ইন্দুবালা ও খ্রীষ্টমাসের বৃক্ষ
তিরিশ
বছর পরে আমাদের দেখা
হয়ে গেল হোয়াটস অ্যাপে। আমরা
পঁচিশ জন। অর্ধেক
জীবন পার করে দেখা
হওয়াটা খুব আশ্চর্যের।
বস্তুতঃ , আশ্চর্য শব্দটাই বহুদিন নিরুদ্দিষ্ট আমাদের
দৈনন্দিনে। এতদিন
পরে জীবনে কোনো আশ্চর্য
এলে যা হয়, মেয়ের
মাধ্যমিক, ছেলের এইচ এস,
বরের ব্লাড প্রেসার, শাশুড়ির
ছানিকাটা , নিজেদের ক্রমবর্ধমান মেদকলা আর কোমর
ব্যথাকে ভারচুয়াল জগতের একদম বাইরে
রেখে আমরা রোজ রোজ
কথা বলে যেতে থাকি
অনর্গল। আসলে,
ঊনিশ শো চুরাশির র আষাঢ়ে যখন
আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল,
ভার্চুয়াল শব্দটা আমরা কেউ
জানতাম না। আর
দেখা হবে না ধরে
নিয়ে, শেষ বারের মত
পরস্পরের হাত ধরেছিলাম ক্লাইভ
হাউজের বাস স্টপে কিম্বা
স্কুলের সবুজ গেটের সামনে।
মল রোড আর যশোর
রোডের ক্রসিংয়ে দুশো ঊনিশ বাস
টার্মিনাস, দুটো চায়ের দোকান,
আর অনেক কদমগাছ ছিল
তখন। আষাঢ়ের
শুরুতে , সেই শেষ দেখার
দিনে ,বাস কিম্বা রিক্শায়
উঠে পরস্পরকে হাত নাড়ার সময়
কদম ফুলের গন্ধ পেয়েছিলাম
আমরা কেউ কেউ।
তিরিশ বছর আগে ছেড়ে
এসেছিলাম সেই
সব কদম গাছ, জামরুলতলা,
কাজীপাড়া, ক্লাইভ হাউজ চত্বর। ছেড়ে
এসেছিলাম মৃণালিনী সিনেমার সামনে এল আই
সির বিরাট হলদে বিজ্ঞাপনে
নীল রঙের দুটি হাতের
পাতায় আড়াল করে রাখা
প্রদীপ, জিতেন্দ্রর পোস্টার যা আমরা রোজ
দেখতাম স্কুল যাতায়াতের পথে।
তখনও জানি না, কদিন
পরেই নাগেরবাজার মোড়ে , দুশো
ঊনিশ পিষে
দিয়ে যাবে শৈবালকে।
শৈবাল আমাদের স্কুলে ছোটোবেলায়
পড়েছিল দু এক বছর।একটা
জাহাজের ছবি এঁকে
দিয়েছিল আমাকে ক্লাস ওয়ানে
, বেগুণী আর সবুজ স্কেচপেন
দিয়ে। আমরা
তখনও জানি না , ঊনিশ
শো চুরাশির বর্ষা পেরিয়ে শরৎ
এলে একদিন আমরা নতুন
স্কুল বা কলেজ থেকে
হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরব,
ইন্দিরা গান্ধী নিহত হবেন
আর টেররিজম শব্দটা রোজকার হয়ে
যাবে সেইদিনই। তখনও
জানি না, সে বছরই
শরৎ শেষ হয়ে, হেমন্ত
পেরোতেই ঘটে যাবে ভূপালের
গ্যাস ট্রাজেডি, ক্লাস ইলেভেনের কেমিস্ট্রি
পড়তে শুরু করেই মিথাইল
আইসো সায়ানেটের স্ট্রাকচার আর ফরমুলা জেনে
যাব এক রাতে, যা
আমাদের সিলেবাসের বাইরে ছিল। তিরিশ
বছর পর ভারচুয়ালি
দেখা হলে, আমরা এই
সব ফিরিয়ে আনতে থাকি। তিরিশ
বছর মানে দশ হাজার
নশো পঞ্চাশ দিন আর
আমরা পঁচিশ জন।
দশ হাজার নশো পঞ্চাশকে
পঁচিশ দিয়ে ভাগ দিলে
মিলে যায়, ভাগশেষ থাকে
না। ফলে
এতদিনের কথা দিব্যি
ভাগাভাগি হয়ে যায়, এ
ওকে কথা জোগাতে থাকি। মহুয়া
যদি, ঊনিশ শো চুরাশির
র একত্রিশে শে অক্টোবরের সকালের
কথা বলে, চৈতালী বলবে
সেই বিকেলে হ্বেঁটে ফেরার
গল্প, মধুমিতা ক্লাস টেনের হযবরলর কথা
বলবে , সঙ্ঘমিত্রা ভাস্কর গাঙ্গুলীর কথা
বলতে বলতে হাসবে খুব,
কেয়া পলি বালার ছবি
পোস্ট করে বলবে-কে
বলত? মৈত্রেয়ী আর আমি কৌশিকের
কথা বলব, সেই সঙ্গে,
সৈকত, সন্দীপ, জয়ন্ত, রজত আর শায়েস্তা খাঁর
গল্প। কাকলি
স্কুলের গান শেখানোর কথা
বললে, সঙ্গীতা সদা
থাকো আনন্দে গাইবে, আর
মহালয়ার সকালে দেবানন্দা সাউন্ড
ক্লিপ পাঠাবে-হৃদয়ে ছিলে
জেগে, দেখি আজ শরত
মেঘে।
কস্তুরী, মোনালিসা, পাপিয়া , রূপালী মূলতঃ শ্রোতা-দীপাবলী এলে রঙ্গোলির ছবি
পোস্ট করে চুপচাপ হয়ে
যায়।
সুমনা, শ্রাবন্তী আমাদের ফ্যাশন গুরু আর শ্রীরূপা,
নন্দিনী, শর্মিষ্ঠা ফিরিয়ে আনতে থাকে
সেভেন এ, এইট বি
র দিন , দেবপ্রিয়া অজস্র
জোক শেয়ার করে-খুব
হাসি আমরা;ববির ভালো
নাম যে দেবযানী তিরিশ
বছর পরে, সে কথা
পুনরাবিষ্কৃত হয়। হোয়াটস
অ্যাপ গ্রুপের বাইরে রয়ে গেল
যারা, তাদের খোঁজ শুরু
করি। আমরা
ফিরিয়ে আনি সাত কল,
জামরুল গাছ, এক্কা দোক্কা
খেলা,নিভাদি, পি সেনদি, ধীরাদি,দ্যুতিদিকে।
মিস মামেন আর বকুলদিকে।
শৈবালকে ফিরিয়ে আনি।
প্রতীতি আর সোমা চন্দ্রকেও।
দশ
হাজার নশো পঞ্চাশ বড়
সংখ্যা, অযুতের ঘরে এক
লিখতে হয়। স্কুলের
কথা শেষ হয়ে গেলে,
আমাদের চাকরির
কথা, সংসারের
কথা শুরু হয় , আর
এইখানে আমরা পরস্পরের অজানা। আমরা
নিজেদের নতুন নাম দিতে
থাকি এই সময়।
এ যেন অন্ধকারে ভার্চুয়ালি
হাত ধরা। আমাকে
ওরা ডাকে -ইন্দুবালা।
ইন্দ্রাণী
দত্ত রায় আর ইন্দুবালা
আলাদা লোক । ইন্দ্রাণী
কাঠখোট্টা , প্র্যাকটিকাল। অর্ধেক
জীবন পেরিয়ে এসে নিশ্চিত
জানে , সব সম্পর্কের একটা
একস্পায়ারি ডেট থাকে।
অথচ ইন্দুবালা আবেগপ্রবণ। নিতান্ত
প্রাত্যহিকতায় অলীক মুহূর্ত খুঁজে
পায় । যেমন-'কোন্ পুরাতন প্রাণের
টানে' শোনার সময় ইন্দ্রাণীর
মাথায় থাকে -এ
গান বর্ষার; মাটি, পুব বাতাস,
মল্লার গান, প্লাবন, শ্রাবণ
সমস্ত শব্দ একের পর
এক আসবে যাবে- গান
শোনার সময় সে আঙুলের
টোকা দেয় আলতো করে,
তাল রাখে, ব্যাস।
আর ইন্দুবালা জানে এ গানে
একটা চমক আছে- যাবতীয়
বর্ষা শব্দের পরে আসবে
সেই অলীক চমক-- 'লাগল যে দোল/
বনের মাঝে লাগল যে
দোল'-সাংঘাতিক একটা বদল হয়ে
যাবে গোটা গানে-কোনদিন
পুরোনো হবে না আর।
ইন্দ্রাণী গতানুগতিক
। রাউন্ড অ্যাবাউটে
র ডানদিকে টার্ন নিয়ে রাস্তায় ওঠে, উঁচু রাস্তা-শুধু এটুকুই মাথায়
রেখে হাল্কা
দম নিয়ে পা রাখে
খাড়াই পথে, অথচ ইন্দুবালা
এইখানে সমুদ্রগন্ধ
পায়, শুনতে পায় সমুদ্রগর্জন;
ইন্দুবালার খুব মনে হয়
এই খাড়াই পেরোলেই সামনে
সমুদ্দুর অথচ এই সময়
ইন্দ্রাণী স্পীড লিমিট ছাড়া
আর কিছু ভাবে না।
বহুকাল
কাগজে আঁচড় দিতে পারে
না ইন্দ্রাণী - শাদা কাগজে কলম ছোঁয়ালে, লেখার
কাগজ শুষে নেয়
কলমের কালি। একটা
ছোট্টো গাঢ় নীল বিন্দু
প্রথমে । তারপর
বড় হ'তে হ'তে সমস্ত কাগজটাই
নীল হয়ে যায় একটা
সময়। ব্যস্ততা,
বিষাদ, ক্লান্তিতে দৈনন্দিনের
অ্যাকোয়ারিয়ামে ঢুকে গিয়ে, ক্লোরিন
জলে সাঁতার কাটে ইন্দ্রাণী। অথচ
ইন্দুবালার পিঠে শ্যাওলা, গভীর
দীঘিতে বসবাস। ইন্দুবালা
জানে, কলমের কালি শুকোয়
না।
এই
মুহূর্তে, ক্যালেন্ডারে
মধ্য ডিসেম্বর, আসন্ন খ্রীষ্টদিন।
শপিং মল যথাবিহিত সেজেছে-লাল সোনালী ফিতের
প্রজাপতি ফাঁস, ক্যারলের সুর,
বিক্রেতার সহাস্য উইশ।
হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ আসে
- নতুন বছরের ৩রা জানুয়ারি স্কুলের
পুনর্মিলন উৎসব। ক্রিসমাস
ট্রীর নিচে ইন্দ্রাণী আর
ইন্দুবালা মুখোমুখি হয় তখন।
ইন্দ্রাণী
বলে,' অর্থাৎ , আশ্চর্য শব্দটা আবার উধাও
হবে, বুঝতে পারছ, ইন্দু?
কার্নিভালের আলোয় ভার্চুয়ালিটির কুয়াশা
ভ্যানিশ। ইন্দুবালা
কোথাও থাকবেই না।আগেই বলেছিলাম, সব
কিছুরই এক্সপায়ারি ডেট আছে।'
ইন্দুবালা
বলে-'কি মুশকিল! এত
ভাবার কী আছে? আলাদা
না থেকে ইন্দ্রাণী আর
ইন্দুবালা যদি এক হয়ে
যায়, একস্পায়ারি ডেটের ল্যাটাই চুকে
যায়। সেটা
ভেবে দেখেছ কখনও?'
- ' ধ্যাৎ, সে
আবার হয় না কি?'
ইন্দুবালা
হাসল-' আলাদা যদি হওয়া
যায়, এক হওয়া যাবে
না কেন? দাঁড়াও জাদুকরকে
ডাকি'।
এই
বলে, ইন্দুবালা জাদুকরকে ক্রিসমাস
ট্রীর মাথায় বেথেলহেমের তারাটি
পরিয়ে দিতে বলল।
আসলে, ইন্দ্রাণীর মনে এলো ক্রিসমাস ট্রী শব্দটি।
যদিও, ইন্দুবালা 'খ্রীষ্টমাসের বৃক্ষ'
ই বলছিল। জাদুকর
দীর্ঘদেহী, কাঁধ অবধি লম্বা
চুল, পরণে জোব্বা।
জাদুকরদের মুখ দেখা যায়
না। কল্পনা
করে নিতে হয় শুধু।
ডাকতেই, এসে দাঁড়ালো ।
এবারে
বাকিটা ম্যাজিক।
বেথেলহেমের
তারা খ্রীষ্টমাস
বৃক্ষের শীর্ষ স্পর্শ করতেই
সহস্র বেলের জিঙ্গল প্রথমে
, তারপর বৃক্ষশাখায়
ঝোলানো কৃস্টালের আলো ঠিকরোতে লাগল
সর্বত্র। সেই
সব নানা রঙের আলো কখনও
মিলে মিশে এক
হ'ল, কখনও
আলাদা তারপর সিনেমার
ছবির মত দেখতে পেলাম,
যশোর রোড, মাটিতে বসে
যাওয়া টায়ারের দাগে বর্ষার জমা
জল, ভাঙা সাইকেল, বেগুণি
কালিতে আঁকা জাহাজ।
আমি ক্রমশঃ ঢুকে
যেতে লাগলাম সিনেমার মধ্যে। দেখলাম,
পরিত্যক্ত বাস্কেটবল কোর্ট, নিষ্পত্র গাছ,
পুরোনো চ্যাপেল। দেখলাম
, পাখিদের ডানা কালো তেলে
ভারি, রক্তে ভিজে মানুষ শুয়ে
আছে বোরিভিলি স্টেশন চত্বরে, জাফনায়,
ইরাকে, লেবাননে। বেসলান, পেশোয়ার, আফগানিস্থানে শিশুর শব। দেখলাম,
হাওয়ায় ভেসে ভেসে রাস্তা
পেরোচ্ছে হলুদ বেলুন, চরাচর ভেসে যাওয়া
জ্যোৎস্নায় ফলন্ত লেবুগাছের পাশে ফুটপাথে
ডাঁই করা থাকছে পুরোনো
আসবাব, ল্যাম্পশেড, কীটদষ্ট বই-যেন কেউ চলে
যাচ্ছে এই জ্যোৎস্নায়।
তারপর দেখলাম প্রজ্বলিত মোমে
ঘেরা কাচঘর। দরজা
বন্ধ।
জানলায় উঁকি দিয়ে দেখি,
ভিতরে বরফ ঢাকা
বাগান, নিষ্পত্র, তুষারাবৃত বৃক্ষ। সেই
বাগানে, এক বালকের
মুখোমুখি বিশাল
দেহী । তরবারি
আস্ফালন করে সে বলছে,'Who
hath dared to wound thee?' Tell me, that I may take my big sword and slay him.'
বালক বলছে-'
Nay, these are the wounds of love'. বলছে
আর হাসছে। তার
কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত
হয়ে চলেছে বাগানে।
আমি শুনতে পাচ্ছি , 'nay , nay , nay'. শুনতে পাচ্ছি, ' এলি
এলি লামা শবক্তানি।
হে পিতঃ এদের ক্ষমা
কর, এরা জানে না
এরা কি করছে।'
আমি দেখছি, তার হাসির
ছোটো ছোটো লাল সোনালী
টুকরো রিক্ত
বাগানে ঝলমল করে জ্বলছে।
খ্রীষ্টমাস
বৃক্ষের শীর্ষে তারাটি লাগানো
সম্পন্ন। সুন্দরের
কোনো একসপায়ারি
ডেট হয় না-এখন
আমি জানি ।
Thank you indranidi....expiry date asole chawar bishoy..chaile achhe na chaile nei....manbena bolle ami manbona.... amon lekha lekhe keu?! Bhalo theko
ReplyDeleteThank u Anasua. uttar dite deri haye gela.
Deleteপড়েছি, সেটাই জানিয়ে গেলাম।
ReplyDeleteএমন অদ্ভুত লেখা ......
:) kee kaanDa!! thank u.
Deleteচিরন্তন দ্বৈরথ ---
ReplyDeleteThank you, Debjani.
Delete