সদর স্ট্রিট জার্নাল

-' বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয় নি তো?

-‘না না, ঠিকানা তো’ ছিলই; বাজারের কাছে এসে , শুধু একটু জিগ্যেস করতে হয়েছে –‘

-‘পোস্টাল অ্যাড্রেস যাই থাকুক, এ' রাস্তার নাম কিন্তু সদর স্ট্রীট। হা হা। অবাক হচ্ছেন? এই তো' লেখকের কাজ - স্থান কাল পাত্র নিয়ে খেলা করে করে পাঠককে ধন্দে ফেলে দেওয়া। ছোটোবেলা থেকেই কাজটিতে আমি পটু। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার স্বভাব বরাবরের; তার ওপর মানুষ, পশু, পাখি এমনকি জায়গার নাম বদলে দেওয়ার একটা ফেজও চলেছিল বহুদিন - আমিই এ' গলির নাম দিয়েছিলাম সদর স্ট্রীট।' -এই অবধি ব'লে কমলিকা সামন্ত কফিতে চুমুক দিলেন।

রণজয় আর সুস্মিতা মুখ চাওয়াচায়ি করল।

সুস্মিতারা মিনিট কুড়ি আগে এ' ঘরে ঢুকেছে। মফস্সলের পুরোনো বাড়ির বসবার ঘর - লাল মেঝে, বেতের সোফা, দেওয়াল জোড়া তাকে শুধু বই আর বই; বাঁধিয়ে রাখা গণেশজননীর এক কোণে কালচে ছোপ , প্রাচীন ঘড়ির সঙ্গে সুস্মিতার মোবাইলের সময় মিলছিল না। রণজয় ক্যামেরা বাগিয়ে এদিক ওদিক দেখছিল - বিকেলের রোদ, কমলিকা আর ঘরভরা বই এক ফ্রেমে ধরার ইচ্ছে। জানলা দিয়ে এলোমেলো ঘাস আর কিছু গোলাপ দেখা যাচ্ছিল- একটা কালো ছোপ ছোপ বিড়াল রোদে পিঠ দিয়ে গোলাপের দিকে তাকিয়ে। গোলাপের গাছ ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে কমলিকার ছবি তোলার কথা রণজয়কে বলবে ভাবছিল সুস্মিতা - তারপর মনে হয়েছিল, বড় বড় সাদা গোলাপ, কাঠের বাড়ি আর কমলিকার ছবি আগে কোথাও দেখেছে । আসলে, কমলিকার লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত সুস্মিতা; এই মফস্সলের পুরোনো বাড়িতে সে আজ কমলিকার মুখোমুখি - এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। কমলিকা সামন্ত আশৈশব বিদেশবাসী, বাবা মা বাঙালী, লেখালেখি যদিও ইংরিজিতেই। এই বাড়ি কমলিকার দাদুর। এখানে কমলিকা সাত দিনের জন্য এসেছেন , দুপুরের দিকে একটা ছোটো ইন্টারভিউ দিতে রাজি, দাদুর বাড়ি, ওঁর ছোটোবেলা নিয়ে প্রশ্ন করা চলবে -এই সকল তথ্য রণজয়ের পুরোনো বস গতকাল ফোনে জানিয়েছিলেন। বস রিটায়ার করেছেন গতবছর, কমলিকার মাসির প্রাণের বন্ধু । মাসি সংসার ছেড়ে ছুড়ে এ'গ্রামে সে'গ্রামে আদিবাসী মেয়েদের সঙ্গে নানা কাজ করেন-তাঁর ঠিকানা আবার প্রাণের বন্ধু ছাড়া কেউ জানেও না। কমলিকা বহুবছর পরে সম্ভবতঃ মাসির সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

চমৎকার বাংলা বলেন কমলিকা; সাক্ষাৎকারের ইন্ট্রোতে সুস্মিতা সুললিত শব্দটা ব্যবহার করবে সম্ভবতঃ। কমলিকার কথার ভঙ্গিতে একটা প্যাটার্ন আবিষ্কার করছিল সে -ঈষৎ ভেবে, শব্দর পরে শব্দ সাজাচ্ছেন কমলিকা , পছন্দ না হ'লে বদলে নিচ্ছেন; শব্দ, বাক্য যেন মালার মত গাঁথছেন, দম নিচ্ছেন, হাসছেন, তারপর আবার শব্দ,আবার বাক্য-

-'লন্ডন থেকে মা'র সঙ্গে প্রতিবছর আসতাম দাদুর বাড়িতে। শীতকালে। ঐ সময়ে লন্ডনের বন্ধুবান্ধব, সান্টা ক্লজ, ক্রীসমাস ট্রী ফেলে আসতে আমার কিন্তু কোনো কষ্ট হ'ত না। বরং সারা বছর ভাবতাম, কবে আসব দাদুর বাড়ি। প্রতিবার ফিরে যাওয়ার সময়, এয়ারপোর্টে সে যে কী কান্নাকাটি! একবার কি হয়েছে,’ দিদার ক্রীমের কৌটোয় এ'বাড়ির হাওয়া বাতাস ভরলাম- ওখানে স্কুলে গিয়ে শো অ্যান্ড টেলে বলছি - এই আমার দাদুর বাড়ির গন্ধ আর সবাই বলছে , ওমা এতো পন্ডসের গন্ধ - আমি কেঁদে আকুল হয়ে কৌটো বন্ধ করে দিচ্ছি। কী জানেন, ছোটোবেলা থেকেই গলিটা খুব অদ্ভূত লাগত -প্রতিটি বাড়িতে সকাল থেকেই চেঁচামেচি- গৃহস্থের নিত্যদিনের ঝগড়া, আবার উচ্চস্বরে রাজনীতিচর্চা, কিম্বা হয়ত ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান নিয়ে ভয়ানক তর্কাতর্কি। এই ধরুন, সবে ভোর হয়েছে, কাক টাক ডাকছে, এ বাড়িতে ও বাড়িতে উনুন ধরানো হচ্ছে-গলি ভরে গেছে ধোঁয়ায় - তখন তো' গ্যাস আভেন টাভেন ছিল না - আর সেই কাকভোরেই চতুর্দিকে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে। টুবলুদা , আমার মামাতো দাদা বলত-পাগলপাড়া। হা হা ।‘ রণজয় খচ খচ ছবি তোলে বেশ কয়েকটা।

-'টুবলুদা ভালো লিখত, লিটল ম্যাগাজিন টিন-'

-'টুবলুদার থেকেই কি আপনি লেখার প্রেরণা পান?' সুস্মিতা কথোপকথন কন্ট্রোল করার সামান্য চেষ্টা করল। কমলিকা আমলই দিলেন না।

-' সেটা পরে বলছি। তার আগে সদর স্ট্রীটের গল্পটা বলি। পাঁচ বছর বয়স থেকে মোটামুটি সবই মনে করতে পারি। আমার তখন বছর ছয় -জানলার সামনে বসে রাস্তা দেখছি-একজন লম্বা মতো ভদ্রলোক- চাপদাড়ি টাড়ি- বাজার নিয়ে ফিরছেন, আমাকে দেখে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন: কে তুমি খুকী? কোথা হইতে আসিয়াছ? কংগ্রেস না নকশাল? আমি তো ভয় টয় পেয়ে -দিদা দিদা - বলে কাঁদতে শুরু করেছি; সেই ভদ্রলোক মুচকি হেসে সুর ক'রে বললেন: কা গোপালি নেপালি/ হাতে হাতে ভোজালি - বলতো খুকী কেমন পদ্য?'

-'ছ বছর বয়সে শোনা লাইন এখনও মনে আছে আপনার? '

-' ডায়রি লেখা শুরু করেছিলাম যে- দাদুর বাড়ির সব কথা লিখে রাখতাম। খুব বিশদে লিখতাম। ছোটো থেকেই। এনিওয়ে, তারপর ধরুন, উল্টোদিকের লাল বাড়িটা -ভোর হতেই এক মহিলা চেঁচাতেন: প্রবীর, উঠ্‌ উঠ্‌ উঠ্‌, লুচি বোঁদে খাবি নি? চ্যান করতে যাবি নি? হা হা। ভাবুন একবার। এই প্রবীরদা আর টুবলুদা আবার একই ক্লাসে পড়ত। ভালো ছবি আঁকত প্রবীরদা। টুবলুদার হাতে লেখা পত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকে দিত। একবার কি হ'ল, শীতকালে আমরা যথারীতি দাদুর বাড়ি এসেছি -সেবারে বাবাও এসেছিল- বিকেলের দিকে শোনা গেল, প্রবীরদার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে-স্কুলের সামনেই বাসের তলায়-হাসপাতালেই মারা গেল । প্রবীরদার মা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন- এ'বাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে, প্রবীর, উঠ্‌ উঠ্‌ উঠ্‌ আউড়ে যেতেন ঘন্টার পর ঘন্টা- যেন দাদুর বাড়িরই কোনো ঘরে প্রবীরদা ঘুমিয়ে আছে। ক'দিন পরে নতুন দুটো লাইন বলা শুরু করলেন ; গলি দিয়ে লোক গেলেই , ধরে ধরে : 'টিন টিন/কেরোসিন/ কোথা পাই/ বল ভাই । শীত ফুরোতে আমরা লন্ডন চলে গেলাম। সামার ভেকেশনে দাদুর চিঠি এল, প্রবীরদার মা গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা গিয়েছেন। '

কমলিকা কফির কাপ নামিয়ে রাখলেন।

-'মানে যেটা হয়েছিল, ঐটুকু বয়সেই দেখলাম এ'পাড়ার সবাই মুখে মুখে পদ্য বানায়। জাস্ট দুটো গল্প বললাম, আরো অনেক গল্প ছিল, ডায়রিতে লেখা আছে লাইনগুলো সমেত। আচ্ছা, জীবনস্মৃতি মনে আছে আপনাদের? সেই যে.. আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। সেইদিনই ‘নির্ঝরের স্বপভঙ্গ’ কবিতাটি নির্ঝরের মতোই যেন উৎসারিত হইয়া বহিয়া চলিল.. মনে আছে? তো, টুবলুদাকে বললাম -পাগলপাড়া নয়, এ হ'ল সদর স্ট্রীট। সবাই প্রভাত পাখির গান শুনতে পেয়েছে। বয়সের তুলনায় একটু না বেশ একটু পাকা ছিলাম-প্রচুর পড়তাম তো। আমার এই ডায়লগটা সুপারহিট হয় দাদুর বাড়িতে। দাদুও চিঠিতে লিখত- সদর স্ট্রীটের জনগণ তোমা বিরহে অতি দুঃখে কালাতিপাত করিতেছে-এই সব। '

-' আপনার এই গলি নিয়ে লেখার ইচ্ছে হয় নি কখনও?'

-'লিখছি অ্যাকচুয়ালি। মানে আপনাদের জটায়ূর ভাষায়-ছক কেটিচি মশায়। হা হা । ধরুন, একশো তিরিশ চল্লিশ বছর আগের দশ নম্বর সদর স্ট্রীট, সূর্যোদয়, রবীন্দ্রনাথ - তারপর মনে করুন ফিফটিজের কলকাতা-কেন্ডালদের শেকসপীয়ারিয়ানা , জেফ্রি , জেনিফার, ফেলিসিটি -সদর স্ট্রীটের ফেয়ারলন হোটেলের সিঁড়ি টপকে টপকে উঠছেন শশী কপূর- সদ্য সদ্য জেনিফারের প্রেমে পড়েছেন - সেই সময়ের হগ মার্কেট, পাশে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম -কী ভাইব্র্যান্ট একটা জায়্গা - অনেক বদনামও ছিল সদর স্ট্রীটের, এখনও আছে- যাই হোক, তার বছর দশ পনেরো পরে ধরুন নকশাল আমল- দাদুর বাড়ির ছাদের ওপর উনুনের ধোঁয়ায় মলিন সূর্য , গলির ঝগড়া, পদ্য, প্রবীর, উঠ্‌ উঠ্‌ উঠ্‌ - ক্রোনোলজি মেইনটেনড হবে না একদম- এই হয়ত, টুবলুদার সঙ্গে তরুণী জেনিফারের দেখা হয়ে গেল, ওদিকে জেফ্রি কেন্ডাল নাটকের দল নিয়ে জ্ঞানদানন্দিনীকে মীট করছেন- আবার দেখুন, বলা যায় না, রবীন্দ্রনাথ সটান চলে এসেছেন প্রবীরদার বাড়ি, স্থান কাল পাত্র দুমড়ে মুচড়ে একদম গুলিয়ে দেওয়া খেলা আর কি -দেখা যাক কদ্দূর কী হয়-'

-'এগুলো লিখতে পারি তো?'

-'লিখুন, অসুবিধে নেই-'

-'লেখক হয়ে উঠলেন কীভাবে সেটা যদি বলেন-'

-'হ্যাঁ, এবারে সেই গল্প। আসলে, লন্ডনে নিরুত্তাপ জীবন-আমি, ভাই, বাবা, মা -এমন কিছু ঘটেনি যাতে লেখার কথা ভাবতে পারি সিরিয়াসলি । যা ঘটেছিল তা' এখানেই। সেবার বুল্টুমামার বিয়ে, মা আমাকে আর ভাইকে নিয়ে এল। বাবা বোধ হয় পরে এসেছিল। এসে দেখি বাড়ি ভর্তি লোক-অর্ধেক লোককে চিনিও না- আগে দেখি নি কখনও আর কি। বিয়ের দিন, খুব ভোরে মানে ব্রাহ্মমুহূর্তে পুকুরে জল ভরতে যাওয়া হবে- যেখানে আপনারা গাড়ি পার্ক করেছেন , সেখান থেকে বাঁদিকে পাঁচ মিনিট গেলেই পুকুর-সেইসময় বেশ পরিষ্কার- ঘাট টাট বাঁধানো ছিল। সেই সকালে অনেকেই যাচ্ছিল পুকুরে , শাঁখ , কুলো, ঘড়া টড়া নিয়ে; আমিও লেপ ছেড়ে উঠে পিছু নিলাম। ছোটো তো-নিজে নিজে সোয়েটার মাফলার মোজা টোজা পরতে সময় লাগল, দেরি হয়ে গেল- এদিকে মা ঐ দলের সঙ্গে বেরিয়ে গেছে, জানেও না আমি উঠে পড়েছি। যাই হোক, একটু পিছিয়েই হাঁটছি-প্রচন্ড কুয়াশা-জল ভরতে যাওয়ার দলের কথা বার্তা হাসি সবই দিব্যি শুনতে পাচ্ছি-দেখতে পাচ্ছি না কাউকেই। এমন সময়, একজন খুব সুন্দর মহিলা-ছাপা ছাপা একটা শাড়ি, লাল চাদর, কপালে টিপ-মনে আছে এখনও- কুয়াশার ভেতর থেকে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন-ওমা তুমি উল্টো বাগে চলেছ -পুকুর তো ঐ দিকে। চলো আমার সঙ্গে । আমি ভাবলাম আত্মীয়দের কেউ বুঝি। যাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে - দেখি একেবারে অন্য একটা পুকুর-আরো সুন্দর, অনেক পরিষ্কার-দিব্যি বসবার জায়গা, জল ভরার দলের কেউই নেই অথচ। সেই মহিলা বললেন, ওরা এসে পড়বে, আমি জল ভরতে শুরু করে দিই বরং , তুমি সিঁড়ি বেয়ে এসো। ভদ্রমহিলা কলসী নিয়ে জলে নেমেছেন, মানে পায়ের পাতা ভিজিয়েছেন, আর গুনগুন করছেন- আমিও পিছন পিছন সিঁড়ি বেয়ে জলের সামনে; দেখি কুয়াশা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে আর জলের নিচে, বুঝলেন, সব দেখা যাচ্ছে, মানে সমস্ত। স্বচ্ছ পরিস্কার। জলতল যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই আর একটা শহর যেন মাথা নিচু করে ঝুলে আছে। আগের রাতেই ভাই আর আমি ছবির বই দেখছিলাম- দেশ বিদেশের শহরের রঙীন ছবি- চকচকে মসৃণ বইটার পাতা-ঐ বই য়ের পাতা থেকেই যেন একটা গোটা শহর যেন ঐ পুকুরের তলায় ঢুকে পড়েছে। সেদিন মনে হয়েছিল টিবিলিসি'-

-'মানে জর্জিয়ার রাজধানী?'

-'হ্যাঁ, সেদিন সেরকমই মনে হয়েছিল-পুরোনো টিবিলিসি-পাহাড়ের গায়ে ছোটো ছোটো বাড়ি, একটা চার্চ, ঘোড়সওয়ারের মূর্তি, জলের তলার টিবিলিসিতে তখন রাত, চাঁদ দেখা যাচ্ছে। কীরকম জানেন- মানে, আমার সামনে প্রথমে জল, তার তলায় টিবিলিসির মাটি, তারপর মাথা নিচে ঘরদোর, ঘোড়সওয়ার, তারও নিচে আকাশ আর চাঁদ। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল-আরও ভালো করে দেখব বলে মাথা ঠেকিয়ে দিলাম জলের ওপর। কানে, চোখে নাকে টের পাচ্ছি কনকনে ঠান্ডা জল-আরো অবশ অবশ লাগছে-হঠাৎ টুবলুদার চীৎকার-এই ত্তো এই ত্তো। লাবণ্যমাসি ঝপ করে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে চিল চীৎকার-কী করছিলি এখানে? সে এক হৈ হৈ মহাকান্ড। আমাকে ঘিরে ভীড় জমে গেল। এক ঝলক তাকিয়ে দেখে নিলাম, পুকুরের ওপর আবার কুয়াশা - যেন একটা দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ।'

-'আর সেই মহিলা?'

-' ভ্যানিশ। সবাইকে যতই বলি, এ’বাড়িরই কেউ একজন, বিশ্বাসই করে না-পুকুরটাও একেবারেই অন্যদিকে আর বেশ দূরে। শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হ'ল আমি অন্য কোনো বিয়েবাড়ির দলের সঙ্গে এসে কুয়াশায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর সিঁড়ির ওপর ঘুমিয়ে পড়েছি।'

-'তাহলে ঐ জলের তলার টিবিলিসি? জাস্ট স্বপ্ন? '

-'অ্যাকচুয়ালি এটাই তোমার মূল প্রশ্নের উত্তর-মানে আমি জানি না-আর সেজন্যই লিখি। অপটিকাল ইলিউশন জানো তো ? সরি সরি, এহে, তুমি বলে ফেললাম-'

-' না না সরি কিসের, অবশ্যই তুমি বলবেন-'

-' ছোটোবেলায় খেলেছ নিশ্চয়ই-চারটে কালো ছোপের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলে-এই ধরো তিরিশ সেকেন্ড- তারপর ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলে রামকৃষ্ণ বা যীশু কিম্বা রবীন্দ্রনাথ। আমার এক এক বার সেরকম মনে হয়েছে- হয়ত ইলিউশন ছিল। পরে আবার মনে হয়েছে- আসলে গুরুজনদের কথা বেজায় ইনফ্লুয়েন্স করত তো- ভেবেছি, স্বপ্নই দেখেছিলাম। ঘটনাটা ডায়েরিতে লিখেছিলাম, কাটাকুটি করেছি, নানাভাবে লিখেছি। কনক্লুশনে আসতে পারি নি। সেই শুরু। আমার লেখাতেও একটা ইলিউশন ক্রিয়েট করি , যেন স্বপ্ন। কনক্লুশন নেই, শেষ নেই, শেষ কথা বলার কেউ নেই । কত বছর ধরে এই সব করে যাচ্ছি। করতে করতে যদি কোনোদিন উত্তর পেয়ে যাই '।

সুস্মিতা এরপর সাজিয়ে আনা প্রশ্নগুলি করে। কমলিকার এ' উপন্যাস , সে' উপন্যাস থেকে প্রশ্ন, সমসাময়িক লেখকদের মধ্যে কাকে ভালো লাগে, ডায়াস্পোরিক লিটরেচার এই সব।

এক ঘন্টার বেশিই কেটে গেছে। সুস্মিতাদের উঠতে হবে। শেষ প্রশ্ন করল সুস্মিতা, ' আচ্ছা আপনার ছোটোবেলার এই গলি মানে সদর স্ট্রীট আর এখনকার সদর স্ট্রীটের কী পার্থক্য দেখেন?' যতবার সদর স্ট্রীট বলছিল সুস্মিতা, নিজের দুহাতের আঙুল তুলে কোট আনকোট বোঝাচ্ছিল-রণজয় হাসিমুখে ছবি তুলছিল।

-'ছোটোবেলার মত নিয়মিত আসি না , এ’ বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে, ছোটোমাসি মাঝে মাঝে এসে থাকেন। সকালের চেঁচামেঁচিটা বন্ধ হয়ে গেছে -হাঁক্ডাক এখনও হয় তবে সন্ধ্যাবেলায়- টিভি সিরিয়ালের। আর একটা ব্যাপার, গলির শুধু নয়, পাড়ার অনেক বাড়িই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে - সে বাড়িগুলো হয় ভেঙে ফেলে অ্যাপার্টমেন্ট উঠছে-ছোটো ছোটো পায়রার খোপ, নয়তো গেস্টহাউজ বানিয়ে ফেলছে । কাউকে কবিতা বলতে শুনি না। গলির চরিত্র হয়ত বদলে গেছে। তবে আবার লিখতে লিখতে অন্য কথা মনে হয়-'

-'কী?'

-'সদর স্ট্রীট রহিয়াছে সদর স্ট্রীটেই। হা হা হা ।'

শেষ বিকেলের রোদ পিছনে রেখে কমলিকার ক্লোজ আপ নেয় রণজয়।




-‘এখন আর এই সব জায়গাকে মফস্সল বলা যায় না, তাই না? কমলিকার ছোটোবেলায় এ'পাড়া কেমন ছিল ভাবছি। সেই পুকুরটা দেখে যাবি?'

-'কোন পুকুরটা? কাছেরটা না টিবিলিসিরটা?'

-'তুই একটা যা তা। থাক, পুকুর দেখে কাজ নেই। '

-'তুইই বললি দেখবি। যাব্বাবা। '

-'নাঃ ওটা কুয়াশা -কুয়াশাই থাক, কমলিকার লেখার মত। ওঁর কথাও লেখারই মত। তাই না? হুঁ? আচ্ছা, ঐ যে বললেন , সদর স্ট্রীট রহিয়াছে সদর স্ট্রীটেই-মানে কী বল্‌তো?'

-' কী জানি, বুঝি নি। তবে ইন্টারভিউটা ভালো হয়েছে। এত কথা উনি বোধ হয় এর আগে কোথাও বলেন নি। এই, চা খাবি রে? চল ঐ দোকানটায় যাই। আরে কী হয়েছে, শর্মিষ্ঠাদি যখন কাল খবরটা দিলেন মানে ওঁর এখানে আসার খবরটা, কী বললেন জানিস? বললেনঃ কমলিকা ঐ বাড়ি বিক্রি করার মতলবে এসেছে। ভেবে দ্যাখ, মতলবে শব্দটা ব্যবহার করলেন শর্মিষ্ঠাদি। '

-'মতলব কেন হতে যাবে?'

-'আরে আমি অত কি জানি! শর্মিষ্ঠাদি বলছিলেন, কমলিকার মাসি বাড়ি বিক্রি করতে চান না। মামারা চান বোধ হয়, কমলিকার মা পঙ্গু, বোধশক্তি নেই, নিজের বোধ হয় টাকাকড়ির দরকার-মাসির সঙ্গে এবারে একটা বোঝাপড়া করতে এসেছেন ।'

-'লেখক কবি দের সম্বন্ধে বেশি না জানাই ভালো। একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে যা সব গল্প শুনেছিলাম...এখন অবশ্য এই প্রফেশনে সেলেবদের হাঁড়ির কথা জানা হয়েই যায়।'

-'বাদ দে। তোর কাজ হয়ে গেছে। কমলিকার যত গ্যাঁজা গুল গুছিয়ে লিখে দিবি। ব্যাস। এই দ্যাখ, ইউ টিউবে সদর স্ট্রীট এর ভিডিও পেলাম। দেখবি? তোর লেখার কাজে লাগবে। '

-'সে দেখে আমার কী হবে? বরং একবার মিউজিয়ামের দিকে ঘুরে আসব কাল। এখন চা খেয়ে কাটি চল।'

-'আরে দু’মিনিটের ভিডিও। দেখে নে। তারপর উঠি।'

কমলিকা সামন্তর গলিতে তখন চুপিসাড়ে সন্ধ্যা নামছিল। ওদিকে কলকাতার সদর স্ট্রীট রণজয়ের মোবাইল স্ক্রীনে পিক্সেলে পিক্সেলে জমজমাট। মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে রাস্তা গিয়েছে- ফুটপাথ, দোকান, শস্তার হোটেল, পুরোনো রেকর্ড, বইএর দোকান- ঝকঝক করে গ্রামোফোনের চোঙ । রণজয় আর সুস্মিতার চোখের মণিতে , চশমার কাচে হলুদ ট্যাক্সি গেল একটা, দুটো, তারপর হাতেটানা রিক্শায় বিদেশিনী, দোকানে মধুবনী প্রিন্টের সাদা কালো স্কার্ট, লাল চাদর বিক্রি হ'ল পরপর, হোটেলের মলিন লবিতে কে যেন মেরি ক্রিসমাস বলল, চোখ মেরে ।

-'চল্‌ রে এবার ফিরি। গাড়ি পার্ক করেছিস কোথায় মনে আছে?'

-'তোর প্রিয় লেখকের বাড়ির সামনেই তো’ ।'

- 'এই দ্যাখ্‌ রাস্তার ওপারে একটা খাবার জায়গা-কী সুন্দর আলো জ্বলছে নিবছে -ওখানে গেলেই তো হ'ত।'

-'আজ্ঞে না, চা খাওয়ার জায়্গা নয়, ওটা গেস্ট হাউজ। কমলিকা বলছিলেন না-'

-'চল্‌ না, দেখে আসি।'

সাইনবোর্ডে 'গেস্ট হাউজ ' লেখা ছিল; বাড়ির কার্নিশে, ব্যালকনিতে আলোর মালা -যেন দুর্গাপুজো অথবা দীপাবলী- পিছনের লন আলোকিত, গাছে গাছে লাল সবুজ টুনি বাল্ব।

-'আবার ওদিকে যাচ্ছিস কেন? অত ঘুরে ঘুরে দেখার কী আছে?'

-'না দেখারই বা কি? কোনদিন তো আসি নি। তুই এসেছিস? আসবি আবার না? তোর তো ‘ একশো আট না কত জন যেন-'

-'ইয়ার্কি রাখ্‌, ওখানে ঢোকার কোনো দরকার নেই।'

-'তুই দু'মিনিট দাঁড়া। আমি যাবো আর আসব। একটু দেখে আসি। লেখাটায় যদি কিছু অ্যাড করতে পারি-'

রণজয় সিগারেট ধরিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সুস্মিতা লোহার গেট খোলে। পোর্টিকো পেরিয়ে কাচ দেওয়া দরজা - সুস্মিতা প্রথমে ঠেলা দেয় তারপর বন্ধ পাল্লায় নাক ঠেকিয়ে চোখের দুপাশে হাত রেখে ভিতরে দেখার চেষ্টা করে। ভিতরে হলঘরে বাজনা বাজছিল , সাইকেডিলিক আলো- আবছা অন্ধকারে নারীপুরুষের নাচ -এইসব দেখতে পাচ্ছিল সুস্মিতা।

-' হ'ল দেখা? আরে আয় এবারে। এখানেই রাত কাবার করবি নাকি?' রণজয় চটিতে সিগারেট ড'লে এগোয়।

কাচের দরজা খুলে গেল ঠিক তখনই - ব্যাঞ্জো চেলো গিটারের আওয়াজ - ' রাত বাকি বাত বাকি হোনা হ্যায় যো' ভেসে এল, আর অতীব সুদর্শন, ঢেউ খেলানো চুলের হাস্যমুখ তরুণ সুস্মিতার হাত ধরে টান দিল ভিতরে। একদম শশী কপূরের মত দেখতে ছেলেটা- রণজয়ের মনে হ'ল - ঠিক ওই রকম গুঁজে শার্ট পরা , চওড়া বেল্ট, তার ওপর ব্লেজার । 
দরজা বন্ধ হয়ে গেল দড়াম করে।

Comments

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস