পরীছাঁট

রবিবারের বিকেলে শপিং মলের এস্ক্যালেটরের সামনে দাঁড়িয়ে অ্যান হ্যাথওয়েকে মনে করার কথাই নয় অদিতির। অ্যান হ্যাথওয়ের সিনেমা সে খুব কমই দেখেছে - দুই মেয়ের সঙ্গে প্রিন্সেস ডায়ারি আর হিমানীশের সঙ্গে ডেভিল ওয়ারস প্রাডা দেখেছিল। আর কি একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে সং ওয়ানের একটা ট্রেলার- অথচ এই রবিবারের বিকেলে এস্ক্যালেটর থেকে নেমে ঐ ট্রেলারটাই মনে এল অদিতির। এই শপিং মলের উপচে ভরা ভীড়, আলোকোজ্জ্বল বিপণি, এস্ক্যালেটর, স্যান্টা ক্লজ , শেষ বিকেলের রোদ্দুরটুকু, গোটা মল জুড়ে ক্রিসমাসের সাজ-সব ছাপিয়ে সং ওয়ানের অ্যান হ্যাথওয়ের মুখ ওর একটা সুপ্ত ইচ্ছে জাগিয়ে তুলল। আসলে অদিতি নিজের জন্য সময় দেয় নি কোনদিন; জামা কাপড় , জুতো, নিজের লুক-কোনো কিছু নিয়েই সেভাবে ভাবে নি। শপিং মলে যতবারই এসেছে-মেয়েদের নিয়ে , হিমানীশের সঙ্গে বা কখনও বন্ধুদের সঙ্গে-প্রতিবারই কী কিনবে , কী করবে, কোথায় খাবে আগেই ঠিক করে এসেছে - তারপর কেনাকাটা ক'রে, সিনেমা দেখে, খেয়ে দেয়ে ফিরে গেছে। আজ পুরো এক ঘন্টা শুধুই নিজের জন্য হাতে পেয়ে খানিক অবাক হয়ে গিয়েছিল প্রথমটায়, তারপর ঈষৎ দিশেহারা। একটা খেলনা ভর্তি ঘরে ছোটো বাচ্চাকে ঢুকিয়ে দিলে যা হয়-অদিতির ঠিক সেইরকম লাগছিল-যেহেতু কি করবে আগে থেকে ঠিক নেই, চাপা উত্তেজনা হচ্ছিল , কিছু একটা করা দরকার এরকম মনে হচ্ছিল অথচ ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। আবার এই উত্তেজনাটুকু যে ওর মধ্যে বেঁচে আছে সেটা বুঝতে পেরেও শিরশির করে আনন্দ হচ্ছিল। অজস্র দোকান ওকে ঘিরে, বিবিধ পসরা- অদিতি একের পর এক দোকানে ঢুকছিল, মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসছিল আবার পরের দোকানে ঢুকছিল। বই কিনবে না কি কুর্তি না একটা টি সেট -সে নিয়ে ধন্ধে পড়ছিল। আবার এই ধন্ধে পড়াটাও উপভোগ করছিল খুব। অথচ ঘটনা খুবই সাধারণ। অদিতিরা দুপুরে মলে এসেছিল-এক বৈদ্যুতিন সামগ্রীর দোকানে। লোক উপছে পড়ছিল শপিং মলে-ক্রিসমাস সামনেই। অদিতির বরের ল্যাপটপের গন্ডগোল, লজিক বোর্ড বদলাবে না নতুন মডেল কিনবে সেই নিয়ে কথা বলছিল দোকানে , বিবিধ ল্যাপটপের মডেলের বৈশিষ্ট্য শুনছিল মন দিয়ে, নিজের মতামত দিচ্ছিল, মাথা নাড়ছিল; দুই মেয়ে ডিসপ্লে করা ট্যাব, ফোন, ল্যাপটপ ছুঁয়ে ছেনে খেলে বেড়াচ্ছিল। অদিতি প্রথমে ভিতরেই ছিল। হঠাৎই মনে হয়েছিল-বড্ড ভীড়। দোকান থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে বসেছিল। অদিতির বসার জায়্গা আর দোকানের মাঝখান দিয়ে জনস্রোত বয়ে যাচ্ছিল। নিজের স্বামী কন্যাদের দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিল অদিতি। কখনও হিমানীশের চেক শার্টের কাঁধের অংশ দেখছে , কখনও দুই মেয়ের ফ্রকের কোণা, বা টী শার্ট অথবা হেয়ার ব্যান্ড। একটু দূরের লাগছিল তিনজনকেই। যেন এক নদী পেরিয়ে চলে এসেছে অদিতি, অন্যপাড়ে হিমানীশ আর মেয়েরা। উঠে দাঁড়িয়েছিল অদিতি তারপর রেলিংএ ভর দিয়ে দেখছিল এস্ক্যালেটরের নামা ওঠা, দেখছিল ক্রিসমাস ট্রী, আলোকমালা, বিশাল বেথেলহেম স্টার, দেখছিল অজস্র মানুষের স্রোত, কেনা কাটা - এক দল অল্পবয়সী মেয়ে হৈ হৈ করে ঢুকল বিউটি পার্লারে, বাবা মা আর ছেলে ঢুকল জুতোর দোকানে , পাশের দোকান থেকেই বেরিয়ে এলো তরুণ দম্পতি , তিনটি মেয়ে আইসক্রীম খেতে খেতে সেল্ফি তুলল।
কোনোদিন একলা কিছু করে নি অদিতি, একলা সিনেমা দেখে নি, একলা আইসক্রীম খায় নি, একলা ট্রেনে চড়ে যায় নি কোনখানে- এই সব হঠাৎ অদিতির মনে হতে লাগল। এই জনস্রোতের কতজন আজ অদিতির মত নদীর অন্য পাড়ে চলে এসেছে হঠাৎ- জানার ইচ্ছে হচ্ছিল। দুটো তিনটে চারটে ভাষায় কথোপকথন কানে আসছিল। কফি, পারফিউম আর ফুলের গন্ধ পাচ্ছিল অদিতি। ভালো লাগছিল।ও টেক্স্ট করল হিমানীশকে-'দেরী হবে?'
-'আরো ঘন্টাখানেক লেগে যেতে পারে, তুমি শাড়ি টাড়ি দেখো ততক্ষণ। না কি?আমাদের কাজ হয়ে গেলে ফোন করব।'
অদিতি এস্ক্যালেটর বেয়ে নিচের তলায় এলো।সামনেই বিউটি পার্লার, জামা কাপড়, জুতোর দোকান , স্যালন। আর একটু এগিয়ে বইএর দোকান, কফি শপ, খেলনাপত্র। আরো একটু এগিয়ে এস্ক্যালেটর উঠে গেছে সিনেমা হল অবধি। দুটো কুর্তি নিজের ওপর ফেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল , ডিসপ্লে করা নানা রকম জুতো দেখল খানিক তারপর স্যালনের সামনে এল। স্যালনের বাইরে নানা ছাঁটের নানা রঙের চুলের মেয়েদের ছবি, অদিতি কাচ দরজা দিয়ে দেখল-ভেতরে দেওয়াল জোড়া আয়নার সামনে হেলানো সিটে বসা নানা বয়সের মহিলা; কালো জামা কালো প্যান্ট পরা হেয়ার ড্রেসাররা শ্যাম্পু করছে, চুল কাটছে। হেয়ার ড্রেসারদের মাথায় ক্রিসমাস হ্যাট। ঠিক তখনই অ্যান হ্যাথওয়ের মুখ ভেসে এল। আসলে দীর্ঘদিনের একটা ইচ্ছে মাথা তুলল হঠাৎ। অদিতি চিরকালই নরম সরম। মুখের ওপর কথা তো দূরে থাক, না বলতে পারে নি কাউকে আজ অবধি। চিরকালই ভীড়ে মিশে থেকেছে খানিকটা অদৃশ্য হয়ে। অথচ মনে মনে খুব ধারালো একটা ব্যক্তিত্ব পেতে চেয়েছে চিরকাল -অল্পবয়সে, সুচিত্রা মিত্র আর কমলিকা ভট্টাচার্য ওর পছন্দের ব্যক্তিত্বের তালিকায় প্রথমদিকে ছিল। আবছা মনে হ'ত ওর চুল ঐ রকম হ'লে ও হয়ত বদলে যাবে। প্রখর উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব হয়ে যাবে অদিতিও। এসব যে অদিতি খুব বিশ্বাস করত তা নয়, ঐ রকম চুল কাটার একটা আলতো আকাঙ্খা তুলোর আঁশের মত বসে থাকত ওর ভাবনার ওপরে। চুল কাটার ইচ্ছে বাড়িতে জানালে, অদিতির মা'র সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল-'ঐ সব স্টাইল বিয়ের পরে কোরো । এখন পড়াশোনা শুধু।' অদিতি যেমন- মুখ তুলে তর্ক করেনি একবারও। তারপর ভুলেই গিয়েছিল। বস্তুত পড়াশোনা, পরীক্ষা, স্কুলের চাকরি, সংসার সব নিয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে চুল কাটার কথা আর মনে হয় নি কোনদিন। ঘন লম্বা চুল, বিণুনী, খোঁপা -এসব নিয়ে তার স্বামীর, বন্ধুদের এবং একেবারেই অপরিচিত জনের মুগ্ধতা সে দেখেছিল। সেটাও ভুলে যাওয়ার একটা কারণ সম্ভবতঃ। আজ অ্যান হ্যাথওয়েকে মনে পড়ে গেল আর তুলোর আঁশটা এত দিন পরে উড়ে এসে আবার ওর গায়ে বসল। পেটের ভিতরে প্রজাপতি টের পেল অদিতি, বুকে একটু সংকোচ আর এক ছটাক দ্বিধা; পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইচ্ছেটা এমন জোরালো হয়ে উঠল যে কাচ দরজা ঠেলে সটান স্যালনে ঢুকে পড়ল সে।

অদিতি শেষ চুল কেটেছিল ক্লাস ফোরে। বস্তুত নেড়া হতে হয়েছিল - স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড শম্পার থেকে উকুন এসেছিল মাথায় । বাড়িতেই চুল কাটা হয়েছিল। স্বপনদা বাড়িতেই ক্ষুর কাঁচি নিয়ে এসেছিল; অদিতি বসেছিল একটা মোড়ায়, বাড়ির উঠোনে। মা আর ঠাকুমা পাশে ছিল। একটা সাদা চাদর ওর গায়ে জড়িয়ে প্রথমে কাঁচি দিয়ে চুল কেটেছিল স্বপনদা। তারপর ক্ষুর দিয়ে চেঁছেছিল।

এই স্যালনের নাম জাস্ট কাট-ওয়াক ইন স্যালন -লেখা ছিল কোথাও। কাউন্টারে গিয়ে নাম লেখালো অদিতি। চশমা পরা হাসিখুশি একটি মেয়ে এলো অদিতির চুল কাটতে।
-'শ্যাম্পু করাবেন? ব্লো ড্রাইং?'
-'অত কিছুর তো সময় নেই আজ, শুধু চুল কাটব।'
-'কতটুকু কাটবেন? জাস্ট ট্রিমিং তো?'
-'না পিকসি কাট'।
-'আর ইউ সিওর? ওন্ট ইট বী আ বিট টু এক্সট্রীম?'
-'না না আমি সিওর।'
-'বব করে দি বরং। মানাবে আপনাকে।'
-'না পিক্সি কাটই । আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।'
-'আপনার ফেমিনিন লুকটা কিন্তু চলে যাবে'
-' আপনি কাটুন তো। আচ্ছা, কতক্ষণ লাগবে?'
মেয়েটি অদিতির বিণুণী খুলে, কাঁচি চালায়। কাঁচির চলন ওর পিঠ বেয়ে কাঁধে, তারপর ঘাড়ে ওঠে ,হেয়ারলাইন স্পর্শ করে। অদিতি সামান্য শিউরে চোখ বুজে থাকে।
-' নাউ উই আর গোইং অ্যারাউন্ড ইওর ইয়ার'
ঘাড়ের কাছে হাল্কা লাগে। কানের পাশ থেকে , কপালের ওপর থেকে চুলের গুচ্ছ পায়ের ওপর ঝরে পড়ছে টের পায় সে।
-'দেখে নিন এবারে, হয়ে গেছে।'
চোখ খুলে চমকে গেল অদিতি-আয়নায় অল্পবয়সের সুচিত্রা মিত্র। খুব ধারালো আর ঝকঝকে -একেবারে অন্য এক অদিতি।নতুন।
-' ও মাই গড! হোয়াট আ জ লাইন ইউ হ্যাভ গট। লুক অ্যাট ইওর চীকবোন, বিউটিফুল! এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলেন এই ভাবে?'
অদিতি হাসে।
মেয়েটি চশমায় আঙুল ঠেকিয়ে অদিতিকে আবার দেখে তারপর বলে-'আই গেভ ইউ আ নিউ উওম্যান, কমপ্লিটলি নিউ উওম্যান। টেক গুড কেয়ার অফ হার।মেরি ক্রিসমাস।'

নতুন অদিতি স্যালনের বাইরে এসে ক্রিসমাস ট্রীর সামনে দাঁড়িয়ে সেল্ফি তোলে।তারপর এস্ক্যালেটরে ওঠে। খুব হালকা লাগতে থাকে । কাচ দেওয়ালে নিজেকে দেখে আর চোয়ালে, গালে আঙুল বুলোয় আলতো করে।
হিমানীশ আর মেয়েরা তখনও দোকানেই।' আর কতক্ষণ ? 'টেক্স্ট করে অদিতি।
হই হই ক'রে বেরিয়ে আসে হিমানীশ , দুই মেয়ে -হাতে প্যাকেট।
-'দ্যাখো কত কি কিনেছি।এমা ,একী করেছ মা?'
-'ইশ কি করেছ চুলে? একদম ছেলেদের মত লাগছে তোমাকে-অদিতি তুমি না-উফ-'
-'এইটুকু সময়ের মধ্যে ডিসিশন নিয়ে নিলে? বললেও না আমাদের!'
-'তোমার চেহারায় মানায় না কি এই সব'?
-'এইভাবে চুল কাটলে বয়স কমে যাবে ভেবেছে তোদের মা!'
-'একদম মা মা লাগছে না তোমাকে-'
-'কী যে কর তুমি! এক ঘন্টাও হয় নি-এর মধ্যে কি সব করে এলে!'
-'পুরো দিনটা ঘেঁটে দিল-দ্যুৎ!'

এই মুহূর্তে নতুন আর পুরোনো অদিতিকে ঘিরে আলোজ্বলা দোকানপাট, মানুষের নদী , স্যান্টা ক্লজ, বেথেলহেমের তারা-

হয়ত নতুন অদিতি বলতে গেল -'আমার চুল , আমার ইচ্ছে, আমার টাকা, আমার সময়।'
হয়ত পুরোনো অদিতি তার গলা টিপে থামিয়ে দিল; চোখ নামিয়ে নরম গলায় বলল, 'নাক কান নয়, চুল ই তো,আর কাটব না। আবার আগের মত হয়ে যাবে, দেখো। রাগ কোরো না, প্লীজ, রাগ কোরো না।'
হয়ত ঠিক উল্টোটাই।

আসলে তো একটা ম্যাজিক হওয়ার কথা এইখানে -
এত ভীড়ে কিছু শোনা যায় না।

Comments

  1. Darun likhhechhis.... Sob kichhu nijer thakleo oneker nijer ta nijer hoy na...














    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

চরাচরের পাখিরা

কোলক্লিফ, ২০২৩

সলস্টিস