অরফ্যানগঞ্জ
পায়ের নিচে মাটি তোলপাড় হচ্ছিল প্রফুল্লর— ভূমিকম্পর মত। পৃথিবীর অভ্যন্তরে যেন কেউ আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে— সেই প্রচণ্ড কাঁপুনিতে ফাটল ধরছে পথঘাট, দোকানবাজার, বহুতলে। পাতাল থেকে গোঙানির আওয়াজ আসছিল। ঝোড়ো বাতাস বইছিল রেলব্রিজের দিক থেকে। প্রফুল্ল দোকান থেকে বেরিয়ে নেতাজি মূর্তির দিকে দৌড়ল। চশমা চোখে টুপি মাথায় ফ্যাটফ্যাটে সাদা নেতাজি সেই কবে থেকে চৌমাথার মোড়ে— হাত, পা, ঘোড়াবিহীন। ছোটবেলায় প্রফুল্ল আর হেমন্ত বাবার হাত ধরে মূর্তির সামনে পতাকা তোলা দেখত; উঠো গো ভারতলক্ষ্মী গান হত। পুনঃ কনক-কমল-ধন-ধান্যে গাইতে গাইতে প্রফুল্ল ভাবত, ওদের পাড়ার মাটির তলায় ঘড়া ঘড়া মোহর রয়েছে আর নেতাজির মূর্তি আসলে জাস্ট একটা ছিপি— প্যাঁচ খুলে সরিয়ে নিলেই লাখে লাখে মোহর বেরিয়ে আসবে ফোয়ারার মত। তারপর মোহরের বন্যা— মোহরে মোহরে ডুবে যাবে এ পাড়ার পথঘাট, খানাখন্দ, ঘরদোর, শ্যাওলাধরা উঠোন— একটা মানুষ দাঁড়ানোর জায়গাও থাকবে না। নায়কের সেই সিনটার মত যেন— টাকায় টাকায় ডুবে যাচ্ছে উত্তমকুমার। এই সব বড় ভয়ের কথা— ভাবতে গেলে বুক কাঁপে প্রফুল্লর সেই ছোটবেলা থেকে। তারপর চারপাশের বাতাস কমে গিয়ে দম বন্ধ লাগে। বিনবিন করে ঘাম হয়। তখন শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খুলে টাটকা হাওয়া ঢুকতে দিতে হয় বডিতে। আসলে, এই ভয়ের শুরু শৈশবে, ছবিওলা বইতে সে যখন পড়ছিল, বনের মধ্যে শিয়াল বলছে— ‘আকাশ ভেঙে পড়েছে রে, আকাশ ভেঙে পড়েছে’; প্রফুল্লর মনে হয়েছিল, বইয়ের ঐ লাইনটা ওর বুকের থেকে সব হাওয়াটুকু শুষে নিয়ে একটা ছাইরঙা বেলুন হয়ে ওপরে উঠে গেল, তারপর আকাশের সঙ্গে বেলুনের ধাক্কায় হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল আকাশ— যেন একটা ভারী নীল পর্দা নিচে নেমে আসছে আর রাশি রাশি মেঘের তলায় যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে সে, দমবন্ধ হয়ে আসছে তার; ছোট্ট প্রফুল্ল কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল। প্রফুল্ল খুব স্পষ্ট করে বুঝে উঠতে পারত না ওর ভয়ের রকমসকম— মাঝে মাঝে মনে হত, মাটির নিচে কিম্বা হয়ত মাথার ওপরে, কে জানে কোথায়, অনেক কিছু জমছে জমছে আর জমছে— হয়ত জল, হয়ত রোদ, হয়ত অনেক কান্না, হাসি, ধনদৌলত, অথবা নিছক সুখ কিম্বা দুঃখ— জমে জমে একদিন উপচে পড়বে সব— ভেসে যাবে রাস্তাঘাট ঘরদোর দোকান বাজার, রেলস্টেশন; কতবার রাতবিরেতে ঘুম ভেঙে গেছে— মনে হয়েছে কল খুলে গিয়ে জল পড়ছে বেসিনে, তারপর সে জল উপচে মেঝেয়, সারা বাড়ি ঘর দোর জলে জলাক্কার— ভয়ে ভয়ে পা ঘষে ঘষে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রফুল্ল; অন্ধকারে পায়ের পাতা এদিক ওদিক করে বুঝে নিতে চেয়েছে জল কতদূর— তারপর আলো জ্বালিয়েছে। বেসিন ট্যাপের মুখ বন্ধ, খটখটে শুকনো মেঝে, ঘরদোর দেখে নিশ্চিত হওয়ার বদলে সংশয়ে ভুগেছে তখন— যেন জলের তোড়ে ঘরদোরের জানলাদরজা ভেঙে ওর ভেসে যাওয়ারই কথা ছিল এতক্ষণে। অথবা হয়ত রাস্তা দিয়ে এক ছোকরা গেল— লম্বা চুল, হাল্কা দাড়ি, ইয়ারবাড— ঢিমে তেতালায় চলেছে বাজারের রাস্তা পেরিয়ে স্টেশনের দিকে ট্রেন ধরতে। প্রফুল্ল তখন ওর দোকানের শাটার তুলেছে সবে। ধূপ টুপ ঘোরাচ্ছে। ছেলেটার কানে গোঁজা তার বেয়ে গান বাজনা সুর তাল সব উপচে বেরোচ্ছে স্পষ্ট দেখল প্রফুল্ল— সা রে গা মা, ধা ধিন ধিন ধা কানের ফুটো থেকে বেরিয়ে জুলফি গড়িয়ে প্রথমে শার্টে তারপর জিনসে তারপর রাস্তায় পড়ে বলের মত দলা পাকাল— একটা বল, তারপর দুটো তারপর অজস্র পিণ্ড রাস্তা ভাসিয়ে, নালা উপচিয়ে স্টেশনের দিকে চলল— প্রফুল্ল দ্রুত মুখ সরিয়ে নিয়ে শার্টের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল, ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরিয়ে দিল ম্যাক্সিমামে।
প্রফুল্লর ছোট দোকান। কাচঢাকা ঠান্ডা ঘেরাটোপে ক্রিম রোল, কেক, পেস্ট্রি, চকলেট, আইসক্রিম, থামস আপ, পেপসি; কুরকুরে, চিপসের প্যাকেট দড়িতে ঝুলে থাকে। সব ধুলোপড়া। ঘরের আনাচে কানাচে ধুলো, মাকড়শার জাল। দোকানে কেউ আসে না। হেমন্ত বলেছিল, ফুলটুলের ব্যবসা করতে— এ পাড়ার বিয়েতে, শ্রাদ্ধে ফুল কিনতে লোকজন এখনও নাগেরবাজার ছোটে; পাড়ার মধ্যে একটা ফুলের দোকান— জন্মদিনের ফুল, বিয়ের গাড়ি সাজানো, কিম্বা ফুলশয্যার খাট, শ্রাদ্ধবাসরের রজনীগন্ধা, মালা টালা। প্রফুল্ল রাজি হয়নি।
অথচ দিনকাল এমন ছিল না। প্রফুল্লর বাবার দোকান ছিল চৌমাথার মোড়ে— স্কুলের বইখাতা, পেনসিল, গন্ধরাবার, বাঁশের রুলার, জেমসক্লিপ। সরস্বতী পুজোর পরে বুকলিস্ট নিয়ে লাইন পড়ে যেত দোকানের সামনে। যৌবনে সে দোকান পেয়েছিল প্রফুল্ল আর হেমন্ত। হেমন্তর ভাগে স্কুল কলেজের বই খাতা পেন পেনসিল, ওদিকে, প্রফুল্ল কলেজ স্ট্রিট থেকে আনত মোটাসোটা উপন্যাস, পাতলা কবিতার বই, ম্যাগাজিন। প্রফুল্লর তখন নবীন বয়স, গালময় দাড়ি, ফতুয়া পায়জামা, ঝোলাব্যাগ। নিজে লিখত; প্রতিবছর পাড়ায় পুজোর নাটকে ডিরেকশন, পার্টি অফিসে যাতায়াত। সেই সময়ে, একদিন বেণু এসেছিল দোকানে— ভাস্কর চক্রবর্তী, দেবারতি মিত্রর বইয়ের অর্ডার প্রফুল্ল তার আগে আর পায়নি কখনও। বেণুর সঙ্গে সঙ্গে পাড়া উপচে গলি উপচে বেলফুলের গন্ধ এসেছিল রেলব্রিজের দিক থেকে, তারপর বেলফুল আর বকুলগন্ধ মেশামেশি করে রেললাইন পেরিয়েছিল; শেষ অবধি, বাজার উপচে গিয়ে বেল, বকুল আর কদম্ব থেমেছিল প্রফুল্লর দোকানের সামনে। প্রফুল্ল আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিল। গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ পেরিয়ে মাঘে বেণুর এমএ কমপ্লিট করে স্কুলে চাকরি পেতে পেতেই ওদের বিয়ে। বেণু পিএইচডি করার কথা ভাবছিল। ফলে, বিয়ের পরে বেণুর সকালের স্কুল— ট্রেন ধরে মফসসল থেকে কলকাতা, তারপরে লাইব্রেরি, ইউনিভার্সিটি— বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। প্রফুল্ল অপেক্ষা করত দোকানে। তারপর দোকান বন্ধ করে একসঙ্গে বাড়ি যেত দুজন।
সেদিন সোমবার। সকালের ট্রেন ধরে বেণু স্কুলে চলে গিয়েছে যথারীতি। দোকানের জন্য বই আনতে কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিল প্রফুল্ল; দুপুর নাগাদ ফিরছে— দুহাতে খবরের কাগজ জড়ানো বই, দড়িবাঁধা। কপাল থেকে ঘাম গড়াচ্ছে, ঘামে ভেজা ফতুয়া। প্রফুল্ল দেখল, মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের সামনে বেণু। সঙ্গে সুশোভন, অধ্যাপক। প্রফুল্লর হতভম্ভ লেগেছিল— বেণুর তো স্কুলে থাকার কথা— দুপুরে কলেজ স্ট্রিটে আসবে কই বলেনি তো! প্রফুল্ল চিৎকার করে ডেকেছিল— ‘বেণু, বেণু, এই…’ ট্রামের ঘন্টি, বাসের হর্ন, জগৎসংসারের যাবতীয় কলরব তখন কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে। বেণু দেখতে পায়নি প্রফুল্লকে; একমনে রাস্তা পেরিয়ে কফি হাউজের দিকে গেল দুজনে। উপচে পড়ার আতঙ্ক পেয়ে বসল প্রফুল্লকে— আচমকা মনে হল, কলেজ স্ট্রিট ট্রামলাইনের তলায় গরম কফি জমছিল অনেকদিন, আজ যেন মাটি খুলে গেছে; ঠনঠনের দিক থেকে কফির ঢেউ ছুটে আসছে। উত্তাল। প্রথমটায় পালাতে চাইল প্রফুল্ল তারপর গাঢ় খয়েরী কফির স্রোতে গলা অবধি ডুবে গেল। পুড়ে যাচ্ছিল ওর চামড়া। ফোস্কা পড়ছিল সারা শরীরে। কফির গন্ধে নাক জ্বলছিল ওর, গা গুলিয়ে উঠছিল, বমি করে ফেলেছিল রাস্তার মোড়ে। পাতিরাম থেকে লোকজন ছুটে এসে ওকে ধরে, মাথায় মুখে জল দেয়। হাতের বই বমিতে, জলে একাকার।
কফির গন্ধ বকুলগন্ধ থেকে অধিক শক্তিশালী— এমনই কথিত। ক্রমে বাড়ি ফেরার সময় আলাদা হয়ে গেল দুজনের। তারপর একদিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরে বেণুকে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলতে দেখল প্রফুল্ল। পায়ের কাছে উল্টোনো টুল।
পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল প্রফুল্লকে— খবরের কাগজে অনেকদিন ধরে লেখালেখি— বেণুর বাবা, মার অজস্র অভিযোগ, পাড়ার লোকজনের ইন্টারভিউ, ওর বইয়ের দোকানের ছবি। বছরখানেক পরে, শেষ অবধি মুক্তি পায় সে— বেণুর পড়ার টেবিলে সুইসাইড নোট খুঁজে পেয়েছিল পুলিশ। বই ছেড়ে এবারে কেক পেস্ট্রির ফ্র্যানচাইজি নিল প্রফুল্ল— সঙ্গে থামস আপ, চিপস, ক্যাডবেরি, কুরকুরে; দোকানের সামনে ভোরের দিকে নীল ট্রেতে মাদার ডেয়ারির পাউচ। সকালের দিকে দুধ নিয়ে যেত বাজারফেরত মানুষজন; বাকিসময় বিক্রিবাটা প্রায় শূন্য— এ পাড়ার প্রতিটি লোকই সম্ভবত বিশ্বাস করত, প্রফুল্লই বেণুকে খুন করে ঝুলিয়ে দিয়েছিল।
পল্টুদা কয়েকবার লেখালেখি শুরু করতে বলেছিল। ‘আবার আয় পার্টি অফিসে’, এরকমও বলেছিল। প্রফুল্ল সাড়া দেয়নি। বই পড়া এমনকি কাগজ পড়াও ছেড়ে দিয়েছিল। ওর মনে হয়েছিল, জীবন বড় আশ্চর্য জায়গায় এসে থেমে গেছে। মনে হয়েছিল— কোথাও আর যেন এগোনোর নেই। যেন কেউ বিশাল এক পাঁচিল তুলে দিয়েছে প্রফুল্লর সামনে, বড্ড উঁচু আর কঠিন— দেওয়াল ভেঙে, ইঁট বালি পাথর সরিয়ে চলার শক্তি তার আর ছিল না।
দোকান বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবছিল সে। বেণুর আলমারি খুলেছিল— ব্যাঙ্কের, দোকানের কাগজপত্র বের করবে। আলমারির তাকগুলো প্রায় ফাঁকাই। পুলিশ সবই নিয়ে গিয়েছিল। কিছু শাড়ি জামা প্রফুল্ল বিলিয়ে দিয়েছিল নিজেই। একটা দুটো শাড়ি, সম্ভবত ভালো সিল্কের শাড়ি বেণু লন্ড্রিতে দিয়েছিল কোনকালে, সে সব ভাঁজ করে রাখা ছিল এক কোণে। ব্যাঙ্কের কাগজ খুঁজতে গিয়ে একটা শাড়িতে হাত পড়ল প্রফুল্লর। মসৃণ সিল্কের তলায় খচমচ করে উঠেছিল কিছু; প্রফুল্ল পাট করা শাড়ি থেকে টেনে বের করে আনল লালচে কাগজ— নিরানব্বই সালের মার্চ মাসের খবরের কাগজের পাঁচ নম্বর পাতা— এক পিঠে নারী দিবসের ভাবনা, চৌকো ব্লকে ১৯১০-এর স্টুটগার্ট সম্মেলনের প্রস্তাব, ডান দিকের ওপরের কোণে পূর্ব রেলওয়ের ট্রাফিক ব্লকের বিজ্ঞপ্তি, নিচে লাইফ ইন্সিওরেন্সের জীবন আশা-২; উল্টোপিঠে খেলার খবর— কোর্টনি ওয়ালশের চারশো উইকেট, কবাডি খেলোয়াড় বিশ্বজিৎ পালিতের সাক্ষাৎকার, ডানদিকের কোণে সরকারি নোটিস— ‘যেহেতু রাজ্যপালের এরূপ প্রতীতি হইয়াছে যে ধুরখালি ও বানুচক গ্রামের জমি ক্ষেত্রাধিকার তালিকা… তফসিল-মৌজায় দাগের নম্বর, বিবরণ, ক্ষেত্রফল। এক মুহূর্তের জন্য প্রফুল্লর মনে হল— বেণু তখন বেঁচে।
পিছিয়ে যাওয়ার উপায় পেয়ে গেল প্রফুল্ল। ঘুপচি দোকানঘরে বাসি কেক, পেস্ট্রি, ধুলোপড়া চিপসের প্যাকেট নিয়ে বসে থাকে সে। সারাদিন। মাদার ডেয়ারির পাউচ বিক্রি হয়ে যায় ভোরে। তারপর অখন্ড অবসর। নিজের বাড়ির কয়েক বছরের জমে থাকা ধুলো পড়া প্রাচীন সংবাদপত্র, হেমন্তর, অনিলের দোকানের থেকে চেয়ে আনা কাগজ গভীর মনোযোগে পড়ে চলে ঘাড় নিচু করে।
২
আজ আবার পায়ের নিচে মাটির তলায় তোলপাড় শুরু হয়েছিল। যেন মাটির তলায় কেউ আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে। ফাটল ধরছিল পথঘাট, দোকানপাটে, বহুতলে। গোঙানির আওয়াজ আসছিল মাটির তলা থেকে। এই ব্যাপারটা, যতদূর মনে পড়ে, সার্কাসের তাঁবু থেকেই শুরু। শহরে সার্কাস এসেছিল শীতে। সবুজ সোয়েটার গায়ে দিয়ে প্রফুল্ল পোস্টার মারা দেখছিল। পাতলা রঙিন কাগজ নীলচে আঠায় জবজবে করে ঠাকুরবাড়ির পাঁচিলে, লালার দোকানের দেওয়ালে আটকে দিচ্ছিল রোগাভোগা ছেলেটা— গোটানো প্যান্ট, পায়ের কাছে পোস্টারের বান্ডিল, আঠার বালতি। প্রফুল্ল যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে লাল, হলুদ, নীল, আর সবুজে লুডোর ছকের মতো লাগছিল পোস্টারগুলো, প্রতিবারের মতো। প্রফুল্ল জানে, লাল রঙে ট্রাপিজ, নীলে জোকার, হলুদে সিংহ আর চাবুক হাতে রিংমাস্টার, সবুজটা রহস্যময়। সেখানে কখনও একটা মেয়ে দুহাতে ভর দিয়ে পা মাথার ওপরে করে, সেই পায়ের পাতায় দাঁড়িয়ে আরেক মেয়েমানুষ নাচের ভঙ্গিতে অথবা টুলের ওপর পা রেখে শুঁড়ে বল নিয়ে হাতি। খুব নজর করে দেখলে, পোস্টারে জলছাপের মতো কালো টুপি পরা একটা লোক, হাতে কালো সাদা ছাপ ছোট লাঠি। লুডোর ছক টানছিল প্রফুল্লকে— বলা যায়, জলছাপের মধ্যে লোকটাই। ফলত প্রফুল্ল বড়দিনের রাতে সার্কাসের মাঠে যায় এবং টিকিট কেটে ফার্স্ট রোতে বসে।
ট্রাপিজ শেষ হয়ে গিয়ে তখন খেলা দেখাচ্ছিল জাদুকর। টুপি থেকে খরগোশ, রুমাল থেকে ফুল বের করে আনছিল। হাততালির ঝড় বইছিল অ্যারেনায়। সার্কাসের আলোয় মুখ দেখা যায়, চেনা যায় না। প্রফুল্ল ফার্স্ট রোয়ে বসে জাদুকরকে দেখছিল— ম্যানড্রেক টুপি, কালো রোবে লাল সোনালী তারার ডিজাইন। হঠাতই জাদুকর তার জাদুদণ্ড নাচিয়ে বলেছিল— ‘কী চাও? ঠিক এই মুহূর্তে কী চাও?’
প্রফুল্ল বিড়বিড় করে বলেছিল, ‘আমার অর্ধেক জীবন। বেণুকে আবার দেখতে চাই।’ জাদুকর টুপিওলা মাথা নেড়ে বলল, ‘চোখ বুজে হাত বাড়াও সামনে।’ সে টান করে হাত বাড়াল, হাতের নীল সবুজ শিরা জেগে উঠল চামড়ার তলায়; চোখ বুজল প্রফুল্ল। চোখ বন্ধ করায় সার্কাসের বাজনা যেন আরো উদ্দাম হয়ে কানে আসছিল। তারপর হাতের ওপর একটা তিরতিরানি। চোখ খুলে প্রফুল্ল দেখেছিল, বাজনা থেমে গেছে, অ্যারেনা শূন্য, লাল নীল আলো জ্বলছে নিবছে তাঁবু জুড়ে আর তার হাতের তেলোর ওপর যেন একটি স্বচ্ছ নীল ডিম— তার মধ্যে প্রফুল্লর অর্ধেক জীবন। শৈশব, কৈশোর, প্রথম যৌবন গুটিয়ে এইটুকুনি হয়ে হলুদ কুসুমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে।
ডিম হাতে নিয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না প্রফুল্ল। সার্কাসের তাঁবুর বাইরের একটা চেয়ারে বসে রইল গুটিশুটি মেরে। আকাশ থেকে হিম নামছিল। সার্কাসের জামায় হেঁটে যাচ্ছিল লোকজন। বেলুন হাতে বাচ্চারা। গায়ে তাদের পশমের জামা, মাথায় কানঢাকা টুপি। এমন সময়, পাশে এসে বসল ম্যানড্রেক টুপি, আলখাল্লা। জাদুকর। প্রফুল্লর হাতের তেলোয় রাখা ডিমটা লাট্টুর মত ঘুরিয়ে দিয়ে বলল— কার্নিভাল শুরু হো-ও-ও-ও-ক।
অমনি ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজল। মিলিয়ে গেল মানুষজন, আলো, তাঁবু। প্রফুল্লর পায়ের তলার মাটি কেঁপে উঠল। যেন ঢেউ উঠল রেলস্টেশনের দিক থেকে; তারপর মাঠ পেরিয়ে, বাজার পেরিয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছল ঢেউ আর চৌরাস্তার মোড়ে ফাঁক হয়ে গেল মাটি— প্রফুল্লর যেন জানাই ছিল কী করতে হবে— মন্ত্রমুগ্ধর মত নেতাজির মূর্তি খুলে আনল প্যাঁচ ঘুরিয়ে। প্রথমে একটা রক্তমাখা হাত বেরিয়ে এসেছিল; জাদুকর বাঁশি বাজিয়ে বলেছিল, ধরো হাত— দশ গুনছি— দশ, নয়, আট, সাত, ছয়, পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক, শূন্য… প্রফুল্ল হাত টেনে ধরল— মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল ছোটখাটো বুড়ো মানুষ— পাকা চুল দাড়ি— বুকে, মাথায় রক্তের ছোপ; বেরিয়ে এসে ধুলো টুলো ঝাড়ল জামা থেকে। প্রফুল্ল অবাক হয়ে দেখছিল। তারপর হাত বাড়িয়ে নিজের নাম বলল। প্রফুল্লকে জড়িয়ে ধরল বুড়ো তারপর নাম বলেছিল; একটু থেমে নিবাস— ‘মহম্মদ আখলাখ সইফি, দাদরি, উত্তরপ্রদেশ, ভারত।’ যাদুকর মাথা দুলিয়ে খিলখিল করে খুব হাসল, তারপর নিজের সাদা কালো লাঠি প্রফুল্লর হাতে দিয়ে স্রেফ মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। এবারে সব কিছু জানা— মনে হয়েছিল প্রফুল্লর। যেন কতদিনের অভ্যেস, এমনিভাবে ম্যানড্রেকের কায়দায় লাঠি দোলাল সে; দেখল, রেলস্টেশন, বাজার, চৌরাস্তা, নেতাজির মূর্তি পেরিয়ে একটা ভেলভেটের পর্দা উঠছে, ভাঁজে ভাঁজে উপরে উঠছে— সিনেমাহলের মতো। পর্দা উঠতেই সবুজ বিস্তীর্ণ প্রান্তর, রামধনু উঠেছে আকাশ ছেয়ে, ছোট ঘরদোর, পুকুর, গাছপালা, পাখি, প্রজাপতি। আখলাখ হাত নেড়ে, মাঠ পেরিয়ে রওনা হল— যেন কতকালের চেনা পথ পেরিয়ে সে বাড়ি ফিরছে— ভাত ফুটছে, দুধ উথলোচ্ছে তার গেরস্থালিতে; সে ফিরবে, স্নান করলেই ধুয়ে যাবে রক্তের ছোপ, ধুলো, দুটি ভাত নিয়ে খেতে বসবে তারপর।
এভাবে মাঝেমাঝেই প্রফুল্লর পায়ের তলার মাটি কাঁপে। কাঁপে, কাঁপে, কেঁপেই চলে। প্রফুল্ল পুরনো কাগজ থেকে চোখ তোলে তখন। কাগজ ভাঁজ করে রেখে চৌমাথার মোড়ে এসে দাঁড়ায় তারপর। প্যাঁচ খুলে সরিয়ে আনে নেতাজি মূর্তি। মাটির গভীর থেকে হাত বের করে বুড়ো, বুড়ি, শিশু, তরুণ তরুণী। কারও গলায় আঙুলের দাগ, কালশিটে, বুকে, পেটে, মাথায় গভীর ক্ষত, কারও হাত নেই, পা নেই, চোখ খুবলানো; বর্শায় এফোঁড় হয়ে গিয়েছে কেউ, হয়তো মুখের সামনেটাই নেই; অস্পষ্ট মুখ, ছায়াময় অবয়ব। কখনও আবার খুব স্পষ্ট চেহারা, পরিচয়। প্রফুল্ল শুধু মাটির মুখ খুলে দেয়, হাত বাড়িয়ে তুলে আনে তাদের। একদিন একসঙ্গে অনেক শিশু উঠে এসেছিল— শিশু, বালক, বালিকা। প্রফুল্ল গুনেছিল উনিশ। গোলাপী টুপি, গোলাপী সোয়েটার; সাকিন— নিঠারি, ভারত। প্রফুল্লর হাত টনটন করেছিল সেদিন। তারপর সাদা কালো লাঠি ঘুরিয়ে পর্দা খুলে দিয়েছিল ওদের। পর্দা পেরিয়ে নিবিড় মাঠ, মাঠের ওপর রামধনু, ঘরদোর, বাচ্চাদের স্কুল— সকালের প্রার্থনা হচ্ছে।
আজ আবার সকাল থেকেই মাটি যেন ছটফট করছিল পায়ের তলায়— প্রথমে হাল্কা তরঙ্গ তারপর ছটফটানির ঢেউ ছড়িয়ে যাচ্ছিল রেললাইন থেকে চৌমাথায়। প্রফুল্ল কাগজ সরিয়ে দোকানের বাইরে এল। মাটির তলা থেকে ঢেউ ধাক্কা দিচ্ছিল রাস্তায়, ফুটিফাটা হয়ে যাচ্ছিল পুরনো পথঘাট, চিড় ধরছিল বাড়িতে, দোকানে, উল্লম্ব ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা ভেঙে খসে পড়ছিল চাঙড়। নেতাজি মূর্তির প্যাঁচ আলগা হয়ে গিয়েছিল। প্রফুল্ল এক পাক ঘোরাতেই খুলে গেল ধরণীর মুখ। নখওলা লোমশ থাবা উঠে এল আজ। কমলা কালো ডোরা। তার ওপর লাল রক্তের ছোপ।
এগোনো কি পিছোনো কিছু জানে না প্রফুল্ল, কিন্তু তার এখন একটা নিজের জায়গা হয়েছে। জাদুকরের দিয়ে যাওয়া লাঠি ঘোরালেই সেইখানে পৌঁছনো যায়— বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর রামধনু, তারপর ছোট শহর। হয়ত শহর নয়, গঞ্জ সম্ভবত। ছোট একটা গঞ্জ। প্রফুল্লর একদম নিজের। নিজের বাজার, নিজের সেলুন, সিনেমাঘর, ইস্কুল, সার্কাস, পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে, নিজের একটা পুকুর, বিশাল বনে পিলভিটের বাঘিনী, লালগড়ের বাঘ। ওদের আড়াল করে, ভেলভেটের পর্দা টানা থাকে। প্রফুল্ল সেই পর্দার বাইরে বসে কাগজ পড়ে। উপচে পড়ার ভয় আর নেই প্রফুল্লর। বরং মাটি কেঁপে ওঠার অপেক্ষা করে সে। ওর খুব মনে হয়, একদিন, হয়ত বেণুর হাত উঠে আসবে মাটির নীচ থেকে। কোনও একদিন।
কতদিন হয়ে গেছে, বেণুকে দেখেনি প্রফুল্ল। বেণুও তো দেখেনি তাকে। বেণু যদি পথ চিনতে না পারে— পুরনো কাগজ পড়তে পড়তে ভাবছিল প্রফুল্ল। ভাবছিল, এবারে, গঞ্জের একটা নাম দেওয়া দরকার।
Comments
Post a Comment