটায় বড্ড ভরসা হয়েছিল আমার। জানো লিপি? রূপকথায় সেই প্রাণভোমরার গল্প আছে না? ভাবতাম, আমার প্রাণ যেন গোপালের মধ্যে। এক গোপাল গেলে অন্য গোপাল-আমিও মরব না কোনোদিন-এই ভাবে-'
-'তুমি কী গো! এখনও এরকম ভাবো ?'
অনিমেষ কেঁপে উঠেছিল।
-'বড় ভয় করে। রাত হলেই মৃত্যুভয়- সে যে কী আতঙ্ক। অন্ধকার হলেই ....', আবার ফোঁপাচ্ছিল অনিমেষ।
-'এবার থেকে আর হবে না, দেখো।'
লিপি বাতি নিভিয়ে দিয়েছিল।
পরদিন অনিমেষের প্রাচীন বাড়িতে গোপালকে প্রথম দেখে লিপি। সকালে অনিমেষ অন্যরকম। বাড়ির দরজার চাবি ঘোরালে খুলছিল না, নানা কসরতের প্রয়োজন হচ্ছিল। সে’ কসরতে রেগে উঠতে দেখেছিল অনিমেষকে। বাইরে দাঁড়িয়ে অনিমেষ চাবি ঘোরাচ্ছে, দরজা খুলছে না, আর অনিমেষ রেগে উঠছে-গালাগালির স্রোত বইছে মুখে আর সেই সময় বাড়ির ভিতর থেকে গোপালের গর্জন শুনেছিল লিপি। দরজা খুলে যেতেই দৌড়ে ঘরে ঢুকেছিল অনিমেষ- সদর পেরিয়ে দু ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা ঘর-টিভি, প্লাস্টিকের ডাইনিং টেবল, চেয়ার, একটা ডিভান আর এক বিশাল খাঁচায় পেল্লায় জার্মান শেফার্ড। অনিমেষ খাঁচার দরজা খুলে দিয়েছিল-বিশাল সারমেয় দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরেছিল-মুখ চাটছিল -অনিমেষ হাত বাড়িয়ে বলেছিল-'মীট মাই ব্রাদার-গোপাল।' তারপর গোপালের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল-'আমার বৌ। তোর বৌদি। প্রণাম কর।' গোপাল মাথা ঘষেছিল লিপির পায়ে-পেট উল্টে শুয়ে পড়েছিল লিপির সামনে।
অনিমেষ বলেছিল-'আদর করো।' তারপর হেসে বলেছিল-'গোপালের কথা বলছি।'
লিপি অবাক হয়ে বলেছিল, 'এই ক’দিন ওকে কে দেখল? খেতে দিল কে?'
-‘পিন্টু ছিল ।পাশের বাড়ির। বৌভাতে এসেছিল, মনে নেই? কেউ বাড়িতে না থাকলে , গোপাল খাঁচায় থাকে। অফিসের দিনে, দুপুরের দিকে পিন্টু এসে খাইয়ে যায়, বাইরে ঘুরিয়ে আনে।তোমার তো মর্নিং স্কুল। খুব বেশিক্ষণ ওকে থাকতে হবে না খাঁচায়। এই জন্যই তোমাকে...'
এই অবধি বলে অনিমেষ চুপ করে গিয়েছিল। লিপির দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। বলেছিল, 'শুনতে খারাপ লাগলো, না?'
লিপি মাথা নেড়ে হেসেছিল-' আমিও দেখে নিয়েছিলাম তোমার বাড়ি টাই আমার স্কুলের সব চে' কাছে। '
অনিমেষ এবারে তাকে দীর্ঘ চুমু খেয়েছিল। আঁকড়ে ধরেছিল ।
গোপাল খাঁচার ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। দু’ থাবায় মুখ গুঁজে চোখ বুজেছিল।
লিপির স্কুল খুব ভোরে। সে বাড়ি ফেরার অনেক আগেই অনিমেষ অফিস চলে যায়। লিপি ফিরে খাঁচা খুলে দেয়। তারপর, অনিমেষের ফেরা অবধি এ’বাড়িতে শুধু গোপাল আর লিপি। লিপি রান্না বসায়, উঠানে কাপড় মেলে দড়িতে, আর গোপাল ওর বিশাল শরীর নিয়ে লিপির পায়ে পায়ে ঘরময় ঘুরঘুর করে, কখনও থাবার মধ্যে মুখ রেখে চোখ পিটপিট । গোপালকে খেতে দেয় লিপি, হাঁটতে বেরোয়, কখনও উঠোনের কলে স্নান করালো; হয়তো সোফায় বসে কাগজ পড়ছে লিপি, পায়ের কাছে দুপুরের রোদ- গোপাল ওর কোলে ধপ করে শুলো- হাল্কা রোঁয়া সারাঘরে উড়ে বেড়ালো খানিক, থিতিয়ে গেল মেঝেয়-
লিপি অনিমেষের মিলনকালে , গোপাল খাঁচায় থাকত।অনিমেষ গোপালের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যেত-'একটু খাঁচায় থাক। এক্ষুণি আসব। এক্ষুণি।' অতঃপর মিলনপর্ব দ্রুত হ'ত। পাশের ঘরে, খাঁচার ধাতব মেঝেতে গোপালের পাশ ফেরার শব্দ পেত লিপি। অনিমেষ দ্রুততর হত। তারপর দৌড়ে খাঁচার সামনে এসে দরজা খুলে দিত। বিশালদেহী গোপাল অনিমেষের সঙ্গে ওদের ঘরে এসে ঘুমোতো। গোপালের বড় বড় নিঃশ্বাস, পাশবালিশে হাত রেখে অনিমেষ হাল্কা নাক ডাকছে, মাথার ওপর পুরোনো সিলিং ফ্যান ঘুরে চলেছে অবিরাম; রাস্তার আলো অথবা জ্যোৎস্না জানলা দিয়ে ঢুকছে; ঘরময় গোপালের গন্ধ, সিগ্রেটের ঘ্রাণ, পাউডারের বাস - গোপাল, লিপি আর অনিমেষ একেই সুখ বলে চিনেছিল।
আজ প্রায় মাঝরাতে স্ট্রীটলাইটের তলায় দাঁড়িয়ে লিপি অনিমেষকে কী বলবে ভাবছিল। গত দুই রাত সে নিজেকেই দোষী বলে ভেবেছে, প্রতিটি মিনিট প্রতিটি সেকন্ড অপরিমেয় গ্লানি তার শোককে ছাপিয়ে গিয়েছে। গত পরশুও এমনই শীত পড়েছিল। রাতে গোপালকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিল লিপি। রোজকার রাতের হাঁটা- গলি পেরিয়ে বড় রাস্তার ফুটপাথ ধরে এক চক্কর দিয়ে বাড়ি। গোপাল বরাবরই হাঁটায় উৎসাহী, লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল-তাল রাখতে লিপির সামান্য হাঁফ ধরছিল সেদিন। বড় রাস্তায় ট্রাক, রুটের বাস, অটো- গোপালের গলার বকলস আর শিকলির জোড় আলগা হয়ে গিয়েছিল সম্ভবতঃ বহুদিন। সেদিনই ছিঁড়ে গেল। ভারি ট্রাক এসে পড়ল তখনই। লিপির হাতে ধরা শিকলিতে তখনো গোপালের বকলশ ঝুলছে। এক মুহূর্তে নেই হয়ে গিয়েছিল গোপাল।
অনিমেষ সচরাচর রেলস্টেশনে নেমে হেঁটে আসে। গোপাল বহুদূর থেকে ওর গন্ধ পেয়ে ডেকে উঠত। সেই ডাক শুনে ভৌ ভৌ করে দৌড়োদৌড়ি করত গলির কুকুর, তারপর বড় রাস্তার কুকুররা ডেকে উঠত -মেক্সিকান ওয়েভের মত কুকুরের ডাক পৌঁছত অনিমেষের কানে। গলি টুকু প্রায় দৌড়ে ঢুকত বাড়িতে। গোপাল দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে মুখ চাটত অনিমেষের। লিপি ততক্ষণে ভাত বসিয়েছে।
আজ পাড়া নিশ্চূপ, গলি শুনশান -শুধু আলোর তলায় লিপি একলা দাঁড়িয়ে । লিপির দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ওর কান মুখ ঢাকা শাল, ওর দীর্ঘ ছায়া, মাথার ওপর ঝাঁক বেঁধে আসা মশা অনিমেষকে যেন সমস্ত বলে দিল এক মুহূর্তে। এমনকি অনিমেষ যেন লিপির হাতের হাতের ছেঁড়া শিকলিও দেখতে পেল যাতে গোপালের বকলশ ঝুলে রয়েছে। হাতের ব্যাগ নামিয়ে রেখে অনিমেষ বলল-
-'কখন? কষ্ট পেয়েছিল?'
-'ঘরে চলো'। লিপি বলেছিল শুধু।
বাড়িতে ঢুকে থমকে দাঁড়ালো অনিমেষ, ডুকরে উঠলো খালি খাঁচার সামনে। একটু ঝুঁকে জুতোর ফিতে খুলল তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল খাঁচায়। গোপালের মতই লাগছিল অনিমেষকে-জামা প্যান্ট বেল্ট আর মোজা পরা গোপাল যেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে আর হামাগুড়ি দিচ্ছে। খাঁচার মেঝেতে, লোহার জাফরিতে হাত বোলাচ্ছিল অনিমেষ ।
-'গোপাল এখান থেকে আমাদের দেখত। কত বড় লাগছে ঘরটা, দ্যাখো লিপি-কত বড়। আমরা শুধু দুজন এই অ্যাতো বড় ঘরে। অ্যাঁ! আমরা দুজন শুধু-'
লিপি খাঁচার পাশে বসল, গরাদের ফাঁক দিয়ে অনিমেষের আঙুল ধরার চেষ্টা করল প্রথমে তারপর নিজেও ঢুকে গেল খাঁচায়। অনিমেষের পাশে বসে লিপি দেখছিল- কত কত উঁচুতে উঠে গেছে এতকালের ছাদ, ফ্যানের ব্লেডে যেন জন্মের ঝুল কালি, দেওয়ালে অনিমেষের মা বাবা, ক্যালেন্ডারের পিছন থেকে ঐ সরে গেল টিকটিকি, দরজার মাথায় মাকড়শার জাল, ঘড়ির কাঁটা টক টক টক আওয়াজ করে ঘুরেই চলেছে, ঘুরেই চলেছে - সুখের প্রলেপ মুছে গিয়ে ওদের প্রতিদিনের ঘরদুয়ার মলিন আর জীর্ণ দেখাচ্ছে। খাঁচা থেকে বেরোনোর কথা ভাবল না দুজনের কেউ । ধাতুর শক্ত মেঝেতে গোপালের পুরোনো তোয়ালে পাতা-শোকে অশ্রুতে মাখামাখি হয়ে পাশাপাশি শুয়ে রইল দুজনে। গুটিয়ে এইটুকুনি হয়ে। লিপি ওর গায়ের চাদর বিছিয়ে নিল দুজনের ওপর।
শেষ রাতে অনিমেষ চাদর সরিয়ে দিল, সার্ট খুলল তারপর গেঞ্জি খুলে ছুঁড়ে ফেলল, খাঁচার মেঝে ছেঁচড়ে তা গুটিয়ে গেল এক কোণে-যেন ছোট্টো গোপাল-সাদা, শুধু কোমর আর নাকের কাছে ছোপ ছোপ-অনিমেষের ঘামের দাগ। অনিমেষ উঠে এল লিপির ওপর।
-'এভাবে বাঁচতে পারব না, লিপি। কেউ তো নেই-দ্যাখো কেউ ডাকছে না, কোথাও কোনো শব্দ নেই-উফ কী অন্ধকার-
-'আমি তো আছি। গোপাল আসবে। আবার আসবে। আমাদের গোপাল -তোমার আমার গোপাল। কী? আসবে না?'
-'কেউ থাকবে না। আমি না, তুমি না, যে আসবে, সেও না-কী হবে? কী হবে লিপি? আমার যে ভয় করে। সব ছেড়ে চলে যাই চলো। যাবে? বোধিবৃক্ষ কোথায় জানো লিপি? জানো তুমি?'
লিপিকে আঁকড়ে চীৎকার করছিল অনিমেষ।
পাখি ডাকছিল। খাঁচার বাঁদিকের দরজা দিয়ে ভোরের রোদ ঢুকেছে। লিপির ঘুমন্ত মুখ , গ্রীবা, স্তন সোনালী আভায় অপার্থিব। গলিতে সাইকেলের বেল , রিক্সার হর্ন, কুকুর ডেকে উঠল; বড় রাস্তা থেকে গাড়ির আওয়াজ আসছিল। এফ এমে আমি যামিনী তুমি শশী হে বাজছিল। পিন্টুদের রান্নাঘর থেকে ডালে ফোড়ন দেওয়ার ঝাঁঝালো ঘ্রাণ এলো জানলা দিয়ে।
খাঁচার অন্য দিক তখনও রোদহীন , সেখানে গোপালের ঝরা রোম, গোপালের লালার দাগ, কুঁকড়োনো গেঞ্জি, এবং প্রবল শৈত্য। খাঁচার গরাদে বরফ জমেছে যেন।
অনিমেষ দোটানায় ছিল।
ফুলশয্যায় অনিমেষ নিজেকে ইন্ট্রোভার্ট বলেছিল প্রথমে। নিজেকে রাগী বলেছিল; ওর তেমন কোনো বন্ধু নেই, বলেছিল সে কথাও। তারপর লিপিকে গোপালের কথা বিশদে বলে। বস্তুত, লিপির বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ার দুমাসের মধ্যে, তাড়াহুড়োয় সম্বন্ধ করে বিয়ে; অনিমেষের মামার বাড়িতে বৌভাত, ফুলশয্যা। নিমন্ত্রিত আত্মীয়স্বজন চলে গেলে , ফুল সাজানো খাটে বসে অনিমেষ বলেছিল- 'গোপালের কথা তোমার জানা দরকার। গোপাল আমার প্রাণ। আর আমার কেউ নেই।'
ফুলশয্যায় কেঁদে ফেলেছিল অনিমেষ ।
-' ছোটোবেলায় মা বাবাকে মরে যেতে দেখেছি; মরতে আমার বড় ভয় লিপি। '
রজনীগন্ধা এবং গোলাপের গন্ধ ছিল ঘর জুড়ে। লিপি অনিমেষকে দেখছিল; ছোটোখাটো নিরীহ মানুষ, মাথার সামনে টাকের আভাস; আঙুলে গ্রহরত্নের আংটি-দু চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। এক অস্পষ্ট আকারবিহীন মায়া ক্রমে ঘন হয়ে উঠেছিল তারপর আচমকা ঘাই দিয়েছিল লিপির বুকে। এই প্রথম , সে তার নতুন বরের হাত ধরেছিল; গত দু'মাসে শোনা আপ্তবাক্যগুলি আউড়ে গিয়েছিল একে একে। প্রথমে বলেছিল-'জন্মিলে মরিতে হবে'। তারপর আবার গলা খাঁকরে বলেছিল-'সেই গল্প জানো তো? এক মুঠো সর্ষে দানার গল্প?' তারপর থেমে গিয়ে আর কী বলবে ভাবতে বসেছিল।
অনিমেষ কথা বলছিল অনর্গল-' ছোটোবেলা থেকে এই রকম ভয় আমার। তুমি হাসবে শুনলে। একবার তো বুদ্ধদেবের মত তপস্যা করব ভেবে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম । ছোটোমামা অনেক খুঁজে ফিরিয়ে আনে। মামাবাড়িতে ছিল গোপাল। বিশাল কুকুর। সে মারা গেলে আর এক গোপাল এনেছিল মামা মামী। এক রং, এক চেহারা। আমার গোপাল ওদেরই ছেলের ছেলে।'
লিপির সামান্য গুলিয়ে যাচ্ছিল, বলেছিল- 'সবার নাম গোপাল?'
-'বড়মামা বলত, 'গোপাল অমর। এক গোপাল গেলে অন্য গোপাল আসবে....এই কথাটায় বড্ড ভরসা হয়েছিল আমার। জানো লিপি? রূপকথায় সেই প্রাণভোমরার গল্প আছে না? ভাবতাম, আমার প্রাণ যেন গোপালের মধ্যে। এক গোপাল গেলে অন্য গোপাল-আমিও মরব না কোনোদিন-এই ভাবে-'
-'তুমি কী গো! এখনও এরকম ভাবো ?'
অনিমেষ কেঁপে উঠেছিল।
-'বড় ভয় করে। রাত হলেই মৃত্যুভয়- সে যে কী আতঙ্ক। অন্ধকার হলেই ....', আবার ফোঁপাচ্ছিল অনিমেষ।
-'এবার থেকে আর হবে না, দেখো।'
লিপি বাতি নিভিয়ে দিয়েছিল।
পরদিন অনিমেষের প্রাচীন বাড়িতে গোপালকে প্রথম দেখে লিপি। সকালে অনিমেষ অন্যরকম। বাড়ির দরজার চাবি ঘোরালে খুলছিল না, নানা কসরতের প্রয়োজন হচ্ছিল। সে’ কসরতে রেগে উঠতে দেখেছিল অনিমেষকে। বাইরে দাঁড়িয়ে অনিমেষ চাবি ঘোরাচ্ছে, দরজা খুলছে না, আর অনিমেষ রেগে উঠছে-গালাগালির স্রোত বইছে মুখে আর সেই সময় বাড়ির ভিতর থেকে গোপালের গর্জন শুনেছিল লিপি। দরজা খুলে যেতেই দৌড়ে ঘরে ঢুকেছিল অনিমেষ- সদর পেরিয়ে দু ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা ঘর-টিভি, প্লাস্টিকের ডাইনিং টেবল, চেয়ার, একটা ডিভান আর এক বিশাল খাঁচায় পেল্লায় জার্মান শেফার্ড। অনিমেষ খাঁচার দরজা খুলে দিয়েছিল-বিশাল সারমেয় দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরেছিল-মুখ চাটছিল -অনিমেষ হাত বাড়িয়ে বলেছিল-'মীট মাই ব্রাদার-গোপাল।' তারপর গোপালের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল-'আমার বৌ। তোর বৌদি। প্রণাম কর।' গোপাল মাথা ঘষেছিল লিপির পায়ে-পেট উল্টে শুয়ে পড়েছিল লিপির সামনে।
অনিমেষ বলেছিল-'আদর করো।' তারপর হেসে বলেছিল-'গোপালের কথা বলছি।'
লিপি অবাক হয়ে বলেছিল, 'এই ক’দিন ওকে কে দেখল? খেতে দিল কে?'
-‘পিন্টু ছিল ।পাশের বাড়ির। বৌভাতে এসেছিল, মনে নেই? কেউ বাড়িতে না থাকলে , গোপাল খাঁচায় থাকে। অফিসের দিনে, দুপুরের দিকে পিন্টু এসে খাইয়ে যায়, বাইরে ঘুরিয়ে আনে।তোমার তো মর্নিং স্কুল। খুব বেশিক্ষণ ওকে থাকতে হবে না খাঁচায়। এই জন্যই তোমাকে...'
এই অবধি বলে অনিমেষ চুপ করে গিয়েছিল। লিপির দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। বলেছিল, 'শুনতে খারাপ লাগলো, না?'
লিপি মাথা নেড়ে হেসেছিল-' আমিও দেখে নিয়েছিলাম তোমার বাড়ি টাই আমার স্কুলের সব চে' কাছে। '
অনিমেষ এবারে তাকে দীর্ঘ চুমু খেয়েছিল। আঁকড়ে ধরেছিল ।
গোপাল খাঁচার ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। দু’ থাবায় মুখ গুঁজে চোখ বুজেছিল।
লিপির স্কুল খুব ভোরে। সে বাড়ি ফেরার অনেক আগেই অনিমেষ অফিস চলে যায়। লিপি ফিরে খাঁচা খুলে দেয়। তারপর, অনিমেষের ফেরা অবধি এ’বাড়িতে শুধু গোপাল আর লিপি। লিপি রান্না বসায়, উঠানে কাপড় মেলে দড়িতে, আর গোপাল ওর বিশাল শরীর নিয়ে লিপির পায়ে পায়ে ঘরময় ঘুরঘুর করে, কখনও থাবার মধ্যে মুখ রেখে চোখ পিটপিট । গোপালকে খেতে দেয় লিপি, হাঁটতে বেরোয়, কখনও উঠোনের কলে স্নান করালো; হয়তো সোফায় বসে কাগজ পড়ছে লিপি, পায়ের কাছে দুপুরের রোদ- গোপাল ওর কোলে ধপ করে শুলো- হাল্কা রোঁয়া সারাঘরে উড়ে বেড়ালো খানিক, থিতিয়ে গেল মেঝেয়-
লিপি অনিমেষের মিলনকালে , গোপাল খাঁচায় থাকত।অনিমেষ গোপালের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যেত-'একটু খাঁচায় থাক। এক্ষুণি আসব। এক্ষুণি।' অতঃপর মিলনপর্ব দ্রুত হ'ত। পাশের ঘরে, খাঁচার ধাতব মেঝেতে গোপালের পাশ ফেরার শব্দ পেত লিপি। অনিমেষ দ্রুততর হত। তারপর দৌড়ে খাঁচার সামনে এসে দরজা খুলে দিত। বিশালদেহী গোপাল অনিমেষের সঙ্গে ওদের ঘরে এসে ঘুমোতো। গোপালের বড় বড় নিঃশ্বাস, পাশবালিশে হাত রেখে অনিমেষ হাল্কা নাক ডাকছে, মাথার ওপর পুরোনো সিলিং ফ্যান ঘুরে চলেছে অবিরাম; রাস্তার আলো অথবা জ্যোৎস্না জানলা দিয়ে ঢুকছে; ঘরময় গোপালের গন্ধ, সিগ্রেটের ঘ্রাণ, পাউডারের বাস - গোপাল, লিপি আর অনিমেষ একেই সুখ বলে চিনেছিল।
আজ প্রায় মাঝরাতে স্ট্রীটলাইটের তলায় দাঁড়িয়ে লিপি অনিমেষকে কী বলবে ভাবছিল। গত দুই রাত সে নিজেকেই দোষী বলে ভেবেছে, প্রতিটি মিনিট প্রতিটি সেকন্ড অপরিমেয় গ্লানি তার শোককে ছাপিয়ে গিয়েছে। গত পরশুও এমনই শীত পড়েছিল। রাতে গোপালকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিল লিপি। রোজকার রাতের হাঁটা- গলি পেরিয়ে বড় রাস্তার ফুটপাথ ধরে এক চক্কর দিয়ে বাড়ি। গোপাল বরাবরই হাঁটায় উৎসাহী, লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল-তাল রাখতে লিপির সামান্য হাঁফ ধরছিল সেদিন। বড় রাস্তায় ট্রাক, রুটের বাস, অটো- গোপালের গলার বকলস আর শিকলির জোড় আলগা হয়ে গিয়েছিল সম্ভবতঃ বহুদিন। সেদিনই ছিঁড়ে গেল। ভারি ট্রাক এসে পড়ল তখনই। লিপির হাতে ধরা শিকলিতে তখনো গোপালের বকলশ ঝুলছে। এক মুহূর্তে নেই হয়ে গিয়েছিল গোপাল।
অনিমেষ সচরাচর রেলস্টেশনে নেমে হেঁটে আসে। গোপাল বহুদূর থেকে ওর গন্ধ পেয়ে ডেকে উঠত। সেই ডাক শুনে ভৌ ভৌ করে দৌড়োদৌড়ি করত গলির কুকুর, তারপর বড় রাস্তার কুকুররা ডেকে উঠত -মেক্সিকান ওয়েভের মত কুকুরের ডাক পৌঁছত অনিমেষের কানে। গলি টুকু প্রায় দৌড়ে ঢুকত বাড়িতে। গোপাল দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে মুখ চাটত অনিমেষের। লিপি ততক্ষণে ভাত বসিয়েছে।
আজ পাড়া নিশ্চূপ, গলি শুনশান -শুধু আলোর তলায় লিপি একলা দাঁড়িয়ে । লিপির দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ওর কান মুখ ঢাকা শাল, ওর দীর্ঘ ছায়া, মাথার ওপর ঝাঁক বেঁধে আসা মশা অনিমেষকে যেন সমস্ত বলে দিল এক মুহূর্তে। এমনকি অনিমেষ যেন লিপির হাতের হাতের ছেঁড়া শিকলিও দেখতে পেল যাতে গোপালের বকলশ ঝুলে রয়েছে। হাতের ব্যাগ নামিয়ে রেখে অনিমেষ বলল-
-'কখন? কষ্ট পেয়েছিল?'
-'ঘরে চলো'। লিপি বলেছিল শুধু।
বাড়িতে ঢুকে থমকে দাঁড়ালো অনিমেষ, ডুকরে উঠলো খালি খাঁচার সামনে। একটু ঝুঁকে জুতোর ফিতে খুলল তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল খাঁচায়। গোপালের মতই লাগছিল অনিমেষকে-জামা প্যান্ট বেল্ট আর মোজা পরা গোপাল যেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে আর হামাগুড়ি দিচ্ছে। খাঁচার মেঝেতে, লোহার জাফরিতে হাত বোলাচ্ছিল অনিমেষ ।
-'গোপাল এখান থেকে আমাদের দেখত। কত বড় লাগছে ঘরটা, দ্যাখো লিপি-কত বড়। আমরা শুধু দুজন এই অ্যাতো বড় ঘরে। অ্যাঁ! আমরা দুজন শুধু-'
লিপি খাঁচার পাশে বসল, গরাদের ফাঁক দিয়ে অনিমেষের আঙুল ধরার চেষ্টা করল প্রথমে তারপর নিজেও ঢুকে গেল খাঁচায়। অনিমেষের পাশে বসে লিপি দেখছিল- কত কত উঁচুতে উঠে গেছে এতকালের ছাদ, ফ্যানের ব্লেডে যেন জন্মের ঝুল কালি, দেওয়ালে অনিমেষের মা বাবা, ক্যালেন্ডারের পিছন থেকে ঐ সরে গেল টিকটিকি, দরজার মাথায় মাকড়শার জাল, ঘড়ির কাঁটা টক টক টক আওয়াজ করে ঘুরেই চলেছে, ঘুরেই চলেছে - সুখের প্রলেপ মুছে গিয়ে ওদের প্রতিদিনের ঘরদুয়ার মলিন আর জীর্ণ দেখাচ্ছে। খাঁচা থেকে বেরোনোর কথা ভাবল না দুজনের কেউ । ধাতুর শক্ত মেঝেতে গোপালের পুরোনো তোয়ালে পাতা-শোকে অশ্রুতে মাখামাখি হয়ে পাশাপাশি শুয়ে রইল দুজনে। গুটিয়ে এইটুকুনি হয়ে। লিপি ওর গায়ের চাদর বিছিয়ে নিল দুজনের ওপর।
শেষ রাতে অনিমেষ চাদর সরিয়ে দিল, সার্ট খুলল তারপর গেঞ্জি খুলে ছুঁড়ে ফেলল, খাঁচার মেঝে ছেঁচড়ে তা গুটিয়ে গেল এক কোণে-যেন ছোট্টো গোপাল-সাদা, শুধু কোমর আর নাকের কাছে ছোপ ছোপ-অনিমেষের ঘামের দাগ। অনিমেষ উঠে এল লিপির ওপর।
-'এভাবে বাঁচতে পারব না, লিপি। কেউ তো নেই-দ্যাখো কেউ ডাকছে না, কোথাও কোনো শব্দ নেই-উফ কী অন্ধকার-
-'আমি তো আছি। গোপাল আসবে। আবার আসবে। আমাদের গোপাল -তোমার আমার গোপাল। কী? আসবে না?'
-'কেউ থাকবে না। আমি না, তুমি না, যে আসবে, সেও না-কী হবে? কী হবে লিপি? আমার যে ভয় করে। সব ছেড়ে চলে যাই চলো। যাবে? বোধিবৃক্ষ কোথায় জানো লিপি? জানো তুমি?'
লিপিকে আঁকড়ে চীৎকার করছিল অনিমেষ।
পাখি ডাকছিল। খাঁচার বাঁদিকের দরজা দিয়ে ভোরের রোদ ঢুকেছে। লিপির ঘুমন্ত মুখ , গ্রীবা, স্তন সোনালী আভায় অপার্থিব। গলিতে সাইকেলের বেল , রিক্সার হর্ন, কুকুর ডেকে উঠল; বড় রাস্তা থেকে গাড়ির আওয়াজ আসছিল। এফ এমে আমি যামিনী তুমি শশী হে বাজছিল। পিন্টুদের রান্নাঘর থেকে ডালে ফোড়ন দেওয়ার ঝাঁঝালো ঘ্রাণ এলো জানলা দিয়ে।
খাঁচার অন্য দিক তখনও রোদহীন , সেখানে গোপালের ঝরা রোম, গোপালের লালার দাগ, কুঁকড়োনো গেঞ্জি, এবং প্রবল শৈত্য। খাঁচার গরাদে বরফ জমেছে যেন।
অনিমেষ দোটানায় ছিল।
Comments
Post a Comment