মৃগদাব
সুখ বলতে সুপর্ণার চোখে একটা ছবি ভাসত -সে ছবির কতখানি সত্য কতখানি মনগড়া না কি পুরোটাই স্বপ্ন -সুপর্ণা জানে না। সুখ ভাবলে কোথাও যেন কিরকির শব্দ করে প্রজেক্টর চালু হয়ে যেত আর একটা সাদা কালো ভিডিও ক্লিপ দেখতে পেত সুপর্ণা- চোখের একদম সামনে। সুপর্ণা দেখত, একটা চওড়া রাস্তা-নতুন সব ঘরদোর তৈরি হচ্ছে একদিকে-পাঁজা পাঁজা ইঁট, সিমেন্ট , বালি, স্টোনচিপসের ঢিপি, ভারা বেঁধে কাজ , অন্যদিকে অজস্র কাশফুল আর মহালয়ার আগের দিন বেলা দশটা নাগাদ মা বাবা আর সুপর্ণা রিকশা করে যাচ্ছে। সে ছবিতে রোদ চড়া নয়-নীল আকাশ ; আর সেই আকাশের নিচে পিচঢালা নতুন রাস্তা ধরে যেন এক গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্নে যাচ্ছে সুপর্ণা, যেন ফিরবে সন্ধ্যায় , যেন বিকেলে আর পড়াশোনা নেই তার। তারপর যেন শেষরাতে মহালয়া শুনবে, আর তারপরদিন রবিবার। সোমবারে যেন কোনো ক্লাস টেস্ট নেই বরং পুজোর ছুটি পড়ে যাবে দুপুরে। এব্যতীত গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্নের মেনুতে ফিসফ্রাই একথাও যেন জানা গেছে আগেই। একটার পর একটা সুখবোধ, আনন্দ, ভালো লাগা যেন মুক্তোর মালার মত পরপর গাঁথা- যেন কোথাও কোনো ফাঁক নেই, যেন বিষাদ কিংবা দুঃখ ঢোকার কোনো পথই খোলা নেই। ঘটমান বর্তমান আর অদূর ভবিষ্যত মিলিয়ে সেই ভিডিও ক্লিপ কেই সুপর্ণা সুখ বলে জেনেছে এতকাল। সেই মালার মত নিরবচ্ছিন্ন সুখ পেতে হ'লে দাম ধরে দিতে হয়-এই কথাটা অবশ্য সুপর্ণা ধীরে ধীরে জেনেছে। কোনো কোনো রাতে ব্যালকনিতে বসে থাকতে থাকতে করুগেটেড ফাইবারের শেডের ভেতর দিয়ে চাঁদের মালা দেখত সুপর্ণা। অখ্ন্ড একটানা। এই দেখার পিছনে কোনো এক শারীরবৃত্তীয় বা নিছক ভৌত কারণ আছে যেটা সুপর্ণা জানত না অথচ এই চাঁদের মালা যে চোখের আড়াল হতে দেওয়া চলবে না এই রকম তার মনে হ'ত। এইভাবে নিরবচ্ছিন্ন সুখবোধে সে মজতে থাকে, সেইমত নিজেকে ট্রেইন করে তারপর অভ্যস্ত হয়ে যায়। অখন্ড সুখবোধের মূল্য সে চুকিয়ে আসছে আজ চল্লিশ বছর। কারোর কোনো কথায় কোনোদিন না বলেনি সুপর্ণা।
এই যেমন আজ এই ট্যুরিস্ট লজের ঘরে সে আর অতনু বিয়ের কুড়ি বছর উদযাপন করতে এসেছে, সেও অতনুর ইচ্ছায়, অতনুর পছন্দে। কোথায় যাবে, হোটেলে থাকবে না ট্যুরিস্ট লজে, কি খাবে সবই অতনুর ছকে দেওয়া। অখন্ড সুখবোধের চাঁদমালা সুপর্নার হস্তধৃত এতদিনে, সে তা হাতছাড়া করতে চায় নি, বলাই বাহুল্য। অতনুর সঙ্গে ওর বিয়েটাও এভাবেই- সুখের মডেল অনুসারী। মায়ের প্রতিটি কথায় সে হ্যাঁ বলেছিল-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ায়, পাত্রপক্ষের মেয়ে দেখতে আসায়, অতনুকে কেমন লাগল প্রশ্নের উত্তরে সে হ্যাঁ বলেছে, ঘাড় কাত করে মাথা নেড়েছে। রোম্যান্সের সামান্য একটা সুতো ছিল অবশ্য-যেদিন অতনু ওকে দেখতে আসে সেই আশ্বিনের সকালে আকাশবাণী কলকাতা ক র সাতটা চল্লিশে 'শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে' বেজেছিল, সন্ধ্যায় অতনু সহ পাত্রপক্ষ সুপর্ণাদের বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার এক ঘন্টার মধ্যেই ফোন এলে , ফোনের ওধারের হবু জা, ফোনের এধারের বা মা জেঠু জেঠিমা সুপর্ণার উত্তরের প্রত্যাশী হয়। সুপর্ণার কানে শরতে আজ কোন অতিথি বাজতে থাকে এবং সে এক সেকেন্ডের কম সময়ে হ্যাঁ বলে। এ বিষয়ে গিনেস রেকর্ড বুকে কোনো রেকর্ড আছে কি না জানা ছিল না কারোরই , তবু সুপর্ণার মা অবাক হয়ে বলতে থাকে-'আরেকটু সময় নিয়ে ভাবতে পারতি,' বাবা বলেছিল, 'স্বচ্ছন্দে না বলতেই পারিস'। এখন 'না' বললে , আবার কবে এই রকম পরিস্থিতি আসবে এবং আজকের আর সেই ভবিষ্যত পরিস্থিতির মাঝে ফারাক কতদিনের এবং সর্বোপরি সেই ফারাকে অখন্ড সুখবোধের মডেলটি বিপর্যস্ত হয়ে যাবে কি না সে বিষয়ে কোনো অদৃশ্য অঙ্ক কষা সুপর্ণার মনে চলতে থাকে এবং ফলশ্রুতি 'হ্যাঁ' তে দাঁড়ায়।
এই সব ছিল পুরোনো কথা। আজ ওরা অন্য শহরে। এই শহরে সবাই হরিণ দেখতে আসে। রিসর্টের ঘরে ঘরে বিছানার চাদরে হরিণের মোটিফ, বিলবোর্ডে হরিণের ছবি, বাজারে হরিণ আঁকা টি শার্ট, হরিণের সফট টয়, রাস্তায় তীরচিহ্ন দিয়ে, একাধিক ভাষায় 'ডিয়ার পার্ক এই দিকে' লেখা। আজ সকালে রিসর্টে পৌঁছনোর পরেই অতনু দরজা বন্ধ করেছে, দুপুরে 'চলো তোমাকে এখানকার ফেমাস বিরিয়ানি খাওয়াই' বলেছে-এসবই সুপর্ণার হস্তধৃত সুখের মালায় একদম খাপে খাপে ফিট করে গেছে। রোদ পড়লে বিকেলে ওরা ডিয়র পার্কে হরিণ দেখতে যাবে-এরকমই কথা হয়ে আছে। সুপর্ণা এখন অতনুর পাশে শুয়ে , বালিশে মাথা, এ সি মেশিনের মৃদু আওয়াজ আসছে, ভারী পর্দার বাইরে দুপুরের রোদ, পাশের ঘরে বড় গোছের একটা গ্রুপ সদ্য চেক ইন করল। হাল্কা কথা শোনা যাচ্ছে করিডোরে, একটা বাচ্চা একটানা গাইছে, হুড় হুড় হুড় দাবাং দাবাং। এক কথায়, ঘটমান বর্তমান বা অদূর ভবিষ্যতে কোনো বেদনাবোধের স্থান নেই।
ওদের রিসর্ট থেকে ডিয়ার পার্ক মিনিট পঁয়্তাল্লিশ, সূর্য ডোবার সময়ে হরিণরা দল বেঁধে জল খেতে আসে। ট্যুরিস্টরা সানসেট , জলস্রোত আর হরিণের পালকে এক ফ্রেমে ধরে নিয়ে বাড়ি যায়। বেরোনোর আগে অতনু ক্যামেরার ব্যাটারি চেক করল। রিসর্টের বাসে আরো দুটি দল , সানগ্লাস, টুপি, জলের বোতল। বাচ্চা ছেলেটা একই গান গেয়ে চলেছে -হুড় হুড় হুড় দাবাং দাবাং। হুড় হুড় হুড় দাবাং দাবাং।
যদিও বিকেল, রোদ এখনও চড়া, উল্টো দিক থেকে হু হু ট্রাক , বাস, অ্যাম্বাসাডর মারুতি, দুপাশে ধানক্ষেত, কাশের গোছা, রাস্তায় কোথাও কোথাও ধান শুকোতে দেওয়া আছে। ড্রাইভারের পাশের সিটে অতনু যাত্রাপথের টানা ভিডিও তুলছে , পরে এডিট ক'রে ফেসবুকে আপলোড করে দেবে। দাবাং দাবাংএর দল আর অন্য দলটি সূর্যাস্তের সময়ে জলের কাছে পৌঁছোনো নিয়ে সামান্য চিন্তিত। বাসের ড্রাইভার 'বালম পিচকারি' চালিয়ে দিয়েছে। এই সময় , সামনে রাস্তার ওপরে একটা ভীড় দেখতে পেলো সুপর্ণা। অতনুও দেখেছে সম্ভবতঃ। ড্রাইভার গান বন্ধ করে বাসের গতি কমালো। যে ভীড়টা দূর থেকে ছোটো মনে হচ্ছিল, কাছ থেকে তাকে আর ছোটো লাগছিল না সুপর্ণার। উপরন্তু রাস্তার এদিকের ধানক্ষেত , ওদিকের ইঁটভাটা পেরিয়ে আরো কিছু মানুষ রাস্তায় এসে উঠতে লাগল। কিছু লোকের হাতে বাঁশ লাঠি আর টাঙ্গি দেখল সুপর্ণা। ভীড়ের মধ্যে থেকে দুজন হাতে গামছা নাড়তে নাড়তে বাসের দিকে এগিয়ে এলে, ড্রাইভার বাস থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাবাংএর দল চেঁচিয়ে বলল, 'কেউ নামবেন না বাস থেকে, প্লীজ, প্লীজ', অতনু 'কি হ'ল' বলতে না বলতেই , বাসের গায়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে কেউ বলল, 'এই রাস্তা বন্ধ, বলছি না ব্যাক করতে'। ড্রাইভারের পাশের জানলার কাচ নামানো ছিল, সেখানে মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে কেউ বলল-'বলছি না,ব্যাক করতে! কানে কথা যায় না?' অতনু মুখ বাড়িয়ে বলল, 'কি হয়েছে, কি হয়েছে ভাই'? ঐ ভীড়কে মোটামুটি দুভাগে ভাগ করতে পারছিল সুপর্ণা- একটা দল যাদের হাতে লাঠি, বাঁশ, অন্য ভাগটা স্রেফ দর্শক।, অতনুর দিকের ভীড়টা মূলতঃ দর্শকের।সেখান থেকেই কেউ বলল-'মোষ চুরির ধোলাই চলতেসে।' সুপর্ণা এই বার দেখতে পায় ভীড়ের ভেতরে আরেকটা ছোটো ভীড় , সেই ছোটো ভীড়ের মাঝখানে কেউ শুয়ে-বিকেলের রোদে শুধু শুষ্ক দুটি পায়ের পাতা ; লাঠি হাতে লোকদুটি বাসের জানলা ছেড়ে আবার ভীড়ের দিকে দৌড়ে যায়।
অতনু কপাল মুছে বলে,' যত্তো সব ঝামেলা , ব্যাক করে ডানদিকের মাটির রাস্তায় চলো, ওখান থেকে হাইওয়ে ধরলে এখনও সানসেট দেখা যাবে।‘
বাকি পথ একদম ঝামেলা রহিত ছিল। শেষ বিকেলে ওরা জলের কাছে, হরিণের কাছে, সূর্যাস্তের কাছে ঠিকই পৌঁছতে পেরেছিল, ছবি উঠেছিল অনেক, সেল্ফিও।
সে রাতে রিসর্টের ডাইনিং হলের ৩৯ ইঞ্চি স্ক্রীনে সংবাদ্পাঠক মোষ চোর সন্দেহে এক কলেজ ছাত্র হত্যার খবর দেয়; জানা যায় দুষ্কৃতীরা অসনাক্ত-পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। বুমের সামনে শীর্ণা বৃদ্ধাকে বিলাপ করতে দেখে সুপর্ণা, একটি কিশোরীকেও।মৃত ছাত্রর মা আর বোন যথাক্রমে। সুপর্ণার হস্তধৃত মালাটির জপ বন্ধ হয়ে যায় এই খানে।
সুপর্ণা জিগ্যেস করে-‘তোমার ক্যামেরা অন ছিল না অতনু? ছবি ওঠে নি একজনেরও?’
-‘তো?’
-‘লোকাল থানায় গেলে হয় না?’
-‘পাগল না কি তুমি? এই সব ঝামেলায় যেচে যায় কেউ? তার ওপর শিওর পোলিটিকাল পার্টি ইনভলবড। তিন আঠারোয় পুরো চুয়ান্ন ঘা হয়ে যাবে। দুদিনের জন্য বেড়াতে এসে এই সব কেউ করে?’
সুপর্ণা খিদে নেই বলে উঠে যায়। অতনুও ওঠে।
-‘মাথা ধরেছে তোমার? একটা স্যারিডন খেয়ে শুয়ে থাকো বরং। কাল ভোরে উঠতে হবে। গাড়ি বলা আছে।‘
সমস্ত রাত গুম মেরে থাকে সুপর্ণা। বারে বারে জল খায়, বাথরুমে যেতে থাকে। ভারি পর্দার ফাঁক দিয়ে রিসর্টের বাগানের আলোর একফালি ওদের বিছানায়, অতনু ঘুমোচ্ছে। আলো জ্বালিয়ে ক্যামেরা খোঁজা সম্ভব নয়, জেগে যাবে । অন্ধকারে সুপর্ণা ভাবতে থাকে , 'ক্যামেরা কোথায় রেখেছে অতনু'?
পর্দার যে ফাঁক দিয়ে বাগানের আলো ঢুকছিল রাতে, সেই ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকলে , অতনুর দিকের সাইড টেবিলে ওর ক্যামেরা দেখতে পায় সুপর্ণা। এই সময় অতনু ঘুম ভেঙে সুপর্ণার চোখের দিকে তাকায় তারপর ক্যামেরার দিকে।
-‘কি ভাবছটা কি? এই সব কি পাগলামি? কি হয়েছে কি তোমার?’
-‘ক্যামেরাটা নিয়ে থানায় চলো অতনু, প্লীজ।‘
-‘ও ভিডিও এক্ষুণি ডিলিট করে দেব-পুলিশকে দেখানোর কিছু থাকবে না।‘
এক লাফে বিছানা ছেড়ে ওঠে অতনু। পর্দা সরিয়ে, চোখ কুঁচকে ক্যামেরা অন করে।
পর্দা সরাতেই সূর্যের আলো হু হু করে ঢুকতে থাকে, বিছানায় থৈ থৈ করে রোদ, চাদরে হরিণের মোটিফে আলো-সবুজ ঘাস পরিস্ফুট হয় প্রথমে তারপর হরিণেরা জাগে। জেগে ওঠে, জ্যান্ত হয়, মাথা তুলে সুপর্ণার দিকে তাকায়। সেই চাহনিতে সুপর্ণার হস্তধৃত এতকালের সুখমালাটি ছিঁড়ে ঝরঝর করে মুক্তো গড়িয়ে পড়ে, মেঝেতে ছড়ায়। ঠিক তখনই মিনিটের ভগ্নাংশ সময়ে, এত বছরের অনুচ্চারিত সমস্ত ‘না’ গুলিকে সংহত করে বিছানার অন্য প্রান্তে পৌঁছতে সুপর্ণা ভল্ট খায় - দীপা কর্মকারের প্রাদুনোভা ভল্ট - যে ভল্ট না দিলে নতুন করে কিছু শুরু করা যায় না। হতবাক অতনুর হাত থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে দরজা খোলে সুপর্ণা।। উস্কোচুল, লাল চোখ আর রাতপোশাকেই রাস্তা দিয়ে ছুটতে থাকে। চল্লিশ বছরের সুপর্ণা স্প্রিন্ট টানে খালি পায়ে। সঙ্গে হরিণগুলি। সুপর্ণা যখন করিডোর দিয়ে দৌড়োচ্ছিল, পাশের ঘর, তার পাশের ঘর থেকে আরো হরিণ বেরিয়ে আসে। নিচের লবি, ডাইনিং হল, রিসেপশন থেকে আরো আরো হরিণ।
কথিত আছে, সন চোদ্দোশো বাইশ বঙ্গাব্দে আশ্বিনের সকালে বড় রাস্তা ধরে এক দল হরিণকে দৌড়তে দেখা গিয়েছিল। যানবাহন রুদ্ধগতি , এবং পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়েছিল। অজস্র টুরিস্ট আর স্থানীয় বাসিন্দা সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিল। সেল্ফি তোলার সাহস করে নি কেউই। তীব্র গতিতে ছুটে যাওয়া সমস্ত হরিণের চোখ রক্তবর্ণ , গ্রীবাভঙ্গী গর্বিত , এবং শৃঙ্গ উন্নত ছিল।
সন চোদ্দোশো বাইশের আশ্বিনের সকালে হরিণের বন শূন্য হয়ে গিয়েছিল।
এই যেমন আজ এই ট্যুরিস্ট লজের ঘরে সে আর অতনু বিয়ের কুড়ি বছর উদযাপন করতে এসেছে, সেও অতনুর ইচ্ছায়, অতনুর পছন্দে। কোথায় যাবে, হোটেলে থাকবে না ট্যুরিস্ট লজে, কি খাবে সবই অতনুর ছকে দেওয়া। অখন্ড সুখবোধের চাঁদমালা সুপর্নার হস্তধৃত এতদিনে, সে তা হাতছাড়া করতে চায় নি, বলাই বাহুল্য। অতনুর সঙ্গে ওর বিয়েটাও এভাবেই- সুখের মডেল অনুসারী। মায়ের প্রতিটি কথায় সে হ্যাঁ বলেছিল-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ায়, পাত্রপক্ষের মেয়ে দেখতে আসায়, অতনুকে কেমন লাগল প্রশ্নের উত্তরে সে হ্যাঁ বলেছে, ঘাড় কাত করে মাথা নেড়েছে। রোম্যান্সের সামান্য একটা সুতো ছিল অবশ্য-যেদিন অতনু ওকে দেখতে আসে সেই আশ্বিনের সকালে আকাশবাণী কলকাতা ক র সাতটা চল্লিশে 'শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে' বেজেছিল, সন্ধ্যায় অতনু সহ পাত্রপক্ষ সুপর্ণাদের বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার এক ঘন্টার মধ্যেই ফোন এলে , ফোনের ওধারের হবু জা, ফোনের এধারের বা মা জেঠু জেঠিমা সুপর্ণার উত্তরের প্রত্যাশী হয়। সুপর্ণার কানে শরতে আজ কোন অতিথি বাজতে থাকে এবং সে এক সেকেন্ডের কম সময়ে হ্যাঁ বলে। এ বিষয়ে গিনেস রেকর্ড বুকে কোনো রেকর্ড আছে কি না জানা ছিল না কারোরই , তবু সুপর্ণার মা অবাক হয়ে বলতে থাকে-'আরেকটু সময় নিয়ে ভাবতে পারতি,' বাবা বলেছিল, 'স্বচ্ছন্দে না বলতেই পারিস'। এখন 'না' বললে , আবার কবে এই রকম পরিস্থিতি আসবে এবং আজকের আর সেই ভবিষ্যত পরিস্থিতির মাঝে ফারাক কতদিনের এবং সর্বোপরি সেই ফারাকে অখন্ড সুখবোধের মডেলটি বিপর্যস্ত হয়ে যাবে কি না সে বিষয়ে কোনো অদৃশ্য অঙ্ক কষা সুপর্ণার মনে চলতে থাকে এবং ফলশ্রুতি 'হ্যাঁ' তে দাঁড়ায়।
এই সব ছিল পুরোনো কথা। আজ ওরা অন্য শহরে। এই শহরে সবাই হরিণ দেখতে আসে। রিসর্টের ঘরে ঘরে বিছানার চাদরে হরিণের মোটিফ, বিলবোর্ডে হরিণের ছবি, বাজারে হরিণ আঁকা টি শার্ট, হরিণের সফট টয়, রাস্তায় তীরচিহ্ন দিয়ে, একাধিক ভাষায় 'ডিয়ার পার্ক এই দিকে' লেখা। আজ সকালে রিসর্টে পৌঁছনোর পরেই অতনু দরজা বন্ধ করেছে, দুপুরে 'চলো তোমাকে এখানকার ফেমাস বিরিয়ানি খাওয়াই' বলেছে-এসবই সুপর্ণার হস্তধৃত সুখের মালায় একদম খাপে খাপে ফিট করে গেছে। রোদ পড়লে বিকেলে ওরা ডিয়র পার্কে হরিণ দেখতে যাবে-এরকমই কথা হয়ে আছে। সুপর্ণা এখন অতনুর পাশে শুয়ে , বালিশে মাথা, এ সি মেশিনের মৃদু আওয়াজ আসছে, ভারী পর্দার বাইরে দুপুরের রোদ, পাশের ঘরে বড় গোছের একটা গ্রুপ সদ্য চেক ইন করল। হাল্কা কথা শোনা যাচ্ছে করিডোরে, একটা বাচ্চা একটানা গাইছে, হুড় হুড় হুড় দাবাং দাবাং। এক কথায়, ঘটমান বর্তমান বা অদূর ভবিষ্যতে কোনো বেদনাবোধের স্থান নেই।
ওদের রিসর্ট থেকে ডিয়ার পার্ক মিনিট পঁয়্তাল্লিশ, সূর্য ডোবার সময়ে হরিণরা দল বেঁধে জল খেতে আসে। ট্যুরিস্টরা সানসেট , জলস্রোত আর হরিণের পালকে এক ফ্রেমে ধরে নিয়ে বাড়ি যায়। বেরোনোর আগে অতনু ক্যামেরার ব্যাটারি চেক করল। রিসর্টের বাসে আরো দুটি দল , সানগ্লাস, টুপি, জলের বোতল। বাচ্চা ছেলেটা একই গান গেয়ে চলেছে -হুড় হুড় হুড় দাবাং দাবাং। হুড় হুড় হুড় দাবাং দাবাং।
যদিও বিকেল, রোদ এখনও চড়া, উল্টো দিক থেকে হু হু ট্রাক , বাস, অ্যাম্বাসাডর মারুতি, দুপাশে ধানক্ষেত, কাশের গোছা, রাস্তায় কোথাও কোথাও ধান শুকোতে দেওয়া আছে। ড্রাইভারের পাশের সিটে অতনু যাত্রাপথের টানা ভিডিও তুলছে , পরে এডিট ক'রে ফেসবুকে আপলোড করে দেবে। দাবাং দাবাংএর দল আর অন্য দলটি সূর্যাস্তের সময়ে জলের কাছে পৌঁছোনো নিয়ে সামান্য চিন্তিত। বাসের ড্রাইভার 'বালম পিচকারি' চালিয়ে দিয়েছে। এই সময় , সামনে রাস্তার ওপরে একটা ভীড় দেখতে পেলো সুপর্ণা। অতনুও দেখেছে সম্ভবতঃ। ড্রাইভার গান বন্ধ করে বাসের গতি কমালো। যে ভীড়টা দূর থেকে ছোটো মনে হচ্ছিল, কাছ থেকে তাকে আর ছোটো লাগছিল না সুপর্ণার। উপরন্তু রাস্তার এদিকের ধানক্ষেত , ওদিকের ইঁটভাটা পেরিয়ে আরো কিছু মানুষ রাস্তায় এসে উঠতে লাগল। কিছু লোকের হাতে বাঁশ লাঠি আর টাঙ্গি দেখল সুপর্ণা। ভীড়ের মধ্যে থেকে দুজন হাতে গামছা নাড়তে নাড়তে বাসের দিকে এগিয়ে এলে, ড্রাইভার বাস থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাবাংএর দল চেঁচিয়ে বলল, 'কেউ নামবেন না বাস থেকে, প্লীজ, প্লীজ', অতনু 'কি হ'ল' বলতে না বলতেই , বাসের গায়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে কেউ বলল, 'এই রাস্তা বন্ধ, বলছি না ব্যাক করতে'। ড্রাইভারের পাশের জানলার কাচ নামানো ছিল, সেখানে মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে কেউ বলল-'বলছি না,ব্যাক করতে! কানে কথা যায় না?' অতনু মুখ বাড়িয়ে বলল, 'কি হয়েছে, কি হয়েছে ভাই'? ঐ ভীড়কে মোটামুটি দুভাগে ভাগ করতে পারছিল সুপর্ণা- একটা দল যাদের হাতে লাঠি, বাঁশ, অন্য ভাগটা স্রেফ দর্শক।, অতনুর দিকের ভীড়টা মূলতঃ দর্শকের।সেখান থেকেই কেউ বলল-'মোষ চুরির ধোলাই চলতেসে।' সুপর্ণা এই বার দেখতে পায় ভীড়ের ভেতরে আরেকটা ছোটো ভীড় , সেই ছোটো ভীড়ের মাঝখানে কেউ শুয়ে-বিকেলের রোদে শুধু শুষ্ক দুটি পায়ের পাতা ; লাঠি হাতে লোকদুটি বাসের জানলা ছেড়ে আবার ভীড়ের দিকে দৌড়ে যায়।
অতনু কপাল মুছে বলে,' যত্তো সব ঝামেলা , ব্যাক করে ডানদিকের মাটির রাস্তায় চলো, ওখান থেকে হাইওয়ে ধরলে এখনও সানসেট দেখা যাবে।‘
বাকি পথ একদম ঝামেলা রহিত ছিল। শেষ বিকেলে ওরা জলের কাছে, হরিণের কাছে, সূর্যাস্তের কাছে ঠিকই পৌঁছতে পেরেছিল, ছবি উঠেছিল অনেক, সেল্ফিও।
সে রাতে রিসর্টের ডাইনিং হলের ৩৯ ইঞ্চি স্ক্রীনে সংবাদ্পাঠক মোষ চোর সন্দেহে এক কলেজ ছাত্র হত্যার খবর দেয়; জানা যায় দুষ্কৃতীরা অসনাক্ত-পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। বুমের সামনে শীর্ণা বৃদ্ধাকে বিলাপ করতে দেখে সুপর্ণা, একটি কিশোরীকেও।মৃত ছাত্রর মা আর বোন যথাক্রমে। সুপর্ণার হস্তধৃত মালাটির জপ বন্ধ হয়ে যায় এই খানে।
সুপর্ণা জিগ্যেস করে-‘তোমার ক্যামেরা অন ছিল না অতনু? ছবি ওঠে নি একজনেরও?’
-‘তো?’
-‘লোকাল থানায় গেলে হয় না?’
-‘পাগল না কি তুমি? এই সব ঝামেলায় যেচে যায় কেউ? তার ওপর শিওর পোলিটিকাল পার্টি ইনভলবড। তিন আঠারোয় পুরো চুয়ান্ন ঘা হয়ে যাবে। দুদিনের জন্য বেড়াতে এসে এই সব কেউ করে?’
সুপর্ণা খিদে নেই বলে উঠে যায়। অতনুও ওঠে।
-‘মাথা ধরেছে তোমার? একটা স্যারিডন খেয়ে শুয়ে থাকো বরং। কাল ভোরে উঠতে হবে। গাড়ি বলা আছে।‘
সমস্ত রাত গুম মেরে থাকে সুপর্ণা। বারে বারে জল খায়, বাথরুমে যেতে থাকে। ভারি পর্দার ফাঁক দিয়ে রিসর্টের বাগানের আলোর একফালি ওদের বিছানায়, অতনু ঘুমোচ্ছে। আলো জ্বালিয়ে ক্যামেরা খোঁজা সম্ভব নয়, জেগে যাবে । অন্ধকারে সুপর্ণা ভাবতে থাকে , 'ক্যামেরা কোথায় রেখেছে অতনু'?
পর্দার যে ফাঁক দিয়ে বাগানের আলো ঢুকছিল রাতে, সেই ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকলে , অতনুর দিকের সাইড টেবিলে ওর ক্যামেরা দেখতে পায় সুপর্ণা। এই সময় অতনু ঘুম ভেঙে সুপর্ণার চোখের দিকে তাকায় তারপর ক্যামেরার দিকে।
-‘কি ভাবছটা কি? এই সব কি পাগলামি? কি হয়েছে কি তোমার?’
-‘ক্যামেরাটা নিয়ে থানায় চলো অতনু, প্লীজ।‘
-‘ও ভিডিও এক্ষুণি ডিলিট করে দেব-পুলিশকে দেখানোর কিছু থাকবে না।‘
এক লাফে বিছানা ছেড়ে ওঠে অতনু। পর্দা সরিয়ে, চোখ কুঁচকে ক্যামেরা অন করে।
পর্দা সরাতেই সূর্যের আলো হু হু করে ঢুকতে থাকে, বিছানায় থৈ থৈ করে রোদ, চাদরে হরিণের মোটিফে আলো-সবুজ ঘাস পরিস্ফুট হয় প্রথমে তারপর হরিণেরা জাগে। জেগে ওঠে, জ্যান্ত হয়, মাথা তুলে সুপর্ণার দিকে তাকায়। সেই চাহনিতে সুপর্ণার হস্তধৃত এতকালের সুখমালাটি ছিঁড়ে ঝরঝর করে মুক্তো গড়িয়ে পড়ে, মেঝেতে ছড়ায়। ঠিক তখনই মিনিটের ভগ্নাংশ সময়ে, এত বছরের অনুচ্চারিত সমস্ত ‘না’ গুলিকে সংহত করে বিছানার অন্য প্রান্তে পৌঁছতে সুপর্ণা ভল্ট খায় - দীপা কর্মকারের প্রাদুনোভা ভল্ট - যে ভল্ট না দিলে নতুন করে কিছু শুরু করা যায় না। হতবাক অতনুর হাত থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে দরজা খোলে সুপর্ণা।। উস্কোচুল, লাল চোখ আর রাতপোশাকেই রাস্তা দিয়ে ছুটতে থাকে। চল্লিশ বছরের সুপর্ণা স্প্রিন্ট টানে খালি পায়ে। সঙ্গে হরিণগুলি। সুপর্ণা যখন করিডোর দিয়ে দৌড়োচ্ছিল, পাশের ঘর, তার পাশের ঘর থেকে আরো হরিণ বেরিয়ে আসে। নিচের লবি, ডাইনিং হল, রিসেপশন থেকে আরো আরো হরিণ।
কথিত আছে, সন চোদ্দোশো বাইশ বঙ্গাব্দে আশ্বিনের সকালে বড় রাস্তা ধরে এক দল হরিণকে দৌড়তে দেখা গিয়েছিল। যানবাহন রুদ্ধগতি , এবং পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়েছিল। অজস্র টুরিস্ট আর স্থানীয় বাসিন্দা সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিল। সেল্ফি তোলার সাহস করে নি কেউই। তীব্র গতিতে ছুটে যাওয়া সমস্ত হরিণের চোখ রক্তবর্ণ , গ্রীবাভঙ্গী গর্বিত , এবং শৃঙ্গ উন্নত ছিল।
সন চোদ্দোশো বাইশের আশ্বিনের সকালে হরিণের বন শূন্য হয়ে গিয়েছিল।
গায়ে কাঁটা দিল শেষটা পড়ে।
ReplyDeleteগায়ে কাঁটা দিল শেষটা পড়ে।
ReplyDeleteDarun
ReplyDeleteDarun
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো।আরো চাই।আরো আরো।
ReplyDelete