সমরেশের জীবনদেবতা
সন চোদ্দোশো কুড়ির মাঘ মাসের
গোড়ায়, এক শনিবারের দুপুরে
সমরেশের নিজেকে অসম্ভব সংকটাপন্ন
মনে হতে লাগল।জায়গাটা একটা রেলস্টেশন।
কলকাতা থেকে শ দুই
কিলোমিটার। স্টেশনে
সমরেশের পাশে সোহিনী আর
দুটো ট্রলিব্যাগ। মাঘের
রোদ তেমন কড়া নয়-
সূর্যের আলো তেরছা হয়ে
শেডের তলায় ঢুকেছে।
রেললাইনের একদিকে তিন নম্বর
প্ল্যাটফর্মে সমরেশরা দাঁড়িয়ে, চার পাঁচজন হকার
গোল হয়ে বসে আর
লাইনের অন্যদিকে কালচে ইঁটের ছোটো
ঘর, লম্বা সজনে গাছ-টিনের চালে গোটা
দশেক বাঁদর লাফাচ্ছে।
আড়াইটে বাজে প্রায়।
পাশাপাশি দাঁড়ানো ট্রলিব্যাগ দুটোর লম্বা ছায়া
মুড়িওলার পিঠ থেকে সরতে
সরতে চা গরমের কেটলিতে
পড়ল। কলকাতায়
যাওয়ার ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্টও হল তখন।
মুড়িওলা তেলের বোতল ঝাঁকাতে
ঝাঁকাতে উঠে দাঁড়াল।
চা গরম আর সাইড
ব্যাগওলা প্ল্যাটফর্মের বাঁ দিকে আর
চাবি-তালা-ক্লিপ-চিরুণিওলা
ডানদিকে হাঁটতে শুরু করল। আর
সমরেশ একটা সিগারেট ধরালো। ও
সিগারেট ধরাতেই সোহিনী ওর
পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল,
ফলে সোহিনীর পায়ের কাছে এখন
ট্রলিব্যাগের ছায়া। সেই
ছায়া যেখানে শেষ হয়েছে,
সোহিনীর শাড়ির সবুজ সোনালি
পাড় মাটি ছুঁয়েছে,সেখানে
একটা ছোটো কালো চিরুণি দেখতে পেল
সমরেশ -হাতল ওলা, বড়
দাঁড়া। সমরেশ
তৎক্ষণাৎ বুঝে গেল-ও
আর প্ল্যাটফর্মে নেই, একটা বনে
ঢুকে পড়েছে। সেখানে
উঁচু গাছ, লম্বা অগোছাল ঘাস
ওর হাঁটু অবধি।
একটা বড় সাদা পাখি
জোরে জোরে ডাকছিল, তারপর
উড়ে গেল সমরেশের মাথার
ওপর দিয়ে। আর
সমরেশ, টর্চ হাতে ওর
পকেট থেকে পড়ে যাওয়া
একটা চিরুণি সন্ধান করতে
লাগল ঐ বনে।
সমরেশের মনে হচ্ছিল, চিরুণিতে
সোহিনীর একটা চুল জড়িয়ে
আছে আর সেই চুলসমেত
চিরুণি ওকে খুঁজে পেতেই
হবে এই ঘাসে, জঙ্গলে,
বনের অভ্যন্তরে। আঁতিপাঁতি
খুঁজে চলেছে সমরেশ আর
পকেট থেকে মোবাইল বের
করে করে দেখছে।
ওর মনে হচ্ছে সোহিনীর
সঙ্গে যেন ওর বিচ্ছেদ
ঘটে গেছে আর সেজন্যই চিরুণিটা
ওর খুঁজে পাওয়া দরকার। ও
যেন জানে চিরুণি খুঁজে
পাওয়ামাত্র সোহিনীর ফোন আসবে। একটা
না জানা গল্পও যেন
হাতড়ে ফিরছিল সমরেশ-ওর
আর সোহিনীর বিচ্ছেদের গল্প। সোহিনীর
ফোন এলে গল্পটাও
পেয়ে যাবে-এরকম মনে হচ্ছিল ওর। এই
সব ঘটনা খুব দ্রুত
ঘটছিল সমরেশের মনে যেখানে একটা
মন দুটো মন হয়ে
যাচ্ছিল-একটা মন যেখানে
সজাগ থাকছিল ট্রেন এখনই
এসে পড়বে বলে, অন্য
মন অগোছ্হলো ঘাস আর জঙ্গলের
মধ্যেই রয়ে যাচ্ছিল।
সমরেশের ঠাকুমারও এরকম হত।
ঠাকুমা যাকে বলত ভিসান
দেখা। ভিসান
শব্দটা বিলাতফেরত দেওরের থেকে শিখে
নিয়েছিল ঠাকুমা। একগাল
হেসে বুড়ি বলত, 'আজ
আবার ভিসান দেখসি।
গল্পটা কই তরে?' ভিসান
শব্দের বড় দাপট।
সবাই কান খাড়া করত,
বলত, 'আইচ্ছা, কও'।
সমরেশও ভিসান
দেখে। আসলে
একটা গল্প দেখে সমরেশ
-এমন গল্প যার মাঝখানটা আছে শুধু।
শুরুটা ভেবে নিতে হয়,
শেষটা তৈরি করে নিতে
হয়। মনে
মনে এই নির্মাণ চালিয়ে
যেত সমরেশ। ভাঙা
ভাঙা গল্প জোড়া দিত। এই
প্ল্যাটফর্মে এখন যা ঘটছে,
এই রকমই কিছু ঘটেছিল
কাল রাতেও।
বিছানায়
সোহিনীকে চুমু খাচ্ছিল সমরেশ।
বছর পাঁচেক আগে বই
মেলায় সমরেশ আর সোহিনীর
আলাপ। সোহিনী
লেখে। আর
সমরেশ পাঠক। সোহিনীর
নিজের সংসার আছে, সমরেশের
নেই।
গত রাতে গেস্ট হাউজের
ঘরে চুমু খাওয়ার সময়
সমরেশের চোখ হঠাৎ খুলে
যায়-সামনে সোহিনীর বোজা
চোখ, চোখের পাতার লালচে
বাদামি ভাঁজ আর সোহিনীর
হাত। বাঁ
হাতে বিছানার চাদরের অংশ মুঠো
করে ধরে ডান হাত
চাদরে বোলাচ্ছে সোহিনী। সমরেশ
বুঝতে পারে ও আর
গেস্ট হাউজের ঘরে নেই-
একটা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসছে। হাসপাতালের
ভিতরটা খুব ঠান্ডা, অথচ
কাচ দরজা দিয়ে বেরোতেই
গরম হাওয়া-লু বইছে
যেন। ওর
হাত সোহিনীর হাতে, সোহিনীর চোখ
বোজা, জল গড়াচ্ছে গাল
বেয়ে। রাস্তার
ওপারে একটা গাড়ি দেখতে
পাচ্ছে সমরেশ-তারপর কেউ
যেন গাড়ির দরজা খুলে
দিচ্ছে, পিছনের সিটে ওরা
পাশাপাশি বসছে আর সোহিনী,
ওকে অবাক করে গাড়ির
সিটে হাত বোলাচ্ছে, যেন
পরখ করছে গাড়ির
সিটের উপাদান এবং মূল্য।
এইখানে
এসে সমরেশের দুটো মন জুড়ে
গিয়েছিল আর অসম্ভব দ্রুততায়
সোহিনীকে আঁকড়ে ধরে, মিলিত
হয়েছিল।
সোহিনী
কিছু বুঝেছিল। শেষ
রাতে সমরেশের চুলে বিলি কাটতে
কাটতে জিগ্যেস করেছিল-'কি হয়েছিল তোমার?'
সমরেশ বলেছিল বড় হাসপাতালের
কথা, গরম লু আর
গাড়ির কথা।গাড়ির
সিটে হাত বোলানোর কথাও
বলেছিল কিন্তু তা নিয়ে
আবছা ধারণাটুকু যেটুকু ঐ স্বল্প
মুহূর্তে ওর অর্ধেক মন
ভেবে ফেলেছিল, সেটুকু বাদ রেখেছিল।সোহিনী
বলেছিল, 'অনেক পড়েছ সমরেশ,
এবার তোমার লেখার সময়
হয়েছে।'
সমরেশ
কথা না বলে সিগারেট
ধরিয়েছিল। পাশ
ফিরে শুয়েছিল সোহিনী।সিগারেটের
ধোঁয়া ছোটো বৃত্ত তৈরি
করছিল-বন্ধ ঘরের বাতাসে
সিগারেটের গন্ধ আটকে থাকছিল। সমরেশ
এই প্রথম আবিষ্কার করেছিল,
সোহিনীকেও সব কথা বলা
যায় না।
কলকাতা
যাওয়ার ট্রেন ঢুকছিল প্ল্যাটফর্মে। ওরা
দুজনে ট্রলি ব্যাগ টেনে
নিয়ে এগোচ্ছিল কামরার দিকে।
সমরেশের হাত সোহিনীর বাহু
ছুঁয়েছিল। সোহিনীকে
চিরুণির গল্পটা বলবে কি
না, আদৌ বলা যায়
কি না ভাবছিল সমরেশ। এই
ভাবাটাই ওকে সংকটাপন্ন করে
তুলছিল। সোহিনীর
কাছ থেকেও যে ওর
কিছু গোপন করার থাকতে
পারে- এই পাঁচ বছরে
কোনদিন ভাবে নি ।
বরং ক’টায় উঠলো ঘুম
থেকে, মাথাটা ধরবে মনে
হচ্ছে, আপিসে বস বড্ড
পলিটিক্স করছে ইদানিং, এমনকি,
ফেরার পথে নাগেরবাজারে আম
কিনেছে, কিম্বা সবুজ প্লাস্টিক
ব্যাগ থেকে একটা আপেল
পড়ে গেল রাস্তায়, অথবা
পুজোসংখ্যায় সোহিনীর লেখার বিজ্ঞাপন এই
মাত্র দেখল-এস এম
এস , ই-মেইল , ফোনে
এই সমস্তই বলেছে সমরেশ। আসলে,
সমরেশ সবসময় একজনকে চেয়ে
এসেছে যাকে ওর সব
গল্প বলতে পারে -একদম
কিছু না লুকিয়ে।
শীতের দিনে অশক্ত মানুষ
যেমন রোদে পিঠ দিলে
আরাম পায়, সমস্তদিন রোদ
নিয়ে থাকতে চায়, আর
রোদ না উঠলে মৃত্যুভয়ে
আর অসহায়তায় লেপের তলায় কুঁকড়ে
থাকে, রোদকেই বেঁচে থাকার
একমাত্র উপকরণ ভেবে নিয়ে
নিতান্ত কাঙালপনা করে যেন, সমরেশেরও
সেইরকম কাউকে ভীষণরকম আঁকড়ে
ধরে বাঁচা। ক্লাস
এইট থেকে নীলাদ্রিকে সব
কথা বলেছে , আর একদম ছোটোবেলায়
মা কে। স্টোভ
বার্স্ট করে মার
মৃত্যু আর ক্লাস এইটে
নীলাদ্রির সঙ্গে বন্ধুত্বের মাঝখানের
সময়টুকু , সমরেশের সব কথা শোনার
জন্য ছিল মা র
সোনালি পাড় কমলা শাড়ি
আর লালু। সমরেশদের
পোষা কুকুর। নীলাদ্রি
চলে গিয়েছিল আমেরিকা, ইমেইল অনিয়মিত ছিল,পয়লা বৈশাখ আর
বিজয়ার আই এস ডিতে
সব কথা হত না। নীলাদ্রি
অবশ্য বলত, 'এইটুকুই বা
ক'জনের হয়? যোগাযোগই
থাকে না।স্টে
কানেকটেড।' সমরেশ
জানত এটা শুধুই যোগাযোগ,
কানেকশন হচ্ছে না।
কানেকশন বলতে ও বুঝত,
কালিপুজোর সন্ধ্যায়, বসবার ঘরের কালো
সুইচ টিপে দিলেই বাইরের বারান্দার
রেলিংএ টুনি বাল্ব জ্বলে
ওঠা।ওঠা।ইন্টারনেটের
আড্ডা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এ সমরেশ গেছে,ফিরেও এসেছে।
টুনিবাল্ব জ্বলে নি।
ফলতঃ কথারা জমছিল।
বইমেলায় সোহিনীর সঙ্গে আলাপের মাস
তিনেকের মধ্যে টুনিবাল্ব জ্বলে ওঠা টের
পায় সমরেশ। প্রতিদিনের ফোন, এস এম
এস, ইমেইলের পরেও অনেক কথা
বাকি থেকে যাচ্ছিল।
কথা কিম্বা শরীর।
কলকাতার কাছাকাছি এক রাত, দু
রাত থাকা শুরু হয়েছে
ওদের গত তিন বছর।
এই মুহূর্তে, ট্রেনে ওঠার ঠিক
আগে, যেন টুনিবাল্ব জ্বালার
সুইচ খুঁজে পাচ্ছে না
সমরেশ। মাঘের
বিকেলে ঘাম হচ্ছে বিনবিন
করে। অথচ
শীত যায় নি তখনও,
ট্রেনের জানলার বাইরে অন্ধকার
দ্রুতই নামছিল।
সন চোদ্দোশো কুড়ির এই সংকট
সমরেশকে পাঠক থেকে লেখক
করে দিয়েছিল। মাঘ
মাস শেষ হয় হয়,
এমন সময় একদিন সমরেশ
অফিস থেকে ফিরেই লিখতে
শুরু করে দেয়।
দ্রুত লিখছিল সমরেশ।
বৈশাখের মধ্যে গোটা দশেক
ছোটো গল্প লেখা শেষ
হয় যার মধ্যে একটির
নাম ছিল চিরুণিতালাস-যে
গল্পটি সে মাঘের দুপুরে
কলকাতার দুশো কিলোমিটার দূরে
খুঁজে পেয়েছিল।
লেখাকে
যত্নে লালন করছিল সমরেশ। যেমন
করে নতুন মা সন্তানের
চারদিকে বালিশ ঘিরে ঘুম
পাড়ায় আর নিজে না
ঘুমিয়ে অজস্রবার তার মুখ দেখে-সমরেশ অনেকটা তেমন
করেই ওর গল্প লেখাকে
আড়াল করে রাখছিল।
ঘুম পাড়াচ্ছিল, ঘুমন্ত মুখ দেখছিল
আবার ঘুম ভাঙিয়ে খুব
কাঁদাচ্ছিল। ঘরের
ভেতরের ভারি কালো সুইচ
টিপে বারান্দার টুনিবাল্ব জ্বালাচ্ছিল প্রতিদিন। সোহিনীর
সঙ্গে কথা কমছিল।
কথা এবং শরীর।
সেদিন
বাইপাসে অজয়নগরের সিগনালে গাড়ি থামলে কথাটা
তোলে সোহিনী।
'সমরেশ,
আমাদের কি হয়েছে?'
'কি হয়েছে মানে?'
'বোঝোনা
কি হয়েছে? '
'আজকাল
কথা কম হয়, দেখা
কম হয়। এ
ছাড়া….'
'খুব সহজে বললে কথাটা
সমরেশ। এটাই
জানতে চাইছি-কেন? কি
হল হঠাৎ?'
'তুমি
ব্যস্ত । তোমার
পুজোর লেখা, মেয়ের পরীক্ষা। আমার
অফিসে কাজ বেড়েছে মানে
তুমি তো জানই-এই
সময়টা কাজ বাড়ে ….'
'দুজনের
মন আমরা পড়তে পারতাম
। আমি এখনও
পারি। তুমি
কিছু লুকোচ্ছো সমরেশ।'
সমরেশ
চুপ করে থাকে।
হাতের তালুতে আঁকিবুকি কাটে। একবার
বাইরে তাকায় । তারপর
সোহিনীর দিকে ফিরে জড়িয়ে
জড়িয়ে বলে, 'আমি লিখছি। গল্প। ছোটো
গল্প। বেশ
কয়েকটা লেখা হয়েছে।তোমাকে বলি নি।'
সোহিনী
নিজেই ড্রাইভ করে।
রাস্তায় চোখ রেখেই বলল,
'কেন'?
'জানি
না। সত্যি
জানি না কেন বলি
নি।তুমি
পড়বে?'
সোহিনী
ঢোঁক গেলে সামান্য।
রাস্তা থেকে চোখ না
সরিয়ে বলে, 'বাড়ি ফিরে
পাঠিয়ে দিও তবে।
ইমেইলে।'
'খাতায়
লিখেছি সোহিনী। সফট
ওয়ার টোয়ার লাগবে বাংলা
লিখতে। ওসব
ঝামেলায় যাই নি।'
'বেশ তবে কাল কুরিয়ারে
পাঠিয়ে দিও। ভালো
লাগছে লিখতে? "
'জানি
না, সোহিনী'
দুজনেই
চুপ করে রইল বাকি
সময়টুকু। তারপর,
সল্ট লেকের মোড়ে নেমে
গেল সমরেশ।
২
সন চোদ্দোশো একুশের বৈশাখের দুপুরে
মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ম্যানিকুইনের
বেনারসী দেখছিল সমরেশ ।
সোহিনী এলে ওরা এক
প্রকাশকের কাছে যাবে।
পটুয়াটোলা লেনে।
আসলে,
গল্পগুলো কুরিয়ার করার আধবেলার মধ্যেই
সোহিনী ফোন করে, উত্তেজিত
গলা।
'সমরেশ,
এই লেখা লুকিয়ে রেখেছ
তুমি এতদিন? কোত্থাও পাঠাও
নি কেন?'
সমরেশ
মনে মনে বলল, 'আমি
তো তোমাকেই পড়াই নি সোহিনী। লুকিয়ে
লিখতে ভালো লাগছিল।'
ফোনে শুধুই হাসল।
সামান্য শব্দ করে।
'শোনো
পরশু একবার লেখাগুলো নিয়ে
কলেজস্ট্রীটে আসতে পারবে?'
'পরশু
তো শুক্রবার, অফিস আছে।
কটার সময়?'
'চারটে
নাগাদ এসো। এর
পরে আমার একটু অসুবিধে
হবে।মেয়ের
পরীক্ষা চলছে।'
'লেখাগুলো
কেন?'
'একজন
প্রকাশককে চিনি-নতুন লেখকদের
বই ছাপান। ওঁকে
পড়াব ভাবছি। সিরিয়াসলি
সমরেশ, তোমার লেখাগুলো সবার
কাছে পৌঁছন দরকার।'
বৈশাখের
দুপুর, বেলা বয়ে যাচ্ছে,
বাসের হর্ন, উল্টোদিকে পানওলা,
ম্যাগাজিনের স্টলে পঞ্জিকা বিক্রি
হল পরপর তিনটে।
একটা নীল বেনারসী ভালো
লাগছিল সমরেশের। সোহিনীকে
কেমন মানাবে ভাবছিল।
সোহিনীর বিয়েতে ও বেনারসী
পরেনি-নিজেই বলেছিল একদিন
। এমন সময়ে
সোহিনী এসে দাঁড়ালো, 'অনেকক্ষণ
দাঁড়িয়ে আছ? লেখা সব
এনেছ তো?' সমরেশ কাঁধের
ঝোলায় হাত রেখে হাসল।
হ্যারিসন
রোড দিয়ে হেঁটে গিয়ে
পটুয়াটোলায় ঢুকল ওরা।
ফুটপাথে পাশাপাশি হাঁটা যাচ্ছিল না-সোহিনী সামান্য আগে
হাঁটছিল।
রাস্তার
ওপর থেকেই সিঁড়ি উঠে
গেছে একটা ছোটো ঘর
অবধি। দেওয়ালের
তাকে বই সাজানো যার
কিছু সমরেশ পড়েছে।
নবীন লেখকই সব মূলতঃ,
দু একজন প্রতিষ্ঠিতরও বই
দেখল যাদের
মধ্যে সোহিনীও ছিল। প্রকাশক
ভদ্রলোক সমরেশেরই বয়সী; দাড়িতে হাত
বুলিয়ে -'দিদি রেকমেন্ড করছেন
যখন তখন নিশ্চয়ই ভালো
লেখা-তবু আমি নিজে
একবার পড়ব-আপনি সামনের
সপ্তাহে একবার আসুন এই
সময়ে' বলায় ওরা ফুটপাথে
নেমে হ্যারিসন রোডের দিকে এগোয়। সোহিনী
বলে, 'আমার একটু তাড়া
আছে আজ, বাড়ি যাব। তুমি
কি অফিস ফিরবে?'
'না আরেকটু থাকি, অনেকদিন পরে এলাম।
পাতিরামে যাব। দেজ
থেকেও কিছু বই নেব। ঝোলাটা
তো খালি করে দিলাম।'
'ফিরে
যেও তাড়াতাড়ি। কালবৈশাখীর
ফোরকাস্ট আছে।'
বাস্তবিকই
ঝড় আসবে মনে হচ্ছিল। মেডিকাল
কলেজের মাথার ওপর নীলচে
কালো মেঘ জমছিল।
হাওয়া বইছিল কলেজস্ট্রীট জুড়ে। সমরেশ বই
কিনল-লিটল ম্যাগাজিন, কবিতার
বই, একটা নতুন উপন্যাস। ঝোলাটা
উপচে পড়ছিল। বিধান
সরণি দিয়ে হাঁটতে লাগল
সমরেশ।ওর
লম্বা ছায়া পড়তে লাগল
ফুটপাথে। লম্বা
কালো ছায়া। কাঁধের
ঝোলাটা ডানদিকের
হাঁটু অবধি। সমরেশের
পায়ের ছায়ার পাশে তারও
ছায়া। ফলে
ডানদিকের ঊরুর ছায়া বাঁদিকের
তুলনায় অনেক ভারি দেখাচ্ছিল। যেন
সে কোনও এক বাহনে
সামান্য কাত হয়ে সওয়ার
হয়েছে। ঝড়
এসে পড়ল ঠিক সেই
সময়ে। ছায়াটা
মিলিয়ে যেতে লাগল ক্রমশঃ
আর ওকে ঘিরে উড়তে
লাগল প্লাস্টিকের কাপ, মাধ্যমিকের সাজেশন,
এঁটো শালপাতা, চকোলেটের র্যাপার। মেঘ
আর বিদ্যুতে বেগুনি দেখাচ্ছিল বিধান
সরণির ওপরের আকাশ।
সেই বেগুণি আকাশের তলায়
ঠনঠনের মুখে একটা সার্কাসের
তাঁবু দেখতে পেল সমরেশ। ছোটো
তাঁবু আলোর মালায় সেজে
আছে।
যেন বৌভাতের সন্ধ্যায় ঈষৎ জড়োসড়ো নতুন
বৌ। দৌড়ে
তাঁবুতে ঢুকে গেল সমরেশ।
তাঁবুর
ভেতরে লাল নীল সবুজ
আলো জ্বলছিল নিভছিল আর অ্যারেনায়
ট্রাপিজের খেলা চলছিল।
সমরেশ ঢুকতেই জাদুকর
দৌড়ে এল-ঝলমলে জামা,
পাগড়ি, হাতে জাদুদন্ড।
সমরেশের হাত ধরে অ্যারেনা
পেরিয়ে তাঁবুর আরো অভ্যন্তরে নিয়ে
যেতে লাগল সে।
গোল খাঁচায় মোটর বাইক
ঘুরতে লাগল, আগুনের ভিতর
দিয়ে লাফ দিল সিংহ,
একটা লম্বা সাইকেল চড়ে
হাত নাড়তে লাগল ছ
জন সুন্দরী। ডিগবাজি
দিতে দিতে ওদের পেরিয়ে
অ্যারেনার দিকে চলে গেল
সার্কাসের ক্লাউন। জাদুকর
সমরেশের হাত ধরে তাঁবুর
বাইরে বেগুণি আকাশের তলায়
নিয়ে এল। সেখানে
ঘোড়ারা চরে বেড়াচ্ছে।
সাদা , বাদামি, কালো ঘোড়া।
একটা বাঁশি আকাশ থেকে
পেড়ে আনল জাদুকর আর
ঠিক তক্ষুণি ঝমঝম করে বৃষ্টি
নামল। বৃষ্টি
মাথায় সে বাঁশিতে ফুঁ
দিল। আর
এই সময় সমরেশের মোবাইল
বেজে উঠল। ঠনঠনের
মন্দির ফিরে এল, ফিরে
এল ট্রাফিক, বাস মিনিবাসের হর্ন,
ছাতামাথায় পথচারী। বৃষ্টি
অবশ্য রইল সমরেশকে ঘিরে-পিচরাস্তায় হাজার হাজার জলের
মুকুটে স্ট্রীট লাইট আর বিদ্যুতের
আলো ঠিকরোতে লাগল।
সোহিনী
ফোন করেছিল।
' বাড়ি
পৌঁছে গেছ তো'?
'সোহিনী,
এবারে বর্ধমান গেলাম যেদিন, একটা
সার্কাসের তাঁবু দেখেছিলাম, মাঠের
মধ্যে- একজ্যাক্ট লোকেশনটা মনে করতে পার?'
মোবাইলে
মুহুর্মুহু বাজ পড়ার আওয়াজ
পাচ্ছিল সোহিনী।
'তুমি
ভিজছ ? কোথায় দাঁড়িয়ে আছ?'
'সোহিনী,
প্লীজ ,আগে জায়গাটা মনে
কর।'
'গ্রামের
নাম কি করে বলব?
তবে ঐ পথে আবার
গেলে চিনতে পারব।
কেন কি হয়েছে?'
' যাবে
কাল সকালে ওখানে? আমার
সঙ্গে?'
'মেয়ের
পরীক্ষা সমরেশ। বললাম
না? কিন্তু হঠাৎ কি
হল?'
'ঠিক জানি না।
হয়তো একটা গল্পের খোঁজে। কাল
ভোরে গণদেবতা ধরব।'
৩
সন চোদ্দোশো কুড়ির মাঘের শুরুতে
সার্কাসের তাঁবু পড়েছিল যেখানে
, বৈশাখে সে জায়্গা ঠিকই
চিনেছিল সমরেশ। বোলপুরের
গেস্টহাউজ থেকে ভাড়ার অ্যাম্বাসাডরে
এতদূর এসেছে । অজয়
পেরোলেই বর্ধমান। মাঘের
গোড়ায় পথে ধান শুকোচ্ছিল। সর্ষেক্ষেত
ছিল ।আর
শুকনো কাশের রোঁয়ার ওড়াউড়ি
। নাইম অটো
সেন্টার, কিং হোমিও, কালীমাতা
ফার্নিচারের পাশে শমী আর্ট
সেন্টার। তার
পাশের দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের মাঝে
জোড়হাত মুখ্যমন্ত্রী । এরপর
ডোনা ব্রিক ইঁটভাটা, মৌমিতা
ম্যাচিং সেন্টার আর বাবা বিশ্বকর্মা
মাল্টিপারপাস কোল্ড স্টোরেজ।
তারপরেই লোচনদাস সেতুর টোলট্যাক্স।
নূতনহাট, পীড়তলা পেরিয়ে সার্কাসের তাঁবু পড়েছিল।বৈশাখে ফাঁকা মাঠ
ধু ধু করছে।
পিচরাস্তার পাশে ছোটো
দোকান দেখে নামল সমরেশ।
গীতা ভ্যারাইটি স্টোর্স। প্রোঃ
শুভব্রত লাহা।সদ্য
তরুণ দোকানী।
'খাতা
আছে?'
'লাইনটানা?
না সাদা?'
'লাইনটানাই
দিন।
বেশ বড় দোকান আপনার। এগ্রামেই
বাড়ি? আচ্ছা, শীতকালে এখানে
সার্কাস এসেছিল না?'
'কেঁদুলির
মেলার সময় এসেছিল ।
চলে গেছে। আপনি কোথা
থেকে? কাগজের লোক ?'
'না তো। কাগজের
লোক আসার কথা ছিল?
কিছু গন্ডগোল হয়েছে?'
'ঘোড়ার
কথা বেরোলো যে গত
রোব্বারের আগের রোব্বার!ঐ
সার্কাসেরই কান্ড তো।
পড়েন নি?একটা ঘোড়াকে
এখানে রেখে দিয়ে চলে
গেছে সার্কাস। ঘোড়াটা
অন্ধ।পেপারে
লেখালেখি হল। কেউ
নিয়ে গেল না।
গ্রামেই আছে ।'
'মিস করে গেছি খবরটা
তার মানে।'
'পেপারে
এই প্রথম আমাদের গাঁয়ের
নাম বেরোলো। রিপোর্টার
এসেছিল একজন। অনেকের
সঙ্গে কথা বলল।
আরে, আমাদের পাশের গাঁ
তো ফেমাস- সেই কবে
পেপারে নাম বেরিয়েছিল, আমি
তখন ছোটো….. '
ঠিক এই সময় ভাড়ার
গাড়ির ড্রাইভার সমরেশকে চেঁচিয়ে ডাকে। মাঠের
ভেতরে ছায়া দেখে অপেক্ষা
করবে কি না জানতে
চাইলে সমরেশ গাড়ি ছেড়ে
দেয়। বোলপুরের
বাস ধরে নেবে ফেরার
পথে।
গীতা ভ্যারাইটির সামনে বেশ কজন
ক্রেতা এখন। সমরেশ
গলা তুলে জিগ্যেস করল,
'ঘোড়াটা দেখতে পারি?'
'এই তো বাঁদিক দিয়ে
ঢুকে যান। পুকুরের
পাশ দিয়ে রাস্তা।
সিধে চলে যান।
একটা সাইনবোর্ড দেখবেন। ডাক্তারবাবুর
। ওখানেই ঘোড়াটা
আছে। পথে
কোনো গন্ডগোল নেই। দেখে
আসুন।'
সমরেশ
হাঁটতে থাকে এরপর।
বাঁ হাতে দীঘি, ঘাট
বাঁধানো।এয়ারটেলের
বিজ্ঞাপনের পাশেই সাইনবোর্ডে - "ডাঃ
সিতাংশু পাল,হোমিওপ্যাথ, বি
এইচ এম এস"।
মাটির রাস্তায় উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা
সংকলনের ছেঁড়া পাতা।
বৈশাখের রোদ ঝাঁ ঝাঁ
করে। সেই
খানে একফালি ছায়ায় ঘোড়া
দেখতে পায় সমরেশ।গাছের তলায় বাঁধা,
মুখ নিচের দিকে, লেজ
নাড়ছে।
পাশে মোড়া পেতে বসে
একজন। একটানা
একঘেয়ে সুর কানে আসছে। দূর
থেকে সমরেশের মনে হচ্ছিল, সুর
করে পাঁচালি পড়ছে কেউ।
সমরেশ কাছে গিয়ে দাঁড়ালে
পাঁচালি পড়া থামে।
'ঘোড়া
দেখতে এসেছেন? কাগজের লোক নাকি
স্যার?'
সমরেশ
মাথা নাড়লে খোঁচা খোঁচা
পাকা দাড়ি, মাথায় সামান্য
টাক নিয়ে লোকটি হাসে।
'আমি ডাঃ সিতাংশু পাল।এই
তো আমার বাড়ি।
আপনি আসছেন কোথা থেকে?'
'কলকাতা। এখানে
সার্কাস এসেছিল না, শীতকালে?'
' ঐ সার্কাসেরই ঘোড়া তো।
চোখে দেখে না।
ফেলে পালিয়ে গেছে।
বেইমান বজ্জাতের দল।'
'আপনিই
রেখেছেন ঘোড়াটাকে?'
'আমি রাখার কে বলুন
স্যার? গ্রামের সবাই খেতে দেয়। আমার
উঠোনে থাকে।'
'বাসরাস্তার
ওখানে গীতা ভ্যারাইটি স্টোরে
গিয়েছিলাম। শুনলাম,
আপনাদের পাশের গ্রাম নাকি
বিখ্যাত। কোন
গ্রাম বলুনতো?'
'সে তো আত্মহত্যার গ্রাম। ইছাবট। একসময়
আত্মহত্যা এত বেশি হত
যে কাগজে লেখালেখি হয়। অনেক
লোক এসেছিল, কত ছবি টবি
তুলেছিল।'
'হ্যাঁ
হ্যাঁ। পড়েছি
তো। অনেকদিন
আগে।' সমরেশ
উত্তেজিত হয় সামান্য তারপর
জিগ্যেস করে, 'কি পড়ছিলেন
সুর করে? পাঁচালি? কিসের
পাঁচালি? '
সিতাংশু
মোড়া দেখিয়ে বলে, 'বসুন
না স্যার। জল
খাবেন? পাঁচালি নয়। গল্প
বলছিলাম'।
'ঘোড়াকে
গল্প বলছিলেন? কি গল্প?'
'ওর নাম সুলতান, স্যার। আমারই
লেখা গল্প বলছিলাম।
কলকাতার গঙ্গোত্রী প্রকাশনী-চেনেন? সেখান থেকে
তিনটে বই বের করেছিলাম। নীল
পাহাড়ের হাতছানি, সাগরজলের শব্দ আর জঙ্গলের
গল্প। কেউ
পড়ল না স্যার।
এক কপিও বিক্রি হয়
নি। আর
ছাপাই নি কিছু।
এখানেই ডাক্তারি করি আর গল্প
লিখি। তবে
মানুষকে আর পড়াই না। কুকুরদের
শোনাতাম, গরুদের। তবে
সুলতানের থেকে বড় শ্রোতা
হয় না স্যার।
অন্ধ তো। দেখতে
পায় না। সব
শোনে। এই
যে আপনি বসলেন-মোড়া
টানার শব্দ হল-শুনেছে
। ঐ ডালটা
খসে পড়ল-কান খাড়া
হল, দেখলেন না? সুলতান
আমার কথা বোঝে ।
আসল কথা কি জানেন
স্যার, সুলতানের সঙ্গে একটা কানেকশন
হয়ে গেছে।'
এই সময় দরজা খুলে
এক বৃদ্ধা বেরিয়ে এলে,
সিতাংশু বলে-'আমার মা
বুড়ি। অনেক
বয়স হয়েছে। এখন
আর আমার সঙ্গে নয়,
নাতিদের সঙ্গে কানেকশন।'
সামান্য হাসে সিতাংশু।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
'আজ বিকেলে ঝড় হবে
কিন্তু। সঙ্গে
গাড়ি আছে?'
'আপনার
কাছে ইছাবটের গল্প শুনতে চাই
সিতাংশুবাবু। খুব
কি অসুবিধে হবে যদি থেকে
যাই?'
থেকে গেল সমরেশ।
সকালে বেরোনোর সময় মোবাইল বাড়িতেই
ফেলে এসেছে, ট্যাক্সিতে হাওড়া
যাওয়ার পথে খেয়াল হয়েছিল,
ফেরেনি। এতক্ষণে
সোহিনী হয়ত গেস্ট হাউজে
ফোন করছে মোবাইলে না
পেয়ে। অন্য
কোন টেলিফোন ব্যবহার করার তাগিদ বোধ
করল না সমরেশ।
ইছাবটের গল্প তাকে টানছিল
আর কানেকশনের টেকনিক। এক
চতুর্থাংশ বৈশাখের রোদ বাকিটা বকুলের
ছায়া মাথায় নিয়ে সুলতানের
সামনে, সিতাংশুর পাশে মোড়া নিয়ে
ঠায় বসে রইল সে।
'ইছাবটের
শোভাকর ছিল, আমাদের বন্ধুলোক। তার
দাদা প্রভাকর যখন বিষ খায়,
বিষের সঙ্গে চাট ছিল
আপেল।গ্রামের
কাছেই আলের মাথায় মরে
পড়েছিল,হাতের মুঠির কাছে
ছিল আধখাওয়া আপেল, আর বিষের
কৌটো ছিল পায়ের কাছে। পকেটে
বাহান্ন টাকা ছিল আর
চিরকুট।'
'কি লেখা ছিল?'
'আমি এমনি এমনি মরছি,
কেউ দায়ী নয়।
ভাষার কি বাঁধুনি, খেয়াল
করুন স্যার। মরার
আগে কানেক্ট তো করেছিল, নইলে
এতদিন পরেও মনে থাকে
চিরকুটে কি লেখা ছিল?
এইরকমই এমনি এমনি মরেছিল
আনন্দ। আমাদেরই
বয়সী ছিল। কালীপুজোর
দিন সবাইকে বলল-আমার
নাম আনন্দ, আমি আজ
সাংঘাতিক আনন্দ করব।
তারপর বাজি ফাটিয়ে, হুল্লোড়
করে, ভোররাতে ঘরের সামনের বটগাছে
গলায় দড়ি দিল।'
'কেন এমন হত? জানেন
আপনি?'
'নাঃ কেউ জানে না। তবে
কেমন ছোঁয়াচে মনে হত।
মুরারি ছিল, চক্রবর্তি।
বাইশ বছর বয়সে কলকে
ফুলের বীজ খেল।
তারপরেই শুরু হয়ে গেল। কেমন
যেন অপঘাতের ওপর লোভ।
কত কাগজের লোক এল।ইন্ডিয়া
টুডে এসেছিল। সায়েন্স
কলেজ থেকে টিম এল।
মাটির স্যাম্পল নিল, জলের স্যাম্পল। কিন্তু
কেউ কিছু ধরতেই পারল
না।'
'আর এখন'?
'এখন সব সেরে গেছে। এও
কানেকশন স্যার।কি
জানেন, সেই গ্রাম একদম
বদলে গেছে। চওড়া
বাসরাস্তা দেখলেন না? বাইরের
স্টেটে কাজ করতে যায়
এ গাঁয়ের ছেলে ছোকরা।হাতে
হাতে মোবাইল, ডিশ, টিভি।
ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ হচ্ছে। ছেলেরা,
মেয়েরা কলেজে পড়ছে ।সবাই কানেকটেড স্যার। ছেড়ে
যাবে কেন? তবে আছে
এক আধজন-কানেকশন করতে
পারে নি-তারাই টুকটাক
বিষ খায় এখনও।
ধরুন, বছরে এক আধটা। গেল
বছর অঘ্রাণে না কার্তিকে চরণের
বউ মরেছিল।তার
আগের বছর ঐ অঘ্রাণেই
একজন। কানেকশনটা
বেঁচে থাকার জন্য জরুরী। ঠিক
কি না স্যার?'
প্রবল
ঝড় জলের পরে রাতে
চাঁদ উঠেছিল। সিতাংশু পালের উঠোন চাঁদের
আলোয় ভেসে যাচ্ছিল। উঠোনে,
ধানের মরাইতে, বকুলডালের আগায় জ্যোৎস্না।
সিতাংশুর মার জানলা দিয়ে
চাঁদ আর জোলো হাওয়া
ঢুকছিল। জানলা
বন্ধ করতে উঠে সিতাংশুর
মা সুলতানকে
দেখতে পেল। মাথা
তুলে , চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে,
কেশর ঝাঁকাচ্ছে সুলতান, শরীরে জোছনা পিছলে
পড়ছে। আর
এক মানুষ তার বাঁধন
খুলে দিচ্ছে, তারপর তার পিঠে সওয়ার
হচ্ছে। ঘরের
দোর সামান্য খুলে মুখ বাড়ায়
সিতাংশুর মা। দেখে,
চাঁদের আলো মাখা উঠান,
বকুলগাছ। দেখে
অনন্ত মায়া। অকস্মাৎ
সুলতান তার লুক্কায়িত দুই
পক্ষ বের করে আনে,
বিস্তার করে ,ঝাপটায়।
তারপর উড়ান দেয়।
সিতাংশুর মা দুচোখ ভরে
পক্ষীরাজ দেখে চাঁদের আলোয়। দেখতে
থাকে, পক্ষীরাজ পিঠে মানুষ নিয়ে
ইছাবটের দিকে
উড়ে যাচ্ছে।
সিতাংশুর
মা দোর দেয়।
ঘুমন্ত নাতিদের গায়ের কাঁথা টানে। তারপর
ফিসফিস করে, 'গল্প শুনবি?
পক্ষীরাজের গল্প। সত্যি
গল্প। নিজের
চোখে দেখা। বলি
তোদের? '
Comments
Post a Comment